মাঝরাত্তিরের ভয়

মাঝরাত্তিরের ভয়

কেন মাঝরাত্তিরে আমার ঘুম ভেঙে গেল? কিছু একটা জোর শব্দ হল? কিন্তু আর তো কেউ জাগেনি? আমার বয়স এগারো বছর। আমি কিন্তু ভূতের ভয় পাই না একটুও। আমি শুয়ে আছি ছাদে, একটা মাদুর পেতে। কাছাকাছি আরও তিনখানা মাদুরে ঘুমোচ্ছে চাঁদুদা, ভন্তুমামা আর অচিনমামা। ওরা সকলে বড়োদের দলে।

অন্যদিন আমার নিজের দাদাও আমার সঙ্গে এক মাদুরেই শোয়। আজ দাদার জ্বর হয়েছে। জ্বর হলে ছাদে শুতে নেই, তাই আমি আজ একা।

মেয়েরা কেউ ছাদে শোয় না। মেয়েদের নাকি গরম কম লাগে।

পুরো গরমকালটা আমরা ছাদেই শুই। কলকাতায় যত গরম পড়ে, আমাদের বাগবাজারে নাকি তারচেয়েও বেশি পড়ে।

তখন অনেক বড়োলোকদের বাড়িতেও এ. সি. ঘর থাকত না। পাখা, মানে ফ্যানও থাকত না সব বাড়িতে। আমাদের বাড়িতে মাত্র একটি ঘরে একটা পাখা ছিল, বাবা-মা শুতেন সেখানে। মায়ের একটু-একটু হাঁপানির অসুখ, তাই তিনি একেবারে গরম সহ্য করতে পারেন না।

ছাদে শোওয়া বেশ আনন্দের। ঘরে শোওয়ার চেয়ে অনেক ভালো। ছাদে বেশ ফুরফুরে হাওয়া দেয়। শুতে-না-শুতেই চোখ জুড়িয়ে আসে।

ভন্তুমামা অনেক দেশ-বিদেশে ঘুরেছেন। এক এক রাত্তিরে শুয়ে নতুন-নতুন গল্প শুরু করেন। কিন্তু আমার আর সেসব গল্প শোনা হয় না। শুয়েই চোখ বুজে ঘুমের দেশে চলে যাই। প্রত্যেকদিন বাবার কাছে আমাকে রাত ন-টা পর্যন্ত সব বই নিয়ে বসে পড়তে হয়। তারপর ঘুম পাবে না?

যাই হোক, বড়ো হয়ে আমি তো এইসব দেশে যাবই। তখন এইসব গল্প আমারও জানা হয়ে যাবে।

ছাদে শোওয়ার একটাই অসুবিধে। যদি হঠাৎ মাঝরাত্তিরে বৃষ্টি নেমে আসে, তাহলেই খুব তাড়াতাড়ি মাদুর গুটিয়ে, বালিশ নিয়ে আমাদের দৌড়োতে হয়। বালিশ ভিজে গেলেই সবচেয়ে মুশকিল। একবার বালিশ ভিজলে তিন-চারদিনেও শুকোতে চায় না।

মাঝে মাঝে এমন হয়, হঠাৎ ঝুপঝুপ করে বৃষ্টি পড়তে শুরু হল, আমরা দুদ্দাড় করে নীচে নেমে এলাম। ওমা, সঙ্গেসঙ্গেই থেমে গেল বৃষ্টি, যেন আকাশের মেঘেরা আমাদের নিয়ে মজা করে। বৃষ্টি থেমে গেলেও সে রাতে আর ছাদে ফিরে যাওয়া যায় না। ছাদ ভিজে গেলে আর মাদুর পাতা হবে কী করে? সেই সব রাতে ঘরে ফিরে এলে বেশি-বেশি গরম লাগে।

…দেখলাম মাথায় ঘোমটা দেওয়া একটা মেয়ে ছাদের এই দিক দিয়ে কাঁদতে-কাঁদতে যাচ্ছে।

বড়োদের মধ্যে চাঁদুদা খুব ভীতু। এখন সে অফিসে চাকরি করে, তবু ভূতের ভয় পায়। রাত্তিরে যদি বাথরুমে যেতে হয়, তখনও চাঁদুদা একলা যেতে সাহস পায় না। অচিনমামাকে ডেকে তোলে। অচিনমামা খুব ভালো মানুষ। খুব শান্ত। মাঝরাত্তিরে শুধু শুধু ঘুম ভাঙলে কারোর ভালো লাগে? অচিনমামা রাগ করে, কিন্তু বেশি না, একটু-একটু। চাঁদুদার সঙ্গে যায়।

একদিন মাঝরাত্তিরে চাঁদুদা জেগে উঠে বলতে লাগল, ‘ও কী? ও কী? কে? কে?’

এমনই জোরে চেঁচিয়ে উঠল যে ঘুম ভেঙে গেল আর সকলের।

ভন্তুমামা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে? কী হয়েছে?’

চাঁদুদা বলল, ‘তোমরা কান্নার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছ? একটা মেয়ে কাঁদছে?’

আমরা সকলে কান পেতে শোনার চেষ্টা করলাম। কই, কেউ তো কাঁদছে না। এমনকী হাওয়ার শব্দও নেই।

চাঁদুদা বলল, ‘আমি যে স্পষ্ট শুনলাম, আর দেখলাম মাথায় ঘোমটা দেওয়া একটা মেয়ে ছাদের এই দিক দিয়ে কাঁদতে-কাঁদতে যাচ্ছে।’

ভন্তুমামা বলল, ‘তুই ভুল দেখেছিস! ভুল শুনেছিস!’

চাঁদুদা তবু জোর দিয়ে বলল, ‘না, আমি স্পষ্ট দেখেছি!’

ভন্তুমামা বলল, ‘ছাদের দরজা বন্ধ। একটা মেয়ে আসবে কোথা থেকে? আকাশ থেকে?’

অচিনমামা বলল, ‘তুই স্পষ্ট দেখবি কী করে? তখন তো তোর চোখ বোজা ছিল। তার মানে তুই ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে এসব দেখেছিস।’

ভন্তুমামা বলল, ‘চাঁদু, তুই যত ইচ্ছে স্বপ্ন দেখ? কিন্তু বিচ্ছিরিভাবে চেঁচিয়ে আবার আমাদের জাগিয়ে দিলে কিন্তু এরপর গাঁট্টা খাবি!’

গাঁট্টা মারার ভয় দেখিয়েও কিন্তু চাঁদুদাকে থামানো যায়নি। আরও দু-বার এরকম স্বপ্ন দেখে চেঁচিয়ে উঠেছে। চাঁদুদা সবসময় ভয়ের স্বপ্ন দেখে। আমি কিন্তু ভালো-ভালো স্বপ্ন দেখি। শুধু পরীক্ষার দু-চার দিন আগে একটা বাজে স্বপ্ন দেখে ভয় পেয়ে যাই। স্বপ্নটা হচ্ছে, আমি যেন পরীক্ষার হলে বসে সব প্রশ্নের উত্তর লিখে শেষ করতে পারছি না, তার আগেই ঘণ্টা পড়ে যাচ্ছে!

আসলে কিন্তু পরীক্ষার সময় ওরকম কিছুই হয় না। সব কোয়েশ্চেনই তো ঠিকঠাক লিখে ফেলি। আমি কোনো পরীক্ষায় ফার্স্ট হইনি বটে, তবে এবছরই থার্ড হয়েছি। ফার্স্ট হয় আমার বন্ধু ধূর্জটি, সে আমার খুব বন্ধু। আমি মোটেও তাকে ডিঙিয়ে যেতে চাই না।

আজ রাতে আমার ঘুম ভেঙে গেল কেন? কীসের শব্দ? না:, কিছু তো নেই।

আমার ঘুম একেবারে চলে গিয়েছে। আমি পুরো চোখ মেলে তাকিয়ে আছি।

আকাশে আজ এক ছিটে মেঘ নেই। অসংখ্য তারায় ঝকঝক করছে আকাশ।

আমার ভূতের ভয় নেই, কারণ আমাকে যে বাবার কাছে পড়াশোনা করতে হয়। পড়ার বইয়ের বাইরেও অনেক কিছু শিখিয়ে দেন বাবা।

একদিন ভূতের কথা উঠেছিল। মা মাঝে মাঝে অন্ধকারে ভয় পান। বাবা বলেছিলেন, ‘শোনো, অন্ধকারে চোর-ডাকাত লুকিয়ে থাকতে পারে, সে জন্য সাবধান হতে হয়। কিন্তু ভূত থাকলেও তো ক্ষতি নেই। ভূত তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না, তা জান?’

আমি ঠিক বুঝতে পারিনি। ভূত যদি থাকেই, তাহলে ক্ষতি করবে না কেন? সব গল্পেই তো ভূতেরা খুব পাজি হয়।

মাও বলেছিলেন, ‘তোমার যত সব অদ্ভুত কথা।’

বাবা হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘ভূত ব্যাপারটা তো অদ্ভুত। বাংলার ভূতের আর একটা নাম অশরীরী। তার মানে কী? যার শরীর থাকে না। মানুষ মরে গেলে কিছুতেই তার শরীর থাকতে পারে না। যার শরীর নেই, সে যদি ভূতও হয়, তোমার সামনে এলেও কিছুই করতে পারবে না। তার হাত নেই, তাই গলা টিপে দিতে পারবে না। মুখ নেই, তাই কামড়ে দিতে পারবে না। আর যদি খানিকটা ধোঁয়া-ধোঁয়া মতো চেহারা হয়, যেমন অনেক ছবিতে দেখা যায়, তাহলে খুব জোরে ফঁ¥ দিয়ে উড়িয়ে দেবে। সে তো তোমাকে ছুঁতে পারবে না!’

আমি বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘বাবা, ভূত কি কথা বলতে পারে?’

বাবা বলেছিলেন, ‘দূর বাবা, যদি মুখ না-থাকে, গলা না-থাকে, তাহলে কথা বলবে কী করে? কোনো শব্দই করতে পারবে না!’

বাবা আরও অনেক কিছু বলে আমাদের পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।

আমার মাসতুতো বোন টুলটুলি বেশ ভীতু। তার মা তাকে একটা ছড়া শিখিয়ে দিয়েছে,

ভূত আমার পুত

পেতনি আমার ঝি

রামলক্ষ্মণ বুকে আছে

করবি আমায় কী!

এখন সেই ছড়াটা শুনলে আমার হাসি পায়।

আমি শুধু মনে মনে বলি, অশরীরী, অশরীরী! যার শরীরই নেই, সে আবার কী করবে!

তাহলে মাঝরাত্তিরে আমার ঘুম ভেঙে গেল কেন?

এই সময় ছাদের দরজার দিক থেকে একটা কালো চেহারার মূর্তি দেখতে পেলাম। ভূত নয় জানি, তবু বুকটা একটু ভয়ে কেঁপে উঠল কেন?

চোর কিংবা ডাকাত?

ছাদে শোওয়ার সময় আমাদের কারো কাছেই তো টাকাপয়সা থাকে না। চোর-ডাকাত আমাদের কী করবে?

যদি আমাদের মেরে নীচে বাবা-মাকেও মারতে যায়?

ধ্যাৎ! এসব কিছুই না। কালো মূর্তিটা কাছে এলে বুঝলাম এ তো ভন্তুমামা। নিশ্চয়ই বাথরুম করতে গিয়েছিল।

আমি আর কোনো কথা বললাম না। ভন্তুমামা গিয়ে শুয়ে পড়ল নিজের মাদুরে।

একটু পরেই পিচপিচ করে তার নাক ডাকতে লাগল।

আমার কিন্তু কিছুতেই আর ঘুম এল না।

একটু বাদে কী যেন একটা কালো রঙের পাখি উড়ে গেল! কালো পাখি দেখলে ভয় পাওয়ার কী আছে! তবু কেন আমি চমকে উঠলাম?

এটা একটা বাদুড় নিশ্চয়ই।

কাছেই জমিদার রায়বাড়ির সামনে অনেকটা বাগান আছে। ওখানে বাদুড় যায়।

আর একটা প্যাঁচাকেও দেখেছি মাঝে মাঝে। সেটা আবার তারের উপর বসে ডাকে।

এই দুটো পাখিকেই দেখা যায় রাত্তির বেলা। ধূর্জঢি বলেছিল, বাদুড় কিন্তু পাখি নয়। যদিও উড়তে পারে, তবু বাদুড় একটা প্রাণী। সব পাখিরা ডিম পাড়ে, বাদুড় ডিম পাড়ে না। তাদের পেট থেকে আস্ত-আস্ত বাচ্চা বেরোয়!

এইসব এলেবেলে কথা মনে আসছে, কিন্তু ঘুম আসার আর নাম নেই।

আকাশ ভরতি এত তারা। বাবা বলেছেন, ‘যত তারা দেখতে পাই, তার মধ্যে অনেকগুলো ওখানে নেই। সেই তারাগুলো অনেক বছর আগেই মরে গিয়েছে। তবু আমরা দেখতে পাচ্ছি!’

কথাটা কিছুতেই আমার মাথায় ঢোকে না, যে তারা নেই সেটাকেও আমরা দেখতে পাই কী করে? বাবা তো আর ভুল বলবেন না!

তারাগুলো মরে গেলে কি ভূত হয়?

আবার ভূতের কথা? এঃ, এটা আমার ভাবা উচিত নয়। তারাগুলো তো জ্যান্ত প্রাণী নয় যে মরে যাবে? যাদের জন্ম হয়, তারাই এক সময় মরে। আমাদের স্কুলের বইতে একটা পদ্য আছে, ‘জন্মিলে মরতে হবে, অমর সে কোথা কবে?’

কিন্তু বাবা যে বলেছেন অনেক তারা মরে যায়। তাহলে তাদের জন্মও হয় নিশ্চয়ই।

আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করি কোন কোন তারা মরে গিয়েছে। কিছুই বোঝা যায় না।

আমরা আকাশে তাকিয়ে যা দেখি, সবই তারা বলে ভাবি। কিন্তু এটা আমি জানি, তারাও আছে, গ্রহও আছে। যেগুলো পিটপিট করে, সেগুলো তারা, আর যেগুলো একেবারে স্থির সেগুলো গ্রহ। আমাদের সূর্যের যেমন অনেক গ্রহ আছে, সেরকম অন্য অনেক নক্ষত্রেরও গ্রহ আছে।

কত তারা আর গ্রহ আছে আকাশে?

আজও নাকি কোনো বৈজ্ঞানিকই তা গুনে শেষ করতে পারেননি।

কোটি-কোটি-কোটি-কোটি তারা, কত দূর, কত দূর।

আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে একসময় মনে হল, আমি যেন মহাশূন্যে ভেসে যাচ্ছি। কোথায় যাব?

ওরে বাবা, অতসব গ্রহ-নক্ষত্রের মধ্যে আমাদের এই পৃথিবীটা নাকি বেশ ছোটো। তার মধ্যে আমি একটা এগারো বছরের ছেলে, আমি কতটুকু? এক বালির চেয়েও ছোটো!

তাহলে আমি ভেসে-ভেসে কোথায় যাচ্ছি। এক্ষুনি তো হারিয়ে যাব!

উপরের দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে আমি যেন দেখতে পেলাম, এই আকাশ ছাড়িয়ে আরও আকাশ, আরও কোটি-কোটি গ্রহ-নক্ষত্র, তার মধ্যে আমি একটি বালির কণার চেয়েও ছোটো, উড়ে যদি হারিয়ে যাব, এক্ষুনি হারিয়ে যাব।

ভয়ে আমার সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।

না, না, আমি হারিয়ে যেতে চাই না, চাই না!

আমি ধড়মড় করে উঠে বসলাম। ভয়ে আমার শরীর এখনও কাঁপছে।

আমি তাড়াতাড়ি মাদুরটা গুটিয়ে আর বালিশটা বগলে নিয়ে ছুটে চলে এলাম নীচে।

আমার মায়ের ঘুম খুব পাতলা। একটু শব্দ পেয়েই জেগে উঠে মা বললেন, ‘কে রে? নীলে নাকি?’

‘হ্যাঁ মা।’

‘কেন, নেমে এলি কেন? বৃষ্টি পড়ছে?’

সেকথা তো আমি বলতে পারি না, আমি আকাশ দেখে ভয় পেয়েছি, একথাও তো বলা যায় না।

আমি বললাম, ‘মা, তোমার পাশে শুতে ইচ্ছে করছে।’

মা আর কিছু জিজ্ঞেস না-করে হাত বাড়িয়ে বললেন, ‘আয়, এখানে আয়।’

আমি ধুপ করে শুয়ে পড়লাম মায়ের পাশে। মা আমাকে জড়িয়ে ধরতেই আমার মনে হল, এখান থেকে আর আমি হারিয়ে যাব না!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *