৯
আলিপুর সেন্ট্রাল জেল থেকে আলিপুর কোর্ট। গাড়িতে যেতে দুই থেকে তিন মিনিট লাগার কথা। কিন্তু ওঁদের লাগল আধঘণ্টা। সাড়ে ন’টায় ট্যাক্সি নিয়ে বার হয়েছিলেন জেলখানার ফটক থেকে, আর আদালতের সামনে এসে যখন উপস্থিত হলেন তখন ঠিক দশটা। কারণ ছিল। জেলখানা থেকে ট্যাক্সিটা নিয়ে ওঁরা চলে এসেছিলেন ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে। গাড়িটা বাগানের ধারে রেখে ড্রাইভারের পাশে বসা বাসু-সাহেব পিছন ফিরে বলেছিলেন, একটু নেমে এস, ঐ গাছতলায় বসে কয়েকটা কথা বলব।
পিছনের দিক থেকে সুজাতা আর সুবর্ণ নেমে পড়েছিল।
ট্যাক্সি ড্রাইভার বলে, আমাকে ছেড়ে দিন স্যার-
মানিব্যাগ থেকে একটা দশ টাকার নোট বার করে ওর দিকে বাড়িয়ে ধরে বাসু বলেন, এটা তোমার মিটারের উপর। আধঘণ্টা দাঁড়াতে হবে।
ট্যাক্সি ড্রাইভার বুদ্ধিমান। তৎক্ষণাৎ বুঝে নেয়, মালদার শাঁসালো প্যাসেঞ্জার জুটেছে আজ তার বরাতে। সে কৃতার্থ হয়ে বলে, ঠিক আছে স্যার।
ঘাসের উপর ওঁরা তিনজন বসলেন। বাসু বললেন, সুবর্ণ, বুঝতে পারছি সুপ্রিয় তোমার সঙ্গে দেখা করতে রাজি না হওয়াতে তুমি মর্মাহত হয়েছ—কিন্তু এতে তোমার দুঃখ করার কিছু নেই, এতে তোমার আনন্দিত হওয়ার কথা।
সুজাতা অবাক হয়ে তাকায়। আসামি সুপ্রিয় দাশগুপ্ত হাজতে তার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে না-চাওয়াটা বোম্বাই থেকে ছুটে আসা তার হতভাগ্য স্ত্রীর কাছে কোন্ যুক্তিতে আনন্দের হতে পারে এটা তার মাথায় ঢোকে না। বাসু-সাহেব বলে চলেন, কাল যখন কোর্ট থেকে ফিরে এসেছিলাম, তখন আমার জয়ের সম্ভাবনা ছিল শূন্য—কেসটা হারার আশঙ্কা ছিল হান্ড্রেড পার্সেন্ট। তারপর সন্ধ্যা সাতটার সময় কৌশিক একটা অদ্ভুত আবিষ্কার করে বসল। এক লাফে আমার জেতার সম্ভাবনাটা হয়ে গেল শতকরা পঁচিশ ভাগ। আজ দুরু দুরু বুকে তোমাকে নিয়ে আলিপুর জেলে এসেছিলাম। তুমি হয়তো শুনলে রাগ করবে, আমি মনে মনে ভগবানকে বলছিলাম—হে ঈশ্বর! সুপ্রিয় যেন তার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে রাজি না হয়! শেষ পর্যন্ত দয়াময় আমার প্রার্থনাতে কর্ণপাত করেছেন। আয়াম হ্যাপি টু সে—ঠিক এই মুহূর্তে আমার জয়ের সম্ভাবনা সেভেন্টিভাইভ পার্সেন্ট।
সুবর্ণ তার অশ্রুধৌত চোখজোড়া তুলে তাকায়। কথা বলে না।
সুজাতা কিন্তু স্থির থাকতে পারে না। বলে, কী বলছেন আপনি! সুপ্রিয়বাবু আমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে রাজি না হওয়ায় আপনার এ মামলা জেতার সম্ভাবনা শতকরা পঞ্চাশ ভাগ বেড়ে গেল?
—ইফ নট মোর!
—কেন?
—সেটা আমি এখন বলব না। বলতে পারি না। সুবর্ণকে আমি আশা দিয়ে হতাশ করতে চাই না। কিন্তু একটা কথা বলব সুবর্ণ, মন দিয়ে শোন—
—বলুন?
—আদালতে মনকে খুব শক্ত করে রেখ। যত বড় মানসিক আঘাতই আসুক তুমি ভেঙে পড়বে না। পারবে?
সুবর্ণের চোয়ালের হাড় শক্ত হয়ে উঠল। বললে, আমাকে পারতেই হবে।
—ধর যদি আসামির মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞা হয়, ভেঙে পড়বে না?
সুবর্ণ দাঁত দিয়ে ঠোঁটটা কামড়ে নির্বাক বসে রইল।
বাসু-সাহেব বললেন, তোমাকে সাক্ষী দেবার জন্য ডাকব আমি। পাঁচ-সাতটা প্রশ্ন করব। কিন্তু জেরায় বিপক্ষের উকিল তোমাকে খুব নাকাল করতে চাইবে। তুমি খুব শক্ত হয়ে থাকবে আর জবাবে যা বলবে তাতে নির্জলা সত্য থেকে বিন্দুমাত্র বিচলিত হবে না। পারবে? উত্তরে তোমার স্বামীর ভাল হবে কি মন্দ হবে তা বিবেচনা করবে না—আদ্যন্ত সত্য কথা বলবে!
—তাই বলব আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন—কোর্টে যত বড় আঘাতই আসুক না কেন আমি অটল থাকব।
—দ্যাট্স এ গুড গার্ল। কিন্তু তারও আগে হয়তো একটা শক পাবে তুমি। কোর্টে বসার আগে, মানে তোমাকে সাক্ষী দিতে ডাকার আগে তোমার কানে কানে একটা প্রশ্ন করব আমি। তুমি আমার কানে কানে তার সত্য জবাব দেবে। এগ্রিড?
সুজাতা বলল, এখনই সে উত্তরটা জেনে নিন না?
—সব জিনিসেরই একটা নিজস্ব সময় আছে সুজাতা। এগ্রিড?
— হ্যাঁ!
—তবে ওঠো, চলো, সময় হয়ে গেছে। আদালতে-প্রাঙ্গণে ওঁরা প্রবেশ করলেন দশটায়। সেখানে বাসু-সাহেবের জন্য দুটি বিস্ময় ইতিপূর্বেই উপস্থিত। প্রথমত তাঁর পাশের চেয়ারে বসে আছেন বৃদ্ধ ব্যারিস্টার এ.কে.রে। প্রবেশপথেই দেখতে পেলেন বাসু-সাহেব। উনি ভেবেছিলেন, ব্যারিস্টার রে আজ আসবেন না। দ্বিতীয়ত প্রবেশপথেই দাঁড়িয়ে ছিল কৌশিক।
—কী খবর?
—কৌশিক ওঁকে হাত ধরে বারান্দার একান্তে নিয়ে গেল। নিজের হাতঘড়িতে সময়টা দেখল। দশটা বেজে এক। বললে, ভোর সাড়ে চারটেয় আসানসোল থেকে রওনা হয়েছি। মিনিট দশেক আগে এখানে পৌঁছেছি। শুনুন—জীবন বিশ্বাস ফেরার, তার এক লাখ টাকা সমেত—
—আই নো। নেক্সট?
— মিস.ভি. সল্ভার আস্তানা আমরা খুঁজে পেয়েছিলাম, কিন্তু সেও ভেগেছে!
—লেট হার গো টু হেল্। তার ভাই? বিকৃতমস্তিষ্ক ছেলেটা?
—তাকে উদ্ধার করে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। কোর্টে বসিয়েছি। দর্শকদের গ্যালারিতে—কিন্তু সে পাগল নয় মোটেই
কৌশিক থেমে পড়ল। কে একজন এগিয়ে এসে বললেন, জজসাহেব এসে গেছেন।
বাসু বলেন, চলুন আমি যাচ্ছি—
কৌশিক বলে, আসল কথাটাই আমার বলা হয়নি—
—আসল কথাটা আমি জানি কৌশিক! তুমি মিস্টার ডি. সিল্ভার কাছে যাও। বেচারি অনেক ধকল সয়েছেন এ-কদিন। ডাক্তার দেখিয়েছিলে?
একজন কোর্ট পেয়াদা ছুটতে ছুটতে এসে বললে, স্যার!
—ঠিক আছে, চল।
দ্রুত পায়ে বাসু এসে প্রবেশ করলেন। নিজ আসনের কাছে এসে জজ-সাহেবকে বাও করে বললেন, আয়ম সরি!
জাস্টিস ভাদুড়ী বললেন, য়ু অট টু বি! আমাদের প্রতিটি মিনিট হচ্ছে পাবলিক টাইম। এনি ওয়ে। আর উই অল রেডি নাউ?
বাদীপক্ষে নিরঞ্জন মাইতি উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, আমরা তো অনেকক্ষণ আগে থেকেই প্রস্তুত!
—তাহলে আদালত বসছে। গতকাল মিস্টার পান্ডের ক্রস-এগজামিনেশনের আগেই অধিবেশন শেষ হয়েছিল। মিস্টার পান্ডে! টেক ইয়োর স্ট্যান্ড প্লিজ।
সি.বি.আই অফিসার মঞ্চের উপর উঠে দাঁড়ালেন।
জাস্টিস ভাদুড়ী বললেন, প্লিজ রিমেম্বার, য়ু আর আন্ডার ওথ ওভার-নাইট
ফিঙ্গার-প্রিন্ট এক্সপার্ট অভিবাদন করে বলেন, আই নো মি’ লর্ড!
বাসু-সাহেবকে ইঙ্গিত করলেন বিচারক, প্লিজ প্রসিড!
এতক্ষণ নিম্নস্বরে কথা হচ্ছিল গুরু-শিষ্যে। ব্যারিস্টার রে সাহেব বলেছিলেন, সেজন্য কাল আমি উঠে চলে যাইনি বাসু। আমার শরীরটা খারাপ লাগছিল বলে চলে গিয়েছিলাম। হার-জিত নিয়েই জীবন! ইফ্ য়ু ক্যান টেক দ্যা পাঞ্চ, কান্ট আই সোয়ালো ইট অ্যাজ ওয়েল?
জজ-সাহেব ‘প্লিজ প্রসিড’ বলার সঙ্গে সঙ্গে বাক্যলাপ অসমাপ্ত রেখে বাসু উঠে দাঁড়ালেন। সাক্ষীকে প্রশ্ন করেন, মিস্টার পান্ডে, আপনি কাল আপনার সাক্ষ্যে বলেছেন যে, দুটি ভিন্ন লোকের ফিঙ্গার-প্রিন্ট কোনো অবস্থাতেই হুবহু এক হতে পারে না। তাই না?
—তাই বলেছি।
—যেহেতু, ‘এফ-পি-ওয়ান’ আর বহরমপুর থানায় রক্ষিত ফিঙ্গার-প্রিন্ট দুটি হুবহু এক, তাই আপনি এই সিদ্ধান্তে এসেছেন, যে, কাপাডিয়া অ্যান্ড কাপাডিয়া কোম্পানির ম্যানেজার সুপ্রিয় দাশগুপ্ত এবং খোকন ওরফে লালু অভিন্ন ব্যক্তি? ইয়েস অর নো?
— ইয়েস!
—আপনার দু’বছর স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড ট্রেনিং এই সিদ্ধান্তে আপনাকে পৌঁছে দিয়েছে?
—হ্যাঁ তাই!
—কিন্তু ঐ স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড ইতিহাসে কি এমন নজির নেই, যে হায়েস্ট অথরিটি অন দ্য সাবজেক্ট বলেছেন, দুটি ফিঙ্গার-প্রিন্ট হুবহু মিলে গেছে অথচ পরে প্রমাণিত হয়েছে যে দুটি বিভিন্ন লোকের ফিঙ্গার-প্রিন্ট?
—আমি এমন কেস একটিও জানি না।
—আপনি কি ‘চেজ এ ক্রুকেড শ্যাডো’ ফিল্মটা দেখেছেন?
—অবজেক্শান য়োর অনার। দ্যা কোয়েশ্চেন ইজ ইররেলিভ্যান্ট, ইমপার্টিন্যান্ট এবং বর্তমান মামলার সঙ্গে সম্পর্ক বিমুক্ত।
জাস্টিস্ ভাদুড়ী একটু নড়েচড়ে বসে বললেন, অবজেকশান সাসটেন্ড! বাট্…একটু থেমে বললেন, বিষয়টা অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক। প্রতিবাদী কাউন্সেলকে আমি রিসেস্ পিরিয়ডে এ বিষয়ে আমার সঙ্গে আলোচনা করতে অনুরোধ করছি। আমি ঐ ফিল্মটা দেখিনি, কিন্তু—ওয়েল, য়ু মে প্রসিড…
বাসু-সাহেব একটা বাও করে বললেন, ‘চেজ এ ক্রুকেড শ্যাডো’ ফিল্মটা বর্তমান মামলায় অপ্রাসঙ্গিক, কিন্তু সহযোগী তাঁর ডাইরেক্ট এভিডেন্সে রামচন্দ্রপুরে আগরওয়াল হত্যার মামলার প্রসঙ্গ এনেছিলেন। সে মামলায় বর্তমান বিচারকই বিচার করেছিলেন, এবং আমার সহযোগী আইনজীবীই পাবলিক প্রসিকিউটার ছিলেন। আশা করি আপনাদের মনে আছে, সেখানেও দুটি ফিঙ্গার-প্রিন্ট পুলিশ কর্তৃপক্ষ হুবহু এক বলে সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন, কিন্তু পরে প্রমাণিত হয়েছিল সে দুটি ভিন্ন ব্যক্তির!
নিরঞ্জন মাইতি বলেন, সেটা ছিল অন্য ব্যাপার, তাতে ফিঙ্গার-প্রিন্ট সায়েন্সটা ভুল প্রমাণিত হয়নি।
জাস্টিস ভাদুড়ী বলেন, আমি বাদীর সঙ্গে একমত যাই হোক, আপনি জেরা চালিয়ে যান। বাসু-সাহেব বলেন, মিস্টার পান্ডে, আজ যদি আমি প্রমাণ করি আসামি সুপ্রিয় দাশগুপ্ত খোকন ওরফে লালু নয়, তবে কি আপনি মেনে নেমেন ফিঙ্গার-প্রিন্ট সায়েন্সটা ভুল?
—এটা আপনার পক্ষে প্রমাণ করা সম্পূর্ণ অসম্ভব।
—ওটা আমার প্রশ্নের জবাব নয়। সে, ইয়েস অর নো।
— ইয়েস!
বাসু হেসে বলেন, য়ু শুড বেটার হ্যাড সে ‘নো’! তাই কিন্তু প্রমাণ করব আমি! মাইতি উঠে দাঁড়িয়েছিলেন প্রতিবাদ জানাতে। তার আগেই বাসু বলেন, দ্যাটস্ অল মি’ লর্ড! তারপর মহামান্য বিচারককে সম্বোধন করে বলেন, আদালত অনুমতি করলে আমি আমার পরবর্তী সাক্ষীকে ডাকতে পারি!
মাইতি একটা স্বগতোক্তি করেন, এর পরেও!
জাস্টিস্ ভাদুড়ী তাঁর দিকে কঠিন দৃষ্টিপাত করলেন; বাসুকে বলেন, ইয়েস, প্রসিড!
—আমার পরবর্তী সাক্ষী মিসেস সুবর্ণ দাশগুপ্তা।
—মিসেস সুবর্ণ দাশগুপ্তা হাজির?
সুবর্ণ সুজাতার পাশ থেকে উঠে দাঁড়ালো সাক্ষীর মঞ্চে। অচঞ্চল দীপশিখার মতো।
—আপনার নাম?
—মিসেস সুবর্ণ দাশগুপ্তা।
— স্বামীর নাম?
—মিস্টার সুপ্রিয় দাশগুপ্ত।
—আপনার স্বামী কী কাজ করেন?
—বোম্বাইয়ের কাপাডিয়া অ্যান্ড কাপাডিয়া কোম্পানির ম্যানেজার।
—কতদিন বিয়ে হয়েছে আপনাদের?
— দু’বছর।
—হিন্দু-ম্যারেজ না রেজিস্ট্রি ম্যারেজ?
—রেজিস্ট্রি ম্যারেজ।
—আপনার স্বামী বর্তমানে কোথায় আছেন?
—আমি জানি না।
—অবজেক্শান য়োর অনার! জানেন না মানে কী?—লাফিয়ে ওঠেন মাইতি। জাস্টিস ভাদুড়ী ভ্রুকুটি করেন। একবার সাক্ষী একবার বাসু-সাহেবের দিকে তাকিয়ে দেখেন। বাসুকে কিছু বলতে যান, তারপর মনস্থির করে মাইতিকেই বলেন, অবজেকশান অন হোয়াট গ্রাউন্ডস্?
—ওঁর স্বামী জলজ্যান্ত চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, আর উনি বলছেন ‘জানি না’!
জাস্টিস ভাদুড়ী বাসু-সাহেবের দিকে ফিরে বলেন, আপনি কিছু বলবেন?
—আমি কী বলব? আমি তো শুনছি এখন। আমি সাক্ষীকে প্রশ্ন করেছি, তিনি জবাব দিয়েছেন। সহযোগী ‘অবজেকশান’ দিয়েছেন, তার কারণ দেখাচ্ছেন না। এখন কী বলতে পারি আমি?
—য়ু আর পারফেক্টলি রাইট টেকনিকালি—জজসাহেব মাইতির দিকে ফিরে বলেন, কী আপত্তি এ প্রশ্নোত্তরে তা তো বলবেন?
—এ তো ডাহা মিথ্যে কথা—ফুঁসে ওঠেন মাইতি!
—সো হোয়াট! সেটা জেরায় প্রমাণ করবেন। মিথ্যা সাক্ষী দেওয়ার জন্য সাক্ষীর বিরুদ্ধে মামলা আনতে পারেন, অনেক কিছু করতে পারেন; কিন্তু বর্তমান মামলায় বাধা দিচ্ছেন কোন অধিকারে?
মাইতি অসহায়ভাবে বসে পড়েন।
বাসুর পরবর্তী প্রশ্ন, এই কোর্ট রুমে আপনার স্বামী উপস্থিত আছেন?
সাক্ষী দর্শকমণ্ডলীর উপর দৃষ্টি বুলিয়ে বলেন, আমি জানি না। দেখতে পাচ্ছি না। মাইতি উঠে দাঁড়ান। আবার বসে পড়েন।
বাসু তাঁর বাঁ হাতটা বাড়িয়ে বলেন, আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়ানো ঐ লোকটাকে ভালভাবে দেখুন…বলুন, ঐ লোকটাকে আপনি ইতিপূর্বে জীবনে কখনও দেখেছেন?
—না!
মুহুর্মুহু হাতুড়ির আঘাত সত্ত্বেও কোর্টরুমে নিস্তব্ধতা ফিরে আসতে পুরো এক মিনিট লাগল। জাস্টিস্ ভাদুড়ী এবার কিন্তু কাউকে ধমকালেন না।
বাসুর পরবর্তী প্রশ্ন, কাঠগড়ায় ঐ লোকটা আপনার বিয়ে করা স্বামী, কাপাডিয়া, কাপাডিয়া কোম্পানির ম্যানেজার সুপ্রিয় দাশগুপ্ত, এম. এ. নয়?
—না!
মাইতি আর আত্মসম্বরণ করতে পারেন না। লাফিয়ে ওঠেন, দিস ইস্ প্রিপস্টারাস মি’ লর্ড! এসব ওঁর অতি-নাটকীয় প্যাচ!
বাসু একধাপ এগিয়ে এসে উচ্চকণ্ঠে বলেন, মাননীয় আদালতের কাছে আমার একটি আর্জি আছে! যেহেতু এ পর্যন্ত বিচার আমার মক্কেল সুপ্রিয় দাশগুপ্তের অনুপস্থিতি সংঘটিত হয়েছে তাই আমি এ মামলার আদ্যন্ত নাকচ করবার প্রার্থনা জানাচ্ছি!
বিচারকক্ষে পুনরায় গন্ডগোলের সূত্রপাত হতেই জাস্টিস্ ভাদুড়ী একবার জোরে হাতুড়ির আঘাত করেন। স্তব্ধতা ফিরে আসে। বিচারক বলেন, যেহেতু এখনও চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত হয়নি যে, আপনার মক্কেলের অনুপস্থিতিতে এ মামলার অধিবেশন হয়েছে তাই আপনার প্রার্থনা এখনই মঞ্জুর করা যাচ্ছে না! য়ু মে প্রসিড!
—দ্যাটস্ অল মি’ লর্ড!—বাসু মাইতিকে বলেন, য়ু মে ক্রস-এক্সামিন হার
আহত সিংহের মত লাফ দিয়ে ওঠেন মাইতি। নাটকীয়ভাবে সাক্ষীর সামনে এগিয়ে এসে বলেন, আপনি বললেন যে, ঐ লোকটা আপনার স্বামী নয়?
—তাই বলছি!
—তাহলে আপনার স্বামী কে?
—সুপ্রিয় দাশগুপ্ত!
—ঐ উনিই তো সুপ্রিয় দাশগুপ্ত!
—হতে পারে ওঁরও তাই নাম, কিন্তু উনি আমার স্বামী নন! মাইতি অসহায়ভাবে মাথা নাড়েন। বলেন, রাতারাতি কোথা থেকে আমদানি হলেন আপনি?
—অবজেকশান য়োর অনার! সহযোগীর প্রশ্নের ভাষায় আমার আপত্তি।
—অবজেকশান সাসটেইন্ড! আপনি সংযত ভাষায় প্রশ্ন করুন।
—আপনার কটা বিয়ে?
—অবজেকশান! সহযোগী আদালতের নির্দেশ মানছেন না। তাঁর ভাষা এখনও অশালীন! জাস্টিস ভাদুড়ী মাইতিকে ধমক দেন, আপনি আপনার ভাষাকে সংযত করুন, না হলে ব্যাপারটা আমি আপনাদের বার-অ্যাসোসিয়েশানকে জানাতে বাধ্য হব!
মাইতি কিছু বলতে গেলেন। পারলেন না। মরিয়া হয়ে বললেন, আমি সময় চাইছি মি’ লর্ড। এ মেয়েছেলেটা কে, সে খবরটা—
—অবজেকশান। এই ভদ্রমহিলাকে বলুন!
মাইতি প্রায় তোতলা হয়ে গেলেন।
জাস্টিস ভাদুড়ী বলেন, আপনারা দু-পক্ষ যদি রাজি থাকেন তাহলে আমি দশ মিনিটের জন্য কোর্ট স্থগিত রেখে আমার চেম্বারে আপনাদের দুজনের সঙ্গে ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ করতে চাই। আফটার অল, আমাদের উদ্দেশ্য সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করা।
বাসু বলেন, আমি রাজি, কিন্তু তার আগে আমি একটা কাজ করতে চাই। আমি জানি, ঐ ভদ্রমহিলার স্বামী এই আদালতে উপস্থিত আছেন। তাঁর জীবন সংশয়। তাঁকে শনাক্ত করে সর্বপ্রথম পুলিশের জিম্মায় দেওয়ার প্রয়োজন। আপনি কি ব্যাপারটা আমার হাতে ছেড়ে দেবেন?
—ইয়েস! ডু অ্যাজ্ য়ু প্লিজ!
বাসু-সাহেব দর্শকমণ্ডলীর দিকে তাকিয়ে বললেন, মিস্টার সুপ্রিয় দাশগুপ্ত, ম্যানেজার, কাপাডিয়া অ্যান্ড কাপাডিয়া কোম্পানি, যদি এ আদালতে উপস্থিত থাকেন তবে দয়া করে উঠে দাঁড়ান।
—দেখা গেল ভিড়ের মধ্যে একজন একহারা ফর্সা ভদ্রলোক উঠে দাঁড়িয়েছেন। তাঁরও বড় বড় জুলফি আছে। কিন্তু কোনো মুর্খই তাঁকে আসামির যমজ ভাই বলে ভুল করবে না—চেহারার সাদৃশ্য থাকা সত্ত্বেও।
—আপনি এগিয়ে আসুন!
ধীর পদক্ষেপে ভদ্রলোক এগিয়ে আসেন।
—আপনিই সুপ্রিয় দাশগুপ্ত—ম্যানেজার, কাপাডিয়া অ্যান্ড কাপাডিয়া কোম্পানি?— প্রশ্ন করেন বাসু!
——হ্যাঁ!
—সাক্ষীর মঞ্চে দাঁড়ানো ঐ সুবর্ণ দাশগুপ্তা আপনার স্ত্রী?
লোকটা মুখ তুলে তাকাল। দেখলো চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়ানো মেয়েটি। সে কিন্তু স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটা বললে, হ্যাঁ, আমার স্ত্রী!
মাইতি বললেন, কিন্তু এটা আমরা মেনে নিতে রাজি নই। এরা দুজনেই জাল হতে পারে! সমস্ত ব্যাপারটাই একটা মেলোড্রামাটিক হচপচ হতে পারে।
জাস্টিস ভাদুড়ী বললেন, মিস্টার বাসু, আপনি কি কোনো পথ দেখাতে পারেন যাতে প্রমাণ করা যায়—এঁরা দুজন সত্যি কথা বলছেন, অর্থাৎ আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়ানো ঐ লোকটা সুপ্রিয় দাশগুপ্ত নয়?
—কিছু সময় পেলে নিশ্চয় পারব, কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তেই সেটা কেমন করে সম্ভব?
—ভুল বললে বাসু! এই মুহূর্তেই সেটা প্রমাণ করা সম্ভব। সকলের দৃষ্টি গেল ডিফেন্স কাউন্সেলারদের চিহ্নিত কোনাটায়। উঠে দাঁড়িয়েছেন অশীতিপর বৃদ্ধ ব্যারিস্টায় এ.কে. রে। তিনি একটি বাও করে বলেন, আদালত যদি আমাকে অনুমতি দেন—আমি পাঁচ মিনিটের ভিতর চূড়ান্তভাবে সমাধান করে দেব সমস্যাটা-
জাস্টিস্ ভাদুড়ী বলেন, ইয়েস! প্লীজ ডু ইট!
—মিস্টার পান্ডে এখানে উপস্থিত। তিনি এই দু-জনের ফিঙ্গার-প্রিন্ট নিন। এখনই! তারপর ঐ নথিটা দিন। পিপলস্ এক্সিবিট নম্বর সেভেন। ওটা হচ্ছে সাদার্ন অ্যাভিন্যুর একটা বাড়ির বিক্রয়-কোবালা। বিক্রেতা পাওয়ার অফ এ্যাটর্নি হোল্ডার সুপ্রিয় দাসগুপ্ত। সাড়ে চার লাখ টাকার সম্পত্তি বিক্রয় করতে হলে সই ছাড়াও টিপছাপও দিতে হয়। মিস্টার পান্ডে ওটা দেখে পাঁচ মিনিটের ভিতর শনাক্তকরণ চূড়ান্তভাবে করে দিতে পারবেন।
আধঘণ্টার জন্য কোর্ট অ্যাডজার্ন করে জজ-সাহেব তাঁর খাশ কামরায় চলে গেলেন। সেখানে ডাক পড়ল বাসু মাইতি এবং এ.কে.রে-র। ইতিমধ্যে পান্ডে-সাহেব তাঁর পরীক্ষাকার্য করে জানিয়েছেন, আসামি আর যেই হোক মোহনস্বরূপ কাপাডিয়ার ওকালতনামাধারী সুপ্রিয় দাশগুপ্ত নয়। দর্শকের আসন থেকে যে ভদ্রলোক উঠে দাঁড়িয়েছিলেন তিনিই তাই।
জাস্টিস ভাদুড়ী বলেন, মিস্টার বাসু, আপনি যদি ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে দেন, তাহলে মামলাটার—অবশ্য মামলার নিষ্পত্তি তো হয়েই গেছে। আপনার মক্কেলের অনুপস্থিতিতে—
মাইতি বলেন, তা কেন! ওঁর মক্কেল তো ঐ আসামি! তার অপরাধ তো প্রমাণিত হয়েছে—
—না হয়নি!—বাধা দিয়ে বলেন এ. কে. রে—মামলায় তাকে অসংখ্যবার ম্যানেজার, কাপাডিয়া অ্যান্ড কাপাডিয়া কোম্পানি বলে আপনি উল্লেখ করেছেন। সে তা নয়। সে পুনর্বিচার দাবি করতে পারে আইনত।
বাসু-সাহেব বলেন, সে সব কথা পরে। আপাতত এই নিন আমার দরখাস্ত। বর্তমান মামলার আসামি খোকন ওরফে লালু আমার মক্কেল নয়। স্টেট-ভার্সেস সুপ্রিয় দাশগুপ্তের মামলা ডিস্মিস্ হয়েছে জানলেই আমার ছুটি!
জাস্টিস্ ভাদুড়ী বলেন, মামলা তো ডিমিস্ হয়েই গেছে। শুধু আমার অ্যানাউন্স করা বাকি। কিন্তু রহস্যটা যে কিছুই পরিষ্কার হল না বাসু-সাহেব।
বাসু হাত দুটি জোড় করে বলেন, আমার এক অনুগত ভক্ত আছে। সে গোয়েন্দা গল্প লেখে। কিছুদিনের মধ্যেই তার লেখা ছাপা বই বাজারে বেরুবে। আপনাকে না হয় এক কপি কমপ্লিমেন্টারি পাঠিয়ে দিতে বলব।
উঠে দাঁড়ান তিনি।
এ. কে. রে মাইতির দিকে ফিরে বললেন, আপনার নিমন্ত্রণে এসেছিলাম। আই এঞ্জয়েড ইট থরলি! আমাকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য ধন্যবাদ।
মাইতির মুখটা কালো হয়ে গেল। তবু কাষ্ঠ-হাসি হেসে শুধু বললেন, হেঁ হেঁ!
জাস্টিস্ ভাদুড়ী বললেন, অনেকদিন পরে আপনাকে দেখলাম রে-সাহেব। শরীর ভাল তো?
—ভাল না থাকলে পর পর দুদিন অ্যাটেন্ড করি?
জাস্টিস্ ভাদুড়ী বলেন, বারওয়েল দ্য সেকেন্ড রিটায়ার করায় কলকাতার ‘বার’ কিন্তু কানা হয়ে গেছে রে-সাহেব।
রে বললেন, আই বেগ ডিফার। নূতন সূর্যের উদয় হয়েছে কলকাতার বারে—’পিয়ারি-ম্যাসন অফ দ্য ইস্ট!’ অর্থাৎ সাদা বাংলায় : পূর্বাঞ্চলের ‘মেরে পেয়ারী বাস্তুকার’।