রাজনীতি
অভিযান ও পর্যটন
সমাজসেবা
জ্ঞান ও শিক্ষা
2 of 2

মাও-সে-তুং (১৮৯৫–১৯৭৬) – চীন সাধারণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা

মাও-সে-তুং (১৮৯৫–১৯৭৬) – চীন সাধারণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা

চীন সাধারণতন্ত্রের যিনি প্রতিষ্ঠাতা এবং পৃথিবীর বুকে সুসভ্য জাতি হিসেবে চীনকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যাঁর অবিস্মরণীয় অবদান, বিশ্বের শোষিত, নিপীড়িত মানুষের মুক্তির অগ্রদূত সেই মহান বিপ্লবী পুরুষের নাম মাও-সে-তুং (Mao-Tse-Tung)।

তাঁর জন্ম হয়েছিল চীনের বড় এক দুঃসময়ে। এই সময় চীনকে তিন ভাগে ভাগ করে শাসন করত তিনজন অত্যাচারী রাজা। তাদের পাইক-পেয়াদারা দেশের গরিব চাষিদের ওপর চালাত অকথ্য অত্যাচার। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যেত অনাহারে। চারদিকে ছিল অনিয়ম আর জুলুমের রাজত্ব।

এমনই দুঃসহ সময়েই চিনের হুনান প্রদেশের সানসিন গ্রামের এক গরিব চাষির ঘরে ১৮৯৬ সালে মাও-এর জন্ম। বাবা মাও-জেন-সেন ছিলেন সাধারণ চাষি। ছয় বছর বয়স থেকেই মাওকে বাবার সঙ্গে ধানের জমিতে কাজ করতে যেতে হতো।

মাওয়ের যখন আট বছর বয়স, তখন তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় গ্রামের এক প্রাথমিক স্কুলে। এখানে পড়ার সময়েও তাঁকে সকাল-বিকালে বাবার সঙ্গে মাঠে কাজ করতে হতো। এই কাজ করার জন্যই স্কুলের পড়া তৈরি করতে পারতেন না কিশোর মাও। ফলে স্কুলে গিয়ে পড়া না বলতে পারার জন্য মার খেতে হতো। তবে লেখাপড়ার প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল তাঁর। বাতি জ্বালিয়ে বাবা পড়াশোনা করতে দিতেন না। নিজের ঘরের জানালা বন্ধ করে তবেই পড়াশোনা করতেন তিনি।

এই সময়ের একদিনের ঘটনা। তাঁদের স্কুলে এলেন এক নতুন শিক্ষক। তিনি ধর্ম- কর্ম সম্পর্কে খুব উৎসাহিত ছিলেন না। তিনি বলতেন, দেশে যত দেবদেবীর মন্দির আছে, সব ভেঙে দিয়ে সেখানে স্কুল খুলে দিতে হবে। এ ছাড়াও তিনি গরিব মানুষের কথা, তাদের অভাব-অভিযোগের কথা বলতেন। রাজার অত্যাচারের কাহিনী শোনাতেন। শিক্ষকের কথাগুলো খুব ভালো লাগত কিশোর মাওয়ের।

এরপর তিনি হুনান প্রদেশের রাজধানী চাংশা শহরে একটি স্কুলে ভর্তি হন। কিন্তু এখানে বেশিদিন থাকা সম্ভব হয়নি। এই সময়েই তিনি একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। সেই বছরেই তিনি বিপ্লবীদের দলে যোগদান করেন। রাজার বিরুদ্ধে বিপ্লব করে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে—এই প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মাও বিপ্লবী সেনাবাহিনীতে নাম লেখালেন মাসে সাত ডলার বেতনে। মাস ছয়েক পরে বিপ্লবী সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি আবার ভর্তি হন কমার্শিয়াল কলেজে। এরপর তিনি আরও কয়েকটি স্কুল বদল করে এসে ভর্তি হন নর্মাল স্কুলে।

মাওয়ের বয়স যখন মাত্র চৌদ্দ বছর, তখন তাঁর বাবা তাঁকে বিয়ে দেন বিশ বছরের এক মেয়ের সঙ্গে। তবু ঘরে মন বসল না মাওয়ের।

১৯১৭ সালে তিনি বন্ধুদের নিয়ে গঠন করলেন একটি ‘গণ-পাঠচক্র সংঘ’। এই সংঘের সঙ্গে জড়িত হয়ে তিনি দীর্ঘ তেরো বছর কাটিয়ে দেন চিয়াংকাংসনের এক পাহাড়ে। সেখানে তাঁর অনেক সাথি বন্ধুও ছিল।

এরপর তিনি চলে এলেন পিকিং শহরে। এখানে এসে এক লাইব্রেরিতে চাকরি নিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানেও বেশিদিন থাকা সম্ভব হলো না। অভাবের তাড়ানায় তিনি পিকিং ছেড়ে চলে এলেন সাংহাই-এ।

১৯২০ সালে তৃতীয় আন্তর্জাতিকের সময় জনৈক প্রতিনিধি আসেন সাংহাইতে। তিনিই এখানে কমিউনিস্ট পার্টির গোড়াপত্তন করেন। ১৯২১ সালে মাও চীনা পার্টি গঠন করেন এবং এই বছরেই হুনানে কমিউনিস্ট পার্টির প্রদেশিক শাখা গঠিত হলে মাও এর সদস্যপদ লাভ করেন।

চীনের প্রেসিডেন্ট ডা. সান ইয়াৎ সেন মারা গেলে ১৯২২ সালে ক্ষমতায় আসেন চিয়াং কাই-শেক। তিনি ক্ষমতায় বসেই কমিউনিস্টদের খতম করতে শুরু করলেন। এই সময়ই কুয়োমিনতাং দল থেকে বের করে দেওয়া হতে লাগল কমিউনিস্টদের। অনেকে দেশ ছেড়ে পালাল। মাওয়ের ওপর আদেশ হলো সিচুয়াংস চলে যাওয়ার।

সেই বছরই নানচাংয়ে চিয়াং কাই-শেকের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহ দেখা দেয়। চিয়াংবাহিনীর হাতে মাও-সে-তুংও গ্রেফতার হন। তাঁকে মিনতুয়ানের প্রধান শহরে নিয়ে যাওয়ার আদেশ দেয়া হয়। কিন্তু পথিমধ্যে তিনি কৌশলে পাহারাদারদের চোখ ফাঁকি দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যান।

সরকারি বাহিনীর অতাচার ও আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য ১৯২৯ সালে একটি ফ্রন্ট কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটির চেয়ারম্যান হলেন মাও-সে-তুং।

তারপর চলল গ্রামের পর গ্রাম ও শহরের পর শহর দখল। জমিদারদের জমি দখল করার পর তা কৃষকদের হাতে তুলে দিতে শুরু করল এই ফ্রন্ট। কলকারখানার শ্রমিকদের নিয়ে গড়ে উঠল গেরিলা ইউনিট।

১৯৩০ সালের জুন মাসে তৃতীয় লাল ফৌজ ও আর্মি কোর একত্রে চাংসার দিকে অগ্রসর হতে লাগল। মাও নির্বাচিত হলেন রাজনৈতিক কমিশার।

চিয়াং সরকার এই সময় মাও-সে-তুংকে ধরার জন্য ঘোষণা করল পুরস্কার এবং হুনান প্রদেশে তাঁর পারিবারিক সকল সম্পত্তি করল বাজেয়াপ্ত। শুধু তা-ই নয়, মাওয়ের স্ত্রী, ছোট বোন ও দুই ভাইকেও গ্রেফতার করা হলো। স্ত্রী ও ছোট বোনকে দেওয়া হলো ফাঁসি।

অবশেষে মাও-সে-তুংকে নির্মূল করার জন্য চিয়াংবাহিনী এক লক্ষ সৈন্য নিয়ে অতর্কিতে ঘিরে ফেলল তাঁর আশ্রয়স্থলের চারপাশ। লালফৌজে ছিল মাত্র চল্লিশ হাজার সৈন্য। যাইহোক, লালফৌজের গেরিলা আক্রমণে সরকারি বাহিনী হলো পর্যুদস্ত।

চারমাস পর মার্কিন অস্ত্রে সজ্জিত দুলাখ সৈন্য আবার আক্রমণ করল লিয়াংশি। এবারও জয় হলো মাওয়ের।

ফলে দিশেহারা হয়ে চিয়াং এবার নিজেই এলেন মাওয়ের বিরুদ্ধে তিন লক্ষ সৈন্য নিয়ে। কিন্তু এ যুদ্ধেও কমিউনিস্টদের জয় হলো।

১৯৩১ সালে চীনা কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশন বসে। এতে মাও আবারও চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন এবং মাওয়ের নেতৃত্বে গঠন করা হয় কমিউনিস্ট সরকার। এই সরকার গঠিত হয়েছিল দক্ষিণ চীনে। এর চারদিকে তখন ছিল সরকারি বাহিনী। তাই কমিউনিস্টরা সিদ্ধান্ত নিল উত্তর চীনে চলে যাওয়ার। ১৯৩৪ সালে মাও-সে-তুং-এর নেতৃত্বে উত্তর দিকে রওনা দিল কমিউনিস্টরা। এটাই ইতিহাসে লং মার্চ নামে খ্যাত। এই লং মার্চ করে উত্তর চীনে পৌঁছুতে তাদের সময় লেগেছিল দীর্ঘ কয়েক বছর।

১৯৩৯ সালে শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ১৯৪২ সালে জাপান দশ লক্ষ সৈন্য নিয়ে এল চীন দখল করতে।

মাও-সে-তুং-এর নেতৃত্বে ছিল এক কোটি নিয়মিত সৈন্য এবং আরো এক কোটি স্বেচ্ছাসেবকের এক সুবিশাল বাহিনী। কমিউনিস্টদের সঙ্গে লড়াই-এ জাপবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়।

জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় মাও-সে-তুং-এর সঙ্গে চিয়াং কাই-শেকের একটি অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল।

কিন্তু মহাযুদ্ধ শেষ হয়ে যাবার পরই চিয়াং কাই-শেক চুক্তি ভঙ্গ করে আবার কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লাগে। এদিকে হিটলারবাহিনীর সাথে ভয়ংকর যুদ্ধের পর কমিউনিস্ট বাহিনীও ক্লান্ত। এই সুযোগে চিয়াংবাহিনী কমিউনিস্টদের রাজধানী ইয়েনান দখল করে নেয়। মাও-এর নেতৃত্বে কমিউনিস্ট বাহিনী পিছু হটে গিয়ে শুরু করে পালটা গেরিলা আক্রমণ। আর এভাবেই ১৯৪৭ সালের জুলাই থেকে ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসের মধ্যে চিয়াংবাহিনীর ২২,৫০,০০০ সৈন্য খতম করে দেয় কমিউনিস্টরা এবং ৪৩, ০০, ০০০ সৈন্য যোগ দেয় কমিউনিস্টদের সঙ্গে। মুক্তিফৌজ ১৯৪৮ সালেই ৪৮০টি শহর দখল করে নেয়।

তারপর ১৯৪৯ সালের ১৪ অক্টোবর মুক্তিফৌজের অগ্রগামী দল ক্যান্টনে প্রবেশ করে। চিয়াং কাই-শেক ও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা চীনের বিশাল ভূখণ্ড ছেড়ে মূল ভূমির ৮০ মাইল দূরে ক্ষুদ্র দ্বীপ ফরমোজায় (বর্তমান নাম তাইওয়ান) গিয়ে আশ্রয় নেয়।

১৯৪৯ সালের ২১ সেপ্টেম্বর মাও সে তুং চীনা সাধারণতন্ত্রের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এতদিনের সংগ্রামের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সহযোগী চৌ-এন-লাই নির্বাচিত হন প্রধানমন্ত্রী। মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত মাও-সে-তুং ছিলেন চীনের চেয়ারম্যন এবং দেশের অবিসংবাদিত নেতা।

মাও-সে-তুং-এর মৃত্যু হয় ১৯৭৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর। আজও তিনি সারা বিশ্বের শোষিত মানুষের সংগ্রামের মূর্ত প্রতীক হয়ে বেঁচে আছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *