মাছ (১)
ভগবানের প্রথম অবতার হল মাছ।
মাছ হল আমাদের দেবতা।
আবার প্রেমের দেবতা, কামের দেবতা মদনের নাম হল মীনকেতন, মীনধ্বজ। মদনের পতাকার প্রতীক মাছ।
বাঙ্গালি হিন্দুর সব মঙ্গলকার্যে মাছ অপরিহার্য। বিয়েতে, অন্নপ্রাশনে তো বটেই, শুভ বিজয়াদশমীতে, শ্রীপঞ্চমীতে জোড়া মাছ লাগবে। জোড়া ইলিশ যদি নেহাতই না জোটে, আঁশওয়ালা একজোড়া মাছের কপালে সিঁদুরের ফোঁটা দিয়ে বরণ করতে হবে।
এদিকে আবার রাশিচক্রের দ্বাদশ রাশির অন্যতম হল মীনরাশি। সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁর একটি আত্মজীবনীমূলক কবিতায় লিখেছিলেন যে, তিনি যদিও সঠিক জানেন না— তাঁর ধারণা, তাঁর হল মনিরাশি, কারণ ‘যেরকম মাছ ভালবাসি।’
আরো অনেক আগে বাঙালির অন্য এক প্রাণের কবি প্রার্থনা করেছিলেন, “আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।”
অবশ্য এই দুধে-ভাতের সঙ্গে মাছে-ভাতের জন্যে দুর্বলতাও আমাদের কম নয়। দুর্ভাগ্যের বিষয়, বাঙালির আহার তালিকা থেকে দুধ-ভাত অনেকদিন বিদায় নিয়েছে। কষ্টেসৃষ্টে মাছে-ভাতে এখনও একটু টিকে আছে।
মাছের সম্পর্কে লিখতে গিয়ে মেছোগল্পের কথাও বলতে হয়। মেছোগল্প মানে আঁশটে গন্ধওয়ালা গল্প, যাকে ইংরেজিতে বলে ফিশি টেল (Fishy tale)। কোনো ঘটনা বা ব্যাপার সন্দেহজনক বা গোলমেলে মনে হলে বলা হয় ফিশি ব্যাপার।
মাছের গল্প প্রথমে যেটা মনে পড়ছে, সেটা এক মৎস্য-শিকারির। অবশ্য মাছের অধিকাংশ গল্পই হতভাগ্য মৎস্যশিকারিকে নিয়ে।
ধরেই নেওয়া হয়, যাঁরা ছিপ দিয়ে মাছ ধরেন, তাঁরা তাঁদের মাছ শিকারের গল্পগুলো একটু বানিয়ে বানিয়ে বলেন। কথাই আছে যে একজন মৎস্য-শিকারি তখনই সত্যি কথা বলেন, যখন অন্য কোনও মৎস্য-শিকারি সম্পর্কে তিনি মন্তব্য করেন, “ও লোকটা মিথুক।”
একটা সত্যি ঘটনার উল্লেখ করা এখানে অসংগত হবে না। আমার এক কাকা ছিলেন শৌখিন মৎস্য-শিকারি। ছিপ, বঁড়শি, চার, টোপ ইত্যাদিতে ছিল তার প্রবল উৎসাহ। আর উৎসাহ ছিল মাছের গল্প বা মাছ ধরার গল্প বলায়।
একদিন লক্ষ করলাম, কাকা লোকদের একটা কাতলা মাছের গল্প বলছেন যে, মাছটা তাঁর ছিপের সুতো ছিঁড়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু গল্পটার গোলমাল হল এই যে, কাকা একেকজন লোককে মাছটার আকার একেকরকম দেখাচ্ছেন।
বেশ কয়েকবার এ-ঘটনা ঘটবার পর আমি কাকাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “একেকবার একেকজন লোককে কাতলা মাছটার সাইজ একেকরকম বলছ কেন?”
মৃদু হেসে কাকা বললেন, “যে যতটা বিশ্বাস করবে, যে যেমন বিশ্বাস করবে তাকে তেমন সাইজ বলি। আমি কখনও কাউকে মাছটার আকার তত বড় বলি না যত বড় সে বিশ্বাস করবে না।”
ছিপ-বঁড়শি দিয়ে মাছধরার কাহিনীর সঙ্গে এবার জাল দিয়ে মাছ ধরার গল্প বলতে হয়।
কোলাঘাটের কাছে রূপনারায়ণে একবার ফাল্গুন মাসে দেখি, সারি সারি ইলিশ মাছ ধরার নৌকো। ফাল্গুন মাসে ইলিশ মাছ একটু অস্বাভাবিক। তীরের কাছ দিয়ে একটা নৌকো যাচ্ছিল। আমি সেই নৌকোর মাঝিদের চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “আপনারা যে এখন ইলিশ মাছ ধরতে যাচ্ছেন, এটা কি ইলিশ মাছের সময়?”
অত্যন্ত বিরক্ত মুখে এক প্রবীণ জেলে নৌকো থেকে আমাকে জানালেন, “দেখুন, যখন ইলিশের সময়, একটা ইলিশও তখন নদীতে আসেনি, আবার এখন যখন ইলিশের সময় নয়, তখন ঝাঁকে-ঝাঁকে হাজারে-হাজারে ইলিশ নদীতে চলে এসেছে। তা ইলিশরা নিজেরাই যদি তাদের নিয়ম না মানে, আমরা সে নিয়ম মেনে কী করব?”
অনেক হাসির ব্যাপার হল। এবার একটা দুঃখের গল্প বলি।
গল্পটা খুবই পুরনো, খুবই দুঃখের, চিরকালের এবং চিরদেশের। যে কোনো শৌখিন মাছশিকারি, যিনি কিনা ছিপ-বঁড়শি, চার-টোপের কারবারি, তাঁর মনের গোপনতম দুঃখের সত্য কাহিনী এটা।
সাতদিন ধরে চারের মশলা জোগাড় করা হয়েছে। তেলের ঘানি থেকে আনা হয়েছে সরষের খোল— যা তিনদিন জলে ভিজিয়ে সারা বাড়ি পচা গন্ধে ভরে গিয়েছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হালুইকরের দোকান থেকে নিয়ে আসা চিনির গাদ, যেটা মিষ্টি বানানোর কড়াইয়ের ওপরের সাদা ফেনা থেকে কালো লোহার হাতায় তুলে উনুনের পাশে একটা বড় গামলায় রেখে দেওয়া হয়।
হাজার বোতল চোলাই মদের মাদার টিংচার (mother tincture) এক হাতা চিনির গাদ।
সেই চিনির গাদের মদির সৌরভে শুধু বাড়ি বা পাড়া নয়, পুরো এলাকা আচ্ছন্ন হয়ে গেছে।
এবং এখানেই শেষ নয়।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একাঙ্গী, টম্বল, ছোটএলাচ, মেথি— এইসব দামি মশলা সমূহের ভাজা গুঁড়ো। তার গন্ধও কম মনোহর নয়।
এ হল চারের কথা। এর পরে টোপ আছে, হুইল আছে সুতো আছে, বঁড়শি আছে, ফাতনা আছে। সে এক বিরাট রাজসূয় যজ্ঞের ব্যাপার।
কিন্তু ফল কী হল?
সারাদিনের পণ্ডশ্রমের শেষে শূন্য হাতে এবং ব্যথিত হৃদয়ে মৎস্য-শিকারি ফিরলেন। যথারীতি একটি মাছও তিনি ধরতে পারেননি। কিন্তু বাড়িতে তো খালিহাতে যাওয়া যায় না— সে তো মহা হাসাহাসির ব্যাপার হবে। ফেরার পথে ভদ্রলোক এক মাছের দোকানে গিয়ে চারটে মোটামুটি সাইজের মাছ কিনলেন তার পর মাছওয়ালাকে বললেন, “ভাই, মাছগুলো আমাকে দূর থেকে ছুড়ে ছুড়ে দাও তো। আমি ধরি।”
মাছওয়ালা অবাক হয়ে বললে, “কেন?”
ভদ্রলোক বললেন, “তাহলে আর কিছু না হোক, বাড়ি গিয়ে বলতে পারব মাছগুলো আমিই ধরেছি। শুধু শুধু মিথ্যে কথা বলতে হবে না।”
পুনশ্চঃ
নদীর ধারে দাঁড়িয়ে একজন লোক ছিপ দিয়ে মাছ ধরছিল। হঠাৎ তার ছিপে ধরা পড়ল একটা অতিকায় বোয়াল মাছ।
একটু টানা-হ্যাঁচড়ার পর বোয়াল মাছটা অতর্কিতে বঁড়শির সুতোয় জোর ঝাঁকি দিতে লোকটা ছিপ সমেত জলে পড়ে গেল।
অতঃপর শুরু হল মাছে-মানুষে লড়াই। একদিকে বঁড়শির ও-প্রান্তে মহাবলী বোয়াল মাছ মাছের শিকারিকে টানছে, অন্যদিকে জলের মধ্যে ছিপ হাতে লোকটা মাছটাকে খেলিয়ে তোলার চেষ্টা করছে।
রাস্তা দিয়ে সরল প্রকৃতির এক গ্রাম্য লোক যাচ্ছিল। সে এই দৃশ্য দেখে স্বগতোক্তি করল, “আমি বুঝতে পারছি না মানুষ মাছ ধরছে, না মাছ মানুষ ধরছে।”