মাছ-ধরা
ভ্রমণের কথা বলতে গেলে, আমার দৌড় হল কলকাতা থেকে শান্তিনিকেতন, আবার শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতা। একটা গাড়ি ছিল, সেটা বোলপুর ছাড়ত বেলা চারটের পর আর হাওড়া পৌঁছত রাত সাড়ে আটটা। ঘণ্টাচারেকের ওয়াস্তা। ‘ছাড়ত’ বলছি, কারণ এখন আর ওগাড়িতে যাতায়াত করি না। তবে একথা বলতে বাধা নেই যাত্রাটি ছিল বড়ই রোমাঞ্চকর।
প্রথম কথা গাড়িটির এক ঘণ্টা আগে-পরে আসা কিছুই বিচিত্র ছিল না। এ-লাইনে কুড়ি মিনিট লেটকেও আমরা অন-টাইম বলি। রোমাঞ্চ অন্য কারণে। গাড়ির বাতিগুলো ছিল কেমন যেন। ট্রেন ছাড়লেই জ্বলে উঠত; যতই বেগ বাড়ত ততই জোরালো হয়ে উঠত, কিন্তু কোনও স্টেশনে এসে ঢুকলে, কমতে কমতে শেষটা নিবেই যেত। কে নামল, কে উঠল কিছুই মালুম দিত না। হঠাৎ অন্ধকার কথা কয়ে উঠত।
একবার ওই গাড়িতে কলকাতা ফিরছি আমরা জনাতিনেক। আলোও ওইরকম বাড়তে বাড়তে কমতে কমতে, শেষটা এক্কেবারে নিবে গেল। কর্ড লাইন দিয়ে চলেছি। এটুকু টের পাচ্ছিলাম। অন্ধকারে একদল লোক লটবহর নিয়ে গাড়িতে উঠল, এটুকু টের পেলাম। সঙ্গে সঙ্গে মৃদু একটা গন্ধে কামরা ভরে গেল আর আমার জ্যাঠামশাইদের। জন্য বড়ই মনকেমন করতে লাগল। কোন কালে তাঁরা স্বর্গে গেছেন, এখন হঠাৎ কেন তাঁদের জন্য মনকেমন করবে? ট্রেনের বেগটা একটু বাড়তেই আলোও জ্বলে উঠল, আমিও মনকেমনের কারণ বুঝলাম।
যাঁরা উঠেছিলেন তাঁদের কাপড়চোপড় আলুথালু, অপরিষ্কার, নাকমুখ রোদেপোড়া কালো ভূত। কিন্তু চোখে সুগভীর তৃপ্তি। সঙ্গের লটবহর হল লম্বা লম্বা বাঁশের ছিপ, গোল গোল বেতের চুপড়ি, তাতে কালো কালো কিছু কিলবিল করছে আর একটা ময়লা ন্যাকড়া-বাঁধা কাঠের বাক্স, তার ভেতর থেকে ভুরভুর করছে মশলার গন্ধ। প্রাণটা আঁকুপাঁকু করে উঠল। এ যে আমার বড় চেনা গন্ধ, খুব একটা সুগন্ধ হয়তো নয়, কিন্তু নাকে যেতেই হৃদয় উদ্বেলিত হয়ে উঠল। সোজা ভাষায় এটি মাছ-ধরার চারের গন্ধ।
অর্থাৎ কিনা ছুটির দিনে এঁরা দল বেঁধে মাছ ধরে ফিরছেন। সেই স্টেশনটাকে তখন চিনতে পারিনি, নামও পড়তে পারিনি, কিন্তু এখন আর বলে দিতে হবে না। ও ডানকুনি না হয়ে যায় না। ডানকুনি সেকালে ছিল মাছ-ধরিয়েদের স্বর্গ। এখনও তাই কি না বলতে পারি না। খালি মনে মনে বলি, তাই যেন মনে হয়, দেড়শো বছরের পুরনো কালো পুকুরগুলোকে যেন বুজিয়ে না দিয়ে থাকে!
জ্যাঠামশাইদের পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তিনজন হাতে ছিপ, গাছে পিঠ দিয়ে সারা ছুটির দিন কাটিয়ে দিতে পারতেন। নষ্টের গোড়া বড়জ্যাঠা, সারদারঞ্জন। সেজ মুক্তিদারঞ্জন। আর ছোট কুলদারঞ্জন তাঁর ভক্ত শিষ্য। এঁরাও সন্ধ্যা নামলে পর ওইরকম কালো মুখ আর চোখে তৃপ্তি নিয়ে বাড়ি ফিরতেন। মাছ পড়া কি না পড়ার সঙ্গে যে ওই তৃপ্তির কোনও সম্বন্ধ নেই, সেটা বুঝতে আমার খুব বেশি সময় লাগেনি। আসল কথা হল সাজসরঞ্জাম নিয়ে মাছ ধরতে যাওয়া, মাছ ধরতে বসা আর বাড়ি ফিরে মাছ ধরার গল্প করা।
খুব সহজ কাজ নয় প্রথম দুটি। এর জন্যে অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হয়। শুধু একটা মেছো পুকুর খুঁজে পেলেই হল না। পুকুরের মালিকের সহানুভূতি থাকা চাই, কিন্তু শখ না থাকলেও চলে। বেশি অতিথিপরায়ণ না হওয়াই বাঞ্ছনীয়। কারণ তা হলে হয়তো ঠিক যখন যে কোনও মুহূর্তে ফাতনা ডুবতে পারে মালুম দিচ্ছে, তখন মালিক এসে পোলাও আর চিংড়ি মাছের মালাইকারি খাবার জন্য পেড়াপিড়ি করে, দিনটাকেই মাটি করে দিতে পারেন। সহযোগ থাকবে, কিন্তু বেশি আগ্রহ থাকবে না, এই হল আদর্শ মালিকের লক্ষণ।
তারপর যাতায়াতের ভাল ট্রেন থাকা চাই, অকুস্থলে পৌঁছতে যেন অতিরিক্ত হাঁটাহাঁটির দরকার না হয়। আর আসল কথা পুরুষ্টু কেঁচো আর তাজা বড় সাইজের পিঁপড়ের ডিমের সন্ধান জানা চাই। ছিপ বঁড়শি ইত্যাদি নিয়ে কোনও সমস্যাই ছিল না। এসপ্ল্যানেডে বড় জ্যাঠার খেলার সরঞ্জামের দোকান ছিল। বর্মা থেকে বাছাই করা ছিপের বাঁশ আসত, ফ্রান্স অবধি চালান যেত।
আরও কিছু দরকার। মাছ-ধরিয়েদের অদ্ভুত সংযম থাকা চাই, যাতে সমান নেশাগ্রস্ত হয়েও সারা দিনের মধ্যে গল্প করে, কি হাত-পা নেড়ে ছায়া ফেলে, টোপ গিলবার আগের মুহূর্তে কেউ সম্ভাব্য মাছ না ভাগায়! পরে বাড়ি ফিরে যত খুশি হাত-পা নেড়ে, যেসব মাছ পালিয়ে গেল তাদের মাপজোক এবং পুত্থানুপুঙ্খ বর্ণনাসুদ্ধ যত খুশি গল্প করা যেতে পারে।
যাদের সত্যিকার মাছ-ধরার নেশা নেই, তারা এমনিতেই বড় মাছ ধরা পড়েনি দেখে রেগে থাকে। কাজেই যেসব বিশাল বিশাল মাছ ধরা পড়েও খেলাতে গিয়ে পালিয়ে গেছে, হয়তো একটা ফার্স্ট ক্লাস বঁড়শি নিয়েই ভেগেছে— তাদের গল্প শুনবার ধৈর্য এদের থাকে না, বিশ্বাসও করে না। অতএব খানিকটা রং চড়িয়ে বললেও দোষ হয় না।
যাই হোক, মশলার কথা বলা হল না। বড় জ্যাঠা একটা চার বানিয়েছিলেন, তার নাম দিয়েছিলেন ‘ইধর আও!’ তাঁর দেখাদেখি যোগীন সরকারও একটা বানালেন। তার নাম দিলেন, ‘উধর মৎ যাও!’ সুখের বিষয় মাছরা তাঁর কথা শুনল না। ও-চার চলল না।
শুনেছি জলের ওপর বড় জ্যাঠার একটু ভাল চার ছড়িয়ে দিলেই, পুকুরের চারকোনা থেকে মাছরা ছুটে এসে, মাত্র তিন-চারটে টোপ দেখে মহা চটে, অপেক্ষা করে থাকত। কিন্তু জ্যাঠামশাইদের বলতে শুনেছি মশলা দিয়ে ভুলিয়ে, কি আলো দিয়ে চোখ ধাঁধিয়ে মাছ ধরা খুব স্পোর্টিং নয়।
বুড়ো বয়সে ছোট জ্যাঠা একবার মেয়ে আর নাতি-নাতনি নিয়ে শিমুলতলা গেছলেন। সঙ্গে ছিপ বঁড়শি ইত্যাদি নিয়ে যাচ্ছেন দেখে সকলের কী হাসাহাসি! ওখানকার দুধ ডিম মাখন মুরগি পেলেই যথেষ্ট, তার ওপর বুড়োর শখ দেখ! সেখানে ভাল পুকুর আছে কি না তাও জানা নেই।
ছোট জ্যাঠার বয়স সত্তরের ওপরে, সঙ্গীসাথী না পেলে মাছ ধরতে যাওয়া অসম্ভব। কিন্তু নেশাগ্রস্তদের আলাদা এক দেবতা আছেন। তিনি তাদের দেখাশুনো করেন। ওখানে পৌঁছেই মেছো কুকুর, খ্যাপাটে সঙ্গীসাথী সব জুটে গেল।
জ্যাঠামশাই রোজ সকাল সকাল খেয়ে ছিপ নিয়ে রওনা দেওয়া আর সন্ধ্যার আগে পোড়া-মুখ নিয়ে ফেরা ধরলেন। আর রোজ বড় বড় গল্প বলতে লাগলেন এই ঢাউস ঢাউস মাছ কীভাবে ফাঁকি দিয়ে ফসকে পালিয়েছে। বলাবাহুল্য কেউ বিশ্বাস করত না।
শেষটা একদিন বড় বেশি ক্লান্ত হয়ে ফিরে, বেপরোয়া ভাবে বলে বসলেন, ‘জানিস, আজ একটা বিশ-সেরি ধরেছিলাম। সে কী খেলান খেলাল রে বাপ, জান বের করে দিল! আমি কি একলা পারি! মৃগাঙ্ক এসে হাত লাগাল। দু’জনে মিলে এক ঘণ্টা খেলিয়ে, কাবু করে এনে তবে তোলা হল!’
মেয়ে মুখ হাঁড়ি করে বলল, ‘কোথায় সে মাছ?’ জ্যাঠামশাই কাঁচুমাচু মুখে বললেন, ‘মৃগাঙ্ককে দিয়ে দিলাম। আমাদের তো অত বড় বঁটি নেই! তাই শুনে সকলে হো হো করে হেসে উঠল।
ঠিক সেই সময় বাইরে ডাকাডাকি। নাতি এসে খবর দিল, ‘মৃগাঙ্কবাবু সের পাঁচেক মাছ কাটিয়ে নিয়ে এসেছেন।’
ব্যস! সব থোঁতা মুখ ভোঁতা হয়ে গেল!