মহামিলন
মানুষের মেলা বইয়ের মেলায়। আমরা শহরবাসীরা প্রতীক্ষায় থাকি, কবে হবে, বনভোজনের মতো সেই মনভোজন। গ্রন্থমেলা আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে গেছে। প্রতি বছর না হলে খারাপ লাগবে। সাহিত্যের যত সম্ভার, যত ফসল, দুটি সময়েই নামে—দুর্গাপুজোয় আর বইমেলায়। এ যেন সাহিত্যের আমন আর আউস। বইমেলার আগে ব্যস্ত হয়ে পড়েন প্রকাশক-কুল, আর পুজোর আগে মাথা তোলার অবকাশ থাকে না পত্র-পত্রিকার সম্পাদকবর্গের। মা দুর্গা আসেন সরস্বতীর হাত ধরে। আর বইমেলায় মা সরস্বতী আসেন লক্ষ্মীকে সঙ্গে নিয়ে। নামিদামি লেখকরা হলেন গণেশ। সঙ্গে বাহন ইঁদুর। অতিশয় তাৎপর্যপূর্ণ এই সম্মিলন। কিছু বই বাজারে কাটে, কিছু কাটে ইঁদুরে।
এত বই, এত রকমের বই একসঙ্গে দেখার সুযোগ যাঁরা করে দেন, তাঁরা সংস্কৃতির দূত। আমাদের কজনই বা সারা বছর নিয়ম মতো কলেজস্ট্রিট পাড়ার প্রকাশকদের ঘরে -ঘরে ঘোরার সময় পান। আমাদের জীবন তো এই বিলাসিতা প্রশ্রয় দেবে না। সারাটা বছর তো আমরা ছিঁচকে চোরের মতো ছাঁচড়া ব্যাপারেই মেতে থাকব। চাল, ডাল, তেল, গম, কেরোসিন, গ্যাস, হাঁচি, কাশি, টিকটিকি, আষ্টে-পৃষ্ঠে বটপাতার আঠা-জড়ানো উদভ্রান্ত জীবন। আয়ের মশারিতে ধারের তাপ্পি। বই কিনব? না, ব্যামোর ওষুধ? লোক-লৌকিকতা, গোদের ওপর বিষফোড়া।
বইমেলা একটা মহৎ উপলক্ষ। বাঁশি বাজিয়ে টেনে আনে মানুষকে। কে আছ কোথায়, ছুটে এসো সবে। মানুষ যখন বিদেশ ভ্রমণে যায়, তখন তার যেমন খরচের তেমন কোনও হিসেব থাকে না, বইমেলাতেও আমরা সেইরকম একটু বেহিসেবি হয়ে পড়ি। বইয়ের আকর্ষণ অপ্রতিরোধ্য। বই যেন সুন্দরী রমণী। ফিরে তাকাতেই হবে। একটু স্পর্শ। একটু গন্ধ। অবশেষে যা থাকে বরাতে, কিনেই ফেলি। কয়েক দিন হাঁড়ি না হয় না-ই চড়ল। শুধুই না হয় ডাল-ভাত হবে। মনকে খাওয়াতে গেলে পেট উপবাসী থাকবে। তাই থাক। কচু, ঘেঁচু আছেই সারাটা জীবন। মনের ভিটামিন হল বই। বইমেলায় ঢোকা মাত্রই, গানের দুটো লাইনের মতো ভাব হয়; হৃদকমলে বড় ধুম লেগেছে। জ্ঞানের কপাট গেছে খুলে। মনের সব জানালা দরজা খুলে যায়।
আগে মনে হত, পরচর্চাই বুঝি একমাত্র চর্চা। এখন দেখছি, জ্ঞানচর্চা কিছু কম যায় না। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের জ্ঞানী, গুণীজন। নিভৃত, নিরালায় বসে কী কাণ্ডই না করছেন। সাহিত্যে, বিজ্ঞানে, দর্শনে। আমরা যেসময় ছাত্র ছিলুম, তখন এমন সুযোগ ছিল না। এখন ভয় হয় আর সময় কোথায়, এত সব পড়ার! ডাক এল বলে! একটা অতৃপ্তি নিয়ে চির-বিদায়। একালের যারা শিশু, তারা কি ভাগ্যবান। তাদের জন্যে কত রকমের, কত ধরনের বই আসে। বেশির ভাগই অবশ্য বিদেশি। আমাদের আমলে পাঠ্যতালিকায় একটি মাত্রবই ছিল, যা দেখে আমরা মোহিত হয়ে যেতুম—ঈশপস ফেবলস। মসৃণ কাগজে, বড় বড় অক্ষর, পাতায়-পাতায় রঙিন ছবি। স্বপ্নের মতো। ওই বইটাই ছিল আমাদের সবেধন নীলমণি। প্রকাশক ছিলেন, ম্যাকমিলন। এ যুগের কিশোরদের জন্যে কত আয়োজন। সেদিন একটা বই দেখছিলাম, দি বেস্ট বুক অফ নার্সারি রাইমস। বড় আকারের বই। ছবিতে-ছবিতে ছয়লাপ। ছবি এঁকেছেন বিখ্যাত শিল্পী, ক্যারোলিন দিনান। আর একটি বই দেখলাম, ফেমিলি বাইবল। লেখায় রেখায় বুঁদ করে রাখার মতো বই। পড়ুয়া কিশোররা ইচ্ছে করলে সারাটা দিন বই নিয়ে থাকতে পারে—জীবনী, ইতিহাস, সাধারণ জ্ঞান, অ্যাডভেঞ্চার, ভ্রমণ, বিজ্ঞান, কল্প-বিজ্ঞান, ঐশ্বর্যের আর শেষ নেই। তুলনায় বাংলা প্রকাশন শিশু ও কিশোর বিভাগে বিদেশিদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছে না, নানা কারণে। আমাদের কাগজ তেমন ভালো নয়। মুদ্রণে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি এলেও সকলেই তার সুযোগ নিতে পারছেন না। পাতায়-পাতায় রঙিন ছবির মানেই দাম বেড়ে যাওয়া। আমাদের অনেক সমস্যা। সাধ আছে সাধ্যি নেই। আমাদের যত সমৃদ্ধি, গল্পে, উপন্যাসে, অ্যাডভেঞ্চারে। যতটুকু চেকনাই সবই মলাটে। ভেতরটা দেখলে হতাশই হতে হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রে। ভালো কাগজের যে অনেক দাম!
বড়দের জগতে উপন্যাস আর গল্পের দাপট। কবিদেরও অসীম দাপট। কবিদের প্রাণচাঞ্চল্য তুলনাহীন; কারণ কবিরা হল প্রজাপতি।
এই বইমেলায় বিভিন্ন প্রকাশক ও পুস্তক ব্যবসায়ীর ভাণ্ডার থেকে এমন সব বই বেরিয়ে আসে, যা সহজে পাওয়া যায় না। কোথাও ছিল আত্মগোপন করে। অতীত বাঙালির বিস্মৃত লেখকের সারস্বতচর্চা। মৃতের আর জীবিতের এমন মহামিলন আর কোথায় পাওয়া যাবে? যাঁদের মাথা থেকে এমন একটি পরিকল্পনা বেরিয়েছিল তাঁদের সহস্র ধন্যবাদ।
প্রকাশক, লেখক ও পাঠকের ত্রিবেণীধারার একপাশে দাঁড়িয়ে মনে হয়, এখনও মরেনি, বেঁচে আছে মানুষের সংস্কৃতি। লোভের পৃথিবী, হিংসার পৃথিবী, জাতি-বিদ্বেষের পৃথিবী, ধর্মীয় হানাহানির পৃথিবী পড়ে থাক বাইরে। ঢুকে যাই চিন্তা আর ভাবনার শাশ্বত জগতে। খুঁজে দেখি সৃষ্টির মহাপ্রাসাদ থেকে ইতর জনের জন্যে কি মহাপ্রসাদ নেমে এল দুই মলাটের ভিতরে অক্ষরমালায়। দেখি সেই বইটি হঠাৎ বেরিয়ে আসে কি না—ক্ষেত্রমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা—’অভয়ের কথা’, যার অনবদ্য ভূমিকা লিখেছেন মোহিতলাল। দেখি, পাওয়া যায় কিনা অধুনা দুষ্প্রাপ্য, শশিশেখর বসুর অসাধারণ রম্য প্রবন্ধ সংকলন। পড়ে শিখব, লেখা কাকে বলে।
প্রতি বছর যা করি, এ বছরেও তাই করব, মেলা ভেঙে যাওয়ার পর গিয়ে দাঁড়াব। না আলোর মালা, না কলকোলাহল। নির্জন প্রান্তর পড়ে আছে প্রতীক্ষা নিয়ে। সময়ের স্রোত বইবে। আবার একটি বছর পরে।