মাইন্ড গেম
তাত্ত্বিক পদার্থবিদেরা (Theoretical physics) ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করার চেয়ে মনে মনে অর্থাৎ কল্পনায় পরীক্ষা করতে পছন্দ করেন। এই পরীক্ষাগুলোকে বলে Thought experiment। শ্রোডিনজারের বিড়াল হলো চিন্তাপরীক্ষার সবচেয়ে ভালো উদাহরণ।
আমরা আমজনতারা চিন্তা পরীক্ষা করতে পারি না। তবে Mind game বা চিন্তা খেলা খেলতে পারি। এই খেলা আমার বিশেষ পছন্দের। খেলার নমুনা দিচ্ছি। একটি আট বছরের বালকের সঙ্গে এই খেলা খেলছি। বালকটির নাম ধরা যাক শুভ্র। মার এবং তার মধ্যে কথোপকথন
আমি : শুভ্র! কেমন আছো?
শুভ্র : ভালো আছি।
আমি : তুমি কাকে বেশি ভালোবাসো? মাকে নাকি বাবাকে?
শুভ্র : দুজনকেই সমান সমান (৯৯% শিশু এই জবাব দেবে)
আমি : ভালো করে চিন্তা করে বলো–সমান সমান?
শুভ্র : হুঁ।
আমি : আচ্ছা বেশ, এখন কল্পনা করো তুমি তোমার মাকে এবং বাবাকে নিয়ে নৌকায় করে যাচ্ছো [মাইন্ড গেম শুরু হয়ে গেল]।
শুভ্র : কল্পনা করছি।
আমি : নৌকায় শুধু তুমি আর তোমার বাবা-মা। মাঝিও নেই।
শুভ্র : আচ্ছা।
আমি : এই তিনজনের মধ্যে শুধু তুমি সাঁতার জানো। বাকি দুজন সাঁতার জানে। ok?
শুভ্র : জি, ok
আমি : তুমি এতই ভালো সাঁতার জানো যে নৌকা ডুবে গেলে বাবা-মা দুজনের একজনকে বাঁচাতে পারবে। বুঝেছ?
শুভ্র : বুঝেছি।
আমি : এখন মনে করো নৌকা ডুবে গেল। তোমার বাবা-মা দুজনই ডুবে যাচ্ছেন। এখন বলো তুমি কাকে বাঁচাবে? বাবাকে না মাকে? [মাইন্ড গেম শুরু হলো]
শুভ্র : দুজনকেই বাঁচাব।
আমি : তোমাকে আগেই বলা হয়েছে তুমি শুধু একজনকে বাঁচাতে পারবে। বেশির ভাগ শিশু এই পর্যায়ে হতভম্ব হয়ে পড়ে। বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে। কারও কারও চোখে পানি এসে যায়।
মনের ওপর চাপ তৈরির এই কঠিন খেলা এখন আমি আর খেলি না।
কারণটা বলি—
এক বালিকা মাইন্ড গেমের এই পর্যায়ে এসে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, আমি মাকে বাঁচাব আর আল্লাহ বাবাকে বাঁচাবে।
তখনই ঠিক করেছি, এই নিষ্ঠুর খেলা শিশুদের সঙ্গে খেলব না।
আমার এই মাইন্ড গেমের ফলাফল বলি। ১০০ ভাগ শিশুই বলেছে তারা মাকে বাঁচাবে। হঠাৎ হঠাৎ এক-আধজন পাওয়া যায়, যারা বাবাকে বাঁচাতে চায়। ঔপন্যাক ইমদাদুল হক মিলনের ছোট মেয়ে (লেখা) তাদের একজন। আমি তাকে বললাম, বাবাকে বাঁচাতে চাও কেন?
সে বলল, বাবা লেখক তো, এইজন্যে বাবাকে বাঁচাব।
তোমার বাবা লেখক না হলে মাকে বাঁচাতে?
অবশ্যই।
মিলন-কন্যার কথাবার্তায় আমি খানিকটা আশ্বস্ত বোধ করলাম। লেখক হওয়ার কারণে আমার শিশুপুত্র হয়তো বা আমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করবে। বাস্তবে দেখা গেল সেই গুড়ে বালি না, একেবারে কঙ্কর!
পুত্র নিষাদের সব খেলাধুলা আমার সঙ্গে। আমি তার টম অ্যান্ড জেরি কাটুন দেখার সাথি। ছবি আঁকার সাথি। সে যখন ঘরের দেয়ালে ছবি আঁকে, তখন তার মা তাকে কঠিন শাসন করে। শুধু আমি বলি, ছবি সুন্দর হয়েছে। বিশেষ করে রাক্ষসের ছবিটা তো অসাধারণ।
এতকিছুর পরেও নিষাদের মাথায় তার মা ছাড়া কিছু নেই।
প্লেনে করে দেশের বাইরে যাচ্ছি। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া। বিমান খুব বাম্প করছে। আতঙ্কিত নিষাদ বলল, বাবা, তুমি মাকে বাঁচাও।
আমি বললাম, তোমাকে বা নিনিতকে বাঁচাতে হবে না?
সে বলল, আগে মাকে বাঁচাও।
লস অ্যাঞ্জেলেস, ইউনিভার্সেল স্টুডিওতে গিয়েছি। ওদের জন্যে একটা রাইড নিয়েছি। এই রাইডে থ্রিডির কিছু কাজ আছে। যাত্রার একপর্যায়ে প্রকাণ্ড এক গরিলার দেখা পাওয়া যাবে। থ্রিডির কল্যাণে গরিলাকে মনে হবে জীবন্ত।
যাত্রা শুরু হলো। একপর্যায়ে সত্যি সত্যি ভয়ংকর এক গরিলার (কিং কং) দেখা পাওয়া গেল। ভালোমতোই জানি, পুরো বিষয়টা থ্রিডি ক্যামেরার কারসাজি। তার পরও আমাদের কলিজা শুকিয়ে গেল। নিষাদ ক্রমাগত চেঁচাতে লাগল–বাবা! আমার মাকে বাঁচাও। বাবা! আমার মাকে বাঁচাও।
পৃথিবীর সব শিশু তাদের মাকে বাঁচাতে চায়। মায়ের পায়ের নিচে বেহেশত–এই (হাদিস?) কথা সবসময় বলা হয়ে থাকে। তারপরও মা কী করে শিশুসন্তানকে হত্যা করেন?
পত্রিকায় পড়লাম, এক মা তার দুই শিশুসন্তানকে নিয়ে ঝাঁপ দিয়ে চলন্ত ট্রেনের সামনে পড়েছেন। এই মহিলা নিজে ঝাঁপ দিতে চাইলে ঝাঁপ দেবেন। অবোধ সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে কেন?
স্বামীর সঙ্গে রাগ করে স্বামীকে শিক্ষা দেওয়ার জন্যে এক মা সন্তান হত্যা করলেন। এই মা কেমন মা?
আমেরিকার এক তরুণী মা তার নয় মাস বয়সী সন্তানকে মাইক্রোওয়েভ চুলায় ঢুকিয়ে চুলা চালু করে হত্যা করলেন। হত্যাকাণ্ডে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার। কী ভয়ংকর!
বিড়ালকে নিজের সন্তান হত্যা করে খেয়ে ফেলতে আমি দেখেছি। বাঘও নাকি এ রকম করে। আমরা কি বিড়াল এবং বাঘের ওপর উঠতে পারি নি? এখনো পশু হয়ে আছি?
ভালো লাগছে