মহারাজা সিং-এর গল্প – হিমানীশ গোস্বামী
চিরিমিরির বড়ো লাহিড়িবাবুর ছিল বিশ্ব কুটুম্বিতা। চিরিমিরি জায়গাটারও কথা তোমরা হয়ত শুনে থাকবে, কিন্তু সেটা যে কোথায় আর সেখানে কেমন করেই বা যেতে হয় সেটা সকলের না-জানারই কথা। যারা কলকাতায় আছে তাদের বুঝিয়ে বলি, প্রথমে হাওড়া স্টেশন থেকে বোম্বাই মেলে চড়ে বিলাসপুরে গিয়ে নামতে হয়। তারপর সকাল দশটা নাগাদ বিলাসপুর থেকে ছাড়ে এমন ট্রেন ইন্দোর-ভূপাল এক্সপ্রেসে চড়তে হয়।
এক্সপ্রেস নাম হলেও সেটা চলে, যেন একটা কচ্ছপ। তারপর স্টেশনও আসে আর প্রত্যেক স্টেশনে কম করেও দশ মিনিট করে দাঁড়ায়। তারপর আবার তার যাত্রা। এইভাবে একটা-দেড়টায় পৌঁছে যাওয়া যাবে অনুপপুর।
সেখানে নেমে আবার চিরিমিরি প্যাসেঞ্জারে উঠতে হবে। সেটা ছাড়ে চারটের সময়। এরও প্রায় তিন ঘন্টা পর চিরিমিরি। স্টেশন থেকে বড়ো লাহিড়ি বিভূতিভূষণের বাংলো খুব কাছে। স্টেশন থেকে পাহাড়ে চড়তে হয়, বোধহয় শ-দেড়েক ফুট উঁচু। সেখানে একটা বড়ো ইউক্যালিপটাস গাছ আছে। মোটা আর উঁচু সেই গাছটি ছবির মতো দেখায়, তার সঙ্গে লাগানো একটা ছোটো লন। চারিদিকে ফুলবাগান, আর মাঝখানে টেবিল আর অনেক চেয়ার। শীতকালে তো বটেই গ্রীষ্মকালেও সন্ধের সময় ওই লনের চেয়ারে বসে চমৎকার গল্পগুজব করা হত। আমি প্রায়ই যেতাম চিরিমিরিতে আর গল্পে মজে যেতাম। অনেক সময়ই হত শিকারের গল্প।
এখন তো অন্যরকম হয়ে গেছে। শালগাছে ভরা জঙ্গল কারা সব কেটেকুটে প্রায় সাফ করেই দিয়েছে। আগে ঝোপে ঝোপে বাঘ না-থাকলেও কোনো কোনো ঝোপে বাঘ ছিল সেটা ঠিকই। বড়ো লাহিড়ির ছেলেরা প্রশান্ত প্রমোদ আর সুগত কত জানোয়ার ওখানে শিকার করেছে তার হিসেব নেই। এমনকি নাতি তথাগত পর্যন্ত ষোলো-সতেরো বছর বয়সে বিশাল বাঘ মেরেছিল। এখন অবশ্য সে পরিবেশও নেই, সে বাঘ তো নেই-ই। আমিও ওখানে দু-বার শিকারে বেরিয়েছিলাম ওঁদের সঙ্গে। কিন্তু সে-সব হাস্যকর ঘটনা না-বলাই বোধহয় ভালো! আমি আজ বিভূতিভূষণের বন্ধু সিং সাহেবের গল্পটা বলি।
একবার চিরিমিরিতে গিয়েছি, শীতকাল। মনে আশা এবারেও শিকারে যাবার সৌভাগ্য হবে। শিকারে যাবার একটা বড়ো মজা হচ্ছে শিকার। বাঘকে বা সম্বর হরিণকে গুলি করে মারবার মধ্যে যে উত্তেজনা আছে, সেটা একটা নেশার মতো অনেককে পেয়ে বসে। আমার শিকারে বিশেষ নেশা ছিল না, তবে শিকারে যাওয়ার নেশা যেন অল্প অল্প আসছিল। জিপে করে দূরে অজানা কোথাও গভীর জঙ্গলে চলে যাওয়া। তাঁবু করে থাকা চাল ডাল মশলা দিয়ে খিচুড়ি, কিছু শিকার করা জানোয়ারের মাংস ঝাল ঝাল করে রান্না করা আর একটা মাচা তৈরি করে সেখানে বসে বসে রাত জাগার মধ্যে কেমন যেন উন্মাদনা ছিল।
তা চিরিমিরি গিয়ে বুঝলাম শিকারে সেবারে যাওয়া হচ্ছে না, কেননা গিয়েই শুনতে পেলাম বড়ো লাহিড়ি সাহেবের বন্ধু সিং সাহেব আসছেন, সঙ্গে বাইশজন লোক। এটাও শুনলাম সিং সাহেব ঠিক বড়ো লাহিড়ির বন্ধু নন। বছর দশেক আগে তাঁদের সঙ্গে দু-বার দেখা হয়। একবার এলাহাবাদের কাছে রাস্তায় তাঁবু ফেলেছিলেন বড়ো লাহিড়ি সাহেবের দলবল। ওখানে একটা রাস্তা তৈরির কন্ট্রাক্ট পেয়েছিলেন বড়ো লাহিড়ি সাহেব। বড়ো কাজ খুব নয়। তিন মাইল রাস্তা হবে পাহাড়ের ভেতর দিয়ে। বড়ো লাহিড়ি সাহেব বেশ কিছু রাস্তা তৈরি করেছিলেন।
ওই সময় সিং সাহেব ওই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর দামি বেন্টলি গাড়ির চাকা ফেটে যায়। বড়ো লাহিড়ি সাহেবের ছিল টি ফোর্ড। অনেক পুরোনো গাড়ি। তা তখন সিং সাহেব বিপদে পড়ায় বড়ো লাহিড়ি সাহেব তাঁর ওই গাড়ি করে সিং সাহেবকে এলাহাবাদে পৌঁছে দেন। ঠিক ওই সময় এলাহাবাদ পৌঁছুতে না-পারলে সিং সাহেবের নাকি দু-দুটো বড়ো সম্পত্তি হাতছাড়া হয়ে যেত। আদালতে সেদিন মামলা ছিল, আর সিং সাহেব না-গেলে সে মামলায় তিনি হেরেই যেতেন। এই হল আলাপের সূত্রপাত।
এর মাসখানেক পর সিং সাহেব বড়ো লাহিড়ি সাহেবকে একটা ছোট্ট উপহার পাঠিয়ে দেন। সেটা আর কিছু নয়, তখনকার আমলের খুব বিখ্যাত আর দামি জার্মান ক্যামেরা রোলাই ফ্লেক্স। বড়ো লাহিড়ি সাহেব এরপর একটা বড়ো শিংওলা হরিণ মেরে সেটিকে উপহার হিসেবে পাঠিয়ে দেন সিং সাহেবের কাছে। এইসঙ্গে চিরিমিরিতে আসার জন্য আমন্ত্রণও জানান। তখনও লাহিড়ি সাহেব জানতেন না, সিং সাহেব খুব বড়ো না-হলেও একটা ছোটো অঞ্চলের মহারাজা, আর তাঁর নিজের আছে অজস্র কয়লাখনি! যাই হোক, প্রত্যেক বছর একজন অন্যকে উপহার পাঠান। দুজনই দুজনকে আমন্ত্রণ জানান অতিথি হওয়ার জন্য। তা এবারেই সিং সাহেবের (এখন থেকে তাঁকে বলব মহারাজা) দুটো টেলিগ্রাম করেছেন পরপর—আগামী 17ই ডিসেম্বর তিনি তাঁর বন্ধু ওমর ওসমান আর কুড়ি জন কর্মচারী নিয়ে আসছেন। বড়োদিনটা চিরিমিরিতেই কাটানো তাঁর ইচ্ছে। তবে তার আগে মিস্টার অ্যালবার্ট গিয়ে জায়গাটা দেখে আসবেন।
অ্যালবার্ট সাহেব এলেন কেন জানো? এই জায়গাটায় মহারাজের জন্য নানারকম ব্যবস্থা করার ব্যাপার ছিল। অ্যালবার্ট ছিলেন মহারাজার সেক্রেটারি। তিনি এসে মাপজোক করে বুঝলেন, ওখানে গোটা কয়েক তাঁবু বেশ ফেলা যাবে। আর রান্নার সব ব্যবস্থাও হয়ে যাবে। কোথায় উনুন বসবে, কোথা থেকে কাঠ কেরোসিন কয়লা সংগ্রহ করা যাবে এসব বিশদ করে জেনে নিয়ে অ্যালবার্ট সাহেব চলে গেলেন।
উনি যাবার পর লাহিড়ি সাহেব ভয়ংকর মনঃক্ষুণ্ণ হলেন, কেননা তাঁর অতিথি তাঁর ওখানে এসে নিজেদের খাবার-দাবার নিজেরা রান্না করে খাবেন, এটা আবার কেমন অতিথি? তিনি সঙ্গে সঙ্গে সিং মহারাজকে চিঠি দেবেন ঠিক করলেন। কিন্তু কী যে লিখবেন তা ভেবে উঠতে পারলেন না। একেবারে আসতে নিষেধও করা যায় না, ভদ্রতায় বাধে, আবার জিনিসপত্র কিছুই আনতে হবে না এমন কথাও লিখতে গিয়ে রাগের চোটে লেখাগুলোই কেমন বেখাপ্পা মনে হতে লাগল। শেষে ভাবলেন, আসুক সিং মহারাজা আর তাঁর সঙ্গে ওঁর বন্ধু ওমর ওসমান। ওঁদের জন্য তিনি সব ব্যবস্থা নিজেই করবেন।
এই ঠিক করে অনেক লোক লাগিয়ে তিনি ছ-টি চমৎকার ঘর বানিয়ে ফেললেন। সেখানে কাঠেরও অভাব ছিল না, মিস্তিরিও ছিল। মহারাজার অনুচরদের জন্য তিনি ব্যবস্থা করলেন খাটের। কুড়িটা খাট চটপট তৈরিও হয়ে গেল। সে এক ধুন্ধুমার কাণ্ড! মহারাজা সিং আর ওমর ওসমানের জন্য দাদামশায় তাঁর দুটো ঘর ছেড়ে দিলেন। সেখানকার ব্যবস্থা ভালোই ছিল। বিলাসপুর থেকে চারজন রান্না আর জোগান দেবার লোকও আনা হল।
ভাবটা এই, তুমি বাপু মহারাজা—ঠিক আছে, কিন্তু তুমি আমার অতিথি যখন, তখন আমার ব্যবস্থাই মেনে নিতে হবে। না-পোষালে কেটে পড়বার তো কোনো বাধা নেই। মহারাজের জন্য বিলাসপুর থেকে কিছু সেরা জাতের মদও এক বাক্স আনিয়ে রাখলেন যদি মহারাজ চান তাহলে খোলা হবে।
2
আমি যেদিন চিরিমিরি যাই, তার দিন পাঁচেক পর ষোলোই ডিসেম্বর একটা বাস এসে পৌঁছোল লাহিড়ি সাহেবের বাড়িতে। বাস ভর্তি কর্মচারী। জানা গেল, মহারাজা আর ওমর ওসমান চারদিন থাকবেন। মহারাজা সিং-এর লোকেরা প্রথমেই করাত, কুড়ুল, জিনিসপত্র, চেয়ার, টেবিল, বিছানা-বালিশ-কম্বল, থার্মোফ্লাস্ক, বন্দুক-রাইফেল—এসব বাসের ছাত থেকে নামাতে লাগল। হই হই ব্যাপার। অবশ্য ওদের মধ্যে একজন বিলিতি পোশাক-পরা কর্মচারী ছিলেন। তিনি লাহিড়ি সাহেবের অনুমতিও চাইতে গিয়েছিলেন, কিন্তু অনুমতি পাওয়ার আগেই লোকেরা সমস্ত জিনিসপত্র নামিয়ে ফেলেছে।
লাহিড়ি সাহেব হন্তদন্ত হয়ে এসে বললেন,—সব আবার বাসে ওঠাও। ওসব কোনো কিছু নামাতে হবে না।
একজন কর্মচারী বিনীতভাবে জানালেন, মহারাজের হুকুম যে! লাহিড়ি সাহেব ঠারেঠোরে কায়দা করে ভদ্রভাবেই বুঝিয়ে দিলেন ওসব আবদার চলবে না বাপু এখানে। কী আর ওরা করবে! ফের তাদের জিনিসপত্র বাসে আর বাসের মাথায় উঠিয়ে নেওয়া হল। ভারপ্রাপ্ত কর্মচারীটি জানালেন, মহারাজের হঠাৎ ইচ্ছে হয়েছে তিনি চিরিমিরিতে বিগ গেম হান্ট করবেন!
রেগে তো লাহিড়ি সাহেব কাঁই। কিন্তু সে তো আর প্রকাশ করা চলে না। তিনি কায়দা করে বললেন বিগ গেম মানে, হাতিও হয় সিংহ গণ্ডার জলহস্তী বাঘও হয়। এমনকি চিতাও—চিতাও বিগ গেম-এর মধ্যে পড়ে। আবার বড়ো বড়ো কুমিরও হতে পারে। তা মহারাজা সিং-এর ইচ্ছে কী? যদি আগে জানাতেন, তাহলে ব্যবস্থা রাখা যেত, আর আগে জানলে জিরাফও আনা যেত, সিংহও। ঠিক কী প্রাণীতে মহারাজের রুচি সেটা এখন জানালে ভালো হয়, তবে সিংহ বা জিরাফ বা কুমিরের ব্যবস্থা করা যাবে না।
ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী বললেন,—মহারাজের ইচ্ছে ঠিক যে কী তা তো জানা সহজ নয়। সব ব্যবস্থা পাকা করার পর তিনি যেভাবে সব ওলটপালট করে দেন তাতে কোনো কিছু আগে থেকে বলা যায় না। উনি এলে উনি নিজেই বলবেন।
সারা বাড়ি তকতকে ঝকঝকে করা হয়েছে। পাছে ধুলো ওড়ে সেজন্য বালতি বালতি জল ঢেলে লনটাকে কাদা করা হয়েছে। অতটা কাদা কে করল তা নিয়ে খুব গোলমাল হল। মহারাজা সিং কাদা পছন্দ করেন কিনা সেটাও ঠিকমতো জানা গেল না। তবে একটা জিনিস জানা গেল, ওঁর চেহারা নাকি খুব খুলেছে। গত দু-তিন বছরে ভারী মোটা হয়ে পড়েছেন। দু-পা হাঁটলে দু-মিনিট হাঁপাতে হয়। শুনে লাহিড়ি সাহেব ভারি খুশি হলেন। ভাবলেন, এইরকম মোটা লোক নিশ্চয়ই শিকারে যাবেন না। একটু স্বস্তির নিশ্বাস পড়ল।
পরদিন সকাল দশটার মধ্যে মহারাজা সিং-এর আসার কথা। প্রায় দুশো মিটার দূরে দূরে এক এক জনকে বন্দুক হাতে মোতায়েন রাখা হয়েছে, যাতে মহারাজের গাড়ি আসার সঙ্গে সঙ্গে তারা বন্দুকের আওয়াজ করে। এক কিলোমিটার পাহাড়ি পথ আসতে দশ মিনিট লেগে যাবে। ওই সময়ের মধ্যে গোলাপজল, আতর, মালা এসব নিয়ে সংবর্ধনা জানানো যাবে।
কিন্তু দশটায় এলেন না। সাড়ে দশটাতেও না। কী হচ্ছে কে জানে। কোথাও কি আটকে গেলেন? কোথাও গাড়ি কি খারাপ হল? দুশ্চিন্তা বেড়ে চলল সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। দুপুর দুটোতেও মহারাজের গাড়ির দেখা নেই। বিকেল চারটে বেজে গেল।
লোকেরা সব উদবিগ্ন। হবারই কথা। কী করা যায় সবাই ভাবছে। ভারি ঠান্ডা চিরিমিরিতে। বিকেল পাঁচটা হতেই অন্ধকারও নেমে এল ঘন হয়ে। আর সে কী শীত। যাদের বন্দুক হাতে দাঁড় করানো হয়েছিল, লোক ছুটল তাদের জন্য গরম জামাকাপড় নিয়ে। দুপুরে অবশ্য তাদের একবার খাইয়ে আনা হয়েছে।
মহারাজা যখন এলেন তখন সন্ধে আটটা বেজে গেছে। ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমেই পেছনের বুট থেকে একটা হুইল-কাম-পালকি চেয়ার বার করল। তারপর দরজা খুলে দিল, আর ওমর ওসমান মহারাজা সিংকে অতিকষ্টে গাড়ি থেকে বার করে ওই চেয়ারে বসিয়ে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে জনা দশেক লোক ওই বিরাট চেহারার মানুষটিকে বয়ে নিয়ে তাঁর জন্য নির্দিষ্ট ঘরে নিয়ে এল।
মহারাজা সিং দুম করে চেয়ার থেকে নেমে গিয়ে বিছানায় উঠে বসলেন কারও সাহায্য ছাড়াই। এর মধ্যে লাহিড়ি সাহেব যথারীতি আতর ফুল এসব দিয়ে অভ্যর্থনা করে ফেলেছেন। মহারাজা সিং বললেন—আঃ চমৎকার জায়গাটা—বেশ অন্ধকার! করে রাখা হয়েছে।
এটা কিন্তু নিন্দে নয়। যদিও প্রথমে মনে হতে পারত, ওটা বোধহয় এক ধরনের সমালোচনা। আসলে মহারাজা খুব বেশি আলো পছন্দ করেন না। তিনি বলেন, অন্ধকারে কেমন চমৎকার আকাশের গ্রহ-তারা দেখা যায়। ওইসব গ্রহ-তারারা পৃথিবীর যাবতীয় প্রাণীর ভাগ্য নির্ধারণ করে—আর তা করতে হলে তারাদের তো পৃথিবী ঠিকঠাক দেখা চাই। তারারা সব এমন যে আলোয় তাদের চোখ ধাঁধিয়ে যেতে পারে।
পা ধোয়ার জন্যে গরম জল আনা হল। ডালায় করে পাঁচরকম পান, চমৎকার সব মশলা এনে ধরা হল তাঁর সামনে। মহারাজ বললেন,—আগে ডিনার হোক, পরে ওসব হবে।
লাহিড়ি সাহেবকে বললেন আমার জন্যে ভাববেন না, বুঝতে পারছি আপনি সব সুবন্দোবস্তই করেছেন। বেশ চমৎকার মাংসের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। বোধহয় মাছও আছে। তবে ডাক্তারের আদেশে ওসব খাওয়া সম্পূর্ণ বারণ। সম্পূর্ণ বারণ মানে বুঝতেই পারছেন। রাত্রে কেবল একটু কড়াইশুঁটির স্যুপ আর একটা সামান্য ঘিয়ে ভাজা শুকনো পরটা টোম্যাটোকুচি আর গাজরকুচি দিয়ে, একটু পেঁয়াজ। এ হল গিয়ে আমার সাহেব-ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন, আর আমার একজন কবিরাজ আছেন। তিনি আসার আগে নাড়ি দেখে বলেছেন যা ইচ্ছে খান, তবে মাছ ছোঁবেন না। ভাবছি কী করা যায়।
লাহিড়ি সাহেব বললেন, কবিরাজের কথাই মানুন না কেন। বিলাসপুর থেকে ভালো রান্নার লোক আনিয়েছি। মাছ মাংস দুই-ই রাঁধে চমৎকার।
মনে হল, কথাটা মহারাজের মনে ধরল। তিনি বললেন,—তা ঠিকই বলেছেন। তা ছাড়া আসার আগে রাজজ্যোতিষী গ্রহণাচার্যকে দিয়ে বিচার করিয়ে এনেছি। তিনি বলেছেন, দীর্ঘজীবন হবে আমার আর দু-একটা সামান্য রোগ ছাড়া স্বাস্থ্য থাকবে চমৎকার। একটা পাথর পরতে দিয়েছেন, সেটা পরলে দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পাব। অতএব বন্ধু, বিলাসপুরের লোকেদের রান্নাই চলুক।
সিং মহারাজা খুব চমৎকার কথা বলেন। মাঝে মাঝে ইংরেজিতে কথা বলেন,—নির্ভুল উচ্চারণে। তিনি বললেন, ছোটোবেলায় দুজন মেমসাহেব ওঁকে ইংরেজি শিখিয়েছেন। পরে ইংল্যান্ডে লেখাপড়াও করেছেন ওখানকার স্কুলে। নানারকম অদ্ভুত গল্প চলতে লাগল। তবে মহারাজা অনেক কথা ভুলে যান, সেজন্য ওমর ওসমান তাঁকে কিছু কিছু মনে করিয়ে দেন। দুজনের মধ্যে ভারি বন্ধুত্ব।
রাত দশটা নাগাদ খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকল। সিং মহারাজা যা খেলেন, তা দেখবার মতো। প্রচুর লুচি সহযোগে হরিণের মাংস আর রুইমাছের কালিয়া দিয়ে চিকেন পোলাও। তারপর একবাটি ক্ষীর আস্তে আস্তে খান আর গল্প করেন। তা গল্প বলতে লাহিড়ি সাহেবও ছিলেন পটু।
দশটা নাগাদ সিং মহারাজা বললেন,—আপনার কাছে রাতে পড়বার মতো কিছু বই আছে?
লাহিড়ি সাহেবের প্রকাণ্ড লাইব্রেরি ছিল। তা থেকে খান পাঁচেক বই পছন্দ করে দিলেন তিনি। বই দেখে উচ্ছ্বসিত হলেন সিং মহারাজা। বললেন,—আজ রাতটা ভালোই কাটবে।
—সে কি মহারাজ, ঘুমোবেন না?
তিনি বললেন,—ঘুম মাঝে মাঝে আসে বটে, কিন্তু এমন বই থাকতে কে ঘুমোয় বলুন? আহা, ভারি চমৎকার বই।
উঠে পড়লেন সিং মহারাজা। ঠিক দশটার পর মহারাজার ঘরে আলো নিভে গেল, আর তার ঠিক তিনমিনিট পর ডাকতে লাগল তাঁর নাক।
পরদিন ব্রেকফাস্টের সময় বললেন,—সারারাত ঘুম হয়নি আমার।
ওমর ওসমান বললেন,—মহারাজ আপনি বোধ হয় পরশুর কথা বলছেন। কাল আপনার ভালোই ঘুম হয়েছিল।
মহারাজা বললেন,—তা হবে। মাপ করবেন লাহিড়িজি। কাল আমার ভারি চমৎকার ঘুম হয়েছিল, তবে কিনা কেবল পরটা টোম্যাটোর কুচি আর শসা খেয়ে মেজাজটা ঠিক ছিল না। তারপর একটু থেমে বললেন—কড়াইশুঁটির স্যুপটা খাসা হয়েছিল। লোকাল?
লাহিড়ি সাহেব তো অবাক। কাল রাতে মাংসে কড়াইশুঁটি ছিল বটে, কিন্তু স্যুপ ছিল মাশরুমের।
ওমর ওসমান সিং মহারাজের হাঁটুতে একটু চাপ দিয়ে ফিসফিস করে কী যেন বললেন, তখন সিং মহারাজা বললেন, বয়স হয়ে গেছে লাহিড়িজি—পঞ্চাশ পেরিয়ে গেল এই সেদিন, কিচ্ছু যদি মনে থাকে। কাল রাত্রে দারুণ ভোজ হয়েছিল—ভারি চমৎকার ছিল, তাই না ওমর?
প্রসঙ্গ পালটে ফেললেন লাহিড়ি সাহেব। তিনি বললেন,—আজ দুপুরে কী খাবেন বলুন। এখানে অবশ্য সবকিছু পাওয়া যায় না, তবু যথাসাধ্য চেষ্টা করা যাবে। আর রাতে যদি ইচ্ছে করেন তো গাড়ি করে অমৃতধারায় যাওয়া যেতে পারে। সেখানে চাঁদের আলোয় চমৎকার জলপ্রপাত দেখতে দেখতে খাওয়া-দাওয়া করা যেতে পারে।
সিং মহারাজা বললেন,—সে কী মশাই? এই তো সবে কাল এসে পৌঁছুলাম। দু-চারদিন বিশ্রাম করি তারপর ওসব ভাবা যাবে। আর খাওয়ার কথা বলছেন—আপনি খুশি হয়ে যা দেবেন তাই খাব মশাই। আর আমার রাজ্যে ফিরে সাহেব-ডাক্তারকে কী বলব জানেন?
—কী বলবেন?
—কী আবার বলব। কিচ্ছু না। বলার দরকার কী। ওকে বলব জানালা দিয়ে বাইরে দেখো। যেমনি সে পেছনে ফিরবে দেব ওর পিঠে দু-দুটো গুলি করে। ব্যাটা আমাকে ডায়েট করিয়ে করিয়ে মেরেই ফেলেছিল। নিশ্চয়ই ভগতনারায়ণের পরামর্শে আর টাকা খেয়ে এইসব কুপরামর্শ দিয়েছে। বলেছিল ঝাল মাছ-মাংস খেলেই মৃত্যু! কই হল না তো মৃত্যু? কোনোদিন ভালো ঘুম হয় না আমার অথচ আপনার এখানে অত সব খেয়েও কী চমৎকার ঘুম হল।
এইসময় হঠাৎ বাইরে বেশ একাট সোরগোল শোনা যেতে লাগল। শুনে আমরা একটু উদবিগ্ন হলাম, কিন্তু দেখলাম মহারাজের মুখ বেশ নির্বিকার, বরং খুশি। উনি বললেন,—ওরা কাজকর্ম নীরবে করতে পারে না।
কাজকর্ম আবার কী হচ্ছে?—লাহিড়ি সাহেব প্রশ্ন করলেন।
মহারাজা সিং বললেন,—ওদের সব ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছি। এখন আমি আর ওমর থাকব কেবল। ওরা সব ফালতু লোক।
তাহলে ওরা এসেছিল কেন?—এ প্রশ্নটা অবশ্য লাহিড়ি সাহেব আগেও করেছিলেন নিজের মনেই। এবারে সরব হলেন।
মহারাজা সিং বললেন,—আগেই ধরে নেওয়া হয়েছিল আপনি লোক খারাপ হতেও পারেন, হয়তো মারামারিরও দরকার হতে পারে সেজন্য ওদের এনেছিলাম। যখন বুঝলাম আপনি দেবতুল্য মানুষ, তখন আর খামোকা ওদের রাখা কেন। তাই কালই ওদের বলে দিয়েছিলাম সরে পড়তে।
শুনে লাহিড়ি সাহেব মনে মনে খুশিই হলেন। তবু বললেন,—আপনি শিকার করবেন না তাহলে? শিকারের জন্যে আনা বন্দুক রাইফেলও তো সব বাসে করে চলে যাবে? আপনার জন্যে এখানকার বাঘের গুহার কাছে একটা জায়গাও ঠিক করা আছে। যদি শিকারে যান তবে এখন যাওয়াই তো ভালো, আকাশও পরিষ্কার আছে, তার উপর শুক্ল পক্ষ, চাঁদ প্রায় পুরো গোল এখন।
মহারাজা সিং বললেন,—না, না, শিকার এখন করা সম্ভব নয়। আমার যিনি জ্যোতিষী তিনি বলেছেন রাত্রে লোহা ছোঁয়া একদম বারণ। আর শিকারে গেলে তো গাড়িতে উঠতে হবে, বন্দুক রাইফেল টোটা ছুঁতে হবে। লোহা ছোঁয়া আমার চলবে না। কাল দেখলেন না আমি কাঁটাচামচ ব্যবহার করলাম না একদম। এমনকি স্যুপ পর্যন্ত চুমুক দিয়ে খেলাম?
তা বটে। সেটা দেখে আমাদের একটু অদ্ভুতই মনে হয়েছিল। কিন্তু সৌজন্যে ব্যাঘাত হতে পারে ভেবে কোনো প্রশ্ন তোলা হয়নি।
কেবল তাই নয়, লাহিড়ি সাহেব নিজেও স্যুপ খেলেন চামচ ব্যবহার না-করে স্রেফ চুমুক দিয়ে। আমি অবশ্য অত সূক্ষ্ম ভদ্রতা বুঝতে না-পেরে চামচ দিয়েই স্যুপটা খেয়েছিলাম।
মহারাজা সিং বললেন,—তাতে কী হয়েছে, আমার অনেক শিকারকাহিনি জানা আছে, তার কিছু শোনানো যাবে। আসল শিকারের চাইতে তেমন মন্দ বিশেষ লাগবে না। জীবনে কম শিকার তো করলাম না। হাজারখানেক বড়ো বাঘ তো শিকার শুরু করার বছর চারেকের মধ্যেই করেছিলাম।
ওমর ওসমান একটু কেশে বিনীতভাবে বললেন,—হাজারখানেক নয়, ওটা কথার কথা। আসলে হবে আটশো বত্রিশটি। আর শিকার শুরুর প্রথম চার বছর নয়, প্রথম এগারো বছর।
সিং মহারাজা হেসে উঠে বললেন,—তা হবে। আজকাল কিছু যদি মনে থাকে! ভাগ্যিস ওমর সঙ্গে ছিল তাই তো সত্যি সংখ্যাটা জানা গেল—নইলে লাহিড়ি সাহেবের কাছে মিথ্যে বলা হত, আর সেটা তো ঘোর অন্যায় হত।
লাহিড়ি সাহেব বললেন, তাহলে আজ সন্ধেয় শিকারের গল্পের আসর বসানো যাক, কী বলেন মহারাজ!
মহারাজা চমকে গিয়ে বললেন,—আজই? না না আজ নয়। আসলে আমার ভ্রমণের ক্লান্তি এখনও যায়নি। গায়ের ব্যথা মরেনি। যাক দু-দিন। এ দু-দিন একটু বিশ্রাম করে নিই। একটু ঘুমোনো দরকার আমার—বলে হাই তুললেন।
ইঙ্গিতটা স্পষ্ট। মহারাজা সিং আস্তে আস্তে ব্রেকফাস্ট টেবিল থেকে উঠে দাঁড়ালেন। ওমর ওসমান তাঁকে ধরে নিয়ে চলে গেলেন।
দু-দিন নয়, পাঁচদিন এইরকম গেল। সারাদিনে দু-বার তিনি দেখা দেন। একবার ব্রেকফাস্টের সময়, আর অন্যবার রাতের ডিনারের সময়। দুপুরবেলাটা তিনি আর ঘর থেকে বেরোন না। খাদ্য তাঁর ঘরে পৌঁছে দেওয়া হয়। প্রত্যেক দিনই বলেন,—কালই বোধহয় ক্লান্তিটা যাবে—তখন জুত করে শিকারের গল্প করা যাবে, কিন্তু গল্প বলার সময় আর তাঁর হয় না। কেননা রোজই তিনি বলেন,—ইস ক্লান্ত ভাবটা আর গেল না।
এইসময় একদিন আমি ওমর ওসমানকে প্রশ্ন করলাম,—উনি এত ক্লান্ত হন কেন? খুব কাজ-টাজ করেন বুঝি? ওমর হেসে বললেন,—আজ্ঞে, আমি ওঁর সঙ্গে বাল্যকাল থেকে আছি, ওঁকে কালেভদ্রে কাজ করতে দেখেছি।
—তবে কি শিকার? শিকার করতে করতে ক্লান্ত?
হাসলেন ওমর। বললেন,—শিকার উনি করেননি কখনও। ভারি ভয় ওঁর বন্দুকে।
—তবে যে বললেন কত যেন বাঘ মেরেছেন, আর আপনিও তো বললেন সবসমেত আটশো বত্রিশটা বাঘ মেরেছেন উনি এগারো বছরে।
আমার কাছ থেকে শুনুন স্যার।—ওমর বললেন : ওঁর মনটা তাতে বেশ ভালো থাকে। উনি শিকার-টিকার কখনও করেননি। তবে বড়ো মহারাজার শিকারের শখ ছিল। কয়েকবার শিকার-পার্টিতে গিয়েছেন, তবে শিকার করতে নয়, গানবাজনা শুনতে।
—গানবাজনা শুনতে?
—হ্যাঁ। বড়ো মহারাজা বছরে দু-বার শিকারে বেরোতেন। একবার বেরোতেন শীতের আগে, আর একবার শীতের শেষে। শিকার কিছু হত ঠিকই, কিন্তু আসল ব্যাপার ছিল নানাপ্রদেশের ওস্তাদদের গান। এক-একটা শিকারপর্ব চলত প্রায় একমাস ধরে। মহারাজা সিং খুব ভালোমানুষ, মনটা দয়ায় ভর্তি।
আমার মনে হল বলি, দয়ায় ভর্তি না ছাই। একজনের বাড়িতে অতিথি হয়ে এসে যাবার নামটি করছেন না—এদিকে বুঝতে পারছি লাহিড়ি সাহেবও রোজ এত খরচ ঠিক মেনে নিতে পারছেন না। তিনি ভেবেছিলেন, বড়োজোর চার-পাঁচদিনের ব্যাপার, কিন্তু ক্রমশ সাতদিন কেটে গেল। লাহিড়ি সাহেব ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠতে লাগলেন। ক্লান্তি আর দূর হয় না মহারাজা সিং-এর।
এইরকম চলল কয়েকদিন। এল বড়োদিন। খুব হইচই করা হল লাহিড়ি সাহেবের বাংলোয়। কিন্তু মহারাজা সিং ঘর থেকেই বেরুলেন না সেদিন। খাবার-দাবার সব ওঁর ঘরেই পাঠিয়ে দেওয়া হল। ওমর ওসমান জানালেন,—প্রত্যেক বছর বড়োদিনের সময় মহারাজা সিং চুপচাপই থাকেন, কথা তো বলেনই না, কান্নাকাটিও করেন।
কী ব্যাপার?
ওমর ওসমান বললেন,—সেসব মহারাজা সিং-এর প্রাইভেট ব্যাপার। কাউকে তা বলেন না। মনে হয় ওইদিন কিছু একটা দুর্ঘটনা ঘটেছিল।
আমি ওমর ওসমানকে প্রশ্ন করলাম,—আপনি তো ওর বাল্যবন্ধু, আপনিও কি জানেন না ব্যাপারটা?
ওমর ওসমান বললেন,—ওরকম প্রশ্ন করবেন না। এককালে বন্ধু ছিলাম বটে কিন্তু এখন তো কেবল চাকর। তবে এটা ঠিকই, বছর কুড়ি আগে এক বড়োদিনে ওঁর জীবনের সবচেয়ে আনন্দের আর সবচেয়ে দুঃখের ঘটনা ঘটেছিল। তবে ঘটনাটা আমি নিজের চোখে দেখিনি। ওই দিন আমি ওঁর সঙ্গে ছিলাম না।
একই ঘটনা সবচেয়ে আনন্দের আর সবচেয়ে দুঃখের কী হতে পারে? মনটা ভারি কৌতূহলী হয়ে উঠল।
পরদিন দেখা গেল, মহারাজা সিং মোটামুটি বেশ হাসিখুশি আছেন। ডাইনিং রুমে চলে এলেন নিজেই শিস দিতে দিতে। বললেন,—লাহিড়ি সাহেব কাল সকালেই এখান থেকে চলে যাব। ভারি ভালো লাগল এই জায়গাটা। ইচ্ছে করছিল এখানেই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিই। যাই হোক, আজ সন্ধেয় ডিনারের পর আমি একটা গল্প বলব শিকারের। আপনিও বলবেন। সারারাত ধরে গল্প চলবে আর একটু-আধটু মদও টানব, আশা করি আপনি তাতে আপত্তি করবেন না। আমার কাছে মদের ব্যবস্থা আছে, আপনি কেবল বরফ আর সোডার ব্যবস্থা করবেন। তবে এখন বেজায় ঠান্ডা, তাই বরফ না-হলেও চলবে, তবে সোডা চাই। আপনিও যদি দু-এক চুমুক দেন তাহলে আমি খুব খুশি হব।
অনেক সময় চলে গেছে বলতে বলতে। আমার গল্প বড়ো হয়ে আসছে বলে, আরও অনেক কথা ছিল, বাদ পড়ে গেল। তাই সোজাসুজি গল্পটাই বলি—এ গল্প আমার নয়, মহারাজা সিংএর কাছ থেকে শোনা। দেখলাম গল্প বলতে পারেন বটে মহারাজা সিং।
প্রমথ চৌধুরী যে নীললোহিত সম্পর্কে লিখেছিলেন, সে যখন গল্প বলত তখন তার কেবল কথা নয়, হাবভাব ভঙ্গি, গলার বৈচিত্র্য এমন থাকত যে তা ঠিকমতো বলা অন্য কারও পক্ষে ছিল অসম্ভব। তাই তোমরা যারা আমার এই লেখা পড়ছ তাদের বলে দিই, আমার লেখা গল্পটা মহারাজা সিং-এর গল্পের চেয়ে অনেক অনেক নিরেস হবে। কিন্তু কী আর করা যাবে, প্রত্যেকের গল্প বলার ক্ষমতা তো এক নয়।
আসরটা জমেছিল ভালো। মহারাজা সিং-এর অনুরোধে চিরিমিরির দুজন তানপুরা বাদককে নিয়ে আসা হল। তাঁদের কাজ হবে পাশের ঘরে বসে একটু একটু করে বাজানো। গল্পের সঙ্গে নাকি তা খাপ খেয়ে যায়। যাই হোক মহারাজা লাহিড়ি সাহেবকে একটা শিকারের গল্প বলতে অনুরোধ করলেন।
লাহিড়ি সাহেব বলতে না-চাইলেও শেষপর্যন্ত অনুরোধ-উপরোধ এমন করতে লাগলেন মহারাজা সিং যে তিনি একটা গল্প বলতে বাধ্য হলেন। উনি যখন চিরিমিরিতে প্রথম আসেন তখন একটা মানুষখেকো বড়ো বাঘ ওই অঞ্চলে সপ্তাহে প্রায়ই একটা-দুটো করে মানুষ ধরে নিয়ে যাচ্ছিল। ফলে ওই অঞ্চলে দারুণ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। এই গল্পের শুরু, এবং দশ মিনিটের মধ্যে ওই অতবড়ো একটা বাঘকে শেষও করে দিলেন তিনি। বলাবাহুল্য টেনেটুনে ঘটনাটিকে আরও ঘন্টাখানেক করা যেত ঠিকই, কিন্তু লাহিড়ি সাহেব চান মহারাজা সিং-এর গল্প শুনতে।
তা মহারাজা সিং একটু করে গেলাস থেকে সোডা-মেশানো পানীয় চুমুক দিতে দিতে বলতে শুরু করলেন : সে অনেকদিনের ব্যাপার। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগেকার কথা…।
শুনে ওমর ওসমান বললেন,—সাব, আপনার একটু ভুল হচ্ছে, আপনার বয়সই তো এখন সবে ঊনপঞ্চাশ। পঞ্চাশ বছর আগে আপনি কোথায় ছিলেন?
—ও হ্যাঁ ভাই, ঠিক কথা বলেছ, ওই সময় আমি তো পৃথিবীই দেখিনি। তাহলে বোধহয় বছর চল্লিশ আগেকার কথা?
—না সাহেব, এই তো বছর কুড়ি হবে—উনিশ বা একুশও হতে পারে। তখন ইউরোপে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলছে।
তাই তো ওমর, তাই তো!—জিভ কেটে মহারাজা সিং ভ্রম সংশোধন করলেন। বললেন : কলকাতা থেকে ফিরছি—কলকাতার এক বন্দুকের দোকানে আমার একুশটি রাইফেল আর বাহান্নটা বন্দুক মেরামত সার্ভিস করতে দিয়ে গাড়িতে করে ফিরছি…।
ওমর ওসমান বললেন,—সাব, তিনটে রাইফেল আর দুটো বন্দুক…।
—থ্যাংক ইউ ওমর। আমার আবার স্মৃতিশক্তিটা খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে ইদানীং। তা আমার কাছে না-আছে একটা বন্দুক, না-আছে রাইফেল। আমি ফিরছি একা। সঙ্গে এক ড্রাইভার। গাড়িটা ঝাড়গ্রামে পৌঁছুল যখন, তখন দুপুর তিনটে। ভীষণ খিদে আর তেষ্টা। গাড়িতে শুকনো একগাদা বিস্কুট ছাড়া কিছু নেই। গাড়িটাও এক কীর্তি করে বসল, কথা নেই বার্তা নেই টিউবটা গেল ফেটে। ড্রাইভার যখন টিউবে পট্টি লাগাচ্ছে তখন সেই ধুধু নির্জন রাস্তায় বসে প্রায় এক পাউন্ড শুকনো বিস্কুটই আমায় খেতে হল। খেয়ে তো প্রায় দম বন্ধ হয়ে গেল।
তখন চোখে পড়ল আশেপাশে কমলাগাছের সমারোহ। বেশ কয়েকটা গাছ বেশ ছোটো আর তাতে কমলা প্রচুর। বড়ো বড়ো দেখে গোটা ত্রিশেক লেবু নিজেই তুলে গাড়িতে রাখতেই, ড্রাইভার বলল : টায়ার ঠিক হয়ে গেছে, আর হুজুর যদি বেয়াদপি মাপ করেন তাহলে আমার কাছে এক কুঁজো চমৎকার জল আছে তা পান করতে পারেন।
দেখলাম, ড্রাইভার কথাটা ঠিকই বলেছে। জল চমৎকারই ছিল। আমি ঢক ঢক করে প্রায় অর্ধেক জলই সাবাড় করে দিলাম। এরপর গাড়ি হুড়মুড়িয়ে চলল। জামশেদপুর গেল তারপর চক্রধরপুর।
ওখান থেকে গাড়িটা রাঁচির পাহাড়ি পথ ধরল। অত চমৎকার জঙ্গল দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। কিন্তু সে দেখবার মতো মনের অবস্থা ছিল না। রাত দশটার মধ্যে রাঁচি পৌঁছোতে হলে তাড়াতাড়ি করা দরকার। কিন্তু হল কই? একটা পথের বাঁকে বেশ কয়েকশো ফুট উঁচুতে গাড়িটা গেল খারাপ হয়ে। ভালো গাড়ি হলে কী হবে। ওই সময় দেশে গাড়ির পার্টস পাওয়া যেত না বলে কোনোমতে একটা কামারকে দিয়ে কাজ চালানো গোছের গড়িয়ে নেওয়া পার্টস ছিল।
ড্রাইভার বলল,—সেটা দু-টুকরো হয়ে গেছে।
মানে গাড়ি আর চলবে না। সেদিনও ছিল বড়োদিন, আর পূর্ণচন্দ্র না-হলেও আকাশে চাঁদ বেশ জ্বলজ্বল করছিল।
ড্রাইভার বলল,—জায়গাটা ভয়ের।
—কীসের ভয়?
সে গম্ভীর এবং কাঁপা গলায় বলল,—বাঘ উঘ হবে। রাস্তায় গর্জন শোনেননি?
গর্জন আবার শুনিনি।
তা আমি ভেবেছিলাম গাড়ির ইঞ্জিন থেকে আওয়াজ বেরুচ্ছে। গর্জন তখনও শুনতে পাচ্ছি। অথচ গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ। আমি বললাম,—বাঘ উঘ?
ড্রাইভার বলল,—হুজুর বাঘ উঘ!
ভয়ে তো আমার অবস্থা তখন দারুণ। ঠক ঠক করে হাত-পা গা কাঁপছে। আমি তখন গাড়ির দরজা লক করে দিয়ে সিটের তলা থেকে একটা বোতল বার করে ঢক ঢক করে খানিকটা খেয়ে একটু সাহস সঞ্চয় করলাম। ঠিক করলাম বাঘ যা করবার করুক, আমি গাড়ি ছেড়ে নামব না।
ড্রাইভারের সাহস একটু বেশি ছিল। সে বলল, তার ভীষণ তেষ্টা পেয়েছে। সে জলের কুঁজো আনতে যেই নেমেছে গাড়ি থেকে, অমনি—হঁককর হাঁ-লু-লুম! এক বিদঘুটে আওয়াজ। আর সে আওয়াজ দশ ফুট দূর থেকে হলেও আর চাঁদের আলো ফুটফুটে হলেও বাঘ কেন, একটা ইঁদুরকেও দেখতে পেলাম না। ড্রাইভারও গাড়ির মধ্যে এসে ভয়ে কাঁপতে লেগেছে। আমি তখন বললাম, —কালু ভায়া…।
আজ্ঞে মিছছরলাল।—ওমর ওসমান বললেন।
—হ্যাঁ হ্যাঁ। মনে ছিল না। কালুভায়া তো তার আগেই ম্যালেরিয়ায় মরে গেল…।
—না সাব ম্যালেরিয়া নয়, কালাজ্বরে।
—হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক ঠিক। কালাজ্বরে। তা মিছছরলালকে আমি বললাম,—তেষ্টা পেয়েছে তো আমার বোতল খাও। দশ বোতল আছে—ভাবনা নেই। তা মিছছরলালের তো কী লজ্জা—না হুজুর ওটা বলবেন না। আপনি আমার মালিক, আপনার…।
অর্থাৎ মিছছরলালের তেষ্টায় বুক ফাটবে তবু সে আমার জল খাবে না, আমার সামনে। তখন আমি বললাম,—মিছছর—এক কাজ করো একটা কমললেবু খাও। আমি একগাদা গাড়ির সিটে রেখেছি। সেগুলো সিটে তখন আর ছিল না—মেঝে থেকে কুড়িয়ে তার হাতে একটা দিলাম আর জানালার কাচ দিয়ে চারদিক দেখতে লাগলাম, আর কানে শুনতে লাগলাম বাঘের হুংকার।
মিনিট দশেক এইভাবে কেটে গেল। মিছছরের কোনো সাড়াশব্দ নেই দেখে তাকে ডাকলাম। সে তাতে সাড়া দিল না। আমি উঠে দেখি সামনের সিটে মিছছর ঘুমে অচেতন। বাপ রে কী সাংঘাতিক নার্ভ। এত বাঘের ডাকের মধ্যেও নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে। আবার অদ্ভুতভাবে নাকও ডাকছে। আবার গোঁ গোঁ আওয়াজও হচ্ছে।
এইসময় হঠাৎ দেখি মিছছরের দরজার কাচটা পুরো বন্ধ হয়নি, অর্ধেক খোলা আছে। আমি ঝুঁকে পড়ে কাচটাকে পুরো বন্ধ করতে যাচ্ছি কিন্তু কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না। তখন মনে পড়ল, খড়গপুরের পর মিছছর বলেছিল কাচটাকে রাঁচি গিয়ে ঠিক করতে হবে।
আর এই সময়েই দেখি কী সর্বনাশ—! সেই হলদে রঙের বিচ্ছিরি জানোয়ার বাঘ কিংবা উঘ! প্রায় বাইশ ফুট লম্বা…।
ন-দশ ফুট সাব! —ওমর ওসমান বললেন।
—তা হবে, কিন্তু তার হাঁ-টা প্রায় চার ফুট। তার মধ্যে দুটো ফুটবল ঢুকে পড়তে পারে।
ওমর একটু উশখুশ করলেন, কিন্তু কিছু বললেন না।
মহারাজা গেলাস থেকে একটু পানীয় গলায় ঢেলে বললেন,—ভয়ে আমি কাঠ। এদিকে মিছছর তো মনের আনন্দে নাক ডাকিয়েই চলেছে।
বাঘটা এরপর কী করল জানেন? বললে বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না। সে ওই কাচের খোলা জায়গার কাছে মুখ এনে লোভীর দৃষ্টিতে আমাদের দেখতে লাগল। একবার আমাকে দেখে আর একবার মিছছরকে। দেখে আর তার জিভ দিয়ে লালা পড়ে। আমার তখন কীরকম মনে হল। কাণ্ডজ্ঞান লোপ পেয়ে যা হয় আর কী। আমি পায়ের কাছ থেকে একটা লেবু নিয়ে বাঘের হাঁয়ের মধ্যে দিলাম গুঁজে। বাঘটা হুস করে কোথায় যে গেল কে জানে—রাস্তার দু-দিকে বিরাট ঢাল। বোধহয় গড়িয়েই পড়ল—তাকে আর দেখতে পেলাম না।
বেশ খানিকটা পর দেখি বাঘটা আবার এসেছে। সে ফের জানালার খোলা জায়গা দিয়ে মুখ ঢুকিয়েছে যেমনি, আমি তো প্রস্তুত হয়েই ছিলাম, ফের আর একটা কমলালেবু তার মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলাম। এবারেও বাঘটা গর্জন আর কীরকম ভয়ানক আর্তনাদ করে রাস্তার ঢাল দিয়ে গড়িয়ে পড়ল। ভাবলাম আপদ গেল।
কিন্তু ধৈর্য বটে বাঘটার—ফের সে এসে কাচের ফাঁক দিয়ে মুখ বাড়িয়ে গর্জন করতেই ফের তার মুখে গুঁজে দিলাম আর একটা লেবু। আমার মনে হল বাঘটা যেন লেবু খাওয়ার জন্যেই বারবার আসছে।
এর মধ্যে একটা ব্যাপার হল। চাঁদটা এতক্ষণ ছিল, এবারে একটা কালো মতো মেঘ এসে সেটাকে ঢেকে দিল। কিন্তু তাতে কি হয়েছে—বাঘটা সাতবার ওই ভাবে এল, আর লেবু খেয়ে বিকট গর্জন করতে করতে গড়িয়ে গেল।
—সাতবার নয় সাব ষোলোবার!
—তা হবে। আমার তো মনে কিছুই আর থাকছে না আজকাল। তা একুশবারই হবে তাহলে।
—একুশবার নয়, ষোলোবার।
—ও ঠিক আছে। ষোলোও যা একুশও তা। তারপর শুনুন একটা আশ্চর্য কাণ্ড ঘটল।
আশ্চর্য কাণ্ডটা কী?—লাহিড়ি সাহেব প্রশ্ন করলেন।
—সকাল হল। আর বাঘটা এল না। ওদের রীতি অনুযায়ী ওরা দিনের বেলায় ঘুমোয়। জানেন তো বাঘের স্বভাব অনেকটা আমার মতো।
—কেমন?
—বাঘেরা ঘুমোতে পেলে আর কিছু চায় না।
যাই হোক বাঘটা বোধহয় ঘুমোতে গেল। আর তর্জন নেই গর্জন নেই। তবু আমার ভয় যায় না। আমি গাড়িতে বসে কেবল বোতল থেকে একটু একটু খাচ্ছি। মনটাও ঘোলাটে হয়ে আসছে আমার। একটু তন্দ্রার মতো এসেছে—পরক্ষণে দেখি আমার চারদিকে ঘিরে ফেলেছে এক দঙ্গল লোক।
তাঁরা মাদল বাজাচ্ছে, গান গাইছে—আর আমার জন্যে কত কী সব উপহার এনেছে। ডজনে ডজনে মুরগি, ভেড়া, পাঁঠা, ফুলকপি, আলু, টোম্যাটো। বুঝতে পারলাম আমি একটা অসম সাহসিক কিছু করেছি বলে তাদের মনে হয়েছে। তারা আমাকে গাড়ি থেকে বার করে নিল। বড়ো পালকির মতো কি একটায় চড়াল। প্রচুর মালা দিল আমার গলায় পরিয়ে।
আমি তো লজ্জায় জবুথবু। এদিকে তারা মিছছরকে ডেকে তুলতে পারছে না। ব্যাটা দারুণ ঘুমোচ্ছে যে! পরে বুঝলাম ব্যাপারটা। ওই সেই লেবু। ঝাড়গ্রামের পরে যে লেবু আমি সংগ্রহ করেছিলাম, তারই একটায় কামড় দিয়ে একটু রস টেনেছে সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান। অত টকলেবু পৃথিবীতেই হয় না। সে তো আর আমি জানি না। আমি তো ভালো লেবু মনে করেই সেগুলোকে তুলেছিলাম গাড়িতে। আর তখন মনে হল তাহলে বাঘটা আমার লেবুগুলো খেয়েই বোধহয় অক্কা পেয়েছে।
লাহিড়ি সাহেব আপনি বললে হয়তো বিশ্বাস করবেন না, আমারই মাঝে মাঝে বিশ্বাস হয় না। আমি দেখি কী ওরা আমাকে একটা জায়গায় নিয়ে গিয়ে একটা সিংহাসনে বসিয়ে আমাকে তাদের মহারাজ বলে বরণ করে নিল। এটা হচ্ছে কী সম্মানসূচক মহারাজাত্ব। তাও কম নয়। এরকম ভাগ্য দশ-পঁচিশ বছরে মাত্র দু-একজনের ঘটে। সেখানে প্রচুর লোক—প্রচুর লোক। প্রচুর বাদ্য, প্রচুর খাদ্য, প্রচুর ফুল।
আর সামনে মাঠের মধ্যে সার দিয়ে শুয়ে আছে ষোলোটা বাঘ। সব অজ্ঞান হয়ে আছে। একটা নয় লাহিড়ি সাহেব, একটা নয়—সারারাত ধরে আমি ষোলোটা বাঘকে ওই লেবু দিয়ে ঘায়েল করেছি। কী ওমর ভাই এবারে হিসেবটা ঠিক বলেছি তো?
ওমর ওসমান বললেন,—একেবারে যথার্থ হিসেব, কোনো ভুল নেই।
গল্প করতে করতে ভোর হয়ে এল। মহারাজা সিং বললেন,—এই ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন। কেননা আমি একদিনে ষোলোটা বাঘ মেরেছিলাম। আবার সবচেয়ে দুঃখেরও দিন, কেননা ওই ষোলোটা বাঘের একটাও মরেনি। অজ্ঞান হয়েছিল মাত্র। শুনেছি বিকেলের দিকে ওদের জ্ঞান হবার পর সব জঙ্গলে পালিয়ে গিয়েছিল—কেউ তাদের মারতেও পারেনি, ধরতেও পারেনি। গ্রামের দেড় হাজার লোকই তখন মদ খেয়ে আনন্দে বেহুঁশ হয়ে পড়েছিল। তবে শুনেছি বাঘেরা সেদিনই ওই মুলুক ছেড়ে পালিয়েছিল।
গল্প শেষ হল। কিন্তু সেদিন লাহিড়ি সাহেব মহারাজা সিংকে ছাড়লেন না। আরও গল্প শোনার জন্য তিন সপ্তাহ জোর করে রেখে দিলেন। ওমর ওসমানও রয়ে গেলেন। আর যাওয়ার সময় মহারাজা সিং লাহিড়ি সাহেবকে একটা হিরের আংটি উপহার দিয়ে গেলেন। সেরকম আংটির জোড়া পৃথিবীতেই ছিল না তখন, আর এখন তো নেই-ই। পরে কখনও গুছিয়ে বলবার ইচ্ছে রইল। কিন্তু আমার মুশকিল এই যে গুছিয়ে ঠিকমতো বলতে পারি না!