৮
বাড়িতে যখন এসে পৌঁছলেন তখন বিকাল পাঁচটা। গাড়ি থেকে নেমে উনি ধীরে ধীরে ঢুকে গেলেন নিজের চেম্বারে। অন্যদিন সচরাচর প্রথমেই গিয়ে রানির সঙ্গে দেখা করেন। দু-চারটে খোশ-গল্প করতে করতেই এক কাপ কফি খান। তারপর স্নান করেন, এবং তারপর নিজের চেম্বারে গিয়ে বসেন। পিছনে থাক-দেওয়া আইনের, বই—নিচেকার লকারে থাকে লিকার-গ্লাস। বিশু রেখে যায় বরফের কুচির প্লেট। রাত নটায় ডিনার। কিন্তু তারপর আবার শুরু হয় পড়াশুনা। আবার গিয়ে বসেন চেম্বারে—তখন আর মদ্যপান করেন না। ক্বচিৎ কোনোদিন হয়তো একটা ড্রাই মার্টিনি নিলেন—সেটা ধর্তব্যের মধ্যে নয়। কখন শুতে যাবেন সেটা নির্ভর করে পরদিনের মামলার গুরুত্বের উপর—অথবা হয়তো নির্ভর করে কতক্ষণে একটা চাকা দেওয়া চেয়ার এসে থামবে ঐ চেম্বারের দ্বারপথে। শোনা যাবে প্রশ্ন, রাত অনেক হল যে, শোবে না?
আজ তার ব্যতিক্রম হল। বাসু স্নান করলেন না, কফি খেলেন না। রানি দেবীর সঙ্গে দুটো হাল্কা-রসিকতাও করলেন না। এমনকি জামা জুতো পর্যন্ত ছাড়লেন না। ঢুকে গেলেন চেম্বারে।
মিনিট দশেক পরে ইন্টারকমটা সাড়া দিয়ে উঠল। কাচের গবলেটটা সরিয়ে রেখে বাসু সুইচ টিপে বললেন, বলো, শুনছি।
—কফি খাবে না? ভিতরে আসবে না?
—আসব রানু—ভিতরে আসব বই কি। একটু পরে-
—শোনো, ইতিমধ্যে একটা ব্যাপার হয়েছে। একটু আগে সুবর্ণ এসেছে-
চমকে উঠলেন বাসু। অস্বাভাবিকভাবে। হয়তো আনমনা ছিলেন, কিম্বা অত্যন্ত দ্রুত মদটা খাচ্ছিলেন—প্রায় আর্তকণ্ঠে বলে ওঠেন, কে? কে এসেছে বললে?
—ঐ সুপ্রিয়ের স্ত্রী। যাকে আসতে বলেছিলে তুমি—
—হ্যাঁ, কিন্তু কী নাম বললে তাঁর?
বেদনাহত কণ্ঠ ভেসে এল রানি দেবীর, হ্যাঁ, ঐ নামই! আশ্চর্য কোয়েন্সিডেন্স নয়? দুজনেই নীরব। প্রায় আধ মিনিট। শেষে রানি বললেন, আমি ও-ঘরে আসব? –তাই এস আমি ঐ মেয়েটার সামনে দাঁড়াতে…তুমি চলে এস—
নিতান্ত কাকতালীয় ব্যাপার। বছর সাতেক আগে ম্যাসানজোর বাঁধ দেখতে গিয়ে পথ-দুর্ঘটনায় বাসু-সাহেবের যে মেয়েটি মারা যায় তার নাম এবং ঐ ‘দাগী আসামি’ সুপ্রিয় দাশগুপ্তের স্ত্রীর নাম অভিন্ন। দুজনেই সুবর্ণ!
একটু পরে চেম্বারের দরজাটা খুলে গেল। চাকা-দেওয়া চেয়ারে এসে উপস্থিত হলেন মিসেস বাসু। বললেন, সুজাতার কাছে সব শুনলাম। আজকের মামলার খবর।—একটু থেমে আবার বলেন, ছেলেটাকে বাঁচানো যাবে না, নয়?
অসহায়ভাবে মাথা নাড়লেন বাসুসাহেব।
দুজনেই কিছুটা নীরব। তারপর বাসু বললেন, তুমি যা ভাবছ তা নয় রানু। আমার আনব্রোকন রেকর্ড আজ ভেঙে যাচ্ছে বলে আজ ভেঙে পড়িনি আমি। আফটার অল, হোয়াট্স দ্যাট আনব্রোকন রেকর্ড? মিয়ার চান্স! আমি বরাবর জিতেছি। কেন জিতেছি? আমার বাকপটুতার জন্যে? বুদ্ধির জন্যে? আইনজ্ঞানের জন্যে? না! নিতান্ত কোয়েন্সিডেন্স। ঘটনাচক্রে প্রতিটি ক্ষেত্রেই সত্য ছিল আমার পক্ষে। আমি যাদের হয়ে লড়েছি তারা প্রতিক্ষেত্রেই ছিল নির্দোষ। হ্যাঁ, একটিমাত্র ব্যতিক্রম আছে—তোমার মনে আছে নিশ্চয়। সেই মারোয়াড়ি ছেলেটার কেস—যে তার বাপকে খুন করেছিল। কিন্তু আমি যখন তার কেস লড়েছিলাম তখন আমি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করেছিলাম তার কথায়—যে, সে নির্দোষ? সেও বেকসুর খালাস হয়েছিল। খালাস পাবার পর আনন্দের আতিশয্যে সে এসে আমার কাছে স্বীকার করেছিল—সে নিজেই তার বাপকে খুন করেছে!
রানি বললেন, মনে আছে আমার। তারপরে বহুদিন তুমি কোর্টে যাওনি
—সেবার তবু একটা সান্ত্বনা ছিল রানি—আমি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করেছিলাম যে, ছেলেটা নির্দোষ! বিবেকের কাছে আমি পরিষ্কার ছিলাম। কিন্তু এবার? এবার যে আমি নিজেই বুঝতে পারছি লোকটা একটা পাকা ক্রিমিনাল!
—সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই?
—থাকলে এভাবে ভেঙে পড়ি আমি? আগামীকাল জীবনে প্রথম কোর্ট থেকে হেরে ফিরব—সেজন্য আমার কোনো দুঃখ নেই। অতটা আত্মকেন্দ্রিক নই আমি। কোর্ট থেকে ফেরার কথা ভাবছি না আমি। কোর্টে যাবার কথাই ভাবছি। লোকটা দোষী জেনেও কেমন করে তার পক্ষে সওয়াল করব? সেখানেই যে আমার সত্যিকারের অনাব্রোকন রেকর্ড সজ্ঞানে ভাঙব আমি।
—উপায় কী বল? এ অবস্থায় কি তুমি আইনত ওর পক্ষ ত্যাগ করতে পার?
—পারি! আইনত পারি—প্রফেশনাল এথিক্সে পারি না। সমস্ত বার অ্যাসোসিয়েশান একবাক্যে বলবে—নিশ্চিত পরাজয় এড়াতে বাসু-সাহেব পালিয়ে গেল!
—ওরা তোমার আসল বেদনার কথাটা বুঝবে না?
—কেমন করে বুঝবে রানু? তুমি ওদের সাইকলজিটা দেখছ না? ওদের সবারই একবার না একবার লেজ কাটা গেছে। দল-ছুট এই লাঙ্গুল-যুক্ত শৃগালটিকে কেমন করে ওরা ক্ষমা করতে পারবে? আর তাছাড়া কথাটাও তো ঠিক! নিশ্চিত পরাজয় এড়াতে সবাই যদি এমনভাবে সরে দাঁড়ায় তবে মক্কেলরা কোথায় দাঁড়াবে?
—মিঠুর সঙ্গে দেখা করবে না?
—মিঠু!—চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান বাসু-সাহেব!
অত্যন্ত লজ্জা পেয়ে যান রানি দেবী, না, না। ওটা আমারই ভুল! ওর নাম মিঠু নয়। ওর…ওর ডাক নাম আমি জানি না! আমার…আমার…
হঠাৎ কোথাও কিছু নেই মুখে আঁচল চাপা দিলেন রানি বাসু।
অনেক অনেক দিন পর ঐ দুটো নাম—’সুবর্ণ’ আর ‘মিঠু’ এ বাড়িতে উচ্চারিত হল। বাসু-সাহেব বুঝতে পারেন—রানি অজান্তে ঐ নামের সাযুজ্যে ধরে অজানা অচেনা মেয়েটাকে আপন করে নিয়েছে। তাই সুপ্রিয় দাশগুপ্তের স্ত্রী সুবর্ণ হঠাৎ ‘মিঠু’ও হয়ে গেছে তাঁর কাছে। বাসু উঠে এসে ওঁর পিঠে একটা হাত রাখেন। রানি ততক্ষণে সামলেছেন। স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন, চল, ভিতরে যাই।
সুপ্রিয় বলেছিল তার স্ত্রী নার্ভাস প্রকৃতির। কিন্তু তেমন কিছু নার্ভাস প্রকৃতির বলে মনে হল না বাসু-সাহেবের। এমন দুঃসংবাদ আচমকা পেলে সবাই কিছুটা হতচকিত হয়ে পড়ে। তার বেশি কিছু নয়। সে নিজেই চলে এসেছে। প্লেনে নয়, ট্রেনেই। হাওড়া স্টেশন থেকে ট্যাক্সি নিয়ে একেবারে নিউ আলিপুরে। বাসু-সাহেব ওকে আপাদমস্তক ভাল করে দেখে নিলেন। ওঁদের মেয়ে সুবর্ণ মারা গেছে সাত বছর আগে। তখন তার বয়স ছিল আট নয়—অর্থাৎ থাকলে আজ সেই সুবর্ণের বয়স হত ষোলো। এ মেয়েটি ষোড়শী নয়। বছর-বাইশ বয়স ওর। দুই সুবর্ণের আকৃতিগত পার্থক্যও যথেষ্ট। সে ছিল ফর্সা, এ শ্যামলা। সে ছিল রোগা একহারা, এ দোহারা, স্বাস্থ্যবতী। একমাত্র নাম—সাযুজ্য ছাড়া আর কোনো সাদৃশ্য নেই!
না! ভুল হল! আর একটা সাদৃশ্য আছে! সেই সুবর্ণের মাথা লক্ষ্য করে যখন এক নিষ্ঠুর অলক্ষ্যচারী বজ্র নিক্ষেপ করেছিলেন তখন বাসু-সাহেব বুক পেতে দিয়েও তাকে রক্ষা করতে পারেননি। ওঁর বিদ্যা, বুদ্ধি, প্রতিপত্তি, অর্থ সব কিছু নিষ্ফল হয়ে গিয়েছিল সেই অসহায় ছোট্ট মেয়েটার শেষ-সংগ্রামে। আজ এই সুবর্ণের অবস্থাও তাই। ওঁর বিদ্যা-বুদ্ধি-আইনজ্ঞান কোনো কিছুই ঐ আশ্রিতা মেয়েটিকে রক্ষা করতে পারবে না!
—কতদিন বিয়ে হয়েছে তোমাদের?—প্রশ্ন করলেন বাসু।
—দু’বছর।
—বাচ্চা-টাচ্চা হয়নি?
মেয়েটি মুখ নিচু করল। রানি দেবী পাশ থেকে বলে ওঠেন, পেটে এসেছিল, থাকেনি।
—বাবা-মা আছেন? বাপের বাড়ি কোথায়?
মেয়েটি মুখ তুলল না। টপ্ টপ্ করে কয়েক ফোঁটা জল ঝরে পড়ল কোলের উপর রানি দেবীই জবাব দিলেন এ প্রশ্নের। বললেন—বাপের বাড়ি, শ্বশুরবাড়ি কোথাও ওকে নেবে না। অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ নয়—অসবর্ণ বিয়ে। ওরা পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছিল।
কোথায় এ রোমান্টিক সংবাদে খুশিয়াল হয়ে উঠবেন আধুনিকমনা ব্যারিস্টার-সাহেব, তা নয় খিঁচিয়ে ওঠেন উনি, প্রেম করে বিয়ে! তা প্রেম করার আগে ওর ফিঙ্গার-প্রিন্টটা নিয়ে যাচাই করাওনি?—চেয়ার ছেড়ে উঠে পদচারণা শুরু করেন।
বেদনাহত জলভরা দু-চোখ তুলে মেয়েটি বললে, ও খুন করেনি! আপনি বিশ্বাস করুন!
বাসু-সাহেব বাঁ-হাতের তালুতে ডান হাত দিয়ে একটা মুষ্টাঘাত করলেন শুধু।
—ও মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে পড়েছে…আপনি…আপনি ওকে বাঁচান!—মেয়েটি উঠে দাঁড়াতে চায়। ওঁর পায়ের উপর লুটিয়ে পড়ত—কিংবা—
বাসু-সাহেব প্রচণ্ড ধমক দিয়ে ওঠেন : সিট ডাউন!
থতমত খেয়ে মেয়েটি আবার চেয়ারে বসে পড়ে।
—আজ থেকে ছ’মাস আগে—ধর, গত বছর অক্টোবর-নভেম্বর-ডিসেম্বর সুপ্রিয় বোম্বাই থেকে ক’লকাতা এসেছিল?
সুবর্ণ মনে মনে কী হিসাব করে বলল, হ্যাঁ, অফিসের কাজে। মাসখানেকের জন্য কেন?
—’কেন’ সে-কথা থাক। তুমি কি কোনোদিন এমন আশঙ্কা করনি, যে, ওর কোন ‘শেডি-পাস্ট’ থাকতে পারে?
—ওর কোনো শেডি-পাস্ট নেই!
—কাকে কী বলছ সুবর্ণ? মায়ের কাছে মাসির গল্প?
রানি দেবী এবার প্রতিবাদ করে ওঠেন, তুমি কথায় কথায় ওকে অমন ধমক দেবে না কিন্তু
বাসু-সাহেব একবার সুবর্ণের দিকে তাকিয়ে দেখলেন। শ্রাগ করলেন। গিয়ে বসলেন তাঁর ইজিচেয়ারে। পাইপটা ধরালেন।
সুবর্ণ বললে, আমি ওর সঙ্গে দেখা করব।
—তা তো করবেই। কাল সকালে তোমাকে নিয়ে যাব।
ঠিক তখনই বিশু এনে দিল একটা ওভার-সিজ টেলিগ্রাফ। খামটা খুলে বাসু দেখলেন তারবার্তাটা আসছে ব্যাঙ্কক থেকে। তাতে লেখা :
“সুপ্রিয় দাশগুপ্তকে ডিফেন্ড করুন এএএ তার সততা এবং কর্মদক্ষতা সন্দেহের অতীত এএএ যাবতীয় খরচ আমার এএএ আকাশ হচ্ছে খরচের ঊর্ধ্বসীমা এএএ রবিবার দমদম পৌঁছাব এএএ মোহনস্বরূপ কাপাডিয়া।”
বাসু-সাহেব টেলিগ্রাফখানা বাড়িয়ে ধরলেন সুবর্ণের দিকে। বললেন, আই নাউ বেগ য়োর পার্ডন, সুবর্ণ! আমি অন্যায় কথা বলেছিলাম। তুমি প্রেমে পড়ে যে ভুল করেছ তোমার স্বামীর এমপ্লয়ার ধুরন্ধর কোটিপতি হওয়া সত্ত্বেও সেই একই ভুল করেছেন!
নিজের ঘরে গিয়ে টেলিফোন তুলে নিলেন বাসু। পার্ক-হোটেলের নাম্বার চাইলেন। অপারেটারকে বললেন, রুম নম্বর 78 প্লিজ।
একটু পরে রিঙিং টোন শোনা গেল। ওপ্রান্ত বলল, হ্যালো, জীবন বিশ্বাস বলছি—
—আমাকে না বলে কোর্ট ছেড়ে চলে এলেন কেন?
—আপনি কে? বাসু-সাহেব?
—হ্যাঁ, আমি। কোর্ট থেকে পালিয়ে এলেন কেন?
—পালিয়ে তো আসিনি স্যার। কেন, কোনো দরকার আছে?
—আছে! তুমি ইচ্ছে করে তোমার বন্ধুকে ফাঁসাচ্ছ!
—কী যে বলেন স্যার! আমি কেন ফাঁসাব? আমি তো তার জন্যে পার্জারির কেসে ফাঁসতে পর্যন্ত রাজি হয়েছিলাম?
বাসু-সাহেব একটু চুপ করে থাকলেন। তারপর বললেন, তুমি ঘণ্টাখানেক হোটেল ছেড়ে বের হয়ো না। তোমাকে একটা জরুরি খবর দেব। বুঝলে?
—আজ্ঞে আচ্ছা!
‘বাসু-সাহেব টেলিফোনটা রেখে টানা-ড্রয়ারটা খুললেন। বার করে নিলেন আত্মরক্ষার একটা অস্ত্র। সুজাতা এসে দাঁড়ালো দরজায়। বললে, বের হচ্ছেন নাকি আবার?
—হ্যাঁ, সুজাতা! আবার এক মিস্টিরিয়াস্ ব্যাপার। পার্ক-হোটেলে ফোন করে এইমাত্র জীবন বিশ্বাসের সঙ্গে কথা বললাম। লোকটা জীবন বিশ্বাস নয়। আই মাস্ট ‘ফাইন্ড আউট—লোকটা কে!
—সে কী! লোকটা বলল যে, সে জীবন বিশ্বাস?
—তাই সে বলল। গলাটা নকল করবার চেষ্টাও করছিল—কিন্তু পারেনি।
গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে গেলেন উনি। একাই।
আধঘণ্টা পরে পার্ক হোটেলের নিচে গাড়িটা রেখে এগিয়ে গেলেন রিসেপশান কাউন্টারের দিকে। জীবন বিশ্বাসের রুম নম্বর জেনে নিয়ে লিফ্ট ধরে উপরে উঠলেন। চিহ্নিত দরজায় যখন বাঁ-হাতে টোকা মারলেন তখন তাঁর ডান হাতটা ছিল পকেটে—যে পকেটে আছে তাঁর আত্মরক্ষার অস্ত্রটা।
একটু পরেই দরজা খুলে গেল। ভিতরে দাঁড়িয়ে আছে কৌশিক।
—তুমি! তুমিই তখন ফোন ধরেছিলে?
—হ্যাঁ, কিন্তু আপনি যে বললেন আবার ফোন করবেন?
বাসু-সাহেব দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। হাসতে হাসতে গিয়ে বসলেন একটা চেয়ারে। বললেন, টিকটিকিগিরি ভালই করছ। কিন্তু একটা ভুল হয়েছিল তোমার। তুমি ভুলে গিয়েছিলে জীবন বিশ্বাসের কাছে ‘পার্জারির’ অর্থ জোলাপ নেওয়া।
এবার কৌশিকও হেসে ওঠে উচ্চকণ্ঠে। বলে, আয়াম সরি।
কৌশিক তার এই অদ্ভুত আচরণের কৈফিয়ত দিল—
মিথ্যা-সাক্ষী ধরা পড়ার পরেই জীবন আদালতে ছেড়ে বেরিয়ে আসে। কৌশিকের সন্দেহ হয় যে, সে আত্মগোপন করতে চাইছে! সে পিছন পিছন বেরিয়ে আসে। জীবন একটি ফ্লাইং ট্যাক্সি ধরে রওনা দেয়। দ্বিতীয় ট্যাক্সি পেতে প্রায় মিনিট দশেক দেরি হয়ে যায় তার। দুর্ভাগ্যক্রমে পথে একটা মিছিল পড়ে আরও দশ মিনিট দেরি হয়ে যায়। কৌশিক এসে পৌঁছয় পার্ক-হোটেলে। রুম বেয়ারা হরিমোহনের খোঁজ পেতে বিলম্ব হয় না। তার মাধ্যমে রিসেপশান কাউন্টারে খবর নিয়ে জানতে পারে, মিনিট পাঁচেক আগে জীবন বিশ্বাস চেক আউট করে বেরিয়ে গেছে। ও তার রুম নাম্বারটা জেনে নেয় এবং জে. বিশ্বাস নামে তখনই ঘরটা বুক করে।
—কেন?
—আমি একটা চান্স নিলাম স্যার, আর অদ্ভুত ফল ফলেছে তাতে!
—কী রকম?
কৌশিক নাকি ঘরে এসেই টেলিফোনটা তুলে নিয়েছিল। অপারেটারকে বলে, রুম নাম্বার 78 থেকে মিস্টার বিশ্বাস বলছি—আমার কোনো ট্রাংক কল এসেছিল ইতিমধ্যে?
মেয়েটি বললে, না স্যার। কাল বিকালে সেই যে ট্রাংক কল এসেছিল তারপর তো আসেনি।
—কৌশিক বলেছিল, আচ্ছা কালকে আমি যে কলটা রিসিভ করেছিলাম সেটা বর্ধমান থেকে, না দুর্গাপুর থেকে? মনে আছে আপনার?
—আপনার মনে নেই? আসানসোল থেকে। কলার-এর নাম্বারটা চান?
—আছে আপনার কাছে? আমাকে উনি বলেছিলেন, লিখেও রেখেছি; কিন্তু কোথায় যে ফেললাম!
—এক মিনিট। আপনি লাইনটা ছেড়ে দিন। এখুনি জানাব আপনাকে। সমস্ত ইন-কামিং আর আউট-গোয়িং ট্রাংক কল লেখা থাকে একটা রেজিস্টারে।
—তাই নাকি? তা তো জানতাম না।
—নাহলে এত চার্জ আপনারা দেন কেন পার্ক-হোটেলে?
কৌশিক টেলিফোনটা নামিয়ে রাখল। সে মনে মনে হাসছিল—মেয়েটা ধরতে পারেনি, যে, রুম নম্বর 78-এর বাসিন্দা গত দশ মিনিটের ভিতর বদলে গেছে। ‘বিশ্বাস’ উপাধিটাই কি ওর বিশ্বাস উৎপাদন করল? মেয়েটিও তখন ও-প্রান্তে মনে মনে হাসছিল—রুম 78-এর ভদ্রলোকের কাছে হোটেলের বিজ্ঞাপনটা সে ভালই করেছে। সে জানে এ ব্যবস্থার জন্য আসলে দায়ী কলকাতার পুলিশ কমিশনার! খানদানি হোটেলেই খানদানি ষড়যন্ত্রকারীরা ওঠে। তাদের গতিবিধির উপর নজর রাখার জন্যই এই আদেশ দিয়েছে আরক্ষা বিভাগ
এক মিনিট পরে মেয়েটি ফোন করে জানাল, কাল আপনার কলার ছিলেন আসানসোল…
— থ্যাঙ্কু। আপনি আর কতক্ষণ বোর্ডে আছেন?
—কেন বলুন তো? কোন ইন্সট্রাকশান থাকলে আমার সাসেসারকে বলে যাব।
-–সে জন্য নয়। কারণটা না জানালে বলতে আপত্তি আছে?
—না না, তা কেন? আমার এখনই ডিউটি শেষ হল। আবার কাল বেলা দশটায় আসব আমি। এবার বলুন, কেন জানতে চাইছিলেন।
কৌশিক অম্লান বদনে বললে, তাহলে কাল দশটার সময় আবার আপনাকে বিরক্ত করব। আপনার কণ্ঠস্বরটা আমার খুব ভাল লাগছে। ডোন্ট টেক ইট আদার-ওয়াইজ আমার এক নিকট আত্মীয়া, আত্মীয়া ঠিক নয় বান্ধবীর সঙ্গে আপনার কণ্ঠস্বরের অদ্ভুত মিল।
মেয়েটির হাসির জলতরঙ্গ ভেসে এসেছিল টেলিফোনে। বলেছিল, গুডনাইট স্যার। সুইট ড্রিমস!
—সেম টু য়ু। লাইন কেটে দিয়েছিল কৌশিক।
তারপর আধঘন্টা অপেক্ষা করে সে আবার ফোনটা তুলেছিল। এবার কণ্ঠস্বর অনেক ভারী, অনেক ভরাট। কৌশিক বর্ধমান সদর থানার ও.সি.-কে একটা পি.পি. কল বুক করে। লাইটনিং কল। তৎক্ষণাৎ লাইন পায়। সে নৃপেন ঘোষালকে জানায় যে, বাসু-সাহেব যে মিস ডিক্রুজাকে খুঁজছেন সে আসানসোলের ‘অমুক’ নম্বর থেকে গতকাল ফোন করেছিল। নৃপেন ওকে বলে—এরপর যদি মেয়েটাকে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে পাকড়াও করতে না পারি তবে আমার নামটা পালটে রাখবেন।
কৌশিকের এতবড় কৃতিত্বেও কিন্তু বাসু-সাহেবের কোনো ভাবান্তর হল না। তিনি স্থির হয়ে বসে আছেন। যেন ধ্যানস্থ। এতক্ষণ শুনছিলেন কি না তাই বোঝা গেল না। কৌশিক বুঝতে পারে উনি গভীর চিন্তায় মগ্ন। সে কোনো সাড়াশব্দ দেয় না। পুরো পাঁচ মিনিট কী চিন্তা করে হঠাৎ নড়েচড়ে বসলেন উনি। বলেন, কৌশিক, আমি কোনো চান্স নেব না। মনে হচ্ছে সমাধান হয়ে গেছে। এখনও দু-চারটে ছোট ছোট অসঙ্গতি রয়েছে বটে, কিন্তু মূল সমস্যাটার মীমাংসা হয়ে গেছে
—কী বুঝেছেন আপনি?
—দুই আর দুইয়ে চার!
—তার মানে?
—তার মানে তুমি এখান থেকেই আমার এই গাড়িটা নিয়ে আসানসোল চলে যাও। এখন সন্ধ্যা সাতটা। রাত দশটা নাগাদ তুমি বর্ধমানে পৌঁছাবে। সেখানে যদি নৃপেনের দেখা পাও ভাল, না পাও প্রসিড টু আসানসোল। রাত একটা নাগাদ সেখানে পৌঁছবে। সোজা কোতোয়ালিতে চলে যাবে। সেখানে আমার পরবর্তী নির্দেশ পাবে।
—কার কাছে?
—ডিউটি অফিসারের কাছে। আমি বাড়ি ফিরে এ.ডি. এম্ আসানসোল, ডি. এস. পি. অথবা এস. ডি. ও. সদর যাকে কনট্যাক্ট করতে পারব তাঁকে ব্যাপারটা জানাব। মার্ডার-কেস। ওরা তোমাকে সাহায্য করবেই।
কৌশিক বলে, আর যে-সে মার্ডার নয়! লক্ষপতি এস.পি. জৈনের মার্ডার-কেস! বাসু উঠে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ওর কাঁধে একখানা হাত রেখে বলেন, তুমি আমাকে ভুল বুঝছ কোশিক। আমি হত্যা তদন্তের কথা বলছি না—হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে চাইছি! আজ রাত্রেই আসানসোলে দ্বিতীয় একটা মার্ডার হবার আশঙ্কা আছে!
কৌশিক স্তব্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে।
বাসু-সাহেব পকেট থেকে রিভলভারটা বার করে ওর হাতে দেন, ধর!
—সে কী! এর লাইসেন্স যে আপনার নামে!
—সে দায়িত্ব আমার, কৌশিক। কিন্তু মৃত্যুর মুখে তোমাকে তো আমি নিরস্ত্র যেতে বলতে পারি না। আমি নিজে যেতে পারছি না। কাল দশটায় আমার কেস আবার উঠবে। আশা করছি, তার আগেই ভোররাত্রে তোমার একটা ফোন পাব। আমার অনুমান যদি সত্যি হয় মিঠুকে এবার বাঁচাতে পারব!
কৌশিক অবাক বিস্ময়ে বলে, মিঠু কে?
ম্লান হাসলেন বাসু। নিজেকেই বললেন যেন, আই বেগ য়োর পার্ডন। মিসেস্ সুপ্রিয় দাশগুপ্ত। সে এসে উঠেছে আমার বাড়িতে।