৭
আদালতের অধিবেশন শুরু হওয়ার আগেই কৌশিকের সঙ্গে বাসু-সাহেবের দেখা হল। ওর কাছে আদ্যোপান্ত শুনে উনি তখনই গিয়ে দেখা করলেন আসামি সুপ্রিয়র সঙ্গে। বললেন, তুমি কি শখ করে ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে চাও?
লোকটা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল।
—এগারো তারিখ রাত্রে মোকাম্বোতে তুমি আর যদুপতি খেতে গিয়েছিলে—তাহলে কেন বললে জীবন বিশ্বাসও তোমাদের সঙ্গে ছিল।
—সুপ্রিয় চোখটা নিচু করে বলল, জীবনই এ পরামর্শ দিয়েছিল। বলেছিল, যদুপতি কিছুতেই সাক্ষী দিতে আসবে না। জীবন ছাড়া আর কে আমার অ্যালিবাইটা প্রতিষ্ঠিত করবে?
—তাই বলে তোমাদের কাউন্সেলকেও তোমরা জানাবে না যে, মিথ্যে সাক্ষী দিচ্ছ?
—আমি জানতাম আপনি এতে রাজি হবেন না!
—হব না, তো বটেই! জীবনকে নতুন করে তালিম দিতে হবে; তাছাড়া ঐ সুকুমারের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছিলে সেটা এতক্ষণ স্বীকার করনি কেন?
সুপ্রিয় মাথা নিচু করে বসে রইল।
—ওর ক্যাশে কত টাকা আছে তা টেলিফোনে জানতে চেয়েছিলে?
মাথা নেড়ে সায় দিল সুপ্রিয়। অস্ফুটে বলল, পরদিন ছিল গুডফ্রাইডের ছুটি। ব্যাঙ্কের ভল্ট বন্ধ। সেই অজুহাতে দু’-লাখ টাকা নগদ নিতে জৈন-সাহেব রাজি হবে না আমার এই আশঙ্কা ছিল। অথচ ঐ গুডফ্রাইডের রাতের ট্রেনেই আমাদের টিকিট কাটা ছিল। তার উপর যদি জৈন-সাহেবের ক্যাশে আগে থেকেই মোটা টাকা থেকে থাকে তাহলে ছুটির দিন তিনি হয়তো মুশকিলে পড়বেন। তাই আমি জানতে চেয়েছিলাম।
বাসু-সাহেব ধমকে ওঠেন, বেশ করেছিলে! কিন্তু আমাকে বলনি কেন?
সুপ্রিয় অধোবদনে বসেই রইল।
—বোম্বাইয়ে তোমায় স্ত্রীকে চিঠি লিখেছ?
নেতিবাচক শিরশ্চালন করল সুপ্রিয়
—তোমার স্ত্রী আজ-কালের মধ্যেই আসছে।
একেবারে শিউরে উঠল সুপ্রিয়, সর্বনাশ! তার নাম-ঠিকানা কেমন করে পেলেন আপনি?
—সেটা পরের কথা। সর্বনাশ কেন?
—ও ভয়ানক নার্ভাস! সে আপনি বুঝবেন না। জীবনকে একবার আমার কাছে আনতে পারবেন?
বাসু-সাহেব বললেন, অসম্ভব! তোমার উকিল ছাড়া আর কারও সঙ্গে এ অবস্থায় তোমাকে দেখা করতে দেবে না। তোমার স্ত্রী হলে, হয়তো দিতে পারে।
ঠিক এই সময়েই প্রহরী এসে জানাল–আদালত এবার বসবে। বাসু-সাহেব ফিরে এলেন। কোর্টে গিয়ে বসলেন। প্রদ্যোৎকে বললেন, জীবনকে ডাক তো?
জীবন গরুড়পক্ষীর মতো হাত দুটি জোড় করে এসে দাঁড়ায়। বাসু বলেন, তোমাকে এখনই সাক্ষী দিতে ডাকব। মোকাম্বোতে তুমি ঐ রাত্রে সুপ্রিয়র সঙ্গে খেয়েছ এ মিথ্যা কথা বলবে না, বুঝলে?
মাথা চুলকে জীবন বলে, ঐটেই আমাদের একমাত্র ভরসা স্যার! অকাট্য অ্যালিবাই! ধমক দিয়ে ওঠেন বাসু, বেশি পণ্ডিতেমি কর না। মিথ্যে সাক্ষী তোমাকে দিতে হবে না।
—কিন্তু স্যার আমি যে থানায় গিয়ে এজাহার দিয়ে বসে আছি।
—সেটা অন্য জিনিস। থানায় মিথ্যে এজাহার দেওয়া, আর আদালতে হলপ নিয়ে মিথ্যে সাক্ষ্য দেওয়া সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস।
জীবনবাবু বলে, আপনি মিছে ডরাচ্ছেন স্যার। ঐ মাইতির বাবার ক্ষমতা হবে নাজেরায় আমাকে কাত করে! আমি মোকাম্বোতে ঢুকে সব খুঁটিয়ে দেখে এসেছি কাল সন্ধ্যাবেলায়।
বাসু-সাহেব আর কিছু বলবার সুযোগ পেলেন না। জাস্টিস ভাদুড়ী পুনরায় বিচারারম্ভ ঘোষণা করলেন। বাদীপক্ষের সাক্ষ্য নেওয়া শেষ হয়নি। সাক্ষ্য দিতে উঠলেন ইস্টার্ন রেলওয়ের স্টাফ—বোম্বাই মেল-এর কন্ডাকটার-গার্ড হেমন্ত মজুমদার। মাইতি সাহেবের প্রশ্নে তিনি গুডফ্রাইডের সন্ধ্যায় বোম্বাই মেল-এ সি-নং ক্যুপেতে যে ঘটনা ঘটেছিল তার আনুপূর্বিক বর্ণনা দিলেন। সুজাতা ফিরে এসে যা বলেছিল হুবহু তাই।
বাসু তাঁকে কোনো জেরা করলেন না।
পরবর্তী সাক্ষী নেপালচন্দ্র বসু। জি. আর. পি-র ইন্সপেক্টার। তিনিও তার সাক্ষ্যে ঐ ঘটনার পাদপূরণ করলেন। বাসু-সাহেব তাঁকে ক্রস এগজামিনে প্রশ্ন করলেন, মিস্টার বোস, আপনি যখন জিজ্ঞাসা করলেন, ব্যাগটা আপনার? আর আসামি বলল, ‘হুঁ’ তখন সে কি ব্যাগটার দিকে তাকিয়ে দেখেছিল?
—না, দেখেনি, কিন্তু তার পূর্বমুহূর্তে যখন সুজাতা বললেন, ও ব্যাগটা আমার নয়, তখন সে ব্যাগটার দিকে তাকিয়ে ছিল।
—আপনার কি মনে হয় সেটা ভেকেন্ট লুক—মানে সে অন্য কথা ভাবতে ভাবতে ঐদিকে তাকিয়ে ছিল?
—অবজেকশান! সাক্ষী কী মনে করেছিল তা আমরা শুনতে চাই না!—মাইতির কণ্ঠস্বর।
—অবজেকশান সাসটেন্ড—জজসাহেবের নির্দেশ।
—বেশ, দ্বিতীয়বার যখন আপনি প্রশ্ন করেন তখন ও অস্বীকার করেছিল? বলেছিল, ব্যাগটা, ওর নয়?
—হ্যাঁ, তাই বলেছিল।
—তখনও তো আপনি রিভলভারটা ব্যাগ থেকে বার করে দেখাননি?
—না।
—তার মানে আসামি তখনও জানত না যে, ব্যাগের ভিতর কী আছে?
—তা কেন? আপনি ধরে নিচ্ছেন কেন যে, ব্যাগটা সে নিজেই সঙ্গে করে আনেনি?
—আপনি কি তাই ধরে নিতে চান?
—কেন নয়?
—’কেন নয়’, আমার প্রশ্নের জবাব নয়। আমার প্রশ্ন ‘আপনি কি তাই ধরে নিতে চান’, ‘ইয়েস অর নো?
— ইয়েস!
—আপনি কি এখনই এটা ভাবছেন, না প্রথম থেকেই ওটা ধরে নিয়েছেন?
—প্রথম থেকেই।
—তাই বলুন। তার মানে ব্যাগটা যে আসামির এই রকম একটা পূর্বসিদ্ধান্ত প্রথম থেকে ধরে নিয়ে আপনি সাক্ষী দিতে এসেছেন? যা দেখেছেন তা বলছেন না, যা আপনার প্রথম থেকে ধরে নেওয়া পূর্ব-সিদ্ধান্তের সঙ্গে মিলে যায় তাই সাক্ষী দিচ্ছেন।
—কী আশ্চর্য! আমি কি তাই বলেছি?
—আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনি ঠিক তাই বলেছেন!— দ্যাটস্ অল্ মি লৰ্ড!
সরকার পক্ষের সাক্ষী এখানেই শেষ।
প্রতিবাদী পক্ষের প্রথম সাক্ষী মিসেস্ সুজাতা মিত্ৰ।
হলপ নিয়ে সাক্ষ্য দিতে উঠল সুজাতা। বাসু-সাহেব প্রশ্নের মাধ্যমে প্রমাণ করলেন, সুজাতা ঐ সি-চিহ্নিত ক্যুপেতে প্রথম প্রবেশ করে। বন্ধ দরজা খুলেই সে দেখতে পায় একজন স্যুটপরা ভদ্রলোককে। তাঁর সঙ্গে সুজাতার কী কথা হয়েছিল তা নথিবদ্ধ করা হল। ভদ্রলোকের চলে যাওয়ার সময় ব্যাগ রেখে যাওয়ার কথাও সুজাতা বলল এবং বলল—সুপ্রিয় কামরায় ঢুকেই প্রথম প্রশ্ন করেছিল, ব্যাগটা আপনার?
মাইতি জেরা করতে উঠলেন। তাঁর প্রথম প্রশ্ন, আপনি কোথায় থাকেন সুজাতা দেবী?
সুজাতা তার ঠিকানা দিল।
—ঐ বাড়িতে এ মামলার প্রতিবাদী ব্যারিস্টার পি. কে. বাসুও থাকেন না?
—হ্যাঁ, থাকেন।
—আপনি যে ডিটেক্টিভ প্রতিষ্ঠানের পার্টনার তার সঙ্গে ঐ ব্যারিস্টার সাহেবের একটা পার্সেন্টেজ ব্যবস্থা আছে, না? কমিশনের ব্যবস্থা।
—আছে।
—অর্থাৎ এ মামলায় বাসু-সাহেব যা ফি পাবেন তার একটা অংশ আপনারও জুটবে, কেমন? সুজাতার মুখটা লাল হয়ে ওঠে।
—বলুন, বলুন, লজ্জা পাচ্ছেন কেন? এ মামলা বাবদ কমিশন পাবেন না?
—পাব।
—তার মানে এ মামলায় বাসু-সাহেব জিতুন এই আপনি চান?
—না। আমি চাই সত্যের জয় হোক!
—চমৎকার। আর্থিক লোকসান করেও
—ওঁর কেস জেতা-হারার সঙ্গে আমাদের কমিশনের কোনও সম্পর্ক নেই। উনি স্পেসিফিক জব’ দেন, ‘স্পেসিফায়েড ফি’ দেন। হারলেও দেন, জিতলেও দেন।
—তাই বুঝি? আচ্ছা সুজাতা দেবী আপনি নিজে কখনও ঐ 302-ধারায় আসামি হয়েছিলেন? খুনের মামলায়?
—না।
—না? কিন্তু আমি যদি প্রমাণ করতে পারি-
—উকিল হিসাবে আপনার জানা উচিত সে-ক্ষেত্রে আপনি আমার বিরুদ্ধে পার্জারির মামলা আনতে পারেন। আপনার আরও জানা উচিত আদালতের বাইরে ওকথা বললে আপনার বিরুদ্ধে আমি মানহানির মামলা আনতে পারি—সুজাতার দৃপ্ত জবাব।
মাইতি চোখ থেকে চশমাটা খুললেন। প্রতিটি শব্দ স্পষ্ট উচ্চারণ করে বললেন, রামচন্দ্রপুরের ময়ূরকেতন আগরওয়াল হত্যা-মামলায় আপনি খুনের মামলার আসামি ছিলেন না?
—না! আমার বিরুদ্ধে কোনো চার্জ ফ্রেম করার আগেই প্রকৃত অপরাধী ধরা পড়ে। আমার বিরুদ্ধে খুনের মামলা তো ছাড়, আদৌ কোনও চার্জ ফ্রেম করা হয়নি!
—কিন্তু আপনি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তো?
—বাসু-সাহেব উঠে দাঁড়ান, এনাফ অব ইট! অবজেকশান য়োর অনার। এ সব প্রশ্নের সঙ্গে বর্তমান মামলার কোনো সম্পর্ক নেই। অনেক আগেই আমি আপত্তি করতাম—করিনি এজন্য যে, ভেবেছিলাম—মাননীয় সহযোগীর যে-কোনো মুহূর্তে মনে পড়ে যাবে যে, সে মামলায় প্রকৃত আসামিকে গ্রেপ্তার না করে তিনি ক্রমাগত রাম-শ্যাম-যদুকে কাঠগড়ায় তুলেছিলেন। উনি সাক্ষীকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন— ‘লজ্জা পাচ্ছেন কেন?’ তাই ভেবেছিলাম, সে-সব কথা মনে পড়ে গেলে উনি নিজেই লজ্জায় থেমে যাবেন। কিন্তু উনি থামছেন না মি’ লৰ্ড!
জাস্টিস ভাদুড়ী সংক্ষেপে শুধু বলেন, অবজেকশান সাসটেন্ড। আপনি অন্য প্রশ্ন করুন।
—আমার আর কিছু জিজ্ঞাস্য নেই–বসে পড়েন নিরঞ্জন মাইতি
এরপর সাক্ষী দিতে এলেন জীবন বিশ্বাস
এগারো তারিখের প্রসঙ্গ আসামাত্র সে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে জানিয়ে দিল ঐ দিন সন্ধ্যায় সে, আসামি এবং তৃতীয় একজনের সঙ্গে মোকাম্বোতে নৈশ-আহার করেছে।
বাসু-সাহেবের মুখচোখে রাগে লাল হয়ে উঠল। তিনি তৎক্ষণাৎ সওয়াল বন্ধ করে বললেন, ‘দ্যাটস্ অল্ মি’ লর্ড’।
মাইতি ডাইরেক্ট এভিডেন্সের সূত্রটি তুলে নিয়ে বললেন, জীবনে কতবার মোকাম্বোতে খেয়েছেন, জীবনবাবু?
—ঐ একবারই স্যার।
—ঐ এগারোই তারিখে রাত্রেই, জীবনে একবার?
—আজ্ঞে হ্যাঁ স্যার।
—তার পরে গতকাল আপনি মোকাম্বোতে যাননি? সন্ধ্যা সাতটা পাঁচে?
জীবনবাবুর চোয়ালের নিম্নাংশটা ঝুলে পড়ে।
—বলুন, বলুন—আমি আপনার টনসিল দেখতে চাইছি না। কোর্টে হাস্যরোল উঠল। ঢোক গিলে জীবন বিশ্বাস বলে, গিয়েছিলাম স্যার।
—কেন গিয়েছিলেন? হোটেলের ভিতরটা দেখে আসতে? যাতে জেরায় আপনার ঐ অ্যালিবাইটা ফেঁসে না যায়?
সামলে নিয়েছে জীবন। বললে, আজ্ঞে না, আমি দেখতে গিয়েছিলাম যদুপতি সিঙ্ঘানিয়া ওখানে আছেন কিনা। সেই মর্মে একটা খবর পেয়েছিলাম।
—তাই বুঝি। তাহলে মিথ্যা কথা বললেন কেন? জীবনে একবার মাত্র মোকাম্বোতে গিয়েছিলেন।
জীবন বলে, আপনি আমার মুখে নিজের ইচ্ছে মতো কথা বসাবেন না স্যার।
ভ্রুকুঞ্চিত করে মাইতি বলেন, তার মানে। আপনি ও কথা বলেননি?
জীবন এতক্ষণে বেশ সহজ হয়েছে। বললে, আজ্ঞে না। আপনি প্রশ্ন করেছিলেন, ‘জীবনে কতবার মোকাম্বোতে খেয়েছেন জীবনবাবু?’ তাতে আমি বলেছিলাম, ‘ঐ একবারই স্যার’। কাল সন্ধ্যায় আমি মোকাম্বোতে খাইনি কিন্তু!
একটা মোক্ষম আন্ডারকাট সাক্ষী অতি সুন্দরভাবে এড়িয়ে গেল সেটা এতক্ষণে অনুধাবন করলেন নিরঞ্জন মাইতি। জীবন বিশ্বাসের পিছনে টিকটিকি লাগিয়ে এমন সুন্দর একটা সূত্র আবিষ্কার করলেন, কিন্তু লোকটা পিছলে গেল। জীবন হাসি-হাসি মুখে বললে, আমিও স্যার আপনার টনসিল দেখতে চাইছি না। বিশ্বাস না হয় পেশকারবাবুকে শুধোন!
প্রচণ্ড হাস্যরোল উঠল আদালতে।
জোরে হাতুড়িটা ঠুকলেন জাস্টিস্ ভাদুড়ী। দর্শকদের দিকে ফিরে বললেন, আপনারা যদি আদালতের কাজে বাধা দেন তাহলে আমি আদালত ফাঁকা করে দিতে বাধ্য হব।
তৎক্ষণাৎ নিস্তব্ধতা ফিরে এল কোর্ট-রুমে। সাক্ষীর দিকে ফিরে জাস্টিস্ বললেন, আপনি বাজে কথা বলবেন না একদম।
হাত দুটি জোর করে জীবন বিশ্বাস বললে, টনসিলের কথাটা কিন্তু হুজুর আমি আগে তুলিনি।
—স্টপ ইট! য়ু মে প্রসিড।
মাইতি পুনরায় শুরু করেন, কী খেয়েছিলেন আপনারা?
—বিরিয়ানি পোলাও, তন্দুরি চিকেন, ফ্রায়েড প্রন, সুইট অ্যান্ড সাওয়ার। ও ভুলে
গেছি স্যার—তার আগে আমি খেয়েছিলাম চিকেন সুপ আর ডিনার রোল। সব শেষে কুলফি!
—সবাই তাই খেয়েছিলেন।
—আজ্ঞে হ্যাঁ ভাগ করে। ওঁরা দুজন সুপ খাননি।
—ড্রিংকস্ নেননি?
মাথা চুলকে জীবন বিশ্বাস বললে, আজ্ঞে আমি খাইনি স্যার। ছাপোষা মানুষ, ওসব আমার পোষায় না। আমি সুপ খেয়েছিলাম শুধু।
—আর ওঁরা দুজন?
—ওরা এক এক পেগ চড়িয়ে ছিলেন!
বাসু-সাহেব দাঁতে দাঁতে চেপে বললেন, ইডিয়ট!
মাইতিও স্বাভাবিকতা ফিরে পেয়েছেন। বড়শি-ছেঁড়া মাছটা আবার টোপ গিলেছে। এখন খেলিয়ে তুলতে হবে। বললেন, মাত্র এক এক পেগ?
—আজ্ঞে হ্যাঁ স্যার!
—কী খেয়েছিলেন ওঁরা জানেন? না কি মদের নামও জানেন না আপনি? প্রদ্যোত বাসু সাহেবের কানে কানে বললে—অবজেকশন দিন! মামলার সঙ্গে এসবের কী সম্পর্ক? বাসু-সাহেব বললেন, ও আমার মক্কেল নয়! লোকটা আত্মহত্যা করছে। করুক, আমার কী? ব্যারিস্টার রে-সাহেব অস্ফুটে বললেন, টু!
—কেন? বে-ফাঁস কী বলল ও?—প্রশ্ন করে প্রদ্যোৎ।
ব্যারিস্টার রে অস্ফুটে বললেন, ডোঞ্চু ফলো ইয়াং ম্যান? ঘটনাটা গুডফ্রাইডের আগের সন্ধ্যা।
প্রদ্যোত হালে পানি পায় না। ওদিকে আরও কয়েকটি প্রশ্নোত্তর হয়ে গেছে মাইতি তখন জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কী করে বুঝলেন ইনি ব্ল্যাকনাইট হুইস্কি খেলেন, আর উনি জিন-উইথ-লাইম? একটু পরখ করে দেখেছিলেন নাকি?
জীবন বিশ্বাস একগাল হেসে বললে, আজ্ঞে না স্যার! আমার সামনে অর্ডার দিলেন, বিল মেটালেন, আমি জানব না?
—তা তো বটেই। তাহলে আপনি নিঃসন্দেহ যে, আসামি সে-রাত্রে জিন-উইথ-লাইম আর মিস্টার যদুপতি সিঙ্ঘানিয়া ব্ল্যাক-নাইট হুইস্কি খেয়েছিলেন?
—আজ্ঞে হ্যাঁ।
মাইতি হেসে বলেন, এবার বলুন তো বিশ্বাস মশাই, ‘পার্জারি’ মানে কী?
—আজ্ঞে আমি জানি না। জোলাপ নেওয়া বোধহয়।
—কিন্তু এটা তো জানেন যে, সেটা ছিল গুডফ্রাইডের আগের সন্ধ্যা।
—আজ্ঞে, হ্যাঁ। তা জানি বইকি।
—সেদিন কি বার ছিল?
—বৃহস্পতিবার।
—কলকাতার কোনো খানদানি দোকানে বৃহস্পতিবার মদ বিক্রি হয়? টনসিলের প্রশ্নটা মাইতি আবার তুলতে পারতেন। তা কিন্তু তুললেন না তিনি। বললেন, আপনি আগাগোড়া মিছে কথা বলেছেন। মোকাম্বোতে আপনি ঐ দিন আদৌ যাননি এবং সেখানে ঐ আসামির সঙ্গে খানা খাননি। বলুন স্বীকার করুন।
জীবন হাত দুটি জোড় করে বললে, বিশ্বাস করুন স্যার, আমি যাইনি। কিন্তু ওঁরা দুজন গিয়েছিলেন। ঐ সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত ন’টা পর্যন্ত ওঁরা ওখানে ছিলেন।
—দ্যাটস্ অল মি’ লর্ড!—মাইতি আসন গ্রহণ করেন। তৎক্ষণাৎ এখজন সা ইন্সপেক্টর তাঁর কানে কানে কী যেন বলে! উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন মাইতি। উঠে দাঁড়িয়ে জজ-সাহেবকে একটি সাড়ম্বর ‘বাও’ করে বলেন, আদালত যদি অনুমতি করেন, তবে আমি একটি নিবেদন করতে চাই। এই মাত্র ইনভেস্টিগেটিং অফিসার আমাকে একটি চাঞ্চল্যকর সংবাদ করেছেন–যা এই মামলায় সত্য নির্ধারণে প্রভূতভাবে সাহায্য করবে। বস্তুত গত এক সপ্তাহ ধরেই আমরা অনুসন্ধান কার্য চালাচ্ছিলাম— চূড়ান্ত তথ্য এইমাত্র জানা গেছে। আদালত অনুমতি করলে আমি আর একজন সাক্ষীকে প্রসিকিউশনের তরফে সাক্ষ্য দিতে ডাকতে পারি।
জজ-সাহেব বলেন, আদালত এটা পছন্দ করেন না। বাদীপক্ষ সম্পূর্ণপক্ষ প্রস্তুত না হয়ে মামলায় ‘ডেট’ নিলেন কেন? বিবাদী পক্ষের সাক্ষী নেওয়া হয়ে গেছে, এখন, ওয়েল—আমি রুলিং দেবার আগে জানতে চাই এ বিষয়ে প্রতিবাদীর কাউন্সেল কী বলেন?
বাসু বলেন, সত্য প্রতিষ্ঠিত হ’ক এটাই আমরা চাই। আমাদের আপত্তি নেই। মাইতির আহ্বানে অতঃপর সাক্ষ্য দিতে উঠে দাঁড়ালেন সি.বি. আই-এর ফিঙ্গার প্রিন্ট এক্সপার্ট মিস্টার এম. পান্ডে। মাইতি খুশিতে ডগমগ। প্রশ্ন করেন, মিস্টার পান্ডে, আপনি ফিঙ্কার-প্রিন্ট এক্সপার্ট হিসাবে কোথায় ট্রেনিং নিয়েছেন? কতদিনের?
—স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে। দু’বছরের।
—আপনাকে গত বারই এপ্রিল আসামির একটি ফিঙ্গার-প্রিন্ট দিয়ে অনুসন্ধান করতে বলা হয়েছিল কি?
—হয়েছিল।
—আসামির সেই ফিঙ্গার-প্রিন্টটি কি আপনি দয়া করে আমাদের দেখাবেন?
সাক্ষী তাঁর ব্যাগ খুলে নম্বর দেওয়া একটি ফিঙ্গার-প্রিন্ট বার করে দিলেন। মাইতি সেটি আদালতে নথিভূক্ত করলেন—’এফ-পি-ওয়ান’ রূপে। তারপর বললেন, এবার আপনার তদন্তের ফলাফল বলুন।
সাক্ষী জবাবে বললেন, যে, তিনি লালবাজার ফিঙ্গার-প্রিন্ট লাইব্রেরিতে বসে গত চার-পাঁচদিন ঐটা মেলবার জন্য ক্রমাগত চেষ্টা করে যান। গত পনের তারিখে তাঁর সন্দেহ হয়, একজন দাগি আসামির সঙ্গে ফিঙ্গার-প্রিন্টটি মিলে যাচ্ছে। দাগি আসামির নাম লালু, ওরফে খোকন। সে বহরমপুরের একটি ডাকাতি কেসে ইতিপূর্বে ধরা পড়েছিল আরও সাতজনের সঙ্গে। তাদের ভিতর পাঁচজনের মেয়াদ হয়—দুজন যথেষ্ট প্রমাণ অভাবে ছাড়া পায়। সেই দুজনের ভিতর একজন ঐ খোকন ওরফে লালু। ঘটনা ছয় মাস আগেকার। সাক্ষী ঐ দিনই বহরমপুরে চলে যান। সেখানকার থানায় রাখা ফিঙ্গার- প্রিন্ট-এর সঙ্গে ঐ ‘এফ-পি-ওয়ান’ ছাপটি মিলিয়ে দেখেন। দেখে নিঃসন্দেহ হন যে, বর্তমান মামলার আসামি সুপ্রিয় দাশগুপ্ত আর খোকন ওরফে লালু অভিন্ন ব্যক্তি!
মাইতি প্রশ্ন করেন, বহরমপুর থানা থেকে কী খবর পেলেন? সেই লালু ওরফে খোকন বর্তমানে কোথায়?
—ওঁরা তা বলতে পারলেন না। আজ ছয় সাতমাস সে বহরমপুরে যায়নি।
—তাহলে আপনি নিঃসন্দেহ যে, খোকন ওরফে লালুই হচ্ছে ঐ আসামি সুপ্রিয়?
—হ্যাঁ, আমি নিঃসন্দেহ!
—আচ্ছা, এমনও হতে পারে যে দুটো ফিঙ্গার-প্রিন্ট হুবহু মিলে গেল, অথচ পরে দেখা গেল সে দুটো বিভিন্ন লোকের?
—না, তা হতে পারে না।
—এমন রেকর্ড কোথাও নেই?
—না নেই!
—কিন্তু ‘আনব্রোকেন রেকর্ডও ক্ষেত্র-বিশেষে তো ‘ব্রোকন’ হয়?
—সাক্ষী ভ্রুকুঞ্চিত করে বলেন, আমি আপনার প্রশ্নটা বুঝতে পারছি না?
—পারছেন না? আচ্ছা, আমি একটা উদাহরণ দিই,—হয়তো বুঝবেন কী বলতে চাইছি—ধরুন আজ আমি বিশ বছর ডিফেন্স কাউন্সেল হিসাবে প্র্যাকটিস করছি এবং এই বিশ বছরের ভিতর আমার কোনও মক্কেলের কখনও ‘কনভিকশন’ হয়নি। তখন হয়তো আমি বড়াই করে বলতে পারি, এটা হচ্ছে ‘আনব্রোকন রেকর্ড! এ রেকর্ড কখনও ভাঙা যাবে না!
পাণ্ডে সাহেব কলকাতার লোক নন। প্রশ্নটার তীব্র ব্যঙ্গের মর্মোদ্ধার করতে পারলেন না। সহজভাবে বলে ওঠেন, তার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই! সমস্ত দুনিয়া মেনে নিয়েছে দুটি মানুষের কখনও হুবহু এক রকম ফিঙ্গার-প্রিন্ট হতে পারে না।
প্রদ্যোৎ লক্ষ্য করে দেখে বাসু-সাহেব একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন আসামির দিকে! যে লোকটাকে বাঁচাবার প্রতিজ্ঞা নিয়ে এসেছেন, এখন যেন তাকেই খুন করতে চান উনি! তার পরেই প্রদ্যোতের নজরে পড়ল বাসু-সাহেবের পাশের চেয়ারখানায়। সেটা ফাঁকা। বৃদ্ধ ব্যারিস্টার এ. কে. রে কখন নিঃশব্দে উঠে চলে গেছেন।
মাইতি একেবারে বিনয়ের অবতার। ঝুঁকে পড়ে বাসুকে বলেন, য়ু মে ক্রস-এক্সামিন হিম, ইফ য়ু প্লিজ!
বাসু উঠে দাঁড়ালেন। আদালত কর্ণময়। বার অ্যাসোসিয়েশানের অনেকেই এসেছে আজ। এমন অবস্থায় বাসু-সাহেবকে কেউ কখনও দেখেনি। সবাই উদ্গ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছে। বাসু-সাহেব গম্ভীর স্বরে বললেন, সহযোগী পাবলিক প্রসিকিউটার যে বারো তারিখ থেকে এ জাতীয় অনুসন্ধান চালাচ্ছিলেন সে খবরটা তিনি এতাবৎকাল আদালতকে জানাননি। বস্তুত তদন্ত শেষ না করে মামলায় উপস্থিত হওয়া যে তাঁর পক্ষে উচিত হয়নি একথা মহামান্য আদালত ইতিপূর্বেই বলেছেন। সে যাই হোক, আমরা এ তথ্য এইমাত্র শুনলাম। তাই প্রতিবাদী পক্ষ আদালতের কাছে কিছু সময় চাইছেন।
জাস্টিস ভাদুড়ী বলেন, আমি আপনার সঙ্গে একমত। প্রতিবাদী আগামীকাল জেরা করবেন।
নির্ধারিত সময়ের কিছু পূর্বেই আদালত বন্ধ হয়ে গেল।
বাসু-সাহেবের গরম লাগছিল। গাউনটা খুলে হাতে ঝুলিয়ে নিলেন। চকিতে তাকিয়ে দেখলেন পাশের চেয়ারখানার দিকে। সেটা ফাঁকা। ধীরে পদে আদালত ছেড়ে বার হয়ে এলেন। পিছন পিছন এল সুজাতা। প্রদ্যোৎ না বলে পারল না—সুপ্রিয়র সঙ্গে একবার দেখা করবেন না স্যার?
—নো! হি ইজ্ এ ডাউন-রাইট ড্যাম্ লায়ার। এক নম্বর মিথ্যাবাদী!
—কিন্তু যদুপতি সিঙ্ঘানিয়া তাহলে কেন ওকে
—যদুপতি কিছু যুধিষ্ঠিরের বাচ্চা নয়! একটা ব্ল্যাকমার্কেটিয়ার! এমনও হতে পারে ঐ খোকন ওরফে লালু—অর্থাৎ সুপ্রিয়, ওর পোষা গুন্ডা। পাপের সাথী!
কোর্ট থেকে ফিরে এলেন ওঁরা।