মাছগুলো কোথায় পালিয়ে গেল – চিন্ময়কুমার দাস

মাছগুলো কোথায় পালিয়ে গেল – চিন্ময়কুমার দাস

গুয়াহাটির পান্ডু লোকনাথ মন্দিরের পাশের বাগানে তিনটি বিড়ালের বাচ্চা একমনে খেলা করছে। তাদের মধ্যে একটা বাচ্চার রং অদ্ভুত হলুদ। নরম তুলতুলে বিড়ালের বাচ্চা কোনো কিশোরের পছন্দ হবে না, তা কী হয়! অথচ প্রতীক সেদিক থেকে দ্রুত মুখ ফিরিয়ে নিল।

লোকনাথ মন্দিরকে বাঁয়ে রেখে দশ-বারো পা এগিয়ে গেলেই একটি তিনকোনা পুকুর। টলটলে সবুজ তার জল। সেখানে হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে ছোট্ট জাল ফেলে মাছ ধরছে একটি লোক। লোকটির খালি গা। পরনে সবুজ গামছা।

প্রতীক পায়ে-পায়ে সেই পুকুরপাড়ে এসে দাঁড়াল। তার উপস্থিতি টের পেয়ে জাল টানার এক ফাঁকে মাথা ঘুরিয়ে লোকটি তার দিকে চেয়ে একবার হাসল। বলল, ‘কীগো খোকা, মুখটা ওইরকম শুকনা-শুকনা ক্যান? তুমার বুঝি মন খারাপ?’

একথার জবাব না-দিয়ে প্রতীক নিরুত্তাপ গলায় অন্য কথা জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কী কী মাছ ধরো?’

লোকটি বলল, ‘তা অনেক মাছ। কত শুনবা। খইলস্যা, ট্যাংরা, পুঁটি, বইরাল্যা, রুইয়ের পনা…। মাছের কী কম জাত আছে খোকা?’

লোকটি একটু বাদে জাল গোটাতে গোটাতে জল থেকে পাড়ে উঠে এল। তারপর জালটাকে ঢালু পাড়ের সাদা মাটিতে বিছিয়ে দিল। প্রতীক দেখল জালের মাঝখানে অজস্র কচুরিপানা আর কাদা। তার ফাঁক-ফোকরে লাফাচ্ছে অজস্র ছোটো- ছোটো মাছ। লোকটি মাটিতে বসে জালের কাদা আর কচুরিপানার মধ্যে থেকে মাছ বেছে-বেছে একটি মুখভাঙা মাটির হাঁড়িতে তুলে রাখতে লাগল।

লোকটি বলল, ‘তুমারে যে জিগাইলাম, মুখে হাসি নাই ক্যান?’

লোকটির প্রশ্নকে এবারও পাত্তা দিল না প্রতীক। সে বরং মাটির হাঁড়ির দিকে ঝুঁকে চেয়ে থাকতেই বেশি আগ্রহ দেখাল।

জাল থেকে মাটির হাঁড়িতে উঠে এসেও ছোটো-ছোটো রকমারি মাছগুলির যেন একটুও বিরাম নেই! হাঁড়ির ওইটুকু জলের মধ্যেই সাদা-কালো মাছগুলো খলবল-খলবল করছে।

লোকটি আবারও জিজ্ঞেস করল, ‘কী হইছে খোকা তুমার? ছোটো পোলাপাইনের মুখে হাসি না-দেখলে যে আল্লার বড়ো কষ্ট হয়!’

এতক্ষণে প্রতীক কিছুটা অন্যমনস্কভাবে জবাব দিল, ‘কে তোমার আল্লা? তোমার বন্ধু আল্লা কী জানে না যে, আজ আমার মন ভালো নেই?’

লোকটি বলল, ‘ক্যানরে খোকা, মন ভালো নেই ক্যান? কেউ তুমারে বকছে? বাবা-মা…’

প্রতীকের মন বারবার মাটির হাঁড়ির মধ্যে নৃত্যরত মাছগুলোর দিকেই চলে যাচ্ছে। সেদিকে চেয়েই সে বলল, ‘মাছগুলো এত লাফাচ্ছে কেন? আমার তো মন খারাপ। কিন্তু আজ ওদের কীসের এত আনন্দ?’

লোকটি বলল, ‘খোকা, তুমি শুধু মাছগুলারেই দেখলা! আল্লার আদেশ আছে, এই দুনিয়ার সবারই ডেইলি ডেইলি খুশিতে থাকন উচিত।’

প্রতীক আবারও জিজ্ঞেস করল, ‘কে তোমার আল্লা? তাকে পেলে একবার জিজ্ঞেস কোরো, আমার কেন কোনো আনন্দ নেই।’

ইতিমধ্যে জাল থেকে মাছ বাছা হয়ে গিয়েছিল। কচুরিপানাগুলোকে পাড়ের অদূরে ছুড়ে ফেলে, জালটাকে পুকুরের জলে ধুয়ে এনে রোদের মধ্যে বিছিয়ে দিতে-দিতে লোকটি বলল, ‘অল্প দাঁড়াও।’ তারপরই হঠাৎ করে কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেল। প্রতীককে দারুণ অবাক করে দিয়ে পরক্ষণেই লোকটি আবার তার কাছে হাজির হল।

প্রতীক চেয়ে দেখল, লোকটির হাতে একটুকরো কচি কলাপাতা। সেই কলাপাতাকে অসাধারণ দক্ষতায় বাদামের ঠোঙার মতো করে ভাঁজ করল লোকটা। তারপর এগিয়ে গেল পুকুরের দিকে। কলাপাতার ঠোঙাটিতে অঞ্জলিবদ্ধ ডান হাত দিয়ে খনিকটা জল তুলল। এরপর জল থেকে পাড়ে উঠে এসে, মাটির হাঁড়ি থেকে চোদ্দো-পনেরোটা মাছ তুলে কলাপাতার ঠোঙার জলে ছেড়ে দিল। এবার সেটা অতিসাবধানে তুলে দিল প্রতীকের হাতে।

হাতে নিয়ে প্রতীক দেখল, কলাপাতার ঠোঙার সবুজ জলে ছোটো ছোটো মাছগুলো যেন আরও-আরও বেশি পুকুরের আনন্দে সাঁতার কাটছে। মাঝে-মাঝে জলের উপরে লাফ দিতেও কোনো কসুর ছাড়ছে না তারা। যেন এক্ষুনি মাছগুলো জল থেকে উপরে উঠে এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে তার হলুদ শার্টে। দৃশ্যটা সত্যিই মজার। প্রতীকের অন্ধকার মুখে এতক্ষণে কিছুটা হাসির আভাস ফুটে উঠল।

এই ভাবান্তর লক্ষ করে লোকটি এবার প্রতীকের কাঁধে হাতের খোঁচা দিয়ে একটা ইশারা করল। তারপর লোকটি আবার পুকুরের দিকে নেমে গেল। প্রতীকও তাকে অনুসরণ করল। পুকুরের জল যখন প্রতীকের কোমর প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছে, তখন লোকটি তাকে থামার ইশারা করে বলল, ‘এইবার একখান-একখান কইর‌্যা মাছগুলানরে জলে ছাইড়্যা দাও। দ্যাখবা কী মজা, কী আনন্দ!’

প্রতীক বাধ্য ছেলের মতো তা-ই করল। কলাপাতার ঠোঙাটাকে বাঁ-হাতে ধরে, ডান হাত দিয়ে একটা-একটা করে মাছ তুলে জলের মধ্যে ছেড়ে দিতে থাকল। সে এক ভারি মজার দৃশ্য! মাছগুলো জলের মধ্যে পড়েই, তার দিকে ফিরে, ফ্যালফ্যাল করে দেখতে লাগল। তারপর কোনো কোনো মাছ টুপ করে জলের অন্ধকার গভীরে হারিয়ে যেতে লাগল। আবার কেউ-কেউ তার কোমরের চারপাশে চক্কর দিতে শুরু করল। ছোটো-ছোট মাছগুলোর এই কীর্তি দেখে নিজেকে ধরে রাখতে পারল না প্রতীক। প্রথম বারের মতো সে হো হো করে হেসে ফেলল।

লোকটি খুশি হয়ে মজা করে বলল, ‘কী খোকা! আমার আল্লা তুমার মুখে কীরকম হাসি আইন্যা দিল দ্যাখলা!’

প্রতীক উৎফুল্ল হয়ে বলল, ‘মাছগুলো ভারি দুষ্টু তো! ওদের একটু বকে দেব নাকি?’

লোকটি বলল, ‘সেইটা তুমার কথা। আনন্দও তুমার। মাছগুলানও তুমার। তুমি ওরারে আদর করব্যা না বকবা, সেইটা আমারে জিগাও ক্যান খোকা?’

প্রতীক বলল, ‘আচ্ছা কাকু, এই যে মাছগুলো আমাকে দেখে-দেখে চলে যাচ্ছে, ওরা ওদের বন্ধুদের সঙ্গে দেখাটেখা করে, আমি ওদের অপেক্ষায় এই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি কিনা, তা দেখার জন্য আবার এখানে ফিরে আসবে না?’

লোকটি বলল, ‘ক্যান আইব না? হেরা তুমার বন্ধু হইয়্যা গেছে। দ্যাখবা, ঠিক তুমারে খুঁজতে আইব। কিন্তু তুমি কী তারারে চিনতে পারবা? মাছগুলানের চেহারা যে এক!’

প্রতীক চিন্তিত হয়ে বলল, ‘তাহলে কী হবে এখন?’

লোকটি তার কথার কোনো জবাব না-দিয়ে ইশারায় তাকে চুপ থাকতে বলে জলের দিকে ঝুঁকে পড়ল। কৌতূহলী হয়ে প্রতীকও জলের দিকে চোখ ফেরাল। সে মুগ্ধ হয়ে দেখল, তাদের সামনে একঝাঁক মাছ। মানুষের মতো মাছেদের চেহারা আলাদা-আলাদা হয় না ঠিকই, কিন্তু প্রতীকের দৃঢ় বিশ্বাস, একটু আগে যে দশ-পনেরোটা মাছকে সে জলের মাঝখানে ছেড়ে দিয়েছিল, তারা ওই ঝাঁকের মধ্যেই মিশে আছে। তাদের এক-দুটোকে যেন সে চিনতেও পারছে! তার কেবলই মনে হচ্ছে, তার ছেড়ে দেওয়া মাছগুলো তাদের বন্ধুবান্ধব সমেত তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।

লোকটির চোখ বিস্ফারিত। মাছগুলোকে বিস্ময়ের সঙ্গে দেখতে দেখতে স্বগতোক্তির মতো করে বলতে লাগল, ‘হে আল্লা, এই কান্ড আমি জীবনে দেখি নাই! মাছগুলান পোলাডারে ভালোবাইস্যা আবার ফির‌্যা আইছে!’

মাছগুলো প্রতীকের দিকে ঢ্যাবঢ্যাব করে তাকিয়ে দেখছিল। তাদের হালকা শরীরগুলো পুকুরের জলতরঙ্গে তিরতির করে কাঁপছিল। এমন সময় আচমকা কাছেপিঠে কোথা থেকে একটা মস্ত গর্জন ভেসে এল—হুম-আঁ। সঙ্গে-সঙ্গে মাছগুলো ভয় পেয়ে এদিকে-ওদিকে ছুটে পালিয়ে গেল। পুকুরের চারপাশের বড়ো বড়ো গাছগুলোতে এতক্ষণ যে-সমস্ত পাখিরা বসে বিশ্রাম নিচ্ছিল, তারা এবার অদ্ভুতভাবে কিচিরমিচির করতে করতে আকাশে পাক খেতে লাগল। দূরে অনেকগুলি কুকুর একসঙ্গে ডেকে উঠল।

লোকটি পিঠ টানটান করে সোজা হয়ে দাঁড়াল। তারপর সন্ত্রস্ত মুখে দ্রুত এদিক-ওদিক তাকাতে লাগাল। তখন আবারও উঠল সেই বীভৎস গর্জন—হম-আঁ। তা শুনে লোকটি ভয়ার্ত গলায় বলল, ‘হে আল্লা, বাঘ এইখানে কী কইর‌্যা?’ তারপরই সে প্রতীকের ডান হাত শক্ত করে ধরে, ঘুরে, পাড়ের দিকে এগোতে থাকল।

প্রতীক অবাক হয়ে বলল, ‘আপনি কাকু বাঘের কথা বলছেন? কিন্তু বাঘ এখানে কী করে আসবে? ওরা তো জঙ্গলে থাকে।’

লোকটি তার দিকে না-তাকিয়েই বড়ো বড়ো পা ফেলে হাঁটতে-হাঁটতে বলল, ‘জঙ্গল কী আর আইজ জঙ্গল আছে? সবই তো মাইনসের দল দখল কইর‌্যা ফেলছে। বাঘের আর দুষ কী? হেরা যাইব কই? মাইনসের সমাজে নাইম্যা আইছে তাই।’

ওরা ইতিমধ্যেই জল থেকে উঠে, পুকুরপাড় পেরিয়ে পিচের সরু রাস্তায় উঠে এসেছে। কয়েকজন মহিলা ‘বাঘ-বাঘ’ চিৎকার করতে-করতে বাঁদিকে মন্দিরের দিকে ছুটে গেল।

লোকটি জিজ্ঞেস করল, ‘খোকা, তুমার ঘর কুনখানে কও দেহি।’

প্রতীকের ঝলমলে চোখমুখটা হঠাৎ করে যেন নিভে গেল। সে সংক্ষিপ্ত করে জবাব দিল, ‘জানি না।’

লোকটি তুমুল ঘাবড়ে গিয়ে বলল, ‘অমা, ইটা কীরকম কথা। আইচ্ছা হইব। তুমি অহন আমার লগে চলো। তুমারে একা ছাড়ন যাইত না। পরে তুমারে বাড়ি দিয়া আসুম।’

প্রতীক অবশ্য এই কথার কোনো বিরোধ করল না। সে লোকটার সঙ্গে সঙ্গে জোরে জোরে হাঁটতে লাগল।

লোকটি নিজের মনে বলতে লাগল, ‘বাঘের পেটে ক্ষুধা। আইজ কারে নিব কে জানে!’

প্রতীক অবশ্য সেই কথার কোনো মানে বের করতে পারল না। সে ভাবতে লাগল, বাঘ মানুষ খায়, একথা সে জানে। কিন্তু সে মানুষকে তুলে নিয়ে যাবে কেন? বাঘ কী আজকাল মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চাইছে?

এমন সময় ফের সেই ডাক—হুম-আঁ।

কিন্তু এবার ডাকটা এত কাছ থেকে শোনা গেল যে, গর্জনের তীব্রতা আর ভয়ের মিশেলে ওদের দুজনেরই শরীর কেঁপে উঠল। ওরা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। লোকটি প্রতীকের হাত আরও শক্ত করে ধরে, বাঘের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হবার জন্য অস্থিরভাবে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল। তারপর তাকে নিয়ে যে-ই ডানদিকে পালাতে যাবে, ঠিক সে-সময় বাঁদিকের সরু গলিটা থেকে অনেক মানুষের গুঞ্জন আর আর্তনাদ ভেসে এল। অতঃপর তাদের আবার দাঁড়িয়ে পড়তে হল।

লোকটি এবার সেই গলির দিকে পা বাড়াল। পিছন-পিছন প্রতীক। তাদের বেশিদূর এগোতে হল না। একটু গিয়েই তারা একটি আশ্চর্যজনক দৃশ্যের মুখোমুখি হল। ঘটনাটা একই সঙ্গে দারুণ ভয়ংকরও বটে।

গলির মধ্যে একটি টাইপ ওয়ান রেল কোয়ার্টার। তার খোলা দরজা ও জানলার সামনে লাঠি হাতে অজস্র মানুষের জমায়েত। তাদের হইহই রইরই চিৎকারে কান পাতা দায়। এরই মাঝখানে কয়েকজন মহিলা বিলাপ করছে।

লোকটির পিছন-পিছন প্রতীকও সেই ভিড়ের কাছে এগোল। তারপর সেই কোয়ার্টারের খোলা জানলা দিয়ে যা দেখতে পেল, তাতে গোটা শরীর হিম হবার উপক্রম হল।

ঘরের ভিতর একটি বিছানা। সেখানে শুয়ে আছে একটি এক-দেড় বছরের শিশু। আর সেই বিছানার সামনে, নীচে বসে আছে একটি মস্ত বাঘ। শিশুটি মোটেও ভয় পায়নি। সে শুয়ে-শুয়ে একবার বাঘটাকে দেখছে, আরেকবার জানলার বাইরের অস্থির মানুষদের দেখছে। তার চেয়েও বড়ো আশ্চর্যের, বাঘটা বাচ্চাটার কাছে বসে আছে, অথচ তাঁকে ছুঁচ্ছে না। আক্রমণও করছে না।

বাইরের মহিলাদের মধ্যে একজন পাগলের মতো কাঁদতে-কাঁদতে বলছে, ‘আপনারা দাঁড়িয়ে আছেন কেন, ও আমার বাচ্চাটাকে খেয়ে ফেলবে। ওটাকে মারুন।’

মানুষও কী চুপ করে বসে আছে? যেই দরজা দিয়ে লাঠি হাতে কেউ ঢুকে পড়তে চাইছে, অমনি বাঘটা ‘হুম-আঁ’ গর্জন তুলে তার দিকে তেড়ে আসছে। ফলে কেউ আর ভিতরে ঢোকার সাহস করছে না।

এরই মধ্যে দু-একজন বলাবলি করতে লাগল যে, বাঘটার নাকি একটা বাচ্চা হারিয়ে গেছে। তাতেই তার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ঘরের মধ্যে ঢুকে ওভাবে বাচ্চাটার সামনে কেন যে বসে আছে বাঘটা, কেউ তার মাথামুন্ডু বুঝতে পারছে না। অনেকেই উপায়ান্তর না—পেয়ে অস্থিরভাবে এদিক-ওদিক দৌড়াদৌড়ি করছে, একে-তাকে ডাকছে। তবু কিছুতেই বাঘের সামনে থেকে বাচ্চাটাকে উদ্ধারের মতো কোনো উপায় মিলছে না। মাছধরা লোকটিও হঠাৎ করে কখন যেন সেই দলে মিশে গিয়ে ছোটাছুটিতে লেগে গেছে।

ভিড়ের ওই হুলুস্থূল পরিবেশের মধ্যে, এর-তার ধাক্কা খেতে-খেতে, অনেকগুলি মানুষকন্ঠের একত্র কান্না আর আতঙ্কের কথা শুনতে-শুনতে, অনেকক্ষণ ধরে কী-একটা কথা যেন প্রতীক মনে করবার আপ্রাণ চেষ্টা করছিল। তার একটু বাদেই হঠাৎ তাকে ভিড় থেকে বেরিয়ে গলির রাস্তার দিকে ছুটে যেতে দেখা গেল।

পান্ডু লোকনাথ মন্দিরের পাশের বাগানে, সেই ঘণ্টা-দুয়েক আগে দেখে যাবার মতো করেই, এখনও দিব্যি খেলা করে চলেছে খয়েরি, কালো আর হলুদ রঙের বিড়ালছানা তিনটি। বাচ্চাগুলো যাতে ভয় না-পায়, সেইমতো পা টিপে-টিপে সেদিকে এগিয়ে গেল প্রতীক। খুব কাছ থেকে হলুদ বাচ্চাটাকে লক্ষ করে দেখল, তার শরীরে হলুদের উপর ডোরাকাটা অনেকগুলো কালো রেখা। সে যেটা ভেবেছিল, সেটাই ঠিক। দুটো বিড়ালের বাচ্চার সঙ্গে সেই কখন থেকে একমনে খেলা করে চলেছে একটি বাঘের বাচ্চা। বাঘের বাচ্চাটা তার মা-কে হারিয়ে ফেলার পর সম্ভবত খুঁজে পেয়েছে দুজন পরম বন্ধু।

প্রতীক আর দেরি করল না। বাঘের বাচ্চাটাকে মাটি থেকে কোলে তুলে নিল। এই আকস্মিক ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় বিড়ালের বাচ্চা-দুটি থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল। সেই দু-জোড়া চোখের দৃষ্টিতে ঠিক কী লেখা ছিল, তা পড়ে নেবার মতো সময় অবশ্য ছিল না প্রতীকের হাতে। সে ছুটে গেল তিনকোনা পুকুর-সংলগ্ন পিচরাস্তার দিকে।

টাইপওয়ান সেই রেল কোয়ার্টারের সামনে ইতিমধ্যে ভিড় আরও বেড়ে গেছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে চিৎকার- চেঁচামেচি আর কান্না। প্রতীকের অবশ্য কোনো কিছুতেই ভ্রূক্ষেপ নেই। সে বাচ্চাটাকে শার্টের নীচে আড়াল করে ভিড়ের মধ্যিখানে ঢুকে পড়ল। সে কোনোক্রমে দরজার সামনে পৌঁছে গেলেই বাচ্চাটাকে ঘরের ভেতরে ছেড়ে দেবে। কিন্তু দেখা গেল, সেটা সে কিছুতেই করে উঠতে পারছে না। একেই তো সে ছোটো। তার ওপর এত মানুষের ভিড়। প্রতীক তবু হার মানল না। সে বারবার এগোনোর চেষ্টা করে যেতে লাগল। আর এই চেষ্টার ফলশ্রুতিতেই হঠাৎ এক ভয়ংকর দুর্ঘটনা ঘটে গেল। ভিড়ের প্রবল ধাক্কায় টাল সামলাতে না-পেরে প্রতীক দরজা ডিঙিয়ে একেবারে ঘরের মধ্যে গিয়ে পড়ল। বাঘ তার দিকে ফিরে তীব্র হুংকার ছাড়ল—হুম-আঁ। উদ্যত বাঘটির সঙ্গে প্রতীকের ব্যবধান মাত্র পাঁচ হাত। যেকোনো মুহূর্তে বাঘটি তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। এতক্ষণে তার শরীর কাঁপতে শুরু করল। সে উঠে দাঁড়াতে গেল। কিন্তু পারল না। বাঘটি আবার গর্জন করে উঠতেই প্রতীক জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।

একটু বাদে যখন চেতনা ফিরল, প্রতীক দেখল, সে একটি বিছানায় শুয়ে আছে। তাকে ঘিরে অনেকগুলি মুখ তার উপর ঝুঁকে আছে। সে ধড়মড় করে উঠে বসে চিৎকার করে উঠল, ‘বাঘ!’

তার কথা শুনে একটা লোক বলে উঠল, ‘বাঘটা সেই কখন তার বাচ্চাকে নিয়ে চলে গেছে। বাব্বা! তোমার যা সাহস!’

একজন মহিলা ভিড় ঠেলে তার দিকে এগিয়ে এল। তার চুল ও শাড়ি অবিন্যস্ত। চোখের নীচে জলের ধারা। কোলে একটি শিশু। শিশুটিকে ঠিক চিনতে পারল প্রতীক। এই বাচ্চাটাকেই বাঘটা ঘরের মধ্যে বন্দি করে রেখেছিল। তাহলে বাচ্চাটার কোনো ক্ষতি হয়নি! স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল প্রতীক। মহিলাটি বলছে, ‘বাবা, আজ তুমি যে আমার কী উপকার করলে! আমার সোনাটাকে ফিরিয়ে এনে দিয়ে কী যে উপকার…’ —কথা শেষ করতে না-পেরেই মহিলাটি ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল আবারও।

প্রতীক দেখল, সেই মাছধরা লোকটিও তার কাছেপিঠেই দাঁড়িয়ে আছে। লোকটি এবার এগিয়ে এসে তার মাথায় হাত রাখল। প্রতীক তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কোথায় চলে গিয়েছিলে?’

লোকটি বলল, ‘তুমি হইল্যা আল্লার দোয়া। তুমারে রাইখ্যা আমি আর যামু কই। আইচ্ছা, একটা কথা কও দেখি, ওই বাঘের বাচ্চাটারে তুমি পাইলা কই?’

প্রতীক বলল, ‘আমি তো সকালে আসার সময়ই দেখেছিলাম, ও দুটো বিড়ালের বাচ্চার সঙ্গে খেলছে মন্দিরের বাগানে।’

লোকটি বলল, ‘বাঘটা যখন তুমার উপর প্রায় লাফ দিয়াই ফালছে, আমি চোখ বুইজ্যা, দুই হাত তুইল্যা আল্লারে কইলাম, আল্লা, পোলাডারে বাঁচাও। তারপর চায়া দেখি, তুমার জামার তল থেইক্যা কুঁ-কুঁ করতে-করতে একটা বাঘের বাচ্চা বার হইয়্যা বাঘটার দিকে দৌড়াইয়া গেল। সঙ্গে-সঙ্গেই বাঘটার রাগ পইড়্যা গেল। অমা, বাচ্চাটারে জিভ দিয়া চাইট্যা-চাইট্যা বাঘটা কী আদর করল! মাইনসের বাচ্চাও বুধহয় অত আদর পায় না। তারপর বাচ্চাডার ঘাড়ে কামড় দিয়া তুইল্যা লইয়া বাঘটা সুড়সুড় কইর‌্যা দরজ্যা দিয়া বারইয়া পিছনের জঙ্গলের দিকে পালাইয়া গেল। কিন্তু তুমি কী ভাইব্যা বাচ্চাডারে লইয়্যা ঘরে ঢুইক্যা পড়লা খোকা, কও অহন দেহি?’

প্রতীক বলল, ‘আমি বাঘটার মুখের অবস্থা দেখে বুঝতে পেরেছিলাম, ওর বাচ্চাটাকে ফিরে পেলেই সে এখান থেকে চলে যাবে।’

এমন সময় ভিড় ঠেলে প্রতীকের সামনে হুড়মুড় করে এসে পড়ল তারা বাবা-মা। মা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কাঁদতে-কাঁদতে বলতে লাগল, ‘রেজাল্ট খারাপ হয়েছে বলে বাবা না-হয় একটু বেশিই বকাবকি করে ফেলেছেন। তাই বলে রাগ করে ঘর থেকে পালিয়ে গিয়ে একেবারে বাঘের কাছে চলে এলে? এটা তুমি কী করলে বাবাই?’

বাবা প্রতীকের পিঠে হাত রেখে বলল, ‘আমাকে তুই ক্ষমা করে দে বাবাই। আমি ভুল ভাবছিলাম। আমি তোকে অকর্মণ্য বলেছিলাম। কিন্তু আজ তুই যে কাজটা করলি, নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে একটা বাচ্চাকে বাঁচালি, তাতে তোর বাবা হিসেবে আমি গর্বিত। তুই পরীক্ষায় ফেল করেও আজ আমাদের সবার মধ্যে ফার্স্ট। চল বাবাই, এবার বাড়ি চল।’

প্রতীক একে-একে তার মা ও বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে কী যেন দেখল। তারপর সেই মাছধরা লোকটির দিকে ফিরে, বিছানা থেকে ব্যস্তসমস্ত হয়ে নামতে-নামতে বলল, ‘আমাকে প্লিজ ওই পুকুরে নিয়ে চলো। মাছগুলো তখন বাঘের ডাকে ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিল। নিশ্চয়ই আমার জন্য অপেক্ষা করছে ওরা। ওদের সঙ্গে আমার অনেক-অনেক কথা বলবার আছে!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *