১০
“তোর মায়ের মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে।”
শিরীষ দোতারার সঙ্গে কথা বলেছে। দীর্ঘ আলোচনা। খানিকটা তর্কও হয়েছে। মেয়ে যে তার মায়ের পক্ষ নিয়েছে এমন নয়, তবে শিরীষের হয়েও কথা বলেনি। বরং কিছু কড়া কথাই শুনিয়েছে। শিরীষও ছাড়েনি।
দোতারাও সহজভাবে বলল, “অস্বাভাবিক কিছু নয়, স্টিল নাউ, তোমারই তো বউ। মাথা খারাপ হতেই পারে।”
শিরীষ বলল, “তুই জানিস, তোর মা আমাকে ডিভোর্সের নোটিশ পাঠিয়েছে?”
দোতারার হাতে বই। বইয়ের নাম ‘সাম রেন মাস্ট ফল’। লেখকের নাম কার্ল উভে কানাউসগার। গত এক সপ্তাহ ধরে দোতারা এই বইটা নিয়ে পড়ে আছে। ফাঁক পেলেই পাতা খুলে ফেলছে। ফাঁক না পেলেও খুলছে। তখন হয়তো পড়ছে না, কিন্তু বইটা সামনে রেখে তৃপ্তি পাচ্ছে। এটা ওর ছোটবেলার অভ্যেস। একবার কোনও বইয়ের মধ্যে ঢুকে গেলে সেটা ছাড়তে চায় না। পড়ুক না পড়ুক, খাওয়া, ঘুম, বাথরুম— সবসময়ে সেই বই সঙ্গে থাকে। বিহানের সঙ্গে দেখা করার সময়েও বেশ কয়েকবার বই নিয়ে গিয়েছে। কফি বা আইসক্রিম খেতে খেতে সে বই পড়েছে, বিহান উলটো দিকে বসে থেকেছে মুখ বেজার করে। একবার ফিল্ম ফেস্টিভালেও বই নিয়ে গিয়েছিল দোতারা। বন্ধুরা মারতে বাকি রেখেছিল। সত্যি কথা বলতে কী, দোতারার এ ব্যাপারে কিছু করার নেই। কোনও বইয়ের মধ্যে ঢুকে গেলে সে চট করে বেরোতে পারে না। সেদিনও বাবার সঙ্গে কথা বলতে বসে হাত থেকে প্রথমে বই সরাতে পারেনি।
দোতারা বলল, “নোটিশের কথা জানতাম না, এই জানলাম। তবে আঁচ করছিলাম। লইয়ারের কাছে মা ছোটাছুটি করছিল।”
শিরীষ অবাক হয়ে বলেছিল, “সে কী! জেনেও তুই মাকে আটকাসনি?”
এবার বই থেকে মুখ তুল দোতারা বলল, “কেন আটকাব? আমি কি তোমাকে আটকেছি?”
শিরীষ বলল, “আমাকে আটকাবি কেন! আমি কি আটকানোর মতো কোনও পাগলামি করছি?”
দোতরা শান্ত গলায় বলল, “পাগলামি একটা রিলেটিভ ব্যাপার বাবা। তোমার কাছে যা স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে, মায়ের কাছে তা নাও মনে হতে পারে। উলটো ক্ষেত্রেও একই কথা সত্যি। মায়ের এই রিঅ্যাকশনটা হয়তো তার দিক থেকে স্বাভাবিক। তুমি পাগলামি বলছ।”
শিরীষ একটু থমকে গিয়ে বলে, “তুই কি মাকে এ ব্যাপারে সাপোর্ট করছিস তারা?’
দোতারা বলল, “আমি কাউকে সাপোর্ট করিনি, কারও বিরোধিতাও করছি না। তার প্রধান কারণ, তোমরা কেউই আমাকে জিজ্ঞেস করে কিছু করোনি। সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর জানিয়েছ। তুমি একদিন ডেকে বললে, মা তো তাও জানায়নি। তার বিরোধী পক্ষের কাছ থেকে শুনতে হল।”
শিরীষ বলল, “তোর মা আমাকে বিরোধী বলে ধরে নিলেও, আমি তার বিরোধী পক্ষ নই। সেকথা থাক। তোকে না বলা হলেও তুই তো সবই দেখতে পেয়েছিস তারা। বড় হয়েছিস, সবই বুঝিস৷”
দোতারা আবার বইয়ের পাতায় মুখ নামিয়ে বলল, “হ্যাঁ দেখেছি। দেখেছি, একদিন তোমরা দু’জনে মিলে একটা মাটির দেওয়াল ভেঙে ফেললে। একটা সহজ, সুন্দর জিনিস ভাঙতে তোমাদের সেদিন সমস্যা হয়নি। পাথরের হলে পারতে না। কারণ পাথর কঠিন। তার প্রাণ নেই। মাটির দেওয়ালকে আগলে রাখতে হয়। সে নরম, সেনসিটিভ।”
শিরীষ থমকে গিয়েছিল। মাটির দেওয়ালের প্রসঙ্গ তুলে দোতারা কি অন্য কোনও মানে করতে চাইছে? সে কি পরিবারের কথা বলছে? হতে পারে। শিরীষ বলল, “আমি ভাঙিনি, তোর মা ভেঙেছিল।”
“না বাবা, ধাক্কাটা মা দিলেও, তুমিও দায়ী।”
শিরীষ একটু চুপ করে থেকে নিচু গলায় বলল, “সব দেওয়াল রাখা যায় না তারা। আরও বড় হলে বুঝতে পারবি। যতই নিষ্প্রাণ, কঠিন হোক, পাথরেও চিড় ধরে।”
দোতারা আবার মুখ তুলে বলল, “জানি তো, তা হলে তুমি মায়ের ডিভোর্স চাওয়া নিয়ে এত মাথা ঘামাচ্ছ কেন? মা আলাদা হতে চাইলে হোক না। তোমার যেমন জীবনের একটা মানে আছে, মায়েরও তো থাকতে পারে।”
শিরীষ অবাক গলায় বলল, “স্বামী একটা ভেঞ্চারে নেমেছে বলে স্ত্রী ডিভোর্স নেবে! এটা কি হাস্যকর হয়ে গেল না?”
দোতারা সামান্য হেসে বলল, “একজন সফট্ওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারের সফট্ওয়্যার ছেড়ে লাঙল ধরাটা কি হাস্যকর নয় বাবা?”
শিরীষ বলল, “তুই কি বলছিস, আমি ভুল করেছি? সভ্যতা থেকে পিছিয়ে যেতে চাইছি?”
দোতারা বলল, “ভুল না ঠিক, আমি বলার কে? আর এগিয়ে পিছিয়ে যাওয়ার প্রশ্নই বা উঠছে কী করে? সমাজে একজন কৃষকের যেমন প্রয়োজন, একজন সফট্ওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারেরও প্রয়োজন। দুটোর কোনও একটা না থাকলেই সিভিলাইজ়েশন, ডেভলপমেন্টের ব্যালেন্স নষ্ট হয়ে যায়। শুধু চাষ করার জমি থাকলেই হয় না, জলের ব্যবস্থা করতেও ইঞ্জিনিয়ার দরকার হয়। তিনি মাটির গভীর থেকে বা দূরের কোনও খাল-বিল থেকে জল আনার কায়দা বলে দেন। বাবা, এসব তুমি আমার চেয়ে অনেক ভাল জানো৷ তোমার কি মনে হচ্ছে না, এত এফর্ট দিয়ে লেখাপড়া শেখার পর হঠাৎ একদিন মাঠের ধারে সানসেট দেখে সব শিক্ষা ছুড়ে ফেলাটা একটা ইমোশনাল এক্সপ্রেশন ছাড়া কিছু নয়? মনে হচ্ছে না, তুমি আসলে একটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছ? তুমি তো শুধু ইঞ্জিনিয়ার নও, ম্যানেজমেন্টও পড়েছ। ফ্যামিলির কথা না হয় বাদই দিচ্ছি, একটা বড় কোম্পানি তোমাকে ভরসা করে। হঠাৎ তাদের সঙ্গেও কি বিশ্বাসঘাতকতা করা হল না?”
এই বয়সে মেয়ের তর্ক করার কায়দা দেখে শিরীষ অবাক হল না। দোতারার মতো বুদ্ধিমতী মেয়ের মুখে এমন কথাই মানায়। সে আর পাঁচটা মেয়ের মতো নয়। মেয়েরা এমনিতেই বয়সের তুলনায় একটু বেশি পরিণত হয়, দোতারা অনেকের চেয়ে বেশিই পরিণত। শিরীষ একটু ভেবে, মনে মনে গুছিয়ে নিয়ে জবাব দিল।
“আমি তোর কথা অস্বীকার করছি না তারা। এটাই সাধারণ নিয়ম। কিন্তু সবাই যে সাধারণ নিয়ম মেনে চলবে, এমন তো কোনও কারণ নেই। কত মানুষ যা পড়েছেন, যা শিখেছেন, তার বাইরে গিয়ে পেশা বেছে নিয়েছেন। শিখেছেন ডাক্তারি, আর করেছেন অভিনয়, অর্থনীতি পড়ার পর ছবি এঁকেই জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন, হিসাবশাস্ত্রে পাকা হয়েও মন দিয়েছেন ফুটবল খেলায়, আবার ফুটবল খেলোয়াড় উপন্যাস লিখেছেন। তারা সবাই ভুল করেছেন? না, করেননি। এরকম বহু মানুষ পৃথিবী বিখ্যাত। এটা মানুষের নিয়ম, সমাজের নিয়ম এখানে খাটে না। যা ভাল লাগে, মন যা চায়, সেদিকে মানুষ যেতে পারে। একমাত্র মানুষই পারে। নিশ্চিন্ত চাকরি ছেড়ে ব্যাবসার ঝুঁকি নেওয়ার উদাহরণ আমরা সবসময়ই দেখছি। কেউ সাকসেসফুল হচ্ছে, কেউ ফেল করছে। তাতে রিস্ক নেওয়া কমছে? তা হলে আমি কেন নতুন প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করতে পারব না? আমার ইচ্ছে করছে শহরের র্যাট রেস ছেড়ে গ্রামে গিয়ে থাকতে, চাষবাস করতে। তাই করব। আর ওই যে বললি, হঠাৎ দিগন্তে সূর্যাস্ত দেখে ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছি, কথাটা পুরো সত্যি নয়। চিরকালই আমি আউট অব দ্য বক্স। সবাই যেমনভাবে চলে, তেমনভাবে চলতে পারিনি। এখন মনে হয়, স্বভাবটা আমার মামাবাড়ির দিক থেকে এসেছে। দাদু ঘরসংসার ছেড়ে চলে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। দুম করে খানিকটা জমি কিনেও ফেলেছিলেন। বড়মামা বাড়িঘর বেচে দেশ বেড়াতে বেরিয়ে পড়েছেন। ছোটমামা তো কবে ঘর ছেড়েছিলেন। আমার ভিতরেও কোথাও একটা এই ইনস্টিংক্ট ঘুমিয়ে ছিল। সেদিন নাওডুবি গ্রামের সূর্যাস্ত হয়তো তাকে ঠেলে ঘুম থেকে তুলেছে।”
এতটা বলে থেমেছিল শিরীষ। টেবিলে রাখা বোতল খুলে জল খেতে গিয়ে দেখল জল নেই। ফ্ল্যাটে আজকাল অনেক কিছুই গোছানো থাকে না। তালাবন্ধ হয়ে পড়ে থাকে বলে ধুলো জমে যায়। সোমদত্তা তো একেবারেই আসে না। শুধু শিরীষ চাপ দিতে সে ঘরদোর ছেড়ে চলে যায়নি, তার উকিলও তাকে পরামর্শ দিয়েছে। ডিভোর্স পেতে গেলে, একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আলাদা থাকতে হবে। দোতারা মাঝেমধ্যে এসে থাকে। তখন নিজের যেটুকু দরকার পরিষ্কার করিয়ে নেয়। একমাত্র শিরীষ এলেই ভাল করে ঝাড়পোচ পড়ে। তবে তার ব্যবধান বেড়ে গিয়েছে। গতমাসে তো কুড়িদিন ফ্ল্যাট বন্ধ ছিল।
দোতার উঠে গিয়ে রান্নাঘর থেকে বোতলে জল ভরে আনল। শিরীষ জল খেয়ে নিচু গলায় বলল, “তারা, তুই এত কিছু জানিস, এত ম্যাচিয়োরিটি তোর, আর এটা জানিস না সব কাজেই ইমোশন দরকার হয়? শুধু কবিতা লেখা বা ছবি আঁকা নয়, শুধু রাজনীতির মিটিং-মিছিল নয়, একজন সায়েনটিস্টও ইমোশন থেকে কাজ করে। ঠিকভাবে নিজের দায়িত্ব পালনকে যতই আমরা পেশাদার বলে পাশ কাটানোর চেষ্টা করি না কেন, সেটা আবেগ ছাড়া কী? দায়িত্ব পালনের আবেগ। তাই ইমোশন আছে বলে আমি কখনও লজ্জা পাই না। নাওডুবি প্রজেক্ট আমি ইমোশন দিয়েই করে দেখাতে চাই।”
দোতারা এবার একটু থতমতই খেল। বাবার উত্তর এতটা জোরালো হবে তা বুঝতে পারেনি। বোঝা উচিত ছিল। এখন যাই পাগলামি করুক, তার বাবা একজন অতি বুদ্ধিমান মানুষ। যুক্তিতে তাকে পরাস্ত করা মুশকিল। ক’দিন আগে পর্যন্ত কোনও ডিবেট কম্পিটিশনে যেতে হলে বাবার কাছ থেকে পয়েন্ট জেনে নিয়েছে। সেই মানুষটার সঙ্গেই ডিবেট করতে হচ্ছে, কঠিন তো হবেই।
দোতারা নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “বাবা, আমি কিন্তু বলিনি তুমি পারবে না। কঠিন কোনও প্রজেক্টকে উতরে দেওয়ার এফিশিয়েন্সি তোমার আছে। আমি বলতে চেয়েছি, যে যার ফিল্ডে নিজের শিক্ষা, গুণকে কাজে লাগানোটাই কি ঠিক নয়?”
শিরীষ মেয়ের প্রশংসা গায়ে না মেখে বলল, “গ্রামে কত ছেলেমেয়ে লেখাপড়া শিখে বড় হয়। গ্রাম ছেড়ে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে, গুরুত্বপূর্ণ সব কাজ করে। তাদের মধ্যে আমার মতো অনেক সফট্ওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে। তার জন্য কি গ্রামে চাষবাস করবার লোক কমে গিয়েছে? ফসল কম ফলছে? মোটেই নয়। আমার বেলাতেই বা তা হবে কেন? কোম্পানি চালানোর জন্য তোক ঠিক চলে আসবে। তা ছাড়া, এতদিন তো যা শিখেছি, তাই নিয়ে নাড়াঘাঁটা করলাম। এবার একটু ছুটি নিই।”
দোতারা হাতের বই বন্ধ করে বলল, “সরি বাবা, আমি যদি তোমাকে হার্ট করে থাকি, দুঃখিত। প্রথম তুমি যখন চাষবাসের কথা বলেছিলে, তখন তুমি একধরনের ঘোরের মধ্যে ছিলে। ভেবেছিলাম, গ্রামের কঠিন পরিবেশে থাকতে গিয়ে হার্ড রিয়েলিটি তোমাকে খুব তাড়াতাড়ি সেই ঘোর থেকে বের করে আনবে। আমি তখন যুক্তি নিয়ে তোমার মধ্যে ঢুকব। তুমি সারেন্ডার করবে।”
শিরীষ একটু হেসে বলল, “এখন কি দেখছিস, ঘোর কেটেছে?”
দোতারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “না, বেড়েছে। আরাম বিলাস ছেড়ে কঠিন জীবনে গিয়ে তুমি যেমন কালো হয়েছ, রোগা হয়েছ, তেমন চোখে এক ধরনের ব্রাইটনেসও এসেছে। ঝকঝক করছে। ঘোর লাগা চোখে যেমন হয়। সেই ঘোর থেকেই তুমি তোমার নড়বড়ে যুক্তিগুলো আরও শক্তপোক্ত করার চেষ্টা করেছ। নিজের সুবিধে মতো সাজিয়ে নিয়েছ। যাই হোক, তোমাকে কিন্তু হোলহার্টেডলি সাপোর্ট করতে পারলাম না। চাষবাস করার আরও অলটারনেটিভ মেথড তোমার কাছে ছিল। কলকাতা ছেড়ে পাকাপাকি চলে যাওয়ার দরকার ছিল না। টাকা না থাকলে তুমি যেমন নাওডুবি প্রজেক্টে নামতে পারতে না, তেমন টাকা দিয়ে ম্যানেজার রেখেও কাজ করাতে পারতে। সেখানে জলকাদা, সাপের মধ্যে ঘর বানিয়ে থাকতে হত না।”
শিরীষ বলল, “না পারতাম না। আমি গোমস্তা রেখে জমিদার হওয়ার জন্য এই প্রজেক্ট নিইনি। তা ছাড়া শহরের জীবন আমার আর ভাল লাগছে না, সেটা তো বলেছি।”
এরপর একটু চুপ করে ছিল দোতারা। তারপর গলা নামিয়ে বলেছিল, “বাবা, তুমি বরং মায়ের সঙ্গে বসে কথা বললো। আমাকে যেভাবে বললে সেভাবে বলো। মা আমার মতো অত সহজে তোমার যুক্তির নড়বড়ে দিকগুলো বুঝতে পারবে না। আমিও থাকব।”
শিরীষ উৎসাহ নিয়ে বলল, “অবশ্যই বসব। আজই বসব। তুই এখনই ফোন কর। আচ্ছা, আমি করছি।”
দোতারা তাড়াতাড়ি বলল, “তোমাকে করতে হবে না। দাঁড়াও, আমি করছি। তোমার গলা শুনে আবার চটে না যায়।”
বই সরিয়ে দোতারা ফোনে নম্বর টিপল। একবার বাজতেই সোমদত্তা তুলেছিল।
“মা, তুমি কি অফিসে?”
সোমদত্তা বলল, “না, সল্টলেকে। তুই কোথায়? ফোনে পাওয়া যায় না কেন? সকাল থেকে কতবার ফোন করছি!”
দোতারা বলল, “ফোন সাইলেন্ট করে পড়াশোনা করছিলাম।”
সোমদত্তা বলল, “সল্টলেকে এসে ক’দিন থাকতে তো পারিস। মা-ও ডাকছিল, মায়ের শরীরটা ভাল নেই। সেই জন্য আজ কামাই করেছি। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। তোর সঙ্গে আমার কথা আছে তারা।”
দোতারা বলল, “শনিবার যাব।”
সোমদত্তা বলল, “শনিবার কেন? আজই আয়। কসবায় যেতে বলেছিলাম না? গিয়েছিলি?”
দোতারা একটু ভেবে নিয়ে বলল, “এই তো আজ এসেছি। বইটই কিছু নেওয়ার আছে।”
সোমদত্তা বলল, “কাজ না থাকলেও যাবি। মাঝেমধ্যে গিয়ে রাতে থাকবি। মনে রাখবি ওই ফ্ল্যাট আমারও। ওখানে আসা-যাওয়া না থাকলে ওই নোংরা মেয়েটা এসে ঢুকে পড়বে। দখল নেবে।”
দোতারা এবার বিরক্ত হয়ে বলল, “তুমি যে কী সব উদ্ভট কথা বলো! বাবা আছে না?”
সোমদত্তা ব্যঙ্গের হেসে বলল, “তোর বাবা কী করবে? এই সব মেয়েকে ঠেকাবার ক্ষমতা তোর বাবার নেই। সে তো এখন ওই হাঁটুকন্যাকে নিয়ে পাগল! তোর বাবার হাঁটুর বয়সি বলে হাঁটুকন্যা নাম দিয়েছি। নাম ভাল হয়েছে না? তবে জেনে রাখ তারা, অত সহজ হবে না। আমি ওই হারামজাদিকে কোর্টে টেনে এনে কলগার্ল প্রমাণ করে ছাড়ব। তোমার বাবার প্রেম আমি বের করছি।”
দোতারা এবার বাবার সামনে থেকে উঠে অন্য ঘরে চলে গেল।
“মা, তুমি মাথা ঠান্ডা করো। তোমাকে বলেছি না, তোমার মুখে এসব কথা মানায় না?”
সোমদত্তা রাগে ফুঁসতে ফুসতে বলল, “তোমার বাবা যে-কাণ্ডটি করছে, সেটা মানায়? ধেড়ে বয়েসে একটা কচি খুকির সঙ্গে…সব ফাঁস করে দেব…”
দোতারা শান্ত গলায় বলল, “আমার একটা কথা শোনো। তুমি আর বাবা একবার মুখোমুখি বসো। রাগারাগি, মারামারি করো। একটা পর্যায় পর্যন্ত আমিও থাকব। বাবার প্রজেক্টটা একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়, তবে আমি নিশ্চিন্ত বাবা ওই অজ গ্রামে বেশিদিন থাকতে পারবে না। তাকে ফিরতেই হবে। কোর্টকাছারি করে সেই পথটা বন্ধ করে দিয়ো না মা। মানুষের নানারকম ইমোশন থাকে। বাবার তো অনেক বেশি। ঠিক ঘোর কাটবে। প্লিজ় মা…”
সোমদত্তা একটু চুপ করে থেকে বলল, “বাবার ব্রিফ নিয়েছিস?”
দোতারা হেসে বলল, “মেয়ে হয়ে বাবার ব্রিফ নিলে ক্ষতি কী?”
সোমদত্তা আবার একটু থেমে থেকে বলল, “বেশ, বসব। কিন্তু তার আগে, তোর বাবাকে একটা শর্ত মানতে হবে। লোকাল থানায় গিয়ে ওই মেয়ের নামে ডায়েরি করতে হবে। বলতে হবে, মেয়েটি তাকে ফাঁসিয়েছিল। এবার জালিয়াতি করে টাকাপয়সা নিতে চাইছে। ডায়েরির কপি আমাকে পাঠিয়ে দিলেই আমি বসে পড়ব। একথা আমি তোর বাবাকেও বলে দিয়েছি। এবার তুই রাজি করা। ও যত তাড়াতাড়ি হয় তত মঙ্গল৷ ওই মেয়ে তোমার বাবার মাথা কম খেতে পারবে।”
মায়ের ফোন ছেড়ে শরবত বানাল দোতারা। বরফের কিউব দিল। গতবার এসে ডিপ ফ্রিজে জল পালটে রেখে গিয়েছিল। নিজেকে নিয়ে বেশ অবাকই লাগেছে দোতারার। অনেকটা বয়স বেড়ে গিয়েছে যেন। কত ছেলেমেয়েকে তার চেয়েও কম বয়স থেকে বাবা-মাকে দেখতে হয়। রোজগার করে খাওয়াতে হয়। সে বাবা-মায়ের দায়িত্ব পালন করছে একেবারে অন্যভাবে। দূরত্ব কমিয়ে যদি কাছাকাছি আনা যায়।
প্রসঙ্গটা কীভাবে তুলবে বুঝতে পারছে না সে। বাবাকে কোনও মেয়ের একথা বলা কি ঠিক? বাবার প্রেমিকা নিয়ে বাবার সঙ্গে আলোচনা করা যায়? মনে হয় না যায়। কিন্তু এখন এসব ভাবলে চলবে না। আর সে তো সাধারণ মেয়ে নয়। তার চিন্তা ভাবনা আধুনিক। সে সমাজের তৈরি করা ঠিক ভুল নিয়ে মাথা ঘামায় না। বাবার সঙ্গে সম্পর্ক বন্ধুর মতো। আর মাকে যদি ওই ত্রপা মেয়েটা নিয়ে বকুনি দিতে পারে, বাবাকে পারবে না কেন? মা যেমন মেয়েটি সম্পর্কে অন্যায় কথা বলছে, বাবাও তাকে কাছে রেখে ঠিক কাজ করছে না। এটাও বাবার জানা উচিত।
শিরীষ আগ্রহ নিয়ে বলল, “কী বলল তোর মা?”
দোতারা কাচের গ্লাসের গায়ে জমে ওঠা জলের বিন্দুতে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “মায়ের সঙ্গে তোমার কথা হয়েছে না?”
“কথা তো অনেক হয়েছে। ডিভোর্সের নোটিশ পেয়ে তোর মাকে আমি ফোন করেছিলাম। তুই কোন বিষয় বলছিস?”
দোতারা মুখ তুলে সরাসরি শিরীষের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “ত্ৰপা নামের মেয়েটির কথা বলছি। মা ওকে মেনে নিতে পারছে না। সেটাই স্বাভাবিক।”
শিরীষ মাথা নামিয়ে বসে রইল। দোতারা নরম গলায় বলল, “শরবতটা খাও।”
শিরীষ গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল, “তোকে কী বলেছে?”
দোতারা বলল, “বাবা, ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড। কোনও স্ত্রীর পক্ষে কি এটা মেনে নেওয়া সম্ভব?”
শিরীষ সোফায় হেলান দিয়ে বসল। শান্তভাবে বলল, “তুই কি ত্রপা সম্পর্কে কিছু জানিস? জানিস সে কে? কেন সে নাওডুবিতে আমার কাছে যাতায়াত করে?”
দোতারা হেসে বলল, “না জানি না বাবা। জানতে চাইও না।”
শিরীষ শান্ত বলল, “কেন চাস না? যার বিরুদ্ধে একতরফা অভিযোগ করছিস, তার সম্পর্কে জানাটাও তো একটা কর্তব্য। নয় কি?”
দোতারা বলল, “বাবা, তুমি খামোকা রাগ করছ। আমি কারও বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ করিনি। আমি যদি তোমার কাছে ওর সম্পর্কে একটা কথাও শুনি সেটা হবে তোমার কৈফিয়ত নেওয়া। সেটায় আমি কিছুতেই রাজি হব না। আমার একটাই বলা, সে যেই হোক, মা ওকে পছন্দ করছে না।”
শিরীষ এবার চিৎকার করে উঠল, “একদম বাজে কথা, একদম মিথ্যে! তোর মা ত্রপাকে একটা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে। আমার বিরুদ্ধে অস্ত্র। সে যখন আমাকে ছেড়ে, এই বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল তখন ত্রপা কোথায়? তোর মা একজন লোভী মহিলা। সে আমার কেরিয়ার, আমার টাকাপয়সা, আমার বিদেশে গিয়ে সেট্ল হওয়া নিয়ে ব্যস্ত। সেখানে হাত পড়তেই কেঁপে উঠেছে। নাওডুবির জমিটা বড়মামার কাছ থেকে একরকম জোর করেই ও নিয়ে নেয়। পাছে আমি আটকে দিই …আমি তো নিতে চাইনি। আজ বলে নয়, কোনওদিনই সে আমাকে বুঝতে চায়নি। তুই জানিস না তারা? নিজের মাকে চিনিস না? কেরিয়ার নিয়ে তোর মা তোকে কম অতিষ্ঠ করেছে? শি ইজ় আ গ্রিডি উওম্যান। বাইরের চাকচিক্য ছাড়া কিছু চেনে না। একেকটা সময় আমার দমবন্ধ লাগত। মনে হত ভিতরের সব জানলাগুলো বন্ধ হয়ে গিয়েছে৷ এখন কেউ যদি এসে এক-একটা করে জানলাগুলো খুলে দিতে থাকে, তোর মায়ের হিংসে হচ্ছে কেন? সে ছেলে হোক, মেয়ে হোক, কী এসে যায়? মেয়ে বলে, কম বয়স বলে ত্রপা তো কোনও অন্যায় করেনি। তার মনে হচ্ছে, একটা বুড়ো মানুষের খ্যাপামির সঙ্গে থাকবে, সে আছে। ব্যস, মিটে গেল।”
শিরীষ থামলে দোতারা উঠে গিয়ে বাবার পাশে বসেছিল।
“শান্ত হও। এখন এসব ভেবে লাভ কী?”
শিরীষ একইরকম উত্তেজিত হয়ে বলল, “অবশ্যই লাভ আছে। এখনও নিজের মতো করে জীবনকে অনুভব করবার সময় আছে। সেই সুযোগ পেয়েছি আমি। তাকে কোনওভাবে হারাতে চাই না। দেবও না।’
দোতারা বলল, “বাবা, এটা কি বড্ড বেশি স্বার্থপরের মতো কথা হয়ে গেল না?”
শিরীষ বলল, “না, হল না। নিজেকে ভালবাসা কোনও স্বার্থপরতা নয়। নিজেকে ভাল না বাসলে অন্যকেই বা ভালবাসব কী করে! তারপরেও যদি মনে করিস স্বার্থপরতা, তো তাই। সব দায়িত্ব পালন করে এবার আমি না হয় স্বার্থপরই হলাম।”
দোতারা মাথা নামিয়ে চুপ করে কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর অস্ফুটে বলল, “আমার মনে হয় না, এই সমস্যার কোনও সমাধান আছে। অন্তত এখন তো নয়ই। তুমি বরং মায়ের ডিভোর্স নোটিশে রাজি হয়ে যাও। এই টানাপোড়েনের মধ্যে না থেকে একটা সেটলমেন্টে এসো।”
শিরীষ মেয়ের দিকে তাকিয়ে চোয়াল শক্ত করে বলল, “কখনও নয়। কোনওদিন নয়। আমি ডিভোর্স চাই না। আমি কোর্টে কনটেস্ট করব। দেখি, শহর ছেড়ে গ্রামে গিয়ে চাষ করবার অপরাধে তোর মা কীভাবে ডিভোর্স আদায় করে।”
দোতারা এবার মলিন হেসে বলল, “বেশ, ভাল। তোমরা যুদ্ধ করো। আমি না হয় দূর থেকে দেখে হাততালি দেব।”
শিরীষ উঠে দাঁড়ায়। বলে, “ততাকে শুধু একটা কথা বলব, যদি ইচ্ছে হয় শুনবি, না হলে শুনবি না। একবার নাওডুবিতে আয়। নিজের চোখে দেখে যা।”
দোতারা নিচু গলায় বলল, “বাবা, তুমি কি মাকে চিনতে ভুল করেছিলে?”
শিরীষও চুপ করে রইল। মেয়েকে কী বলবে সে? সোমদত্তা তাকে পুরোটা চিনতেই চাইল না। টাকাপয়সা, ঘরসংসার, অফিস প্রোমোশনের বাইরেও যে মানুষের আর একটা পরিচয় থাকে, মন থাকে, সেটা ও বুঝতে চায়নি কখনও। শুধু বাইরে থেকে গিয়েছে। মাঝেমধ্যে হাততালিও দিয়েছে। অথচ প্রথম ঘনিষ্ঠ হয়েছিল কবিতা শোনার পর। লন্ডনে, টেমস্ নদীর ধারে। ঝকঝকে ছেলে তো আরও ছিল, তারপরেও তার প্রেমে পড়েছিল সোমদত্তা। সে তো ‘অন্যরকম’ বলেই। নিজের বাবার সঙ্গে প্রথম আলাপেও তার ছবি আঁকা, অভিনয়, কবিতার কথা বলেছিল। অথচ সেই ‘অন্যরকম’-কেই মেনে নিতে পারে না। এমন তো নয় যে, শিরীষ মুখার্জি দায়িত্বজ্ঞানহীন, এমন তো নয় সে গৃহত্যাগী হয়েছে। স্ত্রী এবং মেয়ের জন্য যতটা পেরেছে দায়িত্ব পালন করেছে এতদিন। এখন তো ওরা স্বাবলম্বী। পারিবারিক সূত্রে পাওয়া একটা বড় অঙ্কের টাকা দু’জনের জন্য সঞ্চয় করে দিয়েছে। বাকিটা রেখেছে নিজের নামে। এই টাকা বাবা রেখে গিয়েছেন। শিরীষ তখন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শেষ করেছে। মা মারা গেলেন। বাবা বললেন, “কলকাতা আর আশপাশে আমাদের কিছু জমিবাড়ি, গোডাউন রয়েছে। ঠাকুরদার আমলে প্রপার্টি। আমার মনে হয় না, এই সম্পত্তি রেখে দিয়ে লাভ আছে। শিরীষ, তোমাকে দেখে মনে হয় না, সম্পত্তি গুছিয়ে রাখার যোগ্যতা বা ইচ্ছে কোনওটাই তোমার আছে। আমি মরে গেলে সব বেহাত হয়ে যাবে। চারপাশে পরিস্থিতি ভাল নয়। অন্যের জিনিস নেওয়ার জন্য সবার জিব লকলক করছে। সভ্যতার চাকা মনে হয়, উলটো দিকে ঘুরতে শুরু করেছে। অন্যের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়ার অসভ্য যুগ ফিরে আসছে। তাই ঠিক করেছি, সব প্রপার্টি বিক্রি করে তোমার জন্য টাকা আমি গুছিয়ে দিয়ে যাব।”
সেই সময় বাবার গোছানো নিয়ে একেবারেই মাথা ঘামায়নি শিরীষ। ফিরে তাকায়ওনি। ব্যাঙ্কে, পোস্ট-অফিসে আরও কিছু শেয়ার সার্টিফিকেট হয়ে পড়েছিল এতদিন। সোমদত্তাও এই টাকার খবর যে পুরোটা জানত, এমন নয়। এখন সেসব কাগজপত্র বের করছে শিরীষ। দোতারার লেখাপড়ার কোনও সমস্যাই হবে না। ইচ্ছে করলে, বাইরে গিয়ে পড়তে পারবে। তবে লেখাপড়ায় ওর যা মেধা, তাতে বাইরে যাওয়ার জন্য অন্যের টাকা লাগবে না। নিজেই স্কলারশিপ জোগাড় করতে পারবে। চাকরি ছাড়ার পর অফিস থেকেও টাকা পেয়েছে শিরীষ। তাও খুব কম নয়। তার একটা অংশ দিয়ে ‘নাওডুবি প্রজেক্ট’ শুরু করেছে। একে ইনভেস্টমেন্ট হিসেবেই দেখেছে। জমি থেকে ফসল উঠলে বিক্রি করবে আর পাঁচজনের মতোই। এ বিষয়ে শিরীষের পরিকল্পনাও হয়ে গিয়েছে। সে ম্যানেজমেন্টের ছাত্র। আগামী দিনের ‘প্রজেকশন রিপোর্ট’ হাতে নিয়ে কাজ করতে অভ্যস্থ। ‘নাওডুবি প্রজেক্ট’ এর বেলাতেও তাই করেছে। চাষবাসের খরচ বাদ দিয়ে বাকি টাকা নিজের খাওয়া-পরার জন্য রাখবে। এখনই হয়তো সব খরচ মিটবে না, তার জন্য তো ব্যাক আপ আছে। বাকি টাকা সোমদত্তা আর মেয়েকে পাঠিয়ে দেবে। তার পরিমাণও বেশি হবে না, কিন্তু সাধারণভাবে চলে যায়। এমন তো নয় তাদের ধান বিক্রির পয়সায় খেতে হবে। সোমদত্তার নিজের চাকরি আছে। সেখানে সে ভাল পোস্টে কাজ করে। বেতন যথেষ্ট ভাল। আর দোতারা? সে তার নিজের ব্যবস্থা নিজেই করে নিতে পারবে।
শিরীষ সোমদত্তাকে বারবার করে এসব কথা বুঝিয়েছে, জমানো টাকাপয়সার হিসেব দেখিয়েছে। সোমদত্তা শুনতে চাইল না। শিরীষের মনে হয়েছে, টাকাপয়সা নয়, আসলে স্বামীর মনের কথাটাই শুনতে চায়নি।
“তোমাকে অন্যরকম থাকতে কে বারণ করেছে শিরীষ? আমি বারণ করেছি? বরং আই ফিল প্রাউড। আমার অফিস কলিগ, আত্মীয়স্বজন, পরিচিত সবাই জানে, সোমদত্তার হাজ়ব্যান্ড আর পাঁচজনের মতো নয়। উইকেন্ডে পার্টি করার বদলে সে থিয়েটার দেখতে ভালবাসে, ছুটি পেলে টুরিস্ট স্পটের বদলে গ্রামে বেড়াতে যেতে চায়, শনিবার কবিতা নিয়ে থাকে, রবিবার ছবি আঁকে। শনি-রবি দুটো দিন কি তোমার অন্যরকম হওয়ার জন্য এনাফ নয়? তোমার রুচি, কালচার, তোমার যাবতীয় রোমান্টিসিজ়মের এক্সারসাইজ় কি এই দু’দিনে সেরে নেওয়া যায় না? এতদিন তো তাই করেছ। তোমার জন্য মাৰাক চাষির বউ হতে হবে?”
শিরীষ বলেছিল, “তোমাকে আমি বোঝাতে পারছি না সোম। তুমি কতগুলো ফিক্সড ধারণা নিয়ে বসে আছ। তুমি কর্পোরেটের বড় চাকুরের বউ নয়, আবার চাষির বউও নয়। এর কোনও পরিচয়টাই গর্বের নয়। তোমাকে বউ পরিচয়ে থাকতে হবে না। তুমি সোমদত্তা মুখার্জি, নিজের পরিচয়ই যথেষ্ট। তুমি আমার পাশে থাকো। তোমাকে ফিজ়িক্যালি নাওডুবিতে গিয়ে পড়ে থাকতে হবে না। কাদা-জলে নামতে হবে না, কিন্তু মানসিকভাবে এই প্রজেক্টটাকে সমর্থন করো। সবাই নিজের ভাবনা, কল্পনা, নতুন কিছু করার ইচ্ছে শনি-রবিবারের জন্য বাক্সে ঢুকিয়ে রাখতে পারে না সোম।”
সোমদত্তা ঝাঁঝিয়ে উঠে বলেছিল, “একই কথা বারবার বলছ কেন? আমি কি তোমার মেয়ের মতো বোকা? না ছেলেমানুষ? যা বলবে তাই বুঝব? চাকরি-বাকরি, ঘর-দোর ছেড়ে, কাঁধে লাঙল নিয়ে চাষ করতে যাওয়াটা কিছু করা হল?”
শিরীষ শান্তভাবে বলল, “কিছু করা হল কি না তাই নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নেই সোম, এই মুহূর্তে ভাল লাগছে বলে আমি করব। চ্যালেঞ্জিং প্রজেক্ট, খুব কঠিন, টিকে থাকাটা প্রায় অসম্ভব, সেই জন্য এত ইন্টারেস্টিং। পড়ে থাকা একটা জমিতে একেবারে গোড়া থেকে শুরু করে ফসল ফলানোর আনন্দ আমি অনুভব করতে চাই। সরল জীবনের মধ্যে থেকে নিজেকে চিনতে চাই সোম। এরপর আর সুযোগ হবে না। দাদুর মতো অসুস্থ হয়ে পড়ব, চ্যালেঞ্জ নেওয়ার সাহস, ইচ্ছে— দুটোই ফুরিয়ে যাবে। ফেল করলে ফিরে আসব। আর যদি সাকসেসফুল হই, চাষবাসের কাজ আরও একটু বাড়াব। বছরের একেকটা সময়ে একেকরকম ফসল হবে। এক্সপেরিমেন্ট হবে। কত লোকে চাকরি ছেড়ে ব্যাবসা করে, আমার এই চাষবাসটাও সেরকম ধরো না!”
সেদিন উঠে দাঁড়িয়ে শিরীষ মেয়েকে বলেছিল, “একটাই কথা বলব, রাখবি কিনা তার ব্যাপার। একবার নাওডুবিতে আয়। নিজের চোখে দেখে যা।”
দোতারা ফিসফিস করে বলে, “যাব। অবশ্যই যাব। আমি আগেই ঠিক করেছি।”
শিরীষের মুখে হাসি ফোটে। বলে, “থ্যাঙ্ক ইউ, মাই চাইল্ড। আমাকে জানাতে হবে না। হুট করে চলে আয়।”
দোতারা চকিতে মুখ তুলে বাবাকে দেখে। তারপর এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে।