মহাভারতের বিবরণ কতটা সত্য?
রাজশেখর বসু তাঁর ‘কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসকৃত মহাভারত সারানুবাদ’ গ্রন্থের ভূমিকায় মহাভারত সম্বন্ধে কয়েকটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন তুলেছিলেন, যদিও তিনি নিজে তার কোনোটারই উত্তর দেননি। উত্তর না দেওয়া সম্বন্ধে তাঁর অজুহাত ছিল- ‘প্রশ্নগুলোর আলোচনা এই ভূমিকার অধিকার বহির্ভূত। ফলে, প্রশ্নগুলো খোলা প্রশ্নই রয়ে গিয়েছে। প্রশ্নগুলো হচ্ছে— ১. মহাভারতে সত্য ঘটনার বিবরণ কতটা আছে? ২. কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধ মূলত কুরুপাঞ্চাল যুদ্ধ কি না? ৩. পাণ্ডু albino ছিলেন কি না? ৪. কুন্তীর বহুদেবতা ভজনা ও দ্রৌপদীর পঞ্চপাণ্ডবের সঙ্গে বিবাহ কোনো বহুভর্তৃক জাতির সূচনা করে কি না? ও ৫. কৃষ্ণদ্বৈপায়ন আদি মহাভারতের রচয়িতা কি না? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর আমি নিচে দিতেছি।
আমাদের প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে মহাভারতে সত্য ঘটনার বিবরণ কতটা আছে? এই রচনার শুরুতেই বলেছি রবীন্দ্রনাথের মতে মহাভারত মাত্র মহাকাব্য নয়, ইতিহাসও বটে। তাঁর কথাতেই বলি— ‘ইহা কোনো ব্যক্তিবিশেষের রচিত ইতিহাস নহে, ইহা একটি জাতির স্বরচিত স্বাভাবিক ইতিহাস।’ মহাভারত যে ইতিহাস সে-কথা মহাভারতের আদিপর্বে (১/১/২৯২৬) ‘মহাভারতসো-তিহাসস্য’ এই উক্তির দ্বারাই প্রতিভাত হয়, এবং ‘ইতিহাস’ শব্দটির সংজ্ঞার্থ সম্বন্ধে ‘মনুসংহিতা’য় (৩/২৩২) বলা হয়েছে ‘পূর্ববৃত্ত কথাযুক্তমিতিহাসংপ্ৰচক্ষতে’। সুতরাং মহাভারতের মধ্যে যে আমাদের দেশের অতি প্রাচীনকালের ইতিহাস নিবদ্ধ আছে, তা স্বীকার করেই নিতে হবে। যদি মহাভারত ইতিহাস হয়, তাহলে মহাভারতের ঘটনাসমূহ সত্য ঘটনা’ সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু রাজশেখরা বাবুর প্রশ্ন ছিল, ‘মহাভারতে সত্য ঘটনার বিবরণ কতটা?’ মুখে মুখে যে বিবরণ কয়েক হাজার বছর ধরে কীর্তিত হয়ে এসেছিল এবং পরে লিপিবদ্ধ হয়েছিল, তাতে যে অনেক অলীক বিবরণও প্রবিষ্ট হয়েছিল, তা বলা বাহুল্য মাত্র। যেমন জরায়ু ব্যতীত গান্ধরীর সন্তানসমূহ উৎপন্ন হয়েছিল, কিংবা গর্ভধারণ মাত্রই সন্তান-সন্তুতির জন্ম, কিংবা স্ত্রীরা চার-পাঁচটা কন্যা প্রসব করছে, আর সেই কন্যারা ভূমিষ্ট হয়েই নাচছে, গাইছে আর হাসছে’, এসব যে অলীক ব্যাপার তা বলা নিষ্প্রয়োজন। অনুরূপভাবে অম্বিকা পুত্ৰ উৎপাদনের সময় চোখ বুজিয়ে ছিল বলেই ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ হয়েছিল, বা অম্বালিকা কৃষ্ণদ্বৈপায়নের কৃষ্ণবর্ণ কুৎসিত চেহারা দেখে পাণ্ডুবর্ণ হয়ে গিয়েছিল বলে তার সন্তান পাণ্ডুবর্ণ হয়েছিল, এসব কথা জীববিজ্ঞানের ভাষায় আজগুবি ব্যাপার। তাই যদি হতো, তাহলে অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুন্ড্র ও সুহ্ম দেশের লোকেরা সকলেই অন্ধ হতো, কেননা তারা অন্ধ দীর্ঘতমসের ঔরসে জন্মগ্রহণ করেছিল। এরকম আরও অনেক বিবরণ মহাভারতের মধ্যে আছে, যার অলীকতা নিঃসন্দেহ। কিন্তু সে-যুক্তির দ্বারা আমরা মহাভারতের মূল বিবরণটাকে নস্যাৎ করে দিতে পারি না। সেজন্যই রবীন্দ্রনাথ অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়ের ‘সিরাজোদ্দৌলা’ বইখানা সমালোচনা করতে গিয়ে বলেছিলেন যে যুক্তির দ্বারা আমরা কোনো জনশ্রুতিকে নস্যাৎ করে দিতে পারি, কিন্তু সবসময় মনে রাখতে হবে যে প্রতি জনশ্রুতির তলদেশে কিছু সত্য আছে। মহাভারতের বিবরণের মধ্যে সে সত্য কয়টা? যে গ্রন্থ ৮০০০ শ্লোক থেকে ৮০,০০০ বা এক লক্ষ শ্লোকে পরিণত হয়েছিল, তা থেকে সে সত্য নিষ্কাষণ করা খুবই কঠিন। তবে যেগুলো সত্য বলে আমরা ধরে নিতে পারি তা হচ্ছে— ১. মহাভারত চন্দ্রবংশের ইতিহাস, এবং সে ইতিহাসের রূপরেখা মোটামুটিভাবে প্রকৃতই সন্নিবিষ্ট হয়েছে। ২. শান্তনু থেকে জনমেজয় পর্যন্ত। সেই সাতপুরুষের বংশতালিকা এতে যথাযথভাবে দেওয়া হয়েছে, কেননা পুরাণসমূহ কর্তৃক তা সমর্থিত। ৩. ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডু, এ-দুজনের গায়ের রং যে পৃথক ছিল, তা সত্য ঘটনা, যদিও এর কারণ সম্বন্ধে একটা অবৈজ্ঞানিক ও শিশুসুলভ ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। ৪. পরীক্ষিতের আমলে পাঞ্জাবে নাগ-কিরীটধারী এক জাতি বাস করত এবং সেই জাতির সঙ্গে যুদ্ধে পরীক্ষিতের নিহত হওয়া অস্বাভাবিক ঘটনা নয়, কেননা, সিন্ধুসভ্যতার এক কেন্দ্রে আমরা এক ফলক পেয়েছি যাতে নাগ- কিরীটধারী ব্যক্তিগণের প্রতিকৃতি অঙ্কিত আছে। তাছাড়া, নাগরাজ তক্ষকের রাজধানী তক্ষশিলায় ছিল, এবং তক্ষশিলা (রাওয়ালপিন্ডি জেলায়) আজও বিদ্যমান। ৫. অক্ষক্রীড়ার উপাখ্যান সত্য, কেননা, সে-যুগের লোকরা যে অক্ষক্রীড়ায় আসক্ত ছিল, তার নিদর্শনস্বরূপ অক্ষক্রীড়ার পাশা আমরা সিন্ধুসভ্যতার কেন্দ্রসমূহ থেকে পেয়েছি। অক্ষক্রীড়া প্রাচীন ভারতের এক জনপ্রিয় বাসন ছিল, এবং এই ক্রীড়ায় মত্ত হয়ে লোক স্ত্রীকে পর্যন্ত পণ রাখত, এটা কোনো বিচিত্র ব্যাপার নয়, কেননা সমসাময়িক কলকাতার সংবাদপত্রে আমরা পড়ি যে উনবিংশ শতাব্দীতেও ব্যসনক্রীড়ায় স্ত্রীকে পণ রাখা হচ্ছে। ৬. কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ প্রাচীন ভারতের কোনো এক যুদ্ধের প্রতিধ্বনি মাত্র বহন করে (পরে দেখুন)। ৭. যুধিষ্ঠিরের সশরীরের স্বর্গগমন সত্য ঘটনা (পরে দেখুন। ৮. পশুপতি-মহাদেবের আরাধনাই আদি-মহাভারতীয় সমাজের প্রতিষ্ঠিত ধর্ম ছিল। সিন্ধুসভ্যতার কেন্দ্র থেকে প্রাপ্ত আদি শিবের প্রতিকৃতির দ্বারা এটা সমর্থিত। ৯. আদি মহাভারতীয় সমাজে মেয়েদের বিবাহপূর্ব যৌনসংসর্গ অবৈধ ছিল না। কন্যাহরণ বা ‘ম্যারেজ বাই ক্যাপচার’ ও বহুপ্রতি গ্রহণও প্রচলিত ছিল (অতুল সুরু ‘ভারতের বিবাহের ইতিহাস’ দ্র.)। ১০. অবৈধ সন্তানদের রাজা-রাজড়া ও মুনি-ঋষিরা নিজ সন্তানবৎ প্রতিপালন করত। ১১. মহাভারতে বিবৃত ঘটনাসমূহের বিবরণে অসঙ্গতি ও চরিত্রগত বৈলক্ষণের কারণ, মহাভারতে নানা যুগের জনশ্রুতি নানা রচয়িতার হস্তক্ষেপ ও প্রাচীন আদর্শকে কালোপযোগী করার প্রয়াস। ১২. মহাভারতে নানা অলৌকিক ও অতিপ্রাকৃত ঘটনার সমাবেশ আছে, তার কারণ, প্রাচীন ভারতের লোক অলৌকিক ও অতিপ্রাকৃত ঘটনার বিশ্বাস করত।
রাজশেখরবাবুর দ্বিতীয় প্রশ্ন, কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধ মূলত কুরুপাঞ্চাল যুদ্ধ কি না? প্রশ্নটার উত্তর ইতিবাচক হওয়ার সপক্ষে বহু যুক্তি আছে। পাণ্ডবরা পাঞ্চালরাজারই জামাতা ছিলেন, এবং পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ ও পাণ্ডবরা এক ব্যথারই ব্যথী ছিলেন। দ্রুপদ গঙ্গার উত্তরাংশে তাঁর রাজ্য হারিয়েছিলেন, এবং পাণ্ডবরাও পৈত্রিক রাজ্য হারিয়েছিলেন। দ্রুপদ ও পাণ্ডবদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক তাদের নষ্টরাজ্য উদ্ধারের প্রয়াসকে বলবতী করেছিল। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ সম্পর্কে যা-কিছু শলা-পরামর্শ দ্রুপদের গৃহেই হয়েছিল। তা ছাড়া, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে দ্রুপদ ও তাঁর পুত্র ধৃষ্টদ্যুম্নই নেতৃত্ব দিয়েছিল।
এখানে একটা সন্দেহ খুব স্বাভাবিকভাবে মনে জাগে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধটা আসলে উত্তর ভারতের সঙ্গে প্রাচ্যভারতের যুদ্ধ কি না? এখানে আমি আমার ‘বাংলার সামাজিক ইতিহাস’ (১৯৭৬, পৃষ্ঠা ২৭-২৮) গ্রন্থে যা বলেছি তা উদ্ধৃত করছি—’ভরতবংশীয় রাজাদের অভ্যুত্থান পূর্বভারতেই হয়েছিল। ভরতবংশীয় রাজারা ঋগ্বেদে বর্ণিত পরবর্তীকালের দশরাজার বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। পাণিনির ও পতঞ্জলি ভরতদের প্রাচ্যদেশীয় বলে অভিহিত করেছেন। মহাভারতের আদিপর্বে উল্লেখিত এক কাহিনি থেকে আমরা জানতে পারি যে, ভরতবংশীয় রাজা দুষ্মতের এক পূর্বপুরুষ অরিহ অঙ্গদেশের এক মেয়েকে বিবাহ করেছিলেন। ‘কাশিকা’ টীকা অনুযায়ী, পাণিনি উল্লেখিত ‘প্রাচ্য’ দেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল পাঞ্চাল, বিদেহ, অঙ্গ ও বঙ্গ। ‘কাশিকার এই মন্তব্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ, কেননা, আমরা আগেই দেখেছি যে একচক্রানগরে অবস্থানকালে পাণ্ডবরা দ্রুপদরাজার মেয়েকে বিবাহ করেছিলেন। সুতরাং পাঞ্চালদেশ বীরভূমের একচক্রানগরেরই নিকটবর্তী কোনো রাষ্ট্র ছিল।’
এখানে বলা প্রয়োজন যে ‘আর্য শব্দটা জাতিবাচক (racial) শব্দ নয় এটা ভাষাবাচক শব্দ। আর্য-ভাষাভাষী নরগোষ্ঠীসমূহ দুই বিভিন্ন স্রোতে ভারতে এসেছিল। এক স্রোত এসেছিল সিন্ধুসভ্যতার পূর্বে, আর অপর স্রোত সিন্ধুসভ্যতার সমকালে। নরগোষ্ঠীর দিক দিয়ে প্রথম গোষ্ঠীর লোকরা ছিল বিস্তৃত-শিরঙ্ক ‘আলপীয়’ পর্যায়ভুক্ত, আর দ্বিতীয় গোষ্ঠীর লোকেরা দীর্ঘ শিরষ্ক ‘নর্ডিক’ গোষ্ঠীভুক্ত। প্রথম গোষ্ঠীর লোকেরা বাংলায় এসে বসবাস করেছিল। আর দ্বিতীয় গোষ্ঠীর লোকরা পঞ্চনদের উপত্যকায় উপনীত হয়ে বেদ রচনা করেছিল। (এ সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা আমার ‘বাংলার সামাজিক ইতিহাস’ ও ‘বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’ দ্র.)। আলপীয়দের গায়ের রং ছিল ফ্যাকাশে (Pale), এবং সেটা পাণ্ডবদের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে খাটে। রাজশেখরবাবুর তৃতীয় প্রশ্ন ছিল, পাণ্ডু albino ছিলেন কি না? এ প্রশ্নটা একেবারেই অবান্তর। এ প্রশ্ন তাঁরাই তুলতে পারেন, যাঁদের নৃতত্ত্ব বিষয়ে সামান্যতমও জ্ঞান নেই। তাছাড়া, albino শব্দের ইংরেজি অর্থের সঙ্গেও তাঁরা পরিচিত নন। কেননা, albino-দের ত্বক ধবলেন ন্যায় সাদা, চুল শুভ্র ও চক্ষুগোলাপি বৰ্ণ হয়। এটা ঘটে যখন ত্বকে ‘মেলানিন’ (melanin) নামক রঞ্জক উপাদানের অভাব ঘটে। albino-রা সূর্যের বা দিনের আলোতে ভালো দেখতে পায় না। পাণ্ডুর যে এইসব বৈশিষ্ট্য ছিল, তা মহাভারতের কোনো জায়গাতেই লেখা নেই। সুতরাং পাণ্ডু albino হতে যাবে কেন? মোট কথা, পাণ্ডু albino ছিলেন, এটা বিজ্ঞান ও মহাভারত বিরোধী একটা আজগুবি কথা
রাজশেখরবাবুর চার নম্বর প্রশ্নের উত্তর তো আমি আগেই দিয়েছি। রাজশেখরবাবুর শেষ-প্রশ্ন-কৃষ্ণদ্বৈপায়ন আদি মহাভারতের রচয়িতা ছিলেন কি না? এর উত্তর নেতিবাচক। কেননা মহাভারতের সূচনায় আমরা সৌতির মুখে শুনি, ‘কয়েকজন কবি এই ইতিহাস পূর্বে বলে গিয়েছেন, এখন অপর কবিরা বলছেন আবার ভবিষ্যতে অন্য কবিরাও বলবেন।’