মাটির দেওয়াল – ১২

১২

প্রায় সাত মিনিট হতে চলল সোমদত্তা চুপ করে বসে আছে।

বসে না থেকে উপায় নেই। সন্তোষ খাস্তগির জহর কোটের দু’পকেটই হাতড়াচ্ছেন, কিন্তু নস্যির কৌটো খুঁজে পাচ্ছেন না। তাঁর চোখ-মুখে বিস্ময়। একটা না একটা পকেটে তো জিনিসটা থাকবে। উধাও হয়ে যেতে পারে না। খোঁজাখুঁজির পর্ব শেষ না হলে মক্কেলের সঙ্গে কথায় মন দিতে পারছেন না। নস্যিগুঁড়ো হাতে নিয়ে তিনি মনসংযোগ করবেন।

সন্তোষ উকিল সাতদিন ছিলেন না। পরিবার নিয়ে পুরী বেড়াতে গিয়েছিলেন। সোমদত্তা ফোন করতে বললেন, “সমুদ্রের সামনে বসে আছি। এখানে বসে মামলার কথা আলোচনা করলে সমুদ্র বিরক্ত হবে। প্রকৃতি মামলা মোকদ্দমা পছন্দ করে বলে মনে হয় না। আপনাকে আমি ফিরে গিয়ে ফোন করব।”

আজ সকালে নিজেই সোমদত্তাকে ফোন করেছিলেন।

সোমদত্তা উৎসাহ নিয়ে বলল, “কবে ফিরলেন? আজ?”

সন্তোষ উকিল বললেন, “না, আজ নয়, দু’দিন আগে ফিরেছি।”

সোমদত্তা দমে গিয়ে বলল, “দু’দিন আগে ফিরেছেন!”

“দুঃখিত। ফিরেই আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করা উচিত ছিল।”

সোমদত্তা লজ্জা পেয়ে বলল, “আমি তা বলিনি।”

সন্তোষ উকিল বলল, “আপনি বলবেন কেন! আপনার কণ্ঠস্বর বলছে। দু’দিন আপনার কাজই করছিলাম। যাক, বাদ দিন ওসব। মিসেস মুখার্জি, কাল যে একবার আপনাকে আসতে হবে!”

সোমদত্তা বলে, “অবশ্যই যাব। আমার ভীষণ দরকার।”

“কখন আসতে চান?”

একটু ভেবে নিয়ে সোমদত্তা বলল, “রাতের স্লটে যদি যাই?”

সন্তোষ উকিল বললেন, “ভাল। রাতে শুরু হয়েছিল রাতেই শেষ হোক।”

সোমদত্তা বলল, “কিছু বললেন?”

সন্তোষ উকিল এই কথার জবাব বললেন, “আপনি রাতেই আসুন।”

আসার পর থেকে খানিকটা কথা হওয়ার পর চুপ করে বসেই আছে সোমদত্তা। সন্তোষ উকিল ব্যস্ত।

“আপনি কি কিছু খুঁজছেন?”

সন্তোষ উকিল অন্যমনস্কভাবে বিড়বিড় করে বললেন, “নস্যির কৌটোটা কোথায় রাখলাম…”

“ওটা আপনার বাঁ-হাতের মুঠোর মধ্যে রয়েছে না?”

সন্তোষ উকিল হাতটা তুলে দেখলেন। বললেন, “ধন্যবাদ।” তারপর খুব সহজভাবে বললেন, “আসলে কী জানেন ভাই, কিছু জিনিস আছে, যা আমরা হাতের মুঠোয় রেখেও খুঁজে বেড়াই। যাক, তারপর বলুন।”

সোমদত্তা বলল, “আমার মনে হয় এই দুটো ফোটো আপনার কাজে লাগবে। মেয়েটিকে আদালতে এনে নাস্তানাবুদ করা যাবে। এমনভাবে নাস্তানাবুদ যাতে আর যে কোনওদিন ভদ্র সমাজে মুখ দেখাতে না পারে।”

দু’আঙুলের টিপে নস্যি নিয়ে সন্তোষ উকিল বললেন, “দেখুন মিসেস মুখার্জি, আমি এসে জানতে পেরেছি, আপনার স্বামী লইয়ার মারফত কোর্টে, ডিভোর্স নোটিশের জবাব দিয়েছেন। জবাব হিসেবে ভাল। আমি গোড়া থেকেই জানতাম এরকম একটা জবাব আসবে। সেই কারণেই আমি মামলাটা লড়তে রাজি হয়েছিলাম।” এবার হাতের সামনে রাখা ফাইল থেকে একটা কাগজ বের করলেন সন্তোষ উকিল। সেদিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করলেন, “জবাবে বলা হয়েছে, আমার মক্কেলের ডিভোর্স দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কোনও স্বামী যদি শহর ছেড়ে গ্রামে গিয়ে থাকে, জীবিকা নির্বাহের জন্য অফিসের চাকরি ছেড়ে চাষবাস করে, তা কখনওই স্ত্রীর প্রতি তার অবহেলা, অত্যাচার বা অবজ্ঞা প্রমাণ করে না। যে কেউ পেশা বদল করতেই পারে। চাষ আমাদের দেশে গুরুত্বপূর্ণ একটি পেশা। সেনসাস রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, আমাদের দেশে প্রায় চব্বিশ কোটির মতো মানুষ কোনও না কোনওভাবে সরাসরি কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত। হয় কৃষক, নয় খেতমজুর, নয়তো নানাভাবে খেতের কাজ করেন। এদের মধ্যে একজনের স্ত্রীও কি স্বামী কেন চাষ করে বলে আদালতে ডিভোর্স চেয়েছে? কোনও উদাহরণ আছে? নেই। আর বোঝাপড়া হচ্ছে না এটাও ঠিক নয়। এক্ষেত্রে শিরীষ মুখার্জি তাঁর স্ত্রী সোমদত্তা মুখার্জির স্বাধীনতায় কোনওভাবে হস্তক্ষেপ করছেন না, তাঁর পেশায় বাধা দিচ্ছেন না, তাঁকে ধানখেতের মধ্যে গিয়ে বসবাস করতেও বলা হচ্ছে না। এটি শ্রীমতী সোমদত্তা মুখার্জির সাময়িক ক্রোধ মাত্র। অচিরেই ঠিক হয়ে যাবে। সুতরাং মহামান্য আদালত যেন মামলা হিসেব গ্রহণ না করেন।” থামলেন সন্তোষ উকিল। মন দিয়ে নস্যি নিলেন। রুমাল দিয়ে নাক মুছলেন।

সোমদত্তা উত্তেজিত গলায় বলল, “আমি তো শুধু এই কারণে ডিভোর্স চাইনি। আমি মনে করি, চাষবাস বাজে কথা। ওই মেয়েটাই নষ্টের গোড়া। আমি তো আজ প্রমাণ নিয়ে এসেছি।”

সন্তোষ উকিল একইরকম শান্তভাবে বললেন, “ঠিকই করেছেন। তা হলে আমাদের মামলাটিকে সেভাবে সাজাতে হবে। একটি অবৈধ প্রণয়কে ডিভোর্সের কারণ হিসেবে বলতে হবে।”

সোমদত্তা আরও উত্তেজিত গলায় বলল, “অবশ্যই।”

সন্তোষ উকিল নাক টানলেন, তারপর বললেন, “ভাই, আপনি তো ডিভোর্স চান না।”

সোমদত্তা থতমত খেয়ে বলল, “মানে!”

“মানে আপনি সবচেয়ে ভাল জানেন। প্রথমদিনই মনে হয়েছিল, আপনি কিছু গোপন করেছেন। আপনার কাছ থেকে টাকা নিয়ে সেই গোপন করা খবর সংগ্রহের জন্য আপনার পিছনেই লোক লাগিয়ে দিই।”

সোমদত্তা বলল, “সে কী! আপনার তো চর পাঠানো উচিত ছিল নাওডুবিতে। আমার স্বামীর সঙ্গে ওই মেয়ে কত নষ্টামি করছে, তা জানার জন্য। তার বদলে আমার পিছনে চর!”

সন্তোষ উকিল মৃদু হেসে বললেন, “পরামর্শের জন্য ধন্যবাদ মিসেস মুখার্জি। তবে সন্তোষ খাস্তগির জানে কীভাবে কাজ করতে হয়। আপনার চর আমাকে যে-রিপোর্ট দিয়েছে, তার একটিই আমার জন্য যথেষ্ট।”

রাগ কোনওরকমে সামলে সামদত্তা স্থির চোখে তাকিয়ে বলল, “চুপ করলেন কেন? বলুন কী জেনেছেন, আমার একজন এক্স বয়ফ্রেন্ড আছে? সে আমার সল্টলেকের বাড়িতে এসেছিল? তাই তো?”

সন্তোষ উকিল জহরকোটের পকেট হাতড়াতে-হাতড়াতে বললেন, “ওসব তুচ্ছ জিনিস নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। ঘামাতাম যদি আপনার স্বামী আমার মক্কেল হত।”

সোমদত্তা অস্ফুটে বলল, “তবে?”

সন্তোষ উকিল সোমদত্তার চোখে চোখ রেখে বললেন, “আপনি যতই টাকাপয়সা, কেরিয়ার নিয়ে মেতে থাকুন না কেন, আপনি আপনার স্বামীকে ভালবাসেন। একটু নয়, বেশি ভালবাসেন। সেই কারণে আপনি তাকে ফিরে পেতে চাইছেন।”

“কী করে বুঝলেন?”

সন্তোষ উকিল বললেন, “আপনি বারবার ডিভোর্স চেয়েছেন, কিন্তু তার জন্য যেসব ব্যবস্থা নেওয়া যেত, তার একটাও নেননি। আমার পরামর্শ শোনেননি।”

সোমদত্তা ঝাঁঝের সঙ্গে বলল, “ওসব কথা বাদ দিন। আপনার চর কী রিপোর্ট দিল সেটা খোলসা করে বলুন।”

সন্তোষ উকিল একটু হেসে বলল, “ওই যে বললুম। চর তো আমি নিজে। সব চরকে বাড়ি থেকে বেরোতে হয় না, কাউকে ফলো করতে হয় না। ঘরে বসে রিপোর্ট তৈরি করে। ভাই, মনের ভিতরে খবর যে জানতে পারে সেই তো আসল চর। তাই না? তবে সে ফিজ় নিয়ে কাজ করে। প্রফেশনাল।”

সোমদত্তা মাথা নামিয়ে বসে রইল। সন্তোষ উকিল এবার নরম গলায় বললেন, “মিসেস মুখার্জি, আমি এই কেস করব না। টাকাপয়সা যেমন যা নিয়েছি তার সবটাই ফেরত দিয়ে দেব। এমনকী চরবৃত্তির ফিজ়টুকুও। এই প্রথম পেশার জীবনে মামলা নিয়েও ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছি। তারপরেও মনটা ভাল লাগছে। ‘ডিভোর্স সন্তোষ’ কখনও এমন দু’জনকে আলাদা করে না, যারা আসলে একইসঙ্গে থাকতে চায়। আমাকে মাপ করবেন। যান, মামলা তুলে নিয়ে শিরীষবাবুর সঙ্গে দেখা করুন। সব মানুষ এক হয় না। আমার চর বলছে আপনার স্বামী একজন ওয়ান্ডারফুল মানুষ। ভাগ্যিস ওকালতি করতে এসেছি, নইলে, এরকম মানুষের কথা জানা হত না! ভাই, আপনিও তো আমার কাছে আসতেন না। দেখা হলে আমার অভিনন্দন জানাবেন।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *