৩
নাওডুবি নামটা শুনতে অদ্ভুত। ভাল লাগে আবার একই সঙ্গে গা ছমছম করে। নাম শুনে শিরীষ অবাক হয়ে বলেছিল, “গ্রামের নাম নাওডুবি! মানে কী?”
বড়মামা বললেন, “জানি না। গাঁয়ের নামের যে সবসময় কোনও মানে থাকে, এমনটা তো নয়। লোকের মুখে মুখে হয়ে যায়। আমি একটা গ্রামের নাম জানতাম হাতিমারি। কস্মিনকালেও সেখানে হাতি আসেনি, মারার প্রশ্নই ওঠে না। তারপরেও নাম হয়েছে হাতিমারি!”
শিরীষ তাও বলেছিল, “নিশ্চয়ই মানে আছে কিছু। নিয়ারেস্ট রেলস্টেশন কী? সেও কি নাওডুবি?”
বড়মামা বললেন, “রেলস্টেশন ধারেকাছে নেই। অনেকটা ঘুরে যেতে হয়। সেই সাঁইথিয়া। তবে কলকাতা থেকে বাসেও যাওয়া যাবে। হাওড়া থেকে দিনে একটা বাস ছাড়ে। সেও তোমার ওই সবেরগঞ্জ পর্যন্ত। ওখানেই তোমার ব্লক অফিস। তারপরে হয় ট্যাক্টর ধরো, নয় ইঞ্জিন লাগানো ভ্যান রিকশা। ফটফট করতে করতে আর লাফাতে লাফাতে রওনা হও। এখন অবশ্য একটা-দুটো করে ফোর হুইলার টুকছে, তবে সেও ওই চারপাশ ঢাকা ভ্যান। তাতে মানুষও যাচ্ছে, ছাগল-ভেড়া-মুরগিও যাচ্ছে, আবার সবজিও যাচ্ছে। নিজের গাড়ি থাকলে টানা যাওয়া যায়, যদিও রাস্তা অতি খারাপ।”
শিরীষ জ্বলজ্বলে চোখে বলল, “বাঃ, সুন্দর তো! একেবারে ফার ফ্রম দ্য ম্যাডিং ক্রাউড।”
বড়মামা হেসে বললেন, “শুনতে ভাল লাগে। গেলে বোঝা যায় ফার ফ্রম দ্য ম্যাডিং ক্রাউড কতখানি ঝামেলা। অজ পাড়াগাঁ বলতে যা বোঝা যায়, অবস্থা তার চেয়েও খারাপ। পাড়াগাঁ-ই বা কোথায়? আমি যে জায়গার কথা বলছি, সেখানে শুধু জমির পর জমি পড়ে আছে। লোকজন ঘরবাড়ি কিছু নেই। কিছু জমিতে চাষবাস হয়, কিছু পড়ে রয়েছে। মূল গ্রামটা বেশ খানিকটা দূরে।”
শিরীষ বলল, “চাষবাস হয় না কেন?”
“হয় মালিকানার ঝামেলায় পড়ে রয়েছে, নয়তো চাষের অযোগ্য। ওখানকার জমি রুক্ষ, মাটিতে রস কম, কোনও কোনও জায়গায় একটু পাথরও আছে। বেদখল করেও লাভ হয় না। চাষের মতো করে তুলতে খরচ আছে। সেই খরচের পর কত আর লাভ হবে? সার, জল, মঞ্জুরের খরচ বেড়েছে। জমি বাতাতেই প্রথমদিকে বিঘে প্রতি ন’-দশ হাজার টাকা ঢালতে হয়। চাষবাস ঠিকমতো হলে মাসে টেনেটুনে তিন হাজার টাকার মতো বাড়তি থাকে। ওটাই আয়। তাও সব সময় থাকে না। ধানে পোকা, সবজিতে মড়ক, ঝড়-জল হলে তো গেল।”
শিরীষ অবাক গলায় বলেছিল, “বাপ রে! বড়মামা, চাষ নিয়ে তুমি এত জানো!”
বড়মামা হেসে বললেন, “এটাও একটা ইঞ্জিনিয়ারিং। তোরটা কম্পিউটারের, এটা চাষবাসের।”
সোমদত্তা বসেছিল উলটোদিকের সোফায়। সে চোখ বড় করে বলল, “জমি বাতানোটা কী?”
বড়মামা বললেন, “জমিকে চাষের উপযুক্ত করতে গেলে ঠিকঠাক করতে হবে না? ওকেই বাতানো বলে। ভাল করে জল ঢেলে, ট্রাক্টর দিয়ে, লাঙল দিয়ে কুপিয়ে ওলটপালট করতে হয় বারবার। একে বলে ফাল চাষ। ট্র্যাক্টরে একধরনের ফাল থাকে। আর এইসব রুক্ষ জমিতে তো অনেক কোপানো লাগে। এর জন্য লোক পাওয়া যায়। জমির আশপাশের নদী, পুকুর থেকে জল আনার ব্যবস্থা করতে হয়।”
সোমদত্তা বলল, “এরকম একটা জায়গায় দাদুর জমি ছিল!”
শিরীষও অবাক হওয়া গলায় বলল, “কই আমি তো কিছু জানতাম না। মা-ও কখনও বলেনি কিছু। তুমি কোথা থেকে জানলে বড়মামা?”
বড়মামা হেসে বললেন, “আমিও কি জানতাম? কাগজপত্র ঘাঁটতে গিয়ে পেলাম। দাগ, খতিয়ান সব দিয়ে রেজিষ্ট্রি অফিসের পাকা দলিল। বাবা যে কেন এরকম একটা প্রপার্টি করেছিলেন বুঝতে সময় লেগেছিল। জামশেদপুরের বাড়ির সেই দৈত্যের মতো আলমারিটার কথা মনে আছে? বাবার স্টাডিতে ছিল। একেবারে একটা দেওয়াল জুড়ে।”
পুরনোদিনের কথা শুনতে ভাল লাগে। বিশেষ করে বয়স বাড়লে। শিরীষ উৎসাহ নিয়ে বলল, “সেগুন কাঠের ছিল না? কালো বার্নিশ করা? একেবারে ঘরের সিলিং পর্যন্ত উঁচু। বাড়ির যাবতীয় দরকারি অদরকারি কাগজপত্র তাকে রাখা থাকত। মনে আছে আলমারির দরজার বাইরে গোল কাঠের ছিটকিনি ছিল। আমি সেই ছিটকিনি নিয়ে খেলতাম। মা বকত, দাদু আশকারা দিত। আলমারিটা আছে এখনও? বড়মামিমা মারা যেতে গিয়েছিলাম শেষবার। খেয়াল করিনি।”
বড়মামা বললেন, “আলমারিটা থেকেই কাগজ পেলাম। নাওডুবির দশ বিঘে জমি নিয়ে বাবার হাতে লেখা উইল। সঙ্গে ইচ্ছাপত্র।”
সোমদত্তা বলল, “উইল! কী লেখা আছে? ইচ্ছাপত্রই বা কী?”
সোমদত্তার প্রশ্নের জবাবে বড়মামা হেসে বললেন, “বাবার উইলে কী রয়েছে সেটা জানার জন্যই তো শিরীষবাবাজিকে খুঁজে বের করেছি।”
শিরীষ ভুরু কোঁচকাল। অস্ফুটে বলল, “আমাকে খুঁজে পেয়েছ!”
বড়মামা এ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললেন, “জায়গাটা দুর্গম, তবে গিয়ে পড়লে ভাল লাগবে। অন্তত আমার তো লেগেছে।”
শিরীষ বলল, “তুমি গিয়েছিলে নাকি?”
বড়মামা বললেন, “গিয়েছিলাম বই কী। বাবার কাণ্ড দেখতে গিয়েছিলাম। একটা ইঞ্জিনিয়ার মানুষ, চিরকাল মেশিন আর লোহালক্কড় নিয়ে থেকেছে, সে একটা দুর্গম জায়গায় সত্যি জমি কিনেছে কি না দেখতে যাব না? এই বয়সে এসে বুঝেছি, কাগজপত্রের সত্যির সঙ্গে জীবনের সত্যির ফারাক থাকে।”
শিরীষ বলল, “কী দেখলে? ফারাক পেলে?”
“না, বরং বাবা কম লিখেছে।”
বড়মামার সঙ্গে দেখা হয়েছিল একবছর হয়ে গেল? নাকি একটু কম হবে? একটু কমই হবে। একদিন অফিসের অপারেটর ফোন তুলে বলল, “স্যার, সাম মহীতোষ চ্যাটার্জি ওয়ান্টস টু টক…”
শিরীষ একটু থমকে গিয়ে বলেছিল, “মহীতোষ চ্যাটার্জি!”
ওই মুহূর্তখানেকই লেগেছিল। বড়মামাকে মনে পড়ে গেল। এতদিন পরে! কত বছর পর? মনে পড়ছে না। তিন? চার? নাকি আর একটু বেশি? সব পরিবারেই আত্মীয়দের মধ্যে কেউ না কেউ থাকে যে হারিয়ে যায়। সবসময় যে শরীরে হারিয়ে যায় এমন নয়, মন থেকেও হারিয়ে যায়। শিরীষের বেলায় গোটা মামাবাড়িটাই হারিয়ে গেছে যেন।
শিরীষ ফোন চেপে ধরে প্রায় চিৎকার করে বলে ফেলল, “বড়মামা, কোথা থেকে? জামশেদপুর?”
অফিসে এরকম উচ্ছ্বসিত গলায় শিরীষ কথা বলে না। বড় চাকরির কতগুলো নিয়ম আছে। বড় হওয়ারও নিয়ম থাকে। সেখানে আবেগের কোনও জায়গা নেই। মনে করতে হবে, আবেগ হল মানবশরীরের অ্যাপেন্ডিক্সের মতো। অহেতুক, অর্থহীন একটি লুকিয়ে থাকা লেজ মাত্র। মানুষ সভ্য হয়েছে, তার আর লেজের দরকার নেই। ঘাপটি মেরে থাকলে থাকুক। জ্বালালে বাদ দিয়ে দাও। তারপরেও অবশিষ্ট যদি কিছু থেকে থাকে, তাকে লুকিয়ে রাখতে হয়। এত বছর পর বড়মামার ফোন পেয়ে শিরীষ আবেগকে লুকোতে পারেনি।
বড়মামা বললেন, “কলকাতায় এসেছি।”
শিরীষ উত্তেজনা সামলে বলল, “এতদিন কোথায় ছিলে? একেবারে উধাও হয়ে গিয়েছ যে। তোমার মোবাইল নম্বর জানি না। কয়েকবার জামশেদপুরের বাড়ির ল্যান্ডলাইনে ফোন করেছিলাম। বেজে গেল। সেও তো অনেকদিন হয়ে গিয়েছে।”
বড়মামা হেসে বললেন, “মোবাইলে তো পাবি না। মোবাইল ফোন একবার হারিয়ে যাওয়ার পর আর কিনিনি। ওই জিনিস আমার দরকার হয় না। কার সঙ্গেই বা কথা বলব? বারো বছর আগে তোর মামিমা মারা যাওয়ার পর তো কথা বলার লোকই চলে গেল। তোর মা গিয়েছে আরও আগে। আর তোর ছোটমামা সেই যে লেখাপড়ার সময় দেশ ছেড়েছে আর যোগাযোগ রাখেনি। তোর মামাবাড়ি বলে তো আর কিছু নেই শিরীষ। জামশেদপুরের বাড়িতে তালাচাবি দিয়ে দেশ দেখে বেড়াই। ঘরে মন টেকে না, একা লাগে। বাতের ব্যথা, চোখের ছানি, সুগার-প্রেশার ভুলে থাকতে বেড়ানোর মতো ওষুধ নেই।”
শিরীষ খানিকটা গলার স্বর নামিয়ে বলল, “আমরা তো রয়েছি বড়মামা। তোমাকে পাই না।”
বড়মামা আবার হাসলেন, “তোরা কতটা আছিস জানি না, তবে আমি আর নেই। তোর সঙ্গে তিনবছর পর কথা হচ্ছে। ফোন নম্বর হারিয়ে ফেলেছিলাম। বলেছিলি বাড়িও বদলেছিস। সে ঠিকানাও আর নেওয়া হয়নি। এই বুড়ো বয়সেও যে হেঁটে চলে ঘুরতে পারছি এই যথেষ্ট। মিরাকল বলতে পারিস। কতদিন পারব জানি না,” বলে আবার টেলিফোনে একচোট হাসলেন মহীতোষ চ্যাটার্জি। বললেন, “তোর ফোন নম্বর মনে না থাকলেও, তোর অফিসের নামটা মনে ছিল। সেই সূত্র ধরে অনেক কষ্টে নম্বর জোগাড় করেছি। তোর সঙ্গে জরুরি দরকার শিরীষ। খুব জরুরি।”
শিরীষ অবাক হয়েছিল, বড়মামার কী দরকার! এই মানুষ কোনওদিন দরকারে যোগাযোগ করেনি। মায়ের মতো স্বভাব। কিছু লাগলেও চাইবেন না। বলবেন “ও ঠিক হয়ে যাবে।” অসুখ করলেও জানাননি কখনও। হাসপাতালে ভরতি হলেও নয়। মামিমা মারা যাওয়ার পর নিজেকে সবকিছু থেকে সরিয়েও নিয়েছেন। অথচ জামশেদপুরে মামাবাড়িতে একটা সময় খুব যাতায়াত ছিল শিরীষের। দাদুকে পেয়েছিল দশ-এগারো বছর পর্যন্ত। দিদিমাকে দেখেনি। মায়ের বিয়ের আগেই মারা যায়। আড়াই মিনিটের হার্ট অ্যাটাক। সেই সময় ছোটমামা লেখাপড়া করতে বাইরে চলে যায়, আর ফেরেনি। দাদু মারা যাওয়ার সময় এসেছিল একবার। সেই শেষ। তারপর আর বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ রাখেনি। মারা যাওয়ার খবরও দেওয়া যায়নি। শিরীষ আবছা শুনেছিল, ছোটমামা লেখাপড়ায় ভাল ছাত্র হলেও, এখানে কোনও একটা বড় অন্যায় করেছিল। সেই কারণেই পালিয়েছে। দেশে ফেরে না। অন্যায়টা কী, বিস্তারিত জানে না শিরীষ। শুধু জানে, মেয়েঘটিত কোনও ব্যাপার। মেয়েটি কে, তাও জানে না। জানতে ইচ্ছেও করেনি।
বড়মামা এসেছিলেন দু’দিনের জন্য। উঠেছিলেন হাওড়া স্টেশনের কাছে এক হোটেলে। জামশেদপুরের বাড়িটা বিক্রি করে দিচ্ছেন। একজনের সঙ্গে কথাবার্তা পাকা হয়ে গিয়েছে। বাঙালি ব্যবসায়ী। কাপড়ের ব্যাবসা করে। জামশেদপুরে বড় আউটলেট আছে। সেটাকে কেন্দ্র করে আশপাশে আরও কয়েকটা আউটলেট খুলতে চান। জামশেদপুরে পাকাপাকিভাবে থাকতে হবে। সেই কারণেই বাড়ি নেওয়া। বড়মামার সঙ্গে একটাই শর্ত হয়েছে, বাড়ির পিছনের নিমগাছটা কাটা চলবে না। দাদুর হাতে লাগানো। যে বাড়ি কিনছে, সে নাকি শর্ত মেনে নিয়েছে। বাড়ি বিক্রির কাজ সেরে শিরীষকে ফোন করেছিলেন। হাতে সময় নেই। পরদিনই উত্তর ভারত ভ্রমণে চলে যাবেন। হোটেলে গাড়ি পাঠিয়ে বড়মামাকে বাড়িতে নিয়ে এল। সোমদত্তা যত্ন করল। বয়স বেশি হলে কী হবে, মহীতোষ চ্যাটার্জির শরীর এখনও শক্তপোক্ত। মজার কথা হল, এখনও রঙিন জামা পরেন। ডিনারে একবাটি দুধে ফেলে ছ’টা রুটি খেয়ে ফেললেন অনায়াসে। খাওয়া-দাওয়ার পর ড্রইংরুমে সোফায় বসে কথা শুরু হয়।
“বড়মামা, বাড়ি বেচে দিচ্ছ কেন?”
বড়মামা হেসে বললেন, “পথে পথেই তো থাকি, বাড়ি রেখে কী হবে? এবার পাকাপাকিভাবে পথেই থাকব।”
সোমদত্তা খুব বেশিবার যে এই মানুষটাকে দেখেছে এমন নয়। এক-আধবার। তবে স্বামীর কাছে গল্প শুনেছে। সে অবাক হয়ে বলল, “সেকী! পথে থাকবেন কেন? কলকাতায় একটা ছোটখাটো ফ্ল্যাট নিয়ে নিন। আমাদের কাছে থাকবেন। আমরা আপনাকে দেখব।”
বড়মামা চোখ নাচিয়ে বললেন, “খেপেছ? একবার সংসারের মায়া ত্যাগ করেছি, আর ওই জেলখানায় ফিরি? আসলে কী জানো ভাগনেবউ, দেশ ঘুরতে তো টাকা লাগে। বাড়ি বিক্রির কিছু টাকা রেখে দেব হাসপাতালে, চিকিৎসা যাতে হয়। কিছু টাকা থাকবে শ্মশানে, মরে গেলে শরীরটার তো একটা সুরাহা করতে হবে। ছেলেপুলে নেই, কী হবে বাড়ি রেখে?”
শিরীষ বলল, “ছিছি, এসব কী বলছ? তবে সত্যি যদি বাড়িতে মন না থাকে, বাড়ি বিক্রি করে দেওয়াই ভাল। ফেলে রেখে কী হবে? বোঝা ছাড়া কিছু নয়। তবে তুমি চাইলে আমার এখানে এসে উঠতে পারো।”
বড়মামা বললেন, “এক বাড়ি ছেড়ে আর এক বাড়িতে! মোটেই নয় বাপু। রাখো আমার কথা, তোদের ছোটমামার একটা খোঁজ পেয়েছিলাম।”
শিরীষ উত্তেজিত হয়ে বলল, “তাই নাকি! ছোটমামা কেমন আছে?”
বড়মামা বললেন, “খুব ভাল আছে। সে এখন ইটালিতে মানারোলা নামের এক শহরে থাকে। এই শহরের নাম শুনেছিস নিশ্চয়ই।”
শিরীষ বলল, “সমুদ্রের ধারের চমৎকার একটা শহর। ছবির মতো। বলা হয়, পৃথিবীর সেরা সুন্দর শহরের একটা। রঙিন সব বাড়ি। শুনেছি, শহরের ভিতর গাড়ি চলা নিষিদ্ধ। নো হর্ন, নো পলিউশন। শাট্ল বাস আছে। নয়তো পায়ে হাঁটো। জানি না, এখন কী নিয়ম। তবে শহরটা ওয়াইনের জন্যও বিখ্যাত।”
বড়মামা বললেন, “ওই ওয়াইনের কোম্পানিতে কাজ করছে পরিতোষ। ওদেশেরই একটি মেয়েকে বিয়ে করেছে। ওর সঙ্গে কথা হয়নি, ঠিকানা জোগাড় করে চিঠি পাঠিয়েছিলাম। বাড়ি বিক্রির ব্যাপারে। তিনি দয়া করে এক লাইনে উত্তর পাঠিয়েছেন, বাড়ি বা দেশে ফেরার ব্যাপারে তার কোনও উৎসাহ নেই। আমার যা খুশি করতে পারি। গুণধর ভাই আমার।”
সোমদত্তা ঝলমলে মুখে করে বলল, “ইস্, আমার ওইসব দেশে থাকতে খুব ইচ্ছে করে।”
বড়মামা বললেন, “যাও না। সমস্যা কোথায়?”
সোমদত্তা রাগ রাগ মুখ করে বলল, “বড়মামা, আপানার ভাগনেকে একটু বুঝিয়ে বলে যান তো। ওকে অফিস থেকে কতবার যে ফরেনে যাওয়ার অফার দিয়েছে…ও রাজি হয় না…সামনে তো একটা খুব বড় চান্স আসছে। এদেশে থেকে কী হবে? কী আছে এখানে?”
বড়মামা কিছু বলতে গিয়ে একটু থমকে গিয়েছিলেন। তারপর নিচু গলায় বললেন, “কী আছে দেখার জন্যই তো এই বুড়ো বয়সে লোটাকম্বল বেঁধেছি। যেদিন গাড়ির অ্যাক্সেল ভেঙে মুখ থুবড়ে পড়ব সেদিন সোজা ওল্ডএজ হোম। লছমনঝুলার কাছে একটা চমৎকার হোম রয়েছে, সেখানে কথাবার্তা বলে রেখেছি। বাড়ি বিক্রি হয়ে গেলে কিছুটা টাকা দিয়ে রাখব।”
বড়মামা চিরকালই হাসিখুশি ধরনের মানুষ। জীবনে নানারকম ঝড় গিয়েছে, তারপরেও মুখ থেকে হাসি মোছেনি। কিছু মানুষ এরকমই হয়। বয়সও অনেক হল। এই বয়সে গড়পড়তা বাঙালি অসুখবিসুখে কাবু হয়ে মৃত্যুর কথা চিন্তা করে। বড়মামা নতুন করে জীবন শুরু করেছেন।
সেদিন বড়মামা ‘জরুরি’ কথাটা বলেছিলেন, আর-একটু রাতের দিকে।
“বাড়িটা বিক্রি করে দেব বলে কাগজপত্র গোছগাছ করছিলাম। আর তখনই দৈত্যাকৃতি সেই আলমারির একেবারে উপরের তাকে পোকায় কাটা একটা ফাইল মিলল। দড়ি দিয়ে বাঁধা। দড়ির অবস্থাও অতি শোচনীয়। আবর্জনা ভেবে ফাইলটা ধরে ফেলে দিতেই যাচ্ছিলাম। ওপরে দেখি বাবার হাতে লেখা, ‘নাওডুবি’। থমকে গেলাম, কেমন যেন লাগল। নাওডুবি আবার কী! কোনও নাটক-টাটক নাকি? বাবা কি নাটকও লিখতেন! কৌতূহলে ফাইল খুলতে একটা জমির দলিল পেলাম। সবেরগঞ্জের কাছে, নাওডুবি গ্রামে ন’ বিঘে ছ’ ছটাক জমি কেনা হয়েছে। তারিখ যা দেওয়া রয়েছে তা থেকেই বুঝতে পারলাম, বাবার মৃত্যুর বছর দু’য়েক আগের ব্যাপার। জমি রেজিস্ট্রি শিবতোষ চ্যাটার্জি, মানে তোমার দাদুর নামে। কিন্তু তোমাকেও জড়ানো আছে শিরীষ।”
বড়মামা দম নিতে থামলে শিরীষ বিস্ফারিত চোখে বলল, “কী বলছ! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। দাদু জমি কিনে আমাকে জড়িয়ে দিয়েছেন?”
বড়মামা হাত তুলে বললেন, “দাঁড়াও, আগে গল্পটা শেষ করি। তোমার জানা নেই, জানার কথাও নয়, তোমার দাদু মানুষটি একজন গোছানো মানুষ ছিলেন। ওই জীর্ণ ফাইলের নীচে একটা কাগজ পেয়ে গেলাম। বাবারই হাতে লেখা। একটা নোটের মতো। সেখানে লেখা— ‘খুব ইচ্ছে করে এই শহুরে বানানো জীবন ছেড়ে, দৌড়ঝাঁপের জীবন শেষ করে কোনও শান্ত জায়গায় গিয়ে থাকি। বড় মেশিন, বয়লারের আগুন নিয়ে অনেক তো ছোটাছুটি হল, এবার মাটির কাছে যাই। এই ভাবনা একেবারেই বোকার ভাবনা, আজগুবি ভাবনা। তারপরেও একটা বোকার কাণ্ড করেছি। খবর পেলাম সস্তায় জমি পাওয়া যাচ্ছে। ভার্জিন ল্যান্ড। জায়গাটার নাম বড় অদ্ভুত, নাওডুবি। লোভ সামলাতে পারলাম না। লোভ না ইচ্ছে জানি না। হুট করে খানিকটা জমি কিনে ফেলেছি। ইচ্ছে, বাকি জীবনটা চাষ করে কাটাব।”
আবার থামলেন বড়মামা। এবার পাশে রাখা চামড়ার সুটকেস ধরনের ব্যাগ খুলে একটা ফাইল বের করলেন। শিরীষ আর সোমদত্তার মনে হল, তারা সিনেমা দেখছে।
সোমদত্তা বলল, “কী আছে ওতে?”
বড়মামা নির্বিকার ভঙ্গিতে ফাইলের ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া দড়ি খুলতে খুলতে বললেন, “সব আছে। ওই জমির কাগজপত্র, বাবার নোট।”
সোমদত্তা বলল, “আরও নোট।”
বড়মামা বললেন, “হ্যাঁ, আরও নোট।”
বড়মামা সেদিন খোলা ফাইল হাতে লাল হয়ে যাওয়া একটা কাগজ বের করল। এটা আগের মতো সাধারণ কাগজ নয়, কোর্টের স্ট্যাম্প পেপার। নীচে দু’জন সাক্ষীর সইও রয়েছে। শিরীষের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “নে পড়।”
সোমদত্তা বলল, “বড়মামা, আপনি পড়ুন। আমিও শুনব।”
শিরীষ বলল, “তাই ভাল। তবে কাগজটা একটু দিন। দাদুর হাতের লেখাটা দেখি।”
ছোট লেখা। মাত্র গুটিকতক লাইন। কিন্তু মারাত্মক— ‘সংসার আর শরীরের কারণে নাওডুবি গিয়ে থাকা হল না। জমিটাকে চাষের উপযোগী করতে পরিশ্রম আর অর্থ, দুটোই লাগবে। এই বয়সে সেই চ্যালেঞ্জ নিতে পারলাম না। পরাজিত হলাম। তবে স্বপ্নটা রয়ে গেল। মানুষ স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখে তার উত্তরাধিকারের মধ্যে। আমিও রাখলাম। স্বপ্ন আমি রেখে গেলাম আমার নাতি শিরীষের কাছে। এইটুকু বয়সেই তাকে দেখে আমার মনে হয়েছে, এই ছেলে স্বপ্ন দেখতে জানে। সে আর পাঁচজনের মতো নয়। দুষ্টুমি করার চেয়েও সে রূপকথার গল্প শুনতে ভালবাসে, ছড়া ভালবাসে, বসে আঁকতে চায়। আশা করব, বড় হয়ে সে স্বপ্ন দেখা ভুলে যাবে না। এটাই আমার উইল হিসেবে ধরা হোক। আমার নাওডুবির জমি নাতিকে দিয়ে গেলাম।’
বড়মামা ফাইল বন্ধ করলেন। মন দিয়ে ফাইলের দড়ি বাঁধলেন। তারপর ফাইলটা রাখলেন টেবিলের উপর। শান্ত ভঙ্গিতে বললেন, “নাও, নিজের সম্পত্তি নিজের কাছে রাখো।”
শিরীষ সোফায় হেলান দিয়ে থতমত ধরনের হেসে বলল, “খেপেছ বড়মামা? আমার সম্পত্তি কীসের? ওসবে আমি নেই।”
বড়মামা বললেন, “তুমি থাকলে কি না থাকলে আমার তাতে কিছু যায় আসে না বাপু। তোমার জিনিস তোমাকে দিয়ে গেলাম। দায়িত্ব পালন করলাম। বাবা কাউকে কিছু বলেননি কেন, সেটাই অদ্ভুত। যাক, কী করেননি সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, কী করেছেন গুরুত্বপূর্ণ সেটা। আমার ছেলেপুলে নেই, তোমার ছোটমামার ফ্যামিলি কেমন জানি না। ফলে তাঁর নাতি বলতে একমাত্র তুমি আছ। জামশেদপুরের বাড়ি বিক্রির কথা যদি না ভাবতাম, আলমারি কাগজপত্রও ঘাঁটতাম না, এইসব কাগজপত্রও পেতাম না। জমির কথাও জানতে পারতাম না।”
শিরীষ বলল, “দাদুর কেন মনে হয়েছিল, আমি সব ছেড়েছুড়ে গ্রামে গিয়ে চাষবাস করব? এগারো বছরের কাউকে দেখে এসব বোঝা যায়?”
বড়মামা বললেন, “না বোঝা যায় না। বোঝাই যাচ্ছে, তোর দাদু ইমোশনাল হয়ে এসব লিখেছিল। বয়স হয়ে গেলে মানুষ যুক্তি হারায়। আমিও হারিয়েছি। শিরীষ, এই নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। আমার ডিউটি তোমাদের জানানো, সেই ডিউটি করলাম। করার আগে একবার স্পটে গিয়েছি। বিএলআরও অফিসে গিয়ে দেখে এসেছি, বাবা সত্যি এরকম জমি কিনেছিল কিনা, এখন তার স্ট্যাটাস কী, জমি আছে না বেহাত হয়ে গিয়েছে। তোকে বলার আগে তো সবটা জেনে বলতে হবে। বাবা কিনেছেন কতদিন হয়ে গেল। এতদিন পড়ে থাকলে জমি বেদখল হয়ে যায়। দেখলাম সব ঠিক আছে।”
সোমদত্তা গদগদ গলায় বলল, “বড়মামা, ওই প্রপার্টির এখন দাম কেমন হয়েছে?”
বড়মামা বললেন, “জমি খুব ভাল নয়, তবে দাম কম হবে না। বিঘে প্রতি লাখ খানেক হয়ে যেতে পারে। আর খানিকটা যদি রেডি করে দেওয়া যায় তা হলে তো কথাই নেই। আমি গিয়ে সব খবরটবর নিলাম।”
শিরীষ বিরক্ত গলায় বলল, “উফ্! সোম, চুপ করো তো। বিক্রিবাটার প্রশ্ন আসছে কেন? বড়মামা, শুনে রাখো, এসব ঝামেলার মধ্যে আমি নেই। ও জমির ব্যাপারে আমাকে জড়িয়ো না।”
বড়মামা হাই তুলে বললেন, “জড়ানো না জড়ানোর ব্যাপারে আমি কে? আমি তোমাকে জমি দিইনি। তোমার দাদু একটা প্রপার্টি তোমাকে দান করে গিয়েছেন। অনেকের দাদুই নাতি নাতনিকে সম্পত্তি দিয়ে যান। এবার আমি ঘুমোতে যাব। কাল সকালে গুডবাই।”
শিরীষ এবার কঠিন গলায় বলল, “এই ফাইল তুমি নিয়ে যাও বড়মামা।”
বড়মামা চোখ বড় করে বললেন, “কী যে বলিস, আমি বাড়ি বেচে পালাচ্ছি, আর তুই বলছিস কাঁধে করে একটা জমি নিয়ে যাব?”
শিরীষ রাগ করা গলায় বলল, “তুমি বেচে দিয়ে যাও। আমার ঘাড়ে ফেলো না।”
বড়মামা বললেন, “তোদের সম্পত্তি আমি বেচার কে?”
সোমদত্তা নিচু গলায় বলল, “বড়মামা তো ঠিকই বলছেন। ওঁর ঘাড়ে কেন দায়িত্ব চাপাচ্ছ? যদি কিছু করতেই হয়, তুমি করবে।”
স্ত্রীর এই লোভে অবাক হতেও ভুলে গিয়েছিল শিরীষ। সে হতচকিত অবস্থায় বসে রইল। বড়মামা উঠে দাঁড়ালেন। সোমদত্তা আহ্লাদি গলায় বলল, “চলুন, গেস্টরুমে আপনার বিছানা রেডি করা আছে। ইস, ক’টা দিন থেকে গেলে খুব ভাল হত।”
বড়মামা একথার উত্তর না দিয়ে বললেন, “তোমাদের ফ্ল্যাটটা খুব সুন্দর করে সাজানো সোমদত্তা।”
সোমদত্তা হেসে বলল, “আপনার ভাগনের শখ। গাদাখানেক খরচ করেছে। কে থাকবে বলুন তো? মেয়ে তো হস্টেলে থাকে। বাড়িতে থাকলে তার নাকি লেখাপড়া হয় না। আজও তো নেই। বলেছে, পাশ করলেই বাইরে পালাবে। আপনার ভাগনেরও একটা ভাল সুযোগ আসছে। কোম্পানি ওকে আমেরিকা পাঠাতে চায়। আমিও চলে যাব ভেবেছি। তখন তো এই ফ্ল্যাট পড়ে থাকবে।”
বড়মামা সামনের দিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকে বলল, “ওই দেওয়ালটা কোথায় পেলে! মাটির মনে হচ্ছে।”
সোমদত্তা খুশিমুখে বলল, “হ্যাঁ, মাটির। যারা এই ফ্ল্যাটের ইন্টিরিয়র করেছে, তারা আর্টিস্টকে দিয়ে করিয়ে এনেছে। একেবারে আসলের মতো না?”
সেদিন বড়মামা ঘুমোতে গেলেও অনেক রাত পর্যন্ত থম মেরে বসেছিল শিরীষ। বড়মামার সঙ্গে ওই তার শেষ কথা। যোগাযোগ হয়নি আর। আবার হারিয়ে গিয়েছেন।