মহাযুদ্ধের পরে
ঘটনার আগের দিনের রাত্রি এটা।
বৃষ্টিটা হবে কি না, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তবে আকাশ আর আবহাওয়াটা যেন সব দিক দিয়েই তৈরি আছে। কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকার, মেঘের ঘন ঘটা, ভেজা ভেজা ভারী পুবে বাতাস, বায়ুকোণ থেকে আকাশের বহুদূর পর্যন্ত বিদ্যুতের হানাহানি, গুরুগুরু গর্জন, সব আছে। না বর্ষেও রাতটা যেন পুরোপুরি বর্ষার।
হাটের দিন নয়। বাজারের চালাগুলিতে ইতিমধ্যেই বেচাকেনার পাট চুকিয়ে, বাতি নেভাবার পালা শুরু হয়ে গেছে। আরও একটু সময় হয়তো চলত হিসেব-নিকেশ, বাতি জ্বলত। কিন্তু আকাশে বড় ঘটা। বর্ষাকে ত্বরান্বিত করতে বোধহয় ওইটুকুই মানুষের হাত আছে। মাথা-মুড়ি দিয়ে অন্ধকারে একটা মেঘ-মেদুর অনুভূতি নিয়ে শুয়ে পড়া।
চালাঘরগুলির পুবে ইছামতীর জলও দেখা যায় না। অন্ধকারে মেশামিশি করে আছে। কেবল চিকুর ঝিলিক যখন তারও বুকে বসছে কেটে কেটে, তখন টের পাওয়া যায়, স্রোত পাক খাচ্ছে ওখানে। জোয়ার না ভাঁটা, ঠাহর হয় না, শব্দ শোনা যাচ্ছে শুধু, ছল ছল ছলাৎ! তারও যেন বৃষ্টিরই প্রতীক্ষা।
ভারী বাতাসের ঝাপটা খেয়েও পুরুষ জোনাকিগুলি মিটিমিটি বাতির ইশারায় ফুসলে বেড়াচ্ছে নীচের মেয়ে জোনাকিদের। উচ্চকিত হচ্ছে ঝিঁঝির ডাক। সেটা মানুষকে শোনাবার জন্যে নয়। যে বাসনায় জোনাকি জ্বলে ওঠে, সেই বাসনার উন্মাদনায় পুরুষ ঝিঁঝিটা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বীরত্বের ফাঁদ পাতছে মেয়েটার জন্যে।
অন্ধকার গাঢ় হচ্ছে ক্রমে। আর এই অন্ধকারে, মেঘলা রাতে, জলো বাতাসে তল্লাটের কুকুরগুলি পরস্পরের মধ্যে পাড়া ও আঁস্তাকুড় ভাগাভাগি সমস্ত চুক্তি, সন্ধি ও বন্ধুত্ব ভুলে গেছে। তারা লড়ছে, রক্তারক্তি করছে। ঋতুকয়েদিগুলির রক্ত ছাড়া পেয়েছে এই বর্ষার মরসুমে। এখন আর কোনও চুক্তি সন্ধি ওরা মানবে না।
নারকেল গাছের ভিড় বেশি চারদিকে। বাতাসে তাদেরই দোলানি আর ডাক বেশি। বাজারটাকে দুভাগে করে, পাকা রাস্তা চলে গেছে অনেক দূরে, ইছামতীর গা ঘেঁষে ঘেঁষে। শেষ হয়েছে গিয়ে ইছামতীরই তটে।
আপ আর ডাউনের শেষ দুটো মোটর বাস-ই চলে গেছে কিছুক্ষণ আগে। একটা কলকাতায় গেছে, আর একটা কলকাতা থেকে গেছে ইছামতীর কূলে।
শেষ বাস দুটো দেখে ওরা দুজনেই নদী-কিনারের হোটেলে খেয়ে এসেছে চুক্তি অনুযায়ী। দেড়ো ব্যালাইণ্ডা বটা আর ব্যালাইণ্ডা সুলা। নামগুলি একটু অদ্ভুত। বিদেশি নয় নিতান্তই দেশি নাম, আর এ অঞ্চলেরই কালো কালো দুটি পুরুষ। নাম বটা আর সুলা। বাকিগুলি বিশেষণ, দুজনের খ্যাতির ও খাতিরের বাহন। হোটেলের চুক্তিটা আর কিছু নয়, শেষ যা থাকে, ওদেরই। অত্যন্ত দায়িত্বপূর্ণ চুক্তি। যে-দিন কিছু থাকে না প্রায়, সে-দিন ওদেরো ফাঁকা।
খাওয়ার শেষে লাঠি ঠুকে ঠুকে দুজনে রাস্তাটা পার হয়।
বটা একটু লম্বা, ঘাড় অবধি সোজা খাড়া আর শক্ত, মাথাটা নোয়ানো। এলোমেলো, খাপছাড়া দাড়ি তার মুখে। সুলা চওড়া, পেটা পেটা শরীর, একটু বেঁটে।
সুলা এসেছে ইছামতীর ওপার থেকে। বটা এপারের। দুজনে আছে এই বাজারের তল্লাটে অনেক দিন, অনেক বছর ধরে। কত বছর, সেটা ওরা জানে না, কারণ ওরা হিসাব রাখতে পারে না। দশ বছর হতে পারে, বিশ বছরও হতে পারে। নিজেদের বয়স ওরা জানে না। তিরিশ হতে পারে, চল্লিশ-পঞ্চাশও হতে পারে। দেখলে কিছুই প্রায় অনুমান করা যায় না।
কলকাতার বাস যায় এখান দিয়ে, আর বাজারটা আছে। এইটি দুজনের একমাত্র আকর্ষণ।
কে একটা বাস-যাত্রী দেশি সাহেব, অনেককাল আগে, সুলাকে বলেছিল, তুম ব্লাইন্ড আছে?
সুলা বলেছিল, ব্যালাইন্ড? সেটা কী বাবু?
ব্লাইন্ড, ব্লাইন্ড! আন্ধা।
সুলার চোখ খোলা, ঘষা-ঘষা দুটি তারা, কিন্তু জন্মান্ধ। সাহেব তাকে অন্ধ বলে প্রথমে যেন বিশ্বাস করতে পারেনি।
সুলা সাহেবের মাথার উপর অন্ধ চোখ রেখে বলেছিল, হ্যাঁ, আমি কানা, ভিখ-মাগা কানা।
সাহেব ভিক্ষে দিয়েছিল। আর সুলা চিৎকার করে বলেছিল বটাকে, জাইনলি রে বটা, অন্ধও না কানাও না, আমি ব্যালাইণ্ড। তুইও ব্যালাইণ্ড।
বাজারের সবাইকে ডেকে ডেকে বলেছিল, আপনেরা সকলে শুইনে রাখেন গো ব্যাপারি মোহাজনরা, আমরা ব্যালাইণ্ড।
পরে সেটা ডাকাডাকি, হাসাহাসিতে ব্যালাইণ্ডায় দাঁড়িয়েছে।
বটার চোখের মণি নেই, পচা মাছের পটকার মতো দুটো ড্যালা ঝুলে আছে। সেও জন্মান্ধ। দুইই জন্মান্ধ, দুজনেই ভিক্ষে করে। বটা গান গেয়ে আর সুলা সুর করে কথা বলে ভিক্ষে করে।
লাঠি ঠুকে ঠুকে পার হয় দুজনে রাস্তাটা। ওপারে গিয়ে আরও খানিকটা দক্ষিণে যায়। বাজারের চৌহদ্দি পেরিয়ে–যেখানে পাটের খালি গুদামঘরগুলি রাস্তার দু পাশে এক রাশ অন্ধকার গিলে গুহার মতো দাঁড়িয়ে আছে। পাট এখন চাষ হচ্ছে মাঠে। পাইকাররা টাকা নিয়ে ঘুরছে চাষিদের কাছে। গুদাম ঘরগুলি এখন হা-হা করছে, পড়ে আছে বে-ওয়ারিশ। অধিকার আছে শুধু বুড়ি রোগা গোরুর, কুকুরের আর ব্যালাইণ্ডাদের।
সুলা বলে, কোনটায় যাবি। বড়টায় না ছোটটায়?
বটা জবাব দিল, বড়টায়। বিষ্টি হলি, জল পড়ে ছোটটায়।
বড়টায়ও পড়ে।
কিন্তুন জায়গা বেশি।
বটা নাক কোঁচকাল, ঊ, শেয়াল যায় ডাইনা দিয়া।
সুলা বলল, হুঁ!
সুলা হুঁ-বলার আগেই কুকুর ডেকে উঠল সামনে। তারপর ঝোপঝাড় মাড়িয়ে একটা ছোটাছুটির শব্দ। মদ্দা শেয়ালগুলিকে এই মরসুমে একদম বিশ্বাস করা যায় না, কুকুরগুলিকে তো নয়ই! শেয়াল-কুকুরের জার জন্মাবে এক গাদা।
চারিদিক থেকেই কুকুর ডাকতে লাগল। সামনে, পিছনে, কাছে ও দূরে।
তিনটে গুদাম ঘর পার হয় ওরা। প্রতিটি উঁচু-নিচু, পথের প্রতিটি গাছ, ঝোপঝাড় প্রায় অঙ্কের মতো চেনা ও মাপজোক করা আছে।
সুলা বলল, বিষ্টি লাইমবে মনে লয়।
বটা জবাব দিল, দেরি আছে। লোনা বাতাসে এখনও উড়য়ে নেচ্ছে। বাতাসটা জল-জল।
সুলা বলে, হাঁকডাকও তো খুব।
ম্যাগের?
হ্যাঁ। আবার বিজলি নাকি চমকায়।
হুঁ, মানষে কয়, বিজলি চমকায়। কেমন কইরে চমকায়?
কী জানি! মানুষে দ্যাখে? বোধায়, মন যে রকোম চমকায়, সেই রকোমই হবি।
বটা হাসে, বলে, মনের মতন চমকায়?
সুলাও হাসে। হিঃ হিঃ হিঃ!–আবার বলে, সবকিছুর নাকি রং আছে?
হ্যাঁ, মানষে দ্যাখে। লাল, সইবজে, লীল, সাদা…
আর কালা? কালাটা কেমন?
আন্ধারের মতন।
আন্ধার?
হ্যাঁ, মানুষে কয়।
লোকে বলে, অন্ধকারটা কালো। ওরা কালো চেনে না, সাদা চেনে না। লাল চেনে না, নীল চেনে না।
সুলা বলে, পয়সা নাকি নাল আর সাদা।
বটা বলে, শুঁইকলে মালুম দেয়, কোনটা নাল আর সাদা। নালটার গন্ধ ঘামের মতন। সাদাটার গন্ধ নাই।
হুঁ। হাত দিলিও ট্যার পাওয়া যায়।
তা তো যায়ই।
গন্তব্যে এসে দাঁড়ায় দুজনে। সুলা বলে, এই দ্যাখো শালারা এইসে জুইটেছে। হুট, হুট।
গোটা কয়েক কুকুর, ঘেউ ঘেউ করছে না কিন্তু গায়ে পড়াপড়ি, দাপাদাপি করে গরগর করছে। তাড়া খেয়ে দৌড়ে পালাল।
.
ওরা দুজনে লাঠি ঠুকে ঠুকে একটা কোণ বরাবর চলে যায়। সেখানে পাতা চাটাইয়ের ওপর শুয়ে পড়ে দুজনেই।
আঃ!
আর একজন কাশে। তারপর দুজনেই তলপেটের কাছে হাত নিয়ে যায়। খরচ শেষে অবশিষ্ট পয়সা টিপে টিপে দেখে।
কোন গুদামঘরের চালের টিনের জোড় খুলে গেছে। বাতাসে টিনটা ঘা খেয়ে খেয়ে মেঘ ডাকার সঙ্গে তাল রাখছে মাঝে মাঝে। বটা ডাকল, সুলা ব্যালাইণ্ডা।
হুঁ।
রাইত ব্যালাইণ্ডা ডাকে না যে?
তাই ভাবতেছি।
সুলার কথা শেষ হবার আগেই পাখিটা ডেকে উঠল, পিক পিক পিকু পিকু!
বটা বলে উঠল, ওই, ওই, ডাক ছেইড়েছে রাইতকানাটা।
কোথায় একটা কাঠের ফ্রেমের কানাচে বাসা বেঁধেছে পাখি। ওরা যখন আসে, দু-চারটে কথা বলে, তখন পাখিটা ডেকে ওঠে। ভয়ে ডেকে ওঠে শিস দিয়ে, পিক পিক পিকু পিকু। সাবধান। মানুষ এসেছে।
সুলা বলে, বড় তাজ্জব, না?
কেন?
দিনে নাকি দেইখতে পায়, রাইতে ব্যালাইন্ডা।
হুঁ! মানষে কয়। তাই ডরায়।
কেন?
মানুষেরে নাকি ডরায়, মানুষে কয়। কুত্তারে ডরায় না,গোরুরেডরায় না, মানুষেরে ডরায়। ডিম নাকি পাড়ছে, বাচ্চা ফুইটবে, তাই ডরায়।
আবার ডেকে উঠল পাখিটা।
সুলা বলে, ডিম সামলায়। কিন্তু দ্যাখে কেমন কইরে?
আন্দাজে সামলায়। দিনের বেলা দেইখতে পায়।
জম্মো-কানা লয়।
হুঁ। চইখ আছে, রং চেনে, উইড়তে পারে।
একটু চুপচাপ। পাখিটা প্রতিদিনের অভ্যাসের মতো নির্ভয় হয়, শান্ত হয়ে চুপ করে থাকে। বৃষ্টি আসেনি, ঘটা আরও ঘোর হয়েছে তবু জোড়-খোলা টিনটা শব্দ করছে তেমনি।
সুলা বলে, পাখি কোনওদিন দেখি নাই।
অর্থাৎ স্পর্শ করেনি কোনওদিন।
বটা বলে, মানষে দ্যাখে, কয়, দুইটা নাকি পা, আর দুইখান পাখা।
পাখা কেমন?
কী জানি! খুব নাকি লরম জীব। লদীর ওপার নাকি যায় উইড়ে উইড়ে, আবার এইসে পড়ে।
হ্যাঁ, মানষে তো কয়।
ডিম ফুইটে নাকি বাচ্চা বানোয়?
মানষে কয়।
মানষের শুধু বাচ্চা হয়। কেমন কইরে হয়?
সুলা চুপ করে থাকে। গুদামের গুহায় ঢুকে-পড়া বাতাস বেরুবার জন্য ছটফট করে। তার ঘষা মণি দুটি স্থির হয়ে থাকে এক জায়গায়।
বটার পটকার মতো ড্যালা দুটি কাঁপে তিরতির করে।
সুলা হঠাৎ বলে, মানষে কয় না।
তারপর ওদের অন্ধ চোখে ঘুম নামে। ঘটনার আগের দিন ঘুমোয় দুজনে।
.
ইতিহাসের আগে, আদিম যুগের গুহা-মানবের মতো নিতান্ত গোষ্ঠিবদ্ধ দুটি জীব। শব্দ দিয়ে যারা রূপকে দেখতে চেয়েছে, স্পর্শ করে রংকে চিনতে চেয়েছে। কীট আর পতঙ্গের চেয়েও যেন অসহায়। ক্ষুধার মতো প্রাকৃতিক বোধ আর অসুখের অনুভূতি ছাড়া, মানুষ হিসেবে আর কোনও দরকার নেই তাদের।
কোনও হিংস্রতা নেই, ইতিহাসের আলোক তাদের অজ্ঞানতার অন্ধকারে বাতি জ্বালেনি।
কারণ, পৃথিবীতে তারা এসেছে, পৃথিবীর কিছুই তারা দেখেনি। মানুষের মধ্যে বাস করেও কিছু দেখেনি তারা মানুষের।
তবু ইতিহাস তাদের অন্ধ বুকে এসে মাঝে মাঝে দোলা দিয়ে গেছে। পাখি রং-মানুষের বিষয় তারা ভাবতে চেয়েছে।
কিন্তু ইতিহাসের অকৃত্রিম বোধগুলি অচেনা থেকে গেছে তাদের। রাজ্যজয়, ভোগ, দখল, দাবি, ক্ষমতা, অধিকার আর হিংসা তাদের ইতিহাসের দাগের বাইরে রেখে দিয়েছে। ইতিহাস কোনওদিন তাদের সেইটুকু খুলে দেয়নি, যেখান থেকে সে চিৎকার করে উঠবে, আমার! এটা আমার, ওটা আমার, আমি চাই। তাই দেড়ো ব্যালাইন্ডা বটা আর সুলা ব্যালাইন্ডা অনৈতিহাসিক আদিম ভীরু অসহায় অন্ধকারে পড়ে আছে।
তবু ইতিহাস সেখানেও ছায়া ফেলে গেছে মাঝে মাঝে। যেমন, কুকুরের সঙ্গে ওরা শোয়নি, নিজেদের আস্তানা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। ভয় হয়, কেউ ওদের ভিক্ষের কড়ি মেরে কেড়ে নেবে কি না। খাবার নিয়ে ওদের পরস্পরের মধ্যে ঝগড়া হয়েছে। কিন্তু সে ঝগড়া ওদের বেশিক্ষণ টেকেনি। যুগযুগান্ত ধরে পাশাপাশি দুটি রাজ্যের হত্যা ও বিদ্বেষের মতো ঐতিহাসিক হয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি ওদের, কারণ, পরদিন ওরা আবার খেতে পেয়েছে, কারুর ভাগে কম পড়েনি। তখন ওরা আবার একত্র হয়েছে, কেননা, দুজনের অন্ধ-সমাজে আর কেউ নেই। সাধারণ মানুষের মতো সাধারণভাবে ভালবাসাবাসি করেছে। বলাবলি করেছে, ভাত নাকি সাদা।
এ্যা, মানুষে কয়। ওইটা সাদার গন্ধ।
দুধ নাকি সাদা।
মান্ষে কয়। দুধেরো গন্ধ সাদা।
আমি দুধ খেইছি, তিনবার।
আমি একবার
মায়ের দুধ নাকি সাদা?
মানষে কয়। আমার মনে নাই।
আমারও না।
তারপর ওরা চুপ হয়ে গেছে। চুপ হয়ে, অনেক দূর পিছিয়ে গেছে অন্ধকারে। কল্পনা করার চেষ্টা করেছে, একটা মা-কে। একটি মা, নিশ্চয় সে ওদেরই মতো ছিল। একটা মাথা, দুটো হাত, দুটো পা। আর মানুষের মতো চোখ, যা দিয়ে দেখা যায়। কিন্তু দুধ? দুধ কোথায় ছিল? বুকে নাকি থাকত। বুকে? বুকের কোথায়।
যেন মা ঘুমোয় অঘোরে আর তার পাশে দিশেহারা সদ্যোজাত ছেলে বিশ্বময় হাতড়ে ফেরে, দুধ, দুধ কোথায়।
দেড়ো ব্যালাইন্ডা বটা চিৎকার করে গান ধরে দিয়েছে, যে গান গেয়ে ভিক্ষে করে :
হে ভগমান! ভগমান!
অন্ধজনে কর কর ত্রাণ।
সুলা ব্যালাইণ্ডা ঘাড় নেড়ে বলেছে, হ্যাঁ! মা দেখি নাই বাবা, বাবা দেখি নাই বাবা, হেই মা বাবা..
তারপর অন্ধত্ব ঘোচাবার জন্যেই যেন ওরা, গায়ে গা-ঠেকিয়ে শুয়ে থেকেছে। তখন বোধহয় শুধু মহাকালই চোখ মেলে তাকিয়েছিল, যে ওদের আয়ুষ্কালের শেষ দিগন্তে দেখছিল ত্রাণের নিঃশব্দ দিনটাকে।
ওরা দুজনে ঘুমিয়ে পড়ল, বৃষ্টিটা তখনও এল না। পুবে ভারী বাতাস আরও ভারী হয়ে উঠল। শুধু বিদ্যুৎ-হানাহানি, মেঘ-ডাকাডাকি এল কমে। প্রকৃতি যেন এবার চুপি চুপি কিছু সরাবার তালে আছে। কারণ রাত্রিটা অন্ধ। রাত পোহালে দেখা গেল বৃষ্টি হয় নি। কিন্তু মেঘ কাটে নি।
সুলা আর বটা শুয়ে শুয়ে শুনতে পেল, কলকাতার বাস চলে যাচ্ছে। এ সময়টা ভিক্ষে পাওয়া যায় না বড় একটা। সেইজন্য ভোরের দিকে কয়েকটা বাস ওরা রোজই ছেড়ে দেয়।
সুলা বলে, রৌদ ওঠে নাই।
বটা জবাব দেয়, ম্যাগ আছে আকাশে।
লাঠি ঠুকে ঠুকে, চেনা-পথে বাজারের কাছে আসে দুজনেই।
একটু পরেই দূর থেকে আপ গাড়ির শব্দ ভেসে আসে।
সুলা বলে, সুলা ব্যালাইণ্ডারে ডাইকতে ডাইকতে আইসতেছে।
বটা বলে, তোর মুণ্ডু। ওই শোন দেড়ো ব্যালাইণ্ডার নাম করতিছে।
অর্থাৎ, গাড়ির এঞ্জিন নাকি ওদের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে আসে। গূঢ়ার্থ হল ওদের ভিক্ষে পাওয়ার ভাগ্য নিয়ে একটু খুনসুটি।
তা ছাড়া এঞ্জিনের শব্দটা ওদের কাছে শুধু একটা যান্ত্রিক শব্দ মাত্রই নয়। আরও কিছু। রহস্যঘেরা এক বিচিত্র আত্মার মতো, যার মধ্যে ওরা অনুভব করেছে ভয়ঙ্করের ভয়, ভরসার বন্ধু। মানুষ যেমন অলৌকিকের সঙ্গে সম্বন্ধ পাতিয়ে সত্য মিথ্যের নানান খেলা করে, এঞ্জিনের ডিজেলের গন্ধের মধ্যে তাকে ওরা আবিষ্কার করেছে ভয়ঙ্কর ও মহতের মতো একটা কিছু।
গাড়িটা আসে। পরস্পরের চুক্তি অনুযায়ী দুজনে দাঁড়িয়ে যায় গাড়িটার দু পাশে। বটা আর সুলা সবে চিৎকার করতে যাবে। এমন সময় সেই শব্দটা শোনা গেল। দু জনে ওরা দাঁড়িয়ে রইল। স্তম্ভিত হয়ে।
ওরা স্তম্ভিত হল, কিন্তু চা ও খাবারওয়ালার চিৎকার চলতে থাকল সমানে। চলতে লাগল যাত্রীর ওঠা-নামা, হাঁকডাক। কোথাও কোনও বিস্ময় নেই ; আর কেউ স্তম্ভিত হয়নি। বাতাস ঠিক বইছে, আকাশ ঠিক মেঘলা আছে। বাজারের স্তিমিত কলরব শোনা যাচ্ছে ঠিক, ঠিক শোনা যাচ্ছে ইছামতীর খেয়া-মাঝির হাঁক।
কেবল দেড়ো-ব্যালাইণ্ডার আর সুলা ব্যালাইণ্ডার ঘষা চোখের মণি স্থির, মাছের পটকা-ড্যালার টুকুসটুকুস লাফানি।
শুধু মহাকাল দেখল, অন্ধ ও আদিম জগতের একত্র বাস গুহায় নতুন কালের আবির্ভাব হল। পদক্ষেপ করছে ইতিহাস।
বটা-সুলা নয়, বাসের সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করছে একটি মেয়েমানুষ : দুএকখান পয়সা দিয়ে যান গো বাবা, জন্মান্ধ বাবা। সোয়ামি-পুত্তুর নেই, দেখবার কেউ নেই, আপনেদের দয়া। বলতে বলতে গান ধরে দিল :
ঠাকুর, কতকাল আর রাখবে নজর কেড়ে
কবে জনম সাথক হবে, তোমারে হেরে।
সুলা ঘুরে এসে বটার সামনে দাঁড়াল।
সুলা?
হুঁ।
আর এ্যাটটা জুইটল?
ব্যালাইন্ডনি।
চইমকে গেছি।
বিজলির মতন।
জন্মান্ধ কয়।
মানষে দেইখবে।
বটা সুলার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, রাগারাগি করিস না ঝ্যানো।
সুলা বলল, দরদ আইসে না।
বটা প্রায় চাপা-গলায় হামলে উঠল, মাগ, মাগ তাড়াতাড়ি সুলা। বলে সে নিজেই চিৎকার করে উঠল :
ভগমান! ভগমান!
অন্ধজনে কর ত্রাণ।
সুলার ভিক্ষে চাওয়ার রীতি একটু আলাদা। সে গাড়িতে উঠে নানারকম শব্দ করে। বেড়াল ডাকে, কুকুর ডাকে, কোকিল ডাকে। তারপর বলে, সুলা ব্যালাইণ্ডারে দ্যান কিছু।
লোকে হাসে, খুশি হয়। যার সামর্থ্য থাকে, সে দেয় কিছু।
কিন্তু আজকে মনোযোগ দিতে পারল না সুলা।
ওদের দুজনের চিৎকার শুনে, মেয়ে-গলাটা স্তিমিত হয়ে এসেছে একটু। বুঝতে পারল, বিনা-ভাগের নিরঙ্কুশ রাজ্যে সে প্রবেশ করেনি।
গাড়িটা চলে যায়। সুলা আর বটা দাঁড়ায় পাশাপাশি। টের পায়, ভাগিদার পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে।
তাই দাঁড়িয়ে ছিল। নাম ওর কানী কুরচি। এসেছে কলকাতার শহরতলী থেকে। চোখ বলে ওর কিছু নেই, দুটি অস্পষ্ট অন্ধকার গর্ত, চোপসানো দুটি চোখের পাতা পিটপিট করে তার ওপর। বয়সের দাগ পড়েছে সারা গায়ে। সেটা বয়সেরই কিংবা শুধু এই জীবনের দাগ, অনুমান করা যায় না। সে জন্যে বয়সটা তার গৌণ। তিরিশ হতে পারে, পঞ্চাশও হতে পারে। যৌবনের কোনও চিহ্ন নেই, কিন্তু মেয়েমানুষের চিহ্নটুকু আছে সর্বাঙ্গে। শণনুড়ি চুলে, জন্মান্ধের ছাপমারা মুখে, সেই প্রথম সন্ধিক্ষণের বেড়ে-উঠে থমকে-যাওয়া শরীরে বয়সের বহুল রেখায়।
কুরচিও থমকে আছে, টের পেয়েছে দুজনের দাঁড়িয়ে থাকা। মুখের ওপর তার শণ-পাঁশুটে চুল পড়েছে উড়ে। মুখে একটু তোশামোদের হাসি।
বলে, কজনা হে?
বটা-সুলাকে জিজ্ঞেস করছে, মোট কজনা অন্ধ আছে।
সুলা উলটোমুখে হাঁটা ধরে লাঠি ঠুকে ঠুকে। বটাও। কুরচি হাসিটুকু বিকৃত করে, মুখ ফিরিয়ে থাকে ওদের লাঠি-ঠোকার শব্দের দিকে। আপন মনে বলে, ঝগড়া করতে চায়। তারপর সেও অন্যদিকে যায় লাঠি ঠুকে ঠুকে।
সুলা আর বটা গিয়ে বসে একটি চালের আড়তের সামনে গাছতলায়। ভিক্ষে করে। ওইটি ওদের বসার জায়গা।
বটা বলে, আর এ্যাটটা কানা ছাওয়াল জুইটছিল একবার, মইরে গেছে।
সুলা বলে, এইটাও মরপে।
রাগ করিস না সুলা।
দরদ আইসে না।
আপনে আপনেই পলাইবে।
একটু চুপচাপ। সুলা বলে, ভাগিদার।
বটা বলে, মানষে কিছু কয় না।
মানুষে কিছু না বললে, ওদের বলার হক নেই। এই বাজারের এক মহাজনের খদ্দের আর-এক মহাজন ভাঙিয়ে নিলে মারামারি হয়, পঞ্চায়েতের বিচার হয়। কিন্তু কানী কুরচির ব্যাপারে সকলে নির্বিকার। পৃথিবীর কোথাও কিছু যায়-আসে নি।
সুলা বলে, মেইয়েমানুষ।
দেখি নাই কোনও দিন।
অর্থাৎ স্পর্শ করে নি।
ব্যালাইণ্ডানি।
মানষে দ্যাখে।
এয়াদের ছাওয়াল হয়।
দুধ হয়।
চুপ করে ওরা। আবার বাড়ি আসে। ভিক্ষে করে ওরা। বরং কানী কুরচিই আসর জমাতে পারে না! সময় লাগবে।
প্রত্যেকবার গাড়ি আসে, গাড়ি যায়। কানী কুরচি প্রত্যেকবারই খোশামোদ করে হাসে। ব্যালাইণ্ডারা চুপচাপ গাছতলায় চলে যায়।
কানী কুরচি বলে আপন মনে, ভাগাতে চায় আমারে। কানারে দয়া করতে চায় না। দু দিন কাটল এমনি। বাজারের কেউ কেউ একটু-আধটু বলাবলি করল ওদের দুজনের সামনে, আর একটা কানী এসে জুটেছে।
দুই কানা এক কানী হল।
মেঘ কাটেনি দু দিন। তিন দিনের দিন রাত পোহাতেই প্রবল বৃষ্টি এল। সুলা আর বটা বেরোয়নি। বসেছিল গুদাম-ঘরটার অন্ধকার কোণে।
টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ বেশি হয়। চুপচাপ বসে সেই শব্দ শুনছে দুজনে। মাঝে মাঝে মেঘের গর্জন শোনা যায়। মনে হয়, চালের টিনের ওপর কেউ বাঁশ পিটছে থেকে থেকে।
পাখিটা বেরুতে পারে নি। বোধহয় দুটি পাখি থাকে। কখনও কখনও সেই রকম মনে হয় বটা-সুলার। যেন দুজনে কথাবার্তা বলে। এখন একলা আছে পাখিটা নিশ্চয়। মেঘের গর্জন শুনলে ডেকে ওঠে একবার, পিক।
বটা-সুলা দুজনেই গুদামের দরজার দিকে মুখ তুলল। শব্দ হল যেন কীসের?
পাখিটা মহাকালের হয়ে যেন ভয়-চাপা গলায় ডেকে উঠল, পিক পিক পিকররর পিকররর। ব্যালাইণ্ডারা, দ্যাখ কে এসেছে।
জলে ভিজে প্রায় কাঁপতে কাঁপতে বলল কানী কুরচি, বাবারে বাবা, কী বিষ্টি! সমসারটা ধুয়ে নিয়ে যাবে গো।
কে?
বটা জিজ্ঞেস করল।
কুরচি একটু চমকে উঠল। শব্দ-আসা কোণটার দিকে মুখ করে বলল, কানী কুরচি গো বাবু! হেই বাবা, কারুর ঘরে ঢুকে পড়িনি তো!
কোনও জবাব নেই। পাখিটা ডানা ঝাপটে আবার ডাকল, পিক, পিক! সে এসেছে, সে এসেছে। পিকু পিকু পিকচ পিকচ্! ব্যালাইণ্ডারা, মহাকাল তোদের নতুন পথের মোড়ে এনেছে।
কানী কুরচির চোখের অন্ধকারে সন্দেহ ও কৌতূহলের ঝিকিমিকি। কোণ লক্ষ করে এক পা-দুপা করে এগুতে এগুতে বলল, সেই দুজনা নাকি হে ভাই!
সুলা আর বটা দুজনে নিঃশব্দে নিশ্বাসে নিশ্বাসে যেন কথা বলে :
ব্যালাইণ্ডানি?
হুঁ। কী চায়?
সুলা জিজ্ঞেস করে মুখ ফুটে, কী চাই?
কুরচি এগুতে লাগল।–এ্যাটটা ডেরা ডাণ্ডা খুঁজছি। সবাই এদিকটা দেখিয়ে দিলে, বললে, মেলাই খালি গুদোম-ঘর নাকি পড়ে আছে। তা দরজাই খুঁজে পাই না। তা পরে এখেনটায় এসে মনে হল, গুদোম-ঘরের দরজা নেইকো।
মেঘ ডাকল। একটা দমকা বাতাস এক রাশ জল নিয়ে গুদামঘরের অনেকখানি ভিজিয়ে দিয়ে গেল।
কুরচি কেঁপে উঠে বলে, আ মা গো, জাড় লেগে গেল। গায়ের চামড়া থিকথিকে কাদার মতো। নাগছে। তারপর হঠাৎ বলে ওঠে, তোমরা বাপু আমার পরে খুব গোঁসা করে আছ, না!
কানী-কুরচির গলায় যেন সোহাগ-মাখা অভিমান।
দুই ব্যালাইণ্ডার যেন নিশ্বাস আটকে যায় বুকে। কী হল? কী যেন ঘটে গেল গুদামঘরটার মধ্যে? মানুষ কি একেই মায়া বলে? যেন কীসের মায়া ছড়িয়ে পড়ল ঘরটার মধ্যে।
মহাকাল দেখছিল, গুদামঘরে নয়, একটি মানুষিক মায়া এতদিনে ব্যালাইণ্ডাদের অনুভূতিতে প্রবেশ করেছে। মেয়ে-গলায় সোহাগী অভিমানের সুরে, কেমন যেন করে ওঠে বুকের মধ্যে। চমকে চমকে ওঠে। বিজলির মতন কি না কে জানে!
সুলার নিশ্বাস পড়ে বটার গায়ে, বটার নিশ্বাস সুলার গায়ে। নিশ্বাসে নিশ্বাসে নিঃশব্দে কথা বলে দুজনে :
মেইয়েমানুষ।
দেখি নাই কোনওদিন।
ব্যালাইণ্ডানি।
মানষে দ্যাখে।
বটা বলে মুখ ফুটে, না, গোঁসার কি আর আছে।
সুলা বলে, হ্যাঁ, তুমোও যা আমুও তা। হক আছে তোমার ভিক্কে কইরবার।
কানী কুরচির মুখে হাসি ফোটে। পুরুষের স্তুতি শোনা-মেয়েমানুষের হাসি। যেন ঠোঁট ফুলিয়ে বলে, পেখম পেখম গোঁসা করেছিলে, জবাব করনি কো। মনে বড় দুঃখু নেগেছিল।
বড় দুঃখ পেয়েছিল কানী কুরচি।
এখন শুনে বড় দুঃখ পায় ব্যালাইণ্ডারা। কানী কুরচির ঠোঁট-ফোলানো সোহাগের সুরে জন্মান্ধ বুক বড় টনটনিয়ে ওঠে। মনে মনে কথা বলে দুজনে :
মেইয়েমানুষ।
দেখি নাই কোনওদিন।
কাছে আইসতে চায়।
বুকটা বড় টাটায়।
সুলা আর বটা হাসতে চেষ্টা করে। অভিমানহত মেয়েমানুষের কাছে আত্মসমর্পিত পুরুষের বিব্রত হাসি।
সুলা বলে মুখ ফুটে, দুঃখু পেইয়ো না। আমরা কানা।
বটা বলে, হ্যাঁ, জম্ম-কানা। ব্যালাইণ্ডা।
কানী কুরচি তখন দুজনের একেবারে সামনে। তার হাতের লাঠি স্পর্শ করেছে দুজনের পায়ে।
অবাক হয়ে বলল, কী বললে?
ব্যালাইণ্ডা।
ব্যালাইণ্ডা?
হ্যাঁ, কানারে ইঞ্জিরিতে তাই বলে।
বলে সুলা হেসে ওঠে, হিঃ হিঃ হিঃ…।
বটা হাসে, হেঃ হেঃ হেঃ…।
কানী কুরচি ওদের গা ঘেঁষে বসে। মোটা গলার হাসির সুরে একটি মেয়ে গলার খুশির হাসি চড়া সুরে বেজে ওঠে বাজনার মতো।
পাখিটা ডেকে উঠল, পিক? কী হল? পরমুহূর্তেই ডেকে উঠল গলা ফাটিয়ে, ক্যাক্যাক্যা, পিচকা পিচকা। কী মজা! কী মজা! মহাকাল একটা সুখী সংসার করে দিল গুদামঘরের মধ্যে।
অঝোরে বৃষ্টি ঝরছে। টিনের ওপর বৃষ্টি পড়ছে, বাজছে একটানা, ঝম্ ঝম ঝম ঝম্। সেই শব্দে তাল রেখে তিনজনে কথা বলে। পরস্পরের পরিচয় পাড়া হয়। কে কোথা থেকে এসেছে। কোথায় কার ঘর ছিল।
তিনজনে বলে তাদের জীবনবৃত্তান্ত, একটানা গোঙানির মতো। যেন কোনও এক বিস্মৃতকালের অতীত থেকে তারা এতদূর এসে পৌঁছেছে।
কানী কুরচির অনেক অভিজ্ঞতা। অনেক দেশবিদেশ সে ঘুরে এসেছে রেলগাড়িতে করে, মানুষের কত রকম কথা সে শুনেছে। সে সব ইঞ্জিরির চেয়েও অদ্ভুত কথা। কুরচি বলে। বটা-সুলা সায় দেয়, মানষে কইত।
অর্থাৎ, এতদিন লোকে বলত, এবার একটা ব্যালাইণ্ডানি বলছে।
কুরচি বলে, কলকাতার কথা। আ! কী রাস্তা গো। পায়ের তলায় যেন পাকা ঘরের মেঝে। মনে হত হাত দিয়ে ধুলো ঝেড়ে দিই রাস্তার।
তাঁ, মানষে কইত।
বটা-সুলা কথা শোনে আর নাকের পাটা ওদের ফুলে ফুলে ওঠে। গন্ধ নেয়, নতুন গন্ধ, ব্যালাইন্ডানির গায়ের গন্ধ লাগে তাদের নাকে। এর আগে ওরা অনেক ভাল গন্ধ পেয়েছে। বাজারের কলা, কুল, তরি-তরকারি আর ফুলের গন্ধ। সে গন্ধ তাদের ভাল লেগেছে। কিন্তু ব্যালাইণ্ডানির গায়ের গন্ধ তাদের কেমন যেন নেশা ধরিয়ে দেয়। এদিক-ওদিক করতে গিয়ে ছোঁয়াছুঁয়ি হয়।
পাখিটা দুষ্টুমির সুরে যেন ডাকে, পিক? কী হল?
কী হচ্ছে, ব্যালাইণ্ডারা তা বুঝতে পারে না। শুধু বুঝতে পারে, ওদের অন্ধ রক্তে কীসের মোচড় লাগছে। ওরা যেন কী দেখতে পায়। তবু ওরা হতভম্ব। গোষ্ঠিবদ্ধ দুটি গুহাবাসীকে যেন কে ধরে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে আকাশের তলায়, বাতাস আর গন্ধের মাঝখানে। এবার কোনদিকে যেতে হবে? রাস্তার কোনদিকে? ওদের যাত্রা শুরু হয়েছে, ব্যালাইণ্ডারা পথ চায়। মনে মনে কথা বলে ওরা :
দেড়ো ব্যালাইণ্ডা, আমার মন বড় আঁকুপাকু করে।
সুলা ব্যালাইণ্ডা, আমার মন ঝ্যানে কান্দে।
এইটে সুখ না দুঃখু?
মানষে জানে।
কুরচি একরাশ ভেজা চিড়েমুড়ি, ভেলি গুড় আর মৌমাছির দলা-পাকানো মিষ্টি বের করে কোঁচড় থেকে। বলে, আজ আর ভিখ মাগা হবে না। এসো খাই।
তিনজনে হাত বাড়িয়ে খায়।
বিদ্যুৎ চমকায়, মেঘ ডাকে, বৃষ্টি পড়ে অঝোরে। ভেজা বাতাসে শিউরে শিউরে ওঠে গায়ের লোমকূপ। ব্যালাইণ্ডাদের পেটের খিদের জোর নেই, মন তাদের আনচান করে। এই বর্ষায়, মাতাল পুরুষ ব্যাঙ-এর মতো ডাকতে ইচ্ছে করে, ক্যাঁ-কোঁ, ক্যাঁ-কো। যেমন করে মেয়ে ব্যাঙটাকে সে ডাকে।
কুরচির হাত উঠে যায় বটার গায়ে। বৃষ্টির মতো ঝিমঝিম-স্বরে বলে, দেখি এটটু তোমাদের। অ, দাড়ি আছে তোমার?
বটা বলে, মানষে দ্যাখে।
সুলার ঘষা মণি দুটি স্থির। বেঁটে খাটো কালো শক্ত শরীরটা যেন পাথরের মূর্তির মত! তার স্তব্ধ পেশি ও রক্তকোষে কে যেন শব্দহীন চিৎকার করে।
কুরচির একটা হাত উঠে আসে সুলার গায়ে। প্রতি রক্তবিন্দুতে সে-স্পর্শ অনুভব করে সুলা। কুরচি বলে, তোমার দাড়ি নেই গোঁফ আছে।
সুলা বলে, মানষে দ্যাখে।
মাছের পটকার মতো বটার চোখের ড্যালা কাঁপে তিরতিরিয়ে। তার বুকের মধ্যে যেন একটি চোখ-ধাঁধানো অন্ধ চিৎকার করে, আমার গায়ে আমার গায়ে একটুখানি হাত দাও ব্যালাইণ্ডানি।
লাঠি-ধরা কড়া-পড়া শক্ত শক্ত দু হাতে দুজনেরই গায়ে হাত রাখে কানী কুরচি। বুলোয়।
সকাল গেছে, দুপুর গেছে, এবার বুঝি বিকেলও গড়ায়। বৃষ্টি কখনও ধরব-ধরব করেছে, ফিসফিস্ করে ঝরেছে, আবার এসেছে মুষলধারে। থামে নি।
কানী কুরচি দুজনের মাঝখানে জায়গা করে নেয়।
তারপরে মহাকালের ইঙ্গিতে বটা-সুলার হাত উঠে আসে কুরচির গায়ে। ওদের বুকের ভিতর থেকে কীসের একটি প্রচণ্ড স্রোত নামতে লাগল কলকল করে। যেন অন্ধকার গুহা থেকে একটি তীব্র স্রোতধারা, ভয়ঙ্কর প্লাবনের মতো ভাসিয়ে নিয়ে চলল অনেক দেশ, নদনদী, অরণ্য।
কুরচি হাসে খিলখিল করে। ব্যালাইণ্ডাদের হাত তার শরীরে ঘুরে বেড়ায়। কানী কুরচি হাসে বৃষ্টির মতো ঝিরঝির করে।
তারপর কুরচির গা বেয়ে, সুলা আর বটার হাতে হাত ঠেকে যায়। এক মুহূর্তের জন্যে থেমে যায় হাত দুটি। মনে মনে কথা বলে দুজনে :
সুলা ব্যালাইণ্ডা, বড় সুখ লাগে।
বড় সুখ লাগে।
মনটা পাগল পাগল করে।
আমারো করে।
কেন করে?
মানষে জানে।
কানী কুরচি মাতালের মতো হাসে।
পাখিটা ডাকে গলা ফুলিয়ে, পিক পিকচা! মদ্দা পাখির মতো কথা বলে ব্যালাইণ্ডারা।
কুরচির গা বেয়ে বেয়ে আবার হাতে হাত ঠেকে যায় বটা-সুলার। এক মুহূর্ত। আবার সরিয়ে নেয়। আবার ঠেকে, আবার সরায়।
রুদ্ধশ্বাস, অপলক চোখ শুধু মহাকালের।
আবার ঠেকে যায়, আবার সরায়।
তারপর আবার ঠেকল। আর সেই মুহূর্তে একটা হাত আর-একটা হাতকে মুচড়ে, ঝটকা মেরে সরিয়ে দিল।
পলকের স্তব্ধতা। আর একটি হাত কুরচিকে ডিঙিয়ে ঠাস করে মারল আর-একজনকে।
শালা কানা।
কানার বাচ্চা কানা।
কুরচি লাফ দিয়ে উঠে বসে দুজনের মাঝখানে : দ্যাখ দ্যাখ কী কাণ্ড। এই ধুকপুকুনি আমার মনে ছিল গো, এই ধুকপুকুনি আমার মনে ছিল।
পাখিটা ডেকে উঠল, পিকচ পিকচ, পিকরর। হেই গো মহাকাল! এই ভয় আমার মনে ছিল, কানা দুটো ছকের মধ্যে ঘুরবে আর লড়বে।
কুরচি বলে দুজনের গায়ে দুটি হাত রেখে, এই আমি দেখলাম জীবনভর। কি চোখওলা আর কি অন্ধ, সবাই এক। সবাই আমার কাছে এসেছে, সবাই লড়েছে।
দুই ব্যালাইণ্ডা কুরচি দু পাশে, মাথা নিচু করে বসে থাকে। দেখে মনে হয় তারা লড়েনি, আর কেউ লড়েছে। তাদের ভাবলেশহীন মুখ দেখে মনে হয়, দুটি অনড় নিশ্চল পাথরের চাঁই।
কেবল মনে মনে বলে, আমরা ব্যালাইণ্ডা। আমরা কানা। আমরা মানুষের মতন কইরতেছি।
কুরচি সোহাগী সুরে অভিমান করে বলে, এই আমি জীবনভর দেখলাম। ভাগাভাগি চাস তোরা। তবে আমার হাত কেটে নে, পা কেটে নে, আমার শরীল কেটে নে।
ব্যালাইণ্ডারা নীরব। ঘষা চোখের মণি আর মাছের পটকা ড্যালা নড়াচড়া করে। কুরচি দুজনের গায়ে হাত বুলোয়, ঠোঁট ফুলিয়ে বলে, আমাকে কেন ভাগ করিস। আমি তো দুজনার কাছেই এসেছি, তোদের দুজনারে পাব বলে।–মাটি নয়, জল নয়, আকাশ নয় কুরচি। মেয়েমানুষ। কিন্তু কথা বলে অন্যরকম। যেন এই পৃথিবীর মানুষের মতো কথা নয়। যেন আর এক পৃথিবী থেকে এসেছে সে।
ব্যালাইণ্ডারা মাথা নিচু করে বসে থাকে। কুরচি দুজনাকে কাছে টেনে বলে, আমরা ব্যালাইণ্ডা, আয় শুয়ে পড়ি, রাত হয়ে আসছে।
পাখিটা ডেকে বলে, ফিক ফিক ফিকুর। ঠিক বলেছিস ব্যালাইণ্ডানি।
সন্ধ্যার প্রাক্কালে বুঝি কখন বৃষ্টি ধরেছিল একবার। আবার ঝরতে আরম্ভ করেছে। তবে মুষলধারে নয়, টিপটিপ করে। বাতাসে ঝড়ের সংকেত। জোড়-খোলা টিনটা বড় বেশি গুমগুম করছে।
বাজারের কোলাহল এখান থেকে সামান্যই শোনা যায়। আজ সারাদিনই প্রায় স্তব্ধতা গেছে। সারাদিন ডেকেছে শুধু কুকুরেরা। ইছামতীর জল ঘোলা হয়েছে। সেই ঘোলা জলে হিংস্র কামট ঘুরছে খাবারের সন্ধানে।
রুদ্ধশ্বাস মহাকাল এসে দাঁড়িয়েছে গুদামঘরের মধ্যে। সুলা আর বটার হাত ধরে তুলে এনেছে সে কুরচির গায়ে।
কুরচি হাসে নিস্তব্ধ মধ্যরাতের টিপটি বর্ষার মতো। একবার এর দিকে ফেরে, আর একবার ওর দিকে।
আকাশ বৃষ্টি ঢালে কোটি কোটি বছর ধরে, তবু আগ্নেয়গিরি কোনওদিন নেভে না। গুদামের কোণে রক্তে রক্তে আগুন জ্বলছে দাউ দাউ করে।
আবার হাতে হাত ঠেকে যায়। দ্বিতীয়বারের অপেক্ষা থাকে না আর। আগের চেয়েও প্রচণ্ড বেগে, দুজনে আঘাত ও প্রত্যাঘাত করে কুরচিকে ডিঙিয়ে।
কুরচি চিৎকার করে উঠে বসে, থাম। ওরে মরণেরা, আমার মরণেরা, তোরা থাম, থাম।
পাখিটা ডেকে ওঠে, পিকরর পিকরর। মহাকাল! আমার ভয় করছে।
ব্যালাইণ্ডারা থামে। থেমে হাঁপায় দুজনে। কিন্তু মনে মনে আর কথা বলে না। ভিতরে ভিতরে ওদের সমস্ত সন্ধি ভেঙে গেছে।
কুরচির আমন্ত্রণের অপেক্ষাও রাখতে চায় না দুজনে আর। আবার হাত বাড়ায় দুজনে। আবার ধুপধাপ শব্দ হয় মারামারির।
কুরচি লাঠি নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। দাঁতে দাঁত চেপে কেঁদে কেঁদে বলে, এমনি করে মরিস তোরা চেরদিন। তবে মর, তোরা মর, আমি চলে যাই। কুরচি লাঠি ঠুকে ঠুকে বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে যায়। বকবক করতে করতে। লাঠি ঠুকে ঠুকে গিয়ে ওঠে রাস্তার ওপারের একটা গুদামে।
ব্যালাইণ্ডা দুটো দাঁড়িয়ে থাকে স্তব্ধ হয়ে। কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর ব্যর্থ আক্রোশে সুলা বটাকে নিশানা করে হঠাৎ লাঠির খোঁচা মারে।
উঃ!
চাপা আর্তনাদের সঙ্গে সঙ্গে বটা সামনের দিকে লাঠি দিয়ে আঘাত করে। অব্যর্থ সন্ধান অন্ধের। আঘাত খেয়ে সুলা চিৎকার করে সরে যায়। বটাও সরে যায়।
তারপর দুজনেই নিশ্বাস চাপবার চেষ্টা করে হাঁপাতে থাকে।
পাখিটা চিৎকার করে ওঠে, পিকচু পিকচু, পি পি, পিকসা। মহাকাল, ওরা কানা, ওদের থামাও গো, থামাও।
মহাকাল মেঘস্বরে বলে, তা হয় না। কাল নিরবধি, সে থামে না।
.
রাত পোহায়। বৃষ্টি থেমেছে। ব্যালাইণ্ডারা বেরোয় ভিক্ষে করতে। ওদের অন্ধ চোখে মুখে কোথাও নতুন কোনও ছাপ পড়ে না। সেই একই অসহায়, করুণ, অন্ধ দুটি মানুষ।
কলকাতার গাড়ি আসে। দুজনে দু পাশ থেকে চিৎকার করতে যায়। তার আগেই কানী কুরচির সরু গলা করুণ সুরে বেজে ওঠে।
কিছুক্ষণ থেমে যায় দুজনেই। তারপর দুজনেই দু দিক থেকে মাগতে শুরু করে। চিৎকার করে মাগে বটা :
ভগমান
অন্ধজনে কর ত্রাণ।
সুলা বলে, এই বিড়ালটারে দ্যান, কুত্তাটারে দ্যান, শিয়ালটারে দ্যান, ব্যালাইণ্ডারে দ্যান, হেই বাবা!
সারাদিন মাগে, দুজনে গাছতলায় যায়। কিন্তু কথা বলে না। ওদের কথা না বলাটা লোকের চোখে পড়ে না একটুও। কারুর কোনও কৌতূহল নেই। কানী কুরচি শুধু ওদের কাছে পেলে অভিমান করে বলে ওঠে, তোদের কাছে যেতে গেলাম, তোরা আমারে তাড়িয়ে দিলি। তোরা কানা, তবু তোরা পাষাণ।
সারাদিন পরে বাজার ঝিমিয়ে আসে। ছ-টার সময় বাস বন্ধ হয়ে যায়। বাতি জ্বলে এদিকে-ওদিকে।
তিনটে লাঠিরই চুক চুক শব্দ গুদামঘরগুলির দিকে এগিয়ে যায় বাজার থেকে। ঠুকঠুকঠুকঠুকঠুকঠুক। অনেকখানি দূরে দূরে ছাড়া-ছাড়া শব্দ। পাশাপাশি কেউ নয়।
সারাদিন বৃষ্টি হয় নি। দুপুরের দিকে রোদও উঠেছিল। এখন আকাশে ছড়ানো ছড়ানো মেঘ।
ইছামতীর জলে ভাঁটার ঢালের কলকল শব্দ।
কুরচি থামে। সুলা-বটার ঠুকঠুকুনিও থামে।
কুরচি চাপা মিষ্টি ব্যাকুলস্বরে বলে, কেন তোরা লড়িস। তোরা ব্যালাইণ্ডা, আমি তোদের দুজনকার, আমার কাছে আয়। তোদের মন যা চায়, আমার কাছে আছে। মন ঠাণ্ডা করে আয় আমার ঘরটায়। তোদের ঘরটায় আমি যাব না।
কুরচি লাঠি ঠুকে ঠুকে যেতে যেতেও ডাকে, আয়, মরণ দুটো আয়।
ব্যালাইণ্ডারা যুগপৎ লাঠি ঠুকে ঠুকে আর-একটা গুদামঘরে আসে।
কুরচি ডাকে, আয়, এই যে এদিকে, কাঠ পাতা আছে।
দুজনে যায়, আস্তে আস্তে, অনেকখানি দূরত্ব রেখে।
আসছিস? আয় আয়।
কুরচি যেন খুশিতে হাসে চাপা গলায়। নাক-চোখ-মুখহীন দুটি বিচিত্র জীবের মতো ব্যালাইণ্ডারা গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে কাছে এগোয় কুরচির। কুরচির গন্ধ শোঁকে না, ব্যালাইণ্ডারা পরস্পরের গন্ধ শোঁকে। দূরত্ব আঁচ করে। শক্ত শরীরে টিপে টিপে যেন আক্রমণের ভয়ে এগোয় অন্ধ দুটো। অদৃশ্যেও যেন ব্যর্থ না হয় লক্ষ্য।
কুরচি হাত বাড়ায়। বাড়িয়ে, দুজনকেই ধরে। আয়, আয়, বোস।
ওপাশের ঘর থেকে পাখিটা ডেকে মরছিল, পিকচি পিকচি, পিকরর, পিকরর। মহাকাল, সর্বনাশের জন্য তুমি আমার চোখের সামনে থেকে ওদের নিয়ে গেলে।
মহাকালের শোনবারও সময় নেই আর। এখন তার সেই গতি, যে-গতিকে মানুষ চেনবার আগে, বুদ্ধি দিয়ে বোঝবার আগে, কাল চলে যায় ঝড়ের বেগে।
সুলা দু হাতে সাপটে ধরল কুরচিকে। বটা কুরচিকে ধরতে গিয়ে, সুলার বাঁধন খুলে দিতে চাইল।
সুলা চিৎকার করে উঠল, না।
বটা মুহূর্তে না শব্দটার মুখের ওপর সমস্ত শক্তি দিয়ে ঘুষি মারল।
সুলা চিৎকার করে উঠল, আ!
চিৎকার করতে করতেই সুলা কুরচিকে ছেড়ে কঠিন হাতে জড়িয়ে ধরল বটাকে। দুজনেই জাপটাজাপটি করে আছড়ে পড়ল মাটিতে। কতগুলি চাপা হুঙ্কার, আর মাঝে মাঝে দুটি মত্ত হস্তীর মাটিতে আছড়ে পড়ার ধুপধাপ শব্দ। তার সঙ্গে কানী কুরচির আর্তনাদ, মরছে, হে ভগমান, কানা দুটো মরছে। আমি পালাই গো, আমি পালাই।
দুজনেই গিয়ে বেড়ার টিনে পড়ল হুড়মুড় করে। দুটো কুকুর ঘেউ ঘেউ করে ছুটে এল গুদামঘরের দিকে। এসে, অন্ধকারে কানাদের লড়াই দেখে আরও জোরে ডাকতে লাগল, ঘেউ ঘেউ ঘেউ।
হঠাৎ দুজনে ছিটকে পড়ল দুদিকে পরস্পরের ধাক্কায়। তারপর স্তব্ধ। শুধু ঘন ঘন নিশ্বাসের শব্দ।
মহাকাল নির্বিকার, নিয়মের দণ্ড সে নামায় না।
কানী কুরচি কাঁদছে গুঙিয়ে গুঙিয়ে : ওরা বেশি কাছে কাছে থেকেছে, তাই এক দণ্ডও সইতে পারছে না। হে ভগমান!
ওপাশের ঘর থেকে পাখিটা ডাকছে, ভয়ে ভয়ে, প্রিক প্রিক, মরবে, মরবে!
মরবে, তাই মারতেই চায়। অন্ধকারের মধ্যে কী একটা শক্ত জিনিস দুম করে পড়ল টিনের বেড়ায়। একটু পরে, আর এক দিকে আর একটা। অন্ধ দুটো পরস্পরকে দূর থেকে গুদামে পড়ে-থাকা ভারী কাঠের টুকরো ছুড়ে মারছে।
কুরচি চাপাকান্নায় ফিস্ ফিস্ করছে, লড়ছে এখনও লড়ছে, এবার মরবে। পালাই, আমি পালাই।
লাঠি ঠুকে ঠুকে বেরিয়ে যায় কুরচি। তার লাঠিঠোকার শব্দটা শোনার জন্যে এক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়ায় ব্যালাইণ্ডারা। তারপরে আবার ওঁত পাতে।
ইতিমধ্যে বাতাসটা একটু কমে এসেছে। মেঘ দল পাকাচ্ছে আবার।
রাত পোহাল। কলকাতার গাড়ি আসে। রাস্তার উপরে দেখা যায় দুই ব্যালাইণ্ডাকে। দেখে ওদের কিছু বোঝা যায় না। সেই চিরকালের অসহায় দুটি অন্ধ, দুটি কানা ভিখারি। লোকে চেয়ে দেখল না, কোথাও ওদের ঠোঁটের কশ কেটে গেছে, মাথা গেছে ফুলে।
ওরা মাগল, কানী কুরচি মাগল।
ব্যালাইণ্ডারা গাছতলায় গিয়ে বসল। কথা বলল না। কথা ওরা আর কোনওদিন বলবে না। কিন্তু কানী কুরচি ওদের সঙ্গে একটি কথাও বলল না আজ। একবারও অভিমান করল না।
সন্ধ্যা ঘনাল আবার। অন্ধকার নেমে এল গুড়ি মেরে মেরে, হিংস্র কামটসংকুল ইছামতীর কূল বেয়ে বন ও ঝুপসিঝাড়ের কোল ঘেঁষে ঘেঁষে।
কিন্তু কানী কুরচি আর সুলা-বটা আজ সরে গেছে পরস্পরের কাছ থেকে। ঘোর সন্ধ্যার অনেক আগেই কানী কুরচি সরে পড়েছে।
প্রথম চমক ভেঙেছিল সুলার। তা ছাড়া ওর ঝুলঝাপ্পা ছেঁড়া জামার ভিতরে, বুকের কাছে জ্বালা করছে বড়। বটা কামড়েছে, বোধহয় মাংস তুলে নিয়ে গেছে। বটার কাছ থেকে এক সময়ে সরে গেল সে। আস্তে আস্তে লাঠি ঠুকে ঠুকে চলে গেল গুদামের কাছে। এসে চাটাইয়ের ওপর হাতড়াল। কুরচি নেই। ওপাশের ঘরটায় গেল। কাঠের পাটাতন হাতড়াল, কুরচি উধাও।
বাতাস নেই, শুধু মেঘ। অন্ধকারে জোনাকিরা ব্যাকুল হয়ে উড়ছে। শুধু ইছামতীর ছলছলানি আর পাখিটার ডাক শোনা যাচ্ছে, পিকপিক পিকচা পিকচা! মহাকাল, ভয় করছে গো, আমার ভয় করছে।
এই অন্ধকারের মতো অপলক-চক্ষু মহাকাল পল গুনছে। সময় নেই, সময় নেই, এই অন্ধলীলা ত্বরান্বিত করতে হবে।
আবার বেরিয়ে এল সুলা। কুরচি নেই। বটাকেও ফেলে এসেছে। কিন্তু বুকটা জ্বালা করে। সুলা এগিয়ে গেল আরও পুবে। আরও অনেকগুলি গুদামঘর বেওয়ারিশ পড়ে আছে। তারই একটার মধ্যে ঢুকে, সুলা উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে।
তারপরে আসে বটা। সুলা পলাতক। কুরচির কোনও পাত্তা নেই। তলপেটের কাছে একটা ভীষণ ব্যথা তার। সুলা অনেকগুলি ঘুষি মেরেছে। একটু ঝুঁকে চলতে হচ্ছে বটাকে। কিন্তু আক্রোশে ও সন্দেহে জ্বলছে বটা। দুজনে পালিয়েছে?
প্রথমে নিজেদের ঘরটায় ঢুকল বটা। নেই সেখানে কেউ।
পাখিটা আতঙ্কে ডেকে উঠল, পিক পিক, পিকচা। ব্যালাইণ্ডা যাসনে। ওপাশের ঘরটায় গিয়ে উঠল বটা। কাঠের পাটাতন দেখল, কেউ নেই। বেরিয়ে এল বটা। ফিরে গিয়ে দাঁড়াল পুরনো ঘরটার কাছে। ঢুকতে গিয়ে থমকে গেল। টুক টুক শব্দ শোনা যায়। শব্দটা এগিয়ে আসছে। দুটো ঘরের মাঝামাঝি এসে থামল শব্দটা।
বটার বিশ্বাস হল, কানী কুরচি। আক্রমণের ভয়ে যথেষ্ট শক্ত হয়ে সে বলল, কুরচি ব্যালাইণ্ডানি নাকি গো?
কানী কুরচিই। কিন্তু ঘৃণায় সে কোনও জবাব দিল না। লাঠি ঠুক টুক করে সে নিজের ঘরটায় গিয়ে ঢুকল।
দাঁতে দাঁত চাপল বটা। কথা যখন নেই, তখন সুলাকানা নিশ্চয়। সেও আর কোনও কথা না বলে, চাটাইয়ের ওপর গিয়ে বসল। কিন্তু বসতে পারল না, আবার উঠল। মহাকাল ওকে টেনে তুলল। সে-ই ব্যালাইণ্ডাদের বার করে এনেছে তাদের গোষ্ঠী-নির্ভর ভীরু অন্ধকার গুহা থেকে।
বটা আসে বাইরে। এসে দাঁড়ায় মেঘ-অন্ধকার আকাশের নীচে। শেয়াল একটা প্রায় শুঁকেই যায় ওকে। ক্রুদ্ধ মানুষের গায়ের গন্ধ পায় পশুরা। শেয়ালটা পালায়। জোনাকিরা গায়ে বসে তার।
পাখিটার স্বর যেন ভেঙে গেছে। মাঝে মাঝে ডাকছে, পিক…পিক..
হঠাৎ বটা মাথা ঝাড়া দিয়ে সোজা হবার চেষ্টা করল। লাঠি টিপে টিপে ফেলে ওপাশের ঘরটায় গিয়ে উঠল সে। হামা দিয়ে দিয়ে এগোল কাঠের পাটাতনের দিকে।
বটার রক্তে আগুনের দপদপানি। সমস্ত অনুভূতি হারিয়েছে তার। শুধু কানে শুনতে পাচ্ছে নিশ্বাসের শব্দ। সুলার নিশ্বাস। আরও কাছে এল, আরও। তারপর অন্ধটা অব্যর্থ নিশানায় দু হাতে টিপে ধরে নিশ্বাসটা বন্ধ করল কুরচির। প্রচণ্ড শক্তিতে, শব্দের আগে, একবার নড়ে ওঠবারও আগে। যখন বুঝল, সব শেষ হয়েছে, তখন আস্তে আস্তে হাতটা শিথিল করল বটা। শিথিল হাতটা সরাতে গিয়ে কুরচির বুকে হাত পড়ল বটার। আর একটা হাত তার শণনুড়ি চুলে।
আর নিজের গলায় দুটো হাত চেপে বটা চিৎকার করে উঠল, কথাহীন, সুরহীন, তীরবিদ্ধ একটা বুনো শুয়োরের মতো। লাঠিটা কুড়িয়ে প্রায় হামা দিতে দিতে বেরিয়ে গেল বাইরে। ঘরের পিছনে, নদীর ধারে।
ঠিক একইভাবে, সুলা ফিরে এসেছে পুবের গুদামঘর থেকে। টিপে টিপে গেছে পুরনো ঘরের চাটাইয়ের কাছে। কোনও সাড়া পায় নি। শব্দ পায় নি কোনও নিশ্বাসের।
ফিরে গেছে ওপাশের ঘরটায়। কোনও শব্দ নেই। প্রায় হামা দিয়ে দিয়ে গেল কাঠের পাটাতনের কাছে। হাতে ঠেকল দুটি পা। হাতটা পিলপিল করে উঠল গা বেয়ে। যা সন্দেহ করেছিল। কুরচি! কানী কুরচি! ব্যালাইণ্ডানি! আরও ওপরে হাতে তুলল। কুরচি। পুরোপুরি কুরচি।
এক মুহূর্ত সময় না দিয়ে দু হাতে সাপটে ধরে সুলা ঝাঁপিয়ে পড়ল কুরচির উপর। অন্ধকার ঝোড়ো উন্মাদ কয়েক মুহূর্ত! পেয়েছি, পেয়েছি! সুলার রক্ত থেকে সেই উত্তেজিত রুদ্ধশ্বাস উল্লসিত দুর্জয় মুহূর্তটি কাটবামাত্র, সে থমকে গেল। নাড়া দিল কুরচিকে। ফিসফিসিয়ে ডাকল, কুরচি, ব্যালাইণ্ডানি।
মরা ব্যালাইণ্ডানি অনড় নিশব্দ। সুলা কুরচির বুকে কান পাতল। ধুকধুকি বন্ধ। নাকের কাছে হাত নিয়ে গেল। উষ্ণ নিশ্বাস নেই। মুখে হাত দিল, কুরচির মুখ হাঁ করে আছে।
সুলা চাপা গলায় চিৎকার করে উঠল, মরা, মরা।
সেও ছুটে গেল ঘরের পিছনে নদীর ধারে।
দুজনেই শুনতে পেল দুজনের চাপা চিৎকার। চিৎকার নয়, কান্না। ভাষাহীন, সুরহীন কান্না! মহাকাল হাসল। পাখিটা চিৎকার করতে লাগল, পিক পিক পিকর পিকর।
মহাকাল, এ কী করলে গো, এ কান্না যে থামবে না।
.
থামল না সে কান্না কোনওদিন। তারপর ওরা ভিক্ষে করে। কুরচির মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে। খুনিকে খুঁজে পাওয়া যায় নি। জন্মান্ধদের কেউ সন্দেহ করতেও পারেনি।
ওরা ভিক্ষে করে। তারপর রাত্রে ফিরে এসে কাঁদে, ভাষাহীন, সুরহীন গলায়। পাখিটা কাঁদে, পিক পিক পিক পিক। এ কান্না কোনওদিন থামবে না। কোনওদিন না।