মাছের কাঁটা – ৩

রানি দেবীর সমস্ত দিনটাই কর্মব্যস্ত গেল। কৌশিক পর পর চার পাঁচবার ফোন করেছে। বেলা দশটায় প্রথমবার—পার্ক হোটেল থেকে। খবর : ও একচল্লিশ নম্বর ঘরে উঠছে। ওখান থেকে উনচল্লিশ নম্বর ঘর নজর রাখা যাচ্ছে। সেটাতে দুজন বোর্ডার আছেন ডবল-বেড রুম। হোটেল রেজিস্টারে দেখেছে তাঁদের নাম জীবনকুমার বিশ্বাস আর সুপ্রিয় দাশগুপ্ত। স্থায়ী ঠিকানা—কাপাডিয়া অ্যান্ড কাপাডিয়া কোম্পানি, বোম্বাই। জীবনবাবু মধ্যবয়সি। দোহারা চেহারা, গোঁফ আছে। তিনি ঘর ছেড়ে দু-তিনবার বের হয়েছেন। সুপ্রিয় একবার মাত্র বার হয়েছিল। বারান্দায় বেরিয়ে এসেই আবার ঘরে ঢুকে যায়। সে যে ঘরে আছে তার আরও প্রমাণ আছে। কারণ জীবনবাবু যতবারই বার হচ্ছেন ঘরে তালা দিয়ে যাচ্ছেন না। ফিরে এসে নক করছেন। ভিতর থেকে কেউ দরজা খুলে দিচ্ছে।

রানি দেবী রিপোর্টটা বিশুর হাতে পাঠিয়ে দিলেন বাসু-সাহেবকে। বাসু সেটা পড়ে তৎক্ষণাৎ ফোন করলেন পার্ক হোটেলের একচল্লিশ নম্বর ঘরে—দশটা বারোয়।

কৌশিক ফোন ধরতেই বললেন, তোমার রিপোর্ট পেয়েছি। শোনো, একবার জীবন ঘর ছেড়ে বার হলেই তুমি ঊনচল্লিশে ফোন করো। সাড়া দিলেই বলবে, তুমি জীবন বিশ্বাসকে খুঁজছ। ন্যাচারালি লোকটা বলবে, তিনি ঘরে নেই। সঙ্গে সঙ্গে তুমি প্রশ্ন করবে, আপনি কি সুপ্রিয়বাবু? সে উত্তর দেওয়ামাত্র লাইন কেটে দেবে। রিপোর্ট ব্যাক রেজাল্ট।

—কোশিক দ্বিতীয়বার ফোন করল দশটা কুড়িতে। বলল, জীবন সওয়া দশটায় ঘর ছেড়ে বার হতেই ও ফোন করে। উনচল্লিশ নম্বরে কেউ সেটা ধরে। কৌশিক প্রশ্ন করে, ‘জীবনবাবু আছেন?” লোকটা জবাবে প্রতিপ্রশ্ন করে, ‘আপনি কে?’ কৌশিক বলে, ‘আপনি কি সুপ্রিয়বাবু?’ লোকটা যেন পিন-আটকে যাওয়া-রেকর্ড–বলে, ‘আপনি কে?’ সব শুনে বাসু-সাহেব বলেন, ঠিক আছে। জীবন ঘরে ফিরলেই আমাকে ফোনে জানিও।

এগারোটার সময় কৌশিক জানাল সুপ্রিয় দাশগুপ্তকে এখনও দেখা যায়নি; এবং জীবন বিশ্বাস ঘরে ফিরেছে। ‘বাসু তখন নিজেই ফোন করলেন ঐ উনচল্লিশ নম্বর ঘরে। ফোন ধরল সুপ্রিয়। বাসু বললে ‘জীবনবাবু আছেন?”

লোকটা বলল, আপনি কে?

—বাসু বললেন, আমি যেই হই না মশাই, তাতে আপনার কী? জীবনবাবু যদি থাকেন ডেকে দিন, না থাকেন—বলুন, নেই।

একটু নীরবতার পর বাসু শুনলেন, হ্যালো, জীবনকুমার বিশ্বাস বলছি।

—আমি পি.কে. বাসু। ফোন ধরেছিল কে বলুন তো? দু-দুবার—

জীবন ওঁকে শেষ করতে দিল না। বললে, বুঝতেই তো পারছেন। বলুন, কেন ফোন করছিলেন?

—রেজিস্ট্রি করে দিয়েছেন?

—হ্যাঁ, এই মাত্র।

—দু-লাখ টাকা ব্ল্যাক মানির কথাটাও লিখেছেন নাকি?

—না। শুধু লিখেছি অনেক টাকা নগদে নিয়ে যাচ্ছি।

—ঠিক আছে।—লাইন কেটে দিলেন বাসু।

এরপর কৌশিকের ফোন এল বিকেল চারটেয়। সে টিকিট পেয়েছে, ঘটনাচক্রে রিজার্ভেশনও। সুপ্রিয় একবারও ঘর ছেড়ে বার হয়নি। এমনকি লাঞ্চ খেতেও নয়। বোধহয় লোকটা অসুস্থ। না হলে অন্তত দ্বিপ্রাহরিক আহার করতে একবার বার হত। অথচ সে যে ঘরে আছে এটা নিঃসন্দেহ। এ-ছাড়া আর একটা খবরও পাওয়া গেছে। আটত্রিশ নম্বর ঘরে দিন তিনেক আগে একজন ভদ্রমহিলা তাঁর অসুস্থ ভাইকে নিয়ে নাকি উঠেছিলেন। হোটেল রেজিস্টার অনুযায়ী তাঁদের নাম মিস্টার এবং মিস্ ডিসিলভা–ভাই বোন। ভাইটি নাকি বিকৃতমস্তিষ্ক। ইন্টারেস্টিং কেস। রাঁচি থেকে ভাইকে নিয়ে উনি এ হোটেলে উঠেছিলেন। আজ সকাল ছয়টায় চলে গেছেন। পাগল ভাইকে নিয়ে এই কদিন একটা গাড়িতে বারেবারেই বার হতেন চিকিৎসা করানোর ব্যাপারে। ভাইটা কেমন যেন জড়াব, ধন্ধ-ধরা। চেঁচামেচি গণ্ডগোল করত না। দিবারাত্র পড়ে পড়ে ঘুমাতো। খবরটা ওকে দিয়েছে রুম-সার্ভিসের বেয়ারা হরিমোহন। সে পাগলটাকে দেখেছে। দু-একবার তাকে ধরে গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছেও দিয়ে এসেছে। লোকটা ঘুমোতে ঘুমোতেই হাঁটত। চোখ খুলে বড় একটা তাকাতোও না। এত খবর ও জানাচ্ছে এজন্য যে, মিসিং-লিঙ্ক মিস্ ডিক্রুজার সঙ্গে ঐ ডিসিলভার কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে।

সন্ধ্যা ছয়টার সময় সে ফোন করে জানাল—পাশের ঘরের দুই-বাসিন্দা রওনা হলেন। সঙ্গে দুটো বেডিং, চারটে স্যুটকেস। দুটো স্যুটকেস হোটেলের সেফ ডিপজিট লকার থেকে এইমাত্র ডেলিভারি নেওয়া হল। সুপ্রিয়কে ও এক নজর মাত্র দেখেছে। লোকটা ঘর থেকে বেশ তাড়াহুড়ো করেই হঠাৎ বেরিয়ে এল। কৌশিকও ঘর ছেড়ে বের হয়ে এসেছিল। কিন্তু ভাল করে তাকে শনাক্ত করার আগেই লোকটা গিয়ে বসল ট্যাক্সিতে। তবু এক নজরে সে তাকে যা দেখেছে দরকার হলে শনাক্ত করতে পারবে। লম্বা একহারা, রঙ ফর্সা। গোঁফ-দাড়ি কামানো, বড় বড় জুলফি। কৌশিক টেলিফোনে জানাল যে, সেও রওনা হচ্ছে। হাওড়া স্টেশনের ফার্স্ট ক্লাস ওয়েটিংরুমে গিয়ে সে ছদ্মবেশ পালটাবে।

সুজাতাও হাতব্যাগ নিয়ে রওনা হয়ে গেল সন্ধ্যা ছ’টা নাগাদ।

.

যথেষ্ট সময় থাকতে সুজাতা স্টেশানে পৌঁছেছে। থ্রি-আপ বোম্বাই-মেল নয় নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকেই ছাড়ছে। প্ল্যাটফর্ম টিকিট কিনে স্টেশনে ঢুকে সে রিজার্ভেশন চার্টটা দেখল। 7852 বৰ্গিতে সি-চিহ্নিত ক্যুপে-কামরায় মিস্টার এবং মিসেস দাশগুপ্তার আসন সংরক্ষিত। সুজাতা গটিয়ে যেই কামরায় উঠতে যাবে, কন্ডাকটার গার্ড রুখল : আপনার টিকিটটা প্লিজ?

অত্যন্ত সপ্রতিভ-ভঙ্গিতে ও বললে, আমার নাম মিসেস অঞ্জলি দাশগুপ্তা। টিকিট আমার স্বামীর কাছে আছে। উনি পিছনে আসছেন। আমাদের টিকিট নম্বর হচ্ছে 3542 এবং 3543। দেখুন তো সি-কম্পার্টমেন্ট কি?

কন্ডাকটার-গার্ড তাঁর হাতের চার্ট দেখে বললেন, হ্যাঁ, সি-কম্পার্টমেন্ট। যান বসুন। সুজাতা উঠল বগিতে। সি-কম্পার্টমেন্টে ছোট্ট ক্যুপে। দরজা বন্ধ ছিল। টেনে খুলতেই দেখে ভিতরে বসে আছেন এক ভদ্রলোক। একা। বছর চল্লিশ বয়স, স্যুট-পরা। ওকে দেখেই বললেন, মিসেস দাশগুপ্তা নিশ্চয়?

—হ্যাঁ, কিন্তু আপনাকে তো ঠিক—

—না, আমিও আপনাকে চিনি না। ক্যুপেটা মিস্টার অ্যান্ড মিসেস দাশগুপ্তের নামে রিজার্ভ করা তো—

—ও! তা আপনার কোন্ কম্পার্টমেন্ট?

—এখনও জানি না। আপনি ততক্ষণ আমার ব্যাগটা দেখুন, আমি কন্ডাকটার গার্ডকে জিজ্ঞাসা করে আসি।—ব্যাগটা রেখেই নেমে গেলেন ভদ্রলোক। ব্যাগটা হচ্ছে BOAC-এর এয়ার ব্যাগ। সেটা রাখা ছিল জানলার ধারে। জানলার কাচটা বন্ধ। সুজাতা ব্যাগটা সরিয়ে দিল বেঞ্চির মাঝ বরাবর। জানলার ধারে গিয়ে বসল। কাচটা তুলে দিল। ঘড়িতে দেখল সাতটা পনের হয়েছে।

ঠিক তখনই কুলির মাথায় মাল চাপিয়ে এক ভদ্রলোক এসে হাজির। বছর ত্রিশেক বয়স। সুন্দর একহারা চেহারা। গোঁফ-দাড়ি কামানো। লম্বা জুলফি। নিঃসন্দেহে সুপ্রিয় দাশগুপ্ত। সুজাতাকে এক নজর দেখে নিয়ে বললেন, ঐ ব্যাগটা আপনার?

সুজাতা বললেন, না। ঐ ভদ্রলোক রেখে গেছেন।—হাত বাড়িয়ে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো স্যুটপরা ভদ্রলোককে সে দেখিয়ে দেয়। ভদ্রলোক এক প্যাকেট সিগ্রেট কিনছিলেন। আগন্তুক মুখ বাড়িয়ে ভদ্রলোককে একনজর দেখে নিলেন। তারপর সুজাতার দিকে ফিরে বললেন, আপনার রিজার্ভেশন কোথায়?

—এই ক্যুপেতেই। আপনার?

ভদ্রলোক ইতিমধ্যে ব্যাঙ্কটা পেতে ফেলেছেন। কুলি তার উপর বেডিংটা রাখছে। তার হাত থেকে মালপত্র নিয়ে ঘরটা সাজাতে সাজাতে ভদ্রলোক বললেন, আপনি ভুল করছেন। কন্ডাকটার গার্ডকে টিকিটটা দেখান, উনি আপনার কামরা দেখিয়ে দেবেন।

—উনিই আমার টিকিট দেখে বললেন, এই ক্যুপে।

কুলি পয়সা চাইল। ভদ্রলোক সে-কথা কানে তুললেন না। সুজাতাকে বলেন, কই দেখি আপনার টিকিট?

—আপনাকে টিকিট দেখাতে যাব কোন্ দুঃখে?

এই সময় দ্বারপথে এসে দাঁড়ালেন একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক। সুজাতার বুঝতে অসুবিধা হল না,—উনি জীবন বিশ্বাস! ঝোলা গোঁফেই তাঁর পরিচয়। প্রৌঢ় ভদ্রলোক বললেন, কী হল স্যার?

—কন্ডাকটার গার্ডকে ডাকুন তো। এ ভদ্রমহিলা অহেতুক ঝামেলা করছেন।

জীবনবাবুও বৃত্তান্তটা শুনে সুজাতাকে বোঝাতে চাইলেন সে ভুল করছে। সুজাতা কোনো পাত্তাই দিল না। অগত্যা ওঁরা ডেকে নিয়ে এলেন কন্ডাকটর গার্ডকে।

—কী হল আবার আপনাদের?—দ্বারপথে এসে দাঁড়ায় কন্ডাকটার গার্ড। সুপ্রিয় বললে, এ ভদ্রমহিলার কোন্ ঘরে রিজার্ভেশান আছে দেখে দিন তো?

—কই দিন তো আপনার টিকিট?—কন্ডাকটার গার্ড হাত বাড়ায়।

—বললাম না তখন, আমি মিসেস দাশগুপ্তা? টিকিট আমার স্বামীর কাছে আছে। আমাদের টিকিট নম্বর 3542 এবং 3543।

কন্ডাকটার গার্ড আবার তার চার্ট মেলাতে থাকে। সুপ্রিয় বাধা দিয়ে বলে, ওটা দেখতে হবে না। এই দেখুন। টিকিট নম্বর 3542 এবং 3543!

কন্ডাকটার গার্ড ফ্যালফ্যাল করে দুজনের দিকে তাকায়।

—একে নামিয়ে দিন!—কঠিন কণ্ঠে সুপ্রিয় বলে।

—আপনি কাইন্ডলি নেমে আসুন—কন্ডাকটার গার্ড সুজাতাকে অনুরোধ করে।

—ইয়ার্কি নাকি! আগে আমার স্বামী আসুন, তার আগে আমি নামব না।

—কী আশ্চর্য! আপনার কাছে টিকিট নেই—

—কে বলল টিকিট নেই? টিকিট আমার স্বামীর কাছে আছে। উনি আসুন আগে—

—আমিও তো তাই বলছি, তিনি যতক্ষণ না আসেন-

বাধা দিয়ে সুজাতা বলে, বেশ তো ওঁকে জিজ্ঞাসা করুন না, মিসেস দাশগুপ্তা কোথায়? ঐ গুঁপো ভদ্রলোক কি মিসেস দাশগুপ্তা? ওঁর স্ত্রী কোথায়?

জীবনবাবু সুট করে সরে পড়েন।

কন্ডাকটার গার্ড-এর মনে হল সশরীরের টিকিটধারী ভদ্রলোকের স্ত্রীকে হাজির করতে পারলে হয়তো সমস্যার সুরাহা হবে। সুপ্রিয়কে বলে, ইয়েস, আপনার স্ত্রী কই?

—উনি এখনই আসবেন। টয়লেটে গেছেন।

সুজাতাও গম্ভীর হয়ে বলে, আমার কর্তাও এখনই আসবেন। টয়লেটে গেছেন।

ভিড়ের মধ্যে একজন যাত্রী কন্ডাকটার গার্ডকে বলে, সাতটা পঁচিশ হয়ে গেছে স্যার! জি.আর.পি.-কে ডাকুন। না হলে ট্রেন ছাড়তে দেরি হয়ে যাবে।

সুজাতা মুখ তুলে দেখল বক্তা আর কেউ নয়, কৌশিক মিত্র। ইতিমধ্যে বেশ ভিড় জমে গেছে। একজন পুলিশ অফিসার মুখ বাড়িয়ে বলেন, এনি ট্রাবল?

ইন্সপেক্টরের আবির্ভাবমাত্র অবস্থাটা পালটে গেল। প্রথমেই তিনি ভিড়টা হটিয়ে দিলেন—প্লীজ ক্লিয়ার আউট! ট্রেন এখনই ছাড়বে। যে-যার সিটে গিয়ে বসুন।

তারপর ঘরে ঢুকে তিনি কন্ডাকটার গার্ডের কাছে ব্যাপারটা সংক্ষেপে শুনে সুজাতার বিরুদ্ধেই রায় দিলেন। বললেন, আপনি নেবে আসুন। বোনাফাইড টিকেট-হোল্ডারকে সিট ছেড়ে দিন।

সুজাতা বোঝে আর দেরি করা ঠিক নয়। উঠে দাঁড়ায় সে। লেডিজ হাতব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে নেয়। পুলিশ অফিসার BOAC মার্কা ব্যাগের পেটটা চেপে ধরে নেমে আসেন। সুজাতা বলে, ও ব্যাগটা আমার নয়।

—আই সি! আপনার?—পুলিশ অফিসার প্রশ্ন করে সুপ্রিয়কে।

—হুঁ!—গম্ভীভাবে সুপ্রিয় বলে, অন্য দিকে তাকিয়ে।

পুলিশ অফিসার ব্যাগটা নামিয়ে রাখতে গিয়ে কী ভেবে থেমে পড়েন। বলেন, কী আছে ব্যাগটায়? খুলুন তো?

সুপ্রিয় রুখে ওঠে, কেন বলুন তো?

ইন্সপেক্টর মুখ তুলে একবার তাকায় তার দিকে। তারপর কারও অনুমতির অপেক্ষা না করে খোলা ব্যাগের জিপটা টেনে ফেলে। হাত ঢুকিয়ে কী যেন স্পর্শ করে। পুনরায় বলে, ব্যাগটা আপনার?

সুপ্রিয় খিঁচিয়ে ওঠে, বলছি তো, না! কেন, কী হয়েছে?

ইন্সপেক্টর কন্ডাকটার গার্ডকে বলে, কুইক! গার্ডকে বলুন, গাড়ি যেন না ছাড়ে। সামথিং ফিশি! আমার নাম করে বলুন।

সুপ্রিয়র মুখটা সাদা হয়ে যায়। কৌশিক এবং ঝোলা গোঁফ না-পাত্তা। সুজাতা তখনও কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কন্ডাকটার গার্ড ছুটে বেরিয়ে গেল। ইন্সকেক্টর সুজাতা এবং সুপ্রিয় দুজনের দিকে পর্যায়ক্রমে তাকিয়ে বললে, এই ব্যাগটা কার? আইদার অফ য়ু! বলুন কার?

সুজাতা বললে, আমার নয়। আমি জানি না কার।

সুপ্রিয় বললে, আমি যখন ঘরে ঢুকি তখন ব্যাগটা এখানেই ছিল। উনি তখন ঘরে একা ছিলেন। ফলে ব্যাগটা ওঁর!

ইন্সপেক্টর ধমক দিয়ে ওঠেন। তাহলে তখন কেন বললেন ব্যাগটা আপনার?

—আমি সে কথা বলিনি।—সুপ্রিয় জবাবে জানায়।

—বলেছেন! উনি যখন বললেন ব্যাগটা ওঁর নয়। তখন আমি জিজ্ঞাসা করলাম ‘আপনার?’ আপনি বললেন ‘হুঁ।’ বলেননি?

—আমি তখন অন্যদিকে তাকিয়েছিলাম। দেখিনি, আপনি কোন্ ব্যাগটার কথা জিজ্ঞাসা করছেন। কেন, কী হয়েছে?

ইন্সপেক্টর ওদের দু’জনকে ভালভাবে দেখে নিল একবার। সুজাতাকে বললে, আপনার নাম অঞ্জলি দাশগুপ্তা? ঠিকানা?

সুজাত! অম্লানবদনে বললে, না, আমার নাম সুজাতা মিত্র।

—সুজাতা মিত্র! গুড গুড! তাহলে এতক্ষণ মিথ্যা কথা বলেছিলেন কেন?

—আমি বলব না!

—আই মে হ্যাভ টু অ্যরেস্ট য়ু! — হাত বাড়িয়ে ইন্সপেক্টর দরজাটা বন্ধ করে দেয়। বলে, এ ব্যাগের ভিতর কী আছে জানেন?

হাত ঢুকিয়ে সে বার করে একটা লোডেড রিভলভার!

—কেন এতক্ষণ নিজেকে অঞ্জলি দাশগুপ্তা বলে চালাচ্ছিলেন? বলুন? জবাব দিন?

সুজাতা একটুও ঘাবড়ায় না। তার লেডিজ হ্যান্ড-ব্যাগের জিপটা খুলে ফেলে। একটা ছোট্ট আইডেন্টিটি কার্ড বার করে ইন্সপেক্টরের হাতে দিয়ে বলে, আই রিপ্রেজেন্ট ‘সুকৌশলী’। আমার ক্লায়েন্টের স্বার্থে মিথ্যা কথা বলছিলাম। আমি জানতাম, এই কামরায় আজ একটা বিশ্রী কাণ্ড হতে যাচ্ছে।

ইন্সপেক্টর স্তম্ভিত হয়ে যায়। আইডেন্টিটি কার্ডটা পরীক্ষা করে বলে, ‘সুকৌশলী’! এমন প্রাইভেট ডিটেকটিভ ফার্ম কলকাতা শহরে আছে বলে আমি জানতামই না!

—লালবাজারের সিলটা নিশ্চয় চিনবেন?

কার্ডটা, পকেটে রেখে ইন্সপেক্টর সুপ্রিয়র দিকে ফেরে। বলে, আপনার নাম মিস্টার সুপ্রিয় দাশগুপ্ত তা প্রমাণ করতে পারেন?

—নিশ্চয়ই। স্যুটকেসে আমার লেটার-হেড প্যাড আছে। ভিজিটিং কার্ড আছে।

—স্যুটকেসটা খুলুন!

—তার কি কোনো প্রয়োজন আছে? অলরেডি পাঁচমিনিট লেট হয়ে গেছে ট্রেনটা ছাড়তে!

—আই সে ওপন ইয়োর স্যুটকেস।

সুপ্রিয় রুমাল দিয়ে মুখটা মুছল। তারপর বেঞ্চের নিচ থেকে টেনে বার করল স্যুটকেসটা। চাবি দিয়ে স্যুটকেসের ডালাটা খুলল। ওর হাত রীতিমতো কাঁপছে। অতি সন্তর্পণে সে জামা-কাপড়ের নিচে হাত চালিয়ে লেটার-হেড প্যাডটা খুঁজতে থাকে। স্যুটকেসের উপর চাপা দেওয়া ছিল একটা নতুন তোয়ালে। হঠাৎ ক্ষিপ্র হাতে ইন্সপেক্টর তুলে ফেলল সেই তোয়ালেটা।

তার নিচে থাক দেওয়া দশটাকার নোট! এক স্যুটকেস বোঝাই!

—মাই গড! কত টাকা আছে ওখানে?

একটা ঢোক গিলে সুপ্রিয় বললে, এক লাখ টাকা।

—সব দশ টাকায়?

—হুঁ!

—বাক্সটা বন্ধ করুন!

আদেশ পালন পরে সুপ্রিয়।

ইন্সপেক্টর সুজাতার দিকে ফিরে বলেন, আপনি জানতেন, উনি একলাখ টাকা নগদে এবং দশটাকার নোটে নিয়ে যাচ্ছেন?

—না! আমার ইনফর্মেশান ছিল উনি দু-লাখ টাকা নগদে এবং দশটাকার নোটে নিয়ে যাচ্ছেন।

—আই সি!—ইন্সপেক্টার ঘুরে দাঁড়ায় সুপ্রিয়র মুখোমুখি, এ টাকা কোন্ ব্যাঙ্ক থেকে তুলেছেন?

—ব্যাঙ্ক থেকে তুলিনি।

—ব্ল্যাক-মানি?

সুপ্রিয় মাথা নাড়েনেতিবাচক।

—মিস্টার দাশগুপ্ত, আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে বলছেন যে, নগদ এক লাখ টাকা আপনি দশটাকার নোটে নিয়ে যাচ্ছেন—উইথ এ লোডেড রিভলভার—

—ওটা আমার নয়।

—আয়াম সরি! য়ু আর আন্ডার অ্যারেস্ট! নেমে আসুন আপনি!

আবার রুখে উঠে সুপ্রিয়, আপনি-আপনি এভাবে আমাকে গ্রেপ্তার করতে পারেন না। আমি বোনাফাইড প্যাসেঞ্জার! আমি হিউজ কম্পেন্সেশন ক্লেম করব।

—করবেন! তার আগে আপনাকে প্রমাণ করতে হবে ওটা ব্ল্যাক-মানি নয়। নেমে আসুন আপনি! না হলে কিন্তু আমি আপনাকে হ্যান্ডকাফ দিয়ে মাজায় দড়ি বেঁধে প্ল্যাটফর্ম দিয়ে নিয়ে যাব!

কাঁপতে কাঁপতে নেমে এল সুপ্রিয়। পাশের কেবিন থেকে জীবন বিশ্বাস। সুজাতা মুখ তুলে দেখল, কৌশিকও নেমে পড়েছে ট্রেন থেকে। অগত্যা সেও নামল।

দশ মিনিট দেরিতে অনুমতি পেয়ে গুডফ্রাইডের সন্ধ্যায় রওনা হল বোম্বাই মেল। তার চার-চারটে ফার্স্ট ক্লাস বার্থ খালি!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *