মহিলা মহল
মহামতী গ্যেটের মূল ফাউস্ট অধ্যয়ন করার বা তার কোনও তর্জমাও পাঠ করার মতো সময় বা শিক্ষা কিছুই আমার জীবনে ঘটেনি। তবু আমার পল্লবগ্রাহী স্বভাবের দৌলতে ফাউস্ট কাব্যের দ্বিতীয়াংশের শেষ পঙক্তিটি আমি মূল ভাষায় উদ্ধৃত করতে পারি সামান্য একটি রেফারেন্স বুকের সৌজন্যে। বইটির নাম আমি প্রকাশ করব না কিন্তু যাতে মনের মধ্যে কেউ কোনও সন্দেহ পোষণ করতে না পারেন তাই লিখে রাখছি : ‘Das Ewig-Weibliche Zeiht uns hinan,’ আমার অক্ষম ভাষায় যার বাংলা পদান্তকরণ হল :
‘আমাদের ঊর্ধ্বমুখী টেনে তোলে অনন্ত রমণী।’ গ্যেটে সম্ভবত মহাপুরুষ ছিলেন। তিনি নিশ্চয়ই কোনও তরুণীর কাছ থেকে এমন চিঠি পাননি যেখানে লেখা আছে,
প্রিয় তারাপদ,
তুমি নিশ্চয় রাগ করনি। কাল রাতে মনে হয়েছিল রাগ রাগ ভাব তোমার। তুমি কেন বুঝেও বুঝছ না আমি যখন বলছিলাম যে আমি কথা দেব বলে যখন বলেছি আর কথা দেব না যখন বলেছি দু’-সময়েই আমি মনে মনে যা ভেবেছি তার কোনওটাই তুমি সম্ভবত যে কারণে রাগ করেছ তা নয়। নাকি তুমি সেই যে আমি বলে ফেলেছিলাম বলব না অথচ শেষ পর্যন্ত বলি বলি করে বলেও ফেললাম, হয়তো তার জন্যেও। এই রকম একটি সাড়ে তিন পৃষ্ঠা চিঠি যার ভাবার্থ সাহিত্যে লেটার বা ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া ছাত্রও করে উঠতে হিমসিম খাবে সে রকম কোনও পত্রপ্রেরিকার সঙ্গে গ্যেটে সাহেবের পরিচয় থাকলে তিনি হয়তো ঊর্ধ্বমুখী না হয়ে সমতল রমণীদের কথা বলতেন।
মেয়েদের কথা বোঝা খুব কঠিন। তাঁরা কখন কোন কথা বলেন তাঁরা নিজেরাও জানেন না। যে দ্রুত মসৃণতায়, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়, তাঁরা প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে বিচরণ করেন তার সঙ্গে বৃক্ষশীর্যে শাখামৃগের সাবলীলতাই শুধু তুলনীয়।
কে যেন বলেছিলেন, মহিলারা শেষ কথাটি বলুন তাতে আমার আপত্তি নেই, কিন্তু শেষ দশ হাজার কথাটি তাঁরাই বলবেন এটা আমি মানতে পারি না। তা এই ভদ্রলোক মানুন আর না মানুন কথা তাঁকে শুনতেই হবে। তবে এক ভদ্রলোক, আমার এক প্রাক্তন সহকর্মী, বলেছিলেন যে, ‘দেখুন, আপনারা বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, আমাদের বাড়িতে সব তর্কে শেষ কথাটি আমিই বলি।’
বিশেষ জোরাজুরি করার পর অবশ্য ভদ্রলোক স্বীকার করলেন যে শেষ কথাটি হল, ‘ঠিক আছে বুঝতে পেরেছি,’ অথবা সংক্ষিপ্ত সংস্করণে ‘নিশ্চয়’ অথবা ‘হ্যা’।
তবে আমার এক বন্ধুপত্নী একবার আমাকে ধমকে বলেছিলেন, ‘আপনারা আমাকে যত দজ্জাল ভাবেন তত দজ্জাল মোটেই আমি নই। আমার বর আমার সব কথায় হ্যাঁ বলবে তা আমি মোটেই চাই না। আমি যখন না বলব তখন হ্যাঁ বললে আপনাদের বন্ধুকে ছাড়ব না, তখন তাকেও না বলতে হবে। বুঝতে পারছেন, আপনারা যে রটিয়ে বেড়ান আপনাদের বন্ধু আমার সব কথায় হ্যাঁ বলেন, সেটা ঠিক নয়।’
অষ্টাদশ শতাব্দীতে লর্ড চেস্টারফিল্ড তাঁর বিখ্যাত পুত্রের নিকট পত্রমালায় বলেছিলেন, ‘আসলে মেয়েরা হল বড় সাইজের শিশু।’ মাত্র দু’দিন আগে দুই প্রৌঢ়ার আলোচনা শুনে এই প্রতিক্রিয়াশীল মন্তব্যটি আবার আমার ফিক করে মনে পড়ল।
প্রথম প্রৌঢ়া দ্বিতীয়া প্রৌঢ়াকে এক বিয়েবাড়িতে এক প্রান্তে টেনে নিয়ে ফিসফিস করে, মানে আশেপাশের পঞ্চাশজনের কর্ণগোচর করে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কীরে উইগ পরেছিস নাকি?’ দ্বিতীয়া ব্রীড়াবনতা মুখে সামনের দিকে ঘাড়টা দুলিয়ে স্বীকার করলেন, ‘ঠিক তাই।’ প্রথমা বললেন, ‘কী চমৎকার মানানসই হয়েছে, বুঝতেই পারা যাচ্ছে না যে উইগ পরেছিস!’
নিম্ন আদালতের এক দুঁদে বিচারক জীবিকাসূত্রে একদা আমার খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন; তিনি অপর একটি মহিলাজনিত দুর্বলতার প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়েছিলেন। ভদ্রলোক অবশ্য বানিয়ে গল্প বলায় আমার চেয়েও ওস্তাদ ছিলেন (ভাগ্যিস লেখেন না তা হলে আমার সর্বনাশ হত)। তাঁর কোর্টে একবার নাকি এক বিগতযৌবনা মহিলা সাক্ষী বলেছিলেন যে তাঁর বয়েস ছত্রিশ বছর কয়েক মাস। মহামান্য বিচারক বলেছিলেন, ‘মাত্র ছত্রিশ বছর?’ সাক্ষী মহিলা বললেন, ‘এবং আর কয়েক মাস।’ বিচারক বললেন, ‘ঠিক করে বলুন। আপনি আদালতের হলফ নিয়ে বলছেন, অযথা মিথ্যা বলবেন না।’ মহিলা বললেন, ‘ওই তো বললুম ছত্রিশ বছর কয়েকমাস।’ বিচারক বললেন, ‘ঠিক আছে।’ তারপর নোট নিতে নিতে বললেন, ‘ছত্রিশ বছর কয় মাস?’ এই সরাসরি সরল প্রশ্নে কাজ হল, মহিলা আমতা আমতা করে বললেন, ‘ছত্রিশ বছর দুশো তিন মাস।’
বয়েসের ব্যাপারটা অবশ্য মহিলাদের চিরন্তন দুর্বলতা। বাংলা সিনেমার কিংবদন্তী যুগের নায়ক তাঁর প্রবীণ চিত্রসঙ্গিনীকে আলতো করে বলেছিলেন, ‘তুমি আর বদলালে না, সেই প্রথম কুড়ি বছর আগে তোমাকে যেমন দেখেছিলাম, আজও কিছু বদলাল না।’ নায়িকা ক্ষুব্ধ কণ্ঠে নাকি বলেছিলেন, ‘বদলাল না? তুমি কী বলছ? এই কুড়ি বছরে আমার বারো বছর বয়েস বেড়ে গেল।’
এই সূত্রে অন্য এক অবিখ্যাত মহিলার কথা মনে পড়ছে। তার এক যমজ ভাই ছিল। ভাই আর বোনে শুধু ছেলে আর মেয়ে এইটুকু পার্থক্য, বাকি সব নাক চোখ মুখ, কথাবার্তা, চালচলন সব এক রকম। আরেকটা আশ্চর্য পার্থক্য, ভাইয়ের বয়েস যখন বিয়াল্লিশ যমজ বোনের বয়েস আঠাশ— চৌদ্দো বছরের ফারাক।
সে যাক, মেয়েদের বয়েস নিয়ে খুব বেশি আলোচনা ভাল নয় আর চিরচলিত কথাই তো রয়েছে যে মেয়েদের বয়েস নিয়ে মাথা ঘামিয়ো না, শুধু জেনে রাখো যে কোনও মহিলা জীবনের শ্রেষ্ঠ পনেরো বছর হল তিরিশ থেকে পঁয়ত্রিশ পর্যন্ত।
সুতরাং মহিলাঘটিত অন্য একটি কাহিনী বলি। আমার এক প্রতিবেশীর শ্যালক, নববিবাহিত। থাকে দক্ষিণ কলকাতায়, কাজ করে ব্যারাকপুরের কাছে এক কারখানায়। একদিন কারখানার কী একটা কাজে তার একটু দেরি হচ্ছে, সে বেশ চেষ্টা করে বাড়িতে ফোন করল। বাড়িতে নববধূ একাই থাকে, কাজের মেয়েটি সন্ধ্যার সময় বাড়ি চলে যায়। নতুন বউ ফোন ধরেছে, দু’-একটা সুখের কথা হচ্ছে, হঠাৎ হাত থেকে টেলিফোন পড়ে যাওয়ার শব্দ এবং বউয়ের আর্ত চিৎকার, ‘ওরে বাবারে মেরে ফেললে রে…’ শুনে ফোনের প্রান্তে স্বামী বেচারা চমকিয়ে উঠলেন। এরপর হাজার চেষ্টা করেও ফোনে ফোনে জোড়া লাগল না।
হতবিহ্বল দুশ্চিন্তিত স্বামী দু’-একজন সহকর্মীর সঙ্গে কথা বলে পরামর্শ করলেন। ব্যারাকপুর থেকে বাড়িতে ফিরতে অন্তত দেড়-দু’ ঘণ্টা লেগে যাবে, আর এই ভর সন্ধেয় রাস্তায় বা রেলগাড়িতে কোথায় কী জট পাকিয়ে আছে, বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে, সব ভেবেচিন্তে থানায় ফোন করা ঠিক হল। আর তা ছাড়া থানার পাশেই বাড়ি, ইচ্ছে করলেই ছুটে যেতে পারবে পুলিশ।
সুখের বিষয় এক চেষ্টাতেই থানা পাওয়া গেল এবং থানার বড়বাবুই ফোন ধরলেন। বড়বাবু প্রতিবেশী হিসেবে মাসখানেক আগেই এ বিয়েতে নিমন্ত্রণ খেয়েছেন। ফোনে এই দুঃসংবাদ শোনামাত্র তিনি বিশাল বপু এবং অকৃত্রিম সাহসে ভর করে চারজন সশস্ত্র সেপাই ও একজন ছোট দারোগাকে নিয়ে ছুটলেন অকুস্থলে।
গিয়ে দেখেন বারান্দায় একটা বড় টেবিলের এক প্রান্ত ঘেঁষে দাঁড়িয়ে তখনও বধূটি থরথর করে কাঁপছেন। তাকে কিছু জিজ্ঞাসা না করতেই তিনি বললেন, ‘এখনও ঘরের মধ্যে রয়েছে।’ বড়বাবু জানতে চাইলেন, ‘ঘরের মধ্যে কোথায়?’ বধুটি বললেন, ‘বলা কঠিন। খাটের নীচে হতে পারে, আলমারির পিছনে হতে পারে এমনকী আলনার আড়ালেও থাকতে পারে।’
বড়বাবু দু’জন সেপাইকে উদ্যত রিভলবার নিয়ে ঘরে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে নির্দেশ দিয়ে মহিলার কাছে জানতে চাইলেন, ‘আচ্ছা কী রকম দেখতে?’ নববধূটি চোখ বড় বড় করে বলল, কী রকম আর? আর দশটা ইদুর যেমন দেখতে হয় সেই রকমই।