বাঙালির মাংস খাওয়া
ঝাল ঝাল গরগরে খাসির মাংস ছাড়া এখনও বাঙালির ছুটির দুপুর অসম্পূর্ণ। আর খাসির মাংস হলে সঙ্গে মেটে মাস্ট । ‘আমি শ্রী শ্রী ভজহরি মান্না’ গানেও মান্না দে গেয়েছেন, ‘মাংসটা ঝাল হবে মেটে হবে আশিটা।’ তবে আমাদের মাংস রান্নার রীতি মূলত মোগলাই অথবা চিনা কায়দায়। ইদানীং অবশ্য জাপানি বা ফরাসি কায়দার মাংসও বাঙালির পাতে শোভা পাচ্ছে।
ভাবদেশ ভট্ট-র একটা রচনায় পাওয়া গেছে, শুকনো মাংস খাওয়া কোনও কালেই হিন্দুদের (বাঙালি) ধর্মীয় রীতি নয়। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে হিন্দুদের মধ্যে কিন্তু পাঁঠার মাংসের চল তেমন ছিল না। বরং অপবিত্র রেওয়াজ বলে ধরা হত। বাঙালিরাই প্রথম পাঁঠার মাংসের স্বাদ এ দেশকে চিনিয়েছে। সেসময় তাদের দ্বিতীয় শ্রেণির হিন্দু ধরা হয়েছিল ধর্মের নিরিখে। কারণ, যে সংস্কারপন্থী হিন্দুরা এই বাঙালি হিন্দুদের দ্বিতীয় শ্রেণি বলতেন, তাঁরাই বলেছেন, সবচেয়ে কঠিন হল স্বাদেন্দ্রিয়কে জয় করা। শ্রীহর্ষের রচিত ‘নিষাদ চরিত’ মহাকাব্যে বারো শতকের বাঙালির খাদ্যরীতির বিস্তর বর্ণনা পাওয়া যায়। এই কাব্যে নল আর দময়ন্তীর বিয়ের অনুষ্ঠানে পাঁঠার সুস্বাদু ঝোলের স্পষ্ট উল্লেখ আছে। কবি মুকুন্দ চক্রবর্তী ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যে নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছেন, ফুল্লরা কালকেতুর জন্য বিভিন্ন পদের সঙ্গে সঙ্গে পাঁঠার মাংস রান্না করতেন। এই ইতিহাসকে সামনে রেখে সুকুমার সেনও তৎকালীন বাঙালির খাদ্যরীতির বিশদ গবেষণা ও বর্ণনা করেন। যদিও সেখানে পাঁঠার মাংসের ঝোল -এর পূর্ণ সম্মতি নেই। বরং কাবাব-এর প্রচলন ছিল, তার সঙ্গে তিনি সহমত। ১৫ শতকের পর থেকেই খাঁটি বাঙালি সংস্কৃতির দলিল পাওয়া যায়। মঙ্গলকাব্য এবং বৈষ্ণব সাহিত্য বাঙালির খাদ্যপ্রীতির ঐতিহাসিক দলিল। মনসামঙ্গল কাব্যে উল্লেখ আছে, বাঙালিরা পাঁঠার মাংস আর সুরা পান করতেন। নারায়ণ দেবের মনসামঙ্গল কাব্য-এ বেহুলার বিয়ের অনুষ্ঠানে বারো রকম মাছ এবং ন-রকমভাবে পাঁঠার মাংস রান্নার বর্ণনা পাওয়া গেছে। ঘনরাম চক্রবর্তীর ধর্মমঙ্গল-এ অকপট বলা আছে, রাজারা, এমনকি সাধুরাও পাঁঠার মাংস উপভোগ করতেন।
ঈশ্বর গুপ্ত পাঁঠার মাংসের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। সত্যি বলতে এই সময় থেকেই ‘নাগরিক বাঙালি’ তৈরি হতে শুরু করে। ‘ব্যঞ্জন রত্নাকর’ নামক এক অভিনব রান্নার বইয়ের প্রকাশনা সেই সময় হয়। বর্ধমানের রাজা মহতাবচাঁদের আদেশে এই বইতে পাঁঠার মাংস রান্নার যেসব খুঁটিনাটি পাওয়া গিয়েছে, তা শাহজাহানের প্রধান রাঁধুনি নিয়ামৎ খান দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত। এই বইতে আঠেরো রকম কাবাব আর উনিশ রকম কালিয়ার উল্লেখ আছে। বর্ধমানের রাজারা প্রায় দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় এইগুলি উপভোগ করতেন। অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত মাংসের ঝোলে আলু ব্যবহার করা হত না। শুধু তাই নয়, ঝোলে নুনও ব্যাবহার করা হত না। মনে করা হত, নুন ব্যবহার করলে রান্না অশুদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তবে মাংস কোনও শুভ সামাজিক অনুষ্ঠানে স্থান পেত না। ১৬৫০-এর পর থেকে মুঘল এবং ইউরোপিয়ান দ্বারা বাঙালিরা খুবই প্রভাবিত হয়। অষ্টাদশ শতকে ‘ভদ্রলোক বাঙালি’-র সৃষ্টি হয়। যাঁরা মুঘলদের পৃষ্ঠপোষকও ছিলেন এবং আধুনিক বাঙালির সৃষ্টি এই সময় থেকেই। পেঁয়াজ, রসুন দিয়ে মাংস রান্না সেই সময় থেকে শুরু হয়। নানারকম মশলার মিশ্রণ ঘটে মাংসের ঝোলে।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে স্বামীজি চিঠিতে পরিষ্কার জানিয়েছেন যে, তাঁকে পাঁঠার মাংস এবং গোমাংস দুই-ই খেতে হয়েছে। তাতে সমসাময়িক গোঁড়া হিন্দুরা রে রে করে ওঠেন। সন্ন্যাসীর পাতে আমিষ! স্বামীজির খুব কড়া ভঙ্গিমায় বলেন, “All liking for fish and meat disappears when pure sattva is highly developed.” পাঁঠার মাংস খাওয়ার সমর্থনের মধ্যে দিয়ে খাদ্যরসিক বিবেকানন্দকে আবিষ্কার করা না গেলেও, সাহসী এবং মুক্ত বিবেকানন্দ প্রতীয়মান। বাঙালি হিসেবে আর-একজনের নাম উল্লেখ না করলেই নয়, তিনি সত্যজিৎ রায়। রাশিয়ায় থাকাকালীন তিনি সকালে চার কাপ চা আর প্রায় এক পাউন্ড পাঁঠার মাংস ‘সাম্পা’ দিয়ে খেতেন। বাঙালি হিসেবে ঝালে-ঝোলে-অম্বলে রবীন্দ্রনাথ। তাঁর সময় ঠাকুরবাড়িতে ‘পাঁঠার বাংলা’ নামক এক পদের উল্লেখ আছে। ১৯৪১ সালে, কবিগুরু মৃত্যুর ঠিক দুই বছর আগে কালিম্পং থেকে জোড়াসাঁকোতে আসেন ক্লান্ত, অবসন্ন শরীর নিয়ে। এই বিশেষ পাঁঠার মাংস তাঁর খাদ্যতালিকায় ছিল। এই মেনু বাঙালির খাদ্যতালিকায় অবলুপ্ত। রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন, “Do not blame the food because you have no appetite.” তাঁর খুব প্রিয় খাদ্যের মধ্যে ছিল কাবাব। তা ছাড়াও তিনি খুব পছন্দ করতেন আনারস দিয়ে তৈরি রোস্টেড পাঁঠার মাংস। নানান রান্নার ক্ষেত্রেই প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের এক অদ্ভুত মেলবন্ধন ঠাকুরবাড়ির হেঁশেল ঘটিয়েছিল। পূর্ণিমা ঠাকুর ‘ঠাকুরবাড়ির রান্না’ বইতে তা লিপিবদ্ধ করেছেন।
তবে বেশ কয়েকশো বছর আগে, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের নামও যখন কেউ শোনেনি, তখন হরিণের মাংস পাল্লা দিত পাঁঠার মাংসের সঙ্গে। গরু, খাসি এবং হরিণের মাংস খাওয়ার চল ছিল মধ্যযুগ থেকেই। হরিণের মাংস খুব সুস্বাদু। চর্যাপদেও লেখা ছিল ‘আপনা মাংসে হরিণা বৈরী।’ প্রাচীন সাহিত্যে তার বর্ণনা পাচ্ছি তো বটেই, বছর পঞ্চাশ আগেও সে খুব বিরল ছিল না, এমন নমুনাও মিলছে। ‘ধনিয়া সলুপা বাটি দারচিনি যত মৃগমাংস ঘৃত দিয়া ভাজিলেক কত’ (দ্বিজ বংশীদাস)। ‘কচি ছাগ মৃগ মাংসে ঝালঝোল রসা কালিয়া দোলমা বাগা সেকচী সামসা’ (ভারতচন্দ্র)। ‘বাবা মহা খুশি। ডাল আর শুকনো আলু আর নিজের হাতে মারা হরিণের মাংস খেয়ে খেয়ে অরুচি ধরে গেছিল।’ (খেরোর খাতা/ লীলা মজুমদার)। ‘নোনা নৈশ বাতাসের চল্লিশ মাইল দূরে সুন্দরবন— এই জায়গাটা যেন সেই বাঘের জঙ্গলের ঘুমন্ত কিনারা। এইখানে একদিন হরিণের মাংস খেয়েছিলাম— চর্বির চিহ্নহীন টগবগে দৌড়বাজ লাল মাংস। ‘ (অক্ষয় মালবেরি, মণীন্দ্র গুপ্ত)।
মাংস নিয়ে লীলা মজুমদার তাঁর খেরোর খাতা-য় দারুণ এক কাহিনি বলেছেন, ‘‘খেতে ভালোবাসতেন দুই বন্ধু, খাওয়াতেও। একবার যোগীন সরকার এক সের মাংস কিনেছিলেন। দুই বাড়িতেই গিন্নিরা রাঁধতেন। যোগীন সরকারের স্ত্রী মাংস কুটে, ধুয়ে, নুন-হলুদ মাখিয়ে ঢাকা দিয়ে একটু ভেতরের দিকে গেছেন। গিরীশ শর্মা সেই সুযোগে হাঁড়িসুদ্ধ কাঁচা মাংস তুলে এনে, গিন্নিকে বললেন, ‘এটা খুব ভালো করে রাঁধ তো দেখি।’
মেজদিদি চমত্কার রাঁধতেন। তিনিও সঙ্গে সঙ্গে খুব ভালো করে মাংস রেঁধে, উনুনের পাশে ঢেকে রেখে, চান করতে গেলেন। অমনি যোগীন সরকার রান্না মাংসটি বাড়ি নিয়ে গেলেন। এর একটু বাদেই তাঁর বড় ছেলে গিরীশ শর্মাকে একটা চিরকুট দিয়ে গেল। তাতে লেখা ছিল, ‘তোমরা বাড়িসুদ্ধ সকলে আজ দুপুরে আমাদের বাড়িতে খাবে। শুনলাম দুষ্কৃতকারীরা তোমাদের রান্নাঘরে হামলা দিয়েছে।’ তারপর মধুরেণ সমাপয়েৎ।’ বাংলা সাহিত্যের সর্বকালের সেরা রান্নাকেন্দ্রিক উপন্যাসের বিখ্যাত হাজারি ঠাকুর অসাধারণ পাঁঠার মাংস রাঁধতে পারত। ‘হাজারি ঠাকুর মাংস রাঁধিবার একটি বিশেষ প্রণালী জানে, মাংসে একটুকু জল না দিয়া নেপালী ধরনের মাংস রান্নার কায়দা সে তাহাদের গ্রামের নেপাল-ফেরত ডাক্তার শিবচরণ গাঙ্গুলীর স্ত্রীর নিকট অনেকদিন আগে শিখিয়াছিল।’ (আদর্শ হিন্দু হোটেল, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়)
তবে সে হচ্ছে প্রেশার কুকারের আগের যুগ। প্রেশার কুকার যখন আসেনি, তখন হাঁড়ি বা কড়াতেই মাংস রাঁধা হত, আর অনেক সময় সুসিদ্ধ হবার জন্যে তাতে ফেলে দেওয়া হত পেঁপে। সাধনা মুখোপাধ্যায়ের রান্নার বইয়ে ‘রোববারের আলু পেঁপে দেওয়া মাংসের ঝোল’ নামে একটি পদ পাচ্ছি। পরে পাঁঠার মাংস রান্নার একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে গেল প্রেশার কুকার। হৃদয়বিদারক কাহিনিটি লিখেছিলেন তারাপদ রায়, তাঁর বিখ্যাত কলাম ‘কাণ্ডজ্ঞান’-এ। সেটা দিয়েই শেষ করি।
‘কুকারে রাতের মাংস রান্না হয়েছে। সুঘ্রাণে সমস্ত বাড়ি ভরে গেছে। আমরা সবাই খেতে বসেছি, শুধু ভাত আর মাংস খাওয়া হবে। পাতে ভাত দিয়ে আমার স্ত্রী মাংস দিতে যাবে, কিন্তু কিছুতেই প্রেশার কুকার আর খুলতে পারেন না। আমি, বিজন দুজনে তাঁকে সাহায্য করতে গেলাম কিন্তু কী করে যে প্রেশার কুকারের ঢাকনার প্যাঁচ এমনভাবে আটকে গেছে কিছুতেই কিছু বোঝা যাচ্ছে না।’ তো প্রথমে ডাকা হল পাড়ার এক পিসিমাকে। তিনি এলাকায় সর্বপ্রথম এই যন্ত্র ব্যবহার করেন, তাই। তিনি ব্যর্থ হওয়ায় বিজন চলে গেলেন ট্যাক্সি করে কালীঘাট থেকে নাকতলা। রাত এগারোটা নাগাদ এক প্রেশার কুকার খোলায় বিশেষজ্ঞকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে এলেন। ‘তিনি রান্নাঘরে ঢুকে প্রেশার কুকারটার চারপাশে ঘুরতে লাগলেন, তারপর একটা নির্দিষ্ট বিন্দুতে চক্ষু নিবদ্ধ করে কুকারটা কোলে তুলে নিলেন। এরপর শুরু হল হ্যান্ডেলকে ক্লকওয়াইজ আর পাত্রকে অ্যান্টিক্লকওয়াইজ ঘোরানোর পালা। এইরকম চলতে চলতে একসময় প্রেশার কুকারের হাতল তারাপদবাবুর হাত থেকে ছিটকে ভদ্রলোকের থুতনিতে লাগল। তিনি অতর্কিতে আহত হয়ে কুকারটি ফেলে দিলেন, সেটা পড়ল তাঁরই পায়ের ওপর।’
কাহিনি শেষ হয় এইভাবে— ‘সেদিন রাতে আমরা নুন-তেল দিয়ে ভাত খেয়েছিলাম এবং সেও রাত দেড়টায়।’
অভিশপ্ত ডায়না স্টেক
স্টেক শব্দটি পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে স্ক্যান্ডিনেভিয়ানের শব্দ স্টিক (steik), মধ্য ইংরেজি উপভাষায় স্টিকনা (stickna) অথবা পুরাতন নর্স শব্দ স্টিকজা (steikja) থেকে উৎপন্ন অক্সফোর্ড ইংরেজি অভিধান মতে “রোস্টিং বা গ্রিলিং বা ফ্রাইংয়ের জন্য একটি পুরু কাটা মাংস, কখনও কখনও পাই বা পুডিংয়ের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়; বিশেষ করে পশুর হাড়ের অংশ থেকে কাটা হয়।” পঞ্চদশ শতকের দিকে ‘স্টিকিস’ শব্দটি প্রথম রান্নার বইয়ে দেখা যায় এবং যেখানে গোরুর মাংস বা হরিণের মাংস উভয়েরই স্টেক হিসেবে ব্যবহারের উল্লেখ পাওয়া যায়।
ডায়না ছিলেন রোমানদের সতীত্বের দেবী, চাঁদেরও। শিকারের দেবী হিসেবেও এঁকে মানতেন রোমানরা। আর তাই তাঁর নামেই মাংসের স্টেকের সবচেয়ে বিখ্যাত পদটি উৎসর্গ করা হয়েছিল। রোমানরা ফ্রান্স দখল করলে (সেই সিজারের আমলে) তাঁদের হাত ধরে ডায়না স্টেক ফ্রান্সে আসে। মিষ্টি মিষ্টি স্টেকের সঙ্গে ঝাল ঝাল সস মেশানো এই খাবারকে ফরাসিরা আ লা ডায়না নাম দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্রান্সে যুদ্ধরত সৈন্যদের হাত ধরে আমেরিকায় ডায়না স্টেকের প্রবেশ ঘটে। হরিণের মাংসের বদলে এখানে গোমাংস দিয়েই কাজ চালানো হত। ১৯৫০ থেকে ৬০-এর দশকে আমেরিকার সব বড়ো বড়ো হোটেলেই তাঁদের নিজস্ব ডায়না স্টেক পাওয়া যেত, আর প্রত্যেকেই দাবি করতেন এর মেনু তাঁদের নিজস্ব আবিষ্কার। ব্রাজিলের কোপাকাবানা প্যালেস হোটেল আবার এক ধাপ এগিয়ে ডিনার টেবিলেই ডায়না স্টেক বানাত। প্রথমে মাংসের টুকরোকে হাতুড়ি মেরে মেরে পাতলা চ্যাপটা বানানো হত। তারপর খদ্দেরের সামনেই গ্যাস বার্নারে মাখন দিয়ে ভাজা ভাজা করে গোটা প্যানটা আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়া হত। সেই স্টেক শুধু চেখে দেখার না, চোখে দেখারও বটে।
ডায়নাকে নিয়ে এক রোমান পুরাণের গল্প বলে শেষ করা যাক। কাহিনি বড়োই মর্মান্তিক যদিও। একদিন অ্যাকটিওন নামে এক শিকারি একদল কুকুর নিয়ে শিকার করতে করতে জঙ্গলের মাঝে এক সরোবরে উলঙ্গ অবস্থায় ডায়নাকে স্নান করতে দেখে ফেলেন। রেগে গিয়ে ডায়না অভিশাপ দেন, ফলে তিনি একটি সুন্দর চিত্রল হরিণে পরিণত হন। এদিকে তাঁর শিকারি কুকুররা মালিককে খুঁজতে এসে হরিণকে দেখে সেটাকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে খায়। মানে সত্যি কথা বলতে গেলে পৃথিবীর প্রথম ডায়না স্টেক ছিলেন অ্যাকটিওন নিজে।
কেএফসি আর এক অসামান্য বৃদ্ধ
একটু ব্যক্তিগত কথা বলি। ইদানীং আমি আর আমার মেয়ে শপিং মলে গেলেই ভারী ভাবনায় পড়ি ফুড কোর্টে গেলে। কী খাব? কোথায় খাব? অনেক ভাবনা, আলোচনার পর, প্রতিবার আমরা কেএফসি-তেই ঢুকি। সে যাই হোক, কেএফসি-র প্রতিষ্ঠার গল্প এমন একজনের কাহিনি, যার জীবন শুরু হয়েছিল অবসরের পরেই। হারল্যান্ড স্যান্ডারস। ৬৫ বছর বয়সে তাঁর জীবনের মোড় পালটে যায় এক অদ্ভুত নাটকীয় ঘটনায়।
১৮৯০ সালে জন্ম আমেরিকার ইন্ডিয়ানা স্টেটে। আর বাড়িটা ছিল ইন্ডিয়ানার হেনরি ভ্যালি থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে। মাত্র ছয় বছর বয়সে বাবাকে হারানোর পর সংসারের সব চাপ তাঁর কাঁধে উঠে আসে। যখন তাঁর মা বাইরে কাজ করতে যেতেন, স্যান্ডারসকে তাঁর ছোটো ভাই আর বোনকে দেখেশুনে রাখতে হত। মাত্র সাত বছর বয়সেই বেশ ভালো রান্না শিখে গিয়েছিলেন তিনি। ১২ বছর বয়সে তাঁর মা নতুন বিয়ে করলে সৎবাবার আশ্রয়ে খুব বেশিদিন কাটাতে পারেননি। পরবর্তীতে একটা ফার্ম হাউজে কাজ নিয়ে চলে আসেন অনেকটা দূরে। পড়াশোনাও খুব বেশিদিন চালিয়ে যেতে পারলেন না। এরপর থেকে শুরু হয় তাঁর প্রতিকূল পথচলা। অনেক চড়াই উতরাই পাড় করে চলে তাঁর জীবন। কখনও খেতমজুর, ট্রেনের ফায়ারম্যান, কখনও বা বিমা কোম্পানির সেলসম্যান, গাড়ির টায়ার বিক্রেতা, ফিলিং স্টেশনের কর্মচারী এবং সর্বশেষে একজন রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ী।
১৯৩০ সালের দিকে স্যান্ডারস কেন্টাকিতে একটি পেট্রোল স্টেশনের পাশে বিভিন্ন ধরনের খাবার বিক্রি করতে লাগলেন। নিজেই রান্না করে বিভিন্ন সাউথ আমেরিকান খাবার পরিবেশন করতেন। ধীরে ধীরে খাবারের খ্যাতি আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে জায়গাটিকে পুরো রেস্টুরেন্টে রূপ দেন। ১৯৩৯ সালের দিকে তাঁর সিগনেচার রান্না ‘ভাজা চিকেন’ নতুনভাবে সকলের সামনে উপস্থাপন করেন। তিনি নিজেই একটি এমন প্রেশার কুকার তৈরি করে নেন যা ছিল প্রচলিতগুলোর চেয়ে আলাদা। কিন্তু এই প্রেশার কুকারে ফ্রাইড চিকেনের টেক্সচার বা মচমচে ভাবটা খুব ভালোভাবেই আসে। এর পরের দশ বছর বেশ ভালোভাবেই কাটে স্যান্ডারসের। ১৯৫০ সালে কেন্টাকির গভর্নর তাঁকে ‘কর্নেল’ উপাধি দেন।
১৯৫২ সালের দিকে তাঁর এই ব্যবসা নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেন স্যান্ডারস। তাঁর এক ব্যবসায়িক বন্ধু পিট হারমেনের সাথে চুক্তি করেন যে তাঁর তৈরি ‘Kentucky Fried Chicken’-এর প্রতিটি মূল্যের সাথে রয়্যালটি হিসেবে চার সেন্ট করে পাবেন। এই চুক্তির ব্যাপক সাফল্যের পর সেন্ডারস আরও কিছু রেস্টুরেন্টের সাথে অনুরূপ চুক্তি করেন। সবকিছু বেশ ভালোভাবেই চলছিল। কিন্তু হঠাৎ সরকারি জায়গা অধিগ্রহণের বেড়াজালে পড়ে বিশাল ক্ষতিতে বিক্রয় করতে বাধ্য হন তাঁর রেস্টুরেন্ট। হাতে পড়ে থাকে শুধুমাত্র ১০৫ ডলারের সিকিউরিটি চেকের অর্থ। কিন্তু স্যান্ডারস হার মেনে নেওয়ার পাত্র নন। তাঁর চার বছর আগে ফেলে আসা ব্যবসায়িক চিন্তাকে নতুন করে গড়ে তোলার জন্য বদ্ধপরিকর হলেন। গাড়ি ভর্তি করে নিলেন প্রেশার কুকার, ময়দা, মুরগি, তাঁর নিজের তৈরি রেসিপির অন্যান্য উপকরণ আর ঘুরতে লাগলেন রেস্টুরেন্ট থেকে রেস্টুরেন্ট। উদ্দেশ্য একটাই, যদি ভালো লেগে যায় তাঁর রেসিপি, তাহলেই চুক্তিবদ্ধ হবেন। কেউ শুনেই হাসি দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিল, কেউ বলেছিল পাগল, আবার কেউ রেসিপি পছন্দ করেও কোনও প্রকার চুক্তি করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। কিন্তু থেমে থাকেননি। বদ্ধপরিকর চেষ্টা একসময় সফলতায় রূপ নিল। ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত তাঁর চেষ্টায় প্রায় ৬০০টি রেস্টুরেন্টের সাথে চুক্তিবদ্ধ হতে পেরেছিলেন। সেই বছরই অক্টোবর মাসের দিকে ‘জেক সি মেসি’ নামে একজন ধনী মানুষের কাছ থেকে তাঁর রেসিপির রয়্যালটির অধিকার কিনে নেওয়ার আবেদন পান।
১৯৬৫ সালের জানুয়ারি মাসে তাঁর জগৎভোলানো রেসিপির স্বত্ব দুই মিলিয়ন ডলারে বিক্রয় করেন তিনি। চুক্তিপত্র অনুযায়ী Kentucky Fried Chicken কোম্পানি হিসেবে পুরো বিশ্বে নিজস্ব রেস্টুরেন্ট খুলবে এবং রেসিপির ব্যাপারে কোনও প্রকার ছাড় দেওয়া হবে না। স্যান্ডারস সারাজীবনের বেতন হিসেবে ৪০,০০০ ডলার পাবেন, অধিকাংশ শেয়ারের মালিক হবেন এবং কোম্পানির ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হয়ে কোম্পানির প্রচারে অংশগ্রহণ করবেন।
১৯৮০ সালের তাঁর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত স্যান্ডারস ছুটে বেড়িয়েছেন মাইলের পর মাইল তাঁর হাতে গড়া রেসিপির কদর আর মান দেখার জন্য। কখনও গুণাগুণের ব্যাপারে সমঝোতা করেননি। সবসময় চেয়েছেন নিজের তৈরি রেসিপি নিয়ে মানুষের মনে বেঁচে থাকতে। তাঁর চাওয়া যে সফলভাবে পাওয়াতে পরিণত হয়েছে, সময়ই তার প্রমাণ।