মাছি – অনুবাদক: কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়

মাছি

গ্রামের নীচেকার খাড়াই খড়ি-পাথরের পাহাড় বেয়ে দু’টি যুবক উঠছিল। লোহার কাঁটা-লাগানো বুটগুলো পিছলে যাচ্ছিল বলে হাত আর পা দুই-ই তাদের ব্যবহার করতে হচ্ছিল। খুব তাড়াতাড়ি ওঠার জন্যে দম প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল তাই হাঁপাতে-হাঁপাতে পিছল পথটাকে গালাগালি করছিল তারা। গ্রামের প্রবেশ-পথের সামনেই ছোট একটা কুয়ো। তার চারপাশে একদল মেয়ে গল্প করছিল। পাহাড়ের পাশ দিয়ে তাদের দু’জনের টকটকে লাল দুটো মুখ দেখা যেতেই মেয়েরা ঘাড় ফিরিয়ে চাইল, ওরা সেই দু’ ভাই নয়তো? তাই তো, নেলি আর সারো তরতোরিচি! আহা বেচারারা! কিন্তু এই ব্যস্ততার কারণটা কী?

ছোট ভাই নেলির আর এক পা নড়বার ক্ষমতাও ছিল না। মেয়েদের কথার জবাব দেবার জন্যে এবং একটু দম নেবার জন্যে সে দাঁড়াল। সারো কিন্তু তার হাত ধরে হিড়হিড় করে নিয়ে চলল টেনে।

যাবার সময় নেলি বলে গেল, ‘জুইরলাননু জারুর কথা বলছিলুম— সম্পর্কে আমাদের ভাই!’ হাত দুটো উপরে তুলল সে, যেন প্রার্থনা করল ঈশ্বরের কাছে।

আতঙ্ক ও ভয়-মেশানো সুরে মেয়ের দল আর্তনাদ করে উঠল। তাদের একজন প্রশ্ন করল, ‘কে করেছে এ কাজ?’

‘কেউই না। ভগবানের মার!’ দূর থেকে চেঁচিয়ে বলল নেলি। চাঁদনিচকে গ্রামের ডাক্তারের বাড়ি। তারা ব্যস্তভাবে সেদিকে এগিয়ে গেল। পায়ে একজোড়া পুরনো চটি, শার্টের বোতামগুলো খোলা আর আস্তিন দুটো গুটোনো— এই অবস্থায় ডাক্তার সিদোলো লপিচ্চোলো ঘরময় পায়চারি করছে। ঘুমের অভাবে চোখ দুটো ফোলা-ফোলা আর জলে ভারী। তার ফোলা গালের উপর অন্তত দশ দিনের দাড়ি জমেছে। প্রায় বছর নয়েকের একটি মেয়ে তার কোলে, একেবারে কঙ্কালসার। ভুগে ভুগে তার রং হলদেটে হয়ে গেছে।

গত এগারো মাস ধরে স্ত্রী তার একেবারে শয্যাশায়ী। যে মেয়েটি কোলে ছিল তাকে বাদ দিয়ে এ সংসারে আরও ছ’টি ছেলেমেয়ে। মেয়েটিই বড়। ছেলেগুলো যেমন দুরন্ত তেমনি নোংরা। বাড়িটাও অসম্ভব অগোছালো— মেঝেয় কাচের বাসনের টুকরো, ফলের খোসা আর রাশি রাশি ময়লা, চেয়ারগুলো ভাঙা, আরামকেদারার বসার জায়গাগুলোয় গর্ত, কে জানে কতদিন বিছানা পাতা হয়নি, বিছানার চাদরগুলোও কুটিকুটি হয়ে এসেছে। এর কারণ আর কিছুই নয়— বাচ্চা শয়তানগুলো বিছানার উপর বালিশ নিয়ে লড়াই-লড়াই খেলে!

কোনও-একদিন যেটা বসার ঘর ছিল তার দেয়ালের উপরকার শুধু একটি ছবি এখনও অক্ষত। ডাক্তার সিদোলো লপিচ্চোলো ডিপ্লোমা পাবার কিছুদিনের মধ্যেই একটি ছবি তোলা হয়েছিল। তখন সে তরুণ। সেই ছবিটাকেই বড় করে এখানে ঝোলানো হয়েছে। ছবিতে তাকে দেখাচ্ছিল পরিপাটি, এমনকী শৌখিন, খুব ফুর্তিবাজ আর হাসিখুশি।

চটি ফটফট করে ছবিটার কাছে গিয়ে ভেংচি কেটে মেয়েটিকে তুলে ধরে বলল, ‘দেখলে তো সিসিনে।’

‘সিসিনে’ তার ডাকনাম। অনেক, অনেকদিন আগে খ্যাপাতে চাইলে মা তাকে ওই নামে ডাকত। তার মা-র আদুরে-ছেলে ছিল সে। অনেক আশা করা হয়েছিল তার উপর। সবাই ভেবেছিল ভবিষ্যৎ তার উজ্জ্বল।

চাষি দু’জনকে দেখে প্রায় খ্যাপা কুকুরের মতো সে তেড়ে গেল।

‘কী দরকার তোমাদের?’

হাতে টুপি নিয়ে তখনও হাঁপাতে হাঁপাতে সারো তরতোরিচি বলল, ‘ডাক্তারবাবু, আমাদের এক ভাই— আহা বেচারা— প্রায় মরতে বসেছে।’

‘ছোকরার কপাল ভাল বলতে হবে! উৎসবের ব্যবস্থা করেছ?’ চেঁচিয়ে উঠল ডাক্তার।

‘না-না ডাক্তারবাবু… সে মরতে বসেছে… হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ল… কী যে অসুখ কিছুই বুঝছি না। মন্তেলুসায় এক আস্তাবলে পড়ে রয়েছে।’

এক পা পিছিয়ে ভীষণ রেগে ডাক্তার বলল, ‘মন্তেলুসায়? হা ভগবান!’ সে জানে পথ ধরে গেলে জায়গাটা গ্রাম থেকে পাকা সাত মাইল— আর সে কী পথ!

‘আজ্ঞে হ্যাঁ। দোহাই আপনার, যত শিগগির হয় আসুন।’ অনুনয় করে বলল তরতোরিচি। ‘মেটুলির মতো সে কালো হয়ে গেছে আর এমন ফুলেছে যে দেখলে ভয় করে। দোহাই আপনার, আসুন।’

‘কী! হেঁটে যেতে হবে নাকি?’ আবার চিৎকার করে উঠল ডাক্তার, ‘পায়ে হেঁটে দশ মাইল? মাথা খারাপ নাকি? একটা খচ্চরের ব্যবস্থা করো, বুঝলে? তোমাদের খচ্চর নেই?’

‘আমি দৌড়ে গিয়ে এখুনি জোগাড় করছি,’ তাড়াতাড়ি তরতোরিচি উত্তর দিল। ‘কারুর কাছ থেকে ধার করে আনছি।’

ছোট ভাই নেলি বলল, ‘আমি ততক্ষণ তাড়াতাড়ি দাড়িটা কামিয়ে আসি।’

এমনভাবে ডাক্তার তাকাল যে পারলে তাকে এখুনি গিলে ফেলে!

‘আজ রোববার কিনা ডাক্তারবাবু,’ অপ্রস্তুত হয়ে নেলি জানাল, ‘আর আমার বিয়ের কথাটা পাকা হয়ে গেছে কিনা…’

রাগে আত্মবিস্মৃত হয়ে ডাক্তার বলল, ‘বটে! তুমি বিয়ে করতে যাচ্ছ? ধরো তা হলে এটাকে।’

বলে রুগ্ন মেয়েটাকে তার কোলে গুঁজে দিল। তারপর অন্য ছেলে-মেয়েদের, যারা ভিড় করে দাঁড়িয়েছিল, এক-এক করে তার দিকে ছুড়ে দিতে দিতে চিৎকার করতে লাগল, ‘আর এটাকে,’ ‘আর এটাকে’, ‘আর এটাকে,’ ‘আর এটাকে’… ‘গর্দভ কোথাকার,’ শেষে আবার বলল, ‘গর্দভ কোথাকার।’

যেন চলে যাবার জন্যেই সে ঘুরে দাঁড়াল, তারপর ফিরে এসে রুগ্ন মেয়েটাকে আবার কোলে নিয়ে তাদের বললে, ‘দৌড়ে একটা খচ্চর জোগাড় করে আনো। এখুনি যাব।’

তার ভাইয়ের পিছন-পিছন সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে নেলি তরতোরিচি আবার হাসতে লাগল। তার নিজের বয়স কুড়ি, আর আলুৎসার, যার সঙ্গে বিয়ের ঠিক হয়েছে, বয়স ষোলো। ভারী সুন্দরী সে। সাতটা ছেলেমেয়ে? তা-ও যথেষ্ট নয়। সে চায় বারোটা, পুরো এক ডজন! অবশ্য এ কথা সত্যি যে ঈশ্বরদত্ত সবল দুটো হাত ছাড়া তাদের জীবিকা উপার্জনের আর কোনও উপায়ই নেই, কিন্তু হাসিমুখে যে-কোনও কাজ করতে সে প্রস্তুত। তার দুটো জিনিস ভাল লাগে— কাস্তে চালাতে আর গান গাইতে। কাজ করতে করতে গান বাঁধতে পারে বলে লোকে তাকে ‘লায়লা’ (কবি) বলে ডাকে। পরোপকারী আর সর্বদা হাসিখুশি বলে সবাই যে তাকে পছন্দ করে— এ কথাটাও সে জানে। সব সময়েই সে হাসে, সবাইকেই বিলোয় তার হাসি— এমনকী আকাশ-বাতাসকেও। রোদে পুড়ে এখনও তার চামড়া তামাটে হয়নি। তার একমাথা কোঁকড়ানো গাঢ় সোনালি রঙের চুল দেখে মেয়েরা পর্যন্ত হিংসে করে। উজ্জ্বল নীল চোখ মেলে একটি বিশেষ ভঙ্গিতে সে তাকাতে জানে। সেই চাউনির সামনে কত মেয়ে যে লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠেছে তার ঠিক নেই!

তার দূর-সম্পর্কের ভাই জারুর অসুখে সে দারুণ ঘাবড়ে পড়েছে। আরও দুর্ভাবনা হয়েছে লুৎসার জন্যে। মেয়েটা নিশ্চয়ই বেজায় চটে থাকবে— বেচারা দু’দিন ধরে এই রবিবারের জন্যে কীভাবেই না অপেক্ষা করে আছে। আজকের দিনে অন্তত কয়েক ঘণ্টার জন্যেও তো তারা একসঙ্গে থাকতে পেত। কিন্তু কী করেই বা সে কিছু না-করে চুপচাপ থাকতে পারে? তা হলে যে পাপ হবে! বেচারা জুইরলাননু জারু। তারও বিয়ের কথা পাকা হয়ে গিয়েছিল— আর একেবারে হঠাৎ কিনা তার মাথায় এই বাজ ভেঙে পড়ল! মন্তেলুসায় লোপেসের জমিতে গাছ ঝাঁকিয়ে বাদাম পাড়ার কাজে সে বহাল ছিল। তার আগের দিনটা ছিল শনিবার। হঠাৎ আকাশটা মেঘে ভারী হয়ে এল। তাই বলে শিগগিরই যে বৃষ্টি হবে এমন মনে হল না। দুপুরের দিকে লোপেস কিন্তু বলল, ‘ওহে ছোকরারা শুনছ, ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই দেবতা জল ঢালতে শুরু করবে। বাদামগুলোকে ভিজে জমিতে ফেলে রাখতে চাই না। বাদাম-পাড়া থামাও।’

যে মেয়েরা ফলগুলো জড়ো করছিল তাদের ডেকে সে আদেশ দিলে পাহাড়ের পাশের গুদামে গিয়ে খোসা ছাড়াবার কাজে লাগতে। যেসব পুরুষরা গাছ থেকে বাদাম পাড়ছিল, সে দলে নেলি আর সারো তরতোরিচিও ছিল। তাদের দিকে ফিরে সে জানাল, ‘ইচ্ছে হলে তোমরাও মেয়েদের সঙ্গে গিয়ে খোসা ছাড়াতে পারো।’

উত্তরে জুইরলাননু জারু বলল, ‘আমি যাব বটে, কিন্তু রোজকার মজুরি পঁচিশ সলদো আমাকে দিতে হবে।’

‘না, শুধু আধ-দিনের জন্যে ওই হিসেবে পাবে, বাকি আধ-দিনের জন্যে মেয়েরা যেমন আধ লিরা পায়, সেই হিসেবে দেব।’

ঘোর অবিচার, সন্দেহ নেই! পুরুষরা নিজেদের কাজ করে পুরো দিনের যে মাইনে পায় তা কেন সে পাবে না তার কোনও সংগত কারণ নেই। আর সত্যিই, এদিকে দিনে তো বৃষ্টি হল না, এমনকী রাত্রেও না।

‘এক দিনে আধ লিরা এই হিসেবে আপনি মাইনে দেবেন?’ চিৎকার করে উঠল জুইরলাননু জারু। ‘বেশ, ভাল! কিন্তু কাজ আমি করব না। আমি পুরুষের পোশাক পরি, মেয়েদের ঘাঘরা তো আর পরি না! এক দিনে পঁচিশ সলদো এই হিসেবে আমার আধ-দিনের মাইনে চুকিয়ে দিন। আমি চললুম।’

সে অবশ্য গেল না, তার ভাইদের জন্যে সন্ধে পর্যন্ত অপেক্ষা করে রইল। এক দিনে আধ লিরা এই হিসেবে মেয়েদের সঙ্গে খোসা ছাড়াবার কাজ করতে তারা রাজি হয়েছিল। দাঁড়িয়ে দেখতে আর অপেক্ষা করতে করতে অল্পক্ষণেই তার বিরক্তি ধরে গেল তাই কাছাকাছি এক আস্তাবলে গিয়ে সে রইল ঘুমিয়ে। সঙ্গীদের সে বলে গিয়েছিল ফেরার সময় তাকে যেন ডেকে নিয়ে যায়।

মাত্র দেড় দিন ধরে তারা বাদাম-গাছ ঠেঙিয়েছিল বলে ফল অল্পই জড়ো হয়েছিল। মেয়েরা তাই প্রস্তাব করল সন্ধের দিকে কিছু বেশি কাজ করে, বাকি রাতটা সেখানেই কাটিয়ে পরের দিন রাত থাকতে উঠে গ্রামে ফিরে যাবে। এ প্রস্তাবে সবাই রাজি হল। তাদের জন্যে লোপেস এক গামলা বরবটি আর কয়েক বোতল মদ দিল আনিয়ে। মাঝরাতে কাজ শেষ হবার পর খামারের খোলা জমিতে স্ত্রী-পুরুষ সবাই শুয়ে পড়ল। শিশিরে তখন খড়গুলো ভিজে, যেন সত্যি-সত্যিই এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে!

‘লায়লা, আমাদের গান শোনাও!’

আর নেলি গানের পর গান বেঁধে চলল। চাঁদটা এলোমেলো মেঘে কখনও ঢাকা পড়ছে, কখনও মেঘ থেকে বেরিয়ে আসছে, কখনও সাদা, কখনও কালো সেই মেঘ। চাঁদটা যেন তার লুৎসার মুখ, তাদের প্রেমের আনন্দ আর বেদনার মতো কখনও যেন হাসছিল, কখনও আসছিল কালো হয়ে।

জুইরলাননু জারু সেই আস্তাবলেই পড়ে ছিল। ভোর হবার আগে তাকে জাগাতে গিয়ে সারো দেখল সে জ্বরে বেহুঁশ হয়ে পড়ে রয়েছে আর তার সমস্ত শরীর ফুলে উঠেছে কালো হয়ে।

নাপিতের দোকানে বসে নেলি তরতোরচি এই গল্পটাই বলছিল। গল্পটা শুনতে শুনতে উত্তেজিত হয়ে নাপিত তার থুতনির কাছে খানিকটা কেটে ফেলল। ছোট্ট একটুখানি ক্ষত, মাথা ঘামাবার মতো কিছুই নয়। সেই মুহূর্তে দরজায় দেখা গেল লুৎসাকে, সঙ্গে তার মা আর মিতা লুমিয়া— ফলে লোকটার অসাবধানতা সম্বন্ধে অভিযোগ করার সময় পর্যন্ত সে পেল না। জুইরলাননু জারুর সঙ্গেই মিতা লুমিয়ার বিয়ের ঠিক হয়েছিল। বেচারি তখন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল নিজের পোড়াকপালের কথা ভেবে।

মেয়েটি তার ভাবী স্বামীকে দেখবার জন্যে মন্তেলুসায় যাবে বলে বায়না ধরল। বহু কষ্টে নেলি নিরস্ত করল তাকে। মেয়েটিকে কথা দিল সন্ধের আগেই তাকে দেখতে পাবে— যেমন করেই হোক তাকে নিয়ে আসবার ব্যবস্থা করবে তারা। সেই মুহূর্তে ব্যস্ত হয়ে সারো এসে জানাল ডাক্তার রওনা হচ্ছে। আর এক মুহূর্তও সে দেরি করতে রাজি নয়। লুৎসাকে একপাশে নিয়ে গিয়ে নেলি তাকে অনুনয় করে বলল ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে রাত্রির— আগেই সে ফিরবে, তাকে কত কথাই না তার বলার আছে…

বাস্তবিক জঘন্য রাস্তাটা। কয়েকটা গভীর খাদের ধার দিয়ে যাবার সময় ডাক্তার লপিচ্চোলো জীবনের আশাই প্রায় ছেড়ে দিয়েছিল, যদিও লাগাম ধরে তার একপাশে ছিল সারো, অন্য পাশে নেলি। নীচে শস্যখেত, জলপাই আর বাদামের বাগান-ভরা বিরাট মালভূমি-উপত্যকা। ফসলের গোড়াগুলো হলদে, মাঝে মাঝে খানিকটা জমির রং কালো— সার তৈরির জন্যে সেখানে আবর্জনা পোড়ানো হয়েছে। অনেক দূরে সমুদ্র দেখা যায়, কটকটে নীল তার রং। তুঁত, ঝাউ, জলপাই আর অ্যাকেশিয়া গাছের ফিকে গাঢ় নানা ধরনের চির-সবুজ রং চোখে পড়ে, বাদাম গাছের চুড়োগুলো কিন্তু ইতিমধ্যেই পাতলা হতে আরম্ভ করেছে। তাদের চারদিকে দিগন্ত-বিস্তৃত মস্ত পাহাড়ের মতো বাতাসে-উড়ে-আসা মেঘ। কিন্তু বাতাস থাকা সত্ত্বেও অসহ্য গরম। রোদে ফেটে যাচ্ছে পাথরগুলো। মাঝে মাঝে ধুলোয় ঢাকা ফণিমনসা ঝাড়ের ওপাশ থেকে ভারুই আর নীলকণ্ঠ পাখির পরিষ্কার ডাক কানে আসে। শব্দ শুনে খচ্চরটা ভয়ে কান খাড়া করে উঠল।

‘ভারী পাজি জানোয়ার! ভারী পাজি!’ হুংকার দিয়ে উঠল ডাক্তার। এক দৃষ্টিতে সে চেয়ে রইল জানোয়ারটার মাথার দিকে। সবুজ কাপড়ের ছাতাটা কাঁধ থেকে ক্রমশ সরে যাওয়ায় তার মুখে রোদ এসে পড়ল। তবু সেদিকে তার খেয়াল নেই।

তারা দু’ ভাই সাহস দেবার জন্যে বলল, ‘আপনি ভয় পাবেন না। আমরা তো রয়েছি।’

নিজের জন্যে ডাক্তারের অতটা ভয় ছিল না— কিন্তু বাচ্চা-কাচ্চাক’টার কথা ভেবেই সে ভয় পেল। ওই সাতটা অসহায় জীবনের জন্যেই তার নিরাপদে থাকা দরকার।

তাকে ভুলিয়ে রাখার জন্যে দু’ ভাই গল্প জুড়ল। ফসলের কথাই তারা পাড়ল: গম আর বরবটি কীরকম অল্প হয়েছে এবার— আর বাদাম গাছের কথা তো সবাই জানে, এ বছর তো কিছুই ফলেনি— এক বছর অন্তর তাদের ভাল ফসল হয়। আর জলপাই! জলপাইয়ের কথা না বলাই ভাল— এ বছরের গোড়ায় কুয়াশা লেগে তার বাড় বন্ধ হয়ে গেছে, বড় হতে পারেনি। চাষিরা আঙুর দিয়ে যে তাদের লোকসান পুষিয়ে নেবে সে আশাও নেই, সে অঞ্চলের প্রত্যেকটা আঙুর গাছকেই কী এক রোগে ধরেছে…

‘কী সুন্দর ভবিষ্যৎ!’ মাঝে মাঝে মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে ডাক্তার শুধু বলতে লাগল।

দু’ ঘণ্টা হাঁটবার পর বলার মতো সব কথা শেষ হল। এখান থেকে অনেকটা পথ সোজা চলে গেছে— পুরু সাদা ধুলোয় ঢাকা। খচ্চরের খুরের শব্দের সঙ্গে চাষি দু’জনের লোহার নাল লাগানো বুটের শব্দ মিশতে লাগল। নিজের মনেই লায়লা গান ধরল, কিন্তু থামল চট করে। কোনওদিকে জনমানবের দেখা নেই। রবিবার বলে চাষিরা সব উপরের গ্রামে রয়েছে। কেউ বা গির্জেয় যাবে, কেউ বা কেনাকাটা সারবে, কেউ বা করবে ফুর্তি। মন্তেলুসায় সম্ভবত জুইরলাননু জারুর কাছে কেউই নেই। কে জানে এখনও সে বেঁচে আছে কি না। সম্ভবত তাকে মৃত্যুর মুখে একা রেখে সবাই চলে গেছে…

আর সত্যিই দেখা গেল সেই দুর্গন্ধময় আস্তাবলের দেয়ালের পাশে একলা পড়ে আছে সে, সারো আর নেলি যেমনটি তাকে রেখে গিয়েছিল ঠিক তেমনি অবস্থায়। সর্বাঙ্গ ভীষণ ফুলেছে, মুখ দেখে আর চেনবার জো নেই। শব্দ করে অতি কষ্টে নিশ্বাস নিচ্ছে। খড় রাখবার তাকের পাশের জানলা দিয়ে রোদ এসে তার মুখে পড়েছে, সে মুখ কোনও মানুষের বলে মনে হয় না। সমস্তটা এত ফুলেছে যে নাকটা আর দেখাই যায় না; ঠোঁট দুটো কালো আর সাংঘাতিক ফোলা। সেই ঠোঁট দুটোর ভিতর দিয়ে খাবি খাবার মতো করে নিশ্বাস পড়ছিল। শব্দ শুনলে মনে হয় যেন রেগে গর্জন করছে। একটুকরো খড় তার কালো কোঁকড়ানো চুলে আটকে গিয়ে রোদে ঝকঝক করছে।

তাকে দেখে কয়েক মুহূর্তের জন্যে তারা তিনজন দরজায় থমকে দাঁড়াল। যেন আতঙ্কে অবশ হয়ে গেছে। খচ্চরটা আস্তাবলের গা ঘেঁষে মেঝের উপর খুর ঠুকে নাকের ভিতর দিয়ে শব্দ করতে লাগল। তারপর সারো তরতোরিচি মরণাপন্ন লোকটির কাছে গিয়ে সস্নেহে বলল, ‘জুইরলা! জুইরলা! এই দেখো ডাক্তার এসেছে!’

নেলি জানোয়ারটাকে খড়-রাখার তাকের কাছে বাঁধবার জন্যে নিয়ে গেল। দেয়ালে একটা দাগ, যেন আরেকটা জন্তুর ছায়া—সাধারণত যে গাধাটাকে এখানে বেঁধে রাখা হয় এটা তারই— সারাদিন সে দেয়ালের চুনে গা ঘষে।

জারুকে জাগাবার চেষ্টা আর-একবার করা হল।

হাঁপানি থামিয়ে কোনওরকমে চোখ মেলল সে। আতঙ্কে ভরা তার চোখ দুটো টকটকে লাল, চারদিকে কালো রেখা। বীভৎস মুখটা হাঁ করে সে ঘড়ঘড় শব্দ করতে লাগল, মনে হল তার স্বর বুঝি গলার কাছে এসেই বন্ধ হয়ে যাবে।

‘আমি… মরে গেলাম…’

‘না, না,’ আর্ত স্বরে তাড়াতাড়ি জবাব দিল সারো। ‘এই দেখো ডাক্তার তোমাকে দেখতে এসেছেন। আমরা তাঁকে নিয়ে এসেছি। তাঁকে দেখতে পাচ্ছ?’

মুমূর্ষু জারু কাতর স্বরে বলল, ‘গ্রামে… নিয়ে চলো… ও মা, মাগো…’

বহু কষ্টে হাঁপাতে-হাঁপাতে কথাগুলো সে বলল। দুটো ঠোঁট এক করতে পারল না।

‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই আমরা নিয়ে যাব। আমরা একটা খচ্চর এনেছি। এই দেখো,’ দ্রুতস্বরে জানাল সারো।

‘তোমাকে আমি কোলে করে নিয়ে যেতে পারি জুইরলা,’ তার পাশে তাড়াতাড়ি এসে ঝুঁকে পড়ে নেলি বলল। ‘ভয় পেয়ো না তুমি সেরে উঠবে।’

নেলির স্বর শুনে জুইরলাননু জারু ধীরে ধীরে মাথা ফিরিয়ে টকটকে চোখে স্থিরভাবে তার দিকে তাকিয়ে রইল। মনে হল প্রথমে তাকে চিনতে পারেনি। তারপর হাত বাড়িয়ে তার ভাইয়ের কোমরে বাঁধা সিলকের রুমালটা মুঠো করে ধরল।

‘আরে কে… তুমি নাকি?’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি। আমি নেলি। কিছু ভেবো না। কেঁদো না জুইরলা, কেঁদো না।… তোমার কিছুই হয়নি।’

রোগীর বুকের উপর সে হাত রাখল। জারু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে লাগল কাঁদতে, কিন্তু গলা দিয়ে কোনও স্বর বেরুল না। কয়েক মুহূর্ত ধরে নিষ্ফল চেষ্টা করে সে অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে মাথা ঝাঁকানি দিল, শেষটায় এক হাত বাড়িয়ে নেলির ঘাড়টা ধরে নিজের কাছে টেনে আনল।

‘আমাদের একই দিনে বিয়ে হবার কথা ছিল…,’ সে বলল।

তার গলা থেকে হাতটা খুলতে খুলতে নেলি উত্তর দিল, ‘নিশ্চয়ই একই সঙ্গে আমাদের বিয়ে হবে, তাতে কোনও ভুল নেই।’

ইতিমধ্যে ডাক্তার রোগীকে পরীক্ষা করছিল। অসুখটা যে গ্ল্যান্ডার্স, সে বিষয়ে তার কোনও সন্দেহ রইল না। ‘আচ্ছা বলো তো,’ সে প্রশ্ন করল, ‘কোনও পোকামাকড়ে কামড়েছে বলে কি মনে পড়ছে?’

জারু মাথা নাড়ল। ‘পোকামাকড়?’ প্রশ্ন করলে সারো।

সেই দুই নিরক্ষর চাষিদের ডাক্তার তার সাধ্যমতো ব্যাপারটা বোঝাল। নিশ্চয়ই কাছাকাছি কোনও জানোয়ার গ্ল্যান্ডার্স রোগে মরেছে আর তার মৃতদেহটা কোনও খানায় ফেলা হয়েছে। অসংখ্য মাছি এসে বসেছে তার উপর। সেই মাছিগুলোর মধ্যে একটা উড়ে এসে জারুর দেহে ওই রোগের বিষ ছড়িয়ে দিয়েছে।

ডাক্তারের বোঝাবার সময় জারু দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে রইল। তারা কেউ জানলও না যে মৃত্যুর বাহনটি সারাক্ষণ সেখানেই রয়েছে। এত ছোট যে প্রায় দেখাই যায় না। সে আর কেউ নয় কাছের দেওয়ালে বসে-থাকা ছোট্ট একটা মাছি। এমনিতে মনে হয় বুঝি চুপচাপ বসে আছে কিন্তু কাছে গিয়ে ভাল করে লক্ষ করলে চোখে পড়ে মাঝে মাঝে সে তার ছোট্ট শুঁড়টা বার করে চুষছে, নয় তো সামনের পা দুটো বেশ তৃপ্তির সঙ্গে ঘষে চটপট পরিষ্কার করে ফেলছে।

ডাক্তার তখনও কথা বলছিল, হঠাৎ মাছিটাকে জুইরলাননু দেখতে পেল। এক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইল সে।

একটা মাছি… হয়তো এটাই, হয়তো নয়— কে জানে? এখন তার মনে পড়ছে বটে কাল যখন বসে বসে ভাবছিল লোপেসের বাদামের খোসা ছাড়িয়ে কতক্ষণে তার ভাইরা আসবে, একটা মাছি তখন ভারী বিরক্ত করেছিল তাকে… সেটাই কি?

হঠাৎ মাছিটাকে সে উড়ে যেতে দেখল। চোখ ফিরিয়ে সে লক্ষ করতে লাগল কোথায় সেটা যায়।

ওই যা! সেটা যে নেলির গালে বসল। গাল থেকে নিঃশব্দে গোটা দুই ক্ষিপ্র লাফ মেরে থুতনির উপর, তারপর নাপিতের ক্ষুরে যেখানটায় কেটে গিয়েছিল, ঠিক সেখানে বসে পেটুকের মতো খেতে লাগল।

অত্যন্ত মন দিয়ে সেটাকে দেখতে দেখতে জুইরলাননু জারু গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন হল। তারপর বহু কষ্টে কথাগুলো উচ্চারণ করে মুমূর্ষু স্বরে প্রশ্ন করল, ‘একটা মাছি?… একটা মাছির পক্ষে এটা সম্ভব…?’

‘নিশ্চয়ই, কেন একটা মাছি পারবে না?’ উত্তরে বলল ডাক্তার।

আর কোনও কথা না বলে জুইরলাননু জারু মাছিটাকে দেখতে লাগল।

এদিকে ডাক্তারের কথায় নেলি এমন তন্ময় হয়ে ছিল যে মাছিটাকে তাড়াবার কোনও চেষ্টাই করল না। জারু আর শুনল না। ডাক্তার যে ক্রমাগত কথা বলে যাচ্ছে, এতে সে খুশি হয়ে উঠেছে। কারণ নেলি পাথরের মূর্তির মতো নিঃস্পন্দ হয়ে তার কথা শুনছে, তার সমস্ত মন পড়ে আছে সেই কথার দিকে। ফলে মুখের উপরকার মাছিটাকে সে লক্ষই করছে না। কী মজা! এবারে সত্যিই তাদের বিয়ে হবে একসঙ্গে…। তার তরুণ ভাইয়ের নিটোল স্বাস্থ্য আর রঙিন ভবিষ্যৎ দেখে একটা গভীর ঈর্ষা আর ভোঁতা বিদ্বেষে ভরে উঠেছিল তার মন— কেবলই মনে হচ্ছিল এই সুন্দর জীবন অকস্মাৎ যেন তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে।

শেষে এক সময় নেলির মনে হল যেন কিছু একটা তাকে কামড়াচ্ছে। হাত তুলে মাছিটাকে সে তাড়িয়ে দিল, তারপর থুতনির যেখানটা কেটে গিয়েছিল সেখানটা টিপতে লাগল। জারুর দিকে ফিরে দেখল একদৃষ্টিতে তার দিকে সে তাকিয়ে আছে। রুগ্ন লোকটির বীভৎস ঠোঁট দুটো এক বিশ্রী হাসিতে কুঁকড়ে উঠতে দেখে তার একটু অস্বস্তিই হল। কিছুক্ষণ তারা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইল; তারপর, যেন নিজের অনিচ্ছাতেই জারু বলে ফেলল, ‘ওই মাছিটা…’

নেলি বুঝল না। তার মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে প্রশ্ন করল, ‘কী বললে?’

‘ওই মাছিটা…’ জারু আবার বলল।

‘কোনটা? কোথায়?’ আতঙ্কিত হয়ে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে নেলি প্রশ্ন করল।

‘ওই যে ওখানটায়… যেখানটায় তুমি ঘষছ।… ওটা যে মাছি— আমি দেখলুম ওটা মাছি’ —বলে জারু বীভৎসভাবে হাসতে লাগল।

ডাক্তারকে নেলি তার থুতনির কাটা জায়গাটা দেখাল।

‘এখানটায় কী হয়েছে বলুন তো? ভীষণ জ্বলছে…’

জায়গাটা ভাল করে পরীক্ষা করে ডাক্তার যেন বেশ ভয়ই পেয়ে গেল। তারপর আরও ভাল পরীক্ষা করবার জন্যেই যেন নিয়ে গেল বাইরে। সারো চলল তাদের পিছনে।

তারপর কী হল? গভীর উৎকণ্ঠায় কাঁপতে কাঁপতে জুইরলাননু জারু অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে রইল, কিন্তু কিছুই জানতে পারল না। অস্পষ্টভাবে সে শুনতে লাগল বাইরেকার কথাবার্তা। হঠাৎ ব্যস্তভাবে সারো ঘরে ঢুকে জুইরলার দিকে না তাকিয়েই খচ্চরটাকে খুলে তাড়াতাড়ি আবার বেরিয়ে গেল। সে বিড়বিড় করছিল, ‘হা ভগবান! আমার নেলি… আমার ছোট্ট নেলি…’

তা হলে সত্যিই তাই! তারা তাকে কুকুরের মতো মৃত্যুর মুখে একা ফেলে চলে গেল! কোনওরকমে কনুইতে ভর দিয়ে উঠে দু’বার সে ডাকল, ‘সারো… সারো…’

সব চুপ। কোথাও কেউ নেই।

নিজেকে আর সে কনুইয়ের উপর ভর দিয়ে খাড়া রাখতে পারল না, মেঝের উপর পড়ল আছড়ে। গ্রামের এদিকটা যে কীরকম নিস্তব্ধ হয়ে গেছে সেটা যাতে লক্ষ করতে না হয় সেজন্যে কিছুক্ষণ সে খড়ের বিছানায় মুখ গুঁজে পড়ে রইল—কী ভয়ংকর স্তব্ধতা! হঠাৎ তার সন্দেহ হল সমস্ত ব্যাপারটাই একটা দুঃস্বপ্ন নয়তো? জ্বরের ঘোরে সে স্বপ্ন দেখছে না তো? কিন্তু দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে আবার সেই মাছিটাকে সে দেখতে পেল, একই জায়গায় আবার সে এসে বসেছে।

ঠিক, ঠিক! ওই তো ওখানেই রয়েছে ওটা।…

মাঝে মাঝে তার ছোট্ট শুঁড়টা বের করে সে চুষছে, নয়তো তার সামনের পা দুটো বেশ তৃপ্তির সঙ্গে ঘষে ঘষে চটপট পরিষ্কার করে ফেলছে।

কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *