মাটির দেওয়াল – ১

‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী। / তুমি থাক সিন্ধুপারে ওগো বিদেশিনী।।’

পুরুষ কন্ঠে গান হচ্ছে। তবে কেউ গাইছে না, মোবাইল বাজছে। বেজেই চলেছে। যেহেতু ফোন আধখানা চাপা পড়ে আছে বালিশের নীচে, গান তেমনভাবে শোনা যাচ্ছে না। আবছা ভেসে আসছে।

দুপুর গড়িয়ে বিকেলের দিকে। খাটে আধশোয়া হয়ে সোমদত্তা ম্যাগাজ়িনের পাতা উলটোচ্ছে। ওই উলটোচ্ছেই, পড়ছে না। একটা সময়ে খুব পড়ত। বই, ম্যাগাজ়িন হাতের কাছে যা পেত, তাই পড়ত। অনেকদিন হল সেসব বন্ধ হয়েছে। অফিস, সংসার, মেয়ে সামলে বইপত্র পড়ার সময় পায় না সোমদত্তা। যদিও দোতারা মায়ের এই কথা মানতে পারে না।

“বই পড়ার সময় নেই বলে কিছু হয় না। বই পড়তে চাইলে সে নিজেই তোমার থেকে সময় বের করে নেবে।”

সোমদত্তা বলেছে, “এত কাজে ব্যস্ত থাকলে বই পড়ব কখন?”

দোতারা বলে, “তোমার চেয়ে হাজার ব্যস্ত মানুষও বই পড়ে। আর তুমি কী এমন কাজে ব্যস্ত মা? অফিসে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছ ঠিকই, কিন্তু বাড়িতে? বাড়িতে তিনজন কাজের লোক। রান্না, ঘর ঝাড়পোছ, কাপড় কাচা সবই তো তারা করে।”

সোমদত্তা রেগে গিয়ে বলে, “আমি হাত গুটিয়ে বসে থাকি! তোকে দেখতে হয় না? তোর বাবাকে?”

দোতারা হেসে ফেলে বলে, “এই দেখতে ধারণাটাই ভুল মা। আমি নিজেই পড়াশোনা করি। আজ পর্যন্ত কখনও আমাকে পড়তে বস বা পরীক্ষার রেজ়াল্ট ভাল কর বলতে হয়নি। তারপরেও তুমি অকারণে টেনশন করো। ভবিষ্যতে কী করব, তাই নিয়ে ফালতু মাথা ঘামাও। আর বাবাকে দেখা মানে তো বাবার কেরিয়ারের উপর নজর রাখা। ঠিক মতো স্টেপ ফেলছে কি না। নিজেরটাও দেখো। বাড়ি ফিরে মোবাইলে অফিস পলিটিক্স শুরু হয়ে যায়।”

সোমদত্তা মেয়েকে ধমকে ওঠে, “বেশি পাকা পাকা কথা বলিস না! কলেজে গিয়ে তুই বেশি কথা শিখেছিস। সবাই তোকে ডেঁপো মেয়ে বলে জানিস?”

দোতারা হেসে বলে, “পড়তে গেলাম ইলেকট্রনিক্স, শিখলাম কথা। অবশ্যই আমি একজন ডেঁপো মেয়ে। ন্যাকা মেয়ের বদলে ডেঁপো মেয়ে বেটার। ন্যাকারা মুখে মিনমিন করে আড়ালে গালি দেয়। আই ডোন্ট হ্যাভ এনি আড়াল।”

সোমদত্তা চোখ পাকিয়ে বলল, “তুই চুপ করবি তারা?”

দোতারা বলে, “আমি তো চুপ করেই ছিলাম। তুমি সময়ের ঘাড়ে দোষ চাপালে তাই বলছি। আসলে কী জানো মা, যত দিন যাচ্ছে, তুমি কেরিয়ার, পার্টি, স্টেটাসে বেশি সময় দিচ্ছ। আমার লেখাপড়ার চেয়ে তোমার কলিগের ছেলেমেয়েরা যেন টপকে না যায় সেদিকে তোমার মন।”

সোমদত্তা বলল, “কেরিয়ারের দিকে তাকাব না বলছিস?”

দোতারা বলল, “তাকাবে না বলিনি তো। মন দেবে কিনা সেটা তোমার বিষয়। যদি মন দাও তা হলে আর সময়ের অভাবে বই পড়তে পারছি না কথাটা চলে না। বাবাও তো কর্পোরেটের উঁচু পোস্টে। তারপরেও তো কবিতার বই পড়া, ছবি আঁকা, থিয়েটার দেখা সব চালায়।”

সোমদত্তা বলেছিল, “তোর বাবা বিরাট প্রতিভাবান। সব পারে। আমি সাধারণ। একসময়ে অনেক পড়াশোনা করেছি, আর বই পড়া শেখাস না। সময় হলে পড়ব।”

সময় হয়েছে এখন। পঁয়তাল্লিশ বছর বয়স। মেয়ের দু’বছর ইলেকট্রনিক্স নিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া হয়ে যাওয়ার পর, কসবা থেকে সল্টলেকে মায়ের কাছে চলে এসেছে। অফিস থেকে ফিরে বেশিরভাগ সময়ে কোনও কাজ থাকে না। মায়ের সঙ্গে আর কত বসে থাকা যায়? মেয়ে আসে খুব কম। এলেও দিদিমার কাছে গিয়ে বসে। বাধ্য হয়েই খানিকটা টিভিতে হাবিজাবি দেখে, ম্যাগাজ়িন উলটোয়। বেশি বয়সে সংসার থেকে বেরিয়ে আসা খুব সমস্যার। এখন আর কলিগদের সঙ্গে অফিস পলিটিক্স নিয়ে কথা বলা যায় না। দুটো কথার পরই শিরীষের প্রসঙ্গ টেনে আনবে। একমাত্র দেবমিতার সঙ্গেই যা কথা হয়। বয়সে ছোট হলেও সে নানা ধরনের পরামর্শ দেয়। লক্ষ্য আলাদা হলেও, একই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে সেও গিয়েছে। দেবমিতা চেয়েছিল, বরের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে, সোমদত্তা চায় চাপ দিয়ে বরকে ফিরিয়ে আনতে।

‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী…’

সোমদত্তার মোবাইলে গান বেজে চলেছে। এবার আবছা হলেও শুনতে পেল সে। তার ভুরু কুঁচকে গেল। কোথা থেকে ফোন? অফিস? শনিবার অফিস বন্ধ। তবে নিশ্চয়ই মেয়ে। এই রিং টোন পুরনো। ঝট করে সোমদত্তার মনে পড়ে গেল, শিরীষ ইদানীং বলত, “গান যাই বলুক, তোমাকে চিনতে পারি না সোমদত্তা। নাকি তুমি আমায় চিনতে পারো না বলে অচেনা ঠেকে?”

বালিশের তলা থেকে মোবাইল টেনে হাতে নিল সোমদত্তা। মেয়ে নয়, শিরীষ। কেটে দিয়ে ফোন ফেলে দিল পাশে। শরীর, মন কোনওটাই ভাল নেই। দু’দিন আগেই শিরীষকে ডিভোর্সের নোটিশ পাঠানো হয়েছে, মন ভাল থাকার কথা নয়। যতই চাপ বাড়াতে নোটিশ পাঠানো হোক, বিষয়টা তো ডিভোর্স। বাইশ বছরের দাম্পত্য জীবন নিয়ে টানাটানি। না, পুরো বাইশ নয়, আট মাস কম। সাড়ে আট মাস হল সোমদত্তা সল্টলেকে তার মায়ের কাছে চলে এসেছে। শিরীষকে সে বলেওছিল।

“সত্যি যদি এমন কাজ করো, আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাব।”

শিরীষ ঠান্ডা গলায় বলেছিল, “সত্যি মিথ্যের কিছু নেই সোম। আমার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গিয়েছে। তোমার সঙ্গে তো গত তিনমাস ধরে আমি এই বিষয়ে অনেক কথা বলে আসছি। তুমি আমাকে বোঝানোর কম চেষ্টা করোনি। মেয়ে আমার সঙ্গে কথা বলেছে, তোমার মা-ও বসেছিলেন। আমার বন্ধু, অফিস-কলিগদেরও বলেছি। সবাই আটকাতে চেষ্টা করেছে। আমার কাছে খবর আছে, তুমি ডাক্তারের কাছেও গিয়েছিলে সাইকিয়াট্রিস্ট। তোমার ধারণা, আমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে।”

সোমদত্তা রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলেছিল, “তোমার কী মনে হয় শিরীষ? মাথা খারাপ হয়নি? মাথা খারাপ না হলে কেউ এ কাজ করে?”

শিরীষ তখন সোফায় বসে বই পড়ছিল। বইয়ের নাম ‘ধানের পোকা হইতে পরিত্রাণ পাইবার সহজ উপায়।’

শিরীষ একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। আইআইটি থেকে পাশ করেছে। তারপর ম্যানেজমেন্ট করেছে। সেখানে তার স্পেশ্যাল পেপার ছিল, হাউ টু ট্যাকল রিসেশন ইন মাল্টিন্যাশনাল বিজ়নেস— বহুজাতিক সংস্থায় মন্দা পরিস্থিতি কীভাবে মোকাবিলা করতে হয়। সে ধানের পোকা নিয়ে কেন বই পড়বে?

শিরীষ শান্ত গলায় বলল, “সোমদত্তা, মানুষ সবসময়ে একরকম থাকে না। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে সে বদলাতে থাকে। সেই জন্যই সে মানুষ। একটা সময় শুধু জীবন যা চায় সেই অনুযায়ী বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে না। নিজের শখ, স্বপ্নের কাছে পৌঁছতে হয়।”

সোমদত্তা দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “এটা তোমার স্বপ্ন? কই আগে জানতাম না তো! বাইশ বছর তোমার সঙ্গে ঘর করলাম। একটা স্বপ্ন চিনতে বাইশ বছর লেগে যাওয়াটা কি একটু বেশি নয় শিরীষ? আর তুমিই বা কীরকম? আটচল্লিশ বছর বয়সে এসে স্বপ্নের কথা মনে পড়ল! আমাকে ছেলেমানুষ ভাবছ?”

শিরীষ সামান্য হাসল। বলল, “মনের গভীরে কোথাও নিশ্চয় বাস করছিল। জল বাতাস পেয়ে বড় হয়ে উঠেছে। তবে বেশি বয়সে স্বপ্ন দেখতে পাওয়া তো একটা ভাল লক্ষণ। ওসব বাদ দাও, এরকম একটা সুযোগ পেয়ে গেলাম, ছাড়তে চাইল না মন।”

“এই সব তুমি কবিতায় লিখবে শিরীষ, আমাকে বোঝাতে আসবে না।”

শিরীষ মলিন হেসে বলেছিল, “কতদিন কবিতা লিখি না!”

সোমদত্তা স্থির চোখে তাকিয়ে বলল, “এই পাগলামির জন্য তুমি এত ভাল একটা চাকরি ছেড়ে দিচ্ছ!”

শিরীষ বলল, “কতজনই তো নতুন অ্যাডভেঞ্চারে যায়। যায় না?”

সোমদত্তার চোখমুখ লাল হয়ে যাচ্ছিল। কান্না পাচ্ছিল তার। পাওয়ার কথাই। শিরীষ শুধু চাকরি ছাড়ছে না, কেরিয়ারের খুব বড় একটা সুযোগ সে নষ্ট করতে চলেছে। কোম্পানি তাকে আমেরিকায় পাঠাতে চায়। সেখানে নতুন ডিভিশন খোলা হচ্ছে। ফিলাডেলফিয়ায় অফিস হবে। সোমদত্তা শুনে লাফিয়ে উঠেছিল। ঠিক করে ফেলেছিল, সেও যাবে। অফিসে লিয়েন চাইবে। নইলে কাজ ছেড়ে দেবে। ওদেশে গেলে ঠিক একটা না একটা কোনও কাজ পাওয়া যায়। মেয়ে বড় হয়ে গিয়েছে। কসবায় নিজের ফ্ল্যাট থাকা সত্ত্বেও হস্টেলে থেকে লেখাপড়া করে। অসম্ভব জেদি আর স্বাধীনচেতা হয়েছে। বলে, বাড়িতে থাকলে নাকি তার সাবজেক্ট পড়া যাবে না। প্যাটার্নই আলাদা। সংসারের মধ্যে এই প্যাটার্ন খাপ খায় না। ফলে তাকে নিয়েও ভাবনার কিছু নেই। দোতারাও ক’টা বছর বাদে চাকরি পেয়ে যাবে। তার বাবা আমেরিকায় থাকলে, ইচ্ছে করলে সেখানেও আরও লেখাপড়ার জন্য যেতে পারবে। অনেকদূর পর্যন্ত ভেবে রেখেছিল সোমদত্তা।

তার মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়েছে।

শিরীষ বলল, “কোম্পানি আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলছে বলেই তো এবার পালাতে চাইছি। তুমিও আমার সঙ্গে থাকো সোমদত্তা। চলো আমার সঙ্গে, দেখবে কত ভাল লাগবে।”

কসবার ফ্ল্যাটটা বড় এবং অতি সাজানো। ফ্ল্যাট কেনার পর সোমদত্তা ইন্টিরিয়র ডিজ়াইনারকে দিয়ে কাজ করিয়েছে। শিরীষ বলেছিল, “আমরা নিজেরাই পারব। তুমি, আমি দু’জনে মিলে করে ফেলব।”

সোমদত্তা বলেছিল, “না, পারব না। সব কাজে এক্সপার্ট লাগে। আমার এই ফ্ল্যাটে এসে যেন সবার চোখ টেরিয়ে যায়। অফিসের লোকজনকে ডাকব। আমি আর তুমি কী ধরনের লাইফস্টাইল মেনটেন করি দেখবে।”

শিরীষ অবাক হয়ে বলল, “অন্যকে দেখানোর জন্য ঘর সাজাবে!”

সোমদত্তা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে, “সমস্যা কী? অন্যকে দেখানোর জন্য যদি নিজে সাজতে পারি, ঘর সাজাতে অসুবিধে কোথায়? ওদের আমি আসতে বলেছি। ছেলেমেয়ে দলবেঁধে কাজ করে। ভাবনাচিন্তা ইনোভেটিভ। এরা আমাদের অফিসেও কাজ করেছে।”

শিরীষ বলেছিল, “অনেকগুলো টাকা খরচ হয়ে যাবে। তবে তোমার যখন ইচ্ছে, করো।”

দু’জন অল্পবয়সি ছেলে আর একটা মেয়ে এসেছিল। খরচ হলেও কাজ করেছে ভাল। প্রথমে আপত্তি থাকলেও কাজ শুরু হতে শিরীষও উৎসাহ পেল৷ ক্যাবিনেট, ফার্নিচার, পরদা— সব ওরা ডিজ়াইন করেছে। এমনকী ব্যালকনি দুটোও ওদের দায়িত্বে দেওয়া হয়েছিল। কোথায় কীরকম গাছ থাকবে, দোলনা থাকবে কোথায়, বেতের চেয়ার-টেবিল কীভাবে বসবে, কার্পেটের নকশা কেমন হবে, সব ভেবেছে। মাস্টার বেডরুম তো বটেই, মেয়ের বেডরুম কাম স্টাডিও সাজিয়েছে চমৎকার। ফ্ল্যাটের বিভিন্ন দেওয়ালে ছবি আর নানাধরনের ওয়াল হ্যাঙ্গিং ভেবেচিন্তে লাগানো। পছন্দ করবার সময় শিরীষ দোকানে গিয়েছিল। পেনটিংসের ব্যাপারে ওর খুব উৎসাহ। সবচেয়ে মন দিয়ে সাজানো হয়েছে বসার জায়গা। ছিমছাম অথচ অভিনব। তিনরকমের বসার ব্যবস্থা। সোফা, বেতের চেয়ার আর ডিভান। সোমদত্তা একটা ইনডোর ফোয়ারা চাইল। শিরীয় একেবারে হাঁই হাঁই করে উঠেছিল।

“ইস, কী খারাপ যে হবে! মনে হবে হোটেলের লবি।”

ইন্টিরিয়রের একটি ছেলে হঠাৎই মোবাইল বের করে বলল, “দেখুন তো স্যার, এটা কেমন লাগছে?”

মোবাইলে ফোটো দেখে শিরীষ মুগ্ধ হল। বলল, “বাঃ, এটা সত্যিকারের নাকি?”

“না, স্কালপচার স্যার। ইনস্টলেশন বলাই ভাল। তবে মাটি দিয়েই বানানো হয়েছে। তার ওপর রং।”

শিরীষ উজ্জ্বল চোখে বলল, “আমি এরকম জিনিস আগে কখনও দেখিনি। অবশ্যই রাজি!”

সেই ‘জিনিস’ বসার জায়গায় রাখা হয়েছে। শিরীষ তো উচ্ছ্বসিত বটেই, সোমদত্তারও খুব পছন্দ। অতি সাধারণ ভাবনা, অথচ কী অসাধারণ! ‘জিনিস’ কিছুই নয়, একটুকরো দেওয়াল। মাটির দেওয়াল। লম্বায় সাড়ে চার ফুট, চওড়ায় ফুট ছয়ের সামান্য বেশি। হঠাৎ দেখলে মনে হবে, গ্রামের কোনও মাটির বাড়ি থেকে খুলে আনা হয়েছে। ইট রঙা লাল দেওয়ালের গায়ে মাটি লেপার আঙুলের দাগ। এক কোনায় সাদা চুন রঙে খানিকটা আলপনা। যেন কাজ শুরু করে কেউ ছেড়ে চলে গিয়েছে। দেয়ালটা রাখা হল সোফার পিছনে। যেন বসলে মনে হয়, দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসা হয়েছে। গেস্ট যারাই দেখেছে চমকে গিয়েছে।

একদিন রাতে শিরীষের সঙ্গে ঝগড়ার সময় সোমদত্তা ধাক্কা দিয়ে ওই দেওয়াল ফেলে দেয়। দেওয়াল হুড়মুড়িয়ে পড়ে এবং ভেঙে টুকরো হয়। মাটি ছড়িয়ে পড়ে মেঝেতে, কার্পেটে, সোফা ও সেন্টার টেবিলের কাচে। সেদিন আবার দোতারা বাড়িতে ছিল। আওয়াজ শুনে সে নিজের ঘর থেকে ছুটে আসে। খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়ায়। ফিরে গিয়ে আবার ঘরে দরজা লাগায়। দেওয়ালটা তারও খুব পছন্দের ছিল।

তবে এই ফ্ল্যাটে মাটির দেওয়াল ভেঙে গিয়েও থেকে গেল। থেকে গেল অদৃশ্য হয়ে। সোমদত্তা এবং শিরীষ ক্রমশ দু’জনে সেই অদৃশ্য দেয়ালের দু’দিকে চলে যেতে লাগল।

শিরীষ চাকরি ছাড়ার পরদিনই, সোমদত্তা কসবার সাজানো ফ্ল্যাট ছেড়ে সল্টলেকে মায়ের কাছে চলে এসেছে আর এরও মাস তিনেক পরে সে ত্রপা নামে মেয়েটির খবর পায়।

‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী…।’

মোবাইল আবার বাজছে। এবার ফোন কানে নিল সোমদত্তা।

“কী হয়েছে?”

উলটোদিকে শিরীষ চিৎকার করে উঠল, “কী হয়েছে মানে! এটা কী পাঠিয়েছ।”

সোমদত্তা ঠান্ডা গলায় বলল, “আমি পাঠাইনি। আমার লইয়ার পাঠিয়েছে।”

শিরীষ আরও জোরে চিৎকার করে ওঠে, “এটা কী!”

সোমদত্তা নিচু গলায় বলল, “চেঁচাচ্ছ কেন? ইংরেজি পড়তে পারছ না? ডিভোর্সের নোটিশ।”

শিরীষ এবার শান্ত গলায় বলল, “তুমি কি পাগল হয়ে গেলে?”

সোমদত্তা চাপা গলায় বলল, “হ্যাঁ হয়েছি। তুমি একটা হাঁটুর বয়সি মেয়ের জন্য পাগল হলে আমি ডিভোর্স নেওয়ার জন্য পাগল কেন হব না শিরীষ? ডিভোর্স দিয়ে ওই হাঁটুকন্যাকে নিয়ে সুখে থাকো। সরি, হাঁটুর বয়সি মেয়েকে এর থেকে বেশি ভাল নামে ডাকতে পারলাম না।”

শিরীষ বলল, “তুমি নোটিশ তুলে নাও সোম।”

সোমদত্তা এবার দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “ওই বিচটার নামে থানায় ডায়েরি করে ফিরে এসো, আমিও ননাটিশ তুলে নেব।”

শিরীষ অবাক গলায় বলল, “সোমদত্তা, তুমি কার কথা বলছ! ত্রপা? তার নামে কী কমপ্লেন করব?”

সোমদত্তা রাগে ফুঁসতে ফুসতে বলল, “বলবে, ওই মেয়ে তোমাকে ফাঁসিয়েছে। শি ইজ় আ চিট, আ হোর। ক্রিমিনাল একটা। সে তোমার সম্পত্তি, টাকাপয়সা হাতানোর মতলব করেছিল। এই কমপ্লেন করে তুমি ফিরে এসো। আমি সব ভুলে যাব।”

শিরীষ বলল, “সোমদত্তা, এসব তুমি কী বলছ! ত্রপা একটি অতি ভাল মেয়ে। ওর মতো মেয়ে আমি খুব কম দেখেছি। তা ছাড়া আমি তো ফিরব না। আসবে তুমি? এই উইকেন্ডেই এসো।”

সোমদত্তা ফোন কেটে দিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠল। ওই মেয়েটা খুব ভাল! শিরীষ এটা কী বলল! সোমদত্তা কাঁদতে কাঁদতেই মোবাইলের রিং টোন বদলাতে লাগল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *