৫
বৃহস্পতিবার সকাল। প্রতিবাদী সুপ্রিয় দাশগুপ্তের আজ প্রাথমিক হিয়ারিং হবে। বাসু-সাহেব আর সুজাতা তৈরি হয়ে নিল। সুজাতা প্রতিবাদী পক্ষের সমন পেয়েছে। প্রদ্যোৎ নাথ সরাসরি কোর্টে যাবে। ওঁরা রওনা হতে যাবেন এমন সময় বেজে উঠল টেলিফোনটা। বাসু-সাহেব ধরলেন।
ফোন করছেন প্রবীণ ব্যারিস্টার এ.কে.রে। এখন বয়স আশির কোঠায়। ত্রিশ বছর হল তিনি প্র্যাকটিস্ ছেড়ে দিয়েছেন। তাঁর আমলে রে-সাহেব ছিলেন কলকাতার সবচেয়ে নামকরা ক্রিমিনাল ব্যারিস্টার। ব্যারিস্টার মহলে তাঁকে বলা হত ‘বারওয়েল দ্য সেকেন্ড’। বারওয়েল ছিলেন কলকাতা বারের বিখ্যাত শেষ ইংরাজ ব্যারিস্টার। পি.কে. বাসু প্রথম যৌবনে এর কাছেই জুনিয়র হিসাবে কাজ শিখেছেন, ব্যারিস্টারি পড়তে যাবার আগে। রে-সাহেব ওঁকে শুভেচ্ছা জানালেন, বললেন, অনেক অনেকদিন পর কোর্টে বের হচ্ছ, তাই শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।
বাসু বললেন, শুভেচ্ছা কেন স্যার? বলুন আশীৰ্বাদ!
—বেশ আশীর্বাদই। কিন্তু একটা কথা, বাসু। গতকাল নিরঞ্জন মাইতি হঠাৎ আমার কাছে এসেছিল। আমাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করে গেল আজ কোর্টে উপস্থিত থাকতে। আমি তো আজ বিশ-ত্রিশ বছর কোর্টে যাইনি। হঠাৎ এ নিমন্ত্রণটা হল কেন বল তো?
—জানি না। আন্দাজ করতে পারি। সে কী বলল?
—বলল, অনেকদিন পর আপনার শিষ্য আজ সওয়াল করছে, আপনি আসবেন স্যার। আমি নিমন্ত্রণ করতে এসেছি! কিন্তু ওর মুখ-চোখ দেখে আমার মনে হল, মানে…
—আপনার দৃষ্টি ভুল করে না, স্যার! আপনি ঠিকই ভেবেছেন—মাইতি বার অ্যাসোসিয়েশানেও বলে এসেছে এই কেস-এ সে আমার রেকর্ড ভাঙবে! অর্থাৎ অ্যাকিউড-এর কনভিকশান হবে!
—কেসটা কী? তিনশ দুই?
—ইয়েস স্যার!
—কী বুঝছ? কেসটা কী খারাপ?
—ফিটি ফিটি। কিন্তু আমার আশঙ্কা হচ্ছে, মাইতি এমন কিছু এভিডেন্স পেয়েছে যার কোনো হদিসই আমি এখনও পাইনি—হি হ্যাজ সামথিং আপ হিজ্ স্লিভ! কোর্ট-এর ভিতর ড্রামাটিক্যালি সেটা সে পেশ করতে চায়—তাতেই আপনাদের সকলকে নিমন্ত্রণ করছে!
—আমারও তাই মনে হল। এনি ওয়ে—যদি প্রয়োজন মনে কর তাহলে কোর্ট থেকে ফেরার পথে আমার সঙ্গে কনসাল্ট কর। তারপর একটু ইতস্তত করে বললেন, য়ু ক্যান ওয়েল অ্যাপ্রিশিয়েট, বাসু—আই জাস্ট কান্ট অ্যাফোর্ড টু সি মাই হিদারটু আনডিফিটেড কোলিগ—
—কোলিগ নয় স্যার, শিষ্য বলুন!
—ওয়েল মাই বয়! শিষ্যই।…যাক্ তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। বেস্ট অফ লাক্!
প্রবীণ গুরুর আশীর্বাদ নিয়ে বাসু-সাহেব যখন কোর্টে এসে উপস্থিত হলেন তখন কোর্ট বসেছে। আদালতে তিল ধারণের স্থান নেই। ব্যারিস্টার পি.কে. বাসু নতুন করে প্র্যাকটিস শুরু করছেন এ খবর আইনজীবী মহলে ছড়িয়ে পড়েছে। বার অ্যাসেসিয়েশান ভেঙে পড়েছে। দর্শকদের আসন অনেক আগেই পূর্ণ হয়ে গেছে। অনেকে দেওয়াল ঘেঁষে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু প্রেসের লোকও এসেছে। কোর্ট থেকে তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যেন আদালত চলা কালে কোনো ফটো না তোলা হয়।
বিচক্ষণ বিচারক জাস্টিস্ সদানন্দ ভাদুড়ী নিজের আসনে এসে বসলেন। জুরির মাধ্যমে আজকাল আর বিচার হয় না। জুরি নেই। একটু নিচের ধাপে বসে আছে দুজন কোর্ট পেশকার। প্রথা-মাফিক বাদী ও প্রতিবাদী প্রস্তুত আছেন কিনা জেনে নিয়ে বিচারক বিচার আরম্ভ ঘোষণা করলেন। পাবলিক প্রসিকিউটার বিশালায়তন প্রবীণ আইনজীবী নিরঞ্জন মাইতির দিকে তাকিয়ে বলেন, প্রারম্ভিক ভাষণ?
মাইতি খুশিতে ডগমগ। উঠে দাঁড়িয়ে অভিবাদন করে বললেন, আদালত যদি অনুমতি দেন, আমি একটি সংক্ষিপ্ত প্রারম্ভিক ভাষণ দিতে ইচ্ছুক। আমরা আশা রাখি যে, আমরা প্রমাণ করব—আসামি সুপ্রিয় দাশগুপ্ত গত এগারোই এপ্রিল, বৃহস্পতিবার, রাত প্রায় পৌনে আটটার সময় বড়বাজারে মিস্টার এম. পি. জৈনের গদিতে আরও তিনটি সঙ্গীর সঙ্গে অনধিকার প্রবেশ করে। আমরা প্রমাণ করব যে, সে ভয় দেখিয়ে ঐ দোকানের ক্যাশিয়ার সুকুমার বসুর কাছ থেকে ষাট হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয় এবং মিস্টার এম.পি. জৈনের নিজের রিভলভারটি তাঁর হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে তাঁকে গুলিবিদ্ধ করে হত্যা করে। আমরা আশা রাখি, আসামি সুপ্রিয় দাশগুপ্তের বিরুদ্ধে অনধিকার প্রবেশ, ডাকাতি, আনলাইসেন্সড্ রিভলভার রাখা ও হত্যার অপরাধ প্রমাণিত হবে। এবং আমরা আশা রাখি, মহামান্য আদালত এ ক্ষেত্রে আসামির প্রতি চরমদণ্ড বিধান করবেন!
এই কথা বলে নিরঞ্জন মাইতি আসন গ্রহণ করলেন। উকিল মহলে একটা গুঞ্জন উঠল। পি.পি. নিরঞ্জন মাইতিও শুরুতেই একটি রেকর্ড করলেন! এত সংক্ষিপ্ত প্রারম্ভিক ভাষণ নাকি তিনি জীবনে দেননি।
জজ-সাহেবও বোধকরি এটা আশা করেননি। মাইতি শেষ করার পরেও তিনি আশা করেছিলেন, মাইতি বুঝি আবার উঠে কিছু বলবেন। মাইতি সত্যই উঠলেন আবার। হেসে বললেন, দ্যাটস্ অল মি’ লর্ড!
জাস্টিস্ ভাদুড়ী এবার প্রতিবাদী আইনজীবীদের দিকে ফিরলেন। পাশাপাশি বসে আছেন ব্যারিস্টার পি.কে. বাসু তাঁর সহকারী প্রদ্যোৎ নাথ। জাস্টিস্ ভাদুড়ী বললেন, এবার আপনারা প্রারম্ভিক ভাষণ দিতে পারেন।
বাসু-সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। কিছু একটা বলতে গেলেন। হঠাৎ তাঁর দৃষ্টি পড়ল আাদালতের প্রবেশ-দ্বারের দিকে। চমকে উঠলেন উনি। সংক্ষেপে বিচারককে বললেন, দ্যাটস্ অল মি’ লর্ড! আমি কোনো প্রারম্ভিক ভাষণ দেব না!
বিচারকের দিকে একটি বাও করে বাসু-সাহেব তাঁর আসন ছেড়ে এগিয়ে গেলেন দ্বারের দিকে। শুভ্রকেশ অতি বৃদ্ধ এ.কে.রে লাঠি ঠুকঠুক করতে করতে এগিয়ে আসছিলেন। তাঁর হাতটা ধরলেন। হাসলেন রে সাহেব। বাসু ওঁকে নিয়ে এসে বসালেন পাশে। বৃদ্ধ এ. কে. রে স্থির থাকতে পারেননি। এসে উপস্থিত হয়েছেন আদালতে। কোর্টে একটা গুঞ্জন উঠল। জুনিয়র উকিল যাঁরা এ.কে. রে-র শুনেছে, কিন্তু চোখে দেখনি, তারা দাঁড়িয়ে উঠে তাঁকে দেখতে চায়। জাস্টিক ভাদুড়ী তাঁর হাতুড়িটা ঠুকলেন। এ. কে. রে বিচারককে একটা বাও করে আসন গ্রহণ করলেন। বিচারক ভাদুড়ীও হাত নেড়ে প্রত্যভিবাদন করলেন হেসে।
জজ-সাহেব মাইতিকে বললেন, আপনি প্রথম সাক্ষীকে ডাকতে পারেন।
প্রথম সাক্ষী : ডাঃ রামকুমার অধিকারী।
রামকুমার যথারীতি শপথ নিয়ে সাক্ষীর মঞ্চ থেকে তাঁর নাম, পরিচয়, পেশা ইত্যাদি জানালেন মাইতি মশায়ের প্রশ্নের উত্তরে। স্বীকার করলেন, তাঁর ডিসপেনসারি ঐ জৈন-সাহেবের গদির কাছেই। ঘটনার দিন রাত আটটা বেজে তিন মিনিটে একজন লোক ছুটে এসে বলে জৈন-সাহেব গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। শুনেই তিনি তেখতে যান। ওঁর ডাক্তারখানা থেকে যেতে ওঁর আন্দাজ দু’মিনিট লাগে। সুতরাং আটটা পাঁচ মিনিটে তিনি প্রথমে জৈন-সাহেব এবং পরে দায়োয়ানকে পরীক্ষা করেন। জৈন মারা গেছেন, আর দারোয়ানের বাঁ-কাঁধে গুলি বিদ্ধ হয়েছে। দ্বিতীয়জনকে প্রাথমিক চিকিৎসা করে তিনি জানতে চান যে, পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছে কি না। ভিড়ের মধ্যে একজন, কে তা তিনি বলতে পারবেন না—জানায় যে, থানা এবং অ্যাম্বুলেন্সে ফোন করা হয়েছে। মিনিট দশেকের ভিতরেই অ্যাম্বুলেন্স এসে যায়, প্রায় সঙ্গে সঙ্গে পুলিশও
মাইতি প্রশ্ন করেন, মিস্টার জৈন কখন মারা গেছেন বলে আপনার বিশ্বাস?
—এগার তারিখ রাত আটটা পাঁচ মিনিটের আগে।
—না না, কত আগে? রাত আটটা পাঁচ মিনিটে তাঁকে যখন মৃত অবস্থায় দেখেছেন তখন ও-জবাব আমি চাইছি না।
দেখা গেল রামকুমার অত্যন্ত সতর্ক সাক্ষী। জবাবে বললেন, কত আগে তা অটোপ্সি সার্জেন বলতে পারেন। আমি মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদ করিনি।
মাইতি বিরক্ত হয়ে বলেন, কী আশ্চর্য! আপনার পাশের দোকানে ডাকাতি হল, চেঁচামেচি হল, গুলির আওয়াজ হল—
—গুলির আওয়াজ স্বকর্ণে শুনেছি, একথা আমি বলিনি।
—তা শোনেননি, কিন্তু হৈ-চৈ চেঁচামেচি তো শুনেছেন?
—শুনেছি। কিন্তু সেই জ্ঞানের ভিত্তিতে যদি বিশেষজ্ঞ হিসাবে আমি বলি যে মৃত্যু রাত পৌনে আটটার পরে হয়েছে তবে ঐ উনি কোর্টের মধ্যে আমার প্যান্টলুন খুলে নেবেন। ওঁকে আমি চিনি—
সাক্ষী ডিফেন্স-কাউন্সিলার পি. কে. বাসুকে ইঙ্গিত করেন। বাসু-সাহেব তখন একদৃষ্টে একটা নথি পড়ছিলেন। চোখ তুলে দেখলেন না। কোর্টে একটা মৃদু হাস্যরোল উঠতেই জাস্টিস্ ভাদুড়ী হাতুড়ি পিটলেন। বিচারক সাক্ষীকে বললেন, আপনি অবান্তর কথা বলবেন না। প্রশ্নের যা রেঞ্জ উত্তর তার মধ্যেই সীমিত রাখুন।
মাইতি বললেন, দ্যাটস্ অল মি’ লৰ্ড।
বাসু উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, নো ক্রস্ এক্সামিনেশান
এবার সাক্ষীর মঞ্চে উঠে দাঁড়ালেন সরকারপক্ষের দ্বিতীয় সাক্ষী অটোন্সি সার্জেন ডাঃ অতুলকৃষ্ণ সান্যাল। তিনিও তাঁর পরিচয় ইত্যাদি দিয়ে স্বীকার করলেন, মৃত মিস্টার জৈনের শবদেহ তিনি ব্যবচ্ছেদ করেছিলেন। সিসার গোলকটি মৃতের দ্বিতীয় ও তৃতীয় পাঁজরের মাঝামাঝি অংশ দিয়ে হৃৎপিণ্ডে প্রবেশ করে, ঠিক যেখানে ‘সুপিরিয়র ভেনা কাভা’ এবং দক্ষিণ দিকস্থ ‘পালমোনারি আর্টারি’ এসে পড়েছে হৃৎপিণ্ডের দক্ষিণ আর্টিয়ামে। ফলে দক্ষিণ আর্টিয়াম বিদ্ধ হয়, তারপর ঐ সুপিরিয়র ভেনা কাভাকে ফুটো করে এবং দক্ষিণ পালমোনারি আর্টারিদ্বয়ের উপর দিকের ধমনীটি বিচ্ছিন্ন করে সিসার গোলকটি পিঠের দিকে চলে যায়। শিরদাঁড়ার একাদশতম থোরাসিক ভার্টিব্রাতে আহত হয়ে সেটা হৃৎপিণ্ড অঞ্চলেই আটকে থাকে। যেহেতু ‘সুপিরিয়ার ভেনা কাভা’ এবং হৃৎপিণ্ডের আর্টিয়াম মানবদেহে অতি আবশ্যিক প্রত্যঙ্গ—যাকে বলে ভাইটাল-অর্গান, তাই কয়েক মিনিটের ভিতরেই গুলিবিদ্ধ জৈনের মৃত্যু হয়েছিল বলে তাঁর বিশ্বাস।
মাইতি প্রশ্ন করেন, আপনি যা বললেন তা থেকে বোঝা যাচ্ছে গুলিটা জমির সমান্তরালে যায়নি, ক্রমশ উঁচু থেকে নিচু দিকে গিয়েছে। তাই নয়?
—আজ্ঞে হ্যাঁ।
—বুকের যেখান দিয়ে ঢুকেছে এবং পিঠের যেখানে আটকেছে এতে গুলিটা কতখানি নেমেছে?
— পাঁচ সেন্টিমিটার অর্থাৎ প্রায় দু-ইঞ্চি
—এ থেকে কি আপনার ধারণা যে-লোকটা গুলি করেছে, সে মৃত ব্যক্তির চেয়ে উচ্চতায় বেশি?
— আজ্ঞে হ্যাঁ।
—আপনার উত্তরের সাধারণ-বোধ্য বৈজ্ঞানিক একটা ব্যাখ্যা দিন-
ডাক্তার সান্যাল মনে হয় এ প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত হয়েই এসেছিলেন। আদালতের অনুমতি নিয়ে তিনি মানব-কঙ্কালের একটি বড় চার্ট পিছনের দেওয়ালে টাঙিয়ে দেবার ব্যবস্থা করলেন। লম্বা একটা লাঠি দিয়ে দেখালেন ঠিক কোন্ স্থানে গুলিটা বুকে প্রবেশ করেছে এবং কোন্ অস্থিতে আটকে ছিল। উনি বললেন, মানুষে সচরাচর গুলি করে নিজের বুকের সমতলে রিভলভারটা ধরে। ফলে আহত ব্যক্তির ঠিক বুকেই যদি গুলিবিদ্ধ হয় এবং দেখা যায় সেটা ক্রমশ নিচের দিকে নেমেছে তবে আন্দাজ করতে পারা যায় হত্যাকারীর উচ্চতা আহতের চেয়ে বেশি ছিল।
—মিস্টার জৈন-এর উচ্চতা কত ছিল?
—ঠিক পাঁচ ফুট।
—আপনার হিসাবমতো আততায়ীর উচ্চতা কত হবে?
—তা ঠিক করে বলা শক্ত। তবে আন্দাজে বলা যায়, সাড়ে পাঁচ ফুটের উপরে তো বটেই।
—আমার জেরা এখানেই শেষ—বসে পড়েন মাইতি।
ব্যারিস্টার বাসু জেরা করতে উঠে দাঁড়ালেন। প্রথমেই প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা ডক্টর সানিয়াল—ঐ যে বললেন, আপনার মতে আততায়ীর উচ্চতা আহত জৈন-এর চেয়ে বেশি ছিল—এটা আপনার আন্দাজ, বিশ্বাস না স্থির সিদ্ধান্ত।
—না, স্থির সিদ্ধান্ত নয়, আবার আন্দাজও নয়—ওটা আমার যুক্তি-নির্ভর অনুমান।
–আই সি! যুক্তি-নির্ভর অনুমান! কী যুক্তি?
—তাই তো আমি বোঝালাম এতক্ষণ।
—আমি বুঝিনি।
—সেটা আমার দুর্ভাগ্য! আমি চেষ্টার ত্রুটি করিনি।
—তা বললে তো চলবে না ডক্টর সানিয়াল। আপনি মানবদেহ সম্বন্ধে একজন বিশেষজ্ঞ; কিন্তু আমি শারীর-বিদ্যার কিছুই জানি না। আমাদের বোধগম্য ভাষায় আপনাকে বুঝিয়ে দিতে হবে বইকি। আচ্ছা, আমি একে একে প্রশ্ন করি। আমাকে বুঝিয়ে দিন।—ধরুন গুলি করার মুহূর্তে যদি আততায়ী বা আহতের মধ্যে একজন বসে থাকত অথবা কুঁজো হয়ে দাঁড়াত তাহলে আপনার যুক্তিনির্ভর অনুমানটা টেকে না, কেমন?
—না, টেকে না।
—আততায়ী যদি তার নিজের বুকের সমতলে রিভলভারটা না ধরে তাহলেও ও যুক্তি-টেকে না? কারেক্ট?
— ইয়েস।
—আপনি জানেন যে, আয়রন সেফটায় পৌঁছতে গেলে দুটি ধাপ উঠতে হয়। সেক্ষেত্রে আততায়ী যদি সেই সিঁড়ির উপর থেকে গুলি ছুড়ে থাকে তবে বামন হওয়া সত্ত্বেও গলি ঐ ভাবে মৃতের দেহে ঢুকতে পারত। অ্যাম আই কারেক্ট?
একটু ইতস্তত করে সাক্ষী বলেন, কারেক্ট।
—তা সত্ত্বেও আপনি মনে করেন আপনার ঐ সিদ্ধান্ত যুক্তি-নির্ভর অনুমান?
—ও-গুলো তো এক্সেপশানাল কেস!
—এক্সেপশানাল! আপনি তো বিজ্ঞান-শিক্ষিত। পামুটেশন কম্বিনেশান অঙ্ক নিশ্চয় কষেছেন। বলুন—দুজন লোক আছে। একজন আততায়ী একজন আহত; তাদের চারটি অবস্থা হতে পারে—শোয়া, বসা, দাঁড়ানো এবং কুঁজো হয়ে দাঁড়ানো। এক্ষেত্রে দুজনের সমান হয়ে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা কত পার্সেন্ট?
মাইতি উঠে দাঁড়ান, অবজেকশান য়োর অনার! সাক্ষী একজন শারীর-বিদ্যা বিশারদ। অঙ্কশাস্ত্রের পণ্ডিত নন! এ প্রশ্ন অবৈধ
বাসু-সাহেব বলে ওঠেন, এ প্রশ্নের জবাব দিতে হলে অঙ্কে র্যাংলার হবার দরকার নেই। ইন্টারমিডিয়টে অঙ্ক না থাকলে ডাক্তারি কলেজে ভর্তি হওয়া যেত না। যে প্ৰশ্ন আমি করেছি, উনি যখন পাশ করেছেন তখন তো আই.এস.সি.-তে কষানো হত। এই রুডিমেন্টাল অঙ্ক উনি ভুলে গিয়ে না থাকলে ওঁর বলা উচিত, মাত্র 6.25 পার্সেন্ট!
জাস্টিস ভাদুড়ী বলেন, অবজেকশান ওভাররুলড!
সাক্ষী রুমাল দিয়ে মুখটা মুছে বললেন, খাতা পেন্সিল ছাড়া ওটা আমি কষে বার করতে পারব না। তবে মনে হয় শতকরা দশ পার্সেন্টের কম!
—যে পার্সেন্টেজটা এখন বলছেন, সেটা আপনার আন্দাজ, স্থির সিদ্ধান্ত না যুক্তি-নির্ভর অনুমান?
—আন্দাজ!
—ঠিক আছে! অঙ্কশাস্ত্র থাক। ডাক্তারি প্রশ্নেরই জবাব দিন। থেরিসিক অথবা ডর্সাল ভার্টিব্রার সংখ্যা বারোটা অ্যাম আই কারেক্ট?
—ইয়েস।
—একাদশতম থোরাসিক ভার্টিব্রার অবস্থান প্রায় নাভিকুণ্ডের সম-উচ্চতায়? অ্যাম আই কারেক্ট?
—আমি তখন একাদশতম থোরাসিক ভার্টিব্রার কথা বলিনি, স্পাইনাল কলমের একাদশতম অস্থির-
বাধা দিয়ে বাসু বলেন, আনসার মি! একাদশতম থোরাসিক ভার্টিব্রার অবস্থান প্রায় নাভিকুণ্ডের সম-উচ্চতায়? ইয়েস অর নো?
—কী আশ্চর্য! আমি তখন—
—আই আস্ক ফর দ্য থার্ড টাইম—একাদশতম থোরাসিক ভার্টিব্রার—প্রশ্নটা শেষ করতে দেন না সাক্ষী। তার আগেই বলেন, ইয়েস।
—আহতের বুকে যেখানে গুলি লেগেছে সেখান থেকে তার একাদশতম থোরাসিক অস্থির অবস্থিতি—সোজা হয়ে দাঁড়ালে—অন্তত এক ফুট নিচে। ঠিক কথা?
—কিন্তু আমি তা-
—বড় বাজে কথা বলছেন আপনি। বলুন—’হ্যাঁ, না ‘না’।
— ইয়েস!
—আপনার যুক্তি-নির্ভর থিয়োরি অনুযায়ী—অর্থাৎ ঐ 6.25 পার্সেন্ট সম্ভাবনা যদি কোনোক্রমে কার্যকরী হয়, আই মিন দুজনেই যদি খাড়া হয়ে দাঁড়ায় এবং আততায়ী তার বুকের লেভেল থেকে গুলি করে, সে ক্ষেত্রে আততায়ীর উচ্চতা দশ থেকে বারো ফুট হওয়া উচিত? বলুন—’হ্যাঁ’, না ‘না’?
মরিয়া হয়ে সাক্ষী বলেন, আপনি শুধু শুধু ব্যাপারটা গুলিয়ে দিচ্ছেন। আমি একাদশ থোরাসিক ভার্টিব্রার কথা আদৌ বলিনি-
বাসু-সাহেব হাত তুলে সাক্ষীকে থামতে বলেন, জজসাহেবকে বলেন, মহামান্য আদালতকে অনুরোধ করছি, সাক্ষীর জবানবন্দির ঐ অংশ তাঁকে পড়ে শোনানো হোক—ঐ যেখানে উনি সিসার গোলকটা শব-ব্যবচ্ছেদের সময় পেয়েছেন।— বাসু -সাহেব বসে পড়েন, রুমাল দিয়ে চশমার কাচটা মোছেন।
বিচারকের অনুমতি অনুসারে কোর্ট পোর পড়ে শোনায়, ‘ফলে দক্ষিণ আর্টিয়াম বিদ্ধ হয়, তারপর ঐ সুপিরিয়ার ভেনা কাভাকে ফুটো করে এবং দক্ষিণ পালমোনারি আর্টারিদ্বয়ের উপর দিকের ধমনীটি বিচ্ছিন্ন করে সিসার গোলকটি পিঠের দিকে চলে যায়। শিরদাঁড়ার একাদশতম থোরাসিক ভার্টিব্রাতে আহত হয়ে সেটা হৃপিণ্ড অঞ্চলেই আটকে থাকে।’
জবাবনবন্দি পাঠ শেষ হতেই তড়াক করে উঠে দাঁড়ান বাসু-সাহেব— নাউ আনসার মি! আপনার যুক্তি-নির্ভর অনুমান মতো আততায়ীর উচ্চতা দশ থেকে বারো ফুট হওয়া উচিত?
মাইতি আপত্তি জানান, বলেন, সাক্ষী ইতিপূর্বে একাদশ থোরাসিক ভার্টিব্রার কথা মোটেই বলতে চাননি। শিরদাঁড়ার একাদশতম অস্থির কথা বলতে চেয়েছেন। শিরদাঁড়ার উপর দিকের প্রথম সাতটি অস্থি থোরাসিক নয়।
বাসু-সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে বিচারককে বলেন, মাননীয় সহযোগী যদি নিজেকেই বিশেষজ্ঞ হিসাবে দাবি করেন তবে তাঁকেই জেরা করার অনুমতি চাইছি। on voir dire!
কোর্টে একটা হাস্যরোল ওঠে।
জাস্টিস ভাদুড়ী গম্ভীর হয়ে বলেন, আদালত এসব ব্যঙ্গোক্তি পছন্দ করেন না। কিন্তু এক্ষেত্রে ডিফেন্স কাউন্সেলের সঙ্গে আমি একমত। সাক্ষী কী বলতে চান তার ব্যাখ্যা আমরা বাদীপক্ষের উকিলের কাছে শুনতে চাই না, বিশেষজ্ঞ হিসাবে তিনি কী বলেছেন তা আমরা শুনেছি। মিস্টার ডিফেন্স কাউন্সেলার, য়ু মে প্রসিড—
—আমার আর কিছু জিজ্ঞাস্য নেই। আমি মাননীয় আদালতকে এই সিদ্ধান্তেই আসতে বলব যে সাক্ষী শুধু অঙ্কশাস্ত্র নয়, ডাক্তারি শাস্ত্র বিষয়েও বিশেষজ্ঞ হিসাবে দাবি করতে পারেন না। স্পাইনাল কর্ডের একাদশদম অস্থিকে যিনি অষ্টাদশতম অস্থি বলতে পারেন তাঁর পক্ষে ফার্স্ট এম. বি. পাশ করাও অসম্ভব!
জাস্টিস ভাদুড়ী কঠিনস্বরে বলেন, আদালত কোন্ সিদ্ধান্তে আসবেন সেটা আদালতের বিচার্য!
—আই এগ্রি, মি’ লর্ড! কিন্তু একথাও আমি আদালতকে ভেবে দেখতে বলব যে, বিশেষজ্ঞ হিসাবে সাক্ষী যে বলেছেন আততায়ীর উচ্চতা পাঁচ ফুটের চেয়ে বেশি তার কোনো যুক্তি নেই।
জাস্টিস ভাদুড়ী একটু বিরক্ত হয়েই বলেন, মিস্টার পি. পি.। আপনার পরবর্তী সাক্ষীকে ডাকুন।
পরবর্তী সাক্ষী ব্যালাস্টিক এক্সপার্ট জীতেন বসাক। তিনি তাঁর সাক্ষ্যে এই সত্যই প্রতিষ্ঠিত করলেন যে, এ. পি. জৈনের মৃত্যু হয়েছে যে গুলিতে সেটা .38 বোর রিভলভারের। জৈনের নিজের রিভলভারটি ছিল ঐ বোরের স্যাক্সবি কোম্পানির; তার নম্বর 759362 এবং আসামির নামে রিজার্ভ করা ক্যুপে থেকে যে রিভলভারটি আবিষ্কৃত হয়েছে সেটারও ঐ বোর এবং ঐ নম্বর। অর্থাৎ সেটা জৈনের রিভলবার। রিভলভারটি পিপল্স্ একজিবিট হিসাবে চিহ্নিত হল।
বাবু-সাহেব তাঁকে কোনও প্রশ্ন করলেন না।
প্রদ্যোত নাথ জনান্তিকে তাঁকে বলে, ব্যালাসটিক এক্সপার্টকে ক্রস করবেন না?
বাসু নিম্নস্বরে বললেন, পণ্ডশ্রম! লোকটা আদ্যন্ত সত্যি কথা বলছে।
পাশে বসেছিলেন এ. কে. রে। তিনি শুধু বললেন, কারেক্ট।
চতুর্থ সাক্ষী জৈনের ক্যাশিয়ার সুকুমার বসু। মাইতির প্রশ্নে সে নিজের নাম, ধাম, পরিচয় দিয়ে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যারাত্রের ঘটনার একটি নিখুঁত বিবরণ দিল। বলল, তিনজন ডাকাতেরই মুখে রুমাল বাঁধা ছিল। তাদের চোখ দেখা যাচ্ছিল। মাইতি প্রশ্ন করেন, যে লোকটা গুলি করেছিল তাকে আপনি দেখেছেন?
—নিশ্চয়ই! আমার চোখের সামনেই তো সে গুলি করল।
—তার আকৃতির একটা বর্ণনা দিন।
সাক্ষী আসামির দিকে তাকিয়ে বললে, উচ্চতা পাঁচফুট দশ ইঞ্চি হবে; একহারা ফর্সা-
—ওদিকে কী দেখছেন? যিনি প্রশ্ন করছেন তাঁর দিকে তাকান—বাধা দেন বাসু-সাহেব! সাক্ষী থতমত খেয়ে যায়। আসামির দিকে আর তাকায় না। বলে, বয়স পঁচিশ ছাব্বিশ, বড় বড় জুলফি ছিল, চোখে কালো চশমা—
মাইতি ওকে ভরসা দিয়ে বলেন, আমার দিকে কেন? ওদিকেই তাকিয়ে দেখুন। আপনার কি মনে হয়, আততায়ীর চেহারার সঙ্গে আসামির চেহারার সাদৃশ্য আছে?
—আছে।
—কী সাদৃশ্য?
—দুজনের উচ্চতা এক, বয়স এক, দুজনেই ফর্সা এবং দুজনেরই বড় বড় জুলফি আছে।
—আপনার কি অনুমান আসামিই সেই আততায়ী?
—অবজেক্শান য়োর অনার! সাক্ষী তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথাই বলতে পারেন। তাঁর অনুমান কোনো এভিডেন্স নয়।
মাইতি হেসে বলেন, আচ্ছা আমি প্রশ্নটা অন্যভাবে করছি—আপনি আততায়ীকে প্রত্যক্ষ করেছেন, আসামিকেও প্রত্যক্ষ করছেন। এখন বলুন, দুজনের আকৃতি কি একই রকম?
—আজ্ঞে হ্যাঁ!
—সব চেয়ে বেশি সাদৃশ্য কোথায় লক্ষ্য করছেন?
ঐ বড় বড় জুলফি।
—য়ু মে ক্রস এক্সামিন—বাসুকে অনুমতি দিয়ে আসন গ্রহণ করেন মাইতি।
বাসু প্রথমেই জিজ্ঞাসা করেন। সুকুমারবাবু, আপনার নিজের ‘হাইট’ কত?
প্রথম প্রশ্নেই আপত্তি জানালেন পি. পি.। এ প্রশ্ন নাকি অবৈধ। সাক্ষীর উচ্চতার সঙ্গে মামলার কোনো সম্পর্ক নাকি নেই। বাসু জজ-সাহেবকে বললেন, য়োর অনার, সাক্ষীকে দিয়ে বলাতে চাইছি যে, তাঁর নিজের উচ্চতাও ঐ পাঁচ-ফুট দশ ইঞ্চির কাছে, তিনি ও একহারা, হোয়াইটেক্স মাখলে তিনিও আসামির মত ফর্সা হয়ে যাবেন এবং তাঁর নিজেরও বড় বড় জুলফি আছে! অর্থাৎ আসামির মঞ্চে যদি আসামির পরিবর্তে একটি প্রমাণ সাইজ আয়না থাকত তাহলেও তাঁর জবাব এক রকমই হত! যাই হোক, সহযোগী যখন আপত্তি করছেন তখন আমি না হয় অন্য প্রশ্ন করছি। বলুন, সুকুমারবাবু— আপনি এখনই বলেছেন আসামিকে আততায়ীরূপে চিহ্নিত করবার সবচেয়ে বড় যুক্তি হচ্ছে তার বড় বড় জুলফি। তাই নয়?
—হ্যাঁ, তাই বলেছি।
—আপনি কেন অতবড় জুলফি রেখেছেন?
—অবজেক্শান য়োর অনার! ইররেলিভ্যান্ট…
বিচারক বললেন, অবজেক্শান সাসটেনড্।
বাসু হেসে বলেন, বড় বড় জুলফি রাখা আজকের দিনে একটা ফ্যাসান, তাই নয়?
—আজ্ঞে হ্যাঁ, তাই তো দেখতে পাই।
—তাহলে শিকারি বিড়ালকে যেমন গোঁফ দেখে চেনা যায়, মানুষ শিকারিকে তেমনি জুলফি দেখে চেনা যায় না?
মাইতি আজ পান থেকে চুন খসতে দেবেন না। তড়াক করে উঠে দাঁড়ান আবার। আপত্তি জানিয়ে বলেন, সাক্ষী একথা বলেননি, যে, গোঁফ দেখে কিছু চেনা যায়।
বাসু গম্ভীর হয়ে বলেন, না, গোঁফ দেখে চেনার কথা সাক্ষী সুকুমার বোস বলেননি, বলেছিলেন সুকুমার রায় ।
মাইতি অবাক হয়ে বলেন, মানে! সুকুমার রায়! তিনি কে?
বাসু গাম্ভীর্য বজায় রেখেই বলেন, না, সুকুমার রায় নিজে ও কথা বলেননি। বলেছিলেন তাঁর হেড অফিসের বড়বাবু। বড়বাবুর বদলে ক্যাশিয়ার বরং বলেছেন : ‘জুলফির আমি, জুলফির তুমি—তাই নিয়ে যায় চেনা!’
আদালতে হাস্যরোল ওঠে।
জাস্টিস ভাদুড়ী তাঁর হাতুড়ি পিটিয়ে গণ্ডগোল থামালেন। বাসুকে বললেন, আই অ্যাডভাইস দ্য কাউন্সেল নট্ টু বি ফ্রিভলাস!
বাসু একটি বাও করে বললেন, পার্ডন মি’ লর্ড! আমার মনে আছে, এটা তিনশ দুই ধারার মামলা। কিন্তু বর্তমান সাক্ষী তাঁর সাক্ষ্যকে ক্রমশ ঐ ফ্রিভলিটির পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছেন,—আমি নাচার। মাননীয় আদালতে সমবেত ভদ্রমণ্ডলীর দিকে তাকিয়ে প্রণিধান করবেন, ঐ বয়সের শতকরা চল্লিশজনের বড় বড় জুলপি আছে।
জাস্টিস ভাদুড়ী শুধু বললেন, য়ু বেটার প্রসিড উইথ য়োর ক্রস একজামিনেশনস্। বাসু পুনরায় সাক্ষীকে জেরা শুরু করেন : আসামি যখন হাজতে ছিল তখন পুলিশ আপনাকে সেখানে নিয়ে গিয়ে দূর থেকে ঐ আসামিকে চিনিয়ে দিয়েছিল। তাই নয়?
—না তো!
—আপনি বলতে চান আপনাকে পুলিশ আগেভাগে ঐ আসামিকে দেখিয়ে দেয়নি? চিনিয়ে দেয়নি?
—আজ্ঞে না, কখনও না!
—কেন বাজে কথা বলছেন? আপনি কি বলতে চান আজ এই আদালতে এসে ঐ কাঠগড়ায় লোকটাকে জীবনে প্রথম দেখলেন?
—নিশ্চয়ই!
—তাই বলুন। তার মানে দাঁড়াচ্ছে গত এগারো তারিখ রাত আটটা নাগাদ ঐ আসামিকে আপনি দেখেননি—যেহেতু আজই তাকে জীবনে প্রথম দেখলেন। তাই না!
—না, মানে, আমি সেকথা বলিনি!
—বলেছেন! আপনি যা বলেছেন তা সঙ্গে সঙ্গে লেখা হয়ে যাচ্ছে। শুনতে চান?
–না, না, আমি যা বলেছি তার মানে হচ্ছে-
—মানে হচ্ছে ‘কনক্লুশান’। সেটা আদালত করবেন। আপনি নন।
একটি ‘বাও’ করে বাসু বলেন, থ্যাঙ্কু মি’ লর্ড। আমার আর কিছু জিজ্ঞাস্য নেই। তড়াক করে লাফিয়ে ওঠেন মাইতি। বলেন, পরবর্তী সাক্ষীকে ডাকার আগে আমি বর্তমান সাক্ষীকে রি-ডাইরেক্ট-এক্সামিনেশান কিছু প্রশ্ন করতে চাই।
—করুন।
মাইতি বললেন, সুকুমারবাবু, আপনি এইমাত্র বলেন যে, আসামিকে সুপ্রিয় দাশগুপ্তরূপে আজই জীবনে প্রথম দেখলেন—
—অবজেকশান য়োর অনার! সাক্ষী সে কথা আদৌ বলেননি।
—বাট হি মেন্ট ইট!—ঘুরে দাঁড়ান মাইতি।
জজ-সাহেব নিরাসক্ত কণ্ঠে বলেন, আপনার সহযোগী ও প্রসঙ্গে শেষ কথা বলে দিয়েছেন। সাক্ষী কী বলেছেন আদালত তা শুনেছেন, তার কী অর্থ আদালত তা বুঝে নেবেন। আপনি সরাসরি প্রশ্ন করুন। সাক্ষীর মুখে নিজ অভিপ্রায়মতো শব্দ বসাবেন না।
মাইতির মুখচোখ লাল হয়ে উঠল। সামলে নিয়ে বললেন, সুকুমারবাবু, আপনি কি আসামি সুপ্রিয় দাশগুপ্তের সঙ্গে কখনও টেলিফোনে কথাবার্তা বলেছেন? বলে থাকলে কবে?
—বলেছি। ঘটনার দিন অর্থাৎ বৃহস্পতিবার, এ বছরের এগারোই এপ্রিল।
—কখন?
—বিকাল পাঁচটায়
—কী কথা হয়েছিল?
—উনি টেলিফোনে আমার মালিকের খোঁজ করলেন—তিনি গদিতে নেই শুনে উনি নিজের নাম আর পরিচয় দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন—
—জাস্ট এ মিনিট। নিজ নাম আর পরিচয় বলতে?
—উনি বললেন, উনি সুপ্রিয় দাশগুপ্ত, বোম্বাইয়ের কাপাডিয়া অ্যান্ড কাপাডিয়া কোম্পানির ম্যানেজার। আরও বললেন, মালিক ফিরে এলে আমি যেন তাঁকে জানাই যে, সুপ্রিয়বাবু ফোন করেছিলেন, তিনি পরদিন বেলা এগারোটার সময় হুন্ডিটা নিতে আসবেন।
—আই সি! হুন্ডিটা! আর কিছু প্রশ্ন করেননি তিনি?
—আজ্ঞে হ্যাঁ, করেছিলেন। আমি ক্যাশিয়ার বলে পরিচয় দেবার পর উনি জানতে চান, আমার ক্যাশে তখন কত টাকা আছে!
মাইতি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, বলেন কী! আপনার ক্যাশে কত টাকা আছে তা উনি কেন জানতে চাইছেন তা আপনি জিজ্ঞাসা করেননি?
—করেছিলাম। তাতে উনি বলেন, পরদিন গুডফ্রাইডের ছুটি; ব্যাঙ্ক ভল্ট বন্ধ। তাই জানতে চাইছেন?
—তার মানে কী?
—মানে আমি জানি না।
—দ্যা অল মি’ লর্ড।—আসন গ্রহণ করেন মাইতি।
বাসু-সাহেব তখন সাক্ষীকে রি-ক্রস-এক্সামিনেশান শুরু করলেন : আচ্ছা সুকুমারবাবু, টেলিফোনে যে আপনি আসামির সঙ্গেই কথা বলেছিলেন সেটা কেমন করে বুঝলেন?
—উনিই তো তাঁর নাম, ধাম টেলিফোনে বললেন!
—সে তো টেলিফোনে যে কেউ বলতে পারে। পারে না?
— পারে।
—আপনি বলেছেন, আসামিকে আপনি জীবনে কখনও আজকের আগে দেখেননি, কণ্ঠস্বরও শোনেননি নিশ্চয়? শুনেছেন?
—আজ্ঞে না।
—তার মানে যে-কেউ আসামির নাম পরিচয় নিয়ে ও কথা বলতে পারত?
—তা পারত!
—তাহলে কেন হলপ নিয়ে বললেন—আসামি সুপ্রিয় দাশগুপ্তের সঙ্গে আপনি টেলিফোনে কথা বলেছেন?
—স্যার, আমি ভেবেছিলাম—
—ভেবেছিলেন! আই সি!—বসে পড়েন বাসু।
আদালত বেলা আড়াইটা পর্যন্ত বন্ধ রইল। মধ্যাহ্ন বিরতি।