মহারাজের হিরের আংটি – রূপক সাহা
অফিসে বসে স্টার চ্যানেলে স্পার্টাক মস্কো বনাম ইন্টার মিলানের খেলা দেখছি, এমন সময় ঘরে ঢুকে কৌশিক বলল, “কালকেতুদা, এক্সক্লসিভ একটা খবর আছে।”
উত্তেজনায় ওর চোখমুখ চকমক করছে। এটা হয়। একটা ভাল খবর পেলে রিপোর্টারদের চোখমুখই বদলে যায়। ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কী খবর রে?”
“সৌরভ গাঙ্গুলিকে নিয়ে। ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ার কাউন্টি আগামী সিজনে সৌরভকে চায়।”
বললাম, “বাহ, পেলি কোত্থেকে খবরটা?”
“সৌরভের এক বন্ধু আছে দীপপ্রিয়। ওর খুবই ঘনিষ্ঠ। আমারও। আজ কথায় কথায় দীপপ্রিয় আমাকে বলে ফেলল।”
“সৌরভের সঙ্গে কথা বলেছিস?”
“না। ও কলকাতায় নেই। ওর বাড়ি থেকে বলল, কয়েকদিনের জন্য বাইরে গেছে।”
“কোথায় গেছে কিছু বলল?”
“না। বলতে চাইল না। তবে একজনের মুখে শুনলাম, সৌরভ নাকি মরিশাসে গেছে।”
“মরিশাসে? কেন? কোনও বিজ্ঞাপনের শুটিং আছে?”
“জানি না। তবে শুনলাম দিনচারেকের আগে নাকি ফিরবে না।”
“তা হলে তো মুশকিল হল রে কৌশিক। খবরটা দাঁড় করাবি কী করে? সৌরভকে জিজ্ঞেস না করে তো লেখা ঠিক হবে না।”
“আমি লিখে রাখছি কালকেতুদা। আপনি দেখুন অন্য কোনও সোর্স থেকে খবরটা কনফার্ম করা যায় কি না। আমি বলছি খবরটা কিন্তু জেনুইন।”
অগত্যা বললাম, “ঠিক আছে লেখ তা হলে।”
কৌশিক কম্পিউটারের সামনে বসে গেল। আমি আবার টিভি-র দিকে চোখ দিলাম। ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ান লিগের খেলা চলছে মিলানো রোনাল্ডো-জামোরানো খেলছে ইন্টারের হয়ে। একটু আগেই দুর্দান্ত একটা গোল করেছে রোনাল্ডো। ইন্টার এগিয়ে রয়েছে ১-০ গোলে। মাস কয়েক আগে বিশ্বকাপ ফুটবল কভার করতে গিয়েছিলাম ফ্রান্সে। রোনাল্ডোর ছ’টা ম্যাচ দেখে এসেছি নিজের চোখে। না দেখলে বিশ্বাসই করতাম না, ও কতবড় ফুটবলার।
চোখ টিভি পরদার দিকে। কিন্তু মন বসাতে পারছি না। সৌরভের খবরটা মাথায় ঘুরছে। একটা বাঙালি ছেলে ইয়র্কশায়ারের হয়ে খেলতে যাবে, ভাবা যায় না! কাল কাগজে বেরোলে খবরটা নিয়ে বেশ হইচই হবে। ইয়র্কশায়ার ক্লাব একটা সময় খুব রক্ষণশীল ছিল। বাইরের কোনও ক্রিকেটারকে ওরা নিত না। সেই ট্রাডিশনটা ওরা প্রথম ভাঙে শচীন তেন্ডুলকরকে টিমে নিয়ে। এখন কাউন্টি লিগে একজনের বেশি বিদেশি খেলতে দেওয়া হয় না। তাই সৌরভ যদি ওখানে খেলতে যায় তা হলে সেটা বিরাট ব্যাপার হবে আমাদের কাছে।
কিন্তু সমস্যা একটাই। খবরটা কনফার্ম করা দরকার। না হলে প্রতিবাদ আসতে পারে। ভেবেই পেলাম না কে কনফার্ম করতে পারে! ইয়র্কশায়ার ক্লাবে ফোন করা যেতে পারে। কিন্তু ওরা সরাসরি বলবে কিনা সন্দেহ। সব ক্ষেত্রে পেশাদার ক্লাবগুলো চূড়ান্ত গোপনীয়তা বজায় রাখে। আমার এক বন্ধু আছে লন্ডনে। নাম পিটার মার্ভিন। টাইমসের রিপোর্টার। ওকে ফোন করে খবরটা যাচাই করা যেতে পারে। কিন্তু পিটারকে এখন অফিসে পাওয়া মুশকিল। লন্ডনের সঙ্গে আমাদের টাইম ডিফারেন্স প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা। পিটারকে তাই আমাদের রাত ন’টা সাড়ে ন’টার আগে পাওয়া যাবে না।
একটা খবর আমার মাথায় ঢুকলেই হল। সেটা যতক্ষণ না করতে পারছি ততক্ষণ আমি অন্যদিকে মন দিতে পারি না। হঠাৎ জিওফ বয়কটের কথা মনে পড়ল। উনি ইয়র্কশায়ারের লোক। ক্লাবে দীর্ঘদিন খেলেছেন। যতদূর জানি, বয়কট খুব পছন্দ করেন সৌরভকে। ইয়র্কশায়ার যদি সৌরভকে নেয় তা হলে নিশ্চয়ই উনি জানতে পারবেন। বলা যায় না ক্লাবকর্তারা হয়তো সৌরভকে নেওয়ার ব্যাপারে বয়কটের মতামতও নিয়েছেন। এই কথাটা মনে হওয়া মাত্র লন্ডনে বয়কটের বাড়িতে ফোন করলাম। কিন্তু ও প্রান্ত থেকে আনসারিং মেশিন বারবার শোনাতে লাগল, “জিওফ বয়কট বাড়িতে নেই, কোনও কিছু মেসেজ দেওয়ার থাকলে দিতে পারেন।”
টার্মিনালে কাজ করছে কৌশিক। অন্য একটা কম্পিউটারে বসে সন্দীপ। হঠাৎ উঠে এসে আমার হাতে একটা লেজার প্রিন্ট ধরিয়ে দিয়ে বলল, “কালকেতুদা, মোহনবাগান এয়ার ইন্ডিয়াকে চার গোলে হারিয়ে দিয়েছে। মুম্বই থেকে শুভেন্দুদা খবরটা পাঠিয়েছে।”
জাতীয় লিগে মুম্বই আর বাঙ্গালোরের দুটো ম্যাচ ছিল। বাঙ্গালোরে গেছে তাপস। ইস্টবেঙ্গল-আই টি আই ম্যাচ কভার করতে। সন্ধে সাতটা বাজে। এখনও তাপস খবরটা পাঠায়নি। কী রেজাল্ট হয়েছে। তা জানার জন্য ঘনঘন ফোন আসছে আমাদের অফিসে। সন্দীপকে তাই বললাম, “তুই একটা কাজ কর তো। বাঙ্গালোর অফিসে ফোন করে ম্যাচের রেজাল্টটা জেনে নে। ওকে তাড়াতাড়ি রিপোর্টটা পাঠাতে বল।”
সন্দীপ টেলিফোন করতে চলে গেল। খবরের কাগজে এই সময়টা হল পিক আওয়ার্স। এই সময়টায় আমরা এত ব্যস্ত থাকি, অন্য কিছু মাথায় থাকে না। শুভেন্দুর রিপোর্টে চোখ বোলাতে বোলাতে ভাবলাম ইস্টবেঙ্গল যদি আরও বেশি গোলে না জেতে, তা হলে মোহনবাগানের ম্যাচটাকেই লিড স্টোরি করে দেব খেলার পাতায়। চিমা তিনটে গোল করেছে কুপারেজে। ওর একটা ছবি দেওয়াও দরকার।
চিমার একটা ভাল ছবির জন্য তিনতলায় নেটওয়ার্কে যাব ভাবছি, এমন সময় ঘরে ঢুকলেন বীরেনদা। কৌশিক আর সন্দীপের দিকে এক পলক তাকিয়ে নিয়ে বীরেনদা বললেন, “এই কালকেতু, একটা কথা বারবার বলেও কি তোদের শোধরানো যাবে না?”
বীরেনদা হলেন আমাদের কাগজের এডিটোরিয়াল অ্যাডভাইসার। প্রতিদিন কাগজে আমরা যেসব ভুলভ্রান্তি করি, তা ধরাই ওঁর কাজ। বানান, বাক্য গঠন, শব্দপ্রয়োগে অনেক সময় তাড়াহুড়োতে লিখতে গিয়ে রিপোর্টারদের ভুল হয়ে যায়। বীরেনদা রোজ লাল কালির দাগ দিয়ে তা শুধরে, কাগজের সেই পাতাটা সংশ্লিষ্ট দফতরে পাঠিয়ে দেন। একই ভুল দু’-তিনবার করলে বীরেনদা মাঝেমধ্যে একটু রেগেও যান। নিশ্চয়ই খেলার পাতায় আমাদের কোনও ভুল হয়েছে। তাই উনি জিজ্ঞেস করতে এসেছেন। বললাম, “আমাদের আবার কী ভুল হল বীরেনদা?”
“তোদের ক’দ্দিন বলেছি, মিয়াঁদাদ লেখার সময় চন্দ্রবিন্দুটা য়-এর ওপর দিবি। তা না করে এখনও চন্দ্রবিন্দুটা তোরা ম-এর ওপর লিখছিস। যে লিখেছে তাকে আমার কাছে একবার পাঠিয়ে দিস তো?”
বললাম, “ঠিক আছে!”
ভেবেছিলাম কথাগুলো বলে বীরেনদা চলে যাবেন। কিন্তু গেলেন না। দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর বললেন, “হ্যাঁ রে কালকেতু, আমাদের সৌরভটা ব্যাট করার সময় চোখ পিটপিট করে কেন রে?”
বীরেনদাকে বললাম, “সৌরভ চোখে লেন্স ব্যবহার করে বলে ওটা করে।”
“তাই বল,” বীরেনদা বললেন, “আমাদের সময় পঙ্কজ রায়েরও চোখ খারাপ হয়েছিল রে। তখন তো আর লেন্স-ফেন্স ছিল না। ছিল চশমা। পঙ্কজ ওই চশমা পরেই খেলত। পরের দিকে ইমপ্রুভ করেছিল।”
বীরেনদা বেশ গল্পের মুডে। কিন্তু কাগজের লোক, জানেন এই সময়টা গল্পের নয়। হঠাৎ বললেন, “চলি রে। যে কথাটা তোকে জিজ্ঞেস করতে এসেছিলাম, সেটাই ভুলে মেরে দিয়েছি। আজ দিগিনের পার্টিতে তুই যাচ্ছিস তো? ওখানে কিন্তু সৌরভ আসছে।”
কৌশিক ঘুরে বসল কথাটা শুনে। সৌরভ আসবে? মানে? ও তো এখন মরিশাসে। কথাটা আমার আর কৌশিক— দু’জনের মুখ থেকেই ছিটকে বেরোল একসঙ্গে।
বীরেনদা বললেন, “কোনও খবর-টবর তোরা রাখছিস না বোধহয় আজকাল। সৌরভ মরিশা থেকে তো চলে এসেছে দিন দুয়েক।”
॥ ২ ॥
বীরেনদা বলার পর হঠাৎই মনে পড়ল। সত্যিই তো! দিগিন ভট্টাচার্য ওর পার্টিতে যাওয়ার জন্য দু’দিন আগে আমাকে ফোন করেছিল। ওর সঙ্গে আমার পরিচয় দুবাইয়ে। বছরতিনেক আগে। এশিয়ান কাপ ফুটবল কভার করার জন্য সেবার দুবাই গিয়েছিলাম। ওখানে সোনার গয়না সস্তা। আমার স্ত্রী ফুল্লরার জন্য একটা আংটি কেনার দরকার ছিল। তাই একটা দোকানে গিয়েছিলাম। দিগিনও ওর স্ত্রী আর ছেলেকে নিয়ে তখন কী যেন কিনছিল। ছেলেটার বয়স তখন আট-ন’বছর। খুব ছটফটে। ওই সময় দিগিন একবার ধমকে উঠেছিল, “জয়, দুষ্টুমি কোরো না।”
বাংলায় কথা বলতে শুনে যেচে আলাপ করেছিলাম ওদের সঙ্গে। বালিগঞ্জের ছেলে। আমারই বয়সি। সফটওয়্যারের ব্যাবসা করে দুবাইয়ে। সেদিনই দিগিন জোর করে আমাকে ওর বাড়িতে টেনে নিয়ে যায়। দুবাইয়ে প্রচুর ভারতীয় বসবাস করেন। ওঁদের একটা সংস্থা রয়েছে। দিগিন তখন ওই সংস্থার প্রেসিডেন্ট। দু’দিন পর ওরা ভারতীয় ফুটবল টিমটাকে সংবর্ধনাও দিয়েছিল। তখন থেকেই দিগিনের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের সম্পর্ক।
মাঝেমধ্যে দিগিন চিঠি দিয়ে অথবা ফোন করে আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখত। আলাপ হওয়ার পর থেকে দিগিন মাত্র একবারই এসেছিল কলকাতায়। জামির লেনে ওদের বাড়িতে সেবার নেমন্তন্ন করেও খাইয়েছিল। আমিও ওকে আমার বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলাম। দিনকয়েক আগে দিগিন দুবাই থেকে হঠাৎ ফোন করে জানায়, সিঙ্গাপুর যাওয়ার পথে ও এক সপ্তাহের জন্য কলকাতায় আসছে। শুনে খুব ভাল লেগেছিল।
কলকাতায় এসে যখন ফের ফোন করল, তখন বললাম, “এখনই চলে এসো আমাদের অফিসে।”
দিগিন বলল, “না ভাই, সময় পাব না। একটা কারণে তোমাকে আমার খুব দরকার। তোমার সাহায্য চাই।”
“কী বলো।”
“আমাদের ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন এবার আমাকে একটা দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছে। গতবার ইন্ডিয়ান টিম যখন শারজায় খেলতে গিয়েছিল, তখন। সৌরভ গাঙ্গুলিকে ভাল পারফরম্যান্সের জন্য আমরা একটা হিরের আংটি দেব প্রমিস করেছিলাম। কিন্তু গ্রুপ ম্যাচে হেরে যাওয়ায় ইন্ডিয়ান টিম তাড়াতাড়ি চলে আসে। তাই আংটিটা ওকে তখন দেওয়া হয়নি। এবার নিয়ে এসেছি। একটা অনুষ্ঠান করে সৌরভকে আংটিটা দিতে চাই। সে-ব্যাপারেই তোমাকে সাহায্য করতে হবে।”
“আমাদের কাগজে কি খবরটা করে দেব?”
“না না। এখনই কোরো না। খবরটা আগে তোমাদের কাগজে বেরিয়ে গেলে ভান্ডারকর ব্যাটা রেগে যাবে।”
“কে এই লোকটা?”
“আর বোলো না। এই লোকটা এখন আমাদের অ্যাসোসিয়েশনের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা।”
“কোথায় করবে অনুষ্ঠানটা?”
“আমার জামির লেনের বাড়িতে। তুমি তো আগে এসেছ। বেশি লোক ডাকব না ভাই। টিভি আর কাগজের কয়েকজনকে। প্লাস পঙ্কজ রায় আর মানিক গোস্বামীকে।”
“মানিকদাকে তুমি চিনলে কী করে?”
“উনি ইন্ডিয়ার জুনিয়ার টেনিস টিমটার ম্যানেজার হয়ে একবার দুবাইয়ে গিয়েছিলেন। তখন জানলাম উনি চুনি গোস্বামীর দাদা।”
কথা বলতে বলতেই দিগিন তখন অতিথিদের নাম লিখে নিয়েছিল। মাঝের দু’দিন আর যোগাযোগ করেনি। এই ধরনের অনুষ্ঠানে সাধারণত আমি যাই না। কৌশিকদের মতো কাউকে পাঠিয়ে দিই। কিন্তু এই অনুষ্ঠানটা দিগিনের। আমাকে যেতেই হবে। না গেলে ও মনে মনে খুব দুঃখ পাবে। ভাগ্যিস, বীরেনদা মনে করিয়ে দিলেন।
হাতঘড়িতে দেখলাম, সন্ধে প্রায় সাতটা। দিগিনের অনুষ্ঠান রাত আটটায়। এসপ্লানেড থেকে জামির লেনে যেতে আধঘণ্টার বেশি লাগা উচিত নয়। এর মধ্যে বাঙ্গালোর থেকে তাপসের কপি যদি এসে যায় তা হলে ঠিক সময়ে পৌঁছে যেতে পারব। বীরেনদা এই মাত্র বলে গেলেন সৌরভ কলকাতায় আছে। হতে পারে। আসলে এত লোক ওকে বিরক্ত করে, ও কলকাতায় থাকলেও কাউকে জানাতে চায় না। আজকাল সৌরভ ঘনঘন নম্বর বদলায় টেলিফোনের। পছন্দমতো লোক ছাড়া কারও সঙ্গে দেখা করে না। অবশ্য আমি যদি ফোন করি, ও কখনও এড়িয়ে যায় না। ওর সঙ্গে সম্পর্কটা আমার এত ভাল।
বীরেনদা চলে যাওয়ার পর ফোন করলাম সৌরভের বাড়িতে। একটু পর এসে ও নিজেই ধরল ফোনটা। বলল, “কী ব্যাপার কালকেতুদা, অফিস থেকে এখনও বেরোওনি?”
পালটা প্রশ্ন করলাম, “দিগিনের অনুষ্ঠানে তুমি যাচ্ছ না?”
“এই বেরোচ্ছি। তবে বেশিক্ষণ থাকব না। কাল সকালের ফ্লাইটেই ফের মুম্বাই যাচ্ছি।”
“সৌরভ, তোমার সম্পর্কে একটা খবর নিয়ে এসেছে কৌশিক। তুমি নাকি ইয়র্কশায়ারের হয়ে এবার সাইন করছ?”
চমকে উঠে সৌরভ বলল, “কে দিল খবরটা?”
“সেটা জানতে চেয়ো না। আগে বলে খবরটা সত্যি কি না।”
“এখনও তেমন কিছু হয়নি।”
বুঝতে পারলাম খবরটা সৌরভ চেপে যাচ্ছে। তাই বললাম, “খবরটা কিন্তু আমরা ছাপছি। পরে অস্বীকার কোরো না।”
সৌরভ বলল, “যা ইচ্ছে লেখো, কিন্তু আমার মুখ দিয়ে কিছু বসিয়ে দিয়ো না।”
“ঠিক আছে, দিগিনদের বাড়িতে তা হলে তোমার সঙ্গে দেখা হচ্ছে।”
“ও কে।” বলেই সৌরভ লাইনটা ছেড়ে দিল।
কৌশিক ঘাড় ঘুরিয়ে আমাদের কথা শুনছিল। জিজ্ঞেস করল, “কী বলল সৌরভ?”
বললাম, “খবরটা কিন্তু অস্বীকার করল না।”
কৌশিকের মুখে একচিলতে হাসি ফুটে উঠল। আত্মতৃপ্তির হাসি। একজন রিপোর্টার যখন কোনও এক্সকুসিভ খবর আনে এবং পরে তা মিলে যায়, তখন তার মুখে এরকম হাসিই ফুটে ওঠে।
হাতের সব কাজ সেরে অফিস থেকে বেরোলাম প্রায় আটটায়। জামির লেনে যখন পৌঁছলাম, তখন পার্টি অনেকক্ষণ শুরু হয়ে গেছে। নীচের বড় হলঘরেই অনুষ্ঠান। আজকাল প্রাইভেট চ্যানেলের বেশ কিছু লোক ক্যামেরা নিয়ে হাজির হয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। দেখলাম সৌরভকে ঘিরে ছবি তুলছেন কয়েকজন ক্যামেরাম্যান। ইন্ডিয়া টিম নিউজিল্যান্ড সফরে যাবে পঞ্চাশ দিনের জন্য। সে-সম্পর্কে সৌরভকে প্রশ্ন করছে অভিজিৎ বলে একটা ছেলে। উত্তর দিতে দিতে আমার দিকে চোখ পড়ায় সৌরভ হাসল।
যার পার্টিতে এসেছি সেই দিগিনকে কোথাও দেখতে পেলাম না। ঘরের চারদিকে চোখ বোলালাম, অথচ ও কোথাও নেই। হলঘর থেকে দোতলায় উঠে গেছে ঘোরানো একটা সিঁড়ি। হঠাৎ চোখে পড়ল দোতলার ল্যান্ডিংয়ে দাঁড়িয়ে ভিডিও ক্যামেরায় ছবি তুলছে দিগিনের ছেলে জয়। তিন বছর আগে ওকে দেখেছিলাম। এখন বেশ লম্বা হয়ে গেছে। আমার দিকে চোখ পড়তেই নীচে নেমে এসে বলল, “আঙ্কল, পুরো অনুষ্ঠানটা তুলে রাখছি। দুবাইয়ে নিয়ে গিয়ে দেখাব।”
জিজ্ঞেস করলাম, “কী ক্যামেরা তোমার?”
“প্যানাসনিক।”
“তোমার ড্যাডি কোথায়?”
“ওপরে। যান। উঠেই ডান দিকে।”
বলেই জয় ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে ডান দিকে চোখ ফেরাতেই দেখলাম, বিরাট ড্রয়িংরুমে বসে আছে দিগিন, বীরেনদা এবং আরও দু’-একজন। ওদের দিকে তাকিয়েই মনে হল, কোনও একটা অঘটন ঘটে গেছে। নীচে হইহুল্লোড় চলছে। অথচ ওপরটা ঝড়ে বিধ্বস্ত। সবাই চুপচাপ। আমাকে দেখে বীরেনদা শুকনো মুখে শুধু বললেন, “ওহ, তুই এসে গেছিস।”
দিগিনের দিকে তাকিয়ে বললাম, “কী ব্যাপার দিগিন, ইজ সামথিং রং?”
ও বলল, “একটা খুব বাজে ব্যাপার হয়ে গেছে ভাই।”
“কী ব্যাপার?”
“সৌরভকে যে প্রেজেন্টেশনটা দেব বলে এনেছিলাম, সেটা চুরি গেছে ভাই।”
“প্রেজেন্টেশন মানে সেই হিরের আংটি?”
“হ্যাঁ। সৌরভ এসে গেছে। আমার মানসম্মান সব। গেল। তুমি আমাকে বাঁচাও ভাই।”
॥ ৩ ॥
দিগিন যা বলল, তাতে বুঝলাম সন্ধে সাতটা নাগাদ যখন খবরের কাগজের লোকেরা আসতে শুরু করে, তখন কেউ একজন হিরের আংটিটা দেখতে চেয়েছিল। দিগিন সেটা দেখায়। ঠিক সেই সময়ই দুবাই থেকে একটা ফোন আসে। নীচে ফোন ধরে কথা বলার পর দিগিন একবার ওপরে উঠে এসেছিল। পৌনে আটটা নাগাদ সৌরভ আসে। ঠিক তখনই দিগিন আবিষ্কার করে, বাক্সসহ আংটিটা পকেটে নেই। ওর মুখে এ পর্যন্ত শোনার পর জিজ্ঞেস করলাম, “ফোন ধরতে যাওয়ার আগে ঠিক কার হাতে আংটিটা দিয়েছিলে মনে আছে?”
“না।”
“তখন ওখানে কে কে ছিল?”
“আমি, জয়, ভান্ডারকর ছাড়া কাগজের সাত-আটজন লোক। জয় অবশ্য নীচের ফ্লোরে ছিল না। ও সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে আমাদের ছবি তুলছিল।”
“এই ভান্ডারকর লোকটা কে?”
“দুবাইয়ে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি এখন। পুণের লোক। কিন্তু এই অনুষ্ঠানের জন্যই ওকে এখানে টেনে এনেছি। ভাবলাম, সৌরভকে যে আংটিটা দিচ্ছি তার একজন সাক্ষী থাক। কাল সকালে ও পুণে চলে যাবে। এখানে আমার বাড়িতে ওঠেনি। রয়েছে হিন্দুস্থান হোটেলে।”
“দুবাইতে কী করেন ভদ্রলোক?”
“তেমন কিছু না। ফুড প্রোডাক্টসের কী যেন একটা এজেন্সি আছে।”
“এখন কোথায় উনি?”
“বোধহয় নীচে। সৌরভ আসার পর থেকে ছিনেজোঁকের মতো ওর সঙ্গে লেগে রয়েছে। কী করা যায় বলো তো ভাই? আজ আংটিটা না দিতে পারলে সৌরভ আমার সম্পর্কে বিচ্ছিরি ধারণা করবে। পুরো দোষটা অবশ্য আমার। তখন পকেট থেকে বের করে কেন যে সবাইকে দেখাতে গেলাম…”
কথাটা শুনে বললাম, “অত উতলা হোয়ো না। আমাকে ভাবতে দাও।”
দিগিনের চোখমুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে, একেবারে ভেঙে পড়েছে। স্বাভাবিক। ও আমার হাত ধরে বলল, “কালকেতু, তুমি শখের গোয়েন্দাগিরিও করো। একবার চেষ্টা করে দ্যাখো-না, আংটিটা বের করতে পারো কি না।”
বললাম, “সেটা তুমি না বললেও আমি চেষ্টা করতাম। আপাতত একটা কাজ করো, নীচে যাও। সৌরভ যাই যাই করছে। ও এক জায়গায় বেশিক্ষণ থাকার ছেলে নয়। ওকে আধঘণ্টা ঠেকিয়ে রাখে। এর মধ্যে যা ব্যবস্থা করার আমি করছি।”
কথাটা শুনেই দিগিন উঠে দাঁড়াল। সবাই মিলে এসে দাঁড়ালাম সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে। এখান থেকে নীচের হলঘরের সবকিছু দেখা যাচ্ছে। সৌরভকে ঘিরে অল্পবয়সি কিছু ছেলেমেয়ের ভিড়। কেউ কেউ অটোগ্রাফ নিচ্ছে। খবরের কাগজের লোকেরা এদিক-ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে। কারও হাতে খাবারের প্লেট। ঘরের একপাশে বুফে-র আয়োজন রয়েছে। সেখানে ছোট্ট লাইন। এখনও কেউ জানে না, কী বিপদ ঘটে গেছে।
দিগিনরা নীচে নেমে গেল। আমার পাশেই দাঁড়িয়ে ভিডিও ক্যামেরায় ছবি তুলছে জয়। ওপরে দাঁড়িয়ে দ্রুত চোখ বোলাতে লাগলাম। অতিথিদের মধ্যে মোটামুটি সবাই চেনা। এঁদেরই মধ্যে কেউ আংটিটা সরিয়েছেন। কিন্তু কে? অতিথিদের ডেকে ডেকে তো আর পকেট সার্চ করা সম্ভব না। সেটা অপমান করা হবে। বেশিরভাগই খবরের কাগজের লোক। বাকিরা বোধহয় দিগিনের আত্মীয়। সৌরভকে দেখার জন্য এসেছেন। এঁদের মধ্যে কেউ হিরের আংটি হাতাবেন বলে মনে হয় না।
সমস্যা যত কঠিন হয়, তত দ্রুত আমার মাথা। খোলে। হাতে সময় বেশি নেই। বড়জোর মিনিট পঁচিশ। এর মধ্যেই আমাকে আংটি চুরির রহস্য উন্মোচন করতে হবে। মুম্বইয়ে একবার ব্রায়ান লারার গ্লাভস চুরির কেসটা সমাধান করেছিলাম এক ঘণ্টার মধ্যে। সেই কাহিনি লিখেছিলাম আনন্দমেলায় ‘একটা ফালটুস চুরি’ গল্পে। সৌরভ মানে মহারাজের আংটি চুরির ঘটনাটাও লিখতে হবে যদি রহস্য ভেদ করতে পারি। সে অবশ্য পরের কথা।
নীচে দিগিন দাঁড়িয়ে কথা বলছে, মাঝবয়েসি একটা লোকের সঙ্গে। পরনে ঘিরে রঙের সাফারি স্যুট। লোকটাকে দেখে কেন জানি না মনে হল, এর নামই ভান্ডারকর। গায়ের রং বেশ কালো। মরাঠিরা খুব একটা কালো হন না। বিনোদ কাম্বলিকে দেখার আগে পর্যন্ত আমার এই ধারণা ছিল। পরে জেনেছি মহারাষ্ট্রের উপকূল অঞ্চলে যাঁরা থাকেন, তাঁদের অনেকেরই গায়ের রং কালো। নীচের দিকে তাকিয়ে লক্ষ করতে লাগলাম সৌরভকে। পঙ্কজদার সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছে। ওর মাথায় যদি একবার ঢোকে এক মিনিটের বেশি থাকবে না, তা হলে আর ওকে রাখা যাবে না।
হলঘরের ঠিক কোন জায়গাটা থেকে আংটিটা গায়েব হয়েছে, সে-সম্পর্কে আন্দাজ নেওয়ার জন্য নীচে এসে দাঁড়ালাম। হলঘরের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে হঠাৎ ওপরের দিকে তাকাতেই মনে একটা ঝিলিক দিয়ে উঠল। হয়তো সম্ভব, এখনই রহস্যভেদ করা সম্ভব। সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত ওপরে উঠে গেলাম। জয়কে ডেকে বললাম, “এই, তোমাদের বাড়িতে ভিসিআর আছে?”
“আছে। কেন আঙ্কল?”
“তুমি এসো আমার সঙ্গে। দরকার আছে।”
॥ ৪ ॥
সৌরভ মিনিটদশেক আগে চলে গেছে। ওর সঙ্গে সঙ্গে খবরের কাগজের লোক এবং অতিথিরাও। দোতলার ঘরে টিভি-র সামনে বসে আমরা কয়েকজন। দিগিন, ওর স্ত্রী, জয়, বীরেনদা, আরও দু’জন, যাদের আমি চিনি না। টিভি-র রিমোট কন্ট্রোল আমার হাতে। ঘণ্টাখানেক আগে হিরের আংটিটা যখন দিগিনের হাতে তুলে দিই তখন ও চমকে উঠেছিল। ইশারায় তখন বলেছিলাম, এখন না। আগে অনুষ্ঠানটা শেষ করো। তারপর যা বলার বলব। আংটিটা কী করে উদ্ধার করলাম, টিভি-র পরদায় এখন তা ওদের দেখাচ্ছি। আমার কিছু না বললেও চলবে।
আসলে ভিডিও ক্যামেরায় জয় অনুষ্ঠানের যেসব। মুহূর্তগুলো তুলেছিল, তার ক্যাসেট চালিয়ে দিয়েছি। ভিসিআর-এ নিজে একবার দেখেছি। পরদায় একে-একে ছবি ফুটে উঠছে। দিগিন বাক্স খুলে আংটিটা সবাইকে দেখাচ্ছে। সিঁড়ির ওপর থেকে তুলেছে বলে সব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দু’-একজনের হাত ঘুরে আংটির বাক্সটা গেল সাফারি পরা ভান্ডারকরের হাতে। ঠিক সেই সময়ই আমি ছবিটা স্টিল করে জিজ্ঞেস করলাম, “এই লোকটাই তো ভান্ডারকর, তাই না।”
“হ্যাঁ।”
“লোকটার সঙ্গে তোমার সম্পর্ক কেমন?”
“কেন বলো তো?”
“যা জানতে চাইছি বলো।”
“ভাল না। আমাদের অ্যাসোসিয়েশনে দুটো গ্রুপ আছে। বাঙালিদের একটা গ্রুপ। আর অন্যটা অবাঙালিদের। আমরা চেয়েছিলাম সৌরভকে ফেলিসিটেট করতে। আর ওরা প্রেশার দিচ্ছিল, অজিত আগরকরকে। এ নিয়ে বেশ অশান্তি হয়েছিল। দুবাইয়ে সৌরভকে কেন আংটিটা দিতে পারিনি জানো? এই ভান্ডারকররা ইচ্ছে করে দেরি করিয়ে দিয়েছিল। পাছে পরে কোনও অশান্তি করে সেজন্য ওকে কলকাতায় টেনে এনেছিলাম। কিন্তু তুমি এত কথা জিজ্ঞেস করছ কেন ভাই?”
প্রশ্নটা শুনে মুচকি হেসে বললাম, “সেটা নিজের চোখে দ্যাখো এবার।”
বলেই ভিসিআর চালিয়ে দিলাম। ভান্ডারকরের হাতে সেই আংটির বাক্স। ঠিক সেই সময় দিগিন ফোন ধরতে চলে গেল। জয় না জেনেই সেই সময় ভান্ডারকরকে ফোকাস করেছিল। পরদায় আমরা দেখছি, ভান্ডারকর এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। তারপর শো-কেসের ওপর রাখা একটা ফ্লাওয়ার ভাসের মধ্যে গুঁজে দিল ছোট্ট বাক্সটা। ঠিক ওই জায়গাটায় আমি ফের স্টিল করে দিলাম।
দৃশ্যটা দেখে দিগিন রেগে উঠে দাঁড়িয়েছে। বলেই ফেলল, “শয়তানটাকে আমি পুলিশে হ্যান্ডওভার করব।”
বললাম, “কোনও লাভ হবে না। তুমি কিছু প্রমাণ করতে পারবে না। আংটিটা তে ও নিয়ে যায়নি। গোপন জায়গায় লুকিয়ে রেখে গিয়েছিল। ওর উদ্দেশ্য ছিল তোমাকে বেইজ্জত করা। সেটা অবশ্য করতে পারল না।”
দিগিন বলল, “এখন বুঝছি, তুমি যখন আংটিটা এনে আমার হাতে দিলে তখন ভান্ডারকরের মুখটা হঠাৎ কেন ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল। তার দু’মিনিটের মধ্যে ও পার্টি ছেড়ে বেরিয়ে গেল। ভাগ্যিস তুমি আজ এসেছিলে।”
“না, ক্রেডিটটা আমাকে দিয়ো না। এটা প্রাপ্য তোমার ছেলের। নীচ থেকে ওর হাতে ভিডিও ক্যামেরা দেখে হঠাৎই মাথায় খেলে গেল, অনুষ্ঠানের সবকিছু ও ক্যামেরায় ধরে রেখেছে। হয়তো চুরির কোনও ক্লু ক্যাসেটে পাওয়া গেলেও যেতে পারে। হোপ এগেনস্ট হোপ। ওপরে এসে জয়ের কাছ থেকে ক্যাসেটটা চেয়ে নিয়ে দেখতে বসে গেলাম। ব্যস, ক্লু নয়। আসল কালপ্রিটই ধরা পড়ে গেল। আসলে কী জানো, একটা কথা আছে, ‘যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দ্যাখো তাই, পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন।’ কথাটা যেমন আমি সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে মানি, তেমনই গোয়েন্দাগিরিতেও।”
১০ মার্চ ১৯৯৯