মহাভারতের মহারথ
এক । ভূমিকা
আজ ভারত স্বাধীন। ভারতের সন্তানরা এখন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতিদের সঙ্গে সমকক্ষতার দাবি করে।
কিন্তু তার এ সৌভাগ্য ছিল না মাত্র কয়েক বৎসর আগেও। পায়ে পায়ে বেজেছে কঠিন দাসত্ব-শৃঙ্খল, হৃদয়ে হৃদয়ে জেগেছে উত্তপ্ত দীর্ঘশ্বাস, কণ্ঠে কণ্ঠে ফুটেছে তীব্র হাহাকারের ধ্বনি। কী নিদারুণ যন্ত্রণার মধ্যে দিয়েই কেটে গিয়েছে প্রায় আট শতাব্দীকাল! এক-আধ নয়, কিছু কম আট শতাব্দী!
যেদিন থেকে এই চরম দুর্ভাগ্যের সূচনা, তোমাদের কাছে বলতে চাই আজ সেই অতিদুর্দিনের কাহিনি। পুরাতন দিনের পুরাতন কাহিনি, কিন্তু তার মধ্যেও খুঁজে পাবে নতুন করে ভাববার কথা। তাই তা চিরস্মরণীয়।
ভারত ছিল গরীয়ান এবং বাহুবলে বলীয়ান। কিন্তু তবু কেন সে বঞ্চিত হল স্বাধীনতার পরম সম্পদ থেকে? কেন সে পরতে বাধ্য হল গোলামির চাপরাশ?
প্রধান কারণ হচ্ছে, অনৈক্য। এই পুরাতন অনৈক্য-ব্যাধির জন্যেই ভারতকে বারংবার বিপদগ্রস্ত হতে হয়েছে যুগে যুগে। পাছে ঐক্যের বীজমন্ত্র ভুলে অসামান্য কৃচ্ছ্রসাধনের পর অর্জিত দুর্লভ স্বাধীনতার মর্যাদা আবার আমরা নষ্ট করি, তাই এই নতুন যুগের নতুন সূর্যের আলোকে তোমাদের সামনে আবার নতুন করে তুলে ধরলুম সেই পুরাতন ঐতিহাসিক চিত্র।
দুই । আমাদের নায়ক
প্রথমেই কাহিনির নায়ক পৃথ্বীরাজ এবং তাঁর বংশপরিচয়টা দিয়ে রাখি। তাঁর আর এক ডাকনাম হচ্ছে রায় পিযোরা। রাজপুত চৌহান বংশে তাঁর জন্ম।
অনলদেব ছিলেন আজমিরের রাজা। তাঁর তিন পুত্রের নাম জগদেব, বিশালদেব ও সোমেশ্বর।
জগদেবের পর সিংহাসন অধিকার করেন বিশালদেব (১১৫৩-৬৪ খ্রিস্টাব্দ)। তিনি ছিলেন প্রখ্যাত যোদ্ধা। চৌহান বংশের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথমে অস্ত্রধারণ করেছিলন মুসলমান বহিঃশত্রুর বিরুদ্ধে। তিনি দিল্লি দখল করেন এবং নিজের রাজ্যসীমা বিস্তৃত করেন হিমালয়ের পাদদেশ থেকে বিন্ধ্য পর্বতমালা পর্যন্ত। কেবল যোদ্ধা নন, তিনি ছিলেন সুকবি। তাঁর রচিত ‘হরিকেলি নাটক’ আজও পাওয়া যায়।
বিশালদেবের মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসেন ছোট ভাই সোমেশ্বর (১১৭০-৭৭ খ্রিস্টাব্দ)। পৃথ্বীরাজ তাঁরই বড় ছেলে ও সিংহাসনের অধিকারী।
পৃথ্বীরাজ ছিলেন তখনকার আর্যাবর্তে অতুলনীয় যোদ্ধা। চিরদিনেরই রাজধর্ম হচ্ছে, অন্যের রাজ্য কেড়ে নেওয়া। তিনিও সেই ধর্ম পালন করতে ইতস্তত করেননি, ফলে আরও বেড়ে যায় তাঁর রাজ্যের সীমা।
তখনকার সমসাময়িক কাব্যে ও গাথায় উচ্ছ্বসিত ভাষায় পৃথ্বীরাজের মহিমা কীর্তিত হয়েছে। আজও পথেপথে তাঁর নামগান করে বেড়ায় উত্তর-ভারতের চারণ-কবির দল। তাঁর সভাকবি ছিলেন চাঁদ বার্দাই, তিনি রচনা করেছিলেন ‘পৃথ্বীরাজ-রাসৌ’ নামে বিখ্যাত মহাকাব্য। চাঁদ-কবির বংশধররা আজও যোধপুর রাজ্যে বাস করেন। অন্য কবির রচিত আর একখানি উল্লেখ্য কাব্যের নাম ‘পৃথ্বীরাজ-বিজয়।’
কিন্তু উত্তর-ভারতে তখন অন্যতম শক্তিশালী ও কোনও কোনও দিক দিয়ে প্রধান রাজা ছিলেন জয়চন্দ্র (তাঁকে জয়চাঁদ নামেও ডাকা হয়)। তিনি ছিলেন রাঠোর বংশীয় রাজপুত এবং কনৌজ ও বারাণসীর অধিপতি। বংশগৌরব, সহায়-সম্পদ ও খ্যাতি-প্রতিপত্তিতে তিনি নিজে পৃথ্বীরাজের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলেই মনে করতেন। সব ঐতিহাসিক স্বীকার না করলেও কেউ কেউ বলেন, তিনি ছিলেন পৃথ্বীরাজের আত্মীয়।
পৃথ্বীরাজের মাতার নাম কর্পূর দেবী, তিনি চেদিরাজ অনঙ্গপালের কন্যা। জয়চন্দ্রও অনঙ্গ পালের আর এক কন্যার গর্ভজাত সন্তান। একথা সত্য হলে বলতে হবে পৃথ্বীরাজ ও জয়চন্দ্র ছিলেন মাসতুতো ভাই।
কিন্তু স্বার্থে স্বার্থে সংঘাত বাধলে রাজধর্ম কোনও আত্মীয়তাই স্বীকার করে না। পৃথ্বীরাজ ও জয়চন্দ্র উভয়েই চান উত্তর-ভারতের প্রভুত্ব। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে দুইজনে অদ্বিতীয় হওয়ার চেষ্টা করলেই সর্বনাশের সূত্রপাত হয়। এখানে তাই হল।
তিন । পৃথ্বীরাজ ও জয়চন্দ্র
এখান থেকে পৃথ্বীরাজের বিবাহ পর্যন্ত আমরা যেসব ঘটনার উল্লেখ করব, তার মধ্যে কতখানি আছে ঐতিহাসিক সত্য, কবির কল্পনা বা লৌকিক কাহিনি, তা নিশ্চিতরূপে প্রমাণিত করতে গেলে অনেক তর্কবির্তকের অবতারণা করতে হবে। এ-সব নিয়ে ঐতিহাসিকদের নিজেদের ভিতরেই বহু বাগবিতণ্ডার অন্ত নেই।
পৃথ্বীরাজের কথা নিয়ে তিন শ্রেণির ঐতিহাসিকের মতামত পাওয়া যায়। হিন্দু, মুসলমান ও ইংরেজ। একজন যা বলেন, আর একজন বলেন ঠিক তার উলটো কথা। এত ঝামেলার ভিতরে গিয়ে পড়লে গল্পের মার্ধুযটুকু উবে যাবে কর্পূরের মতো। তাই ওরই মধ্যে সামঞ্জস্য রেখে আমরা পৃথ্বীরাজের কথা বলবার চেষ্টা করব।
জয়চন্দ্র নিজেকে আর্যাবর্তের একচ্ছত্র মহারাজাধিরাজ বলে পরিচিত করতে চাইতেন এবং অনেক নরপতিই ছিলেন তাঁর সমান্তরাজা। তাঁর রাজ্যের আয়তনও পৃথ্বীরাজের চেয়ে বড় ছিল এবং তাঁর পূর্বপুরুষরা অষ্টম শতাব্দী থেকেই কনোজের সিংহাসনে বসে রাজদণ্ড চালনা করে এসেছেন এবং এইজন্যে তাঁর মনে ছিল অধিকতর কৌলীন্য বা আভিজাত্যের অহঙ্কার।
পৃথ্বীরাজ যখন সিংহাসনে আরোহণ করেন, তখন থেকেই জয়চন্দ্র তাঁকে ভালো চোখে দেখতে পারতেন না। একালে আমাদের সম্ভ্রান্ত বা বনিয়াদি বংশের লোকেরা যেমন হঠাৎ বড়লোকদের আমল দিতে চান না, পৃথ্বীরাজের প্রতি তাঁর মনের ভাব ছিল অনেকটা সেইরকম। এবং এদিক দিয়ে সায় দিতেন তাঁর অধীনস্থ অন্যান্য রাজন্যবর্গও।
ওদিকে দিকে দিকে নতুন নতুন রাজ্য জয় করে আজমির ও দিল্লির রাজদণ্ডধারী পৃথ্বীরাজ নিজের খ্যাতি-প্রতিপত্তি ক্রমেই বাড়িয়ে তুলে স্বনামধন্য হয়ে উঠলেন। আধুনিক দিল্লির অনতিদূরে তিনি যে বিশাল দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন তার অস্তিত্ব আজও বিদ্যমান আছে।
তখনও পর্যন্ত আর্যাবর্তের রাজরাজড়ারা মহাভারতও রামায়ণে বর্ণিত বহু রাজনীতি অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন। পৃথ্বীরাজও পৌরাণিক দিগবিজয়ীর মত রটিয়ে দিলেন, অতঃপর তিনি করবেন মহাসমারোহে অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন।
ক্রুদ্ধ জয়চন্দ্র এ ব্যাপারটাকে মনে করলেন ভুঁইফোঁড়ের উচ্চাকাঙ্ক্ষা বা বামন হয়ে চাঁদ ধরবার চেষ্টা!
পৃথ্বীরাজের উপরে টেক্কা মারবার জন্যে তিনি রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করলেন।
এ বড় যার-তার কাজ নয়, কারণ এমন লোককে আয়োজক হতে হবে সবাই যাকে সম্রাট বলে জানে আর মানে।
আমন্ত্রণ রক্ষা করতে আসবেন যে-সব সামন্ত রাজা, তাঁদের প্রত্যেকের জন্যে নির্দিষ্ট থাকবে বিভিন্ন কর্তব্য। অর্থাৎ তাঁদের স্বীকার করতে হবে যে, যজ্ঞকর্তার সঙ্গে তাঁদের প্রভু-ভৃত্য সম্পর্ক।
যজ্ঞস্থল কনৌজ বা কান্যকুব্জে। সেখানে আগমনের জন্যে আমন্ত্রণ গেল পৃথ্বীরাজের কাছে। তাঁকে নিযুক্ত করা হয়েছে দ্বারপালের কার্যে।
আমন্ত্রণ পেয়ে পৃথ্বীরাজের মনের ভাব কীরকম হয়েছিল, আমরা এতকাল পরেও অনায়াসে তা অনুমান করতে পারি।
তিনি দিল্লি ও আজমিরের দণ্ড-মুণ্ডকর্তা, দিগবিজয়ী, অশ্বমেধযজ্ঞের অনুষ্ঠাতা মহারাজা পৃথ্বীরাজ, তাঁকে আহ্বান করা হয়েছে দ্বারবান হয়ে দ্বারপথে দাঁড়িয়ে সকলকে মাথা নুইয়ে সেলাম করবার জন্যে! এমন অভাবিত ও অপমানকর প্রস্তাবের উদ্দেশ্য বুঝতে বিলম্ব হয় না।
এর ফলে যুদ্ধ হয়ে ওঠে অনিবার্য। বিশেষত যুদ্ধেই যখন যোদ্ধার আনন্দ। আপন অমিত পরাক্রম সম্বন্ধে পৃথ্বীরাজ ছিলেন নিশ্চিত এবং তাঁর শাণিত তরবারি অলস ও কোশবদ্ধ হয়ে থাকতে ভালোবাসে না।
কিন্তু গৃহযুদ্ধ বা আত্মীয়হনন বা অন্য যে কারণেই হোক আপাতত যুদ্ধ করবার প্রবৃত্তি তাঁর হল না।
জয়চন্দ্রের আমন্ত্রণ রক্ষা করবেন না, যুদ্ধেও তিনি নারাজ, তবু আদেশ দিলেন, ‘সৈন্যগণ, প্রস্তুত হও! আমরা কান্যকুব্জের দিকে যাত্রা করব!’
—কেন?
চার । পৃথ্বীরাজের অ্যাডভেঞ্চার
পৃথ্বীরাজ যে আমন্ত্রণ রাখবেন না, এ ছিল ধরা কথা।
কিন্তু আমন্ত্রিত রাজন্যবর্গের সামনে মহারথ মহারাজা পৃথ্বীরাজকে অপমান করবার জন্যে কান্যকুব্জপতি জয়চন্দ্র ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। অতএব আগে থাকতেই সে উপায় করে রেখেছিলেন।
রাজার আদেশে মৃৎশিল্পী গড়েছিল পৃথ্বীরাজের প্রতিমূর্তি। যজ্ঞসভার তোরণে সেই নকল পৃথ্বীরাজের নিশ্চল মূর্তিকে দাঁড় করিয়ে রাখা হল দ্বারপালের মতো।
একে একে আমন্ত্রিত সামন্তরাজগণ আগমন করেন, প্রবেশপথে দণ্ডায়মান সেই প্রতিমূর্তির দিকে দৃষ্টিপাত করে ওষ্ঠাধারে ফুটিয়ে তোলেন কৌতুকহাস্য। সেইটুকুতেই যথাসম্ভব সান্ত্বনালাভ করে মূঢ় জয়চন্দ্রের আক্রোশভরা চিত্ত।
কিন্তু কেবল রাজসূয় যজ্ঞ নয়, এই সুযোগে জয়চন্দ্র করেছিলেন আর একটি বিশেষ আয়োজন।
তিনি ঘোষণা করেছেন, কান্যকুব্জের কুমারী রাজকন্যা সংযুক্তা হবেন স্বয়ংবরা। সমাগত রাজন্যবর্গের মধ্য থেকে নিজের মনের মতো পাত্র বেছে নিয়ে সংযুক্তা তাঁরই কণ্ঠে অর্পণ করবেন বরমাল্য। এও হচ্ছে প্রাচীন ভারতের চিরাচরিত প্রথা।
কিন্তু এই প্রথা রাখতে গিয়ে প্রাচীন ভারতেও বারবার তুমুল কাণ্ড বেধে গিয়েছিল, এবারও বাধল।
তরুণী রাজকন্যা সংযুক্তা—রূপবতী, গুণবতী, বুদ্ধিমতী।
ঘরে ঘরে লোকে পৃথ্বীরাজের কথা নিয়ে আলোচনা করে—শৌর্যে এবং বীর্যে, সৌন্দর্যে এবং ঐশ্বর্যে আর্যাবর্তে তিনি অনন্যসুলভ। তিনিই হচ্ছেন সংযুক্তার ধ্যানজ্ঞানপ্রাণ। স্বামীর কথা ভাবতে গেলে তাঁর কথাই মনে হয়।
লোকপরম্পরায় সেই সংবাদ পৃথ্বীরাজেরও কানে গিয়ে উঠেছে। অতএব স্বয়ংবর সভায় সংযুক্তা কী করেন দেখবার জন্যে পৃথ্বীরাজের মনে জেগেছে অতিশয় কৌতূহল এবং সেই কৌতূহল পরিতৃপ্তির জন্যেই কান্যকুব্জে তাঁর উপস্থিতি।
কিন্তু নগরের ভিতরে তিনি এসেছেন একাকী, ছদ্মবেশে, অশ্বারোহণে! নগরের বাইরে গোপনে অপেক্ষা করছে তাঁর সৈন্যসামন্ত।
স্বয়ংবর সভার বাইরে কৌতূহলী বিপুল জনতা। তারই মধ্যে পৃথ্বীরাজ। কেউ তাঁকে চিনতে পারলে না।
সারি সারি বসে আছেন দেশদেশান্তর থেকে আগত রাজার পর রাজা। কেউ বড়, কেউ ছোট, কেউ সুপুরষ, কেউ কুপুরুষ—কিন্তু সকলেরই মনে এক আশা, বরমাল্য লাভ করবেন তিনিই।
এগিয়ে এলেন সুন্দরী সংযুক্তা, হাতে তাঁর টাটকা ফুলের মালা। কিন্তু যাঁকে খুঁজছেন তাঁকে তিনি দেখতে পেলেন না, রাজার পর রাজাকে ছাড়িয়ে তিনি এগিয়ে গেলেন।
তারপর তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করল দ্বারপালবেশে পৃথ্বীরাজের মৃন্ময় মূর্তি।
সেই প্রতিমূর্তির কণ্ঠদেশে সংযুক্তা অর্পণ করলেন তাঁর বরমাল্য। বিনা বাক্যব্যয়ে।
সভাস্থ রাজন্যবর্গ এবং অন্যান্য সকলেই বিস্ময়-বিহ্বল! এবং কেউ ভালো করে কিছু বুঝতে না বুঝতেই সমবেত জনতার মধ্য থেকে আবির্ভূত হল এক অপূর্ব, সুদর্শন, বীর্যবন্ত মূর্তি। কবির ভাষায়—’পর্বতের চূড়া যেন সহসা প্রকাশ’!
আগন্তুক স্মিতমুখে বললেন, ‘সংযুক্তা! আমি পৃথ্বীরাজ। ওই আমার অশ্ব! এসো আমার সঙ্গে।’
সে মূর্তিকে দেখলেই চেনা যায়। সংযুক্তা চললেন তাঁর পিছনে পিছনে—যেন মন্ত্রাভিভূত হরিণী!
সংযুক্তাকে সঙ্গে নিয়ে পৃথ্বীরাজ চোখের নিমেষে ঘোড়ায় চড়ে বসলেন। ছুটল ঘোড়া—উড়ে চলল যেন পক্ষিরাজ!
এতক্ষণে সংবিৎ ফিরে পেয়ে জয়চন্দ্র সচিৎকারে গর্জন করে বলে উঠলেন, ‘চোর! দস্যু! প্রহরীগণ, ধরে আনো, বধ করো!’
পলাতকদের পশ্চাদ্ধাবন করলে দলে দলে প্রহরী ও সৈনিক। কিন্তু কাকে ধরবে—বিদ্যুৎশিখা কি ধরা যায়?
নগরের প্রত্যন্তদেশে অন্তরাল থেকে আত্মপ্রকাশ করে কাতারে কাতারে বিদেশি সৈন্য পলাতকদের ঘিরে দাঁড়াল—হাতে তাদের খড়গ, ভল্ল, তিরধনু। তারা পৃথ্বীরাজেরই অনুচর।
পলাতকদের আর ধরা হল না। সাতদিনের পথ অতিক্রম করে স্বয়ংবরবধূ সংযুক্তাকে নিয়ে পৃথ্বীরাজ উপস্থিত হলেন দিল্লি নগরে।
পৃথ্বীরাজকে অপমান করতে গিয়ে জয়চন্দ্র নিজেই হলেন অপমানিত। কন্যা সংযুক্তা হলেন শত্রুর সঙ্গে সংযুক্ত। জয়চন্দ্র দুর্জয় ক্রোধে ও দারুণ লজ্জায় মূর্চ্ছিত হয়ে পড়েছিলেন কিনা ইতিহাসে তার উল্লেখ নেই।
পাঁচ । উত্তরে আঁধি
বীরবর পৃথ্বীরাজ পেলেন মনের মতো বউ, বীরবালা সংযুক্তা পেলেন মনের মতো বর। নিশ্চিন্ত আনন্দসুন্দর জীবন, ধনধান্যে ধন্য দেশ, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে পরিতৃপ্ত প্রজাবৃন্দ।
কেবল সভাকবি চাঁদভাটই নিজের পৃষ্ঠপোষক বীররাজার স্তুতিগীতি রচনা করেন না, সারা আর্যাবর্ত মুখরিত হয়ে উঠেছে পৃথ্বীরাজের প্রশস্তিগানে।
তার ধ্বনি ও প্রতিধ্বনি সবই ভেসে আসে জয়চন্দ্রের কানে। তাই শুনে রাগে রিরি করে ওঠে তাঁর সর্বশরীর, কিন্তু নিষ্ফল আক্রোশে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ ছাড়া আর কিছুই তিনি করতে পারেন না।
যুদ্ধ? কিন্তু পৃথ্বীরাজের সঙ্গে যুদ্ধ তো জুয়াখেলার শামিল, মুখে তাচ্ছিল্য করলে কী হয়—পৃথ্বীরাজ দুর্বল নন, তাঁর সঙ্গে যুদ্ধের পরিণাম অনিশ্চিত। শেষটা কি নিজের রাজ্য নিয়ে টানাটানি পড়বে? অতএব যুদ্ধের কথা জয়চন্দ্র চেপে গেলেন।
কিন্তু ভারতবর্ষের শিয়রে উঠছিল তখন উত্তরে আঁধি।
শিকারের সন্ধান পেলে বাঘ আর ভোলে না। এক বাঘকে বধ করো, তাড়িয়ে দাও, তার বদলে হানা দিতে আসবে আবার নতুন বাঘ।
আফগানিস্তানের মুসলমানরা ভারতবর্ষের মধ্যে পেয়েছিল অগণ্য শিকারের সন্ধান। সাবুক্তিগিন ও মামুদের সঙ্গে বারংবার হানা দিয়ে ভারতের রক্ত নিঃশেষে শোষণ করে মুসলমানরা বেশ কিছু কাল (কিঞ্চিৎ অল্প দুই শতাব্দী) শান্ত হয়ে থাকতে বাধ্য হয়েছিল—কারণ তাদের নানাদিক নিয়ে মাথা ঘামাতে হত নিজেদের ঘরোয়া ঝঞ্ঝাটের জন্যে।
তারপর গজনির সাম্রাজ্য দখল করে সিহাবুদ্দিন বা মহম্মদ ঘোরির বাসনা হল, হিন্দুস্থানকেও তিনি তাঁর সাম্রাজ্যের অন্তর্গত করবেন।
পঞ্চনদের তীর পেরিয়ে মুসলমানরা দাবানলের মতো এগিয়ে আসতে লাগল হিন্দু ভারতের দিকে। এ পথে তার কতকাল আগে বিধর্মীদের পদক্ষেপ হয়েছে, সে কথা হিন্দুদের আর স্মরণ নেই।
দিকে দিকে ছুটে গেল পৃথ্বীরাজের উদাত্ত কণ্ঠধ্বনি—দেশের বিপদ, জাতির সর্বনাশ আসন্ন! ম্লেচ্ছ আসছে হিন্দুর ধ্বংস করতে! এসো আর্যগণ দলে দলে, আমার পতাকার তলায় সমবেত হও!
দিকে দিকে জাগল সাড়া। পৃথ্বীরাজের বীরবাহুর প্রতি শ্রদ্ধা নেই কার?
রাজ্যশাসন ছেড়ে ছুটে এলেন যোদ্ধা রাজার দল, সংসারধর্ম ছেড়ে ছুটে এল দেশভক্ত প্রজার দল, অসি-চর্ম-বর্ম নিয়ে প্রস্তুত হয়ে এল নিয়মিত সৈনিকের দল। ঘন ঘন জাগতে লাগল মত্ত মাতঙ্গযূথের বৃংহিত, তেজি ঘোড়াদের হ্রেষা, রথচক্রের ঘর্ঘর। পত পত ওড়ে অসংখ্য পতাকা, শূন্যতার বুক ফুঁড়ে চোখ ধাঁধায় শাণিত ইস্পাতের বিদ্যুৎকটাক্ষ, বৃহতী বাহিনীনিবেশের দিকে দিকে শোনা যায় সমবেত কণ্ঠে দৃপ্ত জয়ধ্বনি—’হর হর মহাদেব’!
পৃথ্বীরাজের আহ্বানে যে সব রাজা সাড়া দিলেন, তাঁরা হচ্ছেন অপেক্ষাকৃত নিম্নস্তরের। উত্তর-ভারতে যাঁর রাজ্য সবচেয়ে বৃহৎ, তিনি হচ্ছেন কান্যকুব্জের মহারাজা জয়চন্দ্র—মুসলমান ঐতিহাসিকরা তাঁকে বারাণসীর রাজা বলে বর্ণনা করেছেন। তাঁর তরফ থেকে সাড়া পাওয়া গেল না।
পৃথ্বীরাজের উপরে জয়চন্দ্রের জাতক্রোধ, বিশেষত স্বয়ংবরসভার দারুণ অপমান তিনি ভুলতে পারবেন না এ জীবনে। সেই ঘৃণ্য ব্যক্তিকে নায়ক বলে মেনে নিয়ে যুদ্ধযাত্রা করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব।
এখানে একটা কথা পরিষ্কার হয়ে যাওয়া দরকার।
সাধারণ ইতিহাসে জয়চন্দ্রকে দেশের শত্রু বলে দেখাবার চেষ্টা হয়। অনেকেরই মত হচ্ছে, পৃথ্বীরাজের রাজ্য আক্রমণ করবার জন্যে তিনিই নাকি মহম্মদ ঘোরিকে আহ্বান করে এনেছিলেন।
এ অভিযোগ অমূলক। অন্তত এ সম্বন্ধে নির্ভরযোগ্য প্রমাণের অভাব। এমনকী মুসলমান ঐতিহাসিকরাও এ অভিযোগ সমর্থন করেন না।
দেশের শত্রু বলতে যা বোঝায় জয়চন্দ্র তা ছিলেন না। মহম্মদ ঘোরিকে তিনি বন্ধু বলে মনে করতেন না।
তিনি কেবল এই দেখতে চেয়েছিলেন, কাঁটা দিয়ে যদি কাঁটা তোলা যায়। ভারতে তাঁর একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছেন পৃথ্বীরাজ। তার উপরে দুর্ভাগ্যক্রমে তিনি তাঁর আত্মীয়। পৃথ্বীরাজকে স্বীকার করা বা তাঁর বিপক্ষে যুদ্ধ করা, দুইই তাঁর কাছে অপ্রীতিকর। তবে মহম্মদ ঘোরির কবলে যদি এই প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীর পতন হয়, তাহলে সমগ্র আর্যাবর্তে তিনি অনায়াসেই এমন একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন, যেখানে আর কেউ তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে সাহস করবে না। তিনি হবেন সর্বময় প্রভু। তিনি হবেন একচ্ছত্র সম্রাট। এই বিপদজ্জনক যুক্তিই পরে পৃথ্বীরাজের, আর্যাবর্তের—এমনকি জয়চন্দ্রেরও সর্বনাশের কারণ হয়ে উঠেছিল। অর্থাৎ দেশের শত্রু না হয়েও শেষ পর্যন্ত তিনি দেশের শত্রুতাই করলেন—হরে দরে প্রায় একই কথা হয়ে দাঁড়ায়।
এ বিষয়ে কোনওই সন্দেহ নেই যে, জয়চন্দ্র ভেবেছিলেন অন্যান্য মুসলমান হানাদারদের মতো মহম্মদ ঘোরিও পৃথ্বীরাজের রাজ্য লুণ্ঠন করেই তুষ্ট হয়ে বিদায়গ্রহণ করবেন। তিনি আন্দাজ করতে পারেননি, এবারের ‘এ সব দৈত্য নহে তেমন’। এরা এসেছে সারা ভারতে কায়েমি বাসা বাঁধতে।
এই স্বার্থপরতা ও সংকীর্ণ নীতির জন্যেই ভারতে জয়চন্দ্রের নাম বহন করে আসছে চিরকলঙ্কের ভার।
ছয় । তারাইনের যুদ্ধ
গজনির সুলতানরা ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশ পর্যন্ত নিজেদের সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিলেন এবং তাঁদের অধঃপতনের সময়ে সে অঞ্চল আবার সাম্রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল।
সেই অংশের উপরে পুনর্বার ইসলামের পতাকা উত্তোলন করলেন মহম্মদ ঘোরি। তারপর তিনি বললেন, ‘এইবার দিল্লি চলো!’
কিন্তু তিনি জানতেন না, তখনও দিল্লি বহুদূরে! হতে পারে দিল্লির লাড্ডু লোভনীয়, কিন্তু খেতে গেলে নাকি পস্তাতে হয়।
মহম্মদ ঘোরি প্রথমে যেখানে গিয়ে হিন্দুদের রণভেরিধ্বনি শ্রবণ করলেন, সেখানে ছিল তারাইন বা তালাওয়ারি নামে গ্রাম। তারই কাছে থানেশ্বর, কুরুক্ষেত্র এবং পানিপথ। এ অঞ্চল হচ্ছে মহাভারতের প্রাচীন রণক্ষেত্র—আর্যাবর্তের আত্মা এখানে যুগে যুগে বার বার স্নান করেছে রক্তগঙ্গার ধারায়। ভারতবাসীর স্মৃতির পটে আজও লেগে আছে তার রাঙা ছোপ।
জয়চন্দ্র দেশের কাজে সাড়া দিলেন না বলে পৃথ্বীরাজ হতাশ হননি। তিনি হচ্ছেন স্বনামধন্য উদ্যোগী পুরুষ। অন্যান্য রাজপুত রাজা এবং বিপুল এক বাহিনী নিয়ে ভারতের শত্রুর অগ্রগতি রুদ্ধ করবার জন্যে নির্ভয়ে তিনি এগিয়ে এসেছেন।
মুসলমান ঐতিহাসিক ফিরিস্তা বলেন, পৃথ্বীরাজের অধীনে ছিল দুই লক্ষ অশ্বারোহী এবং তিন হাজার গজারোহী সৈন্য।
সেইখানেই ব্যূহ রচনা করে মহম্মদ ঘোরি নিজে মধ্যভাগে গিয়ে দাঁড়ালেন। কাফের বধ করবার জন্যে বেজে উঠল ইসলামের রণ-দামামা। সে হচ্ছে ১১৯১ খ্রিস্টাব্দ।
পৃথ্বীরাজের হুকুমে হিন্দুরা প্রবল বিক্রমে একসঙ্গে আক্রমণ করলে মুসলমান ব্যূহের দুই পার্শ্ব।
মুসলমানের হুঙ্কার—’আল্লা হো আকবর!’
হিন্দুর হুঙ্কার—’হর হর মহাদেব!’
ছোটে গজারোহী, ছোটে অশ্বারোহী, ছোটে পদাতিক, ছোটে বন বন বাণ, শন শন বর্শা! বাজে দম দম শত শত দামামা, বাজে ঝঞ্ঝন লক্ষ লক্ষ তরবারি, বাজে মুহুর্মুহু কোদণ্ড-টঙ্কার। সিংহনাদ! আর্তনাদ! ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত আকাশ-বাতাস! যোদ্ধাদের পদাঘাতে পৃথিবী থর-থর কম্পমান। মিশে যায় দুই দল—হিন্দু ও মুসলমান। সবুজ মাঠের উপরে বিছিয়ে যায় যেন ভয়াবহ রক্তাম্বর!
প্রথমটা—’কে হারে কে জিনে দুজনে সমান।’ তারপর দেখা গেল, হিন্দুরা বেশি এগিয়ে এসেছে এবং মুসলমানরা বেশি পিছিয়ে গিয়েছে। তারপর বোঝা গেল, ‘আল্লা হো আকবর’ ধ্বনি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর এবং ‘হর হর মহাদেব’ ধ্বনি উচ্চ থেকে উচ্চতর!
আচম্বিতে মহম্মদ ঘোরি আবিষ্কার করলেন, তাঁর চারিদিকে দেখা যায় কেবল রাজপুত যোদ্ধাদের মারমুখো মূর্তি।
কিন্তু তিনি দমলেন না, অসম সাহসে ঝাঁপিয়ে পড়লেন শত্রুদের উপরে।
সামনেই পেলেন পৃথ্বীরাজের ভাই গোবিন্দ রায়কে।
ঘোরির তরবারির এক আঘাতে উড়ে গেল গোবিন্দ রায়ের দুই দন্ত।
কিন্তু রাজপুতও মার খেয়ে মার ফিরিয়ে দিতে জানে। গোবিন্দ রায়ও শত্রুর উপরে চড়াও হয়ে তরবারি চালনা করলেন প্রচণ্ড বেগে, ঘোরি সে আঘাত রুখতে পারলেন না, বিষম চোট লাগল তাঁর হাতে—আর একটু হলেই হাতখানা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত।
মুসলমান ঐতিহাসিক মিনহাজ-উস-সিরাজ বলছেন : ‘সুলতান ঘোড়ার মুখ ফিরিয়ে পিছিয়ে এলেন, কিন্তু আহত হাতের যন্ত্রণায় তাঁর পক্ষে ঘোড়ার পিঠের উপরে বসে থাকা অসম্ভব হয়ে উঠল।
ইসলামের হল পরাজয়। তার সৈন্যগণ করলে পলায়ন।
সুলতান ঘোড়ার উপর থেকে পড়ে যাচ্ছিলেন। জনৈক যুবক ও সিংহ-হৃদয় মুসলমান সৈনিক তাঁকে চিনতে পেরে তাড়াতাড়ি তাঁর দেহ নিজের বাহুর উপরে রেখে ঘোড়াসুদ্ধ বেরিয়ে এল যুদ্ধক্ষেত্রের ভিতর থেকে।’
মুসলমানরা আর পিছু ফিরে তাকালে না, ছুটতে লাগল ক্রোশের পর ক্রোশ। তারাও যত পালায়, হিন্দুরাও তত তাড়া করে। দীর্ঘ চল্লিশ মাইল পর্যন্ত সোজা পিঠটান দিয়ে তবে মুসলমানরা হিন্দুদের কবল থেকে অব্যাহতি লাভ করেছিল।
মহম্মদ ঘোরির পরম সৌভাগ্য, রাজপুতরা তাঁকে চিনতে পারেনি। তাহলে সেই তারাইনের রণক্ষেত্রেই তাঁর ভারত-সাম্রাজ্য স্থাপনের দুরাকাঙ্ক্ষা বিলুপ্ত হয়ে যেত এবং আর্যাবর্তকে হয়তো পরতে হত না সাড়ে আঠারো শত বৎসর ধরে দাসত্বের শৃঙ্খল।
সাত । আনন্দ এবং নিরানন্দ
দেখ, দেখ! দেশের শত্রু দলন করে বিজয়ী বীর ফিরে আসছেন, বিজয়ী বীর ফিরে আসছেন।
সফলতায় উৎফুল্ল চতুরঙ্গ বাহিনীর পুরোভাগে অশ্বারোহণে পৃথ্বীরাজ যখন দিল্লির পথে প্রত্যাবর্তন করেন, সেদিন আনন্দে উচ্ছ্বসিত আবালবৃদ্ধবনিতার মুখে মুখে নিশ্চয়ই ওই একই কথা শোনা গিয়েছিল হাটে-বাটে-মাঠে বারংবার।
উথলে উঠেছিল দিগবিদিকে উন্মাদ জনতাসাগরের তরঙ্গের পর তরঙ্গভঙ্গ, বর্ষণ করেছিল লাজাঞ্জলি পুরাঙ্গনারা শঙ্খনাদের সঙ্গে, মুখরিত হয়েছিল অগণ্য জয়ঢক্কা নৃত্যশীল জয়ধ্বজার আগে-পিছে গগনভেদী জয়জয়কারের ছন্দে ছন্দে।
সেদিনেরও রাজকবি নিশ্চয়ই এই ভাব নিয়ে প্রশস্তিসংগীত রচনা করেছিলেন :
‘জনগণমন অধিনায়ক জয় হে,
ভারতভাগ্যবিধাতা!
জয় হে, জয় হে, জয় হে,
জয় জয় জয়, জয় হে!’
সেদিন কান্যকুব্জকন্যা শ্রেয়সী সংযুক্তা দিল্লির ঘরনি হয়ে মনে মনে কি বিপুল গর্বপুলক অনুভব করেননি? কী সুখে তিনি স্বামীর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, কোন পুষ্পিত ভাষায় তাঁর বীরত্বকে অভিনন্দিত করেছিলেন এবং কত আদরে তাঁর রণশ্রান্ত দেহ থেকে যুদ্ধসাজ খুলে নিয়েছিলেন, আজ আমরা কি তা অনুমান করতে পারব?
এই অপূর্ব যুদ্ধজয়ের পর পৃথ্বীরাজ যে গণ্য হলেন আর্যাবর্তের শিরোমণির মতো, সেটা উল্লেখ করা বাহুল্য মাত্র। সূর্যোদয়ের পর আকাশের আর সব গ্রহ-তারা অদৃশ্য হয়ে যায়, পৃথ্বীরাজের গৌরব-সূর্যের দিকে তাকিয়ে ভারতবাসী তাঁর আর কোনও প্রতিদ্বন্দ্বীকে দেখতে পেলে না। খ্রিস্টপূর্ব যুগে যবন গ্রিকদের তাড়িয়ে সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত ভারতের যে শ্রেষ্ঠাসনে আসীন হয়েছিলেন, পৃথ্বীরাজ আজ হলেন সেই আসনেরই অধিকারী।
পৃথ্বীরাজের মতো জামাই পেলে লোকে নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে করে। কিন্তু তার এই অতুলনীয়তায় জয়চন্দ্র মর্মে মর্মে অনুভব করলেন দুর্ভাগ্যের কশাঘাত। পূর্ণভাবে না হোক, আংশিক ভাবেও ওই গৌরবের অধিকারী হতে পারতেন তিনিও, কিন্তু পৃথ্বীরাজের সাহচর্য বর্জন করে তাত্থেকেও তিনি বঞ্চিত হয়েছেন। কেবল তাই নয়, লোকে আর তাঁকে বড় বলে মানে না এবং অনেকেই দেয় তাঁকে ধিক্কার। মন তাঁর ধিকি ধিকি জ্বলতে থাকে হিংসার আগুনে।
ওদিকে আহত মহম্মদ ঘোরি সিন্ধুনদ পার হয়ে স্বদেশে পলায়ন করলেন।
ক্রোধে ও মর্মযাতনায় তাঁর মন হয়ে উঠল একান্ত জর্জর। ইসলামের এমন শোচনীয় পরাজয় এর আগে আর কখনও হয়নি।
যে সব সৈনিক ও সেনানী কাপুরুষের মতো রণক্ষেত্র ত্যাগ করে পালিয়ে এসেছিল, সুলতান তাদের ক্ষমা করলেন না। তিনি হুকুম দিলেন, ‘ওই হতভাগ্যদের ধরে সাধারণ অপরাধীদের মতো অপমান করতে করতে পথে পথে ঘুরিয়ে আনো।’ অনেককেই বন্দি করে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হল।
তবু ঘোরির গায়ের জ্বালা যায় না। ক্ষত না সেরে ওঠা পর্যন্ত তাঁকে দায়ে পড়ে শয্যায় শুয়ে থাকতে হল বটে, কিন্তু তার পরেই আবার তিনি নিজ মূর্তি ধারণ করলেন। দৃপ্ত কণ্ঠে বললেন, ‘পরাজয়ের প্রতিশোধ না নিয়ে আমার শান্তি নেই। ইসলামের অপমান আমি সইতে পারব না। এসো তুর্কি, এসো আফগান, এসো তাতার,—অস্ত্র ধরো, প্রস্তুত হও! আবার আমরা হিন্দুস্থানে যাত্রা করব। সেখানে তোমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে প্রভূত যশ, অগাধ ঐশ্বর্য! কাফের বধ করলে প্রচুর পুণ্য, সে চেষ্টায় প্রাণ দিলেও স্বর্গলাভ! এসো তুর্কি, এসো আফগান, এসো তাতার!’
দলে দলে যোদ্ধা ইসলামের অর্ধচন্দ্রাঙ্কিত পতাকার তলায় এসে সমবেত হতে লাগল, পরাজয়ের দুশ্চিন্তা সকলেই মন থেকে মুছে ফেলেছে, তেজি ও তাজা উৎসাহ শিখায় প্রত্যেকের চিত্ত উদ্দীপ্ত।
এক লক্ষ বিশ হাজার বাছা বাছা সৈনিক নিয়ে মহম্মদ ঘোরি আবার নবোদ্যমে যাত্রা করলেন হিন্দুস্থানের দিকে।
ইতিমধ্যে কেটে গিয়েছে এক বৎসর কাল। সেটা হচ্ছে ১১৯২ খ্রিস্টাব্দ।
আট । আর্যাবর্তের মহাশ্মশানে
কবি বলেছেন—
‘পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর পন্থা, যুগযুগধাবিত যাত্রী!’
উঁচু-নীচু পথ—চলতে গিয়ে পড়ে এবং ওঠে, তবু সেই পথ ধরেই যুগে যুগে ধেয়ে আসছে যাত্রীদল।
এই পথ ছেয়ে আছে কত চূর্ণবিচূর্ণ সাম্রাজ্যের ধুলো এবং সেই ধুলোয় ধূসর হয়ে আবার নতুন সাম্রাজ্যবাদী চলতে চলতে চেঁচিয়ে বলে—এগিয়ে চল, এগিয়ে চল!
কেবল ভারতের নয়, পৃথিবীর ইতিহাস দেখিয়ে দেয় এমনি দৃষ্টান্তের পর দৃষ্টান্ত।
গ্রিক যাত্রী, শক যাত্রী ও হিন্দু যাত্রীর পর এবারে এসেছে মুসলমান যাত্রীর চলবার পালা।
‘আল্লা হো আকবর!’
সেই ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হল আজমির ও দিল্লির রাজপ্রাসাদের মহলে মহলে। রাজাও শুনলেন, প্রজারাও শুনলে। চারিদিকে আবার উঠল সাজ সাজ রব!
আবার পৃথ্বীরাজের অনাহত বাণী দিকে দিকে ছুটে গেল,—’জাগ্রত হও রাজপুত, জাগ্রত হও ক্ষত্রবীর, জাগ্রত হও আর্যপুত্রগণ! হিন্দুস্থানে আবার জাতির বৈরী, ধর্মের বৈরী, দেশের বৈরী বিধর্মীদল পদার্পণ করেছে। বহিঃশত্রুদের বাধা দেওয়ার জন্যে আবার আমি যুদ্ধযাত্রা করব—যদি আত্মরক্ষা, ধর্মরক্ষা, দেশরক্ষা করতে চাও, তবে একমত, একভাব, একপ্রাণ হয়ে সবাই হও আমার সঙ্গে আগুয়ান!’
পৃথ্বীরাজের পরীক্ষিত নেতৃত্বে ও বীরত্বে কারুর আর সন্দেহ ছিল না। রাজপুতানা থেকে দলে দলে রাজা সসৈন্যে তাঁর সঙ্গে যোগ দিতে বিলম্ব করলেন না। দেড়শতজন রাজার সাহচর্য ও সাহায্য পেয়ে পৃথ্বীরাজের বাহিনী হয়ে উঠল রীতিমতো বিশাল।
নিঃসাড় ও নিশ্চেষ্ট হয়ে রইলেন কেবল জয়চন্দ্র। উত্তর-ভারতের অধিকাংশ জুড়ে তাঁর বৃহৎ রাজ্য এবং তাঁর সৈন্যসংখ্যাও ছিল অপরিমিত। তিনিও পৃথ্বীরাজের পাশে গিয়ে দাঁড়ালে হিন্দুবাহিনী হয়ে উঠত একেবারেই দুর্ধর্ষ। জয়চন্দ্রও তা জানতেন। কিন্তু দেশপ্রেমের উপরেও ঠাঁই দিলেন তিনি আত্মাভিমান ও পারিবারিক কলহকে।
ভাবলেন, আগে তো পৃথ্বীরাজের পতন হোক, তারপর অন্য কথা। তখনও যদি বিধর্মীরা হিন্দুস্থানকে গ্রাস করতে চায়, তবে তাঁর তরবারিও অলস হয়ে থাকবে না।
সত্যসত্যই পৃথ্বীরাজের পরে এসেছিল জয়চন্দ্রের পালা এবং সত্যসত্যই তাঁর তরবারিও অলস হয়ে থাকেনি। কিন্তু ফল যা হয়েছিল ইতিহাসে তা লেখা আছে আগ্নেয় অক্ষরে।
জয়চন্দ্র এলেন না। মিত্র রাজাদের নিয়ে পৃথ্বীরাজ নিজেই বেরিয়ে পড়লেন শত্রুদের সন্ধানে।
আবার সেই তারাইনের রণক্ষেত্র।
আবার সেখানে মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ায় হিন্দু ও মুসলমান।
আবার হিন্দু ও মুসলমান হাঁকে—’হর হর মহাদেব’ এবং ‘আল্লা হো আকবর!’
আবার মুসলমান ব্যূহের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে রাজপুত অশ্বারোহিগণ।
কিন্তু মহম্মদ ঘোরির আদেশে এবারে ইসলামের ধ্বজাধারীরা অবলম্বন করেছিল নতুন রণকৌশল।
কথা ছিল, লড়াই শুরু হওয়ার পর রাজপুতরা যেই দলে দলে আক্রমণ করবে, মুসলমানরা অমনি ভয়ের ভান করে পালিয়ে যাবে দলে দলে। রাজপুতরা খানিক দূর পর্যন্ত পিছনে তাড়া করে এলে পর মুসলমানরা আবার ফিরে দাঁড়াবে।
প্রথম দৃষ্টিতে এটা নতুন রণকৌশল বলে মনে হয় বটে, কিন্তু অশ্রুতপূর্ব নয়। তার আগেও এই রণকৌশল ব্যবহৃত ও ফলপ্রদ হয়েছে। এবং তার পরেও। অধিকন্তু আজও এই কৌশল ব্যর্থ হয় না।
চিরদিনই মানুষের মন কাজ করে একইভাবে। এই তথাকথিত এবং প্রকৃত পক্ষে সেকেলে কৌশলে এখনও ঠকতে হয় বারংবার। তার কারণ যুদ্ধের সাময়িক উত্তেজনায় মানুষ মনের ঝোঁকে কাজ করে, মাথা ঘামাবার সময় পায় না।
নিজের বাছা বাছা সৈন্যদল নিয়ে ঘোরি একেবারে পিছনদিকে নিশ্চেষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। কেবল চারদল সাদি সৈন্য সামনের দিকে পাঠিয়ে দিলেন তিনি রাজপুতদের ঠকাবার জন্যে। প্রত্যেক দলে রইল দশ হাজার করে সওয়ার।
প্রভাতসূর্য হল অস্তাচলের যাত্রী। সারা দিন ধরে চলল এই নকল যুদ্ধাভিনয়। একবার মুসলমানরা বাঘের মতো তেড়ে আসে, রাজপুতদের সঙ্গে হয় তাদের খড়েগ খড়েগ পরিচয়, তারপর আবার তারা পালাতে থাকে শৃগালের মতো এবং জয় জয় নাদে আকাশ কাঁপিয়ে তাদের বহুদূর পর্যন্ত খেদিয়ে নিয়ে চলে রাজপুতগণ। আবার শত্রুরা ফিরে দাঁড়ায়, আবার পালায়। এমনি বারংবার। ক্রমাগত ছুটোছুটি করে রাজপুতরা শেষটা শ্রান্ত হয়ে পড়ল।
বারো হাজার তাজা ও বাছা অশ্বারোহী নিয়ে স্বয়ং মহম্মদ ঘোরি তখন প্রচণ্ড বেগে আক্রমণ করলেন রাজপুত ব্যূহ।
হিন্দুরা বীরের মতো বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে বটে, কিন্তু তাদের প্রত্যেকের শরীর তখন রণশ্রমে ক্লান্ত ও দুর্বল, তারা পিছু হটতে লাগল পদে পদে। দেখতে দেখতে সমগ্র শত্রু-বাহিনী আছড়ে পড়ল তাদের উপরে।
রাজপুতদের ব্যূহ ভেঙে গেল, ছত্রভঙ্গ হয়ে তারা ছড়িয়ে পড়ল। সার্থক হল ঘোরির রণকৌশল।
তারপর যা হল, বর্ণনা না করলেও চলে। একবার ব্যূহ ভেঙে গেলে কোনও সেনাপতিই শেষ রাখতে পারেন না—পৃথ্বীরাজও পারলেন না। তারপর যে হানাহানি ও হত্যাকাণ্ড আরম্ভ হল, তার মধ্যে আততায়ীর অংশগ্রহণ করলে মুসলমানরাই—রাজপুতরা হতে লাগল নিহত, আহত ও পলায়মান। হিন্দুর রক্তে ভেসে গেল রণক্ষেত্র।
আকাশের সূর্য এবং হিন্দু গৌরবসূর্য একসঙ্গে হল অস্তগত। পড়ে রইল কেবল আহতদের আর্তনাদপূর্ণ মহাশ্মশান—আর কেউ সেখানে শ্মশান-জাগানো উদাত্ত কণ্ঠে ‘হর হর মহাদেব’ বলে জয়নাদ করেনি।
পৃথ্বীরাজ ভ্রাতা গোবিন্দ রায় রণক্ষেত্রেই অন্তিম নিশ্বাস ত্যাগ করলেন।
পৃথ্বীরাজ রণক্ষেত্র ত্যাগ করলেন বটে, কিন্তু শত্রুকবল থেকে নিষ্কৃতি পেলেন না। তারা ছুটল তাঁর পিছনে পিছনে এবং সরস্বতী নদীর তীর পর্যন্ত গিয়ে তিনি হলেন বন্দি।
গ্রিক দিগবিজয়ী আলেকজান্ডার হিন্দুদের সঙ্গে যুদ্ধে জিতে মহারাজ পুরুকে বন্দি করেও মুক্তি দিয়েছিলেন।
কিন্তু তেমন উদারতা প্রকাশ করতে পারলেন না মহম্মদ ঘোরি। তিনি করলেন মহারাজ পৃথ্বীরাজের মুণ্ডচ্ছেদ।
পৃথ্বীরাজের জীবনপ্রদীপের সঙ্গে নিবে গেল আর্যাবর্তের আশার প্রদীপ। তিনিই ছিলেন মহাভারতের শেষ মহারথ।
অবশিষ্ট
আর অল্প কিছু বক্তব্য আছে।
পৃথ্বীরাজের আদরের স্বয়ংবর বধূ বীরাঙ্গনা সংযুক্তা তাঁর আদর্শ স্বামীর মৃত্যুশোক সহ্য করতে পারেননি। তিনি করলেন জ্বলন্ত চিতায় আত্মদান।
‘পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর পন্থা’য় মহাবীর পৃথ্বীরাজের প্রাণহীন দেহ হল ভূলুণ্ঠিত। তারপর দেখা গেল ইসলামের বাঁধা কর্মসূচি। হিন্দুহনন, ধর্ষণ, নগরলুণ্ঠন ও অসংখ্য মন্দির-ধ্বংসন এবং সেই ধ্বংসস্তূপের উপরে মসজিদ-গঠন। সমস্ত হিন্দুস্থান মর্মে মর্মে পৃথ্বীরাজের অভাব অনুভব করলে, কিন্তু সে অভাব পূরণ করবার দ্বিতীয় লোক নেই।
জয়চন্দ্র ভেবেছিলেন, পৃথ্বীরাজের মৃত্যুর পরে আর্যাবর্তে তিনি হবেন নিষ্কণ্টক এবং একেশ্বর। কিন্তু দুই বৎসর পরে তাঁর সেই ভ্রম ভেঙে গেল। ১১৯৪ খ্রিস্টাব্দে মহম্মদ ঘোরি কান্যকুব্জ আক্রমণ করলেন।
ধিক্কৃত জয়চন্দ্রকে সাহায্য করবার জন্যে এগিয়ে এলেন না রাজস্থানের কোনও রাজাই। যুদ্ধে তিনি পরাজিত ও নিহত হলেন। তাঁর মুকুটহীন ছিন্নমুণ্ড দেখা গেল শত্রুর বর্শাদণ্ডের উপরে।
তারপর জয়চন্দ্রের অধীন বারাণসীধামের উপরে হল মুসলমানদের প্রথম আক্রমণ। সেখানে বিধ্বস্ত হল প্রায় এক হাজার মন্দির। একহাজার চারিশত উষ্ট্রের পিঠের উপরে চাপিয়ে মহম্মদ ঘোরি নিয়ে গেলেন লুণ্ঠিত বিপুল ঐশ্বর্য।
হিন্দুদের চক্ষু সজল করে তুললে পৃথ্বীরাজের স্মৃতি। আজও সেই অক্ষয় স্মৃতি ভারতে জাগ্রত করে নতুন প্রেরণা।