মাকড়সার জাল
প্রতিদিন ঘুম থেকে ওঠার পর খুব তাড়াতাড়ি, আমাদের মাথার ভিতর কিছু হিসেব-নিকেশ চলতে থাকে৷ যেমন—আমি কে, আমি কোথায় থাকি, আমার চারপাশে আর কারা-কারা থাকে—এই সমস্ত৷ অবশ্য, এত কিছু ভাবতে আমাদের মাথার সময় লাগে মাত্র কয়েক সেকেন্ড৷
হসপিটালের বিছানায় কিছুক্ষণের মধ্যেই একজনের জ্ঞান ফিরবে৷ কাল রাতে তার একটা বড়সড় অপারেশন হয়েছে৷ রোগী মোটর-নিউরন ডিজিজে আক্রান্ত৷ তার গলা থেকে পায়ের নীচ পর্যন্ত অসাড়৷
মাকড়সার আবার একটা অদ্ভুত স্বভাব আছে৷ জালে আটকে পড়া পতঙ্গকে সে সাথে-সাথে মারে না৷ নিজেকে ছাড়াবার ব্যর্থ চেষ্টা করতে-করতে পতঙ্গ যখন নির্জীব হয়ে ওঠে, তখন ধীরে-সুস্থে এক পা-এক পা করে তার দিকে এগিয়ে যায়৷
তিনটে আলাদা ঘটনার কথা বললাম৷ যোগসূত্র একটাই…
চোখ খুলতেই প্রথম যে জিনিসটা অনুভব করলাম সেটা হল মাথার ঠিক পিছনে একটানা তীব্র যন্ত্রণা৷ মনে হল যেন চুলের ফাঁক দিয়ে অজস্র আলপিন ফুটছে৷ ছটফট করার চেষ্টা করলাম কিন্তু হাত-পা নড়ল না৷ শুধু মাথাটা এপাশ-ওপাশ করতে লাগলাম৷
মিনিট খানেক পর আচমকাই কমে এল ব্যথাটা৷ আমি চারপাশটা ভালো করে দেখার চেষ্টা করলাম৷ কোথায় আমি? উপরে সাদা ছাদ, অর্থাৎ একটা ঘরে শুয়ে আছি আমি৷ না, ঘর নয়৷ হসপিটাল৷ মাথার পিছন থেকে একটা যান্ত্রিক শব্দ আসছে৷ ডান দিকে তাকিয়ে দেখলাম একটা খোলা জানলা, সেটা আপাতত বন্ধ৷ বাঁদিকে তাকাতেই মানুষ চোখে পড়ল৷ আমার বেডের ঠিক পাশেই বিছানায় মাথা রেখে ঘুমিয়ে রয়েছে কেউ; একজন মহিলা, জামাকাপড় দেখে অবশ্য হসপিটালের কেউ বলে মনে হল না৷ সম্ভবত আমার বাড়ির কেউ৷ সারারাত জেগে থেকে সকাল হতে চেয়ারে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছে৷ ব্যাপারটা মাথায় আসতেই অন্য একটা চিন্তা এসে চেপে ধরল আমাকে৷ কে আমি? আমার নিজের নাম মনে পড়ছে না, এমনকি আমি কীভাবে এই হসপিটালের বেডে এলাম সেটাও বুঝতে পারছি না৷ এই ঘরটা চেনা-চেনা লাগছে৷ অবশ্য সেটা আশ্চর্যের কিছু নয়, সব হসপিটালের ঘরগুলোই একই রকম দেখতে হয়৷ আমি হাত নাড়ানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু পারলাম না, মনে হল আমার হাতের উপর নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে৷ আমার অসহায় লাগল৷
মিনিট খানেক পরে বাইরে খসখসে জুতোর আওয়াজ পেতে বুঝলাম কেউ ঘরে ঢুকছে৷ আমি সজাগ হয়ে উঠলাম৷ আমার কি স্মৃতিভ্রংশ হয়েছে? তবে কি কোনও অ্যাকসিডেন্টে জ্ঞান হারিয়ে এখানে এসেছি আমি? কিছুই মনে পড়ছে না৷
একজন বছর চল্লিশেকের লোক ঘরে ঢুকলেন, সম্ভবত ডাক্তার৷ আমাকে দেখেই একগাল হেসে বললেন, ‘এই যে, সুপ্রভাত৷ কেমন আছেন?’
আমি বিনিময়ে হাসলাম, কিন্তু উত্তর দিলাম না, আমার নিজের কাছেই অনেক প্রশ্নের উত্তর নেই৷
‘চিনতে পারছেন না আমাকে?’ ভুরুটা কুঁচকে ডাক্তার আমার দিকে এগিয়ে এলেন৷
আমি মাথা নাড়ালাম৷ ভদ্রলোক কিন্তু খুব একটা অবাক হলেন না৷ মুখে কী যেন বিড়বিড় করতে-করতে বললেন, ‘লবটমিকাল অপারেশনের সাইড এফেক্ট, ও কিছু নয়, আস্তে-আস্তে মেমোরি গেন করবেন৷’
কথাটা বলে ঘুমন্ত মহিলার দিকে ফিরে তাকে ডাকলেন, ‘মিসেস দাস… উঠুন…’
আমি জানলা দিয়ে বাইরে তাকালাম, খানিকটা দূরে কতগুলো হাইরাইজ বিল্ডিং৷ বড়-সড় দৈত্যের মতো তারা রোদ আগলে দাঁড়িয়ে আছে৷ ধীরে- ধীরে একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি, গলার নীচ থেকে শরীরের উপর আমার নিয়ন্ত্রণ নেই; চাইলেও আমি হাত বা পা নাড়াতে পারব না৷ ব্যাপারটা নিয়ে বেশি মাথা ঘামালাম না, এই মুহূর্তে আমার যেটা দরকার সেটা হল পরিচয়, সমস্ত অজানা প্রশ্নগুলো মাথার মধ্যে ভিড় করে আসছে৷ সেগুলোর মীমাংসা এক্ষুনি না হলে আমার শান্তি হবে না৷ কপালে একটা মেয়েলি হাতের স্পর্শ পেয়ে আমি ঘুরে তাকালাম৷ সেই ঘুমন্ত মহিলা, কেমন যেন বিবর্ণ রক্তহীন মুখ তার৷ চুলগুলো উসকোখুসকো৷ চোখের তলায় মোটা কালি পড়েছে৷ উদ্বিগ্ন মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে সে৷ আমি সেদিকে ফিরতে ভাঙা গলায় প্রশ্ন করল, ‘চিনতে পারছিস আমাকে?’
আমি মাথা নাড়ালাম, আর সাথে-সাথে তার ক্লান্ত বিনিদ্র চোখে যেন আরও অন্ধকার নেমে এল৷ সে মাথা নামিয়ে নিল৷ ডাক্তার ভদ্রলোক পিছন থেকে তাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলেন, ‘এত ভেঙ্গে পড়ার কিছু নেই; প্রথমটা হয় এরকম৷’
আমি ব্যাপারটা খানিকটা বুঝলাম৷ মহিলা সম্ভবত আমার কোনও আত্মীয়া, আমার স্মৃতিভ্রংশ হওয়ায় অর্থাৎ আমি তাকে চিনতে না পারায় বোধহয় মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছে৷ কেমন যেন মায়া হল আমার, তার মাথায় একটা হাত রাখতে ইচ্ছা করল কিন্তু হাত নড়ল না৷ আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর অবশ্য এখনও পাইনি, জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা, আমার কি কোনও অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল?’
ডাক্তার আমার দিকে মুখ তুলে বললেন, ‘অ্যাক্সিডেন্ট! না, না৷ বিগত একবছর আপনি এই হসপিটালের এই বেডে শয্যাশায়ী, কাল রাতে আপনার একটা অপারেশন হয়েছে৷ এই মুহূর্তে আপনার ব্রেন বেশ কিছু মেমোরি হারিয়ে ফেলেছে, আপনি নিজের নাম বলতে পারবেন?’
‘না৷ কিসের অপারেশন?’
‘মাথার৷ আই মিন নার্ভের৷’
আমি আর কিছু বললাম না৷ অপারেশন বা তার আগের কথা কিছুই মনে পড়ছে না আমার৷ মহিলা এখনও নীচু স্বরে কেঁদে চলেছেন, তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে আমার কেমন যেন চেনা লাগল৷ অথচ মহিলা আমার কে হন সেটাও জানি না৷ জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমার নাম কী?’
ডাক্তার উত্তর দিতে যাচ্ছিলেন, মহিলা তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ইন্দ্র, ইন্দ্রনাথ দাস৷’
ডাক্তার আমার দিকে এগিয়ে এসে একটু হেসে বললেন, ‘উনি আপনার বোন৷’
আমি হাত দুটোকে বুকের উপর জড়ো করে চোখ বুজলাম৷ আগের ঘটনা যতটা সম্ভব মনে করার চেষ্টা করলাম৷ এই হসপিটালটা আমার চেনা, এমনকি মানুষগুলোও; শুধু ঘটনার কথা কিছুই মনে পড়ছে না৷ আমি আবার মহিলার মুখের দিকে তাকালাম, চেনা মুখ, আমি আগেও দেখেছি৷ এই সাদা কোট পরা ডাক্তারটা এমনকি জানলার বাইরের সব দৃশ্যই আমার চেনা৷ সেটা হওয়া অবশ্য অস্বাভাবিক কিছু না৷ আমি যদি এক বছর যাবৎ এই বেডেই শুয়ে থাকি তাহলে আমার স্মৃতিভ্রংশ হলেও অবচেতন মনে এদের ছবিগুলো থেকে গেছিল হয়তো৷ সেগুলো যে আস্তে-আস্তে পুরোটাই ফিরে আসবে তা নিয়ে আমার সন্দেহ নেই৷ কিন্তু আমার শরীরটা? সেটা কি আর ঠিক হবে কোনওদিন? ডাক্তারের কথা শুনে অবশ্য মনে হল খানিকটা সম্ভাবনা আছে৷ কী জানি৷ আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল৷ একবছর ধরে আমি বিছানায় শুয়ে আছি৷ আরও কতদিন শুয়ে থাকতে হবে কে জানে৷
‘এই বইটা চিনতে পারছেন?’
ডাক্তার আমার দিকে একটা বই এগিয়ে ধরেছেন, বেশ রংচঙে, আমি নামটা পড়ার চেষ্টা করলাম, ‘কাউন্ট অফ মন্টেক্রিস্টো’৷ আমি কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মাথা নামিয়ে নিলাম৷ ডাক্তার হেসে বললেন, ‘এ বইটা পড়তে ভালোবাসতেন আপনি৷ ভালোই হল, ভুলে গেছেন যখন তখন আবার নতুন করে পড়ার আনন্দ পাবেন৷’
‘আমি পড়ব কী করে?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম৷
‘কেউ না কেউ পড়ে শোনাবে আপনাকে৷ আর কোনও বইয়ের কথা মনে পড়ছে?’
আমি মনে-মনে ভাবার চেষ্টা করলাম৷ আর কিছু মনে পড়ছে না, এটুকু বুঝতে পারছি আমি নিজে যতই চেষ্টা করি না কেন কিছুই মনে পড়বে না; যেটুকু নিজে থেকে ধরা দেবে সেটুকুই জানতে পারব৷
‘এই যে সুতোটা আপনার মুখের কাছে ঝুলছে, কিছু দরকার হলে ওটা মুখ দিয়ে ধরে টান দেবেন, না পারলেও অবশ্য ঘাবড়ানোর কিছু নেই, আপনার রুমটা ২৪×৭ মনিটারিং চলছে৷’
‘আমার বাড়ি থেকে আর কেউ আসেনি?’
‘আসবে হয়তো পরে, আচ্ছা আমি চলি, আবার বিকেলে আসব৷’
ডাক্তার ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন৷ বিছানার পাশে বসা মহিলা এখনও একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন৷ কেমন যেন শূন্য দৃষ্টি৷ আমি আগের থেকে একটুও ভালো হয়েছি কি না এতক্ষণ যেন সেটাই দেখার চেষ্টা করছিল৷
‘তোর ব্যথা নেই তো কোথাও?’
আমি মাথা নাড়ালাম৷ ব্যথা থাকলেই হয়তো সে খুশি হত৷ আমার অসাড় হাতটা নিজের হাতে চেপে ধরে আমার কাছে খানিকটা ঝুঁকে পড়ে বলল, ‘আমাকে একটুও মনে পড়ছে না?’
‘খানিকটা…’ আমি তার দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলাম৷
‘তাহলে বল দেখি আমার মুখে কী নেই?’ সে আমার দিকে চোখ কুঁচকে তাকাল৷
‘চশমা৷’
‘যাহ, ও তো নাকের পাশের দাগটা দেখেই বোঝা যায়৷’
‘তাহলে অন্য কিছু জিজ্ঞেস কর৷’
মেয়েটা কী যেন ভাবল, তারপর আবার ভুরু কুঁচকে তাকাল আমার দিকে, ‘বল দেখি, আমার নাম কী?’
‘স্বাতী দাস৷’
‘বাঃ, আমাদের বাড়ি?’
‘একাত্তর, মহিন চৌধুরী লেন৷’
এবার একটা চওড়া হাসি স্বাতীর মুখ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল, ‘আর একটু কঠিনে যাব?’
‘যা৷’
‘ছোটবেলায় দোতলা থেকে পড়ে তোর একটা হাঁটুর মালাইচাকি সরে গেছিল, কোন হাঁটু?’
‘হাঁটু নয়, কনুই৷ বাঁ কনুই৷’
স্বাতীর মুখটা ক্রমশ আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠছে৷ প্রায় লাফিয়ে উঠে সে জিজ্ঞেস করল, ‘সব মনে পড়ছে তোর? বাড়ির সবার কথা?’
আমি ভাবার চেষ্টা করলাম, হ্যাঁ, আগের থেকে অনেকটা বেশি মনে পড়ছে বটে৷ আমার মা, বাবা, ছোটপিসি, আমাদের বাড়িটার কথাও, কিন্তু এখনই সেটা বলা উচিত হবে না৷ আমি উল্টে একটা প্রশ্ন করলাম, ‘আচ্ছা, একটা কথার ঠিকঠাক উত্তর দিবি?’
‘কী, বল না?’ সে উদ্বিগ্ন হয়ে আমার মুখের দিকে তাকাল৷
‘কালকের অপারেশন নিয়ে ডাক্তারবাবু ঠিক কী বলেছেন?’
‘বলেছেন তুই ঠিক হয়ে যাবি, খালি একটু সময় লাগবে৷’
‘সত্যি তো?’
‘হ্যাঁ রে বাবা, তোকে ছুঁয়ে বলছি৷’
খেয়াল করলাম আমার হাতটা আবার সে মুঠোয় চেপে ধরেছে৷ কথাটা শুনে যেন খানিকটা শান্ত হল মনটা৷ এইরকম অসাড় শরীর নিয়ে বিছানায় আজীবন কাটানোর থেকে মৃত্যু অনেক ভালো৷ তবু যদি সুস্থ হয়ে যাওয়ার খানিকটা আশা থাকে অনেকটা স্বস্তি পাওয়া যায়৷ স্বাতী আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল, ‘কাল যদি পারি চুনিকে নিয়ে আসব৷’
‘চুনি কে?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম৷
‘ওঃ, এটাই মনে পড়েনি! অবশ্য না পড়াই স্বাভাবিক, এতদিন হসপিটালে তাকে আনতেই দেয়নি৷ চুনি আমাদের পোষা কুকুর, তোকে একবছর না দেখতে পেয়ে সে প্রায় আধমরা হয়েছে৷’
‘বেশ, আনিস৷’ কুকুরটার কথা কিন্তু একদম মনে পড়ছে না৷
‘দেখি এবারও ঝামেলা করবে হয়তো৷ আচ্ছা আমি এখন চলি, বাড়িতে খবরটা দিতে হবে, কাউকে পাঠিয়ে দিচ্ছি, গল্প করবে তোর সাথে৷’
স্বাতী উঠে পড়ল৷ ধীর পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল৷ আমিও মাথা ঘুরিয়ে উপরে তাকালাম৷ পাখাটা বনবন করে ঘুরছে, জানলা দিয়ে বাইরে আমার চেনা দৃশ্যগুলো চোখে পড়ছে, হয়তো আমার মনের ভিতর জমা থাকা স্মৃতির জলছবিগুলো কিছুক্ষণের জন্য ধুলোয় ঢেকে গেছিল৷ আস্তে-আস্তে পরিষ্কার হচ্ছে, চোখের সাথে মনের ছবিগুলো মিলে গেলেই আমার সব স্মৃতি ফিরে আসবে৷ আমি আর একবার পা নাড়ানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু নড়ল না৷ ধুর, এখন শরীরটা তাড়াতাড়ি ঠিক হলে বাঁচি৷ কত কাজ করতে ইচ্ছা করছে আমার… মনে হচ্ছে প্রচুর কাজ পড়ে আছে আমার জন্য, অথচ আমি একবছর ধরে পড়ে আছি এই বিছানার উপরে৷ এত কিছু ভাবতে- ভাবতে আমার মন শরীর দুটোই ক্লান্ত হয়ে এল৷ ধীরে-ধীরে ঘুম নামল চোখে৷
বিকেলে ঘুম ভাঙল৷ ভাঙানো হল বলা ভালো৷ এবং চোখ খুলতেই দেখলাম মাঝবয়সী নার্স আমার মুখের উপর ওষুধ ধরে রয়েছেন, ‘ইন্দ্রদা… খেয়ে নিন৷’
আমি ওষুধটা গলায় নিতেই নার্স জল ঢেলে দিল৷ আমি ঢোঁক গিললাম, আবার তোলার চেষ্টা করলাম, প্রথমে পা তারপর হাত৷ ডাক্তার আমার বেডের ঠিক পাশেই বসেছিলেন৷ আমার মুখের উপর প্রায় ঝুঁকে পড়ে কী যেন দেখতে-দেখতে বললেন, ‘শুনলুম আপনি বাড়ির লোকেদের চিনতে পারছেন৷ তো বাড়ি যাচ্ছেন কবে?’
‘সে তো আপনাদের দয়া৷’ আমি হাসলাম৷
‘আরে বলেন কী দাদা, সুস্থ মানুষকে হসপিটালে আটকে রাখে নাকি৷’
‘তাহলে রেখেছেন কেন?’
ডাক্তার কিছু যেন ভেবে বললেন, ‘দেখুন ওষুধ খাইয়ে যাওয়া ছাড়া আমাদের তো আর কাজ নেই৷ সেটা আপনার বাড়ির লোকেরাও পারবে, তারপর তো খালি একটু সময়ের ব্যাপার৷’
‘তাহলে তাই বলুন, আমার আর এখানে ভালো লাগছে না৷’
ওষুধের প্লেট নিয়ে নার্স চলে গেল, বাইরে শহরের আওয়াজ খুব ক্ষীণ হয়ে শোনা যাচ্ছে, এখানে একা-একা শুয়ে থাকতে-থাকতে বুঝি— সবকিছুরই বোধহয় বিশেষ শব্দ আছে; বাচ্চারা সন্ধের মাঠ ছেড়ে ফেরে, মধ্যবিত্তের বাড়িতে রাতের খাবার বানানোর তোড়জোড়, আটা মাখা, কী ভাত বসাও, ভিড়ে ভরা রাস্তার একপাশে ভিখারির ঝুলিতে পয়সা পড়ার শব্দ—এই সবকিছুই যেন এখান থেকে শুনতে পাই আমি৷ মনে হয় আমাকে বাদ দিয়ে বাইরের পৃথিবীটা বেশ নিজের মতো করেই গড়াচ্ছে, ভালোমন্দ মিশিয়ে, সুখদুঃখের মধ্যে জাগলিং করতে-করতে ইচ্ছামতো এগিয়ে চলেছে৷ বাদ পড়েছি শুধু আমি৷ কতদিন এই নগর জীবন থেকে দূরে থাকতে হবে জানি না৷ ডাক্তার অনেকক্ষণ একটানা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন, এবার একটু দম নিয়ে বললেন, ‘স্টিফেন হকিন্সের নাম শুনেছেন?’
আমি নিজের ভাবনায় মশগুল ছিলাম, কথাটা ভালো করে শুনতে পাইনি, মাথা ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কে?’
‘আরে হকিন্স, সেই বিজ্ঞানী, শরীরের প্রায় সমস্তটাই অকেজো, খালি মাথা আর হাতের একটা আঙুল ছাড়া৷’
‘হুম, শুনেছিলাম বটে৷’
ডাক্তার মাথা দুলিয়ে বললেন, ‘আপনার থেকেও খারাপ অবস্থা তাঁর, তাও বছর কয়েক আগে বলেছেন যে তিনি বিশ্বাস করেন ঈশ্বর বলে কিছু নেই৷’
‘হুম, তো?’
‘কতটা সাহস বলুন তো, আমরা একটু কঠিন রোগ হলেই ঠাকুর-ঠাকুর করি৷’
‘আপনিও করেন?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম৷
‘করি বই কী, ডাক্তার বলে কি সব জেনে গেছি?’
আমার এই প্রথম হাসি পেল৷ বললাম, ‘সব যখন জানেন না তখন বিশ্বাসটাই বা করছেন কী করে?’
আমার কথা শুনে ডাক্তারও হেসে ফেললেন, ‘আপনি দেখছি দিব্যি তর্ক করতে শিখেছেন, এটা তো আগে ছিল না৷’
আমি মুখ ঘুরিয়ে নিলাম, বিছানার পাশের টেবিলে কয়েকটা ওষুধ রাখা আছে, তার সাথে দুটো ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ৷ ছোটবেলায় ইঞ্জেকশন নেওয়াটা আমার কাছে বেশ ভয়ের ছিল৷ সেটা এখনও রয়ে গেছে৷ যদিও ব্যথাটা আর লাগে না৷ আমার চোখের দৃষ্টি লক্ষ করে ডাক্তার প্রশ্ন করলেন, ‘ওটা কিসের ওষুধ জানেন?’
আমি শিশির উপরে লেবেলটা পড়ার চেষ্টা করলাম, ‘সোডিয়াম থায়োপেন্টাল, নামটা শুনেছি কোথাও৷’
‘কোথায়?’ ডাক্তারের গলাটা উৎসুক শোনাল৷
‘সম্ভবত এনালজেস্টিক, তীব্র ব্যথা কমাবার ইঞ্জেকশন, কিন্তু ওভারডোজ হলে আর রক্ষে নেই৷’
‘হুম, একসময় ইউএসএ-তে ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট হিসেবে ব্যবহার হত৷ নাহ, আজই ওটা সরিয়ে নিতে হবে৷’
‘কেন বলুন তো?’ আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম৷
ডাক্তার আমার কাছে আর একটু সরে এসে বললেন, ‘এই অপারেশনটা হওয়ার আগে আপনার মাথায় এক ভূত চেপেছিল৷’
‘কী?’
‘আপনি বাঁচতে চাইছিলেন না৷’
আমি আর কিছু উত্তর দিলাম না৷ ডাক্তারও চুপ করলেন৷ বাইরের করিডোর দিয়ে লোকজন যাতায়াত করছে, ঘরের ভিতর যন্ত্রপাতির একটানা শব্দ৷ মাথার উপর একই বনবনে পাখা, জানলা দিয়ে একই দৃশ্য৷ কোনও বৈচিত্র্য নেই; আমার চোখ ফেরানোর মতো পাঁচটা দিক আছে, তার বাইরে কিচ্ছু নেই, গোটা পৃথিবীটা যেন চার দেওয়ালে আটকে গেছে৷ এভাবে কতদিন শুয়ে থাকা যায়? আমি যদি আর ঠিক না হই! একটা নারকীয় আশঙ্কা এসে আমায় চেপে ধরল৷
‘অত ঘাবড়াবেন না, এ ধরনের রোগে পেশেন্টকে সব থেকে বেশি লড়াই করতে হয় নিজের সাথে৷ যখন খুব কষ্ট হবে তখন খালি মনে রাখবেন, এ রোগে মনোবলটাই হল আসল৷ ওটা হারিয়ে ফেললে আর সেরে ওঠার চান্স নেই৷’
ডাক্তারের কথা শেষ হতেই বাইরে থেকে নার্স আবার ঘরে ঢুকল, তারপর আমার দিকে এগিয়ে এসে মাথার কাছের যন্ত্রটায় নজর রাখতে-রাখতে বলল, ‘আপনার বাড়ি থেকে লোক এসেছে৷’
‘কে লোক?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম৷
‘তা তো জানি না, তবে…’
‘তবে কী?’ আমি উদগ্রীব হয়ে উঠলাম, কেন জানি না মনে হচ্ছে বাড়ির সব মানুষকে আমি আবার ভুলে যাচ্ছি৷ এরকম হচ্ছে কেন? আবার কী তবে…
‘একটা ছোট কুকুরও আছে৷’
‘কী যেন নাম বলেছিল… চিনু…’ আমি মনে করার চেষ্টা করলাম৷
‘কথা বলবেন তো?’
আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম৷ নার্সের সাথে ডাক্তারও বেরিয়ে গেল৷ বোধহয় বাইরে আমার বাড়ির লোকজনের সাথে কথা বলতে গেল৷ আমি চুপ করে শুয়ে থাকলাম, কিছু একটা গন্ডগোল হচ্ছে৷ আমারই বাড়ির লোক কিন্তু তাও দেখা করতে ইচ্ছা করছে না আমার৷ উফ, কেন যে হ্যাঁ বললাম! বাইরে থেকে এতক্ষণ একটা কুকুরের ডাক শুনতে পাচ্ছিলাম৷ এবার সেটা একটু-একটু করে কাছে আসছে৷ বুঝলাম তারা আমার কেবিনের দিকেই আসছে৷ আমি তটস্থ হয়ে শুয়ে থাকলাম৷ বড় করে কয়েকটা নিঃশ্বাস নিলাম৷ মাথাটা ব্যথা করছে৷
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে দু-জন মাঝ বয়সি মহিলা আমার ঘরে ঢুকলেন৷ দু-জনকেই আমি চিনতে পারলাম, লম্বা ফর্সা ছোটচুলের মহিলা আমার মা আর তার পাশেই আমার ছোটমাসি৷ প্রায় দৌড়ে তারা আমার বেডের কাছে চলে এলেন, দু-জনেরই চোখে জল৷ আমার অস্বস্তিটা আরও বেড়ে গেল, এবার হয়তো কান্নাকাটি হবে৷ আমি কী উত্তর দেব? কিছুই তো তেমন মনে পড়ছে না৷ ছোটমাসি হাতের ব্যাগ থেকে একটা জবাফুল বের করে আমার কপালে চেপে ধরে কী যেন বিড়বিড় করতে লাগলেন৷ মা আমার মাথায় একটা হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ব্যথা নেই তো বাবা?’
সবাই এটাই জিজ্ঞেস করে কেন? আমি দু-দিকে মাথা নেড়ে দিলাম৷ তিনি আর কিছু বললেন না; মাসি একমনে মন্ত্র পড়ে চলেছেন৷ হঠাৎ আমার মনে হলো ঘরে চতুর্থ কেউ ঢুকছে৷ চতুস্পদ৷ আমি দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলাম একটা ছোট কুকুরের গলার চেন ধরে দাঁড়িয়ে আছে স্বাতী৷ কুকুরটা ছোট৷ জাতে মালতিস৷ বেশ বুঝতে পারলাম স্বাতীর পক্ষে কুকুরটাকে ধরে রাখা আর সম্ভব হবে না৷ সেটা কিন্তু আমার দিকে এখনও তাকায়নি, বরঞ্চ আমার উল্টোদিকে মুখ করে তারস্বরে ডেকে চলেছে৷ স্বাতী দু-হাতে সেটাকে কোলে তুলে নিয়ে আমার পাশে এনে রাখল৷ এমনিতে মালতিস শান্ত জাতের কুকুর, কিন্তু এখন কেন জানি না সেটা অস্থির হয়ে উঠেছে৷ আমি আবার হাত ওঠানোর চেষ্টা করলাম৷ মা কুকুরটাকে আমার দিকে ঠেলে দিতে সেটা মুখ ফিরিয়ে আমার দিকে তাকাল৷ তারপর সেভাবেই একটানা তাকিয়ে থাকল আমার দিকে৷ তার লোমে ঢাকা চোখ দুটো কী যেন খুঁজছে আমার মুখে৷ আমি কী করব বুঝতে পারলাম না৷ হঠাৎ খুব হালকা স্বরে ডেকে উঠল কুকুরটা, তারপর একটু জোরে, তারপর আরও জোরে৷ গলার দড়িটা স্বাতীর হাতে ধরা না থাকলে হয়তো আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ত৷ সেটা করতে না পেরে আচমকা আমার হাতের কাছটা কামড়ে ধরল৷ আমি অবাক হয়ে গেছিলাম৷ তার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার বুকটা ভয়ে দুরুদুরু করতে লাগল৷ হঠাৎ কুকুরটা এত হিংস্র হয়ে উঠল কেন? এতক্ষণে তাকে ছাড়িয়ে নেওয়া হয়েছে৷ আমি নিজের হাতের দিকে তাকালাম৷ হাতটা কেটে রক্ত পড়ছে৷ অবশ্য কোনও যন্ত্রণা হচ্ছে না আমার৷ কুকুরটার গলায় হাত বোলাতে বোলাতে স্বাতী বলল, ‘এতদিন দেখেনি, তোকে ভুলে গেছে বোধহয়৷’
আমার মনটা কিন্তু খচখচ করতে লাগল৷ কুকুর তো এত সহজে ভুলে যায় না৷ আমার অবশ্য তাকে মনে পড়ছে না কিন্তু একবছর আগে পর্যন্ত সে যদি আমাকে দেখে থাকে তাহলে আজও সে আমাকে চিনতে পারবে৷ সেটা তো হলই না উল্টে আমাকেই কামড়ে বসল সে! মা এতক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন, আমি সেদিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এরা তো বলছে ছেড়ে দেবে, আমি বাড়ি যাব কবে?’
মায়ের মুখটা একবারের জন্য গম্ভীর হয়ে উঠল৷ তারপর আবার জোর করে হাসি ফুটিয়ে বললেন, ‘এই তো, কাল-পরশুর মধ্যেই নিয়ে যাব৷ হ্যাঁ রে, বাড়ির কথা মনে পড়ে তোর?’
আমি মাথা নাড়ালাম৷ অবশ্য বাড়ির বাইরেটুকুই মনে পড়ে আমার৷ ভিতরের ঘর বা অন্যকিছুর কথা মনে পড়ে না৷ যাই হোক সেসব এখন আর বলতে ইচ্ছা করল না৷ স্বাতী আমার পায়ের কাছে বসেছিল, সে বলল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ৷ তোকে আর এখানে থাকতে হবে না৷ ডাক্তার দত্ত বলছিলেন উনি নিজেই মাঝে-মাঝে গিয়ে চেক আপ করে আসবেন৷’
একটা অদ্ভুত সন্দেহ আমার মনে দানা বাঁধছে৷ আমি ইশারায় স্বাতীকে কাছে ডাকলাম৷ সে আমার মুখের উপর ঝুঁকে পড়তে নীচু গলায় জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমার হাইট কত?’ প্রশ্নটা শুনে সে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকল, তারপর ঠোঁট উল্টিয়ে বলল, ‘আমি কী জানি!’
‘কত মনে হয়?’
‘পাঁচ আট৷’
আমি আর কিছু বললাম না৷ পরিষ্কার মনে আছে আমার হাইট ঠিক ছ-ফুট৷ কিন্তু তা কী করে হয়? আমার স্মৃতি কি আমার সাথে রসিকতা করছে? সব কিছু এত ঝাপসা, এত ছাড়াছাড়া, তাও কোথায় যেন কী একটা যোগসূত্র আছে৷ কিছু একটা মেলাতে পারলেই সব কিছু মিলে যাবে৷ ঠিক মাকড়সার জালের মতো৷ সব কিছু ছাপিয়ে অন্য একটা ব্যাপার আমার মনে এল৷ এ ঘরের সব কিছু আমার চেনা৷ এই পাখাটা, এই ডাক্তার, নার্স, এদের সবাইকে আমি আগে দেখেছি৷ কিন্তু ঠিক এইভাবেই কি? নাকি একটু অন্যভাবে! আমি চোখ বুজে আমার স্মৃতির সমুদ্রে ভাসতে থাকা ছবিগুলো খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম৷ হ্যাঁ, স্বাতীকে দেখতে পাচ্ছি আমি; মাকে, ছোটমাসিকে, ডাক্তার, নার্স কোথাও কোনও ভুল নেই৷ মনের অন্ধকার ভেদ করে সবক-টা ছবি পরিষ্কার ফুটে উঠছে৷ আমি চোখ খুলতে গিয়েও খুললাম না৷ আশ্চর্য! এ ব্যাপারটা এতক্ষণ মনে আসেনি!
ছবিগুলোতে সবার মুখই আমি দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু তারা সবাই আমার সামনে দাঁড়িয়ে৷ এদের কথামতো আমি একবছর ধরে শয্যাশায়ী৷ তবে আমার মনে যে ছবিগুলো তৈরি হয়ছে সেগুলোও তো নীচ থেকে উপরে তাকিয়ে থাকবে, অথচ সবাই যেন আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে৷ তা কী করে হয়? আমি নিজেই তো একবছর হল উঠে দাঁড়াইনি৷ চোখ খুলে দেখলাম আমার চারপাশে সবাই বসে গল্প করছে৷ খোলা জানলার দিকে তাকালাম, আর সাথে সাথে অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর আমার সামনে পরিষ্কার হয়ে গেল৷ এই জানলা দিয়ে আমি আগেও তাকিয়েছি৷ তবে ঠিক এই ফ্রেমে নয়, এই বেডে শুয়ে নয়৷ দাঁড়িয়ে…
মাথার যন্ত্রণা শুরু হয়েছে… মাথার পিছনে কেউ যেন ধারালো নখ সজোরে ফুটিয়ে দিচ্ছে৷ আমি চিৎকার করে উঠলাম… জ্ঞান হারাচ্ছি… কে আমি? আমার ক্ষীণ হয়ে আসা চিন্তাশক্তির স্তর ভেদ করে কে যেন উত্তর দিল…
ত্রিবেলা যখন জ্ঞান ফিরল তখন ঘরটা অন্ধকার৷ মনে হচ্ছে কেউ যেন মাথার ভিতরের সব কিছু বের করে নিয়েছে; ফাঁকা, ভিতরে কিচ্ছু নেই৷ পা দুটো নাড়ানোর চেষ্টা করলাম, সাথে হাত দুটো৷ নড়ল না৷ ঘরে কেউ বসে আছে৷ আমার ঠিক সামনেই৷ অন্ধকারের ভিতর আমি ছায়ামূর্তিটা খানিকটা দেখতে পেলাম, ‘তোমাকে একটা কথা জানানোর আছে সোমনাথ৷’
ডাক্তারের গলা৷ আমি চিৎকার করে উঠলাম, ‘কে সোমনাথ? আমার নাম ইন্দ্রনাথ দাস!’
‘ও হ্যাঁ, ইন্দ্রনাথ৷ তোমার শরীরটা ঠিক হওয়ার কোনও আশা নেই৷’ ডাক্তারের গলা আশ্চর্য রকম শান্ত৷ একখণ্ড বরফের মতো কথাগুলো আমার বুকের উপর আছড়ে পড়ল৷
‘কে বলছে?’
‘বলার কিছু নেই, সবাই জানে৷’
আমি চারপাশ ভালো করে ঠাওর করার চেষ্টা করলাম৷ ডাক্তার এখনও একই ভাবে সেই চেয়ারটায় বসে আছে, অন্ধকারে তার মুখ দেখা যাচ্ছে না৷ এবার তিনি উঠে দাঁড়ালেন, এক পা-এক পা করে এগিয়ে এলেন আমার দিকে৷ আগের মতোই ঠান্ডা গলায় বলে চললেন, ‘তুমি আমায় স্টিফেন হকিন্সের কথা বলেছিলে…’
‘আমি! শালা আপনি আমায় বলেছিলেন৷’ আমার গলা ফেটে উন্মত্ত চিৎকার বেরিয়ে এল৷
‘তো আমি তোমাকে অন্য একটা গল্প বলি? এটা অবশ্য ওই যাকে বলে ফ্যান্টাসি নয়, একদম পাশের বাড়ির গল্প৷ রগরগে, নৃশংস, মানে যেমনটা হয় আর কী৷ স্পেনে এক ভদ্রলোক থাকতেন জানো৷ তার নাম রামন সাম্পেদ্র৷ পেশায় জেলে, নেশায় কবি৷’
‘এসব আমাকে বলছেন কেন?’
‘আরে শোনোই না, জ্ঞান বাড়বে৷ তা একদিন হল কী—রামন গেল মাছ ধরতে ক্ষীর নদীর কূলে আর উঁচু পাহাড়ের উপর থেকে পড়ে তার ঘাড় গেল মটকে৷ ডাক্তার বলল যে বাকি জীবনটা তার গলার নীচ থেকে শরীরটা আর নড়বে না৷ স্রেফ ল্যাত খেয়ে পড়ে থাকা ছাড়া আর কিচ্ছু করতে পারবে না৷ মানে একদম হাগু মুতু পর্যন্ত লোকে করিয়ে দেবে, গালে মশা কামড়ালে লোকে মেরে দেবে, এমনকি কানে কেঁচো ঢুকতে দেখলেও দাঁত কেলিয়ে চুপচাপ দেখা ছাড়া উপায় নেই৷ ফলে রামনের হল দুক্ষু, এত দুঃখ হল যে সে বলল তাকে বিষ খাইয়ে মেরে দিতে৷ কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘণ্টি বাঁধবে কে! কারণ বেঁচে থাকাটা যত কষ্টেরই হোক না কেন মানুষের পক্ষে মানুষ মারাটা ঘোর অন্যায়৷ নরকবাস৷ ব্যস! ফলে রামনকে আর কেউ মারল না, রামন বাঁচিয়া প্রমাণ করিল সে বাঁচে নাই৷ কিন্তু সে হাল ছাড়ল না৷ লড়াই চালিয়ে গেল, ওই বিছানায় হাগুমুতু করতে করতেই, তিরিশ, হ্যাঁ, তিরিশ বছর ধরে৷ কিসের লড়াই জানো? তেমন বড় কিছু দাবি নয়৷ রোটি, কাপরা, মাকান কিসসু নয়, শুধু এক ছিলিম বিষ পাশের টেবিল থেকে তুলে তার শরীরে পুশ করে দিতে হবে৷ বেচারা! হাত পা অসাড় হয় গেলে শহিদ পর্যন্ত হওয়া মুশকিল৷ যাই হোক তা তিরিশ বছর লড়াই করে শেষ পর্যন্ত বিষ খেয়ে রামন পৃথিবীর এথিক্যাল চিন্তাবিদদের কলা দেখিয়ে ড্যাং ড্যাং করে স্বর্গে গেল…’
ডাক্তার থামলেন৷ বোধহয় একটু নিঃশ্বাস নিলেন৷ আমি কিছু বললাম না৷ জানি কিছু বলেই লাভ নেই, কারণ কথা বলাটুকুই আছে আমার৷ এই মুহূর্তে তাতে কোনও লাভ হবে না৷ ডাক্তার আমার হাতটা চেপে ধরলেন, ‘মনে পড়ছে ডাক্তার? দু-দিন আগে ঠিক এই বেডটায় আমি শুয়ে ছিলাম৷ মরতে চেয়েছিলাম৷ না হয় আমার ঘুমের মধ্যেই একদলা থায়োপেন্টাল ঢুকিয়ে দিতেন মুখে, আমি সারারাত চিৎকার করেছি, যদি হাতদুটো কাজ করত তাহলে আপনার পায়েও ধরতাম৷ এতদিন ধরে শুধু একটাই কথা বলতে চেয়েছিলাম আপনাকে, ‘আমি বাঁচতে চাই না, ডাক্তারবাবু আমায় মেরে ফেলুন, আর পারি না আর পারি না৷’ কিন্তু না, আপনি আমায় বলেছিলেন মনের জোর রাখতে, ভগবান আছে, নিশ্চয়ই কিছু ব্যবস্থা করে দেবেন৷ তারপর পরশু রাতের কথা মনে পড়ে ডাক্তার? শেষ প্রশ্ন করেছিলাম আপনাকে, ‘আমার জায়গায় থাকলে আপনি কী করতেন?’ আপনি কী উত্তর দিয়েছিলেন মনে পড়ে? হেহে হেহে…৷ এখন ভাবলেও ভীষণ আনন্দ হচ্ছে জানেন? আপনিও খুশি, আমিও খুশি, কেমন অদলবদল হয়ে গেল বলুন দিকিনি, অ্যাঁ? হেঁহেঁ… সারারাত ভগবানের কাছে শুধু এটাই চেয়েছিলাম, হয় আমাকে কাল সকালের আলো দেখিও না, না হলে ওই ডাক্তারের শরীরটা দিয়ে দাও আমাকে, আমারটা ওকে৷ আপনাকে কী বলব মাইরি, সকালে উঠে যখন দেখলাম আমার হাত পা নড়ছে, ভাবলাম আপনার পা চেটে ধুলো খাব, তারপর আয়নায় চোখ পড়তেই ভিরমি খাচ্ছিলাম৷ একটু পরে বুঝলাম শালা ভগবান আমার দ্বিতীয় ইচ্ছাটাই শুনেছেন, ভগার আজব রসিকতা মাইরি, অ্যাঁয়? হেঁহেঁ, কী বলেন?’
আমার কথা বলার শক্তিটাও যেন নিভে আসছে, শেষ চোখ পড়ল ওষুধের শিশিগুলোর দিকে৷ থায়োপেন্টাল৷ আমি সমস্ত জোর একত্র করেও হাতটা নাড়াতে পারলাম না৷ মুখ দিয়ে চিৎকার বেরল না৷ ডাক্তার একটা শয়তানি হাসি হেসে ওষুধের শিশিটা টেবিলের উপর একবার নাড়িয়ে আবার রেখে দিয়ে বললেন, ‘ভাবছি ডাক্তারি ছেড়ে অন্যকিছু করব; এই পেশাটা আর পোষাচ্ছে না, ধুসসস… এই রইল আপনার ওষুধ, এই রইল সিরিঞ্জ, নিজগুণে নিয়ে নেবেন৷ আমি চলি, হ্যাঁ? ও হরি, আমার নামটাই তো বলা হয়নি আপনাকে৷ নমস্কার, আমি ডাক্তার সোমনাথ ঘোষ৷’
ডাক্তার ঘর থেকে বেরিয়ে গেল৷ আমি স্থির চোখে তাকালাম ফ্যানের ব্লেডগুলোর দিকে৷ তার ঠিক উপরেই প্রবল হাওয়ার দাপটে ছটফট করছে একটা মাকড়সার জাল৷ মাকড়সাটা কোথায়? ও হ্যাঁ, সেটা ধীরে-ধীরে জাল বেয়ে নেমে আসছে আমার মুখের উপর৷ আমি হাত নড়ানোর চেষ্টা করলাম…