মহিলা কবিরা
এক জন্ম-রোমান্টিক মরমি পুরুষ কবি একদা লিখেছিলেন,
‘রমণীর মন
সহস্র বর্ষের সখা সাধনার ধন।’
এ রকম কোনও কথা মহিলা কবিরা আজকাল একেবারে বলেন না। এক কালে অপরাজিতা দেবী (রাধারানি দেবী), গিরিন্দ্রমোহিনী দাসী এবং এই তো সেদিন ‘ভাব ভাব কদমের ফুল’ রচয়িতা রাজলক্ষ্মী দেবী সুন্দর সুন্দর ভালবাসার কথা লিখেছেন।
এখন আর সেদিন নেই। যেসব পুরুষমানুষের মন একটু নরম প্রকৃতির হয়, তারাই কেউ কেউ কবি হন।
তার তুলনায় একালের মহিলা কবিরা খুব শক্ত মনের মানুষ। তাঁরা পুরুষ জাতিকে তঞ্চক, শোষক ইত্যাদি ভাবতে ভালবাসেন।
একবার এইরকম এক জ্বলন্ত সাহিত্যসভার শেষে আমাকে জনৈকা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, নারীবাদিনীদের সম্পর্কে আমার কী অভিমত।
আমি অভিমত দেওয়ার কে? এ ব্যাপারে আমার কতটুকু অধিকার আছে? তবু, হালকাভাবে একটা উত্তর দিয়েছিলাম, অনেকেই সেটা শুনেছেন এবং জানেন, আমি লিখিতভাবে বলেছি।
আমি বলেছিলাম, ‘এ ব্যাপারে আমি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে একমত।’
প্রশ্ন উঠল, এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথ আসেন কীভাবে? নারীবাদীদের সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ কবে কী বলেছেন?
আমি বললাম, বলার আর কী আছে? রবীন্দ্রনাথ তো তাঁর গানেই লিখেছেন,
‘তারি লাগি যত ফেলেছি অশ্রুজল
নারীবাদিনীর শতদলতলে করিছে
সে টলমল।’
আমার সেই কথা শুনে সবাই হই হই করে উঠল, ‘ইয়ার্কি হচ্ছে?’
তারপরে কোনওদিন-ভালবাসলেও-বাসতে পারতাম, এমন এক প্রৌঢ়া বললেন, ‘যত বুড়ো হচ্ছিস তত ফাজিল হচ্ছিস।’ ইতিমধ্যে এক তরুণী কবি আমাকে চেপে ধরলেন, বললেন, ‘আপনার কোটেশন ভূল। রবীন্দ্রনাথ ও রকম বলেননি।’ আমি অসহায়ের মতো জিজ্ঞাসা করলাম, ‘রবীন্দ্রনাথ তা হলে কী বলেছিলেন?’ সবাই চেষ্টা করতে লাগল। কেউ কেউ মনের মধ্যে গানের সুর ভেঁজে গুনগুন করতে লাগল। কিন্তু বারবার কই মাছের মতো আসল শব্দটি পিছলিয়ে গেল।
সংস্কৃত ছাত্র-পাঠ্য গল্পগুলিতে ‘হা হতোস্মি’ বলে একটা কথা আছে। যার মানে হল, ‘হায়, আমি হতভাগ্য মরিলাম।’ এই পর্যন্ত লেখার পর আমার মনে হচ্ছে, আমাকে হয়তো এবার ‘হা হতোস্মি’ বলতে হবে। নিতান্ত বোকা বলে আমি প্রায় নিজের অজ্ঞাতসারে নারীবাদের মতো জটিল বিষয়ে জড়িয়ে পড়েছি।
অনেকদিন আগে এ রকম একটা বিষয় নিয়ে রচনা লিখে খুব গোলযোগে পড়েছিলাম। সেটা ছিল ‘কাণ্ডজ্ঞানের’ যুগ। আমার মধ্য যৌবন, গায়ে প্রহৃত হওয়ার মতো শক্তি ছিল। পায়ে দৌড়ে পালানোর মতো জোর ছিল।
এখন আর তত সাহস নেই। তবু, প্রসঙ্গটা বলি। আধুনিক বিবাহোত্তরা মহিলারা পিতৃগৃহের পদবির সঙ্গে স্বামীর পদবি যোগ করেন। পিতৃগৃহের পদবিটি প্রথমে, স্বামীর পদবিটি পরে।
এতে আপত্তি নেই। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলে আগামী দিনের একটা ভয়াবহ সমস্যার কথা উঁকি দেবে।
বাম চক্রবর্তীর সঙ্গে বিয়ে হয়ে রমা ভট্টাচার্য হলেন—রমা ভট্টাচার্য-চক্রবর্তী। গোলাম হোসেনকে বিয়ে করে মালতী দাশগুপ্ত হলেন—মালতী দাশগুপ্ত-হোসেন।
পরবর্তী প্রজন্ম মাত্র পঁচিশ-ত্রিশ বছর পরে—ভট্টাচার্য-চক্রবর্তী পুত্রের বিয়ে হল দাশগুপ্ত-হোসেনের কন্যার সঙ্গে। তাদের উপাধি হল দাশগুপ্ত-হোসেন-ভট্টাচার্য-চক্রবর্তী।
কিন্তু এখানেই শেষ নয়। গোকুলে অন্যেরাও বাড়ছে। রমাদেবীর নাতনির সঙ্গে জনৈক যুবকের ভালবাসা হল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়। একইভাবে সেই যুবকের এখন উপাধি ফোর্ড-সুব্রহ্মণ্যম-পট্টনায়ক-মিত্র এবং পৃথিবী ঠিকমতো ঘুরতে থাকলে, চন্দ্র, সূর্য ঠিকমতো নামা-ওঠা করতে থাকলে একদিন এদেরও সন্তানাদির বিয়ে হবে, পদবি আবার ডবল হয়ে যাবে। এ হল পাটিগণিতের জিয়োমেট্রিক প্রগ্রেশন, এর কোনও অন্ত নেই। পরীক্ষা সার্টিফিকেটে নাম লিখতে গেলে এক পাতা দেড় পাতা চলে যাবে। তেমনি সমস্যা হবে ভোটার লিস্টে, খামের ঠিকানায়।
এর কোনও সমাধান নেই। অনেকে বলেছেন, তা হলে পদবি উঠে যাক। সেটা এক দিক থেকে মন্দ নয়।
নাম আর পদবি দুয়ে মিলে একটি মানুষকে বিশিষ্ট করে তোলে। সবাই যদি ‘সুনীল’ হয়ে যায়, সবাই যদি আরতি হয়ে যায়, তখন হাজার হাজার সুনীল, হাজার হাজার আরতির মধ্যে একটি নির্দিষ্ট সুনীল কিংবা আরতি খুঁজে বার করতে গলদঘর্ম হতে হবে। পাড়ায় গিয়ে সুনীলবাবুর বাড়ি কোনটা জিজ্ঞাসা করলে, লোকে বলবে, ‘কোন সুনীল, বেঁটে সুনীল না লম্বা সুনীল, মোটা সুনীল না তোতলা সুনীল, কবি সুনীল না গায়ক সুনীল, ফরসা সুনীল না কালো সুনীল।’