মাটির দেওয়াল – ২

এই মেঘের আলাদা কোনও নাম নেই। থাকলে সম্ভবত হত ‘বৃষ্টি ফুরোনো মেঘ’।

এই মেঘ ভাদ্র মাসের শেষদিকে আকাশে ঘুরে বেড়ায়। ক’মাস ধরে একটানা বৃষ্টি ঝরিয়ে ক্লান্ত, সম্ভবত তার একঘেয়েও লাগছে। তেজ, দাপট সবই কমে এসেছে। এবার বিদায়, গুডবাই। যাওয়ার সময় ‘বৃষ্টি ফুরোনো মেঘ’ কখনও ধীর স্থির, দুলকি চালে ঘোরে ফেরে, কখনও থাকে তাড়াহুড়োয়। ফাঁকে ফাঁকে মুচকি হাসির মতো দেখা দেয় নীল আকাশ। এই রোদ, এই ছায়া। এসব দিনে ছাতা, রেনকোটের প্রয়োজন হয় না বললেই চলে। নিশ্চিন্তে বাড়ি থেকে বের হওয়া যায়। বৃষ্টি ‘হব হব’ একটা গুমোট ভাব থাকে বটে, তবে বৃষ্টি হয় না।

আজ সকাল থেকে আকাশে জমেছে। ব্যস্তসমস্ত হয়ে ছোটাছুটিও করছিল। ভাবটা এমন যেন চলে যাওয়ার সময় এঘর-ওঘর ঘুরে দেখে নিচ্ছে, কিছু পড়ে রইল না তো? কিন্তু দুপুরে তাদের মেজাজ গেল বদলে! সেই মেঘ কলকাতার মাথায় থমকে দাঁড়াল খুব অল্পক্ষণের জন্য। অতি দ্রুত অন্ধকার হয়ে এল চারপাশ, তারপর সবাইকে থতমত খাইয়ে, হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নামিয়ে দিল। একেবারে ঘোর আষাঢ় মাসের বৃষ্টি। সেই বৃষ্টি শুধু নামল না, তার জোর এতটাই বেশি হল যে কিছু বোঝার আগেই রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, মানুষজন সব ভিজে একাকার কাণ্ড। পথের পাশের হকাররা হুটোপাটি করে প্লাস্টিক টেনেও জিনিস বাঁচাতে পারল না। একেই বোধহয় বলে, ‘ঝটিকা আক্রমণ’।

সোমদত্তা তখন উকিলের অফিস থেকে সবে বেরিয়েছে। সে ভাবতেও পারেনি এভাবে বিনা নোটিশে বৃষ্টি এসে পড়বে। মুশকিল হল। উকিলের অফিস থেকে বেরিয়ে মাথা বাঁচানোর উপায় নেই।

উকিলের নাম সন্তোষ খাস্তগির। সবাই ডাকে ‘সন্তোষ উকিল’। ভদ্রলোকের দুটো অফিস। একটা অফিস পাড়ায়, আর-একটা বেহালায়। অফিস পাড়ার পার্টিশান দেওয়া ঘরে উনি কোর্টের দিনগুলোতে বসেন। যার মামলার ডেট থাকে শুধু তার সঙ্গে কথা বলেন। নইলে আসতে হয়, বেহালার বাড়িতে। বড় রাস্তা ছেড়ে সরু গলির মধ্যে। গলিতে গাড়ি ঢোকে না। রিকশাও ঢুকতে চায় না। উলটো দিক থেকে আর একটা রিকশা চলে এলে মুশকিল। তাই গাড়ি বাইরে রেখে হেঁটে ঢোকা ছাড়া উপায় নেই। ‘সন্তোষ উকিল’-এর বেহালার অফিসটাও আদ্যিকালের পুরনো একটা তিনতলা বাড়ির একতলায়। ঘর অতি ছোট। আইনের বই আর কাগজপত্র ঘরটাকে আরও ছোট করে দিয়েছে। তার উপর আবার অন্ধকার। দিনে রাতে সর্বক্ষণ আলো জ্বালিয়ে রাখতে হয়। এমন পসারওয়ালা একজন লইয়ার কেন যে একটা ঘুপচি অফিস বানিয়ে রেখেছে, সোমদত্তা বুঝতে পারে না। তার উপর মাঝেরহাটের ব্রিজ ভাঙার পর থেকে বেহালা যাতায়াতে একেবারে কালঘাম ছুটে যাচ্ছে!

সোমদত্তা আজ বেরিয়েছে হাতে কাগজপত্র নিয়ে। সঙ্গে ক’টা বইও রয়েছে। তার মনে হয়েছে, বইগুলোতে এমন কিছু আছে যা মামলার কাজে লাগবে। তার পক্ষে যাবে। একটি বই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সঞ্চয়িতা’। একটি চটি রান্নার বই, নাম, ‘নিজের খাবার নিজে বানাও’। ট্রেনে এই ধরনের বই বিক্রি হয়। তৃতীয়টি গাবদা অভিধান। ইংলিশ টু বেঙ্গলি। সন্তোষ উকিল বইগুলো উলটেপালটে দেখলেন। হলুদ কাগজের মার্কার দিয়ে আলাদা করা পাতায় গেলেন। সেখানকার লেখাগুলোতে চোখ বুলিয়ে বললেন, “ভাই, এগুলো কোনও কাজে লাগবে না। আদালতে জমা দিলে, আদালত ছুড়ে ফেলে দেবে।”

সোমদত্তা বলল, “কেন? কাজে লাগবে না কেন?”

সন্তোষ উকিল বললেন, “এগুলো অর্থহীন বলে। অর্থহীন কিছু আদালত গ্রাহ্য করে না।”

সন্তোষ উকিলের বয়স বাষট্টি হতে পারে আবার চৌষট্টিও হতে পারে। মাথার চুল সবটাই পাকা। শুধু জুলপিদুটো কালো। হয়তো রং করেন। দাড়ি- গোঁফহীন মুখে বয়সের ক্লান্তি নেই, অভিজ্ঞতার ছাপ রয়েছে। দেখলে মনে হয়, মানুষটা খিটখিটে প্রকৃতির। যদিও ঘটনা তা নয়। ঠান্ডা মাথার মানুষ। চাঁছাছোলা কথাও বলেন ঠান্ডা মাথায়। একটা অদ্ভুত স্বভাবও রয়েছে। মক্কেলদের মাঝেমধ্যে ‘ভাই’ ডাকেন। এই ডাকে ছোট, বড়, নারী, পুরুষ ভেদাভেদ নেই। কেউ কেউ মনে করে, এই অভ্যেস ভাল নয়। তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি থাকে। অপমান করা হয়। তারপরেও মক্কেলরা মুখ ফুটে কিছু বলে না। বলে না তার কারণ, পাকা চুলের এই মানুষ ডিভোর্স মামলার উকিল হিসেবে মারাত্মক। এতই মারাত্মক যে, উকিলমহলে তাঁকে বলা হয় ‘ডিভোর্স সন্তোষ’। তাঁকে নিয়ে কোর্ট চত্বরে নানারকম কথা চালু রয়েছে। অনেকটা মিথের মতো। ভদ্রলোক শুধু আইনের প্যাঁচ জানেন এমন নয়, সেই প্যাঁচে গিট মারতেও জানেন। এমনই গিট যে, উলটোদিকের লইয়ার ঘেমে নেয়ে একসা হবে। সেই গিঁট পাজামার দড়ির মতো। খুলতে গেলে আরও জটিল হয়ে পড়ে। সন্তোষ উকিলের নাকি নিজস্ব চরবাহিনী আছে। তারা কেসের সপক্ষে এবং বিপক্ষে প্রমাণ জোগাড় করে বেড়ায়। দরকারে অনেক সময় প্রমাণ তৈরিও করে। এই বিষয়ে সন্তোষ উকিলের নিজস্ব মত রয়েছে।

“ভাই, প্রমাণ কখনও সত্যি বা মিথ্যে হয় না। আইনের চোখে তাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলাটাই আসল। অনেক সময়ে অভিযুক্ত দোষী প্রমাণিত হয়েও গোলমাল বাঁধে। পরে দেখা যায়, সেই প্রমাণ মিথ্যে। অভিযুক্ত বেকসুর খালাস পায়।”

লোকে বলে, ডিভোর্সের পর মেয়েকে খোরপোশ পাইয়ে দেওয়া সন্তোষ উকিলের কাছে অতি সামান্য বিষয়। উনি এসব ‘সামান্য বিষয়’ নিয়ে মাথা ঘামান না। তাঁর চিন্তা থাকে খোরপোশের পরিমাণ নিয়ে।

“ধর্মাবতার, স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদ মানে শরীরে আলাদা থাকা নয়, বিচ্ছেদের আসল অর্থ নিহিত থাকে মনের দূরত্বে। শরীরকে অস্বীকার করা যায়, সে মেনেও নেয়, কিন্তু মন মানে না। ধর্মাবতার, আপনি মনোমালিন্যের সময়ে থেকেই খোরপোশের আদেশ দেবেন বলে আমার মক্কেলের প্রার্থনা। যেদিন প্রথমবারের জন্য আমার মক্কেল তাঁর স্বামীর সঙ্গে তিনদিন কথা বন্ধ রাখতে বাধ্য হন, আইনত সেদিন থেকেই তাঁর মানসিক বিচ্ছেদের সূত্রপাত এবং খোরপোশ পাওনা। এই বিষয়ে সেই কথা বন্ধের তারিখ, সাক্ষীসহ যাবতীয় প্রমাণাদি আমি আগেই আদালতে পেশ করেছি। এতে অর্থের পরিমাণ বেড়ে অনেকটাই বেশি হবে, তবে তা আমার মক্কেলের মানসিক নিগ্রহের কাছে কিছুই নয়। এই টাকা কতগুলি কিস্তিতে আমার মক্কেল পাবেন সে বিষয়ে মহামান্য আদালত যা রায় দেবেন আমরা মাথা পেতে মেনে নেব। আদালতই শেষ কথা। আমার মক্কেল আপনার সুবিচারের অপেক্ষায় রইল ধর্মাবতার।”

শুধু মেয়েপক্ষ নয়, ছেলেপক্ষের হয়েও প্যাঁচে সন্তোষ উকিল ওস্তাদ। মামলার শেষদিন পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যেতে থাকেন। নিশ্চিত পরাজয় জেনেও হাল ছাড়েন না। শেষ সময়তেও সাজার মেয়াদ বা খোরপোশের পরিমাণ যতটা পারেন কমাতে চেষ্টা করেন।

“ধর্মাবতার, অনুগ্রহ করে এই ফোটোগ্রাফটি দেখুন। আমার মক্কেল তিন বছর ধরে তাঁর স্ত্রীর বেডরুম একই ভাবে রেখে দিয়েছে। তিনবছর আগে চুলের কাঁটা, পাউডারের কৌটো, চিরুনি, সিঁদুরকৌটো ঠিক যেখানে যেমনভাবে ছড়িয়ে ছিল, আজও ঠিক তেমন ভাবেই রয়েছে। কোনও নড়চড় হয়নি। এমনকী বাথরুমে যাওয়ার স্লিপারটি পর্যন্ত খেয়াল করুন ধর্মাবতার, তারা জায়গা পালটায়নি। তিনবছর আগের মতোই খাটের নীচে রয়ে গিয়েছে। একটি সোজা, একটি উলটো হয়ে। এর কারণ কী? এর কারণ হল, আমার মক্কেল বিশ্বাস করে, তার স্ত্রী যেমন হুট করে একদিন তাকে ছেড়ে, সাজানো ঘরসংসার ছড়িয়ে ফেলে চলে গিয়েছিলেন, ভুল বুঝতে পেরে একইরকম হুট করে যে-কোনওদিন ফিরে আসবেন। এসে এই ঘর গোছাবেন। স্ত্রীর প্রতি যদি অপার ভালবাসা না থাকত, কারও পক্ষে অবিকল একইভাবে ঘর রেখে দেওয়া সম্ভব হয় না। আমি মহামান্য আদালতের কাছে ফোটোগ্রাফগুলি পেশ করলাম। আশা করি, ধর্মাবতার রায়দানের আগে, বিষয়টি ভেবে দেখবেন। যদি তিনি চান, আমার মক্কেলের বাড়ি ঘুরে দেখতে আদালত থেকে কোনও অফিসার নিয়োগ করতে পারেন। তিনি দেখে এসে আদালতের কাছে রিপোর্ট জমা দিন, ঘটনা সত্য না বানানো। ধর্মাবতার, আমি জানি, বিষয়টি আইনের কোনও ধারা উপধারার মধ্যে ফেলা যাবে না, কিন্তু আইনকে সে সমর্থন করবে, পোক্ত করবে। আইন কোনও অনড় অটুল বিশ্বাস নয় ধর্মাবতার, সে তথ্য প্রমাণে নিজেকে বারবার পালটে নেয়।”

সেই সন্তোষ উকিল বইগুলো তাচ্ছিল্যের সঙ্গে সরিয়ে দেওয়াতে সোমদত্তা খানিকটা বিরক্ত হল। সে খানিকটা গলা তুলেই বলল, “কেন অর্থহীন বলছেন? ‘সঞ্চয়িতা’টা খুলুন, আমি পেজ মার্ক করে এনেছি, খুলে দেখুন প্রথম পাতায় কী লেখা আছে। লেখা আছে, ‘কবিতায় তোমাকে খুঁজে পাই।’ হাতের লেখা দেখেই বোঝা যাচ্ছে, এই লেখা অবশই কোনও মেয়ের। আমি জানি মেয়ের এবং সেটা ওই শয়তান মেয়েটার। এটা কি প্রমাণ করে না ওই মেয়ে শিরীষের সঙ্গে প্রেম করে? একটা মেয়ে কোনও ছেলেকে কবিতায় কখন খুঁজে পায়? প্রেমে পড়লেই পায়। রান্নার বইটাও দেখুন। অতি রদ্দি একটা জিনিস। ভুলে ভরা। ডালের রেসিপি পর্যন্ত ঠিক করে লিখতে পারেনি। ফোড়নে গোলমাল করেছে। সেই বইতেও কী লেখা দেখুন, ‘খুব ইচ্ছে করে, আমি তোমাকে রেঁধে খাওয়াই। কিন্তু হায় রে! আমি রান্না জানি না।’ প্রেম না হলে কোনও মেয়ে এমন কথা লেখে? আদালত এটা দেখবে না? এটা তো স্ট্রেট অ্যাডালটরি। অবৈধ সহবাস। এবার ডিকশনারিটায় আসুন। এতে কিছু লেখা নেই, কিন্তু ভিতরে একটা শুকিয়ে যাওয়া গাছের পাতা রয়েছে। আমার স্থির বিশ্বাস, ওই মেয়ে পাতাটা শিরীষকে দিয়েছিল। শিরীষ আহ্লাদ করে সেই পাতা বইতে ঢুকিয়েছে। এর থেকে কি প্রমাণ হয় না, শিরীষ ওই কচি খুকিটির প্রেমে পাগল? তার সঙ্গে থাকে?”

আজকাল নস্যি নেওয়ার চল কমে গিয়েছে। খুব কমজনকেই ডিবে বের করতে দেখা যায়। সন্তোষ উকিল নস্যি নেন। নেওয়ার আগে দু’আঙুলের টিপে বেশ খানিকক্ষণ নস্যিগুঁড়ো ধরেও রাখেন। এই ধরে রাখাটাও একধরনের আমেজের মধ্যে পড়ে। তারপর নাকের কাছে হাত নিয়ে লম্বা টান দেন। প্রথমে বাঁ, তারপর ডান। টানা পর্ব শেষ হলে, রুমাল বের করার জন্য সন্তোষ উকিল দু’পকেট হাতড়াতে লাগলেন। এই কাজ তাঁকে সর্বদাই করতে হয়। বারবার নস্যির ডিবে এবং রুমাল বের করেন আর ঢোকান, তারপরেও ভুলে যান, কোনটা কোন পকেটে রেখেছেন। তখন দু’পকেট হাতড়ানো ছাড়া উপায় থাকে না। ভদ্রলোক রুমাল দিয়ে নাক মুছলেন ধীর স্থির ভঙ্গিতে। কিছু ভাবলেন যেন। তারপর নিচু গলায় বললেন, “আমি এগুলো সবই দেখে নিয়েছি। তারপরেও আবার আপনি পড়লেন। আবার বলছি, না, এতে প্রমাণ হয় না। বইয়ের উপর কে কী লিখল তাই দিয়ে অবৈধ প্রেম প্রমাণিত হয় না। এটা কোনও চিঠি নয়। নীচে নামও নেই। আপনি যে ছোট খুকির কথা বলছেন, সে নাও লিখতে পারে। অন্য কোনও মেয়ে লিখতে পারে, আবার কোনও ছেলেও লিখতে পারে। আপনার হাজ়ব্যান্ড একজন সাকসেসফুল ম্যান। বড় পোস্টে চাকরি করছেন। গান-বাজনা পছন্দ করেন। একসময়ে কলেজে নাটক করেছেন, কবিতা লিখতেন। আপনার কাছ থেকেই এই সব তথ্য আমি পেয়েছি। তাঁর ফোটো আমি দেখেছি। এই বয়সেও যথেষ্ট সুন্দর দেখতে। দেখলে মনে হয় না, তাঁর অত বড় একটি কন্যা রয়েছে। থাকলেও কিছু এসে যায় না। প্রেমে বয়স কোনও ফ্যাক্টর নয়। যাই হোক, আপনার স্বামীর মহিলা ফ্যান থাকা আশ্চর্যের নয়। তার থেকে প্রমাণিত হয় না যে, তিনি অবৈধ প্রণয়ে লিপ্ত। একজনকে নির্দিষ্ট করব কী করে? এখানে তো কোনও নাম নেই।”

সোমদত্তা গলা নামিয়ে বলল, “নাম বসিয়ে নেওয়া যায় না? আমি তো নাম জানি।”

সন্তোষ উকিল সহজভাবে বললেন, “যাবে না কেন? অবশ্যই যাবে। তবে সেই সঙ্গে প্রতারণা করার দায়ে জেলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। আদালতকে প্রতারণার দায়ে মিনিমাম কতদিন জেলে থাকতে হয় আপনার জানা আছে মিসেস মুখার্জি?”

সোমদত্তা একটু থমকে গিয়ে বলল, “সইটা যে জাল হয়েছে কী করে বোঝা যাবে?”

সন্তোষ উকিল একটু নড়েচড়ে বসে বললেন, “ভাই, আদালতে একপক্ষের উকিল থাকে, এমন ধারণা আপনার কেন হল বুঝতে পারছি না। উকিল দু’পক্ষেই থাকে। আপনি যা এভিডেন্স দেবেন তাকে ডিফেন্ড করতে বা মিথ্যে প্রমাণের চেষ্টা হবে। যখনই বইগুলো কোর্টে প্লেস করব, অপর পক্ষের লইয়ার বলবে, এই সই যে করেছে তাকে কোর্টে আনা হোক, নয়তো সই জাল বলে ধরা হবে। আমরা ওই মেয়েটিকে সমন করব। সে যদি আসেও, ধরে নেওয়া যাক সে আসবে, তার হাতের লেখার সঙ্গে এগুলো মিলবে না।”

সোমদত্তা বলল, “কেন মিলবে না?”

সন্তোষ উকিল একটু চুপ করে থেকে বললেন, “কেন মিলবে না আপনার জানা আছে ভাই। জানা নেই?”

সোমদত্তা খানিকটা ঝাঁঝের সঙ্গেই বলল, “আপনি কী বলতে চাইছেন?”

সন্তোষ উকিল বললেন, “কী বলতে চাইছি তাও আপনি জানেন। আপনি একজন উচ্চশিক্ষিত, বুদ্ধিমতী মহিলা, উচ্চপদে চাকরি করেন। তারপরেও নারীর স্বভাবজাত ক্রোধ, প্রতিহিংসা, ঈর্ষা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারেননি। আমি দোষ দিই না, এটা পারা সম্ভবও নয়। এখানে শিক্ষিত অশিক্ষিত, ধনী, দরিদ্র সবাই সমান। ক্রোধে যুক্তি বুদ্ধি লোপ পায়। ভাই, এই লেখা আপনি লেখেননি কিন্তু অন্য কাউকে দিয়ে লিখিয়েছেন। একজন নয়, লিখেছেন দু’জন। একটু দেখলেই বোঝা যাচ্ছে, ‘সঞ্চয়িতা’ আর রান্নার বইয়ের হাতের লেখা এক নয়। এই ধরনের ছেলেমানুষি এবং সস্তার জালিয়াতি ধরতে বিশেষ সময় লাগে না। কোর্ট ফরেনসিকে পাঠালেই দুটো কালির পার্থক্য, তাদের সময়ের পার্থক্য সবই জানা যাবে। লেখা একসময়ে, নাম একসময়ে বুঝতে সময় লাগবে না। তখন হাজত কে খাটবে ভাই? আমি তো পারব না, বাইরে আমার প্র্যাকটিস রয়েছে। সে সব ফেলে ভিতরে গিয়ে বসে থাকতে পারব না। আপনি যদি রাজি থাকেন, দেখতে পারেন।”

ধরা পড়ে যাওয়ায় সোমদত্তার নিজের ওপরই রাগ হল। কাজটা বোকামিই হয়েছে। সেই রাগ গোপন করে সে বিরক্তি দেখাল।

“তা হলে কি এভাবেই চলতে থাকবে? আমি মাসের পর মাস ঘুরতে থাকব, কিছু হবে না! শিরীষ ড্যাং ড্যাং করে ওই মেয়েটাকে নিয়ে ঘর সংসার করবে? মাঝখান থেকে আমার গাদাখানেক টাকা খরচ হবে?”

সন্তোষ উকিল আবার জহর কোটের পকেট দুটো হাতড়াতে লাগলেন। প্রথমে পেলেন নস্যির ডিবে। সেটাকে টেবিলে রেখে, আবার পকেট হাতড়াতে লাগলেন। একসময় রুমালটাও পেলেন। সোমদত্তা নস্যি জিনিসটা দু’চক্ষে দেখতে পারে না। গা ঘিনঘিন করে। এখনও করছে।

“ভাই, বিচ্ছেদ আর উচ্ছেদের মামলায় উকিলদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ হামেশাই ওঠে। বলা হয়, উকিলবাবুরা মামলা ধরে রেখে মক্কেলকে ঘোরাচ্ছে। শুধু ঘোরাচ্ছে না, নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে। মামলা চালাতে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে। কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। রাগ হওয়াটা যুক্তিসংগত। তবে কী জানেন, দুনিয়ার যাবতীয় রাগের অন্যতম কারণ হল, নিজের দোষ দেখতে না পাওয়া। নিজের অক্ষমতা যদি মানুষ বুঝতে পারত, তা হলে রাগ নামক অনুভূতিটিই অনেক কমে যেত। এক্ষেত্রেও ঘটনা তাই। ডিভোর্স মামলার দ্রুত নিষ্পত্তিতে যেসব প্রমাণের প্রয়োজন, মক্কেল তা হাজির করতে পারে না। উকিলদের শূন্য থেকে হাতড়ে জোগাড় করতে হয়। সময় লাগে।”

সোমদত্তা একটু ঘাবড়াল। সন্তোষ খাস্তগিরকে ধরতে হয়েছে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে। চলাফেরা, কথাবার্তায় ধীর স্থির হলেও, এই মানুষ পেশায় অতি দক্ষ এবং ব্যস্ত। ছ’মাসের আগে নতুন মামলা নেন না। নেওয়ার আগে মেরিট বুঝে নেন। সহজ, সরল মামলা হলে মুখের ওপর ‘না’ বলে দেন। মামলায় ঘোরপ্যাঁচ থাকতে হবে। জটিলতা চাই। একসময়ে অনেকেই তাঁকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করত।

“সহজ মামলা নেন না কেন? বিনা আয়েশে জিতে যেতেন। পরিশ্রম কম, নামও বেশি হত। উপার্জনও বাড়ত।”

সন্তোষ খাস্তগির বলতেন, “সহজ মামলা জিতলে পরিশ্রম কম হয় ঠিকই, কিন্তু মজা হয় না। পেশায় মজা না থাকাটা দুর্ভাগ্যজনক। নরনারীর সম্পর্ক নিয়ে কাজ করি। এই সম্পর্ক হল সুতোর গোলার মতো। একদিকে ছাড়াবে তো আর একদিকে জড়াবে। গোলা যত জড়াবে, ছাড়াতে তত মজা। সহজ মামলা নিয়ে নাম করবার মানুষ সন্তোষ উকিল নয়। বুদ্ধির খেলা, কখনও সুতোয় টান মারে, কখনও ছাড়ে। একসময়ে হয় জেতে, নয় হারে। লড়াই করে জেতায় মজাই আলাদা বাপু।”

অনেক ঝামেলা করে এই মানুষটাকে ধরা গিয়েছে। দেবমিতা প্রথম খোঁজ দেয়। সে সোমদত্তার অফিসে একই ডিপার্টমেন্টে চাকরি করে। তিন বছর হল ডিভোর্স নিয়েছে। দু’বছরের একটা মেয়েকে নিয়ে সাড়ে চার বছরের বিবাহিত জীবন শেষ করেছে। উচ্চশিক্ষিতার শাশুড়ির নানাবিধ নিগ্রহ এবং সেই বিষয়ে স্বামীর চুপ করে থাকা সহ্য হয়নি। এখন একা সুখে আছে। সোমদত্তার ঘটনা শুনে বলল, “তুমি অ্যাকাউন্টসের অনসূয়া মজুমদারের সঙ্গে কথা বলে দেখো। শুনেছি ওর এক দাদা না ভাই ডিভোর্স মামলায় খুব এক্সপার্ট। আমার কেসটা যখন চলছিল, কোর্টে ওঁর কথা শুনতাম। তবে এত ব্যস্ত যে নতুন কেস নিতে চান না। পরে শুনলাম অনসূয়া মজুমদারের রিলেটিভ। দেখো, যদি কথা বলিয়ে দেয়। অনসূয়াকে চেনো তো?”

সোমদত্তা একটু অস্বস্তি নিয়ে বলল, “চিনি। তবে এড়িয়ে চলি। শুনেছি, মহিলা গসিপ পছন্দ করে। আমার এই ঘটনাটা নিয়েও করবে হয়তো।”

দেবমিতা জোরের সঙ্গে বলল, “এতে গসিপের কী আছে? তোমার লুকোনোরই বা কী হয়েছে? যে যা খুশি বলুক। ওই ভদ্রলোককে পেলে কাজটা হবে। তুমি চেষ্টা করো।”

বলা ঠিক হবে কি না ভাবতে ভাবতেই সোমদত্তা অনসূয়া মজুমদারকে ধরল।

“অনসূয়াদি, যে করেই হোক, আমাকে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট জোগাড় করে দিন।”

অনসূয়া ভুরু কুঁচকে বলেছিল, “কার জন্য?”

সোমদত্তা মাথা নামিয়ে বলল, “আমার জন্য।”

অনসূয়া নিজেকে সামলাতে পারল না। অবাক গলায় বলল, “সে কী! এই তো সেদিন বিয়ে হল! কবে যেন?”

সোমদত্তা বুঝতে পারল, মহিলা গসিপের সাজসরঞ্জাম জোগাড় করতে শুরু করে দিয়েছে। তার মোটেই ‘এই তো সেদিন বিয়ে’ হয়নি। উনি একটা ঢিল ছুড়লেন মাত্র। কিছু করার নেই। সন্তোষ খাস্তগিরের ডেট চাই।

“এই তো সেদিন নয়, বিয়ের বয়স তেইশ বছর হয়ে গিয়েছে। আমার বয়সও তো কম হল না।”

অনসূয়া মুখে চুকচুক আওয়াজ করে বলল, ‘আহা! এতদিন ঘর করার পর ছাড়াছাড়ি! ইস, আজকাল যে কী হচ্ছে, কোনও রিলেশন টিকছে না। এই তো গতমাসে আমার এক ননদ বিয়ের একত্রিশ বছর পর সেপারেশনে গেল। ওরা অবশ্য থাকে ফ্লোরিডায়। সম্পর্ক অনেকদিনই খারাপ ছিল। কোনও ইস্যু ছিল না। ওসব দেশে ডিভোর্স আকছার হয়। আবার সত্তর বছর বয়সেও বিয়ে করে। তোমাদেরও কি একই প্রবলেম? বাচ্চাকাচ্চা না হলে অনেকসময় এরকম হয়।”

সোমদত্তার শরীর রাগে চিড়বিড় করে উঠল। নিজেকে সামলে বলল, “আমাদের একটি মেয়ে আছে। তার প্রায় কুড়ি বছর বয়স হতে চলল। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে।”

অনসূয়া মজুমদার চোখ বড় করে বললেন, “বলো কী! অত বড় মেয়ে।”

সোমদত্তা প্রসঙ্গ পালটে বলল, “আপনি একটু সন্তোষবাবুকে ফোন করবেন? শুধু ফোন করলেই হবে না, যে করেই হোক এই সপ্তাহে আমাকে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট বের করে দিতে হবে। ফিজ় যতই লাগুক সমস্যা নেই।”

অনসূয়া লম্বা করে শ্বাস টেনে বলল, “সে তো করবই। কলিগ বলে কথা। এক অফিসে কাজ করি। একে অপরকে না দেখলে কে দেখবে? কিন্তু দাদাকে বলব কী? এত বছর ধরে শ্বশুরবাড়িতে অত্যাচার? দাদা আবার ঘটনা না শুনে কেস নেয় না। কোনও রিকোয়েস্ট শোনে না। কেসের মেরিট নিয়ে খুঁতখুঁতানি খুব, নাম তো আর এমনি করেনি। সেই জন্যই জিজ্ঞেস করছি। অন্য উদ্দেশ্য নেই।”

সোমদত্তা একটু চুপ করে থেকে গলা নামিয়ে বলল, “না, শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার নয়। বলবেন, অ্যাডজাস্টমেন্ট হচ্ছে না।”

অনসূয়া মজুমদার ভুরু কোঁচকাল। বোঝাই গেল, কথা বিশ্বাস হয়নি। তবে তেরোদিনের মাথায় দূরসম্পর্কের ‘উকিলদাদা’র অ্যাপয়েন্টমেন্ট এনে দিল।

সন্তোষ উকিলের অফিসঘরের বাইরে একচিলতে প্যাসেজে বসার জায়গা। কেউ যাতায়াত করলে উঠে দাঁড়াতে হয়। নইলে হাঁটুতে ধাক্কা দিয়ে যাবে। এসব দেখলে ভক্তিশ্রদ্ধা হয় না। সোমদত্তা ডাক পেল ঠিক সাড়ে এগারোটাতেই। প্রথমেই ভদ্রলোক ঠান্ডা গলায় কথা শুনিয়ে দিলেন।

“প্রথমেই বলে রাখি, আপনি আমার বোনের রেফারেন্সে এসেছেন ঠিকই, কিন্তু তার মানে ধরে নেবেন না, আমি আপনার ব্রিফ নেব। প্রফেশনে চেনা-পরিচিত আমি পছন্দ করি না, তারপরেও মেনে নিতে হয়। সমাজে থাকতে গেলে, নানা ধরনের অপছন্দের কাজ করতে হয়ে। তবে অবশ্যই সেটা একটা স্তর পর্যন্ত। আমি আগে আপনার ঘটনা শুনব, তারপর সিদ্ধান্ত নেব এই মামলা নেব কি নেব না। তবে আপনার মামলা নিই বা না নিই, আজকের জন্য পুরো ফি আপনাকে দিতে হবে এবং সেটা কথা শুরুর আগেই দিতে হবে।”

খুবই ঠ্যাটা ধরনের কথা। কাউকে এই ধরনের কথা বলতে গেলে দশবার ভাবতে হয়। মনে রাখতে হয়, সে অপমানিত হতে পারে। এই লোক ভাবনাচিন্তার ধার ধারেন না। সোমদত্তা ব্যাগ খুলে টাকা বের করল। টাকা গুনতে গুনতে সন্তোষ খাস্তগির বললেন, “আপনি শুরু করুন। চেষ্টা করবেন মিথ্যে না বলতে এবং তেমন কিছু গোপন না করতে।”

সোমদত্তা বলল, “মানে!”

“যা বললাম সেটাই মানে মিসেস মুখার্জি। মিথ্যে বললে এবং জরুরি কথা গোপন করলে লইয়ারকে বিভ্রান্ত করা হয়। নিন, শুরু করুন। স্বামীর চরিত্র নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করবেন, তবে শুধু সেটাই করবেন না, সঙ্গে তাঁর ভাল স্বভাবও বলবেন। কী ভালবাসেন, কী ভালবাসেন না, এই সব। ফোটো আছে? কথা শেষ হলে দেখাবেন।”

সোমদত্তা অবাক হয়ে বলল, “এসব তো ডাক্তারের লাগে।”

সন্তোষ উকিল মুচকি হেসে বললেন, “আমিও ডাক্তার। একটাই তফাত, অসুখ সারানোর বদলে অসুখ বাড়াই।”

সোমদত্তার কথা শেষ হলে সন্তোষ উকিল খানিকক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। পকেট হাতড়ে নস্যির ডিবে বের করলেন, আবার ঢুকিয়েও রাখলেন। তারপর নিচু গলায় বলতে শুরু করলেন।

“ভাই, দুটি কথা বলি। প্রথম কথা হল, আমার সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্টের ব্যাপারে আপনার সময় বাছাই আমার ভাল লেগেছে। একজন মহিলা হয়েও রাত সাড়ে এগারোটায় দেখা করতে আসাটা শুধু সাহসের পরিচয় নয়, বুদ্ধির পরিচয়ও বটে। এই সময়ে বিরক্ত করার লোক বিশেষ থাকে না। আর এতে প্রমাণ হল, আপনার আমাকেই দরকার বলে আপনি মনে করছেন। মনে হয়, আপনি ধৈর্য ধরতে পারবেন। দু’নম্বর বিষয়টি হল, আপনার মামলাটি ইন্টারেস্টিং। কারণ এটি জটিল। আসলে এটি কোনও মামলাই নয়, সেই জন্যই জটিল। কোর্টের প্রসেসের মধ্যে এটি আদৌ পড়ে বলে আমার মনে হচ্ছে না। কাউন্সেলিং স্তরেই ডিল করা উচিত ছিল।”

সোমদত্তা বলল, “আমি তো চেষ্টা করেছি। বারবার ওর সঙ্গে বসেছি। আমার মেয়ে, আমার মা, তাঁরাও কথা বলেছেন। সাইকিয়াট্রিস্টের সঙ্গেও কথা বলেছি। একসময়ে মনে হয়েছিল, মাথা খারাপ হয়ে হয়ে গিয়েছে। ডাক্তার সব শুনে বললেন, আপনার অ্যাডজাস্টমেন্ট না হলে আপনি কোর্টে যান।”

সন্তোষ উকিল ডিবে খুলে দুই আঙুলের টিপে নস্যি নিলেন।

“ইন্টারেস্টিং বিষয় হল, আপনি একটা সাধারণ ব্যাপারকে মামলা বানিয়ে ছাড়তে চাইছেন। সেখানে আপনি বিচার চাইছেন। আপনার হাজ়ব্যান্ড যাতে অপরাধী প্রমাণিত হন, তার চেষ্টা করছেন।”

সোমদত্তা তাড়াতাড়ি বলল, “আমার হাজ়ব্যান্ড নয়, ওই মেয়েটাকে আমি জেলে ঢোকাতে চাইছি। হাঁটুর বয়সি একটা মেয়ে যে এরকম শয়তান হতে পারে…ও-ই আমার হাজ়ব্যান্ডকে এইসব দুর্বুদ্ধি দিয়েছে…আমার সংসার ভেঙেছে… উকিলবাবু আমি এমন মামলা করতে চাই যাতে ওই বিচটাকে জেলে পাঠানো যায়।”

সন্তোষ উকিল এবার নস্যি নিলেন। নাক টেনে বললেন, “হাঁটু ধরতে গেলে আগে মাথা ধরতে হবে।”

সোমদত্তা অবাক হয়ে বলল, “মানে?”

সন্তোষ উকিল বলল, “আগে আপনার স্বামীকে দোষী প্রমাণ করতে হবে, তারপর তো ওই হাঁটুর বয়সি মেয়েকে ধরার প্রশ্ন উঠবে। অ্যাডালটরি এখন আলাদা করে কোনও অপরাধ নয়। তাও জানতে হবে। জানতে হবে, করতে হবে, যে মেয়েটার কথা আপনি বলছেন, তার সঙ্গে আপনার হাজ়ব্যান্ডের সম্পর্ক আছে। মনের এবং শরীরের। তাই না? কী যেন নাম মেয়েটির?”

সোমদত্তা নাক সিঁটকিয়ে বলল, “ত্রপা।”

সন্তোষ উকিল ভুরু কুঁচকে বললেন, “ত্রপা! বাঃ, আনকমন নাম তো! এপা মানে কী?”

সোমদত্তা রাগ-রাগ গলায় বলল, “জানি না। মনে হয় মন্দ মেয়ে।”

সন্তোষ উকিল অন্যমনস্কভাবে নিজের মনে বিড়বিড় করলেন, “ত্রপা…ত্রপা… কেমন বয়স বললেন যেন?”

সোমদত্তা মুখটাকে ভেঙেচুরে বলল, “বলতে ঘেন্না হয়, খুব বেশি হলে পঁচিশ-ছাব্বিশ।”

“আর আপনার স্বামীর?”

সোমদত্তা দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “ফর্টিসেভেন শেষ করে সবে ফর্টিএইটে পা দিয়েছে। সে একজন ছাব্বিশ বছরের মেয়ের সঙ্গে…ছিছি…”

সন্তোষ উকিল অবাক হয়ে তাকিয়ে বললেন, “ছিছি! কেন ছিছি কেন? ছাব্বিশ-সাতাশ বছর বয়স কোনও ছিছি-র বয়স? বয়স তো খুবই ভাল। এই বয়সে মানুষ কত কী করতে পারে! কত এনার্জি থাকে, সাহস থাকে।”

সোমদত্তা মাথা নামিয়ে বলল, “মেয়ের বয়সি…”

সন্তোষ উকিল বললেন, “বড় কোনও মহিলা হলে সুবিধে হত বলছেন? মিসেস মুখার্জি, জীবন খুব রহস্যময়। যাই হোক, আপনার কেস আমার পছন্দ হয়েছে। যা খুব স্পষ্ট করে আইনের পেরিফেরির মধ্যে পড়ছে না, তাকে আইনে জড়িয়ে ফেলার মধ্যে মজা আছে। কোর্টকে বোঝাতে হবে। আমার ভাল লেগেছে। আমাকে ভাবতে দিন। পরের ডেটের সময় আপনার পছন্দমতো দেওয়া হবে। সাধারণত এটা আমি করি না, কিন্তু আপনার জন্য করব।”

সোমদত্তা বলেছিল, “ধন্যবাদ। সময় কি বেশি লাগবে?”

সন্তোষ উকিল টেবিলের কাগজপত্র গোছাতে গোছাতে বলল, “হ্যাঁ লাগবে। তার কারণ, আমি বুঝতে পারছি, আপনাকে আমি যে পথগুলো বলব, আপনি সে পথগুলো নেবেন না। আপনি আর পাঁচজন মক্কেলের মতো নন। তখন আমাকে নতুন পথ ভাবতে হবে। আইনে খুব বেশি এদিক ওদিক করার অপশন থাকে না। ফলে পথটা জটিল হবে। সেই পথ সাকসেসফুল হবে কিনা জানি না। মনে হচ্ছে না হবে।”

সোমদত্তা বলল, “আপনি কী পথ বলবেন?”

সন্তোষ উকিল মুখ তুলে মুচকি হেসে বললেন, “ভাই, সবে তো আজ শুনলাম। এবার খুঁজে দেখি। গোলকধাঁধায় ঢুকেছি। পথ বের করতে সময় লাগবে। সোমদত্তাদেবী, আবার কথাটা মনে করিয়ে দিই, ডাক্তার আর উকিলকে কোনও কিছু লুকোতে নেই। তা হলে কাজ করতে সমস্যা হয়। আমাদের সমস্যা কী জানেন? আমরা পুলিশের মতো জেরা করে, চাপ দিয়ে পেটের কথা বের করতে পারি না। আমাদের মক্কেলের উপর নির্ভর করতে হয়। বুঝতে পারি কথা লুকোচ্ছে বা মিথ্যে বলছে। কিছু বলতে পারি না। ঠিক কিনা?”

সোমদত্তা একটু থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে রইল। অস্ফুটে বলল, “ঠিকই তো।”

সন্তোষ উকিল গম্ভীর হয়ে বললেন, “তারপরেও আমার মন বলছে, আপনি কিছু জিনিস লুকিয়েছেন। মিথ্যেও বলেছেন। প্রমাণ হাতে নেই বলে বলতে পারছি না মিথ্যে ক’টা এবং কয়প্রকার। আশাকরি পরের বার করবেন না।”

সোমদত্তা কিছু বলতে গিয়ে চুপ করে গেল। বুঝতে পারল, বলে লাভ নেই। সন্তোষ উকিল বললেন, “কিছু মনে করবেন না, ভাই বলে ফেলাটা আমার একধরনের মুদ্রাদোষ। দোষটা কাটানোর চেষ্টা করেছি, পারিনি। যাক, অনেক রাত হয়ে গেল, কীভাবে বাড়ি যাবেন?”

রাগ এবং পছন্দ। সোমদত্তার দুটোই হচ্ছিল। তবে বুঝতে পারছিল, ঠিক লোকের কাছেই এসেছে। এর আগে যে-দু’জনের কাছে গিয়েছিল, সে দু’জনেই বলেছিল, “মামলা অতি সহজ। জিতে যাব।” তখনই সোমদত্তা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, ওদের কাছে নয়। সে আইন নিয়ে লেখাপড়া করেনি, তবে যেটুকু যা করেছে তাতে এইটুকু বোঝা যায়, ডিভোর্স চাওয়ার মতো যুক্তি তার হাতে কমই আছে।

সন্তোষ উকিল আবার বললেন, “কী হল, কীসে যাবেন? ক্যাব ডেকে নেবেন?”

সোমদত্তা বলল, “গাড়ি আছে।”

সন্তোষ উকিল অন্য একটা ফাইল টেনে নিতে নিতে বলল, “ভাল। তা হলে এবার আসুন।”

গত আটমাসে মোট সাতবার সোমদা বসেছে সন্তোষ উকিলের সঙ্গে। এ ছাড়া কোর্টে দেখা হয়েছে। এখনও পর্যন্ত সোমদত্তাকে মোট তিনটে পরামর্শ দিয়েছেন। তিনটেই সোমদত্তা নাকচ করেছে। তা নিয়ে যে সন্তোষ উকিল চিন্তিত হয়ে পড়েছেন এমন নয়। একদিন বললেন, “আপনি যে এগুলো মানবেন না, আমি জানতাম। তারপরেও বলেছি। পরে বলতে পারবেন না, আমি আপনাকে পরামর্শ দিইনি। তবে এগুলো সবই রুটিন পরামর্শ। আহামরি কিছু নয়। আমি আপনার স্বামীকে পাঠানোর জন্য ডিভোর্সের নোটিশ তৈরি করেছি, আপনি দেখে সই করে দিন। তবে মনে রাখবেন, এখন পর্যন্ত যেসব প্রমাণ আমরা পাচ্ছি তাতে কনটেস্ট খুব ইজ়ি হবে না।”

সোমদত্তা জিজ্ঞেস করেছিল, “আহামরি কিছু কবে পাওয়া যাবে?”

সন্তোষ উকিল বলেছিলেন, “আপনি ঠিকঠাক কিছু প্রমাণ আনুন। আমি আদালতে দাখিল করি। তখন দেখবেন আহামরি কিছু পেয়ে গিয়েছেন।”

আজ সেই প্রমাণ হিসেবে বই তিনটে এনেছিল সোমদত্তা। তাও তো বাতিল হয়ে গেল। এতে সোমদত্তা বিরক্তি প্রকাশ করে ফেলেছে, টাকার কথাও তুলেছে। সে নিচু গলায় বলল, “সরি, আমি ওভাবে বলতে চাইনি। কিছু মনে করবেন না। আসলে আপনি আমার মেন্টাল কন্ডিশনটা বুঝতে পারছেন।”

বেশিদিন একসঙ্গে চলার কারণে এবং বহু ব্যক্তিগত কথা, অনুভূতি জানিয়ে দেওয়ায়, ডাক্তার-উকিলদের সঙ্গে একধরনের সম্পর্ক তৈরি হয়। সেই সম্পর্ক ভাল-মন্দ দুটোই হতে পারে। তবে এই ঠোঁট-কাটা মানুষের সঙ্গে কোনওরকম সম্পর্ক হওয়াই সম্ভব বলে মনে হচ্ছে না। উকিলবাবু বললেন, “এতে সরি বলার কিছু নেই। ভাই, আপনি মনে করবেন না আমাকে ক’টা কড়া কথা শোনালেন বলে, আমি বলব, যান আর আপনার ব্রিফিং নেব না। এরকম আনপ্রফেশনাল আমি নই। কেস যখন একবার নিয়ে নিয়েছি, যতক্ষণ ফিজ় ঠিকমতো পাব, ততক্ষণ ফাইল ছাড়ব না। অবশ্য আপনি নিজে থেকে যদি চলে না যান।”

সোমদত্তা নিশ্চিন্ত হয়ে বলল, “টাকার কথাটা ওভাবে বলা ঠিক হয়নি আমার।”

“মিসেস মুখার্জি, আপনি আমাকে আরও কথা শোনাবেন। আমি তার জন্য প্রস্তুত। আজ আমাকে এক্সট্রা পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে যাবেন। সঙ্গে না থাকলে, কালকের মধ্যে পাঠিয়ে দেবেন।”

সোমদত্তা বলতে যাচ্ছিল, “এক্সট্রা টাকা কীসের জন্য?” কথাটা গিলে ফেলে ব্যাগ খুলল। সন্তোষ উকিল কাগজপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে বললেন, “টাকা কীসের জন্য, এখন জানতে চাইবেন না। স্টেশনারি লিখে বিল দিয়ে দেব।”

সোমদত্তা কতগুলো পাঁচশো টাকার নোট গুনতে গুনতে বলল, “আমার বিল লাগবে না।”

সন্তোষ উকিল বললেন, “আমার লাগবে। আমি হিসেব ক্লিয়ার রাখি।”

অফিস থেকে বেরোনোর পরপরই হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নামল। গাড়ি পার্ক করতে হয়েছে বেশ দূরে। বড় রাস্তা পার হয়ে আর একটা গলির ভিতর। আজকাল কলকাতা শহরে গাড়ির সংখ্যা এত বেড়ে গিয়েছে যে, গাড়ি নিয়ে বেরোনোই সমস্যা। ঠেলাঠেলি করে চলতে হয়। প্রয়োজনমতো রাখাও যায় না। কোথাও পৌঁছতে হলে গাড়ি দূরে রেখে হাঁটতে হয়। এই হাঁটতে যাওয়ার সময়েই বৃষ্টি এল। হাতের কাগজ, বই রয়েছে সেগুলোকে যে মাথায় ছাতার মতো করে ধরবে সোমদত্তা সে উপায় নেই। সেগুলো ভিজে যাবে। তাই একরকম ছুটতেই হল। শাড়ি পরে, এই বয়সে রাস্তা দিয়ে ছোটা কোনও সহজ কথা নয়।।

গাড়ির কাছে যখন পৌঁছোল তখন সোমদত্তা অনেকটাই ভিজে গেছে। গাড়ির দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে প্রথমেই ব্যাগ থেকে ছোট তোয়ালে বের করে মাথা মুছতে লাগল। বৃষ্টিতে ভিজলে তার সমস্যা হয়।

শিরীষ যে ফোন করে নোটিশ তুলে নিতে বলেছে, সেটা উকিলবাবুকে জানানো উচিত ছিল? সে রাগের মাথায় শিরীষকে কী শর্ত দিয়েছে, সেটাও তো বলা উচিত। মনে হচ্ছে বলা উচিত। ফোন করে বলবে? ভয় ভয় করছে। ওয়াইপার চালাল সোমদত্তা। খুব বৃষ্টি পড়ছে।

সত্যি তো সন্তোষ খাস্তগিরের তিনটে পরামর্শ সে শোনেনি। উনি শিরীষ মুখার্জির বিরুদ্ধে থানায় ডায়েরি করতে বলেছিলেন। ফোর নাইনটি এইট-এ। মারধরের অভিযোগ। সঙ্গে সঙ্গে ‘না’ বলে দিয়েছিল সোমদত্তা। সন্তোষ খাস্তগির তখন বলেছিলেন, “তা হলে এক কাজ করুন। স্বামীর কাছে চলে যান। সেখানে গোলমাল পাকান। জিনিসপত্র ভাঙচুর করুন, কাগজপত্র ছিঁড়ে ফেলুন। ত্রপা মেয়েটিকে ফিজ়িক্যালি হেক্‌ল করুন। হয় এতে মেয়েটি পালাবে, নয়তো রেজ়িস্ট করবে। দুটোতেই আপনার লাভ। পালালে তো মিটে গেল। আর রেজ়িস্ট করলে আপনি সোজা থানায় গিয়ে কমপ্লেন করবে গুন্ডা দিয়ে মেরেছে। ওরা কমপ্লেন করবে। বাকিটা আমি দেখে নেব। বিষয়টা খবরের কাগজ, টিভি পর্যন্ত নিয়ে যাব। প্রেশার ক্রিয়েট করব।”

সোমদত্তা বলেছিল, “সরি, এ ধরনের গুন্ডামি আমি করতে পারব না। আমরা সোশাল প্রেস্টিজ আছে। আমার স্বামীরও আছে। একটা খারাপ মেয়ের জন্য সেই প্রেস্টিজ নষ্ট করতে পারব না।”

সন্তোষ উকিল মুচকি হাসলেন, “তা হলে আমার তৃতীয় পরামর্শ হল, আপনি শিরীষবাবুকে নিয়ে ক’দিনের জন্য কোথাও বেড়াতে যান। গিয়ে ওর মাথা থেকে চাষবাসের পাগলামি উড়িয়ে দিন। বলুন, এই দুনিয়ায় এক-একজনের জন্য এক-একরকম কাজ নির্দিষ্ট করা আছে। এর অন্যথা হলে দুনিয়ার ব্যালেন্স নষ্ট হয়ে যায়। যেমন ওর কাজ খেতের কাদায় নয়, নির্দিষ্ট করা আছে আমেরিকার চকচকে অফিসে। মাথা ঠান্ডা করে বোঝান। দেখবেন দুনিয়ার ব্যালেন্স ঠিক হয়ে গেলে, ওই সব মেয়ে-টেয়েও থাকবে না। আপনাকে একটু নরম হতে হবে এই যা।”

সোমদত্তা বলেছিল, “ইমপসিবল!”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *