২
দুপুরের দিকেই হ্যারি বুঝতে পারল–জ্বর আসছে। গতকাল থেকেই শরীরটা ভালো লাগছিল না। অল্পক্ষণের মধ্যেই জ্বর বাড়লো। কপালে দপদপানি শুরু হল। শরীরের গাঁটে গাঁটে মোচড়ানো ব্যথা।বিস্কো বা অন্য ভাইকিং বন্ধুরা তখনও জানেনা-ফ্রান্সিসের নতুন সংকল্পের কথা। বিস্কো হ্যারির কাছে জানতে এলো এবার দেশের দিকে জাহাজ চালাবে কিনা। দেখল হ্যারি চোখ বুজে শুয়ে আছে। ভাবলো–ঘুমুচ্ছে বোধহয়। বিস্কো বিছানায় বসে ডাকলো–হ্যারি? হ্যারির কোনো সাড়া শব্দ নেই। বিস্কো হ্যারির কাঁধে হাত রেখে ডাকতে গেল। চমকে উঠল। হ্যারির গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে যেন। বিস্কো বিছানা থেকে দ্রুত উঠে দাঁড়াল। হ্যারির কপালে গলায় হাত রাখল। ভীষণ জ্বর। একে শরীরের দিক থেকে হ্যারি বরাবরই দুর্বল। রিস্কো বেশ ঘাবড়ে গেল।তাড়াতাড়ি হ্যারিকে আস্তে ধাক্কা দিল। ডাকল–হ্যারি? হ্যারি চোখ মেলে তাকাল। দু’চোখ বেশ লাল। বিস্কো আর দাঁড়াল না। ওদের বৈদ্যি বন্ধুকে ডাকতে ছুটল।
অল্পক্ষণের মধ্যেই বৈদ্যি ওষুধের পুঁটুলি, একটা বোয়াম নিয়ে এলো। হ্যারিকে পরীক্ষা করল। তারপর পুঁটুলি থেকে এক চিমটে লাল গুঁড়ো বের করে হ্যারিকে খাইয়ে দিল। বোয়াম থেকে কিছু কালো চটচটে ওষুধ বের করে দু’হাতের তালুতে ঘষে বড়ির মতো বানাল। বিস্কোর হাতে দিয়ে বলল–রেখে দাও–সন্ধে রাতে একটা করে খাইয়ে দিও। বৈদ্যি পুঁটুলি বোয়াম নিয়ে চলে গেল।
একটু পরে হ্যারি চোখমুখ কুঁচকে বিস্কোর দিকে পাশ ফিরল। বলল–বিস্কো– ফ্রান্সিস এখন দেশে ফিরতে রাজি নয়। বিস্কো বেশ আশ্চর্য হল। বলল, কেন?
–সে অনেক কথা। ফ্রান্সিস বলবে সব। হ্যারি বলল। হ্যারির অসুখের কথা শুনে কয়েকজন ভাইকিং বন্ধু হ্যারির কেবিনঘরে এলো। একজন ছুটলো ফ্রান্সিসকে খবর দিতে। একটু পরেই ফ্রান্সিস আর মারিয়া এলো। ফ্রান্সিস হ্যারির কপালে হাত দিল। বুঝল বেশ জ্বর। মারিয়াকে বলল সে-কথা। মারিয়া ঘরের চারদিকে তাকাল। ছেঁড়া কাপড়-টাপড় কিছু দেখল না। তখন নিজের পোশাক থেকে কিছুটা ছিঁড়ে নিল। কাঠের গ্লাসে জল ভরে নিয়ে এলো। কাপড়ের টুকরো জলে ভিজিয়ে হ্যারির পাশে বসল। হ্যারির জ্বরতপ্ত কপালে জলপট্টি দিতে লাগল। বিস্কোকে বলল–দরজা সবটা খুলে দাও। আধ ভেজানো দরজা সবটা খুলে দিতেই সমুদ্রের জোর হাওয়া ঢুকল। ঘরের গুমোট ভাবটা কাটল।
দুপুরে স্নান খাওয়া সেরে ফ্রান্সিসরা আবার এলো। মারিয়া জলপট্টি দিতে লাগল।
বিকেল হল। মারিয়া মাঝে মাঝে হ্যারির মাথায় গলায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। হ্যারি চোখ খুলে তাকাল। চোখের লালভাব অনেকটা কম। ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে হ্যারি শুকনো ঠোঁটে হাসল।
–এখন কেমন বোধ করছো? হ্যারির মুখের কাছে ঝুঁকে ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল।
-জ্বর কমেছে। ভালো লাগছে–হ্যারি আস্তে আস্তে বলল–তুমি এখন কী করবে বন্ধুদের বলো।
-ও-হ্যাঁ। ফ্রান্সিস সোজা হয়ে বসল। বিস্কোর দিকে তাকিয়ে বলল
সব বন্ধুদের সন্ধেবেলা ডেক্-এ আসতে বলো। আমার কিছু বলার আছে।
–বেশ-খবর দিচ্ছি। বিস্কো বলল।
সন্ধে হল। ভাইকিং বন্ধুরা ডেক্-এ এসে জমায়েত হল। ফ্রান্সিস এখন কী করবে তাই নিয়ে ওরা পরস্পর কথা বলতে লাগল। একটু পরে ফ্রান্সিস মারিয়াকে নিয়ে ডে এ এলো। বন্ধুদের গুঞ্জন থেমে গেল। আকাশে চাঁদ একটু উজ্জ্বল। জ্যোত্মা পড়েছে শান্ত সমুদ্রের জলে জাহাজে। হাওয়ার তেমন জোর নেই। ফ্রান্সিস একটু গলা চড়িয়ে বলতে লাগল–ভাইসব–সামনে যে ডাঙা দেখা যাচ্ছে–এটা একটা ছোটো বন্দর নাম পালমা নোভা। মাজোরকা দ্বীপের বন্দর। রাজধানীর নাম পালমা। সেটা দূরে। এবার ফ্রান্সিস সালভার কথা, আল আমিরির কথা, রামন লালের পাণ্ডুলিপির কথা, নকশার কথা বলল। তারপর বলল–আমার আপন ভাইয়ের মতো হ্যারি অসুস্থ। আমার মন ভালো নেই। তবু আমাকে যেতেই হবে। তোমরা হ্যারিকে দেখবে। স্থির করেছি আমি, মারিয়া আর শাঙ্কো ঐ দ্বীপে যাবো। রামন লালের প্রথম পাণ্ডুলিপি খুঁজে বের করব। ফ্রান্সিস থামল। সবাই তখন ভাবছে ফ্রান্সিসের কথাগুলো। বিস্কো বলল কী আছে ঐ পাণ্ডুলিপিতে?
-সাধারণ সীসে দস্তা পারদকে সোনায় রূপান্তরিত করার সূত্র লেখা আছে ঐ পাণ্ডুলিপিতে। ফ্রান্সিস বলল। একজন ভাইকিং বন্ধু বলল–
–ফ্রান্সিস এটা কি সম্ভব?
–এই বিষয়টিকে বলে অ্যালকেমি অর্থাৎ অপ-রসায়ন। পাণ্ডুলিপির সূত্রগুলো পেলে প্রক্রিয়া বের করে হয়তো কোনো রসায়নবিদ কিছু করতেও পারেন। আমার লক্ষ্য ঐ প্রথম পাণ্ডুলিপি খুঁজে বের করা। তারপর ঐ দ্বীপের রাজা তৃতীয় জেমসকে দিয়ে দেওয়া। অ্যালকেমি নিয়ে আমার কোনো আগ্রহ নেই।
–কিন্তু একটা কাগজের পাণ্ডুলিপি তো সোনা মুক্তোর মতো মূল্যবান কিছু নয়। একজন ভাইকিং বন্ধু বলল।
ঠিক। কিন্তু তোমরা তো জানো–গুপ্ত সম্পদ বা গুপ্ত পাণ্ডুলিপির ওপর আমার বিন্দুমাত্র লোভ নেই। আমি ভালোবাসি দুর্জয় সংকল্পকে বীরত্বকে সাহসকে এবং বুদ্ধির খেলাকে। ফ্রান্সিস বলল।
–তোমরা তিনজন কি পারবে? বিস্কো বলল।
–দেখা যাক। আমরা চলে গেলে তোমরা দিনকয়েক অপেক্ষা করো। যদি আমরা না ফিরি তাহলে আমাদের খুঁজতে দ্বীপে নামবে। ফ্রান্সিস বলল।
ভাইকিংদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হল। ফ্রান্সিসরা না ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে। দেশের দিকে জাহাজ চালানো যাবে না। আবার এটাও ওরা ভালো করেই জানে ফ্রান্সিসকে কোনোভাবেই সঙ্কল্পচ্যুত করা যাবে না। আস্তে আস্তে গুঞ্জন থামল। বিস্কো। গলা চড়িয়ে বলল- ফ্রান্সিস আমরা তোমাদের ছেড়ে দেশে ফিরবো না। সব ভাইকিংরা সমর্থনের ধ্বনি তুলল–ও-হো-হো। ফ্রান্সিস হাসল। সভা শেষ হল। সবাই চলে যেতে লাগল। ফ্রান্সিসও মারিয়াকে নিয়ে নিজেদের কেবিন-ঘরে ফিরে এলো। ফ্রান্সিসের মনে সংশয় ছিল হয়তো মূল্যহীন একটা পাণ্ডুলিপির জন্যে বন্ধুরা অপেক্ষা করবে কিনা। ওরা তো অনেকদিন দেশ ছাড়া। কিন্তু বন্ধুরা অপেক্ষা করতে রাজি হওয়ায় ফ্রান্সিসদের সংশয় দূর হল। ও খুশি হল।
রাতের খাওয়া শেষ হল। ফ্রান্সিস ওদের কেবিন-ঘরে আস্তে আস্তে পায়চারি করছে। ভাবছে–কেমন সেই রামন লালের নকশা। কে জানে–মুমূর্ষ রামন লাল ঐ নকশায় গুপ্ত পাণ্ডুলিপির হদিশ কিছু দিয়েছে কিনা। তখনি দেখল মারিয়া বিছানায় বসে ওর একটা গাউন কঁচি দিয়ে কাটছে। ফ্রান্সিস দাঁড়িয়ে পড়ল। বেশ আশ্চর্য হয়ে বলল পোশাকটা কাটছো কেন? মারিয়া কঁচি চালাতে চালাতে মুখে একটু গম্ভীরভাব এনে বলল–ফ্রান্সিস–আমরা একটা অভিযানে যাচ্ছি, নাচের আসরে যাচ্ছি না। কাজেই গাউনের ঝুলটা কেটে ছোটো করছি যাতে দরকার পড়লে সহজে ছুটোছুটি করতে পারি।
-কিন্তু অমন সুন্দর দামি পোশাকটা
জীবন এই পোশাকের চেয়ে অনেক বেশি দামি আর অনেক সুন্দর বেঁচে থাকা। মারিয়া হেসে বলল। ফ্রান্সিসও হাসল। কিছু বলল না। একটু পরে দু’জনে অসুস্থ হ্যারিকে দেখতে গেল। হ্যারি এখন অনেকটা সুস্থ। জ্বর কমেছে। তবুঅভিযানে যাবার মতো সুস্থ ) হয়নি শরীর।
রাত একটু বাড়তে ফ্রান্সিস তৈরি হল। পোশাক পরে কোমরে চামড়ার ফেট্টিতে তলোয়ার গুজল। মারিয়া কাটা গাউনটা পরল। পোশাকটা না হল গাউন না হল ফ্রক। ধনুক তুনীর ঝুলিয়ে শাঙ্কো এলো। ওর কোমরে একটা ধারালো ছোরা। ছোরাটা ও সবসময়ে কোমরে গুঁজে রাখে। সালভাও এলো। বৈদ্যির ওষুধ লাগিয়ে ওর বুকের ক্ষমতা শুকিয়ে এসেছে।
জাহাজ থেকে ঝোলানো দড়ি ধরে ধরে নৌকোয় নামল ওরা।ফ্রান্সিসদাঁড় বাইতে লাগল। শাঙ্কো একা দাঁড় হালের মতো ধরে বসে রইল। নৌকোর ভেতরে বসল মারিয়া আর সালভা। চাঁদের আলোয় ফ্রান্সিস দেখল জাহাজের রেলি ধরে ওদের দিকে তাকিয়ে আছেবিস্কো আর কয়েকজন বন্ধু। আবার বন্ধুদের সঙ্গে কবে দেখা হবে। ফ্রান্সিসদের মনটা একটু উদাস হল। পরক্ষণেই এসব ভাবনা মন থেকে সরাল। জোরে দাঁড় বাইতে লাগল।
একসময় তীরে পৌঁছল ওরা। আগের সেই ছোট্ট খাঁড়ির মধ্যেই নৌকোটা ঢোকাল ফ্রান্সিস। একটু গিয়ে ওরা একে একে নৌকো থেকে তীরের বালিয়াড়িতে নামল। কালকে দেখা সেই জাহাজটা তেমনি দাঁড়িয়ে আছে। ফ্রান্সিস বলল–সালভা ঐ জাহাজটা কাদের?
আল আমিরি এই জাহাজেই সৈন্য আর একদল বন্দি নিয়ে এসেছিল। সালভা। একটু থেমে বলল–গভীর রাত্রে দুর্গের রাজার সৈন্যরা কিছু বোঝবার আগেই প্রচণ্ড আক্রমণ করল। রাজা জেমসের সৈন্যরা বাধা দিল। কিন্তু আল আমিরির মূর সৈন্যদের কাছে ওরা দাঁড়াতেই পারল না। মূরদের কাছে ছিল চামড়ার ফিতের গুলতির মতো স্লিং। ঐ স্লিং দিয়ে পাথরের বক্সে বড় টুকরো ছুঁড়ে ওরা সহজেই দুর্গের সৈন্যদের কাবু করে ফেলল। হেরে গেল রাজা জেমসের সৈন্যরা। সালভা থামল।
জাহাজটা কালকেও দেখেছি জনশূন্য। শাঙ্কো বলল।
–হ্যাঁ, জাহাজটায় কেউ থাকে না। সবাই দুর্গে থাকে। সালভা বলল। জাহাজটা বেশ দূরে। চাঁদের আলোয় অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
সামনে সালভা। পেছনে ফ্রান্সিসরা। বালির ওপর দিয়ে হেঁটে চলল। চারপাশ নিস্তব্ধ। শুধু বাতাসের শব্দ আর সমুদ্রের ঢেউ ভেঙে পড়ার মৃদু শব্দ।
ফ্রান্সিসহাঁ টতে হাঁটতে জাহাজটার দিকে ভালো করে নজর বুলোল। বলল–সালভা জাহাজটায় গতরাতে দু-একটা আলো দেখেছিলাম। আজকে দেখছি সব অন্ধকার। মারিয়া বলল–গতরাতে জাহাজটা থেকে কিন্তু কোনো পাটাতন তীরের বালিতে ফেলা ছিল না। আজকে একটা কাঠের পাতাটন ফেলা রয়েছে।
–হুঁ, দেখছি তাই। ফ্রান্সিস একটু চিন্তিতস্বরে বলল। তারপর চারদিক তাকিয়ে দেখতে দেখতে হাঁটতে লাগল। নাঃ, কোথাও কোনো জনপ্রাণীর দেখা নেই।
বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর দেখা গেল কিছু ছাড়া ছাড়া গাছগাছালি। বাতাসে গাছের পাতায় শব্দ হচ্ছে। তার নীচে পরপর কিছু পাথরের বাড়িঘর। কাছে এসে দেখা গেল সব বাড়িঘর আগুনে পোড়া। পাথন বসানো থামগুলো পুড়ে কালো হয়ে গেছে। ছাত বলে কিছু নেই। সব পুড়ে গেছে। সালভা দাঁড়িয়ে পড়ল। বস্তীর পোড়া ঘরবাড়ি দেখল। তারপর এগিয়ে চলল। পেছনে ফ্রান্সিসরা। কয়েকটা পোড়া বাড়িঘর পার হয়ে একটা পোড়া ঘরে ঢুকল সালভা। ফ্রান্সিসরাও ঘরটায় ঢুকল। এবড়ো-খেবড়ো পাথুরে দেয়াল পুড়ে কালো হয়ে গেছে। সালভা মেঝে থেকে পোড়া কাঠের ডাল সরিয়ে উবু হয়ে বসল। বালি সরাতে লাগল। একটা পাথরের ছোটো পাটাতন। তুলে ফেলল ওটা। একটু একুট ছাই-রঙা গোটানো কাগজ বের করল। হেসে বলল–যা নকশাটা পুড়ে যায়নি। নকশাটা খুলে দেখে নিঃশব্দে ফ্রান্সিসকে দিল। ফ্রান্সিস হাতে নিয়ে দেখতে লাগল। মাথার ওপরে ছাত তো নেই। চাঁদের আলো পড়েছে। ফ্রান্সিস কাগজটার সবটা ছড়িয়ে দেখতে লাগল। কালিতে মোটা টানে রামন লালের নিজের হাতে আঁকা নকশা।
ফ্রান্সিস খুব মনোযোগ নিয়ে নকশাটা দেখতে লাগল। মারিয়াও মুখ বাড়িয়ে দেখতে লাগল।শাঙ্কোও একনজর দেখে নিল। সালভা একটু হতাশ স্বরে বলল–মুমূর্ষ অবস্থায় আঁকা এই নকশাটা দেখে রামন লালের প্রথম পাণ্ডুলিপি বের করতে পারবেন? শাঙ্কো বলল–ভাই এর নাম ফ্রান্সিস। কত নকশা, ছড়া ছবির অর্থ বের করেছে ফ্রান্সিস। দেখে–এটারও রহস্য ভেদ করবে। সালভা আর কিছু বলল না।
হঠাৎ রাতের নৈঃশব্দ ভেঙে দিল একটা তীক্ষ্ণ শব্দ। ভীষণ চমকে উঠে সালভা বলল মূর সৈন্যরা আক্রমণ করার আগে মুখে এরকম শব্দ করে। হঠাৎ ধূপ ধাপ শব্দ শোনা গেল। একদল লোকের ছুটে আসার শব্দ। ফ্রান্সিস দ্রুত হাতে নটা ঢোলা জামার মধ্যে গলার কাছ দিয়ে ঢুকিয়ে দিল। শাঙ্কোও কোমর থেকে ছোরাটা বের করে জামার মধ্যে ঢুকিয়ে রাখল। শাঙ্কো ধনুকে তির পরাল। ফ্রান্সিস এক ঝটকায় তলোয়ার খুলল।
চাঁদের আলোয় দেখা গেল পোড়ো বাড়িটার চারপাশ ঘিরে মূল সৈন্যরা খোলা তলোয়ার হাতে দাঁড়িয়ে আছে। শাঙ্কো ধনুকে তির পরিয়ে ছিলা টানল। লক্ষ্য সামনের মূল সৈন্যটা। ফ্রান্সিস বলল–ধনুক নামাও। ফ্রান্সিস পোড়া ঘরটা থেকে বাইরে এলো। পেছনে মারিয়া শাঙ্কো আর সালভা। সালভার মুখ ভয়ে সাদা হয়ে গেছে। ফ্রান্সিস হাতের তলোয়ার বালির ওপর ফেলে দিল। কোন শব্দ হল না। শাঙ্কো ধনুক বালিতে নাময়ে রাখল।
সৈন্যদের দল থেকে একজন লম্বামতো সৈন্য খোলা তলোয়ার হাতে এগিয়ে এলো। ওর চিবুকে কোকড়া দাড়ি। সালভাকে দেখে হলদেটে দাঁত বের করে হাসল। কালো ঘামে ভেজা শরীরে জ্যোৎস্নার আলো পড়েছে। চক চক করছে যেন। বুকে বর্ম। লোকটা আরবী ভাষায় কী বলল। সাভা মাথা নিচু করল। কোনো কথা বলল না। এতক্ষণে মারিয়াকে দেখে লোকটা বেশ আশ্চর্য হল। আরো আশ্চর্য হল মারিয়ার হাঁটুর নীচে পর্যন্ত কাটা গাউন দেখে। সালভাকে কী জিজ্ঞেস করল। সালভা ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে বলল–জিজ্ঞেস করছে আপনারা কে? ফ্রান্সিস বলল–বলো যে আমরা ভাইকিং। আমরা লড়াই চাই না। সালভা বলল সেকথা। লোকটা সালভাকে কী বলল। তারপর তলোয়ার ঘুরিয়ে সবাইকে হাঁটবার ইঙ্গিত করল। সালভা ঐ লোকটার দিকে যেতে যেতে বলল–চলুন আমাদের দুর্গে যেতে হবে।
আগে পিছে মুর সৈন্যরা চলল। মাঝখানে ফ্রান্সিসরা। দু’পাশে ছাড়া ছাড়া গাছগাছালি। মাঝখানে ধুলোবালির পথ। হেঁটে চলল সবাই।
যেতে যেতে ফ্রান্সিসরা দেখল এখানে-ওখানে কিছু পাথরের ঘরবাড়ি। মাথায় বড়ো বড়ো বুনো ঘাসের ছাউনি। চাঁদের আলোয় একটু দূরেই দেখা গেল পাথরের দুর্গের কালো মাথা। একটা ছোটো টিলার ওপরে ঐ দুর্গা। দুৰ্গটা ঘিরে পাথর গাঁথা প্রাচীর। বেশ উঁচু।
ডানহাতি একটা পাথর গাঁথা পথ দুর্গের সদর দরজায় গিয়ে শেষ হয়েছে। ফ্রান্সিসরা গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়াল। দুর্গের বিরাট কাঠের দরজায় একটা বড়ো পাল্লা ঘর ঘ শব্দ তুলে খুলে গেল। ভেতরে ঢুকল সবাই।
একটা চওড়া পাথর বাঁধানো চত্বর পেরিয়ে টানা বারান্দামতো। দুপাশে পাথুরে দেওয়ালের খাঁজে মশাল জ্বলছে। বারান্দা দিয়ে একটু যেতেই ডানদিকে একটা লোহার গরাদ বসানো ছোটো লম্বাটে দরজা। বোঝা গেল কয়েদঘর। কয়েদঘরের পারারাদার এগিয়ে এলো। ফ্রান্সিস দেখল পাহারাদারটি মূর নয়। গায়ের রং, চেহারা দেখে মনে হল এদেশীয়। একটু বয়েস হয়েছে লোকটার। সেই লম্বাটে লোকটার নির্দেশে পাহারাদার কোমর থেকে লোহার বড়ো গোল রিং-এর চাবির গোছা খুলল। ঘরটার বড়ো তালাটা খুলে লোহার দরজাটা খুলে দিল। লম্বা সৈন্যটি মারিয়ার দিকে তাকিয়ে চড়া গলায় কী বলল। মারিয়া বুঝল না। সালভা বলল–এই কয়েদঘরে আপনাকে থাকতে হবে। মারিয়া একবার ফ্রান্সিসের দিকে তাকাল। তারপর ঘরটায় ঢুকল। ফ্রান্সিস ভাবল আপত্তি করবে। মারিয়াকে ওদের সঙ্গেই রাখতে বলবে। কিন্তু লম্বা সৈন্যটির কঠিন মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝল–এ লোকটি কোনো ওজর আপত্তিতে কান দেবে না। তারপরের ঘরাটির তালা খুলল পাহারাদারটি। শাঙ্কোর তির-ধনুক একজন সৈন্য খুলে নিল। ফ্রান্সিসের তলোয়ারটাও সেই রেখেছেহাতে। ওদের ঘরটায় ঢুকিয়ে দেওয়া হল।ফ্রান্সিস সালভাকে বলল–ঐ সৈন্যটিকে বলো আমাদের কয়েক করা হল কেন? সালভা লম্বা সৈন্যটিকে বলল সেকথা। লম্বা সৈন্যটি ফ্রান্সিসের দিকে কড়া চোখে তাকাল। তারপর কী বলে উঠল। সালভা বলল কালকে আল আমিরির দরবারে হাজির করাবে আমাদের। তারপর উনি যা করেন। ফ্রান্সিস আর কোনো কথা বলল না। শুধু মারিয়া যাতে শুনতে পায়। সেভাবে চেঁচিয়ে বলল–মারিয়া কোন ভয় নেই। আমরা পাশের ঘরেই আছি।
এই ঘরটা বেশ বড়ো। মেঝে শুকনো ঘাস পুরু করে বিছানো। দু’পাশের পাথরের দেয়ালে পোঁতা দুটো লোহার আঙুটা থেকে লোহার শেকল ঝুলছে। শেকলের সঙ্গে বাঁধা লম্বা লম্বা দড়ি। আগে ছোটো দড়ি দিয়ে ফ্রান্সিসদের হাত বাঁধা হল। তারপর। শেকলের লম্বা দড়িগুলোর সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হল আলাদা আলাদা ভাবে। ফ্রান্সিস ঘাসের বিছানায় শুয়ে পড়ল। শাঙ্কো সালভা ঘাসের বিছানায় বসে পড়ল। সৈন্যরা চলে গেল।
ফ্রান্সিস একটুক্ষণ চোখ বুজে শুয়ে রইল। তারপর চোখ খুলল। পাথুরে দেয়ালের আংটায় বসানো মশালের আলোয় ওপরের দিকে তাকাল। বেশ উঁচুতে পাথরের ছাত। দু’পাশে দুটো চৌকোণো মতো এবড়ো-খেবড়ো পাথরের ফোকর। অনেক উঁচুতে সেই গরাদহীন ফোকর। ওটার কাছে পৌঁছোনো অসম্ভব। চারপাশে তাকিয়ে দেখল–আরো শেকলবাঁধা আংটা রয়েছে। শাঙ্কো আস্তে ডাকল–ফ্রান্সিস? ফ্রান্সিস ওর দিকে তাকাল। শাঙ্কো বলল–এখান থেকে পালানো যাবে? শুধু তো আমরা নই। রাজকুমারীও রয়েছেন।
–দেখি–আগে। ক’জন পাহারাদার সৈন্য থাকে কতক্ষণ, পরপর পাহারাদার পালটায় কীভাবে খেতে দেয় তারপর ভাববো। সালভাকে বলল–সালভা এখানে অনেক বন্দি রাখা হয় তাই না?
রাজা জেমসের আমলে শত্রুপক্ষের বন্দি সৈন্যদের রাখা হত। এখন তো আল আমিরির দখলে। আল আমিরি অন্তত জনা পঁচিশেক বন্দিকে এখানে এনে রেখেছিল। দিন চার-পাঁচ আগে এক আরবী ব্যবসায়ী জাহাজ নিয়ে এসেছিল। ক্রীতদাস কেনাবেচা ওর ব্যবসা। আল আমিরি সব বন্দিকে বিক্রি করে দিয়েছিল। সালভা বলল।
বন্দিরা কেউ এখান থেকে পালাতে পেরেছিল? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
–হ্যাঁ, শুনেছি তিনজন বন্দিনাকি কীভাবে দুর্গের পেছনের মরণজলা দিয়ে পালাবার চেষ্টা করেছিল। শোনা যায় ওরা নাকি মরণজলাতেই মারা গেছে। সালভা বলল।
ফ্রান্সিস দ্রুত উঠে বসল। বলল–মরণজলাটা কী? সালভা বলল–কে জানে কেন এই দুর্গের পেছনেই আছে একটা জলাভূমি।
–খুব বড়ো? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
-না, না, তবে কী করে যে এই জলায় জল আসে–কাদা থাকেনা মেরীই জানেন। বলল সালভা।
–আমি জানি। এটা পাহাড়ি এলাকা। পাথরের কোনো গোপন ফাটল দিয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে জল এসে জমা হয়। মাটির ভাগে মিশে কাদা তৈরি করে। ঠিক আছে বলো– ফ্রান্সিস বলল।
জলাভূমিটা লম্বা লম্বা ঘাসে ঢাকা। ঘাসগুলো কোনোদিন সবুজ হয় না। শুকনো হলুদ রঙের। কেউ এই জলার ধারেকাছে আসে না। ঘোড়া খচ্চরও এই ঘাস খেতে আসে না। দিনের আলোতেও জলাটার অন্ধকার ভাবটা কাটতে চায় না। কেমন ধোঁয়াটে সারা জলাভূমিটা। লোকে তাই এটাকে মরণজলা বলে। সালভা বলল।
–হুঁ, মরণজলা। ফ্রান্সিস চিন্তা করতে করতে বলল। তারপর শুয়ে পড়তে পড়তে বলল–রাত শেষ হয়ে এসেছে। ঘুমিয়ে নাও। বিশ্রাম চাই। শরীর ঠিক রাখো। শাঙ্কো আর সালভা শুয়ে পড়ল।
ঠঠাং-ঠং দরজা খোলার শব্দে ফ্রান্সিসের ঘুম ভেঙে গেল। দেখল–পাহারাদার খোলা দরজা দিয়ে ঢুকছে। হাতে একটা কাঠের বড় থালামতো। তাতে গোল কাটা রুটির টুকরো। অন্য ছোটো কানা উঁচু থালাটায় টুকরো আলু-ডুমুরের ঝোলমতো। পাহারাদার দুটো থালা ফ্রান্সিসদের সামনে শুকনো ঘাসের ওপর রাখল। ফ্রান্সিস উঠে বসল। বাঁধা হাত উঁচু করে দেখাল। পাহারাদার মাথা নাড়ল। স্পেনীয় ভাষায় বলল– হাত খোলার হুকুম নেই। বাঁধা হাত দিয়েই খেতে হবে। শাঙ্কো লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। চিৎকার করে বলল–পেয়েছো কী? আমরা কি কুকুর বেড়াল? পাহাদার শাঙ্কোর দিকে তাকাল। কোনো কথা বলল না। শাঙ্কোর চিৎকার করে কথা বলা শুনে দু’জন মূর সৈন্য দরজায় এসে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস আস্তে বলল-শাঙ্কো মাথা গরম করো না। খেয়ে নাও। পেটপুরে খাও। শরীর ঠিক রাখো। শাঙ্কো বসল। তিনজনে খেতে লাগল রুটি ভেঙে ভেঙে। ঝোলটা ভালোই লাগল। খেতে খেতে ফ্রান্সিস পাহারাদারটিকে বলল– ভাই, তুমি তো মূরও নও। পাহারাদারটি মাথা নাড়ল।
–নাম কী তোমার? ফ্রান্সিস বলল।
–কালমা। পাহারাদারটি বলল। খাওয়া হয়ে গেছে। ঘরের কোণার রাখা পীপে থেকে কাঠের বাটিতে জল এনে ফ্রান্সিসদের কালমা জল খাওয়াল। কালমা এঁটো থালা নিয়ে চলে গেল। ঠ ঠঙাং দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
একটু বেলা হল। আবার দরজা খুলল কালমা। ঢুকল সেই লম্বামতো লোকটা। সালভাকে কী বলল। সালভা বলল–ফ্রান্সিস, আল আমিরির কাছে আমাদের হাজির করা হবে। সবাই উঠে দাঁড়াল। ফ্রান্সিসের চিন্তা–আল আমিরি কেমন লোক। সালভার ওপর রাগ আছে। কিন্তু আমাদের কী করবে? আটকে রাখবে না ছেড়ে দেবে?
লম্বা দড়িগুলো থেকে খুলে হাত বাঁধা অবস্থাতেই ফ্রান্সিসদের সামনে পেছনে খোলা তলোয়ার হাতে চারজন সৈন্য। একটু এগোতেই মারিয়ার কয়েদঘর। লোহার দরজার ফাঁক দিয়ে ফ্রান্সিস দেখল ঘাসের বিছানায় মারিয়া চুপ করে বসে আছে। ফ্রান্সিসদের পায়ের শব্দে মুখ তুলে তাকাল। ফ্রান্সিস দাঁড়িয়ে পড়ল। সালভাকে বলল-সালভা লোকটিকে বললো–মারিয়াও যাক আমাদের সঙ্গে। সালভা লোকটিকে বলল সেকথা। লোকটি মারিয়ার দিকে তাকাল। কী ভাবল। কালমাকে দরজা খুলে দিতে ইঙ্গিত করল। দরজা খোলা হল। মারিয়া বেরিয়ে এলো। বাইরের আলোয় ফ্রান্সিস দেখল মারিয়ার মুখ শুকিয়ে গেছে। হয়তো রাতে ঘুম হয়নি। ফ্রান্সিস মাথা নিচু করে এগোল। ভাবল মারিয়াকে না আনলেই ভালো হত। অন্ধকার থেকে হঠাৎ বাইরের উজ্জ্বল রোদে এসে ফ্রান্সিসদের তাকাতে অসুবিধা হচ্ছিল। চোখ কুঁচকে তাকাতে হচ্ছিল।
বাইরের চত্বরে নামল সবাই। চলল সামনের একটা কাঠের দরজার দিকে।
দরজা দিয়ে একটা বিস্তৃত ঘরে ওরা ঢুকল। দিনের বেলায়ও ঘরটা কেমন অন্ধকার। দেয়ালে মশাল জ্বলছে। একটা পাথরের লম্বাটে আসনে রঙচঙে কাপড় পাতা। দু’পা ছড়িয়ে একটু আয়েসী ভঙ্গীতে বসে আছে আল আমিরি। বেশ ফর্সা রঙ। চিবুকে সামান্য দাড়ি। লম্বা শক্তসমর্থ চেহারা। পরনে সাধারণ সাদাকালো রঙের জোব্বামতো। আল আমিরির চোখের দিকে তাকিয়ে ফ্রান্সিস বুঝল লোকটা ধূর্ত আর ক্ষমতালোভী। তার দু’পাশের ছোটো আসনে দু’জন আরবীয় বৃদ্ধ বসে আছে। বোধহয় আল আমিরির পরামর্শদাতা।
ফ্রান্সিসরা দাঁড়িয়ে রইল। লম্বা লোকটি আদাবের ভঙ্গীতে সম্মান জানিয়ে কী বলে গেল। আল আমিরি ভরাট গলায় ডাকল–সালভা? সালভা একটু মাথা নিচু করল। আল আমিরি স্পেনীয় ভাষায় বলল–তুমি খুব বেঁচে গিয়েছিলে। এবার আর তোমার বাঁচার আশা নেই। একটু থেমে বলল
–বল্ কোথায় আছে রামনের পাণ্ডুলিপি?
“আমি সত্যি জানি না সিনির (মহাশয়)। সালভা ভীতকণ্ঠে বলল। আল আমিরি ডান দিকে তাকিয়ে আঙ্গুল নেড়ে কী ইঙ্গিত করল। একটি খালি গা বলশালী মূর কালো লম্বা চামড়ার চাবুক শপাং-শপাং-প্রচণ্ড জোরে চাবুক চালাতে লাগল সালভার গায়ে। সালভা চিৎকার করে উঠল। চোখে জল এলো ওর। আল আমিরি হাত তুলল। বন্ধ হল। চাবুক মারা।
এবার বলো–নইলে–আল আমিরি গলা চড়াল। সালভা যন্ত্রণায় কেঁদে ফেলল। বলল–সেই পাণ্ডুলিপি কোথায় আমি জানি না। বিশ্বাস করুন–আমি সত্যি কিছু : জানি না।
–তুই রামনের মৃতদেহ নিয়ে গোর দিতে যাচ্ছিলি। তুই সব জানি। বল–। আল আমিরি বলে উঠল।
না-না। সালভা জোরে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল–আমি কিছু জানি না। আবার আঙ্গুলের ইঙ্গিত। আবার চাবুকের মার। সালভার পিঠের দিকে পোশাক ছিঁড়ে গেল। রক্ত ফুটে উঠল পোশাকে। ও যন্ত্রণায় কাঁদতে লাগল। ফ্রান্সিসের আর সহ্য হল না। ও বাঁধা দু’হাত ওপরে তুলল। বলল–আমার অনুরোধ–সালভাকে চাবুক মারা বন্ধ করুন। আল আমিরি একবার ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে ফ্রান্সসের মুখের দিকে তাকাল। বলল তাহলে সালভার হয়ে তুই চাবুকের মার খাবি?
আমার কথাটা আগে শুনুন। তারপর আমাকে চাবুকমারতে চান মারবেন। ফ্রান্সিস বেশ দৃঢ়স্বরে বলল।
আল আমিরি আঙ্গুল তুলল। চাবুক মারা বন্ধ হল। ফ্রান্সিস একটু চুপ করে রইল। দেখল–সালভা পাথরের মেঝেয় হাঁটু গেড়ে বসে গোঙাচ্ছে। ফ্রাসিস বলল–রামন লাল অত্যন্ত অসুস্থ অবস্থায় সালভাদের ঘরে স্থান পেয়েছিলেন। মুমূর্ষ অবস্থায় তিনি সালভাকে একটা নকশা এঁকে দিয়েছিলেন। তারপরই বাকরোধ অবস্থায় তিনি মারা যান। ফ্রান্সিস থামল। শাঙ্কোকে বলল–জামার নিচ থেকে নক্শাটা বের করো। শাঙ্কো বাঁধা হাত ফ্রান্সিসের গলার কাছে জামার ফাঁক দিয়ে ঢুকিয়ে নকশাটা বের করে আনল। ফ্রান্সিস নকশাটা বাঁধা হাতে ধরে বলল–এই সেই নকশা। আমার দৃঢ় বিশ্বাস রামন লাল এইনশার মধ্যে সালভাকে হদিশ দিয়ে গেছেন–প্রথম পাণ্ডুলিপিটা তিনি কোথায় গোপনে রেখে দেশত্যাগ করেছিলেন। কারণ সালভা তার স্নেহাস্পদ শিষ্য ছিল। আল আমিরি একজন সৈন্যকে ইঙ্গিত করল। সৈন্যটি এসে ফ্রান্সিসের হাত থেকে নকশাটা নিয়ে আল আমিরিকে দিল। আল আমিরি খুব মনোযোগ দিয়ে নকশাটা দেখতে লাগল। তারপর কিছুই বুঝতে না পেরে বলল–এই নক্শার তো কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। তুই কী করে বুঝলি যে এটাতে গোপন পাণ্ডুলিপির হদিশ আছে? ফ্রান্সিস বলল–
দেখুন রামন লাল বুঝেছিলেন যে তার মৃত্যু আসন্ন। তখন তার বাকরোধ হয়েছে। সালভাকে যে মুখে কিছু হদিশ বলবেন তার উপায় ছিল না। প্রায় অসাড় হয়ে আসা হাতে বেশি আঁকাও সম্ভব ছিল না। তাই খুব ছোটো টানে নক্শাটা এঁকে দিয়েছিলেন। কোথাও কোথাও টান অস্পষ্ট হয়ে গেছে। আল আমিরি নক্শাটা আবার দেখতে লাগল। ফ্রান্সিস বলল–লক্ষ্য করুন নীচে একটা ছোটো চৌকোণোর মধ্যে হয়তো একটা বিন্দু বসাতে গিয়েছিলেন বা কিছু লিখতে চেয়েছিলেন। অসাড় হয়ে আসা হাতের কলমের টান বেঁকে নেমে এসেছে। আর আঁকতে পারেননি। আল মিরি ভালো করে নকশাটা দেখতে দেখতে বলল–তোর বুদ্ধি আছে দেখছি। ফ্রান্সিস বলল–আর একটা কথা। নকশাটার মধ্যে যে জায়গাটার ইঙ্গিত করা হয়েছে সেটা নিশ্চয়ই সালভার পরিচিত জায়গা। কারণ সালভাকেই তিনি হদিশটা দিয়ে গেছেন। আল আমিরি এবার একটু উঠে পাথরের আসনে ভালো করে বসল। বলল–তুই তো ভিনদেশী–পারবি এই নকশার নির্দেশ বের করতে?
–এখনই সেটা বলতে পারবো না। পালমার রাজপ্রাসাদে সালভা রামন লালের কাছে বেশ কয়েক বছর পড়াশুনো করেছে। এই পড়াশুনোর জায়গাটা রামন লাল যেখানে থাকতেন–মানে সেইসব জায়গাগুলো ভালো করে দেখতে হবে। এর জন্যে সালভাকে আমার সঙ্গে থাকতে হবে। ওর সাহায্য ছাড়া কিছুই করা যাবে না। ওকে নিয়েই আমাকে পালমার রাজপ্রাসাদে যেতে হবে। কারণ মৃত্যুকালে রামন লাল অনেক কষ্টে আলমুদাইলা মানে পালমার রাজপ্রাসাদের নাম বলেছিলেন।
–হুঁ। আল আমিরি একটু ভাবল। তারপর বলল–ঠিক আছে সালভা যাবে তোর, সঙ্গে। তোরা পাণ্ডুলিপিটি উদ্ধার করে গোপনে এখানে নিয়ে আসবি।
–আমি চেষ্টা করবো। ফ্রান্সিস বলল।
–কিন্তু একটা শর্ত আছে। আল আমিরি আবার পা ছড়িয়ে বসতে বসতে বলল।
ফ্রান্সিস বুঝল–আল আমিরি অত সহজে ওদের ছেড়ে দেবে না। আল আমিরি মারিয়ার দিকে ইঙ্গিত করে বলল।
–এ কে? ফ্রান্সিস বলল–আমাদের দেশের মাননীয়া রাজকুমারী।
–তা রাজপ্রাসাদ ছেড়ে এখানে এসেছে কেন? আল আমিরি বলল।
–আমি ওঁর স্বামী। তাই আমার সঙ্গে এসেছেন। ফ্রান্সিস বলল।
আল আমিরি এবার একটু ভদ্র হবার চেষ্টা করল। মুখে শব্দ করল। তারপর সেঁতো হাসি হেসে বলল–তোমরা যতদিন না পাণ্ডুলিপি উদ্ধার করে নিয়ে আসছো ততদিন তোমার স্ত্রী এখানে কয়েদঘরে বন্দি থাকবে। কী? রাজি?
ফ্রান্সিস এ ধরনের একটা কিছু আগে থেকেই আঁচ করেছিল।
ও বলল–বেশ, আমি আপনার শর্তে রাজি আছি।
মারিয়া চমকে উঠে ফ্রান্সিসের দিকে তাকাল। বলল–
-কী বলছো তুমি? শাঙ্কোও বলে উঠল–ফ্রান্সিস–এরকম একটা সাংঘাতিক শর্তে তুমি রাজি হলে? তোমার কি মাথা খারাপ হল? ফ্রান্সিস কোনো কথা বলল না।
আল আমিরি বলল–তোমরা কালকে পালমা রওনা হবে।
এবার আর একটা শর্ত–তোমরা কাউকে বলতে পারবে না যে আমি এই পালমা নোভার দুর্গ অধিকার করে এখানেই আছি। যদি বলো–
–ঠিক আছে। আমরা বলবো না–ফ্রান্সিস বলল–এবার আমাদের বাঁধা হাত খুলে দিতে বলুন।
–না এখন নয়–কালকে যখন রওনা হবে তখন। আল আমিরি বলল। ফ্রান্সিস। বলল–বেশ–কিন্তু আমার একটা অনুরোধ আছে।
–বলো। আল আমিরি বলল। মারিয়াকে দেখিয়ে ফ্রান্সিস বলল–
–রাজকুমারী মারিয়া কয়েদঘরের জীবনে অভ্যস্ত নন। মারিয়াকে দুর্গের অন্দরমহলে নজরবন্দি করে রাখুন–আপত্তি নেই।
–ভেবে দেখি–আল আমিরি বলল।
–সালভার চিকিৎসার ব্যবস্থা করবেন–আমার অনুরোধ–ফ্রান্সিস বলল।
–হুঁ। আল আমিরি মুখে শব্দ করল। ফ্রান্সিস বলল–এবার তাহলে নকশাটা দিন। ওটা নিয়ে তো আমাকে ভাবতে হবে। আল আমিরি নকশাটা একজন সৈন্যকে ইশারায় ডেকে দিল। ফ্রান্সিস নশাটা নিয়ে ফিরে দাঁড়াল। শাঙ্কো গিয়ে আহত সালভাকে বাঁধা হাতে কোনোরকমে উঠে দাঁড় করাল। নিজে নিচু হয়ে বসল। দু’হাত বাঁধা সালভাকে নিজের পিঠের ওপর ভর রাখতে বলল। সেইভাবে সালভাকে প্রায় পিঠে করে নিয়ে চলল।