৫
সেনাপতি বেলোই প্রথম খোলা তলোয়ার মাথার ওপর তুলে চিৎকার করে বলল– আক্রমণ করো। ঘোড়সওয়ার বাহিনী ছুটল।মূর যোদ্ধারা মুখে শব্দ তুলে ঘোড়সওয়ারদের মোকাবিলায় এগিয়ে এলো। ওরা ঘোড়সওয়ার বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। শুরু হল যুদ্ধ। ঘোড়ার ক্ষুরের আঘাতে চাপে বেশ কিছুমূর সৈন্য আহত হল। তবু অশ্বারোহী যোদ্ধাদের শরীরে ঘোড়ার গায়ে তলোয়ারের কোপ বসাল। বর্শা দিয়ে বিদ্ধ করল। কিন্তু রাজা জেমসের সুশিক্ষিত যোদ্ধাবাহিনীর সামনে মূরবাহিনী আর কতক্ষণ দাঁড়াবে। তবুওরা লড়াই করতে লাগল। প্রান্তর ভরে উঠল আর্ত চিৎকার গোঙানি আর তলোয়ারের ঠোকাঠুকির শব্দে।
এবার সেনাপতির নির্দেশে পদাতিকবাহিনী ছুটে এলো। যুদ্ধে নামল। চলল যুদ্ধ। কিছুক্ষণের মধ্যেই আল আমিরির যোদ্ধারা হার স্বীকার করতে লাগল। ওদের সংখ্যাও কমে আসতে লাগল। জীবন বিপন্ন দেখে কিছুমূর যোদ্ধা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাল। মূর যোদ্ধাবাহিনী পরাস্ত হল। বেশ কিছু দূর যোদ্ধাকে বন্দি করাও হল। এবার সেনাপতি বেলো ঘোড়ায় চড়ে চললেন দুর্গের প্রধান প্রবেশপথের দিকে। তার পেছনে পেছনে যোদ্ধাবাহিনীও চলল।
দুর্গা ঘিরে চারদিকে পরিখা। পরিখা জলে ভর্তি। পরিখা পার হয়ে দুর্গের পাথুরে দেয়ালের কাছে পৌঁছোতে হবে।
প্রধান প্রবেশপথে যেতে পরিখার ওপর কাঠের সেতু দিয়ে যেতে হয়।
ঘোড়ায় চড়ে সেনাপতি বেলো সেতুর কাছে এলেন। দেখলেন দুর্গের বিরাট কাঠের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। দরজার কাছে দেয়ালে তখনও মশাল জ্বলছে। আল আমিরির কোনো প্রহরী ওখানে নেই। সেনাপতি বেলো গলা চড়িয়ে যোদ্ধাদের বললেন–আমার বীর যোদ্ধারা–সেতু দিয়ে ওপারে গিয়ে দেয়ালের চারপাশ ঘিরে দাঁড়াও। যোদ্ধারা কাঠর সেতুর ওপর দিয়ে পরিখার ওপরে গেল। দেয়াল ঘিরে দাঁড়াল। সেনাপতি বেলো আবার উচ্চস্বরে আদেশ দিলেন–দেয়াল ধরে ধরে ওপরে ছাদের দিকে ওঠো।
যোদ্ধারা দেয়ালের কাছে ছুটে এলো। দুর্গের এবড়ো-খেবড়ো দেয়াল ধরে ধরে ওপরের দিকে উঠতে লাগল। এবার শুরু হল আল আমিরির যোদ্ধাদের আক্রমণ। ওরা দুর্গের ছাত থেকে যোদ্ধাদের লক্ষ্য করে তির বর্শা ছুঁড়তে লাগল। কিছু যোদ্ধা আহত হল। মারাও রগেল।
তখন সেনাপতি বেলো চিৎকার করে যোদ্ধাদের চলে আসতে বললেন পরিখার কাছে কাছে যোদ্ধাদের দাঁড়াতে বললেন। যোদ্ধারা তাই দাঁড়াল।
এবার আল আমিরির যোদ্ধারা দুর্গের ছাত থেকে পাথরের ছোটো ছোটো চাই স্লিং এ চড়িয়ে ছুঁড়তে লাগল। স্লিং হচ্ছে কাঠের লম্বা পাটাতন। দড়ি দিয়ে পাটাতন বাঁকিয়ে তার ওপর পাথরে ছোটো ছোটো চাই রাখা হয়। দড়ির বাঁধন খুলে দিলেই বাঁকা পাটাতন প্রচণ্ড জোরে সোজা হয়। পাটাতনে রাখা পাথরের চাঁই ছিটকে গিয়ে মাটিতে দাঁড়ানো যোদ্ধাদের ওপর পড়ে। কিছু যোদ্ধা মরে কিছু আহত হয়। এভাবেই সাত আটটা স্লিং থেকে পাথরের ছোটো ছোটো চাই ছোঁড়া হতে লাগল।
সঙ্গে সঙ্গে সেনাপতি বেলো যোদ্ধাদের উদ্দেশে চিৎকার করে বলতে লাগলেন– সবাই পরিখা সাঁতরে পার হয়ে চলে এসো। যোদ্ধারা পরিখার জলে ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল জল গলা পর্যন্ত। কাউকে সাঁতরাতে হল না। জল ঠেলে যোদ্ধারা এপারে চলে এল। সেনাপতির হুকুমে সার বেঁধে দাঁড়াল। স্লিং থেকে ছোঁড়া পাথরের ছোটো ছোটো চাইগুলো এতদূর এলো না। যোদ্ধারা এবার নিরাপদ।
সেনাপতি বেলো এই স্লিং-এর কথা শুনেছেন কিন্তু আগে কখনো দেখেননি। এবারই প্রথম দেখলেন। স্লিং-এর কর্মক্ষমতা দেখলেন।
সেনাপতি বেলো ভেবে দেখলেন এভাবে দুর্গের বাইরে থেকে আক্রমণ করে দুর্গ দখল করা যাবে না। অন্য কোনো উপায় দেখতে হবে।
ওদিকে দুর্গ থেকে পাথর ছোঁড়া বর্শা ছোঁড়া বন্ধ হল। সেনাপতি বেলোর যোদ্ধারা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে অতদূর পর্যন্ত স্লিং দিয়ে ছোঁড়া ছোটো পাথরের চাঁই উড়ে আসছে না।
তখন পুবের আকাশ লাল হয়ে উঠেছে। একটু পরেই সূর্য উঠল। ভোরের নরম আলো ছড়ালো দুর্গের গায়ে গাছগাছালির মাথায়। পাখি-পাখালির ডাক শোনা গেল।
সেনাপতির যোদ্ধারা তখন অত্যন্ত ক্লান্ত, সেই পালমা নগর থেকে হেঁটে আসা সারারাত যুদ্ধ করা। কিছু যোদ্ধা এত ধকল সইতে পারল না। ঘাসের প্রান্তরে বসে পড়ল। সেনাপতি দেখলেন কিন্তু কিছু বললেন না।
এখন যুদ্ধবিরতি চলছে। সেনাপতির আদেশে কয়েকজন যোদ্ধাকে নিয়ে রসুইকর চলল বনজঙ্গলের দিকে। গাছগাছালির আড়ালে রসুইকররা সকালের খাবার তৈরির জন্য তিনটে পাথর বসিয়ে উনুনের মতো বানাল। রান্নার আয়োজন চলল।
ঘোড়ার তদারক করে যারা তাদেরই একজন সেনাপতির কাছে এলো। সেনাপতি ও ঘোড়া থেকে নামলেন। যোদ্ধাটি ঘোড়াটাকে হাঁটিয়ে নিয়ে চলল দানাপানি খাওয়াতে।
সেনাপতি প্রান্তরে পড়ে থাকা একটা পাথরের চাইয়ের ওপর বসলেন।
তখন বেলা হয়েছে। দুর্গ বড়ো সড়ক পুবদিকে বনজঙ্গল সবই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সেনাপতি একবার চারদিকে তাকিয়ে দেখলেন। ভাবতে লাগলেন কীভাবে দুর্গা দখল করা যায়। রাতের অন্ধকারে দুর্গের দেয়াল ডিঙানো যায়। কিন্তু দুর্গের ছাদে জ্বলন্ত মশালের আলোতে যোদ্ধারা ধরা পড়ে যেতে পারে। অন্য কোনো উপায় ভেবে বের করতে হবে।
সকালের খাবার খেল সবাই। সেনাপতিও ঐ পাথরে বসেই খাবার খেলেন। খেতে খেতে সর্বক্ষণ ভেবে চললেন কীভাবে দুৰ্গটা দখল করা যায়।
হঠাই একটা উপায়ের কথা মাথায় এলো। দুর্গের সদর দরজা ভেঙে ঢুকতে হবে। সেনাপতি দ্রুত উঠে দাঁড়ালেন। কয়েকন যোদ্ধাকে হাত তুলে ডাকলেন। যোদ্ধারা কাছে এসে মাথা নিচু করে সম্মান জানাল। সেনাপতি বললেন–ঐ বনজঙ্গলের সামনে দেখো। সকলে সেদিকে তাকাল। দেখা গেল ঐ দিকে মানুষের বসতি এলাকা। পাথরের বাড়িঘরদোর। সেনাপতি বললেন–ওখানকার লোকজনের কাছ থেকে কয়েকটা কুড়ুল জোগাড় কবো। চলো আমিও যাচ্ছি।
সেনাপতি ঐ জেলেদের বসতির দিকে চললেন। পেছনে কয়েকজন যোদ্ধা চলল। বসতির পাথরের বাড়িগুলোর সামনে এসে সেনাপতি দেখলেন সব বাড়িই আগুনে পোড়া। আশেপাশে কোথাও মানুষজন নেই। সেনাপতি যোদ্ধাদের দিকে তাকিয়ে বললেন মনে হচ্ছে এখানে বসতি ছিল। পেছনেই বনজঙ্গল। এই বসতির লোকেরা নিশ্চয়ই বনজঙ্গ ল থেকে কাঠকুটো জোগাড় করত। কাজেই কুড়ুল ব্যবহার করতো। নিশ্চয়ই এই পোড়া বাড়িগুলো ভালো করে খুঁজলে কুড়ুল পাওয়া যাবে। তোমরা খোঁজো। যোদ্ধারা পোড়া বাড়িগুলোয় ঢুকে কুড়ুল খুঁজতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই যোদ্ধারা তিনটে কুড়ুল পেল। কুড়ুল নিয়ে ওরা সেনাপতির কাছে এলো। সেনাপতি বললেন–এবার চলো বনের মধ্যে। সেনাপতি বনের দিকে চললেন। পেছনে কুঠার নিয়ে যোদ্ধারা চলল।
বনের মধ্যে সেনাপতি একটা বড়ো গাছ খুঁজতে লাগল। পেয়েও গেল। একটা খাড়া উঠে-যাওয়া চেস্টনাট গাছ। বেশ মোটা গাছ। সেনাপতি যোদ্ধাদের গাছটা দেখিয়ে বলল–এই গাছটা কাটো। যোদ্ধারা কুঠার নিয়ে তৈরি হল। প্রথমে দু’জন কুঠার নিয়ে তৈরি হল। প্রথমে দু’জন কুঠারের কোপ পরপর বসিয়ে গাছের গোড়াটা কাটতে লাগল। দু’জনের মধ্যে একজন পরিশ্রান্ত হল। হাঁ করে হাঁপাতে লাগল। তৃতীয়জন এগিয়ে এলো। এবার দুজনে মিলে আগে পরে কুঠার চালিয়ে গাছটা কাটতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যে গোড়া কাটা হয়ে গেল। আশেপাশের গাছের ডালে শব্দ তুলে কাটা গাছটা ঝপ করে মাটিতে পড়ল। সেনাপতি বললেন–গাছটার ডালগুলো ছেটে ফেল। যোদ্ধারা কুঠার চালিয়ে গাছটার ডালগুলো কেটে ফেলল। শুধু লম্বা মোটা কাণ্ডটা রইল। সেনাপতি এবার শুধু কাণ্ডটা দেখে দেখে কী হিসেব করে কাটার ওপরের দিকে একটা জায়গা দেখিয়ে বললেন–এখানটা কাটো। একজন যোদ্ধা কুঠার চালিয়ে সেটা কাটল। এবার রইল শুধু বড়ো লম্বা মোটা কাণ্ডটা। সেনাপতি যোদ্ধাদের বললেন–এবার এটা নিয়ে চলো।
যোদ্ধারা এবার কাটা লম্বা কাণ্ডটা কাঁধে নিয়ে চলল। ওরা সেনাপতির নির্দেশমতো কাণ্ডটা নিয়ে দুর্গের প্রধান প্রবেশপথের দিকে চলল। এবার কাঠের সেতুটা পার হতে লাগল। তখনই দুর্গের ছাত থেকে আল আমিরির যোদ্ধারা স্লিং-এ পাথর চড়িয়ে ছুঁড়তে লাগল। একটা পাথর সেতুর মধ্যে এসে পড়ল। সেতুর ঐ জায়গার কাঠটা ভেঙে জলে পড়ে গেল। সেনাপতি গলা চড়িয়ে বললেন–ঐ কাঠের কাণ্ডটা নিয়ে কুড়িজন যোদ্ধা প্রধান দেউড়ির দরজার কাছে চলে যাও। ছোটো–যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।
কুড়িজন যোদ্ধা সঙ্গে সঙ্গে কাণ্ড ঘাড়ে বসিয়ে ছুটে দেউড়ির কাঠের দরজার সামনে চলে এলো। এখন আর স্লিং-এ চড়িয়ে পাথর ছুঁড়ে লাভ নেই। এত কাছে পাথর গিয়ে পড়বে না। স্লিং থেকে পাথর ছোঁড়া বন্ধ হল। শুধু তিরন্দাজরা তির ছুঁড়তে লাগল। ওদিকে সেনাপতির হুকুমে তার তিরন্দাজ বাহিনী তির ছুঁড়তে লাগল। সেনাপতি চিৎকার করে বলল–শুধু ওদের তিরন্দাজদের মারো নয়তো আহত করো। তিরন্দাজরা নিশান ঠিক করে তির ছুঁড়তে লাগল।
এবার সেনাপতি দ্রুতপায়ে সেতুটা পার হলেন। এলেন দুর্গের সদর দরজার কাছে। যোদ্ধাদের বললেন –এই গাছের কাণ্ডটার কুড়িজন কাঁধে নাও। তারপর ছুটে গিয়ে দুর্গের দরজায় একসঙ্গে কাণ্ডটা দিয়ে ঘা মারো। এভাবে বারবার ঘা মারো।
একজন যোদ্ধা সরু গলায় বলতে লাগল –ধাক্কা মারো একসঙ্গে। যোদ্ধারা সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়ে গাছের কাণ্ডটা একসঙ্গে ধরে কাঠের দরজার মাঝখানে ঘা মারতে লাগল। দড়াম্ দড়াম্ শব্দ হতে লাগল। কাঠের দরজাটা নড়ে উঠতে লাগল।
কুড়িজন যোদ্ধা পরিশ্রান্ত হল। হাঁপাতে লাগল। সেনাপতি তা দেখে সেতুর ওপারে জড়ো হওয়া যোদ্ধাদের দিকে তাকিয়ে গলা চড়িয়ে বললেন-কুড়িজন চলে এসো। জদি। দৌড়ে আসবে।
কুড়িজন যোদ্ধা সেতুর ওপর দিয়ে দ্রুত ছুটে এলো। আগের কুড়িজনকে সেনাপতি হাতের ইঙ্গিতে চলে যেতে বললেন। কুড়িজন যোদ্ধা চলে গেল।
এবার নতুন কুড়িজন যোদ্ধা কাণ্ডটা ঠেলে নিয়ে দরজায় ঘা মারতে লাগল। ঘা পড়ছে আর দরজার মাঝখানের ফাঁকটা বড়ো হচ্ছে। কাঠের দুটো মোটা আগল দরজার মাঝখানে এবার দেখা যাচ্ছে। আগল দুটো দেখে যোদ্ধাদের উৎসাহ বেড়ে গেল। চলল দুম দুম্ শব্দ তুলে আগলদুটোয় ঘা মারা। পরিখার ওপারে দাঁড়ানোর সৈন্যরাও চিৎকার করে উৎসাহ দিতে লাগল। পর পর ঘা পড়তে লাগল বিরাট দরজাটা নড়তে লাগল।
হঠাৎ একটা ধাক্কায় কাঠের একটা আগল ভেঙে ছিটকে পড়ল। যোদ্ধারা চিৎকার করে উঠল। যোদ্ধারা হাঁপাচ্ছে তখন। সেনাপতি ওদের বলল–এবার অন্যদের ডাকছি। তোমরা যাও। ওরা বলে উঠলনা। দু’একজন বলল–একটা আগল ভেঙেছি অন্যটাও ভাঙবো। আমরাই ভাঙবো।
আবার ঘা পড়ল অন্য আগলটায় বারে বারে। যোদ্ধারা হাঁপাচ্ছে তখন। একজন যোদ্ধা বলে যেতে লাগল ধাক্কা মারো একসঙ্গে। কাঠের আগলটা ক্রমাগত এই ধাক্কা সামলাতে পারল না। একটা জোর ধাক্কা খেয়ে কাঠের আগলটা দু’টুকরো হয়ে ছিটকে পড়ল। বন্যার জলের মতো যোদ্ধারা চিৎকার করতে করতে দুর্গের মধ্যে ঢুকে পড়ল। দুর্গের ছাত থেকে দুর্গের ঘরগুলোর আশপাশ থেকে আল আমিরির যোদ্ধার তির বর্শা ছুঁড়তে লাগল। কিন্তু সেনাপতি যোদ্ধাদের থামাতে পারল না। দুর্গের ঘরগুলো থেকে আল আমিরির যোদ্ধারা খোলা তলোয়ার হাতে সেনাপতির যোদ্ধাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। সেনপতির যোদ্ধারা তলোয়ারের লড়াই চালাল। ততক্ষণে বাইরে পরিখার ওপারে দাঁড়ানো সেনাপতির যোদ্ধারা চিৎকার করতে করতে ছুটে এলো। আল আমিরির যোদ্ধারা তাদের রুখতে পারল না। আল আমিরির সৈন্যদের ঘিরে ফেলল সেনাপতির যোদ্ধারা চলল তলোয়ারের লড়াই দুর্গের চত্বরে। চত্বরটা ভরে উঠল আহতের আর্ত চিৎকারে গোঙানিতে। কিছুক্ষণের মধ্যে আল আমিরির যোদ্ধারা হার স্বীকার করতে লাগল। সেনাপতির যোদ্ধারা সাহসী আর রণনিপুণ। আমিরির মূর সৈন্যরা পেরে উঠল না।
দুর্গের ঘরগুলোর বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেনাপতি চিৎকার করে বললেন–বীর যোদ্ধারা–আর ইত্যা নয়। ওরা আর কিছুক্ষণের মধ্যেই হার স্বীকার করবে। ওদের এখন বন্দি কবো। এই দুর্গে নিশ্চয়ই কয়েদঘর আছে। ওদের কয়েদঘরে ঢুকিয়ে দাও।
সেনাপতির যোদ্ধারা তার নির্দেশমতো আল আমিরির যোদ্ধাদের বন্দি করতে লাগল। ওদের দু’হাত দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে চলল কয়েদঘরের দিকে।
লড়াই শেষ। সেনাপতির যোদ্ধারা তখন হাঁপাচ্ছে। সেনাপতি গলা চড়িয়ে বললেন– কিছু যোদ্ধা ছাতে চলে যাও। ওখান থেকে মাঝে মাঝেই তির বর্শা ছোঁড়া হচ্ছে। কিছু যোদ্ধা ছুটল ছাতে ওঠার সিঁড়ির দিকে। ছাতে উঠে আল আমিরির যোদ্ধাদের আক্রমণ করল। তারা কিছুক্ষণের মধ্যেই আত্মসমর্পণ করল। তাদের ছাদ থেকে নামিয়ে এলে কয়েদঘরে বন্দি করে রাখা হল।
তখনই দেখা গেল আল আমিরি খোলা তলোয়ার হাতে ছুটে এলো। সেনাপতি দ্রুত তার সামনে এলেন। বললেন–আল আমিরি–অস্ত্র ত্যাগ করো। লড়াই শেষ হয়ে গেছে। তোমার যোদ্ধারা হয় মরেছে নয়তো আহত হয়েছে অথবা কয়েদঘরে বন্দি হয়ে আছে। তুমি একা লড়ে কী করবে?
আল আমিরি মাথা ঝাঁকিয়ে বলল–আমি লড়াই করবো। মরতে হয় মরবো তবু লড়াই থেকে পিছিয়ে আসবো না।
–তাহলে আমার সঙ্গেই লড়াই করো। সেনাপতি কথাটা বলেই তলোয়ার হাতে আল আমিরির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। আল আমিরি কোনোরকমে সেই মার আটকাল। শুরু হল আল আমিরির সঙ্গে সেনাপতির লড়াই।
তলোয়ারের লড়াইতে কেউ কম যায় না। সেনাপতির যোদ্ধারা লড়াইয়ের জায়গাটা ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়াল। লড়াই দেখতে লাগল।
তলোয়ারের লড়াই চলল। সেনাপতি এগিয়ে পিছিয়ে নিপুণ হাতে তলোয়ার চালাতে লাগলেন। আল আমিরিও কম যায় না। সেনাপতির মার ঠেকাতে লাগল। আবার আক্রমণও করতে লাগল। দু’জনেই তখন হাঁপাচ্ছে। তরোয়ারের ঠোকাঠুকির শব্দ আর শাস ফেলার শব্দ।
এতক্ষণ আল আমিরির তলোয়ার যত দ্রুত এদিক-ওদিক ঘুরছিল এখন কিন্তু সেই দ্রুততা আর নেই। তবু হঠাৎ দ্রুত ঘুরে আল আমিরি তলোয়ার চালাল। রোদে ঝলসে উঠল তলোয়ার। সেনাপতির বাঁ বাহু ছুঁয়ে তলোয়ারের ফলা নেমে এলো। পোশাকের কাপড় কেটে রক্ত বেরিয়ে এলো। সেনাপতি কাটা জায়গাটা দেখলেন। এবার সেনাপতি দ্রুত তলোয়ার চালাতে লাগলেন। আল আমিরি সেই তলোয়ারের মার ঠেকাতে ঠেকাতে পিছু হঠতে লাগল। সেনাপতি ওর ওপর সমান চাপ রেখে এগিয়ে চললেন। হঠাৎ সেনাপতি এত দ্রুত আর এত জোরে তলোয়ার চালালেন যে পরিশ্রান্ত আল আমিরি সেই মার ঠেকাতে পারল না। ওর হাত থেকে তলোয়ার ছিটকে গেল। সেনাপতি আল আমিরির গলায় তলোয়ারের ডগাটা ঠেকিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন–তোকে মেরে ফেলার হুকুম নেই। তারপর যোদ্ধাদের বললেন–এটাকে বন্দি করো। একজন যোদ্ধা ছুটে গেল। আল আমিরির কোমরের ফেট্টি খুলে তাই দিয়ে ওর হাত বাঁধল। সেনাপতি বললেন–মহামতি রামন লালের নশ্বর দেহ কোথায় সমাধিস্থকরা হয়েছে? আল আমিরি। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল–দুর্গের উত্তর দিকে প্রান্তরে।
–আমাদের নিয়ে চলো। সেনাপতি বললেন। তারপর বললেন–এখানে বেলচা কোথায় থাকে? আল আমিরি বলল–আমি জানি না। রামন লালের মৃতদেহ কবর দেবার সময় আমরা কেউ যাই নি। কবর খোঁড়েটোড়ে এমন দু’জন গিয়েছিল। সেনাপতি শুধু বলল–আশ্চর্য। তারপর যোদ্ধাদের দিকে তাকিয়ে বললেন–এই দুর্গের ঘরগুলো খোঁজ। কোথাও দু-একটা বেলচা নিশ্চয়ই পাবে। যোদ্ধারা কয়েকজন বেলচা খুঁজতে গেল।
কিছু পরে তারা দুটো বেলচা নিয়ে এলো। সেনাপতি আল আমিরিকে বললেন– চলোকবরের জায়গাটা দেখিয়ে দেবে।
–সেই জায়গাটা কোথায় তা তো আমি জানি না। আল আমিরি বলল।
তার মানে? সেনাপতি বললেন।
কবরের সময় তো আমরা যাই নি। আল আমিরি বলল।
–ও। ঠিক আছে আমরাই খুঁজে নেব। সেনাপতি বললেন। তারপর দু’জন যোদ্ধাকে বললেন–আল আমিরিকে কয়েদঘরে বন্দি করে রাখো।
সেনাপতি দুর্গ থেকে বেরিয়ে উত্তরমুখো চললেন। তরো যোদ্ধারাও নিঃশব্দে তার পেছনে পেছনে চলল। ওরা সেনাপতি আর আল আমিরির সব কথাই শুনেছে। উত্তরের প্রান্তরে এসে সেনাপতি যোদ্ধাদের দিকে তাকিয়ে বললেন–এখানে খুঁজে দেখো তো কোথায় মাটি কাটা আছে। দু’একদিন আগেই কবর কাটা হয়েছে। সবাই এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়ল। কবর খুঁজতে লাগল। পাওয়া গেল। ঘাসের মধ্যে সহজেই মাটি খোঁড়া জায়গাটা দেখা গেল।
কবরের জায়গাটাতে সেনাপতি এলেন কবরের সামনে কিছুক্ষণ চোখ বুজে দাঁড়ালেন। এ তারপর যে দু’জন যোদ্ধা বেলচা নিয়ে এসেছিল তাদের বললেন কবরটা খোঁড়। কফিনটা তুলতে হবে। যোদ্ধা দু’জন বেলচা দিয়ে কবর খুঁড়তে লাগল। হাত দুয়েক খুঁড়েই কফিনটা পাওয়া গেল। একটা সস্তা দামের কাঠের কফিন। সালভার পক্ষে এর চেয়ে বেশি দামের কফিন জোগাড় করা সম্ভব ছিল না।
কফিনটা উপরে তোলা হল। সবাই মাথায় বুকে ক্রশ চিহ্ন আঁকল। এবার সেনাপতির নির্দেশে কয়েকজন কফিনটা কাঁধের কাছে তুলল। সবার আগে সোনপতি কফিনটার সামনের দিকেকঁধ দিল।তখনও সেনাপতির বাঁ বাহু থেকে রক্ত পড়ছিল। কিন্তু সেনাপতি সেটা গ্রাহ্য করল না। বাকি কয়েকজন কঁধ দিল। সেনাপতি সেটা গ্রাহ্য করল না। বাকি কয়েকজন কঁধ দিল। সেনাপতি কফিন নিয়ে চলল।
দুর্গের বাঁ দিকে বনজঙ্গলের কাছে পালমা থেকে আনা দামি কাঠের তৈরি সোনা রুপোর ফুল লতা পাতার কাজ করা কফিনটা রাখা ছিল। সেই কফিনের কাছে এই কফিনটা আনা হল। নতুন কফিনটার মুখ খোলা হল। আগের কফিনের মুখটা খোলা হল। রামন লালের শায়িত মৃতদেহ বেশ কয়েকজন হাত লাগিয়ে তুলল। তারপর নতুন কফিনে আস্তে আস্তে রাখল। কফিনের মুখ বন্ধ করা হল। সেনাপতির দু’চোখে জলে ভরে গেল। যোদ্ধাদের মধ্যেও অনেকে কাঁদছিল।
দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর সব যোদ্ধারা ঘাসের প্রান্তরে শুয়ে বসে বিশ্রাম করছিল। সেনাপতি সেখানে এলেন। গলা চড়িয়ে বললেন–বীর যোদ্ধারা এখন সবাই বিশ্রাম করো। রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর আমরা পালমা নগরের দিকে যাত্রা করবো। ভোর ভোর সময়ে পালমা পৌঁছে যাবো।
রাতের খাওয়া-দাওয়া শেষ হল। চারদিক খোলা যে গাড়িটা সেনাপতি এনেছিল সেই গাড়িতে কফিনটা রাখা হল। দুটো ঘোড়া গাড়িটা টানবে। আল আমিরিকে হাত বাঁধা অবস্থায় একটা ঘোড়ায় বসানো হল। একজন অশ্বারোহী যোদ্ধা সেই ঘোড়ায় আল আমিরির পেছনেই বসল।
একেবারে সামনে রাখা হল কফিনের গাড়িটাকে। তারপর ঘোড়ায় চড়ে সেনাপতি। তারপর অশ্বারোহী যোদ্ধারা। তারপর পদাতিক যোদ্ধারা, তিরন্দাজরা। সবশেষে বন্দি আল আমিরি।
সেনাপতি তলোয়ার কোষমুক্ত করল। রাজধানী পালমা নগরের দিকে তলোয়ার তুলে চিৎকার করে বললেন–যাত্রা শুরু।
যাত্রা শুরু হল।
আজ চাঁদের আলো খুব উজ্জ্বল নয়। চাঁদ মেঘেও ঢাকা পড়ছে মাঝে মাঝে। সমুদ্রের দিক থেকে জোরালো হাওয়া বইছে!
পালমা নগরে পৌঁছোবার আগেই ভোর হল।
ওদিকে রাজবাড়ি থেকে ফিরে সালভা বলল–ফ্রান্সিস এখন কী করবেন?
ফ্রান্সিস বলল-রামন লাল কোথায় থাকতেন?
ছাত্রাবাসের পাশেই শিক্ষাগুরুদের আলাদা আবাস। তারই একটিতে রামন লাল থাকতেন। সালভা বলল।
–তাহলে ঐ ছাত্রাবাসেই একটা আলাদা ঘরের ব্যবস্থা করো। আমরা সেই ঘরেই থাকবো। ফ্রান্সিস বলল। উত্তরমুখো কিছু পাথরের ঘরের দিকে দেখিয়ে সালভা বলল–
ছাত্রাবাস শিক্ষাগুরুদের আবাস ঐদিকে। সেইদিকে চলল ওরা। তখনি প্রাসাদের দক্ষিণ দিককার দেয়ালের ওপাশ থেকে বহু মানুষের কোলাহল ঘোড়ার ডাক শোনা গেল। সালভা বলল–ঐ দিকেই সৈন্যবাস। একটা বিরাট প্রান্তর আছে ঐদিকে। বোধহয় সৈন্যসজ্জা চলছে সেখানে।
হাঁটতে হাঁটতে উত্তরের ঘরগুলোর কাছে ওরা এলো। সালভা প্রথম ঘরটার দরজায় দাঁড়াল। ফ্রান্সিসরাও এসে ওর পেছনে দাঁড়াল। দেখা গেল ছোটো একটা ঘর। একপাশে পাথরের মেঝেয় কম্বলমতো মোটা কাপড়ের বিছানা পাতা। বিছানায় একজন বৃদ্ধ বসে আছেন। গায়ের ছাইরঙের মোটা কাপড়ের একটা অংশ ঘোমটার মতো তার মাথায় টানা। বৃদ্ধ একটি পাণ্ডুলিপি পড়ছেন।
সালভা গিয়ে বৃদ্ধের সামনে মেঝেয় বসল। বৃদ্ধ মুখ তুলে সালভার দিকে তাকালেন। সালভা মাথা নুইয়ে সম্মান জানাল। হেসে বলল–শ্রদ্ধেয় ম্যাস্ত্রো আমাকে চিনতে পারছেন? বৃদ্ধ ওর দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর হাসলেন। কপালে মুখে বলিরেখা স্পষ্ট হল। বললেন–তুমি সালভা–তাই না? সালভা হেসে মাথা ঝাঁকাল। বলল শ্রদ্ধেয় ম্যাস্ত্রো–মহামতি রামন লালের প্রথম পাণ্ডুলিপিটা তো এখনো পাওয়া যায় নি। ম্যাস্ত্রো মাথা নাড়লেন। সালভা ইশারায় ফ্রান্সিসকে ডাকল। ফ্রান্সিস এগিয়ে এলো। ফ্রান্সিসকে দেখিয়ে সালভা বলল–এর নাম ফ্রান্সিস। আমার বন্ধু। ম্যাস্ত্রো একবার তাকিয়ে ফ্রান্সিসকে দেখলেন। সালভা বলল–রাজা এই ফ্রান্সিসকেই দায়িত্ব দিয়েছেন ঐ পাণ্ডুলিপিটা খুঁজে বের করার জন্যে।
“ভালোই তো। ম্যাস্ত্রো বললেন।
তাই ফ্রান্সিস তার বন্ধুদের নিয়ে এখানে থাকবেন। একটা ঘরের ব্যবস্থা আপনাকে করে দিতে হবে। সালভা বলল।
–এ আর বেশি কথা কি। তুমি তো সবই চেনো। যেকোনো একটা খালি ঘর পছন্দ করে থাকো। ম্যাস্ত্রো বললেন। একটু থেমে সালভা বলল–এবার আপনাকে একটা শোক সংবাদ জানাচ্ছি। আমাদের গুরুদেব মহাতি রামন লাল কিছুদিন আগে দেহত্যাগ করেন। ম্যাস্ত্রো কেমন বিহ্বলচোখে সালভার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন– দীর্ঘদিন আমরা অনেক চেষ্টা করেও তার কোনো খোঁজ পাই নি। কিন্তু তুমি জানলে কী করে?
পরে সব বলবো আপনাকে। সালভা বলল। মাথা নাড়তে নাড়তে ম্যাস্ত্রো বললেন–এখানে বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলবার চেষ্টা করছি আমরা। আশা ছিল, যশস্বী রামন লাল ফিরে আসবেন। আমরা তার সাহায্য ও পরামর্শ পাবো। আঃ বড়ো কষ্ট হচ্ছে। ম্যাস্ত্রো মাথা নাড়লেন। সালভা উঠে দাঁড়াল। মাথা নুইয়ে সম্মান জানিয়ে ঘরের বাইরে এলো। চলল টানা বারান্দা ধরে। ফ্রান্সিসরাও চলল। পর পর বেশ ক’টা ঘর পার হল ওরা। প্রত্যেকটাতেই ছাত্ররা রয়েছে। পাথরের বারান্দাটা যেখানে বাঁক নিয়েছে সেখানে একটা খালি ঘর পাওয়া গেল। ঘরটায় ঢুকল সবাই। ঘরটা বড়ো। কিন্তু ঘরটার মেঝেয় কোনো বিছানামতো কিছু নেই। ঘরটার পাথুরে দেয়ালের ওপরের দিকে চ্যাপ্টালোহার কয়েকটা গরাদ বসানো জানলা। ওরা ঘরটা দেখছেতখনই একটি অল্পবয়সী ছেলে এসে দরজায় দাঁড়াল। ছেলেটার মাথা ন্যাড়া। সালভা বলল–কীরে–তুই এখানে কাজ করিস?
–হ্যাঁ। কর্তা আমাকে পাঠিয়ে দিলেন। ছেলেটি বলল। বোঝা গেল ম্যাস্ত্রো পাঠিয়েছেন।
ন্যাড়া মাথা ছেলেটিই ফ্রান্সিসদের ওখানে স্নান খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিল।
ঘরে এসে দেখল চারজনেরই বিছানার ব্যবস্থা হয়েছে। ফ্রান্সিস বিছানায় শুয়ে পড়ল। তারপর ক্লান্তিতে চোখ বুজল। শাঙ্কো আর মারিয়াও বিছানায় বসল। ক্লান্ত সকলেই। সালভা বলল–আমি রাজবৈদ্যির কাছ থেকে পিঠের ওষুধটা নিয়ে আসছি। ঘা শুকিয়ে এসেছে কিন্তু টনটনানিটা যাচ্ছে না। সালভা চলে গেল।
শাঙ্কো টান টান হয়ে শুয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস চোখ বন্ধ অবস্থাতেই বলল–মারিয়া শুয়ে বিশ্রাম করো। অনেক ধকল গেছে। মারিয়া শুয়ে পড়তে পড়তে বলল–ফ্রান্সিস পারবে পাণ্ডুলিপি উদ্ধার করতে? চোখ না খুলেই ফ্রান্সিস বলল–আগে রামন লালের থাকার ঘর–পড়ার ঘর–পেছনের ছোটো গীর্জাটা–শিক্ষাগুরুদের থাকার জায়গাগুলো–এসব দেখি–তারপর বুঝবো পারবো কি পারবো না।
বিকেল হয়ে এলো। সালভা ফিরল তখন। ওর পোশাকের পকেট থেকে একটা তামার চৌকোণো চাকতি বেরকরল। ফ্রান্সিসের হাতে দিয়ে বলল–পাঞ্জা। রাজা পাঠিয়ে দিয়েছেন। এটা দেখিয়ে যেখানে খুশি আমরা যেতে পারবো। মারিয়া হাত বাড়িয়ে পাঞ্জাটা নিল। দেখতে লাগল। শাঙ্কো দেখল। ওরা নিশ্চিন্ত হল যে এখন রাজপ্রাসাদে ঢোকবার বা বেরোবার জন্যে আর সমস্যা থাকবে না। সালভা ফ্রান্সিসকে বলল– জানেন–মহামতি রামন লালের দেহরক্ষার সংবাদে সারানগর শোকে মুহ্যমান। বন্দরে সব কাজকর্ম বন্ধ হয়ে গেছে। দোকানটোকানও বন্ধ হয়ে গেছে। পথ জনশূন্য। সবাই অধীর আগ্রহে আপেক্ষা করছে কালকে কখন সেনাপতি রামন লালের পবিত্র দেহ নিয়ে আসে। ফ্রান্সিস শুনল। কোনো কথা বলল না। ওর তখন চিন্তা নক্শায় কীভাবে কী। নির্দেশ দিয়েছেন রামন লাল?
সন্ধে হ’ল। ফ্রান্সিস তখনও চুপ করে শুয়ে ভাবছে। সালভা বলল–কী করবেন এখন?
সন্ধে হয়ে গেছে। অন্ধকারে শুধু মোমবাতির অলোয় কিছু বোঝা যাবে না। আজ রাতে শুধু বিশ্রাম। কালকে সকাল থেকে কাজে লাগতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
রাতে খাওয়াদাওয়ার পর ফ্রান্সিস মোমবাতির আলোয় নকশাটা দেখল বেশ কিছুক্ষণ। তারপর মোমবাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ল।
ভোর হতেই পালমার অধিবাসীরা দলে দলে এসে জড়ো হতে লাগল রাজপ্রাসাদের বাইরে। আস্তে আস্তে ভিড় বাড়তে লাগল। সকাল হতেই বহুলোক জড়ো হল। সবাই শ্রান্ত। কারো মুখে কথা নেই। এত লোক। কিন্তু কোনো শব্দ নেই। শুধু এখানে ওখানে দু’চারজন বুড়োবুড়ির ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ শোনা গেল।
হঠাৎ জনারণ্যে বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি হল। দেখা গেল দূরে যুদ্ধসাজে সজ্জিত সেনাপতি ঘোড়া ছুটিয়ে আসছেন। তার পেছনে একটা ঘোড়ায়টানা গাড়িতে রাখা কাঠের কফিন। গাড়িটা চারদিক থেকে ঘিরে আসছে একদল অশ্বারোহী সৈন্য। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সৈন্যরা সবাই পরিশ্রান্ত। অপেক্ষারত নগরবাসীদের মধ্যে চাঞ্চল্য জাগল। সবাই সেই কফিনের কাছে যেতে চায়। কিন্তু সৈন্যরা কাউকে এগোতে দিল না।
রাজা প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এলেন। সঙ্গে মন্ত্রীমশাই। পেছনে প্রাসাদরক্ষীরা। রাজা ও মন্ত্রীমশাই পায়ে হেঁটে সিংহদ্বারের কাছে এলেন। সিংহদ্বার আগেই খুলে রাখা হয়েছিল। কফিনের গাড়ি আস্তে আস্তে সিংহদ্বার দিয়ে ঢুকল। রাজা আর মন্ত্রী মাথা নুইয়ে সম্মান জানালেন। সিংহদ্বারের সামনেই কফিনের গাড়িটা থামিয়ে দেওয়া হল। বন্ধ করে দেওয়া হল সিংহদ্বার। সিংহদ্বারের লোহার গরাদের ওপর মানুষের ঢল নামল। সবাই সেই কফিনটা দেখতে চায়। শেষ শ্রদ্ধা জানাতে চায় রামন লালের নশ্বর দেহকে।
ফ্রান্সিসরা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সেই দৃশ্য দেখছিল। ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে বলল– বুঝলে মারিয়া–মাজোরকার মানুষরা সত্যিই রামন লালকে শুধু শ্রদ্ধাই করতো না ভালোবাসতো।
ওদিকে বন্দি আল আমিরিকে নিয়ে যাওয়া হল সৈন্য আবাসের লাগোয়া কয়েদখানায়। উদ্ধার করা দ্বিতীয় পাণ্ডুলিপিটা নিয়ে সেনাপতি রাজার পেছনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন। রাজা প্রাসাদে ফিরলেই পাণ্ডুলিপিটা দেবেন।
রামন লালের পবিত্র দেহ প্রাসাদ সংলগ্ন সমাধিস্থলে সমাধিস্থ করার আয়োজন চলল।
ফ্রান্সিস সালভাকে বলল–চলো–রামন লালের থাকার ঘর যেখানে ছিল সেখানে। মারিয়া শাঙ্কো এগিয়ে এলো। চলল সবাই।