মহারাজ ও নর্তকী
আগ্নেয়াস্ত্র থেকে গুলি ছুড়ে একটা তাজা খুন!
কাঁপিয়ে দিয়েছিল ব্রিটিশ শাসনে থাকা ভারতবর্ষকে। নাড়া দিয়ে গিয়েছিল তৎকালীন দেশীয় রাজাদের অবস্থান। টলিয়ে দিয়েছিল নারীস্বাধীনতা সম্পর্কে মানুষের মনোভাব।
এই ঘটনার পটভূমি এক—শো বছর আগের বোম্বাই শহর।
১৯২৫ সালের ১২ জানুয়ারি। বোম্বাইয়ের অভিজাত মুসলিম মেমন বংশের সন্তান আবদুল কাদের বাওলা নিজের প্রেমিকাকে নিয়ে হাওয়া খেতে বেরিয়েছিলেন বিকেল বেলা। বোম্বাইয়ের মালাবার পাহাড়ের ওপরের কেম্পস কর্নার থেকে বেরিয়ে গিবস রোড ধরে ঝোলা ব্রিজের দিকে এগোচ্ছিল তাঁর মস্ত গাড়ি।
তাড়াহুড়োর কোনো ব্যাপার নেই। বাওলা সাহেব ড্রাইভারকে আগেই নির্দেশ দিয়েছিলেন, ”কোনো জলদি নেই। আস্তে আস্তে চলো। বহত খুবসুরত মৌসম হ্যায় আজ!”
আবদুল কাদের বাওলা বোম্বাইয়ের প্রথম সারির একজন ব্যবসায়ী। শরীরে খানদানি রক্ত বইলেও নিজের শ্রম ও অধ্যবসায়ের গুণে পারিবারিক ব্যবসাকে তিনি অতিঅল্প সময়েই অনেক গুণ বাড়াতে পেরেছেন। শুধু ধনসম্পত্তিতেই নয়, এই তরুণ বয়সেই প্রচুর জনহিতকর কাজের জন্য তিনি সমাজে একজন শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে উঠেছেন। ব্যবসায়িক কাজ, প্রচুর সম্পত্তি আর সমাজসেবা—এই নিয়েই অতিবাহিত হয় তাঁর ব্যস্ত জীবন।
কিন্তু খুব কেজো মানুষেরও কখনো—সখনো মনে প্রভূত রোম্যান্সের সঞ্চার হয়। বাওলা সাহেবেরও তাই হয়েছে এখন। মালাবার পাহাড়ের এত সুন্দর নৈসর্গিক দৃশ্য যেন চোখেই পড়ছিল না, তাঁর ঘন ঘন দৃষ্টি চলে যাচ্ছিল পাশের সিটে বসা অতুলনীয় সুন্দরী রমণীটির দিকে।
গাড়ির একদম পেছনের সিটে বসে আছে তাঁর ম্যানেজার ম্যাথিউ। তার উপস্থিতির কথা মনে করে বাওলা সাহেব নিজের চিত্তবৈকল্যে একটু রাশ টানতে চাইলেন, কিন্তু মন কথা শুনলে তো!
বাওলা সাহেব কিছুক্ষণ নিজেকে অন্যদিকে আটকে রাখতে চেষ্টা করলেন। অবশেষে সেই চেষ্টায় জল ঢেলে তিনি অকম্পিত চোখে তাকালেন ডান পাশে।
ঈশ্বরের সৃষ্টি এত অপরূপও হয়?
তাঁর পাশেই বসে আছে মুমতাজ বেগম। শাহজাহান পত্নী মুমতাজ নাকি অসামান্য সুন্দরী ছিলেন, তবু বাওলা সাহেবের মনে হয়, এই মুমতাজ শাহজাহানের মুমতাজের থেকেও সুন্দরী। খুব অল্পদিন পরিচয়েই সে বাওলা সাহেবের মনের অনেকখানি অধিকার করে ফেলেছে। হোক তার অতীত কলঙ্কিত, পদ্মফুলও তো পাঁকেই ফোটে।
যে যাই বলুক, বাওলা সাহেব সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছেন, মুমতাজকে তিনি বিয়ে করে স্ত্রীর সম্মান দেবেন। তবে মুমতাজ এখনও এই কথা জানে না। জানলে নিশ্চয়ই ওর গোলাপের পাপড়ির মতো গালদুটো লজ্জায় আরও লাল হয়ে উঠবে, দিঘল কালো চোখদুটো জলে ভরে উঠবে বাওলা সাহেবের প্রতি ভালোবাসায়, কৃতজ্ঞতায়।
পেছন থেকে ম্যাথিউ গলা খাঁকারি দিল, ”হুজুর, ব্রিজে কি নামবেন আপনারা?”
বাওলা সাহেব উত্তর দিলেন না। তিনি ততক্ষণে নিজের হাতের মধ্যে মুমতাজের নরম আঙুলগুলো তুলে নিয়েছেন। ঠান্ডা হাওয়া ঈষৎ শিরশিরানি ধরাচ্ছে। মুমতাজের কপালের সামনের সুন্দর কুচো চুলগুলো উড়ছে সেই হাওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে। মুমতাজ সামান্য হাসল। সেই হাসির সঙ্গে মুহূর্তে ঝরে পড়ল যেন একরাশ মুক্তো।
বাওলা সাহেব মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেলেন।
তাঁর মনে একটা গান গুনগুন করছিল। তিনি সবেমাত্র গানটা গাইতে যাবেন, হঠাৎ পাশ দিয়ে একটা লাল রঙের ম্যাক্সওয়েল গাড়ি সজোরে এগিয়ে গিয়ে বাওলা সাহেবের গাড়ির সামনে আড়াআড়াভাবে বেঁকে দাঁড়িয়ে ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষল।
কর্কশ শব্দে পারিপার্শ্বিক নৈশব্দ্য খানখান হয়ে গেল।
বাওলা সাহেবের ড্রাইভার অভিজ্ঞ। সে বিড়বিড় করল, ”শালা ওই ড্রাইভারটা নির্ঘাত টেনেছে!” সোজা গিয়ে লাল গাড়িটায় ধাক্কা মারার আগেই সে দক্ষ হাতে ব্রেক কষে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে দিল।
বাওলা সাহেব আর মুমতাজ বেগম কোনোরকমে গাড়ির হাতল ধরে সামলালেন নিজেদের। কপাল ঠুকে গেল ম্যাথিউয়ের।
”কোথাকার বেওকুফ লোক সব গাড়ি চালাচ্ছে আজকাল রাস্তাঘাটে—?” বাওলা সাহেবের মুখের কথা মুখেই রয়ে গেল, কারণ ততক্ষণে সামনের লাল ম্যাক্সওয়েল গাড়ি থেকে নেমে এসেছে চার—পাঁচজন লোক। তাদের কারুর হাতে পিস্তল, কারুর হাতে কুকরি, কারুর হাতে আবার চকচকে ধারালো ছুরি।
লোকগুলো এসেই প্রথমে জানলা দিয়ে ড্রাইভারটার গলায় আড়াআড়ি ছুরি চালিয়ে দিল, তারপর তারা আক্রমণ করল মুমতাজ বেগমকে।
তিনজন ষণ্ডামার্কা লোক মিলে টেনে—হেঁচড়ে গাড়ি থেকে বের করার চেষ্টা করতে লাগল মুমতাজকে, ”চল শালি! অনেক নখরা করেছিস তুই!”
‘বাঁচাও, বাঁচাও আমাকে!” মুমতাজের সুন্দর পেলব মুখ ততক্ষণে পাণ্ডুর বর্ণ ধারণ করেছে; সে অসহায় হরিণীর মতো তাকাচ্ছে চারপাশে।
বাওলা সাহেব দিগবিদিকজ্ঞানশুন্য হয়ে লোকগুলোর নির্দয় হাত থেকে মুমতাজকে বাঁচাতে গেলেন, ”এই! কী করছ তোমরা! তোমরা কারা! সাহস তো কম নয় তোমাদের, আমার প্রেমিকার গায়ে—!”
বাওলা সাহেবের কথা শেষ হল না, একটা গুন্ডার হাতের পিস্তল থেকে ছুটে—আসা গুলি মুহূর্তে তাঁর শরীর এফোঁড়—ওফোঁড় করে দিল। ঘটনার আকস্মিকতায় আর আঘাতে বাওলা সাহেব অচৈতন্য হয়ে লুটিয়ে পড়লেন গাড়ির মধ্যেই।
কিন্তু তাতে ওই চার—পাঁচজন লোকের বিন্দুমাত্র হেলদোল দেখা গেল না। তারা হল ভাড়াটে খুনি, মোটা টাকার সুপারি পেয়ে এসেছে। এই তুচ্ছ ব্যাপারে তাদের বিচলিত হলে চলবে কেন! তারা আসল কাজে মন দিল।
একটা লোক মুমতাজ বেগমকে হিড়হিড় করে বাইরে বের করে নিয়ে এসে কর্কশ হাতে ধারালো কুকরি দিয়ে তার অসম্ভব সুন্দর মুখশ্রীকে ক্ষতবিক্ষত করতে লাগল। প্রথমেই আঘাত হানল তার টিকোলো নাকের উপর। দরদরিয়ে রক্ত ঝরতে শুরু করল। তীব্র বেদনায় মুমতাজ বেগম বসে পড়তে যাচ্ছিল রাস্তার ওপরেই, লোকটা তার ঘাড় চেপে ধরে আরোও একবার কুকরির কোপ মারল, এবার গালে।
এই বীভৎস দৃশ্য দেখে ম্যানেজার ম্যাথিউয়ের গা গোলাচ্ছিল। সে অন্য দরজা দিয়ে পালাতে চেষ্টা করছিল, কিন্তু তাকেও তৎক্ষণাৎ ছুরিকাঘাতে ধরাশায়ী করা হল।
মুমতাজের মুখ ততক্ষণে রক্তে ভেসে যাচ্ছে। সেই অবস্থায় গুন্ডাগুলো তাকে টানতে টানতে নিয়ে চলল লাল রঙের ম্যাক্সওয়েল গাড়িটার দিকে। সে আর চিৎকার করতে পারছে না, প্রবল রক্তপাতে সে ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ছে।
তাণ্ডবটা বেশ একতরফাই চলছিল, এমন সময় আরেক কাণ্ড হল। উলটোদিক থেকে চারজন ইংরেজ মিলিটারি অফিসার এই ভর সন্ধ্যা বেলা উইলিংডন ক্লাব থেকে গলফ খেলে গাড়ি করে ফিরছিলেন।
গাড়ি চালাচ্ছিলেন অসমসাহসী অফিসার লেফটেন্যান্ট সিগার্ট। কাছাকাছি এসে তাঁরা হতভম্ব হয়ে দেখলেন—একদিকে একটা লোক পড়ে কাতরাচ্ছে, অন্যদিকে গাড়ি থেকে ঝুলছে একটা নিথর দেহ। এর মধ্যেই কয়েকটা লোক একটা মেয়েকে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে অদূরে দাঁড়ানো একটা লাল গাড়ির দিকে।
লেফটেন্যান্ট সিগার্ট সঙ্গেসঙ্গে গাড়ি থামিয়ে লাফিয়ে নেমে পড়লেন। তাঁর সঙ্গে নেমে পড়লেন গাড়িতে থাকা লেফটেন্যান্ট বেটলি, কলোনেল ভিকারে এবং স্টিভেনসন। প্রত্যেকেই বীরপুরুষ, কিন্তু একমাত্র বেটলির হাতের গলফ স্টিক ছাড়া কারুর কাছে কোনো অস্ত্র নেই।
না থাকুক, তাই বলে এই ঘটনা দেখেও মুখ বুজে চলে যাওয়া যায় নাকি!
লেফটেন্যান্ট সিগার্ট ছুটে গিয়ে একটা গুণ্ডার মুখে সপাটে ঘুষি চালালেন। সে আহত হয়ে মুমতাজ বেগমকে ছেড়ে দিতে—না—দিতেই অন্য একজন গুন্ডার বুলেট থেকে ছুটে এল গুলি, সোজা এসে বিঁধল সিগার্টের কবজিতে। কিন্তু তবু তিনি দমলেন না। এলোপাথারি ঘুসি চালিয়ে যেতে লাগলেন। অন্যদিকে লেফটেন্যান্ট বেটলি তাঁর গলফ স্টিকটাকে বনবন করে ঘোরাচ্ছেন। লেফটেন্যান্ট স্টিভেনসন মুমতাজকে আড়াল করে অন্য একটা গুন্ডার তলপেট লক্ষ্য করে কশালেন একটা লাথি।
ভিকারে পেছন থেকে বজ্রআঁটুনিতে গলা টিপে ধরলেন আরেকটা দুষ্কৃতীর।
সব মিলিয়ে তিন থেকে চার মিনিট। এর মধ্যেই ভাড়াটে গুন্ডাগুলো বুঝতে পারল এই চারজন বীর অফিসারের সঙ্গে তারা পেরে উঠবে না। সুযোগ বুঝে তারা পালাতে চেষ্টা করল। একজন আগেই গিয়ে তাদের ম্যাক্সওয়েল গাড়িটায় উঠে পড়েছিল, অন্যরা কোনোমতে নিজেদের ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে পড়ল গাড়িটায়।
শুধু একজন পালাতে পারল না। তার তখন কলোনেল ভিকারের লোহার মতো হাতের বজ্রআঁটুনিতে নিশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম। লেফটেন্যান্ট সিগার্ট এসে তার পেটে সামনে থেকে জোরে ঘুষি চালিয়ে ধরাশায়ী করে ফেললেন।
একটু পরেই পুলিশ এসে পড়ল, সে চলে গেল পুলিশি হেফাজতে।
ওই গুন্ডাগুলোর উদ্দেশ্য কী? ছিঁচকে রাহাজানি? কিন্তু, তাই যদি হবে, বাওলা সাহেবের হাতের হিরের আংটি, বোতাম কিংবা মুমতাজ বেগমের গয়নাগুলো গায়েই রয়ে গেল কেন?
কারণ জানতে হলে আগে জানতে হবে এই হত্যাকাণ্ডের পেছনের মর্মান্তিক ঘটনাটা। সে কাহিনির শুরু আরও চোদ্দো বছর আগে।
আসুন বোম্বাই প্রেসিডেন্সির সাহেবসুবোদের ছেড়ে চলে যাই দেশীয় রাজাদের অন্দরমহলে। যে রাজারা তখন খাতায়—কলমে ইংরেজদের হাতের পুতুল হলেও রাজপ্রাসাদে বিলাসিতায় মত্ত। প্রখ্যাত নর্তকীদের সুরমূর্ছনায় আলোড়িত হচ্ছে তাঁদের নাচমহল। রঙিন সুরায় তাঁরা তখনও মজে। দেশের মানুষ যতই দুর্ভিক্ষে, যুদ্ধে শেষ হয়ে যাক; বিপ্লবীরা যতই রক্ত গরম করে ঝাঁপিয়ে পড়ুক স্বাধীনতা সংগ্রামে; অধিকাংশ দেশীয় রাজারই জীবনযাত্রায় কোনো পরিবর্তন নেই।
ইন্দোরের মহারাজা তুকাজিরাও হোলকার।
১৯১১ সালে একুশ বছর বয়সে তিনি বসলেন ইন্দোরের সিংহাসনে। অঢেল রাজ—ঐশ্বর্য এবং বিত্তের মাঝে ডুবিয়ে দিলেন নিজেকে। এমনিতেই তিনি সংগীত এবং নৃত্যের বেশ বড়ো সমঝদার; তার ওপর প্রাসাদে তিনতিনটে সুন্দরী স্ত্রী থাকতেও মহারাজার মন সর্বক্ষণ সুন্দরী বাইজিদের সঙ্গলাভের পিপাসায় উন্মুখ হয়ে থাকে। বেনারস, লখনউয়ের নামজাদা বাইজিরা এসে তাঁর নাচমহলে ঝড় তুলে যায়। মহারাজ কাউকেই শুষ্কমুখে ফেরান না, বহুমূল্য অলংকার এবং পারিতোষিকে ভরিয়ে দেন তাদের। আর যাদের ভীষণভাবে মনে লেগে যায়, তাদেরকে তো ছাড়েন—ই না, রেখে দেন নিজের হারেমে।
তেমনই একজন বাইজি হল ওয়াজির বেগম। আসলে সে হিন্দু, নাম সওকাবাই পান্ধারী, কিন্তু এই লাইনে মুসলিম বাইজি না—হলে কদর নেই; তাই সে ওয়াজির বেগম নামেই বিখ্যাত। তার অপূর্ব কণ্ঠের ঠুংরিতে মাত হয়ে যেতেন ছোটোখাটো জমিদার থেকে স্বয়ং মহারাজা তুকাজিরাও হোলকার। তার অপরূপ সুরের মায়াজালে মহারাজার গোটা প্রাসাদই যেন তখন কোনো কল্পলোকে চলে যেত।
মহারাজের নির্দেশে মোটা মাসোহারার বিনিময়ে ওয়াজির বেগম চলে এল ইন্দোরের দরবারে। ওয়াজির প্রথমে খুশিই হয়েছিল। আজ এখানে, কাল সেখানে গান গেয়ে বেড়ানোর বদলে এই বেশ ভালো। ওয়াজিরের স্বামীও ছিল, ওই নামমাত্র যেমন থাকে। আর ছিল তার ফুটফুটে দশ বছরের এক কন্যা, যে ওই বয়সেই মায়ের সৌন্দর্যের সঙ্গে পাল্লা দিত।
নাম তার মুমতাজ।
সবই ভবিতব্য। না হলে একদিন যখন মহারাজ অতিথিদের নিমন্ত্রণ করেছেন ওয়াজির বেগমের ঠুংরি শোনার জন্য, তখন হঠাৎ ওয়াজির বেগমের শরীরটা খারাপ হবে কেন?
কেনই—বা মহারাজের মান রাখতে ওয়াজির তার মেয়েকে বলবে, ”যা তো মা, তোকে তো সবই শিখিয়েছি, আজ একটু আমার হয়ে গেয়ে দিয়ে আয়।”
”ভজন গাইবো মা?” মুমতাজ ঝুঁটি দুলিয়ে বলল।
”না না, তোকে যে ঠুংরিগুলো শিখিয়েছি, সেগুলোই গাইবি। দেখবি রাজামশাই যেন খুশি হন। অতিথিদের সামনে তাঁর যেন বেইজ্জতি না—হয়।” ওয়াজির বার বার মনে করিয়ে দিল।
মুমতাজ বাধ্য মেয়ে, সে গেল। সুসজ্জিত হয়ে সে মায়ের শেখানো মতো ঠুংরি গাইতে বসল। আর ওই বয়সেই তার রূপের ছটায় গোটা দরবার যেন আলোকিত হয়ে উঠল।
সবাই স্তম্ভিত হয়ে ফিসফাস শুরু করল, ”এ কি ওয়াজির বাইয়ের মেয়ে? মেয়ে তো মাকেও ছাড়াবে! এযে যেমন দেখতে তেমন গানের গলা!”
কথাটা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। মুমতাজ গাইতে শুরু করামাত্র বিশাল দরবার সুরে ভরে উঠল, এমনই মাধুর্য তার গলায়।
সবাই সেদিন ধন্য ধন্য করল মুমতাজকে। মহারাজার সামনে অন্য কোনো অতিথির বাইজিকে কোনো বখশিশ দেওয়ার নিয়ম নেই, তাই ‘ওয়াহ!”, ”কেয়া বাত!” জাতীয় প্রশংসায় সেদিন সকলে ভরিয়ে দিল।
মহারাজা উঁচু গদিতে বসে তীক্ষ্নচোখে পর্যবেক্ষণ করছিলেন মায়ের শেখানো মতো তাঁর ইঙ্গিতে এক কর্মচারী এসে মুমতাজকে দিল একগাদা দামি খাবার। স্ট্রবেরি, কেক, ইয়র্ক শায়ারের পুডিং, হ্যাম আরও সব জিভে জল আনা খাবার, যেগুলো খুদে মুমতাজ কোনোকালে চোখেই দেখেনি। মহারাজ গতকালই বিলেত সফর সেরে ফিরেছেন, এগুলো তখনই আনা।
ওই বয়সে অতসব দারুণ খাবার পেলে সবাই খুশি হয় মায়ের শেখানো মতো মুমতাজও হৃষ্টচিত্তে একটা কেকে কামড় বসিয়ে লাফাতে লাফাতে ফিরে গেল মহলে, মায়ের কাছে।
পরের দিন সকালেই ওয়াজির বেগমের ডাক পড়ল মহারাজার কাছে। তখনও ওয়াজির দুর্বল, তবু এমন অসময়ে ডাক পেয়ে সে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে দৌড়ল। মেয়ে কি কাল কিছু গড়বড় করে এসেছে দরবারে? কিন্তু সবাই তো খুশিই হয়েছে শুনে ছিল!
মহারাজ ওয়াজিরকে দেখে কোনো ভণিতা না—করে সরাসরি বললেন, ”তোমার মেয়ে যে রূপে গুণে এমন, কই আগে বলোনি তো!”
”ছোটো আবার কোথায়?” মহারাজা একটা আপেলে কামড় দিয়ে ভ্রূ কুঁচকে তাকালেন, ”আরে এটাই তো উপযুক্ত বয়স! শোনো ওয়াজির, তুমি তো মহলের বাঁধা বাইজি আছই, এবার থেকে তোমার মেয়েও বাঁধা থাকবে আমার কাছে।”
ওয়াজিরের চোখে অপরিসীম ঘৃণা দপ করে জ্বলে উঠেই আবার নিভে গেল। মুমতাজ মহারাজের মেয়ের চেয়েও ছোটো!
সে ঢোঁক গিলে বলল, ”কিন্তু মহারাজ, আসলে আমার মেয়ে ঠিক—মানে—!”
”কী মানে মানে করছ?” মহারাজা তুকাজিরাও বিরক্ত হলেন।
”আসলে আমার মেয়ে এইসব নাচগান ঠিক পছন্দ করে না মহারাজা! ও ভক্তিগীতি গাইতে ভালোবাসে।” যা আছে অদৃষ্টে, ওয়াজির বলেই ফেলল।
মহারাজ এবার প্রবল বিস্মিত হওয়ার ভান করে তাঁর পেয়ারের ভৃত্য রতনলালের দিকে তাকালেন, ”অ্যাঁ! বাইজির মেয়ে গাইবে ভক্তিগীতি! এ যে ভূতের মুখে রামনাম হে রতনলাল!”
রতনলাল কুৎসিত হাসি হেসে উঠল। আশপাশের পরিবেষ্টিত মোসাহেবদের অশ্লীল রসিকতায় ভরে উঠল ঘর, ”হুজুর, এবার কোনোদিন দেখবেন বাইজিরাও দেশও চালানোর দাবি করবে। হ্যা হ্যা হ্যা!”
সমবেত হা হা হো হো—র মাঝে নতমস্তকে দাঁড়িয়ে রইল ওয়াজির।
মহারাজও হাসছিলেন। অকস্মাৎ হাসি থামিয়ে বললেন, ”বেশ। আরও দু—বছর যাক, মুমতাজ আরেকটু ডাগর ডোগর হোক, তারপর সে শুধুই আমার হবে। বুঝেছ? যাও, মেয়েকে ভালো করে গড়েপিটে তোলো। সহবৎ শেখাও।”
ওয়াজির গুম হয়ে মহলে ফিরে এল। সে নিজে যার নিয়মিত অঙ্কশায়িনী হয়ে চলেছে, সেই কামুক মহারাজের কাছে নিজের মেয়েকেও বলি দিতে হবে ভেবে তার কান্না পাচ্ছিল। কিন্তু কিছু করার নেই। জলে বাস করে কুমিরের সাথে বিবাদ করা বাতুলতা। তা ছাড়া প্রাসাদ থেকেই বা বেরোবে কীভাবে, চারপাশে সতর্ক পাহারা।
দু—বছরও মহারাজের তর সইল না, তার আগেই মুমতাজকে পাঠাতে বাধ্য হল ওয়াজির বেগম।
আর ঠিক সেইসময় থেকেই শুরু হল বনের এক পাখির খাঁচায় বন্দি হয়ে নিষ্ফল ছটফটানি।
মুমতাজ মায়ের রুপ, গুণ পেলেও মায়ের মতো পরাধীন থাকতে ভালোবাসত না, মহারাজের বাহুডোরে বন্দি হয়ে সে অস্থির হয়ে উঠল।
মহারাজ নতুন এই শিকারের অস্থিরতায় খুব একটা বিচলিত হলেন না। অনেকেই প্রথমে অমন থাকে, তারপর টাকা—গয়না—দামি কাপড়চোপড়ে ভরে উঠে ঠিক পোষ মেনে যায়।
সেই ফর্মূলা মেনেই মুমতাজের বারো থেকে বাইশ বছর বয়স। এই মাত্র দশ বছরে মহারাজ তাঁকে উপহার দিলেন পঞ্চাশ লক্ষ টাকার অলংকার। শুধু বহুমূল্য সোনার চুড়িই দিলেন বাইশ বাক্স।
কিন্তু না, মুমতাজ বেগমের মন তিনি পেলেন না। মুমতাজ তাঁর শয্যাসঙ্গিনী হয় বটে, গানও শোনায়, কিন্তু মন তার ঔদাসীন্যে ভরে থাকে। মহারাজ তাকে বাহুলগ্না করেও যেন সেই মনের তল খুঁজে পান না।
নারী তাঁর কাছে সহজলভ্যা, নারীমাত্রেই পার্থিব সুখ দিয়ে জয় করা যায়—এই ধারণাটাই পোষণ করতেন মহারাজ। তাতে ধাক্কা খেয়ে তিনি প্রচণ্ড কুপিত হলেন। সব রাগ তাঁর গিয়ে পড়ল মুমতাজের মা ওয়াজিরের ওপর, ”ওই মা—ই শেখাচ্ছে মেয়েকে এইসব ভড়ং! ওয়াজির বাইকে ওর মেয়ের থেকে আলাদা করে দাও!”
তাই হল। পরিকল্পনামাফিক ১৯১৯ সালের এপ্রিল মাসে মহারাজ দু—জনকে নিয়ে ইন্দোর থেকে বোম্বাই বেড়াতে গেলেন। নিজে উঠলেন তাজমহল হোটেলে আর মা—মেয়েকে রাখলেন নিপিয়ান সি রোডের এক বাংলোতে। দরজায় বসল কড়া পাহারা।
দু—চারদিন পরেই মহারাজের নির্দেশমতো তাঁর ম্যানেজার শঙ্কর রাও এল, ”ওয়াজির বাই, মহারাজা মুমতাজকে নিয়ে সিনেমা দেখতে যাবেন। ওকে জলদি রেডি হতে বলুন।”
ওয়াজির বাই মেয়েকে প্রস্তুত করে পাঠালেন। মহারাজের আর তার ওপর আকর্ষণ নেই। বয়স হলে বাইজিদের আর কবেই—বা কদর থাকে!
তো সেই যে ম্যানেজার শঙ্কর রাও মুমতাজকে নিয়ে মহারাজের কাছে চলে গেল, আর ফিরল না।
ওয়াজির বুঝলেন সবই। মায়ের সংস্রব এড়াতে মুমতাজকে মহারাজ অন্য কোথাও পাঠিয়ে দিয়েছেন।
ওয়াজির বেগম উদ্বিগ্ন হলেন। মহারাজের বিকৃতকামের কথা সর্বজনবিদিত। মুমতাজ বাচ্চা মেয়ে, ওয়াজির গোপনে পুলিশে খবর দিলেন।
বোম্বাই থেকে মুমতাজকে অপহরণ করা হয়েছে, আর বোম্বাই তো মহারাজের এলাকা ইন্দোর নয়, যে যা ইচ্ছে তাই হবে। ইংরেজ পুলিশ এসে ম্যানেজার শঙ্কর রাওকে গ্রেফতার করল।
কিন্তু মুমতাজের কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না। মাঝখান থেকে তুকাজিরাও হোলকার মহারাজের দরবার থেকে ওয়াজির বেগমের বাঁধা চাকরিটা গেল। মহারাজ চাইলে আরও কিছু করতে পারতেন, একটা সামান্য বাইজি হয়ে তার বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ করা! এত বড়ো স্পর্ধা!
কিন্তু ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ তিনি আর করলেন না। তখন তিনি কিশোরী মুমতাজের প্রেমে বিভোর, মুমতাজকে নিয়ে সটান চলে গেলেন বিলেত। আদর করে মুমতাজের নতুন নাম দিলেন কমলাবাই।
বিলেত থেকে কমলাবাই ওরফে মুমতাজ যখন দেশে ফিরল, তখন সে সন্তানসম্ভবা। যথাসময়ে একটা মেয়ে হল, কিন্তু মহারাজের সেই জারজ সন্তান বেশিক্ষণ বাঁচল না।
মুমতাজ বরাবরই মহারাজের প্রতি বিরক্ত ছিল। এবার সে সরাসরি বিদ্রোহ করে বসল, ”আমি মায়ের কাছে যাব। প্রাসাদে থাকতে আমার ভাল লাগে না। আমাকে মায়ের কাছে যেতে দিন।”
মহারাজ মনে মনে রাগলেও সদ্য সন্তানহারা মুমতাজের কথায় নরম হলেন, ”তা কী করে হয় কমলা? তোমাকে আমি কত ভালোবাসি, এই দ্যাখো তোমার জন্য হিরের নাকছাবি এনেছি।”
”চাই না আমার হিরের নাকছাবি!” ছুড়ে ফেলে দিল মুমতাজ, ”আমাকে ইন্দোর থেকে চলে যেতে দিন। আমি মার কাছে যাব।”
ক্রুদ্ধ মহারাজ প্রাণপণে নিজের ক্রোধ সংবরণ করলেন। চারদিক বিবেচনা করে তিনি ওয়াজির বেগমকে আবার নিয়ে এলেন প্রাসাদে। মায়ের কাছে যেতে না—পাক, মা কাছে থাকলেই তো হবে, মুমতাজকে বোঝালেন তিনি।
কিন্তু যে পাখি একবার ডানা মেলে ওড়ার স্বপ্ন দেখেছে, তাকে কি আর শিকলে বেঁধে রাখা যায়?
মুমতাজও কিছুতেই বাঁধা থাকতে চাইল না। দিন দিন বিরক্তি, মেজাজ, বিদ্রোহ তার রূপের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে লাগল।
অন্য কোনো মেয়ে হলে হয়তো মহারাজ এতদিন বাঁচিয়েই রাখতেন না। দুর্বিনীত পোষ্য তিনি পছন্দ করেন না। কিন্তু মুমতাজের কথা আলাদা। এই বিদ্যুতের মতো রূপ যে মেয়ের, তার মেজাজ না থাকাটাই তো আশ্চর্যের! এ মেয়ে সাধারণ হলে যেন মহারাজের নিজেরই খারাপ লাগত, আগ্রহ হারিয়ে ফেলতেন তিনি।
এইভাবে আরও বছরদুয়েক কাটল। সেই ইচ্ছের বিরুদ্ধে ধর্ষিতা হওয়া, সেই ইচ্ছের বিরুদ্ধে দাসত্বগিরি—সেই কৃত্রিম সোহাগের অভিনয়।
মেয়ে মাকে বলে, ”চলো মা, রাতের অন্ধকারে আমরা পালাই! একবার যদি ইন্দোর পেরিয়ে ইংরেজ রাজত্বে পৌঁছোতে পারি, ওই শয়তান রাজা আমাদের আর টিকিও ছুঁতে পারবে না। ওখানে এইসব রাজাদের কেরদানি চলে না। মনে নেই বোম্বাইতে কত স্বাধীনতা ছিল!”
মা চমকে ওঠেন। এই প্রাসাদের দেওয়ালেরও কান আছে। মহারাজার কোনো কর্মচারীর কানে কথাটা গেলে মা—মেয়ে দু—জনকেই কেটে রেখে দেবে, ”ওরে থাম। ইন্দোর পেরিয়ে তো দূর, এই প্রাসাদ থেকে বেরোতে পারবি? কী লাভ শুধু শুধু আকাশকুসুম কল্পনা করে?”
মুমতাজ থেমে যায়। মহারাজ তাঁর তিন স্ত্রী কিংবা অন্যান্য রক্ষিতাদের দিকে ফিরেও দেখেন না। প্রমোদবিহারে কিংবা শিকারে—সবেতেই তিনি মুমতাজকে সঙ্গে নেন। প্রাচুর্যে বিলাসিতায় ভরিয়ে দেন, কিন্তু কিছুতেই ওইটুকু মেয়ের মন পান না।
১৯২১ সালের গোড়ার দিকে ওয়াজির বেগম এসে মহারাজের কাছে আর্জি জানালেন, ”মুমতাজ দিন দিন ভেঙে পড়ছে মহারাজ। একটু ঠান্ডার দিকে কোথাও ঘুরে এলে—!”
মহারাজ তুকাজিরাওয়ের সেদিন কোনো কারণে মেজাজ প্রসন্ন ছিল। ম্যানেজারকে ডেকে বললেন, ”এই, মুসৌরির বাংলোয় গিয়ে কয়েক দিন ওদের থাকার ব্যবস্থা করে দাও তো! সঙ্গে পাহারাদার দেবে, লোকজন সব ঠিকমতো যেন থাকে…!”
সুযোগ বার বার আসে না। মা—মেয়ে সব পরিকল্পনা করে ফেলল। কোনোমতে এই ইন্দোর রাজ্য থেকে পালিয়ে ব্রিটিশ ভারতে ঢুকতে পারলেই ব্যাস! সামনে মুক্তির স্বাদ!
মুমতাজ ফিসফিস করে মাকে বুদ্ধি দেয়, ”শোনো মা, তুমি এইবেলা ব্রিটিশ পুলিশকে সব জানিয়ে রাখো। আমরা ওখানে ঢুকলে কিছুতেই যেন মহারাজা আমাদের ধরে আনতে না—পারেন!”
ওয়াজির বেগম মেয়ের কথামতো আগে থেকেই বোম্বাই আর দিল্লির পুলিশ কমিশনারের কাছে আবেদন জানালেন, ”ব্রিটিশ ভারতের রক্ষক হিসেবে আমার এবং আমার কন্যা মুমতাজ বেগমের নিরাপত্তার আবেদন জানাই, একজন অসহায়া নারীর এই অনুরোধ অনুগ্রহ করে…” ইত্যাদি ইত্যাদি।
ওয়াজির চিঠি পাঠিয়ে রাখলেন বড়ো লাটকেও।
অবশেষে ১৯২১ সালের ২২ মার্চ ইন্দোররাজের দেওয়া লোকলস্কর পরিবৃত হয়ে মা—মেয়ে রওনা দিল মুসৌরির পথে।
নিয়মমতো দিল্লি ষ্টেশনে নেমে গাড়ি ধরতে হবে। দু—জনে পরিকল্পনা করেই রেখেছিল, ষ্টেশনে নেমেই দু—জনে সোজা হাঁটা লাগাল, মুসৌরি তারা কিছুতেই যাবে না।
”অ্যাই অ্যাই, কোথায় যাচ্ছ তোমরা…!” মহারাজার দেওয়া ইন্দোরের সতর্ক কর্মচারী এগিয়ে এসে বলপ্রয়োগ করতে গেল, ”আমাদের সঙ্গে চলো, বাইরে গাড়ি দাঁড় করানো আছে।”
প্ল্যান তৈরিই ছিল, ওয়াজির বেগম এবং মুমতাজ চিৎকার করতে লাগল, ”ছাড়ুন, ছেড়ে দিন আমাদের! কেন জোর করছেন?”
মুহূর্তে ছুটে এল দিল্লির রেলওয়ে পুলিশ। এটা দেশীয় রাজার রাজ্য নয়, ব্রিটিশ ভারত। এখানে ওইসব তুঘলকি নিয়ম চলবে না।
তুকাজিরাওয়ের দেওয়া সাঙ্গোপাঙ্গরা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল, মা—মেয়ে তাদের একরকম বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে রেলপুলিশের তত্ত্বাবধানে সদর্পে বেরিয়ে এল ষ্টেশন থেকে।
বেরিয়েই মুমতাজ জড়িয়ে ধরল মা—কে, ”মা, আমরা মুক্ত …! ওই শয়তান রাজা আমাদের আর কিচ্ছু করতে পারবে না দেখে নিও!”
ওয়াজির বেগম হাসছিলেন বটে, তবে ভেতরে ভেতরে আশঙ্কায় তাঁর মন পরিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছিল। মহারাজা তুকাজিরাও এত সহজে হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নন। শিকার মুখের সামনে থেকে হাতছাড়া হলে আক্রোশে তিনি উন্মাদ হয়ে ওঠেন।
ভয়ে আশঙ্কায় ওয়াজির বেগম মেয়েকে নিয়ে দিল্লি থেকে চলে গেলেন অমৃতসর, তাঁর নিজের ছোটোবেলার বাড়ি।
কিন্তু ইন্দোররাজ সেখানেও ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করতে শুরু করলেন। একজন বাইজি হয়ে এতবড়ো সাহস?
অমৃতসরের বাড়িতে প্রথম ক—দিন ভালোই কাটল। ইতিমধ্যে ওয়াজিরের স্বামীও এসে পৌঁছেছেন সেখানে। রাজপ্রাসাদের বৈভব, বিলাসিতার বাইরে গিয়ে অনাড়ম্বর গার্হস্থ্যজীবনের যে সহজসরল অনুভূতি, মুমতাজ তার আস্বাদ নিচ্ছে ধীরে ধীরে।
কিন্তু মা ওয়াজির সর্বক্ষণ ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকেন—এই বুঝি মহারাজের লোক এসে হানা দেয়, তুলে নিয়ে যায় মুমতাজকে।
একদিন হলও তাই। ইন্দোর থেকে মহারাজের এক পেয়াদা এসে হাজির, তার নাম রাম। আগে সে ওয়াজির বেগম বা মুমতাজের সঙ্গে সমীহ করে কথা বলত, কিন্তু এখন ধমকে টমকে বলল, ”ভালো চাও তো মেয়েকে নিয়ে ফিরে চলো। না—হলে ফল কিন্তু খুব খারাপ হবে।”
আসলে পিছোতে পিছোতে মানুষের যখন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায়, তখন ভয় পাওয়ার বদলে তাদের মধ্যে জেগে ওঠে এক বেপরোয়া ভাব। মা—মেয়েরও তাই হল। তারা দাঁত কামড়ে পড়ে রইল অমৃতসরেই। তারা সেখানে ভালোই থাকে, পাড়াপ্রতিবেশীর সঙ্গেও বেশ মেলামেশা করে। কেউ ওয়াজির বেগম আর মুমতাজের অতীত জানে না, তাই নিয়ে কারুর কোনো মাথাব্যথাও নেই।
বিহারীলাল নামে এক পরোপকারী যুবকের সঙ্গে একদিন আলাপ হল। যুবকের অমায়িক ব্যবহারে ধীরে ধীরে সে এই মা—মেয়ের বেশ কাছের মানুষ হয়ে উঠতে লাগল।
বিহারীলালের শালের ব্যাবসা। দিল্লি, বোম্বাই সব জায়গায় দোকান আছে তার। মুমতাজদের বিপদে আপদে ছুটে আসা, ডাক্তার—বদ্যি, কখনো বাজার দোকান—সবই করে দেয়। ধীরে ধীরে সে ওয়াজির বেগমের পুত্রসম হয়ে উঠতে লাগল।
ওয়াজির বেগম একদিন কথায় কথায় বিহারীলালকে খুলে বলল তাদের কথা, মুমতাজকে নিয়ে চিন্তার কথা। সব বটে—টলে বলল, ”জানো বিহারী, সারাক্ষণ ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকি, তুকাজিরাও কোনদিক থেকে কীভাবে যে মুমতাজের উপর হামলা চালাবেন তা সে—ই জানে!”
”এত চিন্তার কী আছে মাইজি? ওই বুড়ো রাজার দিন শেষ এখন, এটা ইংরেজদের যুগ। ওইসব জোরজবরদস্তি এখানে চলবে না।” বিহারীলাল বলল, ”অমৃতসর খুব শান্তির জায়গা।”
”তুমি বুঝতে পারছ না বিহারী।” ওয়াজির বেগম গলা নামিয়ে বলল, ”আমাদের এখানে আর বেশিদিন থাকা হবে না। বোম্বাই চলে যেতে হবে। বোম্বাই প্রেসিডেন্সি হলেও ওখানে রাজামশাইয়ের চর আছে অনেক, সেই ভয়টাই পাচ্ছি।”
‘হঠাৎ বোম্বাই কেন?” বিহারীলাল ভ্রূ কুঁচকে বলল।
ওয়াজির বেগম একটু ইতস্তত করল। বিহারীলালকে এইসব কথা বলছে শুনলে মুমতাজ রেগে যাবে, সে মেয়ের ভারি মেজাজ। তবু চাপা গলায় ওয়াজির বেগম বলল, ”আসলে বোম্বাইয়ে আমার এক ভাই থাকে, তার নাম আল্লাবক্স। সে ওখানকার ব্যবসায়ী আবদুল কাদের বাওলার সঙ্গে আমার মেয়ের পরিচয় করিয়েছে। দু—জন এখন একে অন্যকে চিঠিপত্রও লেখে। ওই বাওলা আমার মেয়েকে বিয়ে করতে চায়।” ওয়াজির সত্যি—মিথ্যে মিশিয়ে বলল।
বাইজির মেয়েকে আর কে বিয়ে করবে! বাওলা সাহেব মুমতাজকে নিয়ে ক—দিন ফুর্তি করতে চান। টাকাপয়সা আগাম পাঠিয়ে দিয়েছেন।
অদৃষ্ট সত্যিই অপ্রত্যাশিত। বাওলা সত্যিই মুমতাজকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। মালাবার হিলসে সেদিন বাওলা খুন না—হলে ওয়াজিরের এই মিথ্যে, রূপকথার মতো সত্যি হয়ে তাদের জীবনটা ভরিয়ে দিত।
”বাহ! সে তো খুব ভালো কথা!” বিহারীলাল বলল, ”আরে এত ভালো খবরের মধ্যে আপনি ওই ইন্দোরের রাজাকে নিয়ে ভয় পাচ্ছেন? শুনুন মাইজি, আমার এক ভাই বোম্বাইয়ের বড়ো ব্যারিস্টার। আপনারা ওখানে চলে চলে যান, সে সব সামলে নেবে। পুলিশের সব বড়োকর্তারা ওর পকেটে। কত রাঘববোয়াল রাজা মহারাজাকে ও শায়েস্তা করেছে!”
সেই মতোই সব হল। ওয়াজির বেগম স্বামী আর মেয়েকে নিয়ে বোম্বাই রওনা দিল। বোম্বাইয়ের ভিক্টোরিয়া টার্মিনাসে তাদের নিতে এল বিহারীলালের ভাই বুলাকীদাস, ”নমস্কার মাইজি। আপনাদের থাকার ব্যবস্থা বাসেবা বলে একটা জায়গায় করেছি। এই আমার চাকর রামলাল, ও আপনাদের সঙ্গে থাকবে। চিন্তার কিছু নেই।”
বাসেবা অঞ্চলটা ভারি নির্জন। ওয়াজির বেগমের গা ছমছম করে। মুমতাজ গজগজ করে, ”এ কোথায় নিয়ে এলে মা? একটা কোনো মানুষের দেখা পাই না!”
”কয়েক দিন একটু সবুর কর। বাওলা সাহেব ব্যবসার কাজ সেরে দেশে ফিরলেই আল্লাবক্স তোকে নিয়ে যাবে, তখন দেখবি কত দেশ ঘোরা হয়।” ওয়াজির বেগম মেয়েকে বোঝায়।
”ধুর! আমার এইসব লোকগুলোর ল্যাজ ধরে কোথাও ঘুরতে একটুও ইচ্ছে করে না।” মুমতাজ গজগজ করে, ”শান্তিতে নিজের মতো কি থাকার অধিকার আমার নেই মা?”
ওয়াজির বেগম নিরুত্তর হয়ে যান।
এভাবেই চলল কিছুদিন। হঠাৎ একদিন ওয়াজির বেরিয়েছেন স্থানীয় বাজারে, একটা দৃশ্য দূর থেকে দেখে আতঙ্কে অস্থির হয়ে উঠলেন। দেখলেন বুলাকীদাসের সেই চাকর রামলাল আর মহারাজা তুকাজিরাওয়ের পেয়াদা রতন একসাথে হেঁটে আসছে এদিকে।
দেখলেই বোঝা যায় তাদের বন্ধুত্ব বেশ প্রাচীন।
ওয়াজির বেগম ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেলেন। একটা মনিহারির দোকানে ঢুকে কোনোরকমে লুকিয়ে রাখলেন নিজেকে। তার মাথা কাজ করছিল না। অমৃতসরের ওই বিহারীলাল, ওর ভাই বুলাকীদাস, চাকর রামলাল—সব তার মানে ইন্দোরের মহারাজার লোক?
এ যে গভীর ষড়যন্ত্র? কীভাবে সে তার মেয়েকে রক্ষা করবে এই এত বড়ো চক্রের হাত থেকে?
ওয়াজির বেগম অশিক্ষিত হলেও জীবনের অভিজ্ঞতার রসদে বেশ বুদ্ধিমতী ছিল। সে সটান চলে গেল বোম্বাইয়ের পুলিশ কমিশনারের কাছে। কমিশনার সাহেবের পরামর্শমতো ভাই আল্লাবক্সের দেখে দেওয়া বোম্বাইয়ের হাকিম বিল্ডিং—এর বাসা পালটে উঠে এল স্বামীকন্যাকে নিয়ে।
ওয়াজির জানতেও পারল না রাতারাতি বিহারীলাল, বুলাকীদাস, রামলাল—এরাও চলে এল তার কাছাকাছি। তারা সব মোটা টাকার বিনিময়ে ইন্দোরের মহারাজার হয়ে কাজ করছে। মুমতাজকে যে করে হোক ইন্দোর নিয়ে যেতেই হবে।
মহারাজের কড়া আদেশ, ”মুমতাজকে ছলে—বলে—কৌশলে ইন্দোর নিয়ে আসবে, একান্তই সে মেয়ে বেগরবাই করলে সোজা নাক কেটে নেবে। ওই সুন্দর মুখকে ক্ষতবিক্ষত করে দেবে যাতে আর কেউ না তাকায়। বাইজির এতবড়ো সাহস! ওর বাপ—মাটাকে কুপিয়ে খুন করবে।”
এর কয়েক দিন পরেই এল সেই ১৯২৫ সালের ১২ জানুয়ারি। এক কামুক মহারাজের বিকৃত লালসার চক্করে পড়ে মাঝখান থেকে বেঘোরে প্রাণ দিতে হল আবদুল কাদের বাওলাকে।
সেই চারজন ব্রিটিশ অফিসার সেই গুন্ডাগুলোর মধ্যে যে একজনকে ধরতে পেরেছিলেন তার নাম শফি আহমেদ। এই শফি আহমেদ ধরা না—পড়লে হয়তো ভারতবর্ষের ইতিহাসের এই ন্যক্কারজনক কাণ্ড চিরকালের জন্য অতলে তলিয়ে যেত।
বোম্বাই হাইকোর্টে এই চাঞ্চল্যকর কেস উঠল ১৯২৫ সালের ২৭ এপ্রিল। ইন্দোরের মহারাজা তুকাজিরাও হোলকারের স্বপক্ষে দাঁড়ালেন মহম্মদ আলি জিন্না, যিনি স্বাধীনতার পরে পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল হয়েছিলেন। এ ছাড়াও আসামি পক্ষে রইলেন বিখ্যাত বাঙালি ব্যারিস্টার যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত।
আদালত ভেঙে পড়ল জনস্রোতে। ইন্দোর তখন ছিল দেশীয় রাজ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম, তারই মহারাজার বিরুদ্ধে এতো বড়ো অভিযোগ খুবই চাঞ্চল্যকর। তার ওপর বোম্বাইতে গুলি করে খুনের ঘটনা এই প্রথম। শুধু উচ্চবিত্ত সমাজই নয়—গোটা দেশকেই কাঁপিয়ে দিয়েছিল এই মামলা।
মারকাটারি সুন্দরী মুমতাজ বেগমকেও আসতে হল সাক্ষ্য দিতে। বাঘা বাঘা উকিলরা তাকে জেরায় জেরায় জেরবার করে ফেললেন।
কিন্তু সে মেয়ে একটুও ঘাবড়ে না—গিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণনা করল, কীভাবে মহারাজা তুকাজিরাও হোলকার দিনের পর দিন তাকে প্রাসাদের অন্তঃপুরে বন্দি করে রেখেছিলেন, কীভাবে কিশোরী বয়সে তার কামলালসার শিকার হতে হয়েছে তাকে, কীভাবে তার এবং তার মায়ের সমস্ত স্বাধীনতা হরণ করেছিলেন মহারাজ—সবকিছু সে উগড়ে দিল মহামান্য আদালতের সামনে। ”ধর্মাবতার—আমি দিনের পর দিন ধর্ষিতা হয়েছিলাম। তারপর দশটা বছর ধরে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। একবার দিল্লি, একবার নাগপুর, একবার অমৃতসর, একবার বোম্বে। আমার কি ইচ্ছেমতো জীবন কাটানোর অধিকারটুকুও নেই?” কান্নায় ভেঙে পড়ল সে, ”আবদুল কাদের বাওলা সাহেব আমাকে ভালোবেসেছিলেন। আমি—আমি ওঁর সঙ্গে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছিলাম। ওই মহারাজ সব শেষ করে দিয়েছেন! ওই ইংরেজ সাহেবরা সেদিন না—এসে পড়লে আমিও শেষ হয়ে যেতাম।”
বিচারপতি ছিলেন জাস্টিস ক্রাম্প। সঙ্গে স্পেশাল জুরি হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছিল আরও একজনকে। সরকারি পক্ষের কৌঁসুলি হলেন অ্যাডভোকেট জে বি কাঙ্গা আর কেনেথ কেম্প। উলটোদিকে তো জিন্না আর যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত ছিলেনই। পরে যোগ দিলেন এস জি ভেলিংকরের মতো দুঁদে আইনজীবী।
বাওলা মামলার বিশেষত্ব হচ্ছে, এটা নিছক একটা খুন নয়, খুনের সঙ্গে এতে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ছিল একজন নারীর অধিকার। মনে রাখতে হবে, সময়টা আজ থেকে প্রায় এক—শো বছর আগে। এইভাবে নারীর স্বাধীনতা নিয়ে সোচ্চর হওয়ার মতো মামলা তখনও খুব বেশি ভারতীয় আদালতে ছিল না। গোটা ঘটনাকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা হল, চলল দিনের পর দিন ট্রায়াল।
প্রধান সাক্ষী হিসেবে দাঁড়ালেন প্রত্যক্ষদর্শী ওই চারজন সাহসী ইংরেজ মিলিটারি অফিসার। তার মধ্যে কলোনেল ভিকারের অভিজ্ঞ চোখ চিনিয়ে দিল ছ—জন অপরাধীকে।
মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে খুন, ক্ষতবিক্ষত করা, আর এতগুলো অভিযুক্ত। জাস্টিস ক্রাম্প অত্যন্ত সতর্কভাবে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন সবকিছু।
আসামিপক্ষের উকিল মহম্মদ আলি জিন্না বললেন, ”মাই লর্ড! খুন হওয়া আবদুল কাদের বাওলার সঙ্গে তাঁর নিজের লাইসেন্সড রিভলভার ছিল। বাওলা আগে গুলি ছুড়েছিলেন।”
”নো।” জাস্টিস ক্রাম্প ডিসমিস করে দিলেন জিন্নাকে, ”বাওলার রিভলভারের লাইসেন্স ছিল ঠিকই, কিন্তু গুলি করা তো দূর, সেদিন সন্ধ্যায় বাওলার সঙ্গে রিভলভার ছিলই না। আর ব্যালিস্টিক টেস্টের রিপোর্ট তো অন্য কথা বলছে। ঘটনাস্থলে পড়ে থাকা গুলি বাওলা বা লেফটেন্যান্ট সিগার্ট কারুর বন্দুকের সঙ্গেই মেলেনি, বরং সেগুলো ম্যাচ করেছে আসামিদের রিভলভারের সঙ্গে।”
আসামিপক্ষের আরেক উকিল ভেলিংকর বললেন, ”মুমতাজ বেগম বহুবছর ধরে তুকাজিরাওয়ের থেকে টাকা, গয়না এইসব পেয়েছে। সে তো একজন প্রস্টিটিউট।”
”তো?” জাস্টিস ক্রাম্প ভ্রূ কুঁচকে তাকালেন, ”টাকা গয়না পেয়েছে বলে তার কোনো স্বাধীনতা থাকবে না? জোরজবরদস্তি করে তার রূপকে ক্ষতবিক্ষত করা হবে? আর কোন আইনে বলা আছে যে বাইজি বা প্রস্টিটিউটকে ইচ্ছেমতো জোর করা যায়? ইচ্ছের বিরুদ্ধে কখনোই কাউকে শারীরিক মিলনে লিপ্ত হতে বাধ্য করা যায় না, হোক সে প্রস্টিটিউট! তার ইচ্ছেটাই আসল। বলপূর্বক সহবাস মানেই সেটা ধর্ষণ!”
”মুমতাজ বেগম নিজেই শেষের দিকে ইন্দোর যেতে চাইছিল।” জিন্না বললেন।
পাবলিক প্রসিকিউটর কেনেথ কেম্প বললেন, ”সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। মুমতাজ বেগমের আগের উকিল মি নরিম্যানও বলেছেন, মুমতাজ বেগম বার বার বলত যে সে তেমন হলে সাগরে ডুবে মরবে, তবু ইন্দোর ফিরে যাবে না কিছুতেই।”
এই শুনানিতে বার বার উঠে আসতে লাগল ইন্দোর রাজপরিবারের নাম, কলঙ্কিত হতে লাগলো দেশীয় রাজাদের শাসনব্যবস্থা, স্বৈরাচারিতা। তুকাজিরাও যতই ধামাচাপা দেওয়ার জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করুন, কিছু লাভ হল না।
মামলার জটিলতা বাড়তে বাড়তে গোটা দেশ এমনকী দেশের বাইরেও ব্রিটেনে এবং ইংরেজদের অন্যান্য উপনিবেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়ল। বোম্বাই বার অ্যাসোসিয়েশন তাদের জার্নালে ঘটনাক্রম প্রকাশ করতে লাগল।
অবশেষে শেষ হল ট্রায়াল।
খুন এবং ষড়যন্ত্রের অভিযোগ ছিল মোট ন—জনের বিরুদ্ধে। তারা প্রত্যেকেরই ইন্দোর রাজদরবারের কর্মচারী। তাদের মধ্যে শফি আহমেদ, পুষ্পশীল বলবন্ত রাও পাণ্ডে আর শাম রাও রেভজি দীঘেকে দেওয়া হল ফাঁসির হুকুম। চারজনের হল যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর। বাকি দু—জন ছাড়া পেল।
মুমতাজ বেগমকে কিডন্যাপ করে তুকাজিরাওয়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার হোতা ছিল সর্দার আনন্দরাও গঙ্গারাম ফ্রান্সে। তাকেও ফাঁসির হুকুম দেওয়া হত, কিন্তু তার উকিল মহম্মদ আলি জিন্না যুক্তি দিলেন, সে তো খুনের সময় উপস্থিতই ছিল না!
জাস্টিস ক্রাম্প তখন ফ্রান্সেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিলেন। ইতিহাসে সাইমন কমিশন আমরা সবাই পড়েছি, সেই জন সাইমনও ছিলেন এই মামলার একজন গুরুত্বপূর্ণ আইনজীবী।
অবশেষে ১৯২৫ সালের নভেম্বর মাসের এক সকালে শফি আহমেদ আর শামরাও দীঘের ফাঁসি হয়ে গেল। ফাঁসির হুকুম শোনার পরে বলবন্ত রাও পাণ্ডে পাগল হয়ে গিয়েছিল, তাকে তখন পুনা জেলে আটকে রাখা হল।
এরপর ফোকাস করা হল ষড়যন্ত্রের মূল হোতা ইন্দোর রাজ তুকাজিরাও হোলকারের দিকে।
হাই প্রোফাইল অপরাধী হওয়ায় ভারতের বড়োলাট একটা পাঁচ সদস্যের এনকোয়ারি কমিশন গঠন করলেন মহারাজের সব দুর্নীতির তদন্তের জন্য। সেই কমিশনে নিরপেক্ষতা বজায় রাখার জন্য হাইকোর্টের বিচারপতি থেকে শুরু করে দু—জন দেশীয় রাজাকেও রাখা হল। বড়োলাট অর্থাৎ ভাইসরয় দাঁড়ালেন ইংল্যান্ডের রাজার প্রতিনিধি হিসেবে।
এনকোয়ারি কমিশনের তদন্তে একের পর এক কুকীর্তি ফাঁস হতে শুরু করল। কেঁচো খুড়তে সাপ বেরোল প্রচুর।
অবশেষে ব্রিটিশ সরকারের ক্রমাগত চাপে ইন্দোরের একচ্ছত্র অধিপতি মহারাজা তুকাজিরাও হোলকার পদত্যাগ করলেন। ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেন তাঁর সেই মহার্ঘ্য সিংহাসন, যার প্রভাব ব্যবহার করে তিনি চালিয়েছিলেন একের পর এক অনাচার।
সুবিচার ওই ন—জনের বিরুদ্ধে হলেও মহারাজের বিরুদ্ধে কিন্তু তেমন কিছু হল না। রাজামশাই রাজ্যপাট ছেলের হাতে তুলে দিয়ে আরেকটা বিয়ে করে চলে গেলেন ফ্রান্সে। তারপরও তিনি প্রায় পঞ্চাশ বছর বেঁচেছিলেন। দেশে আর ফেরেননি।
তাঁর ক্ষমতা, সম্মান, যশ প্রতিপত্তি ধুলোয় মিশল ঠিকই, কিন্তু অপরাধের ন্যায্য শাস্তি কিছু হল কি?
সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু মুমতাজ বেগম এরপর আর কোনো বাধা পায়নি। শোনা যায় সে তখন অন্তঃসত্ত্বা ছিল। বাওলা সাহেবের ঔরসে তার একটি কন্যাও হয়েছিল পরে।
১৯২৫ সালেই এই বাওলা হত্যার ওপর নির্মিত হল একটি হিন্দি চলচ্চিত্র, নাম ‘কুলীন কান্তা’। এই সিরিজ লেখার সময় সেটা অনেক খুঁজেছি, কিন্তু কোনো রেকর্ড সম্ভবত আর নেই।
বাওলা হত্যা মামলা এত রোমহর্ষক, এত বিখ্যাত হয়েছিল তার কারণ, একজন বাইজি, যাদের তখনও পর্যন্ত সমাজে নীচু দৃষ্টিতে দেখা হত, তার মৌলিক অধিকার, তার স্বাধীনতা নিয়ে এত লড়াই চলেছিল। ইংরেজ, ভারতীয় এক হয়ে গর্জে উঠেছিল ক্যাপিটালিস্টিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে।
সাধে কী এলিয়ানর রুজভেল্ট, আমেরিকার একদা ফার্স্ট লেডি বলেছিলেন, “A woman is like a tea bag–– you can’t tell how strong she is until you put her in hot water!”