মহাশূন্যের মণিমুক্তো
রাত আটটা বাইশ। এমনিতেই টিভি চ্যানেলের প্রত্যেকটায় খাস প্রোগ্রামের সময়। তারপর রবিবার থেকে আজ মঙ্গল পেরতে চলল, ঘূর্ণিঝড় আর অবিশ্রান্ত বর্ষার দাপটে কলকাতায় যে যার ঘরে বন্দি। আমরণ বক্সিং, ওয়ান-ম্যান ফুটবল, সিন্থেটিক সংগীত আর সিনেমা দেখে সময় কাটতে চাইছে না। রাবারজাত পণ্যবিক্রেতারা সুযোগ বুঝে অ্যাডাল্টস ওনলি চ্যানেলের সময়সুচির পরিবর্তন ঘটিয়ে (২৫ শতাংশ অধিক ব্যয়ে) প্রায় চার ঘণ্টা আগেই তাদের স্পনসর করা নীল কসরত জুড়ে দিয়েছে।
বিদ্যুৎ সরবরাহ বিচ্ছিন্ন হওয়ার ভঙ্গিতে সতেরোটা চ্যানেলের প্রোগ্রাম আচমকা বন্ধ হয়ে গেল। একই সঙ্গে। পরদার রং মুছে দিয়ে কালো বর্ডার দেওয়া শোকের বাক্সের মধ্যে ফুটে উঠল বড় বড় হরফের ঘোষণা। শব্দরাও কিছুক্ষণের জন্য খারিজ।
এক চলচ্চিত্রকারের দ্বিশত জন্মবর্ষ উপলক্ষে বারো নম্বর চ্যানেলে চলছিল মান্ধাতার আমলের একটা ফিলম। চ্যাপলিন নামটা রাহুলের কাছে অপরিচিত। কিন্তু অন্যমনস্কভাবে দেখতে দেখতেই একসময়ে বেশ জমে গিয়েছিল ব্যাপারটা। ভিসিআর-এ ক্যাসেট পুরে সুইচ টিপে চালু করে দিয়েছে। রিমা ফিরে আসুক, দেখে মজা পাবে।
চ্যাপলিন তার টুপির মধ্যে ভাঙা ঘড়ির টুকরো ভরে অয়েল ক্যান থেকে নিঃশব্দে ফ্যাচফ্যাচ করে সবে তেল ঢালতে শুরু করেছে তখন।
ভুরু কুঁচকে তাকাল রাহুল।
একটি মর্মান্তিক দুঃসংবাদ। এই মুহূর্তে আমাদের কাছে খবর এসে পৌঁছেছে যে, নক্ষত্ৰচারী ডি-সেভেন রকেটটি একশো সতেরোজন ছাত্রী ও সাতজন কর্মী সমেত মহাকাশের এক দুর্ঘটনায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
রাহুল একবার পড়ল। দু-বার পড়ল। তিনবার। শব্দগুলো কতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে পরদায়।
সংবাদপাঠকের একটা পরিচিত মুখ এবার পরদায় এসেছে। কিন্তু তার কথা রাহুল ভালো করে শুনতে পাচ্ছে না। রিমোট সুইচের বোতামটা টিপেই চলে। ফুল ভলিউম। অসংলগ্ন ও দুর্বোধ্য শব্দে ঘর কাঁপে।
…মহাকাশ যুগের তৃতীয় বৃহত্তম রকেট-দুর্ঘটনায়… অজানা উল্কাপিণ্ডের সঙ্গে সংঘর্ষ… পৃথিবী থেকে সাতাশ রকেট-দিবস দূরত্বে… টেলিস্কোপের দৃষ্টি পৌঁছায় না… ধ্বংসের পূর্বমুহূর্তের রেডিয়ো-বার্তা.. আরোহী ছাত্রীদের কারও বয়স বারোর বেশি নয়… কলকাতার স্কুল… এসে কম্পিটিশনে.. পুরস্কার হিসাবে মহাকাশে পাড়ি..
পাহাড়ের চুড়োয় দাঁড়িয়ে দু-হাতের ধাক্কায় আততায়ীকে কয়েক হাজার ফুট নিচে ছুঁড়ে দিল রাহুল। টিভি সেটটা আছড়ে পড়ল মেঝের ওপর। কিন্তু ছবির স্রোত তবু কাত হয়েও চলতে থাকে, ঘোষকের গলাটা শুধু ধাতব ধারালো, রিকন্ডিশন্ড রোবটের মতো শোনাচ্ছে।
পিকচারফোনটা জলতরঙ্গের সুর তুলে বেজে ওঠে ভিক্টোরিয়ান তেপায়া স্ট্যান্ডের ওপর। ঘুরে দাঁড়ায় রাহুল। সে জানে, কে ফোন করছে। মুহূর্তের মধ্যে তার খেপামি উবে গেছে। একটু দ্বিধা। ফোনটার দিকে সতর্ক দৃষ্টি। টিকটিকির শিকার ধরার মতো পা বাড়ায়। যেন তার গতিবিধি জানতে পারলেই ফোনটা কেটে যাবে।
রিসিভারে হাত রেখে আর-একটু সময় নেয়। জলতরঙ্গের গতটা শেষ হোক।
হ্যালো?
ফোনের পিকচার স্ক্রিনে দুটো উদ্ভ্রান্ত নীল চোখ।
গুড ইভনিং!
গুড ইভনিং জয়া! কী ব্যাপার, কার বিছানা থেকে ফোন করছ, ডার্লিং?
রাহুল এখন নর্মাল। জয়ার সঙ্গে গত দু-বছরের মধ্যে কালেভদ্রে যখনই যোগাযোগ হয়েছে, এই সুরেই চলেছে আলাপ।
তুমি শোননি? জান না? রিমা–রিমা দু-হাতে মুখ ঢেকেছে জয়া। কান্নাকে অশালীন চেহারা না-দেওয়ার এই রীতি।
রিমা চলে গেছে, তাতে তুমি সিন ক্রিয়েট করছ কেন? তোমার সঙ্গীর রাত্রিটা মাটি করো না। সেন্টিমেন্টাল হলে তোমাকে কুৎসিত দেখায় জয়া।
ফোনটা আলতো হাতে নামিয়ে রাখল। জয়ার টেলিফোনটা তাকে আত্মস্থ হওয়ার সুযোগ দিয়েছে।
উলটে-পড়া টিভি স্ক্রিনের দিকে চোখ ফেরাল রাহুল। একটা সিগারেট ঠোঁটে খুঁজে কার্পেটের ওপরেই বসে পড়েছে। অভিশপ্ত রকেটের আরোহীদের মুখ আর পরিচয়ের মিছিল। রাহুল দেখতে চায়, কিন্তু তার জন্য টিভি সেটটাকে খাড়া করে বসাবার ইচ্ছা নেই। ওটা ছুঁতেও ঘেন্না লাগছে।
ফুটফুটে দশ-এগারো বছরের মেয়েদের একটা করে মুখ ফুটে উঠছে আর। মিলিয়ে যাচ্ছে। প্রত্যেকেই একজন করে রিমা। রাহুল কিন্তু ভাবছে অন্য কথা। অনেকগুলো অসম্ভব একজোট হয়ে রিমাকে টেনে এনেছে দুর্ঘটনার মধ্যে। রাহুল অধ্যাপক। কন্যাকে মহাকাশভ্রমণে কেন, ইয়োরোপ বা আমেরিকায় পাঠানোর সঙ্গতিও নেই তার। রিমাও বোধহয় কখনও কল্পনা করতে পারেনি, এরকম সুযোগ আসতে পারে। তার ক্লাসের বন্ধুদের মধ্যে একমাত্র রিজিয়া গত বছর চাঁদে তিন দিন কাটিয়ে এসেছে। কিন্তু রিজিয়ার বাবার কথাই আলাদা। ভারতের প্রথম সারির শ-খানেক ব্যাবসায়ীর মধ্যে তিনি অন্যতম।
কাউন্টডাউন শুরু হয়েছে মিকিলেট কোম্পানি প্রচণ্ড প্রতিযোগিতার ফর্ম স্কুলে পাঠানোর মুহূর্ত থেকে। চকোলেট চুয়িং গাম ও বাবলগাম ইত্যাদি নানা মুখরোচক পসরা নিয়ে বাজারে নামার আগে মিকিলেটের এই আয়োজন ছিল পাবলিসিটির চমক। তাদের ব্যাবসার পেছনে সুস্থিত হিমালয়প্রমাণ মূলধনের ইঙ্গিত। কলকাতা থেকে তাদের যাত্রা শুরু। প্রথম দফায় কলকাতার যাবতীয় গার্লস স্কুলের সিক্সের ছাত্রীরাই শুধু সুযোগ পেয়েছিল পরীক্ষায় বসার। দু-চারজন নয়, প্রতিশ্রুতি ছিল একশোজনকে তারা দু-মাসের জন্য নিয়ে যাবে শিক্ষামূলক মহাকাশ সফরে। সেই সংখ্যা শেষে বেড়ে একশো সতেরায় ঠেকেছিল।
রাহুল যখন রিমার প্রতিযোগিতার ফর্মে কোনও আপত্তি নেই জানিয়ে সই করে, ভালো করে পড়েও দেখেনি নিয়মাবলি। ক্লাসের সব মেয়েই তো বসছে, রিমাও তারই একজন। সিট অ্যান্ড ড্র, কুইজ কনটেস্ট–এরকম তো কতই হচ্ছে। পড়াশুনোয় রিমার তেমন মাথা নেই। ছবি আঁকাটাই তার একমাত্র নেশা। রাহুল ভেবেই রেখেছিল, স্কুলের গণ্ডিটা পার হলেই ভরতি করে দেবে আর্ট কলেজে।
সেদিন স্কুল থেকে ফিরেই রিমা তার নির্বাচিত হওয়ার সংবাদ ঘোষণা করেছিল। তাদের ক্লাস থেকে মাত্র চারজন সুযোগ পেয়েছে।
তুই যে চমকে দিলি। একবারও তো বলিসনি যে, এত ভালো লিখেছিস!
ভালো না ছাই। সত্যি বাপি–কোন লেখাটা যে ভালো হয় আর কোনটা খারাপ, আগেভাগে আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না। যা মনে এল, লিখে দিলাম। বড় হয়ে কী করতে চাও–এ আর এমন কী!
কেন রাজি হল? নিজেকে এখন মিথ্যা প্রশ্ন। মনের কোণে একটা সন্দেহকে সে বাতিল করতে পারছে না। সত্যিই দুর্ঘটনা তো? কারা এই মিকিলেট কোম্পানি? বিজ্ঞাপনের চমক দেওয়া ছাড়া দ্বিতীয় কোনও উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই তাদের ছিল না। তাহলে কি পুরানো বাতিল কোনও রকেটে চড়িয়ে ছেড়ে দিল বাচ্চাদের? বেআইনি লাইসেন্স করা রকেট? উল্কার সঙ্গে সত্যিই সংঘর্ষ ঘটেছে, না কোনও যান্ত্রিক ত্রুটির জন্য….
উল্কার সঙ্গে সংঘর্ষ মানে ইনসিয়োরেন্স কোম্পানিকে খেসারত দিতে হবে না।
কিন্তু এ কথা ভাবার পেছনে কোনও যুক্তি নেই। একটু আগেই টিভি-তে দেখানো হয়েছে, বিধ্বস্ত রকেট থেকে পাঠানো বেতার-চিত্রে কীভাবে ধরা পড়েছে উল্কার সঙ্গে সংঘর্ষের প্রাক্-মুহূর্তটি।
তখন অবশ্য ঠান্ডা মাথায় দেখার মতো অবস্থা ছিল না। আরেকবার যদি দেখতে পেত…
মনে পড়ে, ভিডিয়ো ক্যাসেটটা ভরাই আছে। টেপ ফুরিয়ে গিয়ে না থাকলে চ্যাপলিনের ছবির পরেও সবই রেকর্ড হয়েছে।
টেলিফোন অ্যাড্রেস-বুকের পাতা উলটে যাচ্ছে প্রথম থেকে। নামটা কিছুতেই মনে আসছে না। সায়েন্স কংগ্রেসে পরিচয় হয়েছিল। মহাজাগতিক তথ্যকেন্দ্রের ইনফর্মেশন অফিসার।
এই তো! সম্বরণ পালধি। নাম্বারটা আশা করা যায় এর মধ্যে পালটায়নি।
বাড়িতেই ছিল সম্বরণ। পরিচয় দিতেই রাহুলকে চিনতে পেরেছে: আরে মশাই, এতকাল পরে অধমকে স্মরণ! বলুন, বলুন–
একটা প্রয়োজনে ফোন করছি। সাহায্য করলে উপকৃত হব।
আপনাদের উপকার করতে পারলে তবেই না দু-বেলা দু-মুঠো জুটবে। বুদ্ধিজীবীদের কৃপা ছাড়া তথ্যজীবীরা…।
আমার মেয়ে রিমা নক্ষত্ৰচারী ডি-সেভেনে ছিল।
অপর পক্ষ এবার নীরব।
সহানুভূতির দরকার নেই। একটা খবর জানতে চাই। মহাকাশে অভিযান শুরু হওয়ার পর ক-টা যাত্রীবাহী রকেট উল্কার সঙ্গে সংঘর্ষে ধ্বংস হয়েছে? নিশ্চয়ই আপনাদের…
সরি, রাহুলদা। অসম্ভব। এগুলো আমাদের ভাষায় ক্লাসিফায়েড ইনফর্মেশন এক্স। কোনওভাবেই জানানো…
কানেকশন ছিন্ন করে দিল রাহুল। ঘড়ির দিকে তাকাল। সকাল ছ-টা বাজতে দশ। রিমাদের স্কুলের ক্লাস শুরু হতে ঘণ্টাদেড়েক বাকি। কিন্তু আর বসে থাকতে পারছে না। গত রাতটার সঙ্গে যুঝে ওঠার মতো অভিজ্ঞতা ছিল না রাহুলের। এমনকী জয়া চলে যাওয়ার পর প্রথম রাতটার সঙ্গেও এর কোনও তুলনা হয় না।
.
ভোররাত থেকে বৃষ্টি থেমেছে। আকাশ পরিষ্কার। গাড়িটা পার্ক করে গেটের সামনে সে দেখল, নোটিশ ঝুলছে, আজ স্কুল বন্ধ থাকবে। কেন, তার উল্লেখ নেই। দু-পাশে খেলার মাঠ, মাঝখান দিয়ে খোয়া বিছানো পথ। তারই প্রান্তে স্কুলের বাড়ি। পোটিকোর সিঁড়িতে পা দিতেই দারোয়ানের দেখা পাওয়া গেল।
হেডমিস্ট্রেস
যান। দোতলায় বাঁ-দিকের ঘর।
মিস চৌধুরির সঙ্গে রাহুলের পরিচয় আছে। ক্লাসরুমের বাইরে তাঁর চেন-স্মোকিং ভালো লাগেনি। জয়ার সঙ্গে কোথায় যেন একটা মিল। মানসিক অস্থিরতার প্রকাশে সম্ভবত।
চৌধুরি একা নয়, ঘরে আরও তিনজন টিচার ছিলেন। দরজায় নক করেছিল কিন্তু অপেক্ষা করেনি।
মিস চৌধুরি উঠে দাঁড়িয়েছেন। রাহুল নীরবে এগিয়ে এসে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল। অন্য শিক্ষিকারা, দেখেই বোঝা যাচ্ছে, রাহুলের পরিচয় জানেন না।
রাহুল বলল, আমি রিমার বাবা। তারপর মিস চৌধুরির দিকে ফিরে বলে, দু-একটা কথা জানতে এসেছি।
চৌধুরি দাঁড়িয়েই আছেন। স্টিল রিমের চশমার পেছনে নিশ্চল দৃষ্টি, আড়ষ্ট শরীর। বব করা চুলের কাঁচাপাকা কয়েক গুচ্ছ বাঁ কপালের ওপর।
রিমার গ্যারান্টার হিসাবে ফর্মে আমি যখন সই করি, পড়েও দেখিনি। সত্যি বলতে রিমা যে চান্স পাবে…
রাহুলের কথার মাঝখান থেকে একজন শিক্ষিকা উত্তেজিত কণ্ঠে বলে ওঠেন, আমিও তো ভাবিনি। অবাক হয়েছিলাম। আমি রিমার ক্লাস-টিচার। সবাইকে চমকে দিয়েছিল।
দ্বিতীয় শিক্ষিকা যোগ করেন, শুধু রিমা কেন, ক্লাসের আরও যে তিনজন ছাত্রী। সিলেক্টেড হয়েছিল, তারা কিন্তু কেউই স্ট্যান্ড-করা মেয়ে নয়।
রাহুলের মনে পড়ে, রিমা বলেছিল, তাদের ফার্স্ট গার্ল জয়িতার নাকি রীতিমতো নার্ভাস ব্রেক-ডাউন হয় প্রতিযোগিতার ফল বেরবার পর। পরীক্ষায় দ্বিতীয় হওয়ার অভিজ্ঞতা হয়নি যার, পুরো বাতিল!
তা এরকম আনএক্সপেক্টেড রেজাল্টের কারণ কী? কী মনে হয় আপনাদের?
তিন শিক্ষিকাই একসঙ্গে কথা বলতে শুরু করেন। সেটা নাকি বলা সম্ভব নয়। পুরো পরীক্ষাটাই পরিচালনা করেছিল মিকিলেট কর্তৃপক্ষ। তাদের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিল পরীক্ষার দিন। উত্তরপত্রও সেদিনই সিল করে নিয়ে গিয়েছিল। তারপর যথাসময়ে রেজিস্টার্ড পোস্টে হেডমিস্ট্রেসের কাছে রেজাল্ট শিট এল। তাদের নিজস্ব বিচারকরা কীভাবে মেরিট যাচাই করেছেন, কেউই তা জানে না।
মিস চৌধুরি প্রথম মুখ খুললেন এবার, সবটাই ঠিক এবং এটাও সত্যি যে, প্রতিযোগিতার ব্যাপারে ওরা প্রথম যে-সার্কুলার পাঠিয়েছিল, তাতেও এই শর্তগুলোর কথাই ভিন্ন ভাষায় হলেও স্পষ্ট বলা ছিল। এই প্রতিযেগিতা পরিচালনায় স্কুল কর্তৃপক্ষের কোনও ভূমিকা থাকবে না। কলকাতার তিনটেমাত্র। স্কুল এই শর্তে রাজি হয়নি, বাকি সবাই আমাদের মতো…
রিমার ক্লাস-টিচার বললেন, কিন্তু তখন যদি আমরা রাজি না হতাম, গার্জেনদের কাছ থেকে কীরকম চাপ আসত বলুন তো! এমন একটা সুযোগ…।
রাহুল স্বীকার করে, কথাটা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। মিস চৌধুরি নীরবে ঠোঁটে ঠোঁট কামড়ে ঘাড় নাড়ছেন। সহানুভূতি প্রকাশের কোনওরকম চেষ্টা না করায় রাহুল নিজের অজান্তেই প্রথমে ভদ্রমহিলার প্রতি কৃতজ্ঞ বোধ করেছিল। এখন একটু বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে। আর পাঁচজনের থেকে সবসময়েই উনি বেশি বোঝেন যেন। নিজেকে জাহির করার ইচ্ছে।
চৌধুরির অভিমত শোনার কোনও ইচ্ছে নেই বুঝিয়ে দেওয়ার জন্যই রাহুল তার পুরানো প্রশ্নে ফিরে গেল, আমাদের দিয়ে যে বন্ডটা সই করিয়ে…।
এইটুকু অগ্রাহ্য দিয়ে চৌধুরির মতো জাঁদরেল হেডমিস্ট্রেসকে নড়ানো যায় না। রাহুলের চেয়েও কাটা কাটা শব্দে তিনি বললেন, বন্ড নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ কী? বন্ড যা হয় তা-ই। দুর্ভাবনার একটাই কারণ। আমি জানি, এই প্রতিযোগিতায় কী যাচাই করা হয়েছিল। জানি মানে কালকে জানতে পেরেছি। টেলিভিশনে যখন একের পর এক…।
চৌধুরির কথা সম্পূর্ণ করল রাহুল, রিমাদের মুখগুলো দেখাচ্ছিল… বলুন, বলুন সেন্সলেস হয়ে পড়ব না…
রাহুলের তিক্ততার উত্তরে ঝাঁজিয়ে উঠলেন চৌধুরি, সেন্স থাকলে তবে তো সেটা হারাবার ভয়। একবারও আপনাদের কারও মাথায় ঢুকল না যে, প্রত্যেকটা মেয়েই কীরকম সুন্দরী! হ্যাঁ–ওইটাই ছিল একমাত্র বিবেচ্য। পরীক্ষা-প্রবন্ধ–সব বোগাস। আইওয়াশ। পরীক্ষার দিন যে পরিদর্শক পাঠিয়েছিল, সে-ই করেছে নির্বাচন। শুধু মুখ দেখে। বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করার মতো সুন্দর সুন্দর মুখ।
টেলিভিশন যখন প্রথম আঘাত করেছিল, তখনও রাহুলের গলার কাছে এরকম কান্নার ডেলা জমেনি। কিন্তু মিস চৌধুরির যেন রোখ চড়ে গেছে।
আসুন এদিকে। দেখে যান নিজের চোখে। আজ ভোর পাঁচটায় এসে হাজির হয়েছি আমি এই জন্যেই। একবার নয়, তিনবার দেখেছি। এটা অনুমান নয়।
হেডমিস্ট্রেসের সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ডান পাশে ছোট্ট আধা-পার্টিশন বসানো খুপরিতে পার্সোনাল কম্পিউটারের সামনে এসে দাঁড়াল রাহুল। তার পেছনে তিনজন শিক্ষিকা।
চেয়ারে বসে কি-বোর্ড অপারেট করছেন চৌধুরি।
একে একে দেখে যান রিমার ক্লাসের মেয়েদের ছবি। ইন অর্ডার অব মেরিট। ফার্স্ট গার্ল।
রাহুল অস্ফুট স্বরে বলল, জয়িতা।
সিলেক্টেড হয়নি। এবার সেকেন্ড গার্ল। রীতা। চান্স পায়নি। থার্ড গার্ল–নো।
ক্লাসের পরীক্ষায় গতবার যারা প্রথম দশটি স্থান পেয়েছে, তাদের কেউই মৃত্যুর ডাক শোনেনি। এগারো নম্বরে পৌঁছে ফুটে উঠল স্বাতী, আর মিস চৌধুরি ঘাড় বেঁকিয়ে পেছনে তাকালেন: আমাকে নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না, স্বাতী কেন নির্বাচিত হয়েছে? আর একবার দেখবেন প্রথম থেকে? কেন জয়িতারা বেঁচে গেল? চৌধুরি যেন আপন মনেই বকে চলেছেন।
প্লিজ, এবার বন্ধ করুন। মুখে বলে রাহুল, কিন্তু তার হাতের মুঠি দুটো চেয়ারের ব্যাকরেস্টটাকে শক্ত করে চেপে ধরেছে আর চোখ দুটো আটকে রয়েছে কম্পিউটারের স্ক্রিনে।
শক থেরাপি তো বটেই। তবে শুধু এইটুকুতে বিশেষ উপকার করতে পারতেন না মিস চৌধুরি। তিনি সব বোঝেন, বোঝাতেও চান, কিন্তু সেটা শুধু রিমার বাবার খাতিরে। অর্থাৎ হতভাগ্য এক পিতার স্বার্থে।
রাহুল অনুরোধ করেছিল খবরের কাগজে একটা বিবৃতি দেওয়ার জন্য। অনুসন্ধানের দাবিতে। সঙ্গে সঙ্গে মিস চৌধুরি হেডমিস্ট্রেস হয়ে গেলেন। সরাসরি প্রত্যাখ্যান। সেটা সম্ভব নয়। আফটার অল, ধারণা ধারণাই। পাবলিক স্টেটমেন্ট দিতে হলে তার আগে ম্যানেজিং কমিটির সঙ্গে কথা বলা দরকার।
রাহুলের মনে হয়, ইনি সেই ইন্টেলেকচুয়াল গোত্রের মানুষ, যিনি শুধু নিজের আত্মার উন্নতির জন্য সত্যের সন্ধান করেন।
আরও চারটে মেয়েদের স্কুল ঘোরার পরে রাহুল বুঝতে পারল, কারও কাছ থেকেই এই সন্দেহের কথা লিখিত বিবৃতিরূপে সংগ্রহ করা যাবে না। প্রথমত, সবাই এই কথা মানতে রাজি নয়। দ্বিতীয়ত, কেউই এসবের মধ্যে নিজেকে জড়াতে চায় না। তা বলে রাহুলের কোনও লাভ হয়নি বলা ঠিক নয়। মিস চৌধুরি একটা সন্দেহ জাগিয়েছিলেন। স্কুলগুলো ঘোরার সুবাদে মিকিলেট নির্বাচিত অন্য ছাত্রীদের ছবি দেখার পর, সন্দেহটা এখন সিদ্ধান্তে পরিণত। অদ্ভুত হচ্ছে, তার মনের অস্থিরতা যেন এখন অনেকটা আয়ত্তের মধ্যে। ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করতে পারছে রাহুল।
চিফ সাব-এডিটর নয়, বন্ধু হিসেবেই দীপেশের সঙ্গে কথা হচ্ছিল রাহুলের। খুঁটিয়ে প্রশ্ন করে দীপেশ প্রায় সবই জেনে নিয়েছে। প্রখর বুদ্ধিমত্তা আর নিউজ সেন্স ছাড়া এরকম। পোস্টে ওঠার সুযোগ মেলে না।
কফির কাপটা নামিয়ে রাহুল সিগারেট বার করতেই দীপেশ সামনে ঝুঁকে নিজের লাইটারের শিখাটা বাড়িয়ে ধরল।
তাহলে একটা নিউজ তুই করছিস? রাহুলের ধারণা, আর কিছু না হোক, শুধু চাঞ্চল্যকর হিসেবেও খবরটাকে লুফে নেবে দীপেশ।
কীসের নিউজ?
মানে? তাহলে এতক্ষণ শুনলি কী?
সরি। তুই কিন্তু ভুল বুঝেছিস। তোর ভিউপয়েন্টটা ইন্টারেস্টিং ঠিকই, কিন্তু আই মাস্ট সে, ইউ আর অন এ রং ট্র্যাক।
ঠিক কি ভুল তা নিয়ে তোকে মাথা ঘামাতে হবে না, দীপেশ। প্লিজ–একটা কথা শোন –আচ্ছা, বেশ, খবরের দরকার নেই। ধরু, আমি যদি একটা চিঠি দিই, সেটা ছাপবে তো?
অসম্ভব। কোনও প্রশ্নই ওঠে না।
রাহুল উঠে দাঁড়াল: কেন, সেটা কি জানতে পারি? অনেক অনেক টাকার বিজ্ঞাপন দেবে ওরা, তা-ই না? মিকিলেট হাতছাড়া হয়ে যাবে?
না। আবার ভুল করছিস। মিকিলেট আর কোনওদিনই বিজ্ঞাপন দেবে না। দোষ নেই তোর, বুঝতে পারছি, আজকের খবরের কাগজ পড়িসনি। মিকিলেটকে ডিজলভ করে দেওয়া হয়েছে। এমন অপয়া সূচনার পর সেটাই স্বাভাবিক। শোন্ রাহুল, মিকিলেট সম্বন্ধে তোর ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। মিকিলেট কোনও ভুইফোঁড় উটকো কোম্পানি নয়। এটা ছিল স্মিথ লেশনার অ্যান্ড মুখার্জি ইন্টারন্যাশনালেরই একটা নতুন ভেঞ্চার। বুঝলি এবার! হ্যাঁ, আমার কাগজটাও ওই গ্রুপেরই।
ড্রাইভ-ইন-পার্কে বসে চারটি খবরের কাগজ শেষ করেছে রাহুল। প্রত্যেকটার হেডলাইনে। দুর্ঘটনা। নতুন খবর কিছুই নেই। ছবিও প্রায় একই। উল্কার সঙ্গে আসন্ন সংঘর্ষের রেডিয়ো-চিত্র। শিশুাত্রীদের পরিচয়। নিহতদের বাবা-মা-র সঙ্গে কয়েকটি সাক্ষাৎকার। দীপেশ ঠিকই বলেছে, স্মিথ লেশনার অ্যান্ড মুখার্জির বিরাট সাম্রাজ্যেরই অংশ মিকিলেট। দু-পাতা জুড়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছে তারা প্রত্যেকটা পেপারে। তার মধ্যেই আছে আন্তর্জাতিক রকেট পরিবহণ নিয়ন্ত্রক সংস্থার সার্টিফিকেটের প্রতিলিপি। নক্ষত্ৰচারী ডি-সেভেন-এর লাইসেন্সে কোনও খুঁত নেই। ট্যাক্স জমা পড়েছে, ফিটনেস সার্টিফিকেট নবীকরণ হয়েছে। শুধু দু-মাস কেন, এই রকেট দশ বছর মহাকাশভ্রমণের ছাড়পত্র পেতে পারে। ক্লাস ওয়ান পর্যায়ের মহাকাশযান।
এমনকী সন্দেহজনক ইনশিয়োরেন্সের ব্যাপারটা তারা নিজেরাই উত্থাপন করেছে। উল্কার সঙ্গে সংঘর্ষের দায়িত্ব বিমা কর্তৃপক্ষের না হলেও কোম্পানি স্বয়ংপ্রবৃত্ত হয়ে দুর্ঘটনাগ্রস্তদের মোটা টাকা ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সেটা বিমার পরিমাণের এক চতুর্থাংশ হলেও…
রাহুল বুঝতে পারে, এই কোম্পানির পক্ষে দুর্ঘটনার আর্থিক দায়িত্ব বহন করা তেমন কিছু নয়। পৃথিবীর ইস্পাত, তেল ও কয়লাখনির মালিকানা ছাড়িয়ে ওরা এখন মহাকাশে পাঁচ রকেট-বর্ষ দূরের কর্ণিকা গ্রহেও গড়ে তুলেছে বিরাট খনিশিল্প উদ্যোগ। প্রতি মাসে তাদের কারগো-রকেট দুর্লভ সব খনিজ সামগ্রী বয়ে নিয়ে আসছে পৃথিবীতে। মহাকাশের চারটি ভিন গ্রহে খননকার্যের অধিকার পেয়েছে চারটি কোম্পানি। তাদের মধ্যে শীর্ষস্থানে রয়েছে স্মিথ লেশনার অ্যান্ড মুখার্জি। মাত্র বছর পনেরোর মধ্যে ফুলেফেঁপে উঠেছে এরা। সন্দেহ নেই যে, তাদের সাফল্য-কাহিনির কেন্দ্রে রয়েছে মহাশূন্যের ওই বন্ধ্যা কর্ণিকা, যেখানে একটি শেওলা বা অ্যামিবা অবধি আজও জন্ম নেয়নি।
উদ্দেশ্যহীনভাবে প্রায় ঘণ্টাখানেক কলকাতার পথে পথে গাড়ি ছুটিয়ে বেড়াচ্ছে রাহুল। এমন কোনও জায়গায় পৌঁছাতে পারেনি, যেখানে থামতে পারে। এলগিন অ্যাভিনিউয়ে ট্রাফিক সিগন্যালে পড়ে ইঞ্জিন বন্ধ করেছিল। ইগনিশনের চাবিতে বারবার আধ প্যাঁচ দিয়েও আর স্টার্ট নেয়নি। পেট্রোল ফুরিয়েছে। অজস্র হনের একটি সর্পিল হুংকারকে পেছনে রেখে একাই গাড়িটাকে ঠেলে রাস্তার পাশে এনে দাঁড় করিয়ে দিল।
বাড়ি ফেরার কথা ভাবেনি, কিন্তু মিনিট দশেক হাঁটার পর রাহুল আবিষ্কার করল, নিজের ফ্ল্যাটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
বসার ঘরে প্রতুলকে দেখে অবাক হল না। খবরটা না-পাওয়ার তো কোনও কারণ নেই। কিন্তু বাবা যদি জানতে পারেন তো আরেকটা স্ট্রোক অবধারিত।
রাহুল বসে একটা সিগারেট ধরিয়ে প্যাকেটটা ভাইয়ের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, বাবা শুনেছে?
না। টিভির খবরের আগেই শুয়ে পড়েছিল। খবরের কাগজগুলোও আজ সকালে সরিয়ে ফেলেছি।
জানতে ঠিকই পারবে। আজ বা কাল।
ফোন বেজে ওঠে। দু-জনেই উঠে দাঁড়িয়ে ছিল। রাহুলই তৎপর হয়ে ফোনটা ধরল।
আবার জয়া, সকাল থেকে বারবার চেষ্টা করছি। কোথায় ছিলে?
জয়ার চেহারা, তার উচ্চারণ একেবারে অচেনা ঠেকছে। এই জয়াকে কোনওদিন দেখেনি রাহুল। জয়াকে ক্লান্ত দেখাতে পারে–অবিশ্বাস্য! তার উচ্চারণ থেকে চর্চা-করা আদিখ্যেতার রেশগুলোও উবে গেছে।
রাহুল! শুনছ তুমি! সাংঘাতিক কিছু একটা হয়েছে নিশ্চয়। ইমিডিয়েটলি খোঁজ নাও। ক্যালকাটা সেন্ট্রাল জেলের তিনশো সতেরো নম্বর। লাইফ টার্ম আসামি। প্রদীপ্ত সব কথা আমাকে বলে না, কিন্তু… কিন্তু ও জানে না যে, ডি-সেভেনের রিমা আমার মেয়ে…।
হঠাৎ ফোন কেটে গেল। পাশে দাঁড়িয়ে প্রতুল সবই শুনেছে। তার দিকে ফিরে রাহুল বলল, জয়া কি পাগল হয়ে গেল নাকি?
আশ্চর্য নয়। তবে তুই জানিস কি না জানি না, প্রদীপ্ত, মানে প্রদীপ্ত মুখার্জি হচ্ছে স্মিথ লেশনারের ইয়াংগেস্ট ডিরেক্টর। গত দেড় বছর ওর সঙ্গেই আছে জয়াদি।
রাহুল শূন্যদৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে।
প্রতুল বলে, আরও একটা কথা। ঘণ্টাখানেক আগে সানগ্লাস-পরা রোগা-বেঁটেমতো একটা লোক এসেছিল। ভঙ্গিটা খুব সন্দেহজনক। তুই নেই শুনে যেন হাঁপ ছেড়ে পালাচ্ছিল। তারপর লিফটের মুখ থেকে আবার ফিরে এল। বারবার পেছন ফিরে দেখছে। প্যান্টের পকেট থেকে একটা প্যাকেট বার করে আমার হাতে দিয়ে বলল, এইটা দিলেই হবে। তারপরে প্রায় দৌড়।
একটু নাকিসুরে কথা বলছিল কি?
হ্যাঁ। চিনিস তাহলে লোকটাকে?
নিশ্চয়ই সম্বরণ। কিন্তু কী দিয়ে গেল…
একটা ভিডিয়ো ক্যাসেট। মিনিট সাতেকের। তোর ঘরে বসেই দেখেছি। সাত বছর আগে যাত্রীবাহী রকেট আরএমভি-টেনের সঙ্গে উল্কার সংঘর্ষের ছবি। কোনও সন্দেহ নেই। যে, এই টেপটাকেই কাল আমাদের দেখানো হয়েছে। নক্ষত্ৰচারী ডি-সেভেনের নামে চালিয়েছে।
.
আত্মীয় বা আইনজীবী ছাড়া বন্দিদের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি পাওয়া কঠিন। যাবজ্জীবন দণ্ডিতের ক্ষেত্রে তো প্রায় অসম্ভব। সব দিক চিন্তা করেই রাহুল এসেছিল মানবিক অধিকার রক্ষা পর্ষদের দপ্তরে। মিস্টার সেনশর্মার দেখা পাওয়ার জন্য আধ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হলেও কাজ হয়েছে। কোনও কথা গোপন করেনি। সেনশর্মা রাজি হয়েছেন। পর্ষদের লেটারহেডে একটা চিঠি টাইপ করে দিয়েছেন তিনি। নিচে রাহুলের সই অ্যাটেস্ট করা। এর জোরে প্রয়োজনীয় অনুমতি পাওয়ারই কথা।
জেলখানার অভ্যর্থনাকক্ষে অপেক্ষা করছে রাহুল। মিনিট দশেক পেরতে চলল, চিঠিটা হাতে নিয়ে রিসেপশনিস্ট সেই যে উধাও হয়েছে, আর পাত্তা নেই।
সাদা পোশাকের দশাসই চেহারার এক ভদ্রলোককে ঢুকতে দেখেই দরজার দুই প্রহরী আড়ষ্ট হয়ে স্যালুট জানাল।
জেলার বা ডেপুটি জেলার, ভেবেছিল রাহুল। কিন্তু অনুমান ভুল। রাধাবাজারের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের জাঁদরেল অফিসার।
চিঠিটা আপনি এনেছেন? ভঙ্গিটাই যেন আদেশ যে, এখুনি উঠে দাঁড়ান, দাঁড়িয়ে জবাব দিন।
রাহুল আরও ভালো করে ঠেস দিয়ে বসে বলল, একটা লেটার অব ইন্ট্রেডাকশন নিয়ে এসেছি আমি। তিনশো সতেরো নম্বরের সঙ্গে দেখা করার জন্যে।
চলুন।
অফিসার রাহুলকে নিয়ে বাইরের চত্বরে বেরিয়ে এল। সামনেই অপেক্ষা করছিল জানালায় তারের জাল বসানো কালো ভ্যান। পেছনের দরজা খুলে রাহুলকে বলল, উঠুন।
রাহুল আপত্তি করল না। পাশেই দুই পুলিশ প্রহরী। তাদের মতিগতি সুবিধের ঠেকছে না।
পুলিশ অফিসার ড্রাইভারের পাশের সিটে বসেছে। কয়েকবার প্রশ্ন করে রাহুল একটাই উত্তর পেয়েছে: আর মিনিট দশেক ধৈর্য ধরুন।
তবু পরবর্তী অধ্যায়ের জন্য প্রস্তুত ছিল না রাহুল। ছ-জন উচ্চপদস্থ অফিসার ঘিরে ধরেছে তাকে এবং গুলির মতো প্রশ্ন ছুটছে–কেন রাহুল তিনশো সতেরোকে দেখতে এসেছে? আজই বা এল কেন? তিনশো সতেরো তার কে হয়? সে কি জানে তিনশো সতেরোর নাম? কী জানে সে তার সম্বন্ধে?
সন্তোষজনক কোনও উত্তর দেওয়ার উপায় ছিল না রাহুলের। তাহলে জয়াকে জড়াতে হয়। মানবিক অধিকার রক্ষা পর্ষদের দোহাই দিয়েও এগতে পারেনি। হঠাৎ সব ছেড়ে তিনশো সতেরো কেন?
রাহুল বলে, অযথা তিলকে তাল করছেন আপনারা। এর পেছনে কোনও পরিকল্পনা…
কোনও পরিকল্পনা নেই! একজোড়া গোঁফ বেঁকিয়ে ঝুঁকে পড়ল একজন: তাহলে দীপনারায়ণের আজ জেল পালানোর পরিকল্পনার কথাটাও সত্যিই আপনি জানতেন না?
জেল পালানো? দীপনারায়ণ?
বাঃ, আপনি অবাক হচ্ছেন? যা-ই হোক, মনে হয় আপনাকে খুশি করতে পারব না। আপনি কনফার্ম করতে এসেছিলেন, দীপনারায়ণ পালিয়েছে! আমরা জানি। কিন্তু বেচারার গ্র্যান্ড প্ল্যান বানচাল হয়ে গেছে। দ্বিতীয় ফটক আর পেরতে হয়নি। আরে মশাই, যত বুদ্ধি, সবই থাকবে ক্রিমিনালদের? তাহলে আমরা তো ভেসে যাব।
কোথায় দীপনারায়ণ? আই মাস্ট টক উইথ হিম। রাইট নাউ।
রাহুলকে টেনে বসিয়ে দিয়েছে। দীপনারায়ণের সঙ্গে আর কারওই কথা বলার উপায় নেই। সেন্ট্রির রাইফেলের নিশানায় কোনও গলতি ছিল না।
প্রশ্নের কোলাহল কিছুক্ষণ কানে ঢোকেনি রাহুলের। রাহুলের এবার সত্যিই ক্লান্ত লাগছে। মুখ তুলে ধীরে ধীরে বলল, আপনাদের সব প্রশ্নের উত্তর আমি দেব। কিন্তু তার আগে একবার ডিসি সাউথ, ওয়েস্ট মিস্টার চক্রবর্তীর সঙ্গে কথা বলতে চাই। আমার ছোট কাকা।
.
চক্রবর্তীর ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপে রাহুল অব্যাহতি পেয়েছে। তবে প্রতিদিন সকালে তাকে ব্যক্তিগতভাবে হাজিরা দিয়ে যেতে হবে। তিন দিন বাদে পরবর্তী ইন্টারোগেশন। সেদিন তার কাকাও থাকবে।
গাড়িটা এতক্ষণ রাস্তার ধারেই পড়ে ছিল। এবার ওটা তার দরকার। জেরিক্যান থেকে পেট্রোল ঢেলে ঘড়ির দিকে তাকাল। ছ-টা বাজতে দশ। অফিস-ভাঙা পথের কথা হিসেবে রেখেও সাতটার মধ্যে নিশ্চয়ই পৌঁছাতে পারবে।
দশ মিনিট আগেই পৌঁছে গেল। সোনাগাছি সুপার কমপ্লেক্স। থ্রি-স্টার রুমের অতিথিরা গাড়ি চালিয়েই উঠে আসতে পারে সেভেন্থ ফ্লোরের পার্কিং কর্নারে। এখানে নবাগত নয় রাহুল। জয়া চলে যাওয়ার পর থেকে মাস দুই অন্তর নিয়মিত আসছে। আসতে বাধ্য হয়েছে। মানসিক ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য একটা দুষ্পচ্য ওষুধ ঢক করে গিলে ফেলা। শরীরের দাবিকে পুরো অবহেলা করার মতো নীতিধর্মে বিশ্বাস রাহুলের কোনওদিনই ছিল না।
নিনি, টিনা ও রিনি। তিনজনকে মোটামুটি চেনে। প্রত্যেকেই সিলিকন সুন্দরী। কোনারকের প্রস্তরীভূত সুন্দরীদের চেয়েও তাদের উন্নত স্ফীত বক্ষে সময় কোনও আঘাত হানতে পারবে না।
প্রতি মাসে একটি করে সিলিকন ইনজেকশনের আরও দুটি সুফল আছে। তারা আকাঙ্খ্যার বস্তু, কিন্তু নিজস্ব কোনও আকাঙ্খ্যা নেই। সুপারম্যানের স্পর্শেও তাদের কোমলতম অঙ্গে অনুভূতি সঞ্চারিত হয় না। দ্বিতীয়ত, বছর কুড়ির বেশি এই ইনজেকশন নেওয়ার দরকার হয় না। অতদিন কেউ বাঁচে না।
তাপনিয়ন্ত্রিত ঘর থেকে নিনিই প্রথম দেখেছে রাহুলকে। অনাবৃত ঊর্ধ্বাঙ্গ কাচের জানলায় ঠেকিয়ে মাইক্রোফোনে তার নাম ধরে ডাকল।
কাউন্টারের সামনে মিনি কম্পিউটারে নিনির কোড নম্বর টাইপ করে তিন ঘণ্টার চার্জ পে করতেই কিউবিকলের এক পাল্লা দরজা নিঃশব্দে পথ ছেড়ে পাশে সরে গেল। টয়লেটে ঢুকে বাধ্যতামূলক মেডিক্যাল বাথ নিতে হবে শয়নকক্ষে প্রবেশের আগে। অপরিচিত প্রেমিকের ক্ষেত্রে নিনি অবশ্যই সবার আগে ডাক্তারি সার্টিফিকেটটা দেখতে চাইত।
বেডরেস্টে হেলান দিয়ে রাহুল চাদরটা কোমর অবধি টেনে নিল। নিনি ড্রেসিং গাউন চড়িয়ে লম্বা গেলাসে সাবধানে বিয়ার ঢালছে। ফেনা হলে চলবে না। দুটো বিয়ার ও গোটা চারেক সিগারেট শেষ করবে রাহুল, তারপর বলবে, আলো নিবিয়ে দাও। রাহুলের অভ্যাস তার অজানা নয়। ভিডিয়োতে ব্লু-ফিল্ম দূরের কথা, লাইট মিউজিক অবধি তার বরদাস্ত হয় না।
এক চুমুকে বিয়ারের গেলাস ফাঁকা করে রাহুল বলল, আচ্ছা, দীপনারায়ণকে তুমি চিনতে?
দীপনারায়ণ! একটু যেন চমকে গেল নিনিঃ হঠাৎ? চিনব না কেন, এই কমপ্লেক্সের কে না চেনে? তবে পিয়া ছাড়া আর কারও রুমেই কখনও ঢোকেনি।
এবং পিয়াকেই সে এই কমপ্লেক্সে গত বছর গলা টিপে খুন করেছে। ছোট্ট একটা খবর বেরিয়েছিল তখন। কিন্তু নিনি বা কার মুখে যেন এখানেই তখন অনেক কথা শুনেছিল রাহুল। এসব কাহিনি তাকে টানে না। বলতে গেলে সে-ই জোর করে থামিয়ে দিয়েছিল বক্তাকে। এখন অস্পষ্ট মনে পড়ছে, দীপনারায়ণ নাকি আগেও খুন করেছিল। ফাঁসির আসামি। ধরা পড়েও কীভাবে পালিয়েছিল। পিয়ার প্রতি অদ্ভুত আকর্ষণ ছিল। প্রতি রাতে আসত ঘড়ির কাঁটা ধরে। পিয়াকে এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল তার। পিয়া রাজি হয়নি বলেই নাকি…
পিয়াকেও তো চিনতে তুমি? রাহুল প্রশ্ন করে।
খুউব। ওর মুখেই তো দীপনারায়ণের সব গল্প শুনেছি। একেবারে জন্তুর মতো চালচলন। আবার নাকি ভালোবাসত। পিয়ার অত দূর এগনো উচিত হয়নি। কিন্তু…
কিন্তু কী?
বোধহয় প্রচুর টাকাপয়সা দিত।
যাঃ। একটা ফেরারী আসামি
ফেরারী আসামি তো কি? জান কোত্থেকে পালিয়েছিল? কর্ণিকা থেকে। আজ অবধি ওই একজনই পালাতে পেরেছে। ষোলো বছর বয়েসে প্রথম মার্ডার করে। তারপরে প্রাণদণ্ডের আদেশ হলে কর্ণিকায় চাকরি নিয়ে চলে যায়।
সোজা হয়ে বসে রাহুল। মনে পড়েছে যে কথাটা অনেক আগেই মনে পড়া উচিত ছিল। শুধু কর্ণিকা নয়, মহাশূন্যের যে চারটে গ্রহে খননকার্য চলছে, সেখানে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত আসামি ছাড়া আর কোনও লোককে তিন মাসের বেশি বাস করার অনুমতি দেওয়া হয় না। এটা আন্তর্জাতিক আইন। সেই আইন পাশের সময়ও তুমুল ঝড় উঠেছিল। শুধু মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত নয়, তারা স্বেচ্ছায় রাজি হলে তবেই। ভিন গ্রহে প্রথম খনি শ্রমিকদের ব্যাচটা কবে রওনা হয়েছিল মনে নেই, তবে দীপনারায়ণ নিশ্চয়ই তাদেরই একজন।
গেলাসে বিয়ার ঢালতে ঢালতে নিনি বলল, তুমি যা-ই বল, পিয়াকে ও খুন করেছে, কিন্তু ওর জন্যেই আমরা বেঁচে গেছি।
আরও বিস্ময়।
সত্যিই বেঁচে গেছি। লুকিয়ে কর্ণিকায় নিয়ে যাওয়ার জন্যে কীরকম টোপ ফেলেছিল, জান? জনে জনে আলাদা করে বলেছিল। যাতায়াতে দশ বছর আর কর্ণিকায় পাঁচ। সবসুদ্ধ পনেরো। কিন্তু টাকা যা দেবে, সারা জন্মে রোজগার করতে পারব না। দীপনারায়ণ না এলে আমরা কি জানতে পারতাম যে, কর্ণিকায় আট-দশ বছর ধরে প্রায় হাজারখানেক লোক কী অবস্থায় বাস করছে। একটা মেয়েছেলের মুখ দেখার সুযোগ পায়নি। পিয়ার মুখেই শুনেছিলাম, দীপনারায়ণ নাকি কর্ণিকায় বসে ব্লু-ফিল্ম দেখেই পিয়াকে পছন্দ করে রেখেছিল। কিন্তু শুধু ব্লু-ফিল্ম দিয়ে আর কাজ হচ্ছে না। কেউ ভুলছে না। কাজকর্ম নাকি সব বন্ধ হওয়ার উপক্রম। সেই জন্যেই…
তোমাদের মধ্যে কেউ রাজি হয়নি?
একজনও না! ওখানে পৌঁছাবার পর আমাদের কী হবে, সেটা বুঝতে পারছ কি? ছিঁড়ে ফেলবে…
মুখে হাত চাপা দিয়ে টয়লেটে গিয়ে ঢুকল রাহুল। পেটে মোচড় দিয়ে ওয়াক আসছে।
.
একের পর এক গাড়ি রাহুলকে ওভারটেক করে যাচ্ছে। রাস্তা ফাঁকা। কিন্তু তার কোনও তাড়া নেই। কী ঘটছে, সেটা আর তার অজানা নেই এবং তাকে এখন কী করতে হবে, সেটাও স্পষ্ট।
সতর্ক হয়ে গাড়ি চালানো দরকার। রাহুলের জীবনটা এখন বিশেষ মূল্যবান। কোনও অকারণ ঝুঁকি নেওয়া চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় হবে।
দীপনারায়ণকে ওরা সুদলি সরিয়ে ফেলেছে। ভাবছে মোক্ষম প্রমাণ বুঝি ওই একটাই। কিন্তু তা নয়। সবচেয়ে বড় অস্ত্র ওই ভিডিয়ো ক্যাসেট। দেশে এখনও মানুষ আছে। সম্বরণ নিশ্চয়ই একটা কিছু আঁচ করেছিল বলেই দিয়ে গেছে ওটা। সেটা এখন প্রতুলের জিম্মায় তার ফ্ল্যাটেই রয়েছে। প্রমাণ হয়তো আরও মিলবে। হয়তো জয়া ইতিমধ্যেই আরও কিছু জানিয়েছে। সেই জন্যই প্রতুলকে বসিয়ে এসেছে ফ্ল্যাটে। এদিকে নিনিরা তো রয়েইছে।
ফ্ল্যাটের দরজায় বেল দিতে গিয়ে রাহুল দেখল পাল্লার ফাঁক দিয়ে একচিলতে আলো। ভেতরে ঢুকে নিজেই দরজাটা টেনে দিল। প্রতুল বোধহয় ভেতরের ঘরে। রেস্ট নিচ্ছে।
দরজার পরদাটা ঠেলেছিল, কিন্তু ভেতরে ঢুকতে পারেনি। ডাবল বেডের ওপর শুধু প্রতুল নয়, জয়াও আছে। হালকা নীল ও সবুজ রঙের এমব্রয়ডারির নকশাওয়ালা বেডশিট দুটো শরীরের রক্তে ভেসে গেছে।
রাহুল পেছন ফিরে ড্রয়িংরুমের ক্যাসেট প্লেয়ারটার দিকে ছুটে এল। কার্পেটের ওপর হাঁটু মুড়ে বসেছে। হাতের চাপ যতই বেশি হোক, নিরাসক্ত যন্ত্র তার স্বভাবসিদ্ধ অলস ভঙ্গিতে মুখ হাঁ করল। কিছু নেই! ক্যাসেট উধাও!
কী খুঁজছেন? ক্যাসেটটা? এই তো আমার কাছে রয়েছে। সোনালি কোনও স্বপ্নচূড়া থেকে মেঘের বাহনে ভেসে আসে মায়াবী শব্দ।
স্লো মোশন সিনেমার হরিণ শেষবার মাথা ফিরিয়ে যাচাই করে মরণের দূরত্ব। রিভলভারের নল।
সদ্য কন্যাশোকে কাতর জনৈক অধ্যাপক তার ভাইয়ের সঙ্গে প্রাক্তন পত্নীকে এক শয্যায় আবিষ্কার করার পর আত্মহারা হয়ে দুজনকেই হত্যা করে এবং তারপরে আত্মহনন।
প্রভাতি দৈনিকপত্রের এই সংবাদ হয়তো কিছু পাঠকের চোখে পড়ে। কিন্তু এখন আর কেউ নেই যে, জানিয়ে দেবে উৎসুক নক্ষত্রচারী ডি-সেভেন-এর অপ্রতিহত যাত্রার কথা। নির্ভুল লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে রকেট তার শিশুযাত্রীদের নিয়ে। আর কর্ণিকা অপেক্ষা করছে পাঁচ বছর পরে একশো সতেরোজন যোড়শীকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য।
[প্রথম প্রকাশ: দেশ, ১৯৮৯]