মাঝদরিয়ার মহাপ্রহরী
এমন রাগ হয়েছিল! ওই পাইলট লোকটার উপরে! মুখে কি কিছুই আটকাতে নেই মানুষের? জাহাজ থেকে নেমে যাওয়ার সময় দাঁত বার করে না-বললেই কি চলত না, ‘ওহে, বলতে ভুলে গেছি, গ্রিমসির সেই জাহাজখানা, মাত্র ছয় ঘণ্টা আগে যাকে এই বন্দর থেকে আমিই বাইরে এনেছিলাম, সে নাকি সাবাড় হয়ে গিয়েছে টর্পেডোর এক ঘায়ে! দ্যাখো এখন, মানে তোমরা হুঁশিয়ার—’
কথাটা শেষ না-করেই ও নিজের ডিঙিতে চড়ে বসেছিল। সে ডিঙি তরতরিয়ে বন্দরে ফিরে গেল। অনামুখো ওই পাইলট এতক্ষণে হোটেলের টেবিলে চিংড়িভাজা চিবুচ্ছে, আর আমরা—
সামনে লম্বা রাত, আঁধার রাত, অকুস্থান উত্তর সাগর, কাল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গোড়ার দিক। জার্মান সাবমেরিনের ঘায়ে ইংরেজি জাহাজ দৈনিক ঘায়েল হচ্ছে ডজনে ডজনে। গোয়েবলস বলেই দিয়েছে রেডিয়োতে, ‘নর্থ সি-কে জার্মানদের খিড়কির পুকুর বলে যেন গণ্য করে সবাই, ওখানে শত্রুপক্ষ যেন অনধিকার প্রবেশ না-করে।’
তবু আমাদের করতেই হচ্ছে প্রবেশ। অধিকার কার যে কতখানি, তা চূড়ান্তভাবে প্রমাণ যতক্ষণ না-হচ্ছে, করতেই থাকব প্রবেশ। আমাদের এই ‘র্যাভেন্স-উইং’, বছর চৌদ্দো আগে স্কটল্যান্ডের হাল বন্দরে তৈরি, মাল বইতে পারে আট হাজার টন, অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদের বোঝাই নিয়ে এসেছিল সুইডেনের কোনো বন্দরে, মাল খালাস করে ফিরে যাচ্ছে নিজের দেশে, আবারও মাল বোঝাই নেবার জন্য। সে মাল হয়তো পৌঁছে দিতে হবে আফ্রিকায় বা আরবসাগরের কোনো দ্বীপে—
যদি না-জার্মান সাবমেরিনের টর্পেডো এই যাত্রায়ই তার সমুদ্রভ্রমণের কর্মসূচিতে ইতি টেনে দেয়। এমন তারা দিচ্ছে অনেকের। পরের পালাটাই যে আমাদের নয়— একথা কেউ বলতে পারে না। বরং হতচ্ছাড়া পাইলটটার কথার ইঙ্গিত যেন এইরকমই যে, শিকেটা এবারে আমাদের ভাগ্যে ছিঁড়বারই সম্ভাবনা প্রবল। জার্মানরা যেন তাদের খিড়কি পুকুরের এই কোণেই ইদানীং মৎসশিকারে উৎসাহী হয়ে উঠেছে বড়ো বেশি পরিমাণে।
বেলা তিনটে এখন। ইস্পাতের মতো ধূসর সমুদ্রের রং। কোনো সাবমেরিন যদি দুই মাইলের ভিতরও নাক জাগায়, তাকে দেখতে না পাওয়ার হেতু নেই কিছু। অবশ্য রাত্রির অন্ধকার ঘনিয়ে এলে অবস্থা দাঁড়াবে অন্যরকম। কিংবা অন্ধকার ঘনিয়ে আসার আগেই যদি ওই কুঞ্ঝটিকার প্রাচীরটা—
হ্যাঁ, অনেকক্ষণ থেকেই লক্ষ করছি পশ্চিম দিগন্তে কালবৈশাখীর ঘনঘটার চাইতে জমাট একটি কুPটিকার দেয়াল! সেটা স্থির হয়ে আছে, না অতিসন্তর্পণে এগিয়ে আসছে এদিক পানে ইঞ্চি ইঞ্চি করে, তা এতদূর থেকে বোঝা সহজ নয়। কিন্তু ধরা যাক যে, ঘণ্টাখানিকের মধ্যে হাওয়াটা জোরালো হয়ে উঠল এবং কুয়াশার পাহাড়টাকে ঠেলে ছুটিয়ে দিল আমাদের দিকে—
তাহলে সাবমেরিনেরা যত উঁচুতেই তুলুক নাক, মালুম হবে না জাহাজ থেকে। অবশ্য অসুবিধাটা সেক্ষেত্রে একতরফাই হবে না, নাক যতই তুলুক, সাবমেরিনের চোখও অন্ধ হয়ে আসবে কুয়াশার আঁধারে।
ক্যাপ্টেন দুটো পর্যন্ত ডিউটি দিয়ে এই একটু আগে কেবিনে ঢুকলেন। এখন জাহাজের দায়িত্ব আমার উপর, কারণ আমি হচ্ছি প্রথম মেট। দায়িত্বটা যে মামুলি ছয় ঘণ্টার চাইতেও অনেক অনেক বেশিক্ষণ টানতে হবে একনাগাড়ে, সেটা তখনও বুঝতে পারিনি।
বুঝতে পারলাম এই শুভমুহূর্তেই, যখন জার্মান সাবমেরিনের পেরিস্কোপের সঙ্গে শুভদৃষ্টি হয়ে যাওয়ায় প্রত্যাশায় এক-পায়ে খাড়া হয়ে আছি। হঠাৎ ক্যাপ্টেনকে দেখলাম তাঁর কেবিনের দরজায়। এমনটা তাঁকে দেখা যায় কদাচিৎ। ডিউটি যখন না-থাকে, ঝড়ঝাপটার দিন না-হলে তিনি টেনে ঘুম দেন, পরবর্তী খাওয়ার ঘণ্টা না-বাজা পর্যন্ত।
একে তো তাঁকে এমন সময় দেখতে পাওয়াই এক অসাধারণ ব্যাপার, তায় আবার তাঁর মুখের চেহারাও যেন কেমন অস্বাভাবিক মনে হল এই মুহূর্তে। এগিয়ে গিয়ে বললাম, ‘স্যার, কোনো কিছু দরকার আছে নাকি?’
কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখলাম, ভদ্রলোক জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছেন, আর ভর দিয়েও দাঁড়িয়েছেন দরজার কাঠামোতে।
‘দরকার! অ্যাস্পিরিন আছে নাকি? অ্যাস্পিরিন? তলপেটের ব্যথাটা আজ আবার চাগাড় দিয়েছে এই অসময়ে।’
আজ আবার? তার মানে তাহলে এই যে, ব্যথাটা মাঝে মাঝেই হয়? তলপেটে মাঝে মাঝে যে ব্যথা হয়, সেটা অ্যাপেন্ডিসাইটিস হওয়ার বাধা কোথায়? তাই যদি হয়ে থাকে, তাহলে তো সোনায় সোহাগা!
বললাম, ‘থার্মোমিটার আছে আপনার?’
তিনি বিরক্ত হয়ে জবাব দিলেন, ‘থার্মোমিটার কী হবে? জ্বর তো হয়নি আমার!’
‘অ্যাস্পিরিন আনছি।’ বলে চলে গেলাম, এক মিনিটের মধ্যে নিয়ে এলাম থার্মোমিটার। ক্যাপ্টেন তখন শুয়ে পড়েছেন কেবিনে ঢুকে। থার্মোমিটারে জ্বর উঠল এক-শো চার। লোকটার তলপেটে হাত দিয়ে দেখি, শক্ত যেন পাথর। আর দেখতে হবে না, দুই ঘণ্টার ভিতর এঁর অস্ত্রোপচার করা দরকার, করলেই হাতের মুঠির পরিমাণ একটা অ্যাপেনডিক্স টেনে বার করা যায় পেটের ভিতর থেকে।
কিন্তু উত্তর সমুদ্রের মধ্যিখানে অ্যাপেন্ডিসাইটিসের অপারেশন করে কে? ক্যাপ্টেন আর টেঁকেন না দেখি এযাত্রা।
ভাঁড়ারিকে বললাম, ব্রান্ডি আনতে, খাইয়ে দিলাম একেবারে আধ বোতল রোগীকে। ওঁর যা ব্যারাম, ব্রান্ডি নিশ্চয়ই ওষুধ নয়, কিন্তু আমি এখন করছি কী? ব্রান্ডিতে ব্যথাটা কম থাকবে, সেইটাই লাভ। ‘একবার ব্রান্ডি, একবার অ্যাস্পিরিন চালিয়ে যাও’— এই নির্দেশ ভাণ্ডারীকে দিয়ে, ক্যাপ্টেনের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিলাম। কারণ বাইরে থেকে একটা কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে—
‘কী যেন একটা কী দেখা যাচ্ছে বাঁ-দিকে। মাইল খানিক দূরে। মনে হয় যেন সাবমেরিনের পেরিস্কোপ।’
বাঃ! চমৎকার! যা ভাবা গিয়েছিল, তাই। অলক্ষুণে পাইলট যে-আশীর্বাদ করে বিদায় দিয়েছিল, ফলে গেল তাই নির্ঘাত। পকেট থেকে টেলিস্কোপ তুলে চোখে লাগাবার আগে একবার ডেকটার উপরে চোখ বুলিয়ে আনলাম। যতগুলি লোক দেখা গেল, প্রত্যেকের মুখে লক্ষ করলাম একটা বেপরোয়া ব্যগ্রতা।
ঠিক! ওই তো! ও তো ভুল করবার জিনিস নয়। পাতলা একটা ছাইরঙা রেখা, সুচের মতন। আমাদের জাহাজের বাঁ-দিকে। এগিয়ে আসছে, একটা আঁকাবাঁকা বীচিবিভঙ্গ পিছনে রেখে। দ্বিতীয় মেট কার্টার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে আমায়, গুন-টানা ধনুকের ছিলার মতো টানটান হয়ে আছে ছোকরা, আমার হাত থেকে দূরবিন নেবার সময় হাত তার কাঁপছিল উত্তেজনায়।
জাহাজের গতিপথ পালটানো দরকার এক্ষুনি, দিলাম কর্ণধারকে সেই আদেশ। গতিবেগ কিছু বাড়ানো চাই, নীচে টেলিগ্রাফে খবর দিলাম ইঞ্জিনিয়ারকে। তারপরে আবার ধরলাম দূরবিন। গতিপথ ঘুরিয়ে দেওয়ার দরুন ডুবোজাহাজের নাকটা এখন ঠিক আমাদের নাক-বরাবর এসে পড়েছে। কয়েক মিনিটকাল সেই লিকিলিকে রেখাটা নিজের পথেই চলতে লাগল, যেন আমরা কী করছি না-করছি,তাতে কিছুই তার আসে যায় না।
কিন্তু সে তার ভাঁওতা। কী যে সে করবে, তা আগেই বুঝেছিলাম আমি। সে করলও তাই। গতিপথ সেও পালটে ফেলল। তার পেরিস্কোপ আবারও এগিয়ে আসছে বটে আমাদের দিকে, তবে এবার ডানদিক থেকে।
‘দেখেছে আমাদের।’ বলল কার্টার।
‘নিশ্চয়।’ জবাব দিলাম আমি। কার্টার আমার দিকে তাকাল সেই দৃষ্টি নিয়ে, যা হামেশাই দেখা যায় একান্ত-পোষা সারমেয়শিশুর চোখে। আবার গতিপথ পালটানো প্রয়োজন মনে হল, গতিবেগ আরও বাড়িয়ে দিলাম, মনে হল পেরিস্কোপটা পিছনে পড়েছে, আর ব্যবধানও তার বেড়ে যাচ্ছে আমাদের সঙ্গে।
কিন্তু সে আর কতক্ষণ? সেটুকু ব্যবধান সে ঘুচিয়ে দিল পরক্ষণেই। এবারে সে সোজা আসছে আমাদেরই লক্ষ করে। কার্টার চোখা চোখা দিব্যি গালছে, যারা ডিউটিতে নেই, এমন সব নাবিকই ডেকের উপরে এসে ঝুঁকে পড়েছে রেলিংয়ের উপর। দৃষ্টি তাদের ওই ছাইরঙা রেখাটার উপরে নিবদ্ধ।
‘ও এবারে উঠবে।’— বলল কার্টার, ‘ফেনা ভাঙছে যেখানে, ওইখানেই উঠবে, তাকিয়ে দ্যাখো।’
ঠিক বলেছে ও। জলটা এতক্ষণ ছিল স্থির, এইবার তাতে আলোড়ন উঠছে একটা। এইবার সেই আথালপাথাল জলের ভিতর থেকে ডুবোজাহাজটা আস্তে আস্তে জাগতে লাগল, প্রথমে পর্যবেক্ষণের চ্যাপ্টা মঞ্চ, তারপরে জলযানটার লম্বা সরু পরিপূর্ণ অবয়ব, যা থেকে জল গড়িয়ে নামছে প্রপাতের আকারে।
আমার নাবিকেরা এই জলপিশাচটার দিকে তাকিয়ে আছে এক আশ্চর্য ঔদাসীন্যের সঙ্গে, যেন তারা মজার খেল দেখছে একটা, যে মজার সঙ্গে তাদের নিজেদের নিরাপত্তা কোনোমতেই এতটুকুও জড়িত নয়।
ওদের নিরাপত্তার প্রশ্ন অবশ্য ওদেরই মাথা-ঘামাবার ব্যাপার নয়, সে সম্বন্ধে চিন্তা করবার জন্য ক্যাপ্টেন আছেন। আসল ক্যাপ্টেন কিন্তু অ্যাপেন্ডিসাইটিসের ব্যথায় অজ্ঞান হয়ে আছেন নিজের কেবিনে, বর্তমান সংকটের মুহূর্তে ক্যাপ্টেন বলতে যে-অযোগ্য ব্যক্তিটিকে বোঝাচ্ছে, সে হচ্ছে মেট ব্লান্ট অর্থাৎ খোদ আমি।
ওয়াটালুতে ইম্পিরিয়াল গার্ডের আক্রমণে বেসামাল হতে হতে ওয়েলিংটন নাকি চেঁচিয়ে উঠেছিলেন, ‘হয় ব্লুকার, নয় রাত্রি!’ ওই জার্মান সাবমেরিনের আসন্ন আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য উপায় না-দেখে আমিও বলে উঠলাম, চেঁচিয়ে নয় অবশ্য, মনে মনেই বললাম, ‘হয় কুয়াশা, নয় রাত্রি!’
পাহাড়-সমান জমাটি একটা কুয়াশার সমারোহ অনেকক্ষণ থেকেই দিগন্তে দেখা যাচ্ছিল, ওইটি যদি কোনো ম্যাজিকের জোরে চট করে এইখানে টেনে আনা যায় এই মুহূর্তে, তাহলে তার আড়ালে আত্মগোপন করা সম্ভব হতে পারে আপাতত। রাত্রি? তাকে তো ঠিক সময়ের পাঁচ মিনিট আগেও কোনো ম্যাজিকেই নামানো যায় না কোনোদিন!
ওয়েলিংটনের বরাতজোর ব্লুকার এসে পড়েছিলেন প্রুশীয় সৈন্য নিয়ে। র্যাভেন্স-উইং-এর তিন ডজন মনুষ্যসন্তানেরও বরাতের জোর কম ছিল না সেদিন, যে কুয়াশা দূরের বস্তু ছিল এতক্ষণ, হঠাৎ, ভাগ্যদেবতার নিশ্বাসপবনের ধাক্কাতেই বোধ হয়, উড়ে এল ঝড়ের বেগে। রাখেন যিশু মারে কে? দেখতে দেখতে সাবমেরিনের দেহটা আবার ডুব দিল জলের নীচে, নাকটা হয়তো জাগিয়ে রেখেছে উপরে, কিন্তু আমাদের নজরে সে আর আসছে না।
কুয়াশা— ভিজে, ভারী, নিরেট কুয়াশা ঘিরে ধরেছে আমাদের। এক ফুট দূরের জিনিস চোখে দেখছি না। আঁধারি লণ্ঠন জ্বেলে কাজ করছে নাবিকেরা, কাজ করছে যতদূর সম্ভব নিঃশব্দে। র্যাভেন্স-উইং নিঃশব্দে পালাচ্ছে। পেরিস্কোপ যেখানটায় দেখা গিয়েছিল, ঠিক তার উলটোদিকে পালাচ্ছে। অবশ্য সোজা লাইন ধরে নয়, পাঁচ-দশ মিনিট বাদে বাদেই গতিপথ অল্প অল্প পালটে। বলা তো যায় না, দুশমন ধারেকাছেই আছে হয়তো।
অবশেষে রাত্রি এল, আর আমরাও আপাতত নিঃশঙ্ক হলাম, কয়েক ঘণ্টার জন্য। জানি না, ভোরের আলো ফুটবার সঙ্গে সঙ্গে আবার পেরিস্কোপ চোখের সামনে ভেসে উঠবে কিনা ইস্পাতরঙা স্থির সমুদ্রে। যেটা আজ দেখেছি, সেটাকে ফাঁকি দিলেও হয়তো দিতে পারি। কিন্তু সেটা ছাড়া আরও তো সাবমেরিন আছে জার্মানদের এই খিড়কি পুকুরে! শত শত আছে। তাদের সবাইকেই ফাঁকি দিতে পারব, এমন কী কথা?
রাত্রি এসেছে, কালো রাত্রি। আকাশে মেঘ আছে কি না, ঠাহর হচ্ছে না, কিন্তু না-থাকলেও এই কুয়াশার আস্তরণ ভেদ করে আমাদের কাছে কোনো আলোর দূতকে পাঠিয়ে দেবে এমন নক্ষত্র আজও জন্মায়নি অন্তরীক্ষে। নিরেট অন্ধকার, ভিজে কুয়াশা, সমুদ্র নিঃসাড়ে ঢেউ ভাঙছে ফসফোরাসের আভায় র্যাভেন্স-উইংয়ের কালো অঙ্গের দুই-এক ফুট মাত্রকে ঈষৎ আলোকিত করে।
ঢেউ নিঃসাড়ে ভাঙছে বটে, কিন্তু নিজোরে নয়। র্যাভেন্স-উইং এই মুহূর্তে গভীর গহ্বরে নেমে যাচ্ছে, পরের মুহূর্তেই লাফিয়ে চড়ে বসেছে পাহাড়ের চূড়ায়। জলদানবেরা যেন ওয়াটারপোলোর বল বানিয়ে নিয়েছে জাহাজখানাকে, লোফালুফি করছে মনের আনন্দে।
তা করুক। ওতে কোনো ক্ষতি হবে না। বরং লাভ হতে পারে অন্য দিক দিয়ে। সাবমেরিনের পক্ষে তরঙ্গের এই বিক্ষোভ ভারি বিরক্তির জিনিস। সে নিশ্চয় এতক্ষণ গভীর জলে ডুব দিয়েছে। অপেক্ষা করে আছে, কতক্ষণে ভেসে উঠবার মতো অনুকূল অবস্থা হবে সমুদ্রের উপর মহলে।
সে আছে প্রতীক্ষায়, আমরা আছি আশঙ্কায়। দারুণ অস্বস্তি একটা।
হঠাৎ একটা কণ্ঠ ভেসে উঠল এই অস্বস্তির পরিবেশে, ‘ডাইনে যেন জাহাজ দেখা যায়।’ উপরের মাচা থেকে পাহারাদারের সতর্কবাণী এটা।
র্যাভেন্স-উইং তখন একটা গভীর গহ্বরের তলায়। এই মুহূর্তে চারদিকে দেখছি শুধু জল আর জল। কিন্তু পরক্ষণেই জাহাজ ভেসে উঠল ঢেউয়ের মাথায়, আর তক্ষুনি দেখতে পেলাম, একটা জমাট কালো স্তূপ একটানা দৈর্ঘ্যে এলিয়ে পড়ে আছে সমুদ্রের বুকে, ক্বচিৎ তার কোনো ফাঁক দিয়ে আলোর একটা ক্ষীণ আভাস চকিতের জন্য দেখা দিয়ে তখনই মিলিয়ে যাচ্ছে আবার নিবিড় আঁধারে।
কতদূর হবে? এক ফার্লং? তার কম তো নয়ই। কারণ, তার চেয়ে নিকটে হলে ওই অজানা জলযানের নড়নচড়ন হেলানিদোলানি এমনধারা অদৃশ্য থাকত না। তাকিয়ে আছি তাকিয়ে আছি, হঠাৎ একটা বাঁশির সুরের ক্ষীণ রেশ ভেসে এল সমুদ্রবক্ষের উপর দিয়ে। ওটা তাহলে জাহাজ নিশ্চয়। সারেং-এরই বাঁশি বেজে উঠেছে ওই জাহাজে।
আমি ওকে ডাকব কি ডাকব না? ও মিত্র না শত্রু? মিত্র হওয়ার সম্ভাবনা কোথায়?
অন্ধকারে যতটা ঠাহর করা যাচ্ছে, তাতে বাণিজ্যজাহাজ বলে ওকে মনে হয় না। অত লম্বা, অত উঁচু, যুদ্ধজাহাজ হওয়ারই সম্ভাবনা ওর! কিন্তু কোনো ইংরেজ যুদ্ধজাহাজ এ-সমুদ্রে তো এই মুহূর্তে থাকবার কথা নয়। বিশেষ, নিছক একা!
কিন্তু আমার ডাকাডাকির জন্য ওরা বসে নেই। চোঙ-এর ভিতর দিয়ে আওয়াজ এল অন্ধকারকে মথিত করে, ‘অ্যাহয়! কে তোমরা? কোনো বিপদ ঘটেছে নাকি?’
যাক, কতকটা নিশ্চিন্দি। কথা যে কইছে, সে ইংরেজ, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু তবুও আমি হঠাৎ জবাব দিচ্ছি না। সাবধানের মার নেই। আর একটু বাজিয়ে দেখা যাক ওই অপরিচিত জাহাজকে। একটুখানি অপেক্ষার পরে আবার সেই কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘কী জাহাজ তোমরা? কোথায় চলেছ?’
র্যাভেন্স-উইং যুদ্ধজাহাজ নয়, নাবিকেরা নিয়মের অনুবর্তী হলেও একেবারে স্বাধীনতাবর্জিত নয়। আমাকে নীরব দেখে একজন কেউ হঠাৎ হেঁকে উঠল, ‘আমাদের আধ মাইল সমুখেই দুশমনের ডুবোজাহাজ ভেসে উঠেছে একটা—’
আর একজন কেউ তার মুখটা তক্ষুনি চেপে ধরল বটে, কিন্তু যা হবার তা হয়ে গিয়েছে ততক্ষণে। আমরা যে ইংরেজ জাহাজ, শত্রু মানে যে জার্মান, তা স্বীকারই করে নেওয়া হয়েছে। এখন দেখা যাক, অপরিচিতরা কী করে? আঙুলটিও নাড়ছি না কেউ। সব নিশ্চুপ।
ও কী শোনা যায়? অন্ধকারে ঝুপ ঝুপ ঝুপ? দাঁড়ের শব্দ। নৌকা নামিয়েছে ওরা। চাপা-চাপা কথা শোনা যাচ্ছে। ওরা নৌকা পাঠিয়েছে আমাদের সঙ্গে কথা কইবার জন্য। আমাদের বিপদের কথা শুনেও। সবটাই একটা নিষ্ঠুর চক্রান্ত যদি না-হয়, বান্ধবতার পরিচয় বই কী!
কিন্তু সব কাণ্ডখানারই ভিতরে যেন একটা ঢাক-ঢাক-গুড়-গুড় ভাব। ঠিক স্বাভাবিক যেন নয়। সন্দেহ হচ্ছে। পছন্দ হচ্ছে না ব্যাপারগুলো কেন যে, তা বলতে পারি না অবশ্য। তবু। পকেটে হাত দিয়ে দেখলাম রিভলবারটা যথাস্থানে আছে কিনা, বুকে সাহস ফিরে এল তার কুঁদোটাকে মুঠির ভিতর পেয়ে।
ওদিকে দাঁড়ের শব্দ কাছে আসছে। অন্ধকারের ভিতর থেকে আলাদা হয়ে আসছে লম্বা ছিপনৌকা একখানা, জনা পাঁচ-ছয় মানুষ তাতে, গলুইতে একটা আঁধারি লণ্ঠন। পিছনদিকে একজন কে খাড়া হয়ে উঠল। বোধ হয় কোনো অফিসার। অন্ধকারে তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। নৌকা এসে স্থির হয়ে ভেসে রইল র্যাভেন্স-উইংয়ের পাশটিতে, লোকগুলো জলে দাঁড় চেপে বসে আছে।
অফিসার বলছেন, ‘আমাদের ক্যাপ্টেন নমস্কার জানিয়েছেন। আপনারা কি প্রহরী চান?’
আমি রেলিংয়ের উপর দিয়ে ঝুঁকে পড়লাম, হাত দিয়ে আড়াল করলাম ওদের লণ্ঠনের আলোকে। ‘আপনি কে?’— জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
জবাব এল, ‘লেফটেন্যান্ট আর্থার মাইল্ডমে। আপনার আদেশের অপেক্ষা করছি।’
যারা খাঁটি ইংরেজ নয়, তাদের ইংরেজি কথার উচ্চারণে টান থাকে নানারকম। এ লোকের তা নেই। সুতরাং এ ইংরেজ ছাড়া অন্য কিছু নয়, তবে কথার ঢং যেন কেমন। ‘আদেশের অপেক্ষা করছি?’— এরকম সম্ভাষণ আগে কারও মুখে শুনিনি।
‘ধাপ্পাটাপ্পা দিচ্ছেন না তো?’ সোজা প্রশ্নটা ছুড়ে দিলাম বুলেটের মতো।
অফিসার একটুও উত্তেজনা প্রকাশ না-করে বললেন, ‘মোটেই না। আবারও বলছি, আমাদের অধিনায়ক নমস্কার দিয়েছেন আপনাদের। আপনারাই বলছেন আশেপাশে শত্রু আছে। সেই কারণেই অধিনায়ক জানতে চাইছেন যুদ্ধজাহাজের সাহচর্য পেলে আপনাদের সুবিধা হয় কি না। আমাদের উপরে আদেশই আছে, যেকোনো বিপন্ন বাণিজ্যজাহাজকে নিরাপদে পৌঁছে দিতে হবে নিকটতম বন্দরে।’
‘আদেশটি কার?’— জিজ্ঞাসা করলাম।
‘অবশ্যই রাজা জর্জের—’
কী জানি কেন এই কথাতেই ভয় ধরে গেল আমার। জোরে জোরে ঢোঁক গিলতে হল কয়েক বার। গলার ভিতরটা শুকনো, কথা বেরুতে চায় না তা দিয়ে। আশেপাশে অনেকে দাঁড়িয়ে আছে, তাকিয়ে দেখি তারা প্রত্যেকে হতভম্বের মতো তাকিয়ে আছে। ‘রাজা পাঠিয়েছেন?’ বলল একজন। কথাটা হাওয়ায় ভেসে গেল কারও কাছ থেকে সাড়া না-পেয়ে।
রাজা? রাজা আমাদের আছেন, তা ঠিক। সে রাজার নামও জর্জ, তাতেও সন্দেহ নেই। কিন্তু রাজা কাউকে আদেশ দেন না আজকাল, আদেশ দেন গভর্নমেন্ট। এ লোক রাজার দোহাই পাড়ে কেন?
কার্টার টোকা দিল আমার কাঁধে, ‘বিদায় দাও ওদের। এ একটা ফাঁদ—’
গলুইয়ের লোকটা হঠাৎ লণ্ঠনটা ঘুরিয়ে ধরল, তার আলোকে ধাঁধা লাগল আমার চোখে। তরুণ লেফটেন্যান্ট তার হাত থেকে লণ্ঠনটা নিয়ে উঁচু করে ধরল, পাটাতনে এক পা এগিয়ে এসে বলল, ‘আমাদের জাহাজে এসে অধিনায়কের সঙ্গে কথা বলুন না! তাহলে সাহস পাবেন হয়তো—’
লোকটির মুখ তবু দেখতে পাচ্ছি না। যে-হাত লণ্ঠন উঁচু করে ধখেছে, সেটা লম্বা, পাতলা। আমার চোখ জ্বলে যাচ্ছে ওই লণ্ঠনের আলোতে, এত ব্যথা করছে যে হঠাৎ কথা বেরুচ্ছে না মুখ থেকে। কিন্তু কথা যখন বেরুল, তখন আমি নিজেই অবাক হয়ে গেলাম নিজের কথা শুনে, ‘বেশ, একটু জায়গা করে দিন নৌকোয়, আসছি আমি।’
‘না, না, না, না! করো কী? করছেন কী?’ নানাকণ্ঠের ফিসফাস কানে কানে, তারই মধ্য দিয়ে একটা দড়ি বেয়ে আমি নেমে পড়লাম নৌকায়। হাত বাড়িয়ে আমায় ধরল সেই লেফটেন্যান্ট। উঃ, হাত তো নয়, জমাট বরফ যেন। তা হবে! হতে পারে বই কী! র্যাভেন্স-উইংয়ের ডেকের তুলনায় স্বর্গ ছিল, সেখানেও ঠান্ডা বটে, কিন্তু এর কাছে? রাত্রি বেলায় এ-অঞ্চলের সমুদ্রবক্ষ এমন অস্বাভাবিক ঠান্ডা হয়, তা তো জানা ছিল না! নৌকায় পা দেওয়ামাত্র যে জমে যাওয়ার জোগাড়।
দাঁড় টানতে শুরু করল মাল্লারা। অবাক! শীতটা এদের তো স্পর্শও করছে না বোধ হয়। দাঁড়িদের হাতে কনুই পর্যন্ত আস্তিন গুটোনো। যে-শীতে আমি আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছি, তা ওদের স্পর্শ করছে বলেও তো মনে হয় না! নৌকোর কাঁধাতে একদিকে বসেছে লেফটেন্যান্ট, অন্যদিকে বসেছি আমি। অবাক হয়ে তাকাচ্ছি সমুদ্রবক্ষের দিকে। কোথায় গেল সে আথালপাথাল ঢেউ? মসৃণ, নিস্তরঙ্গ জলের উপর দিয়ে সরসর করে তিরবেগে এগিয়ে চলেছে ছিপনৌকা।
অবশেষে ওদের জাহাজ। কী বিরাট উঁচু! কত পাল মাস্তুলে মাস্তুলে! আমার দেশের নৌবাহিনীতে যে এযুগেও পাল-তোলা জাহাজ আছে এরকম, এ তো আমার ধারণাই ছিল না! ওই সম্বন্ধেই কী একটা কথা জিজ্ঞাসা করব করব ভাবছি, এমন সময় লেফটেন্যান্ট হাঁক দিল, ‘অ্যাহয়! অ্যাহয়!’
আলো দেখা দিল অন্ধকার ডেকের এখানে-ওখানে, দড়ি নেমে এল জাহাজের গা বেয়ে। কাজ হয়ে যাচ্ছে নিঃশব্দে, কোথাও কথা কইতে শোনা যায় না জনপ্রাণীকে। আগে আগে লেফটেন্যান্ট, তার পরে আমি উঠে এলাম দড়ি বেয়ে। পাটাতনে অনেক নাবিক ও নৌবাহিনীর সৈনিক। সাদায়-কালো কাপড়ের টুপি অনেকের মাথায়, কারও-বা লোহার টুপি। একটা বারো-তেরো বৎসরের ছেলে দৌড়ে চলে গেল ডেকের এমাথা থেকে ওমাথা, তারও পরনে নাবিকের সাজ।
এতগুলো লোক, কথা নেই, কৌতূহলী দৃষ্টি নেই কারও চোখে। কেউ কাজে ব্যস্ত, কেউ আঁধার সমুদ্রের দিকে চেয়ে আছে। ডেকজুড়ে আবছা অন্ধকার, একটা গন্ধ— না, অস্বস্তিকর গন্ধ নয়, অভ্যাস হয়ে গেলে এ-গন্ধ বেশ ভালোই লাগবে বলে অনুমান হল। কীসের গন্ধ যে এটা, বুঝতে পারলাম না।
লেফটেন্যান্ট পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। নীরবে চলেছি পিছনে পিছনে। নেমে গেলাম সরু সিঁড়ি দিয়ে। একটা চাতাল, একটা দরজা, তার ওপিঠে আরও বেশি অন্ধকার। একখানা ঘর, কত বড়ো ঘর বোঝা গেল না, সমুখে চার-পাঁচজন লোক, পিছনদিকটা অনেক দূর বিস্তৃত বলে মনে হল। নজর চলে না, অন্ধকার সেখানে গাঢ়।
সমুখদিকে টেবিল একখানা, তার ওপাশে উঁচুপিঠওয়ালা চেয়ারে কেউ একজন বসে আছেন। তাঁর পিছনে দাঁড়িয়ে আরও জনা চারেক। সবাই নিস্তব্ধ। লেফটেন্যান্ট স্যালিউট দিল, মৃদুকণ্ঠে উত্তর করল, ‘মিলর্ড! র্যাভেন্স-উইং, হাল থেকে মাল এনেছিল সুইডেনে। ক্যাপ্টেন অসুস্থ, মেট এসেছে রিপোর্ট করতে। শত্রু পিছু নিয়েছে এদের—’
লেফটেন্যান্ট সরে গেল সমুখ থেকে। কোথায় গেল, লক্ষ করলাম না। আমার দৃষ্টি তখন চেয়ারে উপবিষ্ট মানুষটির উপর নিবদ্ধ। মুখখানা কী কৃশ! একটা চোখ আবার প্লাস্টার-করা। কিন্তু দ্বিতীয় চোখটা? তার দৃষ্টি যেন আমার হৃদয় ভেদ করে তার অন্তস্তল পর্যন্ত দেখে নিল এক নিমেষে। আমি নিজের অজান্তেই টুপি হাতে নিয়ে অ্যাটেনশন-এর ভঙ্গিতে দাঁড়িয়েছি, যেমন করে সৈনিক দাঁড়ায় সেনাপতির সমুখে।
‘লেফটেন্যান্ট যা বললেন, তা ঠিক?’ প্রশ্নের স্বর মৃদু কিন্তু তীক্ষ্ন।
‘ঠিক, মিলর্ড!’ উত্তর দিলাম আমি, যদিও নিজেই বুঝলাম না যে, সমুখের একচক্ষু পুরুষটিকে মিলর্ড বলে কেন আমি সম্বোধন করছি।
‘তোমার তাহলে রক্ষী দরকার। বেশ, আমি তার ব্যবস্থা করছি। তুমি নিজের জাহাজে ফিরে গিয়ে নির্ভয়ে নিজের পথে চলে যাও। কেউ তোমাকে ঘাঁটাবে না—’
‘সাবমেরিন, মিলর্ড!’ আমি বুঝতে পারছি না যে, এই পালতোলা সেকেলে ঢং-এর জাহাজখানা নিজেই কেমন করে আত্মরক্ষা করবে শত্রুর হাত থেকে—
‘যে মেরিনই আসুক, আমি কখনো শত্রুকে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করিনি।’ এই বলে মিলর্ড চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন, একখানা হাত একটু উৎক্ষিপ্ত হল সেই মুহূর্তে, আর তক্ষুনি আমি লক্ষ করলাম তাঁর অন্য হাতখানা নেই, জামার হাতাটা বুকের পাশে পিন দিয়ে আটকানো রয়েছে।
কী যেন কী পড়তে চায়, পড়ে না। একচক্ষু, একহস্ত, একপদ— কে সেই অবিস্মরণীয় নৌসেনাপতি ইংল্যান্ডের? যেই হোন তিনি, তিনি তো শতাব্দী পূর্বে ইতিহাসের সামগ্রীতে পরিণত হয়েছেন, এযুগে আবার হুবহু তাঁর এক প্রতিরূপের অভ্যুদয় হয়েছে ইংল্যান্ডের নৌবাহিনীতে,— এখবর তো আমরা পাইনি!
লেফটেন্যান্টের সঙ্গে কখন কীভাবে নৌকায় এসে নেমেছি, কিছুই মনে নেই। হুঁশই ছিল না আমার। ভাবছি, কেবল ভাবছি, কে সে একচক্ষু, একহস্ত—’
নিজের জাহাজে উঠে তবে আমার মনে পড়ল। আমি দৌড়ে গিয়ে ঢুকলাম আমার ক্যাপ্টেনের কেবিনে। আশ্চর্য! তাঁর জ্বর বিরাম হয়েছে এরই মধ্যে, যদিও নৌকাযাত্রায় বেরুবার আধঘণ্টা আগেও তাঁকে দেখেছি জ্বরে একেবারে অজ্ঞান। আর ব্যথা? কিছুমাত্র টের পাচ্ছেন না ব্যথা। আমায় দেখেই বললেন, ‘কী ব্লান্ট ? বড়ো যেন উত্তেজিত?’
‘ক্যাপ্টেন! ক্যাপ্টেন! আমি লর্ড নেলসনকে দেখেছি।’
‘কী? পাগল! লর্ড নেলসন? এক-শো বছর আগে যিনি—?’
ক্যাপ্টেনকে পরের দিন বার করে আনলাম কেবিন থেকে। ডেকের উপরে চেয়ারে বসে তিনি দেখলেন, আমাদের ঠিক এক মাইল ডাইনে আমাদের সমান বেগেই একখানা বিরাট তিনমাস্তুলের পালতোলা সেকেলে জাহাজ বরাবর এগিয়ে চলেছে আমাদের পার্শ্বরক্ষীর মতো। সারাদিন দেখা গেল সে জাহাজকে। সারারাত দৃষ্টিগোচর হল তার লন্ঠনের আলো। পরদিন সকালে আর তাকে দেখা গেল না। দেখা দেবার দরকার ছিল না তার। অদূরেই ইংল্যান্ডের উপকূল। জার্মান সাবমেরিন এখানে আসতে সাহস করবে না।
সাবমেরিন? শতাব্দী পূর্বের ওই মহাপ্রহরীর আশ্রয় যখন আমরা পেয়ে গেলাম, তারপর থেকে উত্তর সাগরের কোথাও আর একটি পেরিস্কোপের ডগা আমাদের চোখে পড়েনি।