মাঝরাতে অতিথি
মাঝরাত্তিরে অনেকগুলো কুকুর একসঙ্গে ডাকছে। সেই ডাক শুনে সনাতন গোস্বামীর ঘুম ভেঙে গেল।
গ্রামের একেবারে এক প্রান্তে সনাতনের বাড়ি। বাড়ি মানে দু’খানা খড়ের ছাউনির মাটির ঘর আর সামনে এক চিলতে দাওয়া। বুদ্ধ সনাতন আর তার বউ মানদা ছাড়া সে বাড়িতে আর কোনো তৃতীয় প্রাণী নেই।
মানদা ঘুমিয়ে আছে, সনাতন উঠে বসল। এত কুকুর ডাকছে কেন? ডাক শুনে মনে হয় কুকুরগুলো কারুকে তাড়া করেছে। চোর এল নাকি? কিংবা বাঘডাসা? বাঘডাসা ঠিক বাঘ নয়, নেকড়ের মতন একরকম প্রাণী, গায়ে সাদা সাদা ছোপ আছে। ওরা হাঁস—মুরগী চুরি করতে আসে।
সনাতনের বাড়ির পরেই বিস্তীর্ণ জলাভূমি, তার মাঝে ঝোপ—জঙ্গলও রয়েছে, সেখানে নানা রকম জন্তু—জানোয়ার আছে।
চোর হলেও চিন্তার কিছু নেই। কারণ সনাতনের বাড়িতে কোনো চোর ভুল করেও ঢুকবে না। ঢুকলে তার পরিশ্রমটাই নষ্ট।
সনাতন বৈষ্ণব মানুষ। সে হাঁস—মুরগী পোষে না, সুতরাং বাঘডাসাও আসবে না। তবু মাঝরাতে এ রকম কুকুরের ডাক শুনলে গাটা ছমছম করে।
কুকুরগুলো প্রায় ঘরের পাশে চলে এসেছে আর হিংস্রভাবে গর্জন করছে। সনাতন চৌকি থেকে নেমে পড়ল। তার বাড়ির দরজাটা খুব পলকা, কেউ জোরে ধাক্কা মারলে খুলে যাবে। যে রাতে খুব ঝড়—বৃষ্টি হয়, সেই সব রাতে সনাতন তার টিনের সুটকেসটা টেনে এনে দরজার সঙ্গে ঠেস দিয়ে রাখে। অন্য রাতগুলোতে দরকার হয় না। এই গরীব বুড়ো—বুড়ির কাছে রাত্তিরবেলা তো কেউ আসবে না।
সনাতনের একটি মাত্র ছেলে ছিল। অনেকদিন আগে সে নদীতে ভেসে গেছে। তার কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। ওদের আর কেউ নেই। সনাতন গান গেয়ে সংসার চালায়। তা বলে সে ভিক্ষে করে না। প্রত্যেক দিন ভোরবেলা সে গ্রামের পথ দিয়ে ভগবানের গান গাইতে গাইতে যায়। কোনো বাড়ির দরজার সামনে থামে না। তার গান শুনে অনেকের ঘুম ভাঙে। মাসের প্রথমে গ্রামের লোকেরা নিজে থেকেই তার বাড়িতে কিছু কিছু চাল, ডাল, ফল—তরকারি আর দু’একটি করে টাকা পৌঁছে দিয়ে যায়। সনাতন একটু একটু কবিরাজী চিকিৎসাও জানে। আগে তার কাছে কিছু কিছু লোক আসত। কিন্তু এখন পাশের গ্রামে একজন নতুন পাস—করা ডাক্তার এসেছে বলে সনাতনের চিকিৎসার ওপরে কেউ ভরসা করে না।
হুড়মুড় করে একটা শব্দ হলো। কী যেন একটা বেশ বড়সড় প্রাণী দরজা ঠেলে ঢুকে পড়েছে পাশের ঘরে। সেই শব্দে মানদারও ঘুম ভেঙে গেল। সে ভয়ে চিৎকার করে উঠল, কে? কে?
পাশের ঘরে কোনো জন্তু ঢোকেনি, ঢুকেছে একজন মানুষ। মানদার চিৎকারের উত্তরে পাশের ঘর থেকে শোনা গেল, চুপ! চুপ!
যে ঢুকেছে সে বাইরের দরজাটা বন্ধ করে দিল। তারপর দু’ঘরের মাঝখানের দরজাটায় এসে দাঁড়াল। অন্ধকারের মধ্যেও বোঝা গেল একজন বিশাল চেহারার লোক। সে ধমকের সুরে বলল, চুপটি করে থাকো, কোনো শব্দ করবে না। গোঁসাই, এদিকে এস, বাতি জ্বালো!
এ ঘরেই একটা তাকের ওপর কুপি আর দেশলাই থাকে। কিন্তু কুপি জ্বালতে গিয়ে সনাতনের হাত থরথর করে কাঁপতে লাগল। এ রকম ঘটনা তো তার জীবেন আগে ঘটেনি। ছোটো নদীতে ভেসে যাবার পর তার জীবনে আর কোনো ঘটনাই ঘটেনি।
সনাতনের চেয়ে মানদার সাহস বেশি। সে জিজ্ঞেস করল তুমি কে? মাঝরাতে আমাদের ঘরে ঢুকে পড়লে?
ছায়ামূর্তি কর্কশ গলায় বলল, আমি কে তা জেনে তোমার দরকার নেই? যদি প্রাণে বাঁচতে চাও, আমি যা বলছি তাই করো। বিছানা থেকে ওঠো, ঘরে কি খাবার আছে, বার করো!
আট—দশটা দেশলাই—এর কাঠি নষ্ট করে সনাতন কুপিটা জ্বালল।
সেই আলোতে মানুষটাকে দেখে আরও ভয় লেগে গেল। সাংঘাতিক চেহারা! মুখভর্তি দাড়ি—গোঁফ, চোখ দুটো জ্বল জ্বল করছে, সারা গায়ে জল—কাদা মাখা, তার ডান হাতে একটা মস্ত বড় ছোরা। লোকটা দাঁড়িয়ে আছে এক ঠ্যাঙে, আর একটা পা মোড়া, সেই পায়ের ঊরুর কাছে জমাট বেঁধে আছে রক্ত।
লোকটা ছুরিটা তুলে বলল, টুঁ শব্দ করলে খুন করে ফেলব! আমার পায়ে গুলি লেগেছে, তিনদিন জল—কাদার মধ্যে লুকিয়ে ছিলাম। গোঁসাই, তোমার কি ওষুধপত্তর আছে লাগিয়ে দাও। আর ঘরে কী খাবার আছে শিগগির আনো, খিদেয় আমার নাড়িভুঁড়ি হজম হয় যাচ্ছে!
লোকটা বোধহয় এতখানি হেঁটে এসেছে মনের জোরে। এবারে সে দরজার চৌকাঠের সামনেই লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল কাত হয়ে, ছুরিটা রাখল মাথার কাছে। তারপর ফিসফিস করে বলল, আমার সঙ্গে কোনো রকম চালাকি করার চেষ্টা করো না। এখনও গায়ে যে—টুকু শক্তি আছে তাতে তোমাদের মতন দুটো বুড়ো—বুড়িকে সাবাড় করে ফেলতে পারব।
সনাতন এবারে কাতরভাবে বলল, বার বার ওকথা বলছ কেন, বাবা! আমাদেরই মারলেই বা কী আর না মারলেই বা কী! আমাদের বাড়িতে অতিথি হয়ে এসেছ, আমরা যে—টুকু পারি সেবা করব।
লোকটি বলল, আমার পায়ে অসহ্য ব্যথা। ওষুধ দাও।
সনাতন এবারে এগিয়ে এসে লোকটির ঊরু পরীক্ষা করে দেখল। যেখানে গুলি ঢুকেছে সেখানে কুচিকুচি মাংস আর পুঁজ জমে এর মধ্যেই থকথকে ঘা হয়ে গেছে। গুলিটা বেরিয়ে গেছে না ভেতরেই রয়েছে তাই—বা কে জানে। সনাতনের অত বিদ্যে নেই।
সনাতন বলল, এর চিকিৎসা আমি কি করব বাবা? এ যে অনেক বড় ব্যাপার। পাশের গ্রামে ভালো ডাক্তার আছে, তুমি তার কাছে যাও! যদি বল তো, আমি তোমাকে ধরে ধরে নিয়ে যেতে পারি।
লোকটি বলল, চুপ! ওসব কথা শুনতে চাই না। তুমি যা পারো শিগগির করো।
সনাতনের কাছে খানিকটা পুরনো মলম আছে, তা—ই লাগিয়ে দিতে হবে। সে আগে জলের কুঁজো এনে ক্ষতস্থানটা ভালো করে ধুয়ে পরিষ্কার করতে লাগল।
লোকটা যে কে তা এতক্ষণে সনাতন বুঝে গেছে। তিন রাত আগে এখান থেকে খানিকটা দূরে খলসেখালি গ্রামে দারুণ ডাকাতি হয়েছে। তবে ডাকাতরা নিশ্চিন্তে লুটপাট চালাতে পারেনি। ডাকাতরা দু’জন লোককে মেরে প্রচুর জিনিসপত্র নিয়ে যখন পালাবার উপক্রম করেছে, তখন পাশের গ্রামের জমিদার হরবল্লভ রায় আর তাঁর ভাই ঘোড়ায় চেপে বন্দুক নিয়ে উপস্থিত। তাদের গুলি খেয়ে একজন ডাকাত সেখানেই মারা যায়, দু’জন আহত অবস্থায় ধরা পড়ে, আর বাকিরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালায়।
এই লোকটা নিশ্চয়ই সেই পলাতক ডাকাতদেরই একজন। এই ক’দিন জলায়—জঙ্গলে লুকিয়ে ছিল।
মানদা পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
লোকটি বলল, কই, খাবার দিলে না?
মানদা বলল, ও ঘরে যেতে হবে। যাব কী করে?
লোকটি বলল, আমায় ডিঙিয়ে যাও।
মানদা বলল, জ্যান্ত মানুষকে কেউ ডিঙিয়ে যায় নাকি? সে আমি পারব না।
লোকটি চোখ কটমট করে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল, তারপর অতি কষ্টে মাথাটা সরাল। সেই ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে গেল মানদা।
লোকটি সনাতনকে বলল, তোমার বউকে ডেকে দাও, যে যদি বাইরে বেরিয়ে গিয়ে গ্রামের লোকদের ডেকে আনে, তাহলে কিন্তু তুমি বাঁচবে না। এই বাড়িতেও আগুন ধরিয়ে দেব। তারপর আমার যা হয় হবে।
সনাতন বলল, তুমি কথায় কথায় খুনোখুনির কথা বলছ। আমরা স্বামী—স্ত্রীতে কোনোদিন একটা পিঁপড়েও মারিনি। তুমি খাবার চেয়েছ, ও ঠিক খাবার এনে দেবে।
ক্ষতটা পরিষ্কার হয়েছে কোনোমতে। এবারে মলম লাগাতে হবে।
চৌকিটার নীচে সনাতন তার ওষুধ—পত্তর রাখে। সেখানে মাথা গলিয়ে সে মলম খুঁজতে লাগল।
লোকটা আর ধৈর্য রাখতে পারছে না। সে বিকৃত গলায় বলল, কই কো গোঁসাই, এত দেরি হল কেন? তোমার বউ খাবার নিয়ে এল না।
সনাতন বলল, এই যে আসছি, আসছি!
ওষুধ নিয়ে এসে সনাতন ক্ষতস্থানে লাগাতেই লোকটি যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল। সে বলতে লাগলো, উঃ, জ্বলে গেল! জ্বলে গেল! ও গোঁসাই, কী লাগালে?
সনাতন বলল, ওষুধে তো একটু জ্বালা করবেই বাবা! একটু পরে কমে যাবে।
সনাতন এক টুকরো কাপড় দিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল সেই জায়গাটায়। মানদা একটা কলাই—করা থালায় খানিকটা খই আর একটু পাটালি গুড় এনে বলল, এখন এই খেয়ে নাও। কাল সকালে ভাত রেঁধে দেব!
লোকটি অদ্ভুত চোখে মানদার দিকে তাকিয়ে বলল, কাল সকালে? হেঃ! ততক্ষণ আমি থাকছি আর কি! সূর্য ওঠার আগেই আমাকে সটকে পড়তে হবে। দাও দাও, কী আছে দাও!
সেই খই জলে ভিজিয়ে তাতে পাটালি গুড় মাখিয়ে লোকটা হ্যাঁংলার মতন গপ গপ করে খেতে লাগল।
কিন্তু সবটা সে খেতে পারল না। হঠাৎ তার মাথাটা ঢলে পড়ল। চোখ দুটো গেল বুঁজে।
মানদা বললে, আহা রে! ঘুমিয়ে পড়েছে। শরীরের ওপর এত ধকল সহ্য হবে কেন? থাক, জেগে উঠে বাকিটা খাবে!
সনাতন বলল, ঘুমোয়নি। অজ্ঞান হয়ে গেছে!
মানদা বলল, এই লোকটা একটা ডাকাত, না গো?
সনাতন বলল, তাতে আর সন্দেহ আছে? দেখছ না, মুখখানা একেবারে রাক্ষসের মতন।
মানদা বলল, ঘুমোলে কিন্তু সব মানুষেরই মুখ সরল দেখায়!
সনাতন লোকটির হাত থেকে ছুরিটা খুলে নিয়ে চৌকির তলায় সরিয়ে রাখল। তারপর বিড়বিড় করে বলল, একটা খুনে! পাপী! শিলের নোড়াটা এনে ওর মাথাটা ছেঁচে দিলেই নিশ্চিন্ত হওয়া যায়!
মানদা আঁৎকে উঠে বলল, সে কি! তুমি লোকটাকে মেরে ফেলার কথা ভাবছ নাকি? সে কি গো?
সনাতন বলল, একটা নৃশংস খুনী! ওর বেঁচে থেকে লাভ কী? কত মানুষ মেরেছে। আরও কত মারবে। আমাদের অসহায় বুড়ো—বুড়ি পেয়ে কতবার মেরে ফেলার ভয় দেখাচ্ছিল। আমরা বুঝি কিছু করতে পারি না?
মানদা বলল, ছি ছি অমন কথা মনেও স্থান দিও না। হ্যাঁগো, এই লোকটার চোখ দুটো দ্যাখো, আর নাকটা? অনেকটা আমাদের খোকনের মতন নয়?
সনাতন বলল, যাঃ কী যে বলো। আমাদের খোকন অনেক সুন্দর ছিল। একটা ডাকাতের সঙ্গে তুমি ওর তুলনা করছ?
মানদা বলল, একেও দেখতে খুব খারাপ নয়। মুখে দাড়ি—গোঁফ জঙ্গল হয়ে আছে! আচ্ছা, লোকটা তো এ গ্রামের কেউ নয়। একে কোনোদিন দেখিনি। কিন্তু তোমাকে চিনল কী করে? তোমাকে গোসাঁই বলে ডাকছে। তুমি যে ওষুধ—পত্তর দাও, তা ও জানে!
সনাতন বলল, আশেপাশের আট—দশখানা গ্রামের মানুষ সনাতন গোস্বামীকে চেনে। তুমি ভাবো কী?
মানদা ধরা গলায় বলল, আমাদের খোকন বেঁচে থাকলে এত দিনে এত বড়োটিই হতো। হ্যাঁ গো, আমাদের খোকনই ফিরে আসেনি তো? নদীতে ভেসে গিয়েছিল, হয়তো মরেনি। কোনো দূর দেশে গিয়ে উঠেছিল।
সনাতন বলল, কী যে বলো তুমি! তা কখনও হতে পারে? যদি বা বেঁচে থাকে আমাদের খোকন ডাকাত হবে কেন? বৈষ্ণবের রক্ত আছে তার গায়ে!
মানদা বলল, যদি কোনো খারাপ লোকের পাল্লায় পড়ে থাকে। হয়তো কোনো ডাকাতের বাড়িতেই সে মানুষ হয়েছে!
সনাতন বলল, থাক ওসব বাজে কথা। চলো আমরা শুয়ে পড়ি। খোকন যখন নদীতে ভেসে যায়, তখন তার চোদ্দ বছর বয়েস। যদি সে বেঁচে থাকত, তাহলে সে তখনই বাড়ি ফিরে আসতে পারত না? এই লোকটা খোকন হলে নিজের বাড়ি চিনতে পারত না? আমাদের ওরকম ধমকে ধমকে কথা বলবে! একটা ডাকাতকে তুমি নিজের ছেলে ভাবছ। হুঁঃ!’
মানদা বলল, প্রথমে ওরকম কথা বলছিল, পরে নিশ্চয়ই সব খুলে বলতো! খুঁজে খুঁজে আমাদের বাড়িতেই এসেছে। তাছাড়া ও যে ডাকাত তা বুঝলে কী করে? যারা দেশের কাজ করে তাদেরও তো পুলিশে গুলি করে মারতে চায়। আহা, আমার কাছে খাবার খেতে চাইল ঠিক আমার খোকনের মতন। খোকন খুব পাটালি গুড় ভালবাসতো।
হুুঁঃ, যত সব! বলে সনাতন ফুঁ দিয়ে কুপিটা নেভাতে যেতেই মানদা বলল, দাঁড়াও, একটা জিনিস দেখি। আমাদের খোকনের বাঁ কানের পেছনে একটা কাটা দাগ ছিল মনে আছে। সেই যে একবার বঁটি নিয়ে খেলা করতে গিয়ে কেটে গিয়েছিল! দ্যাখো তো এর সেই রকম দাগ আছে কিনা!
সনাতন বলল; ডাকাতের গায়ে কত রকম কাটা—ছেঁড়া দাগ থাকে। ওরকম মিল থাকলেই বা কি?
মানদা বলল, তবু তুমি একবার দ্যাখো!
কুপিটা এগিয়ে অজ্ঞাত লোকটির বাঁ কানটা উল্টে দু’জনেই এক সঙ্গে দেখল। ঠিক সেখানে একটা কাটা দাগ! লোকটির মুখে বা গায়ে আর কোথাও কিন্তু কোনো কাটা দাগ নেই!
মানদা চেঁচিয়ে উঠল, এই তো খোকন, এ নিশ্চয়ই আমাদের খোকন!
সনাতনও আর ঠিক অবিশ্বাস করতে পারল না। কাঁপতে কাঁপতে সে কুপিটা নামিয়ে রাখল। জল গড়িয়ে পড়ল তার চোখ দিয়ে। দু’হাত জোড় করে সে মুখটা উঁচু করে বিড়বিড় করে বলতে লাগল, ঠাকুর, তুমি আমায় রক্ষা করেছ। তুমি আমায় বড় বাঁচা বাঁচিয়েছ!
মানদা আনন্দে চ্যাঁচামেচি করছে, তবু সনাতন কোনো সাড়া দিচ্ছে না.। তখন মানদা অবাক হয়ে সনাতনের দিকে তাকাল। আর তখন তার নজরে পড়লো সনাতনের পাশে রাখা ছোট্ট হোমিওপ্যাথি শিশিটা।
সে হাহাকার করে লবলে উঠল, একি? তুমি ওষুধে বিষ মিশিয়ে দিয়েছ নাকি? হায়, হায়, কী সর্বনাশ করেছ! আমাদের খোকন!
সনাতন এবারে মানদার হাত চেপে ধরে বলল, না, দিইনি, বিশ্বাস করো দিইনি। একবার দিতে ইচ্ছে করছিল, সত্যি কথা বলছি! কিন্তু পাপের ভয়ে দিতে পারিনি।
সত্যি বলছ দাওনি?
সত্যি দিইনি!
ওই ছোট্ট শিশিটায় রয়েছে কেউটে সাপের বিষ। একবার গ্রামের ছেলেরা একটা কেউটে সাপকে মারছিল, তখন সনাতন তার বিষদাঁতটা কামিয়ে বিষটা জমিয়ে রেখেছিল। সুঁচের ডগায় সামান্য একটু ওই বিষ অনেক সময় মুমূর্ষু রোগীদের খাইয়ে দিলে তারা বেঁচে ওঠে। কিন্তু মলমের মধ্যে ওই বিষ মিশিয়ে দিয়ে সেই মলম কাটা জায়গায় লাগালে নির্ঘাৎ মৃত্যু।
মানদা বলল, খোকনকে ডাকো! ওর জ্ঞান ফিরিয়ে দাও!
সনাতন বলল, দাঁড়াও, আস্তে আস্তে জ্ঞান ফিরবে। খোকন সত্যিই ফিরে এসেছে? খোকনের সঙ্গে এর মুখের অনেক মিল আছে তো সত্যি!
মানদা বলল, আমার খোকন কিছুতেই ডাকাত হতে পারে না। আহা রে, ছেলেটা কত কষ্ট পেয়েছে! বুকটা একেবারে কাদায় মাখামাখি!
মানদা একটা গামছা এনে লোকটির বুকের কাদা মুছে দিতে লাগল। মুছতে মুছতে হঠাৎ এক সময় বলল, দ্যাখো তো, এটা কি?
সনাতন ঝুঁকে পড়ে দেখল, লোকটির বুকে একটা লাল, গোল দাগ। খুব ছোট গাড়ির চাকার মতন।
সনাতন বলল, এ তো জড়ুল! জন্ম জড়ুল! খোকনের তো এরকম ছিল না।
মানদা ব্যাকুলভাবে জিজ্ঞেস করল, পরে হতে পারে না? সনাতন বলল, না, এ তো জন্মের সময় থেকেই হয়। দাঁড়াও, আর একটা জিনিস দেখি তো!
সনাতন লোকটির মুখখানা ফাঁক করে দেখল। তারপর সনাতনের মুখে হসি ফুটে উঠল।
সে বলল, এই দ্যাখো, এই লোকটার সব ক’টা দাঁত রয়েছে। খোকনের সামনের ওপরের একটা দাঁত ভাঙা ছিল না? নতুন করে তো দাঁত গজাবে না! এ আমাদের খোকন হতেই পারে না!
মানদার মুখখানি ফ্যাকাসে হয়ে গেল। আপন মনেই বলে উঠল, যাঃ, খোকন নয়! খোকন ফিরে আসবে না!
সনাতন বলল, আর খোকনের কথা ভেব না। চলো শুয়ে পড়ি!
মানদা উঠে দাঁড়াতেই লোকটির বুকে বিচ্ছিরি শব্দ হতে লাগল। যেন গাড়ির চাকা চলছে। একটু পরে অ্যাঁক করে শব্দ হয়ে সব থেমে গেল।
সনাতন লোকটির ডান হাতের নাড়ি দেখে বলল, যাঃ, সব শেষ!
মানদা বলল, সব শেষ? না, না, না, ওকে বাঁচানোর চেষ্টা করো। ওকে ওইটা দাও!
মানদা হাত দিয়ে ছোট শিশিটা দেখাল।
সনাতন বলল, কী বলছ পাগলের মতন কথা। ওটা দিলে এখন কী হবে? তাছাড়া ও মরেছে, আপদ গেছে! ও বেঁচে উঠলে আবার কী কাণ্ড করত কে জানে! হয়তো আমাদের মেরে রেখে যেত।
মানদা বলল, তা বলে শেষ চেষ্টা করবে না? ওকে ওটা একবার দিয়ে দ্যাখো অন্তত।
সনাতন বলল, আমি পারব না, আমার হাত কাঁপছে। তুমি যদি পার তো দাও!
মানদা বিছানার তলা থেকে একটা সুঁচ নিয়ে এল। সেটা বিষের মধ্যে ডুবিয়ে বার করে ফুঁ দিয়ে দিয়ে বেশিটা ঝরিয়ে নিল। তারপর সেই সুঁচটা ছোঁয়াল লোকটার জিভে।
কোনো কাজ হলো না। লোকটা একেবারে নিথর।
মানদা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
সনাতন তার পিঠে হাত দিয়ে বলল, আর কাঁদছ কেন? যা হবার ভালোই হয়েছে, ও তো খোকন নয়। একটা ডাকাত!
মানদা বলল, তুমি কি ওর মলমে বিষ দিয়েছিলে? তাহলে এবার আর কোনো কিছুতেই কাজ হবে না!
সনাতন বলল, না, দিইনি। সত্যি দিইনি। বিশ্বাস করো।
মানদা বলল, হ্যাঁ, তুমি বিষ দাওনি! তবু আমি কাঁদছি, ও খোকন না হলেও একজন মানুষ তো! চোখের সামনে একজন মানুষ মরে গেলে কাঁদব না?
মানদার চোখের ফোঁটা ফোঁটা জল ঝরে পড়তে লাগল লোকটার বুকের ওপর।