মহারাজা তারিণীখুড়ো

মহারাজা তারিণীখুড়ো

‘আজ আপনার কপালে ভ্রূকুটি কেন খুড়ো?’ জিগ্যেস করল ন্যাপলা। এটা অবিশ্যি আমিও লক্ষ করেছিলাম। খুড়ো তক্তপোষের উপর বাবু হয়ে বসে ডান হাতটা পায়ের পাতায় রেখে অল্প অল্প দুলছেন, তাঁর কপালে ভাঁজ।

খুড়ো বললেন, ‘এই বাদলার সন্ধ্যায় গরম চা যতক্ষণ না পেটে পড়চে ততক্ষণ ভ্রূকুটি থাকতে বাধ্য।’

খুড়ো আসার সঙ্গে সঙ্গেই চা অর্ডার দেওয়া হয়েছে, বেশি দেরিও হয়নি, তাও আমি আরেকবার চাকরের নাম ধরে হাঁক দিলাম।

‘আপনার গল্প ফাঁদা হয়ে গেছে?’ ন্যাপলা জিগ্যেস করল। সত্যি, ওর সাহসের অন্ত নেই।

‘গল্প আমি ফাঁদি না’, দাঁত খিচিয়ে বললেন খুড়ো। ‘আমার অভিজ্ঞতার স্টক অঢেল। সে ফুরোতে-ফুরোতে তোদের গোঁফ-দাড়ি গজিয়ে যাবে।’

চা এল। খুড়ো একটা সশব্দ চুমুক দিয়ে বললেন, ‘এক দিন কা সুলতানের গল্প তোরা হয়ত শুনেছিস। সেটা ঘটেছিল হুমায়ুনের যুগে। সেরকম আমাকে পাঁচ দিনের মহারাজা হতে হয়েছিল একটা নেটিভ স্টেটে, সে গল্প তোদের বলেছি কি?’

আমরা সকলে একসঙ্গে না বলে উঠলাম।

‘আপনাকে সিংহাসনে বসতে হয়েছিল?’ ন্যাপলা জিগ্যেস করল।

‘আজ্ঞে না’, বললেন খুড়ো। ‘নাইনটীন সিকসটি ফোরের ঘটনা। তখন রাজারা আর সিংহাসনে বসে না; ভারত অনেকদিন হল স্বাধীন হয়ে গেছে। তবে রাজা গুলাব সিং-এর তখনো খুব খাতির। রাজ্যের সব লোকেরা তাঁকে মহারাজ বলে সম্বোধন করে। যাকগে—গল্পটা বলি শোন্।’

খুড়ো কাপে আরেকটা চুমুক দিয়ে তাঁর গল্প শুরু করলেন :

আমি তখন ব্যাঙ্গালোরে। মাদ্রাজে দুবছর একটা হোটেলের ম্যানেজারি করে আবার ভবঘুরে। সেই সময় একদিন খবরের কাগজে একটা বিজ্ঞাপন চোখে পড়ল। অদ্ভুত বিজ্ঞাপন; ঠিক তেমনটি আর কখনো চোখে পড়েছে বলে মনে পড়ে না। বিজ্ঞাপনের মাথায় একজন লোকের ছবি। তার নিচে বড় হরফে লেখা ‘১০,০০০ টাকা পুরস্কার!’ তারপর ছোট হরফে লিখছে যে ছবির চেহারার সঙ্গে আদল আছে এমন লোক যদি কেউ থাকে, সে যেন নিম্নলিখিত ঠিকানায় অ্যাপ্লাই করে তার নিজের ছবি সমেত। যাদের চেহারা মিলবে তাদের ইন্টারভিউতে ডাকা হবে। ঠিকানা হল ভার্গব রাও, দেওয়ান, মন্দোর স্টেট, মাইসোর। মন্দোর নামে যে একটা নেটিভ স্টেট আছে সেটা টক্‌ করে মনে পড়ে গেল। কিন্তু বিজ্ঞাপনে যাঁর ছবি রয়েছে তিনি যে কে সেটা বুঝতে পারলুম না। নাইবা বুঝি; এটুকু বুঝি যে এই চেহারার সঙ্গে আমার নিজের চেহারার বিলক্ষণ মিল। আমি যদি আমার গোঁফটাকে একটু সরু করে ছাঁটি তাহলে দুই চেহারায় তফাত করা মুশকিল হবে।

গোঁফ ছেঁটে ভিক্টোরিয়া ফোটো স্টোর্সে গিয়ে একটা পাসপোর্ট সাইজের ছবি তুলিয়ে অ্যাপ্লাই করে দিলুম। দশ হাজার টাকার লোভ সামলানো কি সহজ কথা?

সাতদিনের মধ্যে উত্তর এসেছিল। ইন্টারভিউ-এর জন্য ডাক পড়েছে। যাতায়াতের খরচ বিজ্ঞান দাতারাই দেবেন, বোর্ড অ্যান্ড লজিংও তাঁদের দায়িত্ব, আমি যেন অবিলম্বে মন্দোর রওনা দিই। এও বলা ছিল, চিঠিতে যে, আমি যেন সঙ্গে দিন দশেকের মতো জামাকাপড় নিয়ে নিই।

পরের দিনই একটা টেলিগ্রাম ছেড়ে দিয়ে রওনা দিয়ে দিলুম। হুবলি ছাড়িয়ে দুটো স্টেশন পরেই মন্দোর, আমার জন্য স্টেশনে লোক থাকার কথা। অনেকখানি রাস্তা, ভাবতে ভাবতে গেলুম এ বিজ্ঞাপনের কী মানে হতে পারে। যে ভদ্রলোকের ছবিটা দেওয়া হয়েছিল বিজ্ঞাপনে তিনি যে সম্ভ্রান্ত বংশের লোক তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু তাঁর জোড়া কেন দরকার হবে তা আমার মাথায় ঢুকল না।

মন্দোর স্টেশনে স্যুটকেস নিয়ে নেমে এদিক ওদিক দেখছি, এমন সময় এক বছর ষাটেকের ভদ্রলোক আমার দিকে এগিয়ে এলেন।

‘ইউ আর মিস্টার ব্যানার্জি?’ আমার দিকে ডান হাত বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন ভদ্রলোক। তিনি যে রীতিমতো অবাক হয়েছেন সেটা আর বলে দিতে হয় না।

আমি বললুম, ‘হ্যাঁ, আমিই মিস্টার ব্যানার্জি।’

‘আমার নাম ভার্গব রাও’, বললেন ভদ্রলোক। ‘আমি মন্দোরের দেওয়ান। আমাদের বিশেষ সৌভাগ্য যে আপনার মতো একজন ক্যানডিডেট পেয়েছি।’

‘কিসের ক্যানডিডেট?’

‘আগে গাড়িতে উঠুন। পথে যেতে যেতে সব কথা হবে। আমাদের এখন রাজবাড়ি যেতে হবে, এখান থেকে সাত কিলোমিটার। পথে আপনার সব প্রশ্নের জবাব দিতে পারব বলে বিশ্বাস করি।’

একটা পুরোনো মডেলের সুপ্রশস্ত আর্মস্ট্রং সিডনি গাড়িতে গিয়ে উঠলুম। দেওয়ান সাহেব পিছনে আমার পাশেই বসলেন। জানালা দিয়ে দেখছি দূরে পাহাড়ের লাইন—ভারি মনোরম দৃশ্য।

গাড়ি রওনা হবার পর দেওয়ান রহস্য উদ্ঘাটন করতে শুরু করলেন।

‘মিস্টার ব্যানার্জি, আমাদের এখানে হঠাৎ একটা দুর্ঘটনা ঘটায় একটা জটিল পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। আমাদের মহারাজা গুলাব সিং-এর হঠাৎ মস্তিষ্কের বিকার দেখা দিয়েছে। হাসপাতালে চিকিৎসা চলেছে, মাইসোর থেকে বড় ডাক্তার এসেছেন, কিন্তু খুব শিগ্‌গির আরোগ্যের কোনো সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। অথচ আর তিন দিনের মধ্যে মহারাজার কাছে এক অতি সম্মানিত গেস্ট আসছেন আমেরিকা থেকে—ক্রোড়পতি মিস্টার অস্কার হোরেনস্টাইন। উনি প্রাচীন শিল্পদ্রব্য সংগ্রহ করেন এবং তার পিছনে লাখ লাখ ডলার খরচ করেছেন। আমাদের রাজারও সংগ্রহে অনেক পুরোন জিনিস আছে। তাঁর ইচ্ছা ছিল হোরেনস্টাইনকে কিছু জিনিস বিক্রি করা। তার একটা কারণ অবশ্য এই যে, আমাদের তহবিলে অর্থাভাব দেখা দিয়েছে বেশ কিছুদিন থেকেই। আমাদের কম্পাউন্ডে ছোটবড় মাঝারি প্রায় গোটা ছ’য়েক প্রাসাদ রয়েছে, রাজা তাদের মধ্যে একটিকে হোটেলে পরিণত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মন্দোরে দেখবার জিনিসের অভাব নেই। লেক আছে, পাহাড় আছে, জঙ্গলে বাঘ হাতি হরিণ আছে; তাছাড়া এখানকার আবহাওয়া স্বাস্থ্যকর। ঠিক মতো বিজ্ঞাপন দিলে হোটেলের ব্যবসা মার খাবে বলে মনে হয় না। কিন্তু তার আগে কিছু নগদ টাকা পাবার সম্ভাবনা ছিল এই হোরেনস্টাইনের কাছে। সেই জন্য তাঁকে আর আমরা আসতে বারণ করিনি, বা রাজার অসুখের কথা বলিনি। বুঝতেই পারছেন—’

বুঝতে আমি পেরেইছিলাম। বললাম, ‘তার মানে খবরের কাগজের ছবিটা ছিল রাজার ছবি, আর আমাকে কিছুদিনের জন্য রাজার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে।’

‘শুধু যে কদিন হোরেনস্টাইন থাকবেন সেই কদিন।’

‘হোরেনস্টাইনের সঙ্গে রাজার আলাপ হয় কোথায়?’

‘আমেরিকায়, মিনিয়াপোলিস শহরে। সেখানে রাজা বেড়াতে গিয়েছিলেন মার্চ মাসে। রাজার একমাত্র ছেলে মহীপাল সেখানে ডাক্তারি করে। মিনিয়াপোলিসে থাকতে একটা পার্টিতে রাজার সঙ্গে হোরেনস্টাইনের আলাপ হয়। সেখানেই রাজা তাকে আমন্ত্রণ জানান। হোরেনস্টাইনের শিকারের শখও আছে, কাজেই একদিন শিকারের বন্দোবস্তও করতে হবে। আপনি গুলি চালাতে পারেন?’

আমি বললাম, ‘বিলক্ষণ, যদিও শিকার করিনি প্রায় দশ বারো বছর।’

‘এ শিকার হাতির পিঠ থেকে, কাজেই অপেক্ষাকৃত নিরাপদ।’

‘আপনি যে রাজার সংগ্রহের কথা বলছিলেন, এগুলো কী ধরনের জিনিস?’

‘বেশির ভাগই অস্ত্রশস্ত্র। ছোরা, ঢাল, তলোয়ার, পিস্তল—এসব প্রচুর আছে এবং দেখলেই বুঝতে পারবেন সেগুলো কত মূল্যবান। এ ছাড়া প্রসাধনের জিনিসপত্র, আতরদান, আলবোলা, ছবি, ফুলদানি এসবও আছে। আমার মনে হয় না আপনাকে বেশি পীড়াপীড়ি করতে হবে। সাহেবের কথা যা শুনলাম, তাতে তিনি নিজেই কিনতে আগ্রহী হবেন। ইনি আসবেন বলে রাজা একটা দামের তালিকাও করে রেখেছিলেন, সেটাও আপনাকে দিয়ে দেব।’

দেওয়ানের সঙ্গে কথা বলে সমস্ত ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম। আমাকে সাজতে হবে পাঁচ দিন কা সুলতান। তারপর আবার যেই কে সেই। অবিশ্যি পারিশ্রমিকের কথাটা ভুললে চলবে না। তখনকার দিনে দশ হাজার টাকার ভ্যালু এখনকার চেয়ে পাঁচগুণ বেশি।

রাজবাড়ির বিশাল ফটক দিয়ে যখন গাড়ি ঢুকছে, তখন বুকের ভিতরে বেশ একটা দুরু দুরু অনুভব করছিলুম, কিন্তু সত্যি বলতে কি নার্ভাস একটুও হইনি। গাড়িতে দেওয়ান বার তিনেক আমার দিকে চেয়ে চেয়ে দেখে বললেন, ‘আমি স্বপ্নেও ভাবিনি যে, আমাদের বিজ্ঞাপনের উত্তরে আমরা রাজার এমন একজন জোড়া পেয়ে যাব। আমি ধরেই নিয়েছিলাম আমাদের অতিথিকে জানিয়ে দিতে হবে তিনি যেন না আসেন। এখন দেখছি সাপও মরল, লাঠিও ভাঙল না।’

সাহেব আসবেন বুধবার, আজ রবিবার। এই তিন দিন আমার কাজ হচ্ছে রাজার ডায়রি পড়া। আর টেপ রেকর্ডারে রাজার কণ্ঠস্বর শোনা। গোটা তিনেক ইংরিজি বক্তৃতার টেপ করা আছে। দেওয়ান সেগুলো আমার জিম্মায় দিয়ে দিলেন আর সেই সঙ্গে চামড়ায় বাঁধানো গত দশ বছরের ডায়রি। ডায়রিগুলো উলটে পালটে দেখলুম। ইংরিজিতে লেখা, এবং বেশ চোস্ত ইংরিজি। নানান খুঁটিনাটির খবর রয়েছে তাতে। রাজা যখন ঘুম থেকে ওঠেন, কী ব্যায়াম করেন, কী খেতে ভালোবাসেন, কী পরতে ভালোবাসেন, সংগীতে রাজার রুচি নেই—এই সবই ডায়রি থেকে জানা যায়।

রাজার স্ত্রী মারা যান বছর তিনেক আগে। তাতে তিনি সাময়িক ভাবে কী রকম ভেঙে পড়েছিলেন—মৃত্যুর পর পনেরো দিন ডায়রির পাতা ফাঁকা—সে সবও খবর আমার খুব কাজে দিল।

তিন দিনের শেষে আমি দেওয়ানকে বললাম আমি একদম তৈরি। এছাড়া আরেকটা কথা আমি দুদিন থেকে বলব বলব করছিলাম, সেটা আজ বলে দিলাম।

‘দেওয়ানজি, ব্যবস্থা সবই ভালো, কিন্তু আমার দ্বারা ওই রাজশয্যায় শোওয়া চলবে না। অত নরম বিছানায় শোয়া আমার অভ্যেস নেই। ওতে ঘুমের ব্যাঘাত হয়।’

‘তাহলে আপনি থাকবেন কোথায়?’ জিগ্যেস করলেন দেওয়ানজি।

আমি বললাম, ‘কেন আপনার এখানে তো অনেক ছোট ছোট প্রাসাদ রয়েছে—লালকোঠি, পিলাকোঠি, সফেদকোঠি—এর একটাতে থাকা যায় না?’

‘তা অবিশ্যি যায়’, দেওয়ান চিন্তিত ভাবে বললেন, ‘এক দিক দিয়ে লালকোঠিতে থাকার খুব সুবিধে। একটা চমৎকার শোবার ঘর আছে, যেখানে মহারাজার বাপ মাঝে মাঝে থাকতেন। শত্রুঘ্ন সিং এক বাড়িতে বেশিদিন থাকা পছন্দ করতেন না। তাঁর জন্য নানারকম ছোট ছোট বাসস্থান বানানো হয়েছিল।’

‘বেশ ত, সেই লালকোঠিতেই থাকব।’

‘থাকবেন?’

‘কেন, অসুবিধাটি কী?’

‘একটা ব্যাপার আছে।’

‘কী ব্যাপার?’

‘বছর পঞ্চাশেক বয়সে শত্রুঘ্ন সিং-এর মাথা খারাপ হয়ে যায়; উনি নিজের মাথায় রিভলভার মেরে আত্মহত্যা করেন এবং সেটা করেন ওই লালকোঠির শোবার ঘরেই।’

‘আপনার ধারণা তাঁর প্রেতাত্মা বাস করেন ওই ঘরে?’

‘সে ত জানি না। তাঁর মৃত্যুর পর ও ঘরে আর কেউ থাকেনি।’

‘তাহলে ওই ঘরে আমি থাকব। এই অভিজ্ঞতার সুযোগ ছাড়া যায় না। আমি অনেক ভূত দেখেছি তাই আমার ভূতের ভয় নেই। আর বিছানাটা যেন অত নরম না হয়।’

দেওয়ান রাজি হয়ে গেলেন। অবিশ্যি অবাকও কম হননি। একজন বাঙালির যে এত সাহস থাকতে পারে সেটা বোধহয় উনি ভাবতে পারেননি।

সেদিনই বিকেলে সাহেব এসে পড়লেন। বয়স আন্দাজ পঞ্চাশ, আমার চেয়েও ইঞ্চি তিনেক লম্বা, মুখের সব মাংস যেন থুতনিতে গিয়ে জমা হয়েছে, নীল চোখে সোনালি চশমা, মাথায় কাঁচা পাকা মেশানো চুল মাঝখানে সিঁথি করে ব্যাকব্রাশ করা।

সাহেব আসা মাত্র অবিশ্যি আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করিনি। দেওয়ানজি বললেন, ‘লোকটা আগে সফেদকোঠিতে নিজের ঘরে গিয়ে উঠুক, তারপর কিছুটা সময় দিয়ে ওঁকে আপনার কাছে নিয়ে আসব। নইলে প্রেস্টিজ থাকে না। তবে হ্যাঁ, একটা কথা বলে রাখি—সাহেব মনে হল একটু তিরিক্ষি মেজাজের লোক। স্টেশন থেকে আসার পথে গাড়ির টায়ার পাংচার হয়; তাতে বেশ ক্ষেপে আছে।’

আমি মনে মনে ঠিকই করে রেখেছিলুম যে, সাহেব মেজাজ দেখালেও আমি দেখাব না। আমার সঙ্গে দেখা হতে রাগ আর রসিকতা মিলিয়ে সাহেব বললেন, ‘ওয়েল, মহারাজ—হোয়াট কাউন্ড অফ এ ওয়েলকাম ইজ দিস? মাঝ-রাস্তায় আমাকে পনেরো মিনিট রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে হল!’

আমি যথাসাধ্য অ্যাপলাইজ করলুম, বললুম যে আর কোনো গলতি হবে না সে গ্যারান্টি দিচ্ছি। সাহেব চেয়ারে বসলেন, তাঁর জন্য শরবত এল, সেটা খেয়ে যেন মাথাটা ঠাণ্ডা হল। আমি বললাম, ‘তুমি এখানে কী কী করতে চাও সেটা আমাকে বল। অবিশ্যি আমার মোটামুটি জানাই আছে, আর সে অনুযায়ী ব্যবস্থাও করেছি, কিন্তু আমি তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই।’

সাহেব বললেন, ‘আমার শিকারের শখ আছে, আমি বাঘ মারতে চাই—সে ব্যবস্থা করেছ?’

আমি মাথা নেড়ে জানালাম করেছি।

‘আর আমি তোমার সংগ্রহ থেকে কিছু জিনিস কিনতে চাই আমার সংগ্রহের জন্য। বিশেষ করে সামনের বছর আমাদের বিয়ের রজত জয়ন্তী। আমার স্ত্রীর জন্য একটা ভালো উপহার আমি নিয়ে যেতে চাই। আশা করি তেমন জিনিস আছে তোমার সংগ্রহে।’

‘সেটা তুমি দেখলেই বুঝতে পারবে। ভালো জিনিসের অভাব নেই আমার দেড়শ বছরের সংগ্রহে।’

দুপুরে খাবার পর সাহেবকে সংগ্রহশালায় নিয়ে যাওয়া হল। আমিও অবশ্য প্রথম দেখলুম জিনিসগুলো। দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। এমন মহামূল্য জিনিস হাতছাড়া হয়ে যাবে ভাবতে আমার খারাপ লাগছিল। হোরেনস্টাইন দেখলাম সমঝদার লোক। সে চটপট কেনবার মতো জিনিস আলাদা করে রাখতে লাগল। সবসুদ্ধ প্রায় দশ লাখ টাকার জিনিস এইভাবে বাছল। কিন্তু তাও তার কপাল থেকে ভ্রূকুটি যায় না। ব্যাপার কী? শেষটায় সে বলল, ‘সবই হল, কিন্তু ক্যাথলীনের উপযুক্ত কিছু পেলাম না এখনো। কোনো ভালো ডায়মন্ড ব্রোচ জাতীয় জিনিস তোমার নেই? আমার স্ত্রীর পাথরের উপর ভীষণ ফ্যান্সি। একখানা ভালো পাথরও যদি পেতাম তার জন্যে!’

আমি মাথা নেড়ে আক্ষেপ জানালাম। ‘ভেরি সরি, মিঃ হোরেনস্টাইন। পাথর থাকলে আমি তোমাকে নিশ্চয়ই দিতাম।’

দিনের বেলাটা সাহেবকে রাজার বড় গাড়ি লাগন্ডাতে ঘুরিয়ে শহরের নানান দৃশ্য দেখানো হল। সন্ধ্যায় দুজনে বসে কিছুক্ষণ দাবা খেললাম। বুঝতেই পারছিলাম সাহেব তাঁর গিন্নির জন্য লাগসই উপহার পেলেন না বলে তাঁর মনটা ভারি হয়ে রয়েছে, এবং তাই তাঁর চালে ভুল হচ্ছে। কিন্তু মেজাজের কথা মাথায় রেখে আমি আরো বেশি ভুল চাল দিয়ে তাঁকে জিততে দিলুম।

রাত্রি ন’টায় ষোড়শোপচারে ডিনার খেয়ে কফি আর ব্রান্ডিতে কিছুটা সময় দিয়ে সাহেব শুতে চলে গেলেন সফেদকোঠিতে। রাজা নিজে মদ্যপান করেন না, আমিও করি না—এখানে মিলেছে ভালো। আমি শুধু কফি আর একটা ভালো হাভানা চুরুট খেয়ে উঠে পড়লাম। দেওয়ান নিজে এলেন আমাকে লালকোঠিতে পৌঁছে দিতে। আমি জিগ্যেস করলাম, ‘রাজা আজ আছেন কেমন?’ দেওয়ান মাথা নেড়ে আক্ষেপসূচক শব্দ করে বললেন, ‘সেইরকমই। ভুল বকছেন, হাসপাতালের নার্সদের খুব জ্বালাচ্ছেন। ডাক্তাররাও হিমসিম খেয়ে যাচ্ছেন।’

লালকোঠিতে গিয়ে দেখি এখানে খাট বিছানা তোষক বালিশ সবই অনেক ভদ্রস্থ, অর্থাৎ আমার উপযোগী। দেওয়ানজি যাবার সময় বলে গেলেন, ‘আপনার সাহসের তুলনা নেই। এই ঘরে রাজা শত্রুঘ্ন সিং মারা যাবার পর এই প্রথম মানুষ বাস করছে।’ আমি বললাম, ‘কোনো চিন্তা করবেন না। আমি সব অবস্থাতেই নিজেকে সামাল দিতে পারি।’

খাটের পাশে একটা ল্যাম্প রয়েছে; সেটা জ্বালিয়ে কিছুক্ষণ মন্দোরের ইতিহাস সম্বন্ধে একটা বই পড়ে সাড়ে এগারোটা নাগাৎ বাতি নিবিয়ে দিলাম। পশ্চিমে একটা বড় জানালা রয়েছে, সেটা দিয়ে এক সঙ্গে চাঁদের আলো আর ঝিরঝিরে বাতাস আসছে, চোখে ঘুম আসতে বেশি সময় লাগল না।

ঘুমটা ভাঙল যখন তখন চাঁদ নেমে গিয়ে ঘরের ভিতরটা আবছা আলোয় ভরে গেছে। চোখ চেয়েই বুঝলাম যে ঘরে আমি একা নই। দরজা যদিও বন্ধই আছে তবু জানালার পাশে একজন লোক সোজা আমার দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমারই মতন লম্বা আর আমারই ধাঁচের চেহারা, কেবল গোঁফটা আমার চেয়ে একটু বেশি পুরু। চাঁদের আলোয় খুব স্পষ্ট বোঝা না গেলেও লোকটা যে গাঢ় রঙের বিলিতি পোশাক পরে রয়েছে সেটা বুঝতে পারলাম।

আমি কনুইয়ে ভর দিয়ে একটু উঠে বসলাম। বুকের ভিতরে একটা মৃদু কাঁপুনি অনুভব করছিলাম, কিন্তু সেটাকে আমি ভয় বলতে রাজি নই। বেশ বুঝতে পারছি যে যিনি প্রবেশ করেছেন তিনি জ্যান্ত মানুষ নন; তিনি প্রেতাত্মা। এবং ইনি যে বর্তমান মহারাজার বাপ শত্রুঘ্ন সিং-এর প্রেতাত্মা তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। ইনিই এই ঘরে নিজের মাথায় রিভলভার মেরে আত্মহত্যা করেছিলেন।

‘অ্যাই হ্যাভ কাম টু টেল ইউ সামথিং’ গম্ভীর গলায় বললেন প্রেতাত্মা। বাকি কথাও ইংরিজিতে হল, আমি সেটা বাংলায় বলছি।

আমি জিগ্যেস করলাম, ‘কী বলতে এসেছেন আপনি?’

‘আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে আমি একটা মহামূল্য পাথর কিনেছিলাম ভিয়েনাতে একটা নিলামে। সেটা একটা পান্না। তার নাম ছিল ডোরিয়ান এমারেল্ড। এমন পান্না সচরাচর দেখা যায় না।’

‘সে পান্না কী হল?’

‘এখনো আছে। আমার ছেলের আলমারির দেরাজে একটা মখমলের বাক্সতে। যদি পার ত সেটা বিক্রি করে দাও। খরিদ্দার যখন পেয়েছ তখন এ সুযোগ ছেড়ো না।’

‘কেন বলছেন এ কথা?’

‘ও পাথর শয়তান পাথর। যখন কিনি তখন আমি এটা জানতাম না। ওর প্রথম মালিক ছিল লুক্সেমবুর্গের কাউন্ট ডোরিয়ান। সে তার কেল্লার ছাত থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে। তার দেহের একটা হাড়ও আস্ত ছিল না। তারপর এই পান্না উনিশ জনের হাতে ঘোরে। উনিশ জনই আত্মঘাতী হয়। আমি এটা জেনেও পান্নাটি হাতছাড়া করিনি, কারণ এমন আশ্চর্য সুন্দর পাথরের সঙ্গে যে এত ট্র্যাজিডি জড়িয়ে থাকতে পারে সেটা আমি বিশ্বাস করিনি। কিন্তু আমার মৃত্যুর জন্য ওই পাথরই দায়ী। আজ যে আমার ছেলের মাথা খারাপ হয়েছে তার জন্যেও ওই পাথর দায়ী। আমার নাতির এখনও কিছু হয়নি, কিন্তু ভবিষ্যতে…’

প্রেতাত্মা কথা থামালেন। আমি বললাম, ‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আমি ওই পান্নাকে বিদায় করতে পারব।’

‘তবে আমি আসি।’

চাঁদের আলোয় প্রেতাত্মা ক্রমে অদৃশ্য হয়ে গেল।

আমি বাকি রাত আর ঘুমোতে পারলাম না।

পরদিন সকালে দেওয়ানকে বললাম রাত্রের ঘটনা। দেওয়ান ত শুনে থ। বললেন, ‘কিন্তু আমি এমন পাথরের কথা জানি না।’ আমি বললাম, ‘যাই হোক, আলমারির দেরাজটা একবার খুলে দেখতে হয়।’

আলমারির দেরাজ খুলে লাল মখমলের বাক্সে পান্নাটা পেতে কোনোই অসুবিধা হল না। পাথর দেখে আমার চক্ষু স্থির। এমন পান্না আমি জীবনে দেখিনি।

এবার সাহেবকে ডেকে বললাম, ‘সাহেব তুমি পাথর চাইছিলে, একটা আশ্চর্য পাথর আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহে আছে বটে, কিন্তু সেটা আমার বাবার কেনা, তাই হাতছাড়া করতে দ্বিধা হচ্ছিল। পরে ভেবে দেখলাম, তুমি সম্মানিত অতিথি, এবং দূর থেকে এসেছ, তোমাকে বিমুখ করার কোনো মানে হয় না। দেখ ত এই পান্নাটা তোমার পছন্দ হয় কিনা।’

পান্না দেখে সাহেবের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। দুবার অস্ফুট স্বরে বললেন, ‘ইট্‌স এ বিউটি…ইট্‌স এ বিউটি!’ তারপর বললেন, ‘আমি আর কিছু নেব না।’

পান্না সাহেবের হাতে চলে গেল, আর আমাদের হাতে এল একটা চেক।

আশ্চর্য এই যে বিকেলে হাসপাতাল থেকে খবর এল যে রাজা অনেকটা সুস্থ বোধ করছেন।

সাহেবের তরফ থেকে শিকার তেমন জমল না, কারণ জঙ্গল হাঁকোয়াদের কেনেস্তারা পেটানোর চোটে বাঘ জঙ্গল থেকে বেরিয়ে সাহেবের হাতির কাছে এসে পড়া সত্ত্বেও সাহেবের নিশানা অব্যর্থ হল না। শেষটায় আমার গুলিতেই বাঘ মোলো।

পরের দিন সাহেব দিল্লি চলে গেলেন।

দুদিন পরে কাগজে দেখলাম দিল্লির এয়ারপোর্ট থেকে একটি প্যান অ্যামেরিকান বিমান টেক-অফ করার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তার এঞ্জিনে একটা শকুন ঢুকে পড়ে। প্লেন বিকল হয়ে গোঁৎ খেয়ে মাটিতে পড়ে। যদিও কেউ মারা যায়নি, যাত্রীদের মধ্যে জনা পঁচিশেককে নার্ভাস শকের জন্য হাসপাতাল যেতে হয়েছিল। তাদের মধ্যে ছিলেন মার্কিন ধনকুবের অস্কার এম. হোরেনস্টাইন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *