মহারাজা নবকৃষ্ণ দেব বাহাদুর
শোভাবাজার রাজপরিবারের প্রবর্তনকারী মহারাজা নবকৃষ্ণ প্রথমাবধি উচ্চমনের পরিচয় দিয়েছেন। অল্প বয়সেই তিনি ফার্সী ভাষায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন; কিছু ইংরেজিও শিখেছিলেন। মুর্শিদাবাদে তিনি তাঁর শিক্ষা সমাপ্ত করেন। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ওয়ারেন হেস্টিংসের বিচারের সময়, নবকৃষ্ণ সম্পর্কে লর্ড থারলো বলেন, ‘সেই ১৭৫০-এ তিনি ছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংসের ফার্সী ভাষার গুরু তখন তাঁরা দুজনেই ছিলেন যুবাবয়সী।
এর ছ’বছর পরের কথা। মুর্শিদাবাদের কয়েকজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি মিঃ ড্রেকের কাছে ফার্সী ভাষায় একটি চিঠি লেখেন। নবকৃষ্ণ বিশেষ দক্ষতার সঙ্গে ইংরেজিতে এই পত্রের অর্থও ব্যাখ্যা করে দেন; তার উত্তরও তিনি ফার্সীতে লিখে দেন সমান দক্ষতার সঙ্গে। তাঁর কাজে সন্তুষ্ট হয় অনারেবল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাঁকে মুন্সি পদে নিয়োগ করেন।
এইভাবে শুরু হয় নবকৃষ্ণের মুন্সীগিরি। এই কাজে তিনি এমন দক্ষতার পরিচয় দেন, যে কর্নেল ক্লাইভ তাঁকে বহু গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক কাজ দিতে থাকলেন; কাজটা দাঁড়াল (স্বাধীন সরকারের) বিদেশ সচিবের সমতুল। কলকাতার ওপর দ্বিতীয় আক্রমণ করার উদ্দেশ্য নিয়ে সিরাজ-উদ্-দৌলা তখন হালসি বাগে ছাউনি ফেলেছেন; বহু উপঢৌকন দিয়ে তাঁর কাছে নবকৃষ্ণকে পাঠান হল। নবাবের ছাউনির সব খবর নিয়ে নবকৃষ্ণ ফিরে এলেন; মীর জাফর ও কর্নেল ক্লাইভের মধ্যে সম্পাদিত ষড়যন্ত্রের, যার ফলে সিরাজ-উদ্-দৌলা ধ্বংস হয়ে যান, মাধ্যম ছিলেন নবকৃষ্ণ; তাঁদের (মীর জাফর ও কর্নেল ক্লাইভের) মধ্যে সুবেদারীর শর্তসমূহ নবকৃষ্ণের মাধ্যমেই স্থিরীকৃত হয়। মীর কাশিমের সঙ্গে কোম্পানির যুদ্ধ বাধলে নবকৃষ্ণ মেজর অ্যাডামসের সহকারী হন; এবং অ্যাডামসের প্রয়োজনীয় বহু কাজ করে দেন; কিন্তু লুটেরা নবাবী ফৌজের হাত থেকে কোন প্রকারে রক্ষা পেয়ে যান; তখন মেজরকে নিরাপদে কলকাতা নিয়ে আসার দায়িত্ব পড়ে তাঁর ওপর; কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রেই তিনি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। বাদশাহ শাহ আলম ও অযোধ্যার নবাব সুজা-উদ্-দৌলার সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনের ব্যাপারেও তাঁকে নিয়োগ করা হয়েছিল। বারাণসীর মহারাজা বলবন্ত সিংহ এবং বিহারের সিতাব রায়ের সঙ্গে বন্দোবস্তের ব্যাপারেও তাঁর হাত ছিল। এরপর তাঁকে নাবালক বর্ধমানের রাজ তেজচন্দ্র বাহাদুরের অভিভাবক এবং তাঁর বিস্তৃত জমিদারীর কমিশনার নিয়োগ করা হয়। তাঁর সুপরিচালনায় ওই জমিদারী বিশৃঙ্খলা ও ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায়। ১৭৭৫-এ লর্ড ক্লাইভের সঙ্গে নবকৃষ্ণ এলাহাবাদ গেলে বাদশাহ্ শাহ আলম তাঁকে তিন হাজার সওয়ার ‘পঞ্চহাজারী মনসব’ (দারের) মর্যাদা এবং তার সঙ্গে ‘পাল্কী ঝালরদার, টোগ, নখারা’ প্রভৃতি ব্যবহারের অনুমতি দান করেন।
তাঁর কাছে কোম্পানি যে মূল্যবান সেবা ও উপকার পেয়েছিলেন তার জন্য এবং আর্কটের নবাবের কাছে তাঁর উচ্চ বংশের পরিচয় পেয়ে মহামান্য বাদশাহ্ আলমের কাছ থেকে তাঁর জন্য চার হাজার সওয়ারীর অধিকারী, ‘মনসব যষহাজারীৎ’ ও মহারাজা বাহাদুর খেতাব পাইয়ে দেন। এছাড়া তাঁর মহামূল্যবান সেবার কথা ফার্সীতে খোদাই করে তাঁকে একটি সোনার পদক উপহার দেন; এছাড়াও লর্ড ক্লাইভ তাঁকে সাম্মানিক পোশাক, হীরে, জহরৎ, তরবারী, ঘোড়া, হাতি প্রভৃতি উপহার দেন; আর তাঁর তোরণদ্বার পাহারা দেবার জন্য উপযুক্ত সংখ্যক সিপাহীর বন্দোবস্ত করেন। তাঁকে খেলাৎ দান অনুষ্ঠানের শেষে লর্ড ক্লাইভ তাঁকে স্বয়ং হাতির হাওদা পর্যন্ত নিয়ে যান; অনুষ্ঠানটির পর মহা আড়ম্বরপূর্ণ এক শোভাযাত্রা করে তাঁকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হয়।
তাঁর মূল্যবান সেবার পুরস্কার স্বরূপ ১৭৭৮-এ ওয়ারেন হেস্টিংস তাঁকে সুতানুটির চিরস্থায়ী তালুকদারী অর্পণ করেন; (বর্তমানকালে তার সীমানা : উত্তরে মারাঠা খাল, দক্ষিণে টাকশাল, পশ্চিমে হুগলী নদী ও পূর্বে সার্কুলার রোড); ফলে কলকাতা প্রশাসনের মধ্যে তিনি অনারেবল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একমাত্র পার্শ্ববর্তী তালুকদার হলেন। সূতানুটির তালুকদারী এইভাবে হস্তান্তর করার বিরুদ্ধে শহরের সকল ধনী ও বিশিষ্ট অধিবাসী প্রতিবাদ করলে তাঁদের নির্দেশ দেওয়া হয় যে, কোম্পানি যে-সকল সুযোগ সুবিধা ও অধিকার ভোগ করতেন, মহারাজকে এখন সেই সকল সুযোগ সুবিধা ও অধিকার ভোগের ক্ষমতা কোম্পানি তাঁকে দান করছেন; কাজেই সকলে যেন তাঁকে কোম্পানির স্থানাপন্ন প্রকৃত তালুকদার রূপে মান্য করেন।
মহারাজা কোম্পানি সরকারে যে সকল আধিকারিক পদ অলঙ্কৃত করেন সেগুলি হল : মুন্সী দর (ফার্সি সচিবের অফিস), আর্জবেগী দফতর (আবেদনপত্র গ্রহণের অফিস), জাতিমালা কাছারী (জাতপাত সম্পর্কিত মামলার শুনানী ও নিষ্পত্তি করার আদালত); ‘বিত্তশালা’ কোম্পানির তোষাখানা; সে যুগে নাম ছিল ‘দি মণি গোদাম’, ‘মাল আদালত’ (২৪ পরগণার দেওয়ানী বা অর্থসংক্রান্ত আদালত) ও তশিল দফতর (২৪ পরগণার কালেক্টরি)। এই সকল দপ্তর পরিচালিত হত শোভাবাজার রাজবাড়ির বিভিন্ন অট্টালিকায় (এই এলাকার আগের নাম ছিল ‘পাবনার বাগান’)। এই সকল অট্টালিকার মধ্যে রাজা নবকৃষ্ণ স্ট্রিটের উত্তর দিকে অবস্থিত পুরাতন রাজবাটী নামে পরিচিত হর্ম্যটি রাজা রাধাকান্ত দেব বাহাদুরের অন্যান্য বংশধরসহ রাজা রাজেন্দ্রনারায়ণের অধিকার আছে; আর উক্ত পথের দক্ষিণের হর্মগুলি আছে রাজা রাজকৃষ্ণ দেব বাহাদুরের বংশধরগণের অধিকার। পুরাতন রাজবাটীর দেওয়ানকানাটি মহারাজা নির্মাণ করেছিলেন পলাশী যুদ্ধে বিজয়ের স্মারকরূপে; এই অট্টালিকার উদ্বোধন উৎসবে স্বয়ং লর্ড ক্লাইভ উপস্থিত ছিলেন।
রাজা নবকৃষ্ণ ছিলেন বিদ্যোৎসাহী। তাঁর ভবনে বঙ্গদেশ ও পশ্চিমী প্রদেশসমূহের ব্রাহ্মণ পন্ডিতদের প্রায়ই আগমন ঘটত। তাঁর সভার অলঙ্কার ছিলেন সে যুগের প্রখ্যাত পন্ডিত জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন ও বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার। দুর্লভ সংস্কৃত ও ফার্সী পুঁথি সংগ্রহে উদারহস্তে তিনি অর্থব্যয় করতেন। সুন্দর হস্তাক্ষর বিশিষ্ট পন্ডিতদের দিয়ে সংগৃহীত পুঁতিগুলি নকল করিয়ে রাখতেন। তাঁর উত্তরাধিকারিগণ সূত্রে যে সব সম্পদ লাভ করেছিলেন, তার মধ্যে তাঁর এই গ্রন্থাগারটিই বোধ হয় সর্বাপেক্ষা মূল্যবান।
পুরাতন সমাধিস্থল ও সেন্ট জন গীর্জার জমি তাঁরই দান; বেহালা থেকে কুলপি পর্যন্ত তিনি একটি রাস্তা নির্মাণ করিয়েছিলেন– এটি ‘রাজার জাঙ্গাল’ নামে পরিচিত। পুরাতন ও নূতন রাজবাড়ির মধ্যে তিনি আর একটা রাস্তা নির্মাণ করিয়েছিলেন–তাঁরই নামানুসারে এর নামকরণ হয়েছে রাজা নবকৃষ্ণ স্ট্রিট।
গভর্নর ভেরেলেস্ট তাঁর ‘ভিউ অব বেঙ্গল’ গ্রন্থে সরকারি আধিকারিকরূপে রাজার দক্ষতার উচ্চ প্রশংসা করে লিখেছেন, ‘নবকৃষ্ণ ভারতীয় হিন্দু; মীরজাফরকে সুবাদার পদে উন্নীত করার পূর্ববর্তী অশান্তিময় সময়ে তিনি ইংরেজদের স্বার্থ রক্ষার বিষয়ে বিশেষ উৎসাহী ছিলেন। মীর ‘কসিম’-এর সঙ্গে যুদ্ধ বাধলে নবকৃষ্ণ মেজর অ্যাডামসের সঙ্গে থাকেন; প্রদেশসমূহ থেকে মীর ‘কসিম’ বিতাড়িত না হওয়া পর্যন্ত তিনি (নবকৃষ্ণ) মেজরের সহচর হয়ে ছিলেন। ইংরেজদের প্রতি তাঁর সেবা ও শ্রদ্ধার জন্য তিনি লর্ড ক্লাইভের মনোযোগ আকৃষ্ট করায় তিনি নবকৃষ্ণকে কমিটির ‘বেনিয়ান’ করেন (অর্থাৎ, দেশীয় রাজন্যবর্গের সঙ্গে কোম্পানির রাজনৈতিক আলাপ আলোচনার জন্য তাঁকে কোম্পানির এজেন্ট বা প্রতিনিধি করা হয়)। ভেরেলেস্টের কার্যকালে, অর্থাৎ তিন বছর, তিনি এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
লর্ড মার্লোর বর্ণনানুযায়ী, ‘ওয়ারেন হেস্টিংসের শাসনকালে বেতন ও রাজনৈতিক প্রভাবের দিক থেকে তাঁর (নবকৃষ্ণের) স্থান ছিল মহম্মদ রেজা খাঁর পরেই।
১৭৭৪ থেকে ১৭৯৩ পর্যন্ত সময়কালে ইংল্যান্ড থেকে লেডি ক্লাইভ, জন নট এবং স্ট্র্যাচি পরিবার মহারাজাকে যে সব চিঠি লেখেন, সেগুলি থেকে ইংরেজ স্বার্থ রক্ষায় তাঁর দক্ষ সেবা, তাঁর প্রভাব এবং নিঃস্বার্থ শ্রদ্ধা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
পুত্রসন্তান না থাকায়, মহারাজা তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ‘রায়’ রামসুন্দর দেবের পুত্র গোপীমোহনকে দত্তকরূপে গ্রহণ করেন; পরবর্তীকালে তাঁর একটি পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করে। ইনিই রাজা রাজকৃষ্ণ বাহাদুর নামে পরিচিত। শোভাবাজার রাজ পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা মহারাজ নবকৃষ্ণ ১৭৯৭-এর ২২ নভেম্বর পরলোক গমন করেন। সুপ্রীম কোর্টে পর্যন্ত দীর্ঘ শরিকানা মামলা লড়ে তাঁর দুই পুত্র পোপীমোহন ও রাজকৃষ্ণ ঐ রাজকীয় সম্পত্তির সমান সমান অংশ লাভ করেন। পুরাতন রাজবাড়ি পেলেন গোপীমোহন এবং নূতন রাজবাড়ি পেলেন রাজকৃষ্ণ। এইভাবে, গোপীমোহনের বংশধরগণ হলেন বড় তরফ, আর রাজকৃষ্ণের বংশধরগণ হলেন ছোট তরফ। রাজা রাজকৃষ্ণের পুত্রদের মধ্যে এখন জীবিত আছেন মহারাজা কমলকৃষ্ণ ও মহারাজা নরেন্দ্রকৃষ্ণ।