মহাভারতের তাৎপর্য
রামকৃষ্ণদেবের একটি চমৎকার গল্প হয়ত অনেকেরই জানা আছে। দুই ভাইয়ের সংসার। বড় ভাই অসার সংসারমায়া ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হল। ছোট ভাই গৃহস্থ ধর্ম নিয়ে ঘরে পড়ে রইল। সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে বড় ভাই বার বছর পরে ছোট ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে এল। ছোট ভাই জিজ্ঞাসা করল—দাদা, ঘরসংসার ছেড়ে বার বছর তপস্যা করে কি পেলে তুমি? বড় ভাই ছোট ভাইকে নদীর ধারে টেনে নিয়ে গেল, জলের ওপর দিয়ে গট গট করে হেঁটে নদী পার হয়ে গেল। আবার হেঁটে ফিরে এল, বলল–দেখলি তো কি শিখেছি? ছোট ভাই বলল–দুপয়সা দিলে খেয়া নৌকো করেই তো নদী পার হওয়া যায়। তাহলে বার বছর ধরে সংসার ছেড়ে কঠোর সাধনা করে তুমি শেষ পৰ্যন্ত দুপয়সার বিদ্যা আয়ত্ত করেছ?
আজ বিংশ শতকের বানপ্ৰস্থদশায় বিজ্ঞানের রকেটচারিণী জয়যাত্রার কথা মনে রেখেও রামকৃষ্ণদেবের গল্পটির তাৎপৰ্য্য বোধহয় একবার নূতন করে ভাববার প্রয়োজন আছে। বিজ্ঞানের মারফত মানুষ প্ৰকৃতিকে জয় করেছে; আপন প্রয়োজনে প্ৰকৃতির পরিবর্তন ঘটিয়েছে। কিন্তু প্ৰকৃতির উপর মানুষের এই আধিপত্য তার মানসিক জগতে কতখানি প্ৰতিফলিত হয়েছে, মানুষ নিজেকে কতখানি জয় করেছে, বিজ্ঞান মানুষকে কতখানি মানুষে করেছে—এ প্রশ্নের উত্তর আজ মানুষকেই দিতে হবে। Man is a tool-making animal-মানুষ যন্ত্রনির্মাতা প্রাণিবিশেষ, এই কি মানুষের সর্বশেষ লক্ষণ? পশু থেকে মানুষের সেখানে চূড়ান্ত প্ৰভেদ তা হল মানবিক মূল্যবোধ। যন্ত্রবিজ্ঞানের অগ্ৰগতিই যদি মনুষ্যসভ্যতার মাপকাঠি হয়, তবে বলতেই হবে এখন পৰ্য্যন্ত মনুষ্যত্বের চরম গৌরবময় বিকাশ ঘটেছে মার্কিন মুলুকে। ভিয়েটনামে এই মার্কিনী মনুষ্যত্বের মহিমা দেখে আমাদের শ্রদ্ধায় অভিভূত হওয়া উচিত ছিল।
মানুষ বেঁচে থাকবে, জন্তুর মত বাঁচবে না, শিক্ষা দীক্ষা জ্ঞান বিজ্ঞান, সাহিত্য দর্শন ও শিল্পকলায় সমৃদ্ধ সুস্থ সবল সভ্যতার সক্রিয় অংশীদার হয়ে বেঁচে থাকবে। এর জন্য জৈব জীবনের ভিত্তিটা তার সুনিশ্চিত হওয়া চাই, না হলে বাঁচাই অসম্ভব। সেই ভিত্তির ওপর মানবিক নীতিবোধে সমুন্নত সভ্যতা গড়ে উঠবে। একের বেঁচে থাকার সুযোগ কেড়ে নিয়ে অন্যের জীবন প্ৰতিষ্ঠার প্রচেষ্টা পশু প্ৰকৃতির বিকারমাত্ৰ। এই মানবতাবিরোধী পাপাচারকে মানুষের সমাজ থেকে উচ্ছেদ করতে হবে। এই নীতিবোধই হল মানবিক মূল্যবোধের মূলভিত্তি। বর্তমান সমাজ-বিজ্ঞানের ইতিহাসে পুজিবাদী সভ্যতা ধিক্কত, কারণ এ সভ্যতা আদিম শ্বাপদ বৃত্তির পরিণত প্ৰকাশ, এ সভ্যতা ব্যক্তিস্বাধীনতার নকল নামাবলীর অন্তরালে মুষ্টিমেয় ব্যক্তির স্বার্থে সমাজের সম্পদ কেড়ে খাওয়ার হিংস্র পশুতন্ত্রকে গায়ের জোরে কায়েম রাখতে চায়। এর হিংস্রতায় বৈজ্ঞানিক নৈপুণ্যের চমক আছে, এর শোষণব্যবস্থায় ধর্ম ও স্বাধীনতার মুখোশ আছে। কৌটিল্যাতন্ত্রের কুটিলারঙ্গে এ সভ্যতা মানুষের মুখকে মুখোশে পরিণত করেছে, মানবিক মূল্যবোধকে শ্বাসরুদ্ধ করেছে। আর একটি বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কার মূলেও রয়েছে মনুষ্যত্বের এই চরম অবমাননা, নীতির ওপর লালসার এই আধিপত্য। এ অপমানের নির্মম প্ৰায়শ্চিত্ত না করে মানুষের নিস্কৃতি নেই।
সুদূর অতীতে সারা ভারতবর্ষের মানুষকে এমনি এক নিষ্করুণ প্ৰায়শ্চিত্ত করতে হয়েছিল। একটি রাজপরিবারের উদ্ধত দম্ভ ও লালসা সেদিন সমস্ত দেশে ধ্বংস ডেকে এনেছিল। মানুষের মৌলিক মূল্যবোধ কলুষিত ও বিপৰ্য্যন্ত হলে মহাকাল ক্ষমা করে না—এই গভীর তাৎপৰ্য্যই সেদিন উদঘাটিত হয়েছিল। ভারতের মহাকাব্য মহাভারত।
পাশ্চাত্ত্য পণ্ডিতরা মহাভারতকে দেখেছেন বহিরঙ্গ দৃষ্টিকোণ থেকে। মহাভারতের কোন অংশ সুপ্রাচীন এবং কোন অংশ অপেক্ষাকৃত প্রাচীন এ নিয়ে, তারা পাণ্ডিত্যপূর্ণ গবেষণা করেছেন এবং সিদ্ধান্ত করেছেন যে খ্ৰীষ্টপূর্ব চারশ সাল থেকে চারশত খ্ৰীষ্টাব্দ পৰ্যন্ত প্ৰায় এই আটশত বছর ধরে মহাভারত বর্তমানের এই বিপুল কলেবর লাভ করেছে। মহাভারত এক ব্যক্তির লেখা নয়। মূল লেখকের লেখার সঙ্গে পরবর্তী বহু অখ্যাত অজ্ঞাত লেখকের লেখা সংযোজিত হয়েছে। ফলে মহাভারতের আকার হয়েছে বিপুলকায় প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর মত ( literary monster ), যার বিসদৃশ উদ্বত্ত অঙ্গ প্ৰত্যঙ্গগুলি শিল্পদূষ্টিতে বড় বিকট ও বেমানান ঠেকছে। এ জাতীয় গবেষণার প্রয়োজন আছে সন্দেহ নেই। কিন্তু শুধু এই আকারগত দৃষ্টি দিয়ে মহাভারতকে দেখলে এই মহাকাব্যের অন্তনিহিত তত্ত্ব গবেষকের দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে বাধ্য। একটা কথা মনে রাখা দরকার, যে যুগে মহাভারত প্ৰথম লেখা হয়েছিল সে যুগে চিন্তাবিদদের চিন্তাধারায় সাহিত্য, দর্শন ও ধর্ম পৃথক পৃথক শিল্পসত্তার লক্ষণ নিয়ে আবিভূতি হয়নি। ঔপনিষদিক যুগ থেকে মহাভারতীয় যুগের কালগত ব্যবধানটা বিরাট নয়। বেদ ও উপনিষদে যেমন সাহিত্য, দর্শন ও ধর্ম একাধিকার হয়ে মিশে গেছে, মহাভারত ও তার ব্যক্তিক্রম নয়, যদিও মহাভারতে সাহিত্যদৃষ্টি বেদ ও উপনিষদের যুগ থেকে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। পরবর্তী কালের অলঙ্কার-শাস্ত্রীদের নিয়ম কানুন দিয়ে রামায়ণমহাভারতকে বাধা যায় না, বিশেষ করে মহাভারতকে। তাই ভারতীয় ঐতিহ্যিক দৃষ্টিতে মহাভারত সাহিত্য মাত্র নয়, সাহিত্যের অনেক ঊর্ধ্বে। মহাভারতের ভূমিকায় একে বলা হয়েছে উপনিষদ। এর কারণ বোধ হয় এই সে মহাভারতের মূল ঘটনাত্ৰোত ও চরিত্রবিন্যাসের মধ্য দিয়ে এমন একটি কালাতীত বক্তব্য উপস্থিত করা হয়েছে যা নিজস্ব সাহিত্য গণ্ডী প্যার হয়ে সর্ব যুগের সর্ব মানুষের সামাজিক অন্তরাত্মার গভীরতম মানবিক মূল্যবোধকে উচ্চতম দার্শনিক পৰ্য্যায়ে উন্নীত করেছে, সামাজিক ঘটনাবলীর সংঘাতে মানুষের চরিত্রের অন্তস্থল অবারিত হয়েছে, এবং এই বহু মানুষের বিচিত্র মিছিলের ভিতর দিয়ে বেরিয়ে এসেছে মানবিক সত্তার দার্শনিক মূল্য যাকে শুধু আর সাহিত্যের মধ্যে ধরে রাখা যায় না।
কোন গ্রন্থের মূল তাৎপৰ্য্য বুঝতে হলে উপক্রম ও উপসংহার মিলিয়ে দেখতে হবে। এ নীতি আমাদের দেশে প্ৰাচীনকাল থেকে স্বীকৃত। মহাভারতের আরম্ভ থেকে শেষ পৰ্য্যন্ত এমন একটা অত্যাশচাৰ্য্য নীতিগত মিল রয়েছে যাকে উপেক্ষা করে শুধু বহিরঙ্গগত অনৈক্যের ওপর জোর দিলে বিচারকর্তার দৃষ্টিদৈন্য প্ৰকাশ পেতে বাধ্য। একটি বলিষ্ঠ বক্তব্য এই মহাকাব্যের ভূমিকা থেকে আরম্ভ করে কুরুক্ষেত্রের ধ্বংসযজ্ঞ পার হয়ে স্বৰ্গারোহণ পর্বে গিয়ে পরিণতি লাভ করেছে। এদিকে লক্ষ্য না রেখে মহাভারতের প্রথম দিকটা প্রক্ষিপ্ত এবং স্ত্রীপর্বের পরবর্তী সমুদয় অংশ প্ৰক্ষিপ্ত–এজাতীয় গবেষণা সাহিত্যের ওপর ঘোরতর অবিচার এবং গবেষণার নামে বুদ্ধির ব্যভিচার।
মহাভারতের প্রারম্ভিক ভূমিকা বা অনুক্রমণীপর্বেই এই বিরাট কাব্যের তাৎপৰ্য্যগত ইঙ্গিত রয়েছে। লক্ষ্য করা দরকার এই ভূমিকাটির প্রায় অর্ধেক জুড়ে আছে বিখ্যাত ধৃতরাষ্ট্ৰবিলাপ– সেই সুপ্ৰসিদ্ধ “তদা নাশংসে বিজয়ায় সঞ্জয়” দিয়ে আরম্ভ করা শ্লোকগুলি। রিক্ত ও নিঃশেষিত অন্ধ রাজার এই আর্তীরোদনের শেষ কথাটি লক্ষ্য করুন। ধৃতরাষ্ট্র বলছেন—এই কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে ভারতবর্ষের ক্ষত্রির বীরদের মধ্যে বেঁচে রইল মাত্র দশজন; পাণ্ডব পক্ষে সাত জন, কৌরবপক্ষে তিন জন। স্ত্রীপর্বে কুরুক্ষেত্রেযুদ্ধের ধ্বংসস্তুপের মধ্যে দাঁড়িয়ে ধৃতরাষ্ট্র ভীমকেও ঠিক এই কথাটাই একবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। অযুত হস্তীর দৈহিক বল নিয়েও এই বৃদ্ধ রাজার চিত্ত শিশুর চেয়েও দুর্বল, কিন্তু শিশুর মত সরল মোটেই নয়। অন্তরে বাইরে অন্ধ এই রাজা অন্যায়কে অন্যায় জেনেও অসহায়ের মত প্রশ্ৰয় দিয়েছেন, সারা ভারতবর্ষের ধ্বংসের পথ প্ৰশস্ত করেছেন, অথচ এতটা অসহায় তিনি ছিলেন না। এত বড় একটা ধ্বংসের নৈতিক দায়িত্ব তাকে বহন করতে হয়েছে, তাই প্ৰলয়-শেষের প্ৰেতাত্মার হাহাকার ও দীর্ঘশ্বাসের বোঝাও তাকেই বহন করতে হবে। মহাভারতের ভূমিকাতেই গ্রন্থকার কুরুক্ষেত্ৰ-মহাশ্মশানের এই জাগ্ৰত প্রেতিমূতির মুখোমুখী পাঠকদের দাঁড় করিয়েছেন এবং তার একটানা দীর্ঘশ্বাসের মধ্য দিয়ে কুরুক্ষেত্ৰযুদ্ধের যবনিকাপাত পৰ্যন্ত মহাকাব্যের সংক্ষিপ্তসার বিবৃত করেছেন। ভিতরে বাইরে নিঃস্ব এই অন্ধ রাজার নিঃশ্বাসবায়ু যেন সমগ্র মহাভারতের ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে এবং মহাপ্ৰস্থানের পথে পাণ্ডবদের পার করিয়ে দিয়ে তবেই ক্ষান্ত হয়েছে। মহাকাব্যের মূল সুর সুরুতেই বাধা হয়ে গেছে।
কিন্তু এই মূল সুরটিই মহাভারতের মূল বক্তব্য নয়। একটি শোকবিদীর্ণ পিতৃহৃদয়ের উন্মুক্ত ক্ষত হতে যেন কুরুক্ষেত্রের সকল কলুষরাক্ত ঝরে পড়ছে, মহাকাব্যকার অনুক্রমণীপৰ্বই এই রক্তক্ষর হৃদয়টি পাঠকের সামনে মেলে ধরেছেন। এর ফলে পাঠকবর্গ প্রারম্ভেই মহাকাব্যের অন্তনিহিত আত্মিক পরিমণ্ডল বা Inner spiritual climate-এর সঙ্গে পরিচিতি লাভ করেন। এই প্রারম্ভিক পরিচিতি মূল বক্তব্য অনুধাবন করতে সাহায্য করে।
এখন ধৃতরাষ্ট্রের পাশাপাশি আর একটি চরিত্রকে আমরা দাঁড় করিয়ে দেখতে পারি। ইনি হলেন ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির। এই মানুষটি রাজা হতে চাননি, কিন্তু রাজা তাকে হতে হয়েছে। যুদ্ধ করতে চাননি, কিন্তু অনিচ্ছুক হাতে তঁাকে অস্ত্ৰধারণ করতে হয়েছে। অভিশাপগ্ৰস্ত সিংহাসনের পক্ষে তার অনিচ্ছুক পাদুখানিকে চালিয়ে নিতে হয়েছে। কুরুক্ষেত্রের রক্তপ্লাবনে তার কোন অপরাধ নেই। কিন্তু মহত্তম মানবিক বিবেকের কাছে বার বার তিনি নিজেকে অপরাধী মনে করেছেন। তিনি ভারতের অধীশ্বর হলেন। কিন্তু সাম্রাজ্য র্তার কাছে এক সান্তনাহীন নিঃসীম মরুপ্রান্তর ছাড়া আর কিছুই নয়। অন্ধ বৃদ্ধ রাজার হিমশীতল নিঃশ্বাস, কুরুক্ষেত্রের শবরাশির উপর বিলুষ্ঠিত সর্বহােরা বিধবাদের বুকফাটা কান্না বার বার তার বুকে বেজেছে। জয়লাভের শূন্যতাবােধ কোন বিজেতার হৃদয়কে এমন করে আর ক্ষতবিক্ষত করেনি। এই মানুষটি দিনের আলোয় যুদ্ধ করেছেন। রাত্রির অন্ধকারে নিহত মানুষদের জন্য কেঁদেছেন। কুরুক্ষেত্ৰকাব্যের ট্রাজিডি যারা মারা গেল তাদের নয়। এ ট্রজিডি তাদের যারা যুদ্ধশেষের ভস্মরাশির তলে প্রধূমিত বেদনাবহি চাপা দিয়ে নির্মম প্ৰায়শ্চিত্ত করার জন্য বেঁচে রইল।
উরুভঙ্গের পর ভূপতিত দুৰ্যোধনের মস্তকে ভীম বামপদের আঘাত হানলেন। তখন ভীমের প্রতি যুধিষ্ঠিরের সুকঠোর তিরস্কারের মধ্যে পাশবিক প্রতিশোধস্পৃহার বিরুদ্ধে মানবিক বিবেকের সাবধানবাণী উচ্চারিত হয়েছে। যন্ত্রণাক্লিষ্ট দুৰ্যোধনের মুখের উপর ব্যথাহত দৃষ্টি স্থাপন করে যুধিষ্ঠির বললেন –হে নিষ্পাপ বীর, তুমি দুঃখ করোনা, মৃত্যু তোমার গৌরবে বরণীয়, তোমার আত্মা শোচনীয় নয়। আমরাই এখন শোচনীয়, যারা প্রত্যেক মুহূর্তে নরকযন্ত্রণা ভোগ করে বেঁচে থাকব, শোকবিহ্বল বিধবাদের ধিক্কার ও অভিশাপ কুড়িয়ে বেঁচে থাকব।
মহাভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ বিয়োগান্ত নায়ক বা ট্রাজিক হিরো এই যুধিষ্ঠির, মহত্তম মানবিক মূল্যবোধের প্রতিভূ ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির, উদ্ধত বিজয়গৌরব যাঁর বিবেককে মুহুর্তের জন্যও ম্লান করতে পারেনি। কুরুক্ষেত্রের মহাশ্মশানে নিঃসঙ্গ পদসঞ্চারী ধৃতরাষ্ট্রের বিপরীতমুতি এই মহাকাব্যের নিঃসঙ্গ মহানায়ক। যুধিষ্ঠির কুরুক্ষেত্রের ভস্মশেষে জাগ্ৰত মানবাত্মা। বিজয়লাভের বেদনায় অবনত, মানবিকতার মহিমায় সমুন্নত বিক্ষত হৃদয় এই মানুষটিকেই মহাভারতের গ্ৰন্থকার ভারতবাসীর হৃদয়ে ধর্মরাজের আসনে প্ৰতিষ্ঠিত করেছেন। একথাটি না বুঝলে মহাভারত বোঝা হয়না।
কুরুক্ষেত্ৰযুদ্ধের উদ্যোগপর্বে চতুর ধৃতরাষ্ট্র কৌশলে যুধিষ্ঠিরের মহত্ত্বের সুযোগ নেবার চেষ্টা করেছেন। তিনি সঞ্জয়কে পাঠিয়ে দিলেন যুধিষ্ঠিরের কাছে একটি অদ্ভুত কুটিল প্ৰস্তাব দিয়ে। সঞ্জয় যুধিষ্ঠিরের কাছে যে বাণী বহন কবে আনলেন তার সারমর্ম এই–আপনি ধর্মরাজ, ধর্ম আপনার কাছে রাজ্য ও রাজনীতির অনেক উর্ধে। আপনি জানেন এই যুদ্ধে জয় পরাজয় সমান। যেখানে জয়লাভের কোন সার্থকতা নেই। সেখানে একটা অনর্থক ধ্বংসের পথে ধাৰ্মিক হয়ে আপনি দেশকে ঠেলে দিতে পারেন না। ধরে নিন। পাপমতি দীপিত দুৰ্যোধন আপনাকে ন্যায্য রাজ্যাধিকার দেবে না। তাই বলে আপনি দেশ জ্ঞাতি ও কুলের ধ্বংস ডেকে আনতে পারেন না। দুৰ্যোধন রাজ্য দিতে রাজী না হলে ধর্মের জন্য আপনাদের বরং ভিক্ষা করেও বেঁচে থাকা ভাল। কিন্তু যুদ্ধ করা কখনও উচিত নয়। এই নির্লজ্জ প্ৰস্তাবের চাতুৰ্যময় অভিসন্ধি বুঝতে যুধিষ্টিরের বিন্দুমাত্ৰ দেরী হল না। তবু তিনি দ্বিধায় পড়লেন। শেষ পৰ্য্যন্ত রাজ্যের দাবী ছেড়ে দিলেন। সঞ্জয়কে বললেন-আপনি গিয়ে বৃদ্ধরাজাকে বলুন আমরা রাজ্য চাই না, কিন্তু তিনি যেন শুধুমাত্র পাঁচখানা গ্রাম আমাদের ছেড়ে দেবার জন্য নিজপুত্রকে রাজী করান। যুদ্ধ হবে না। সঞ্জয়কে পাঠিয়ে দিয়েই যুধিষ্ঠির নিশ্চিন্ত হলেন না। এই অবিশ্বাস্য সর্বনিম্ন সর্তে ধৃতরাষ্ট্র ও দুৰ্যোধনকে রাজী করাবার জন্য, আপোষ্যমীমাংসার শেষ প্রচেষ্টার জন্য তিনি কৌরব সভায় কৃষ্ণকে পাঠালেন। এ সময়ে ভীমসেনের আশাতীত ব্যবহারে আমরা বিস্ময়ে বিমুগ্ধ হই। কৃষ্ণকে ভীম বলছেন-আমি তোমার কাছে জানু পেতে ভিক্ষা চাইছি। তুমি অকপট ও নিরলস ভাবে এ যুদ্ধ বন্ধ করার চেষ্টা কর। মনে রেখো আমরা কেউ এই কুলক্ষয়ী যুদ্ধ চাইনা। আরো মনে রেখো, দুৰ্যোধন বড় অহঙ্কারী। তার অহঙ্কারে আঘাত দিয়ে কোনো কথা বলে না। পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধ করলে কৌরবরা ধ্বংস হবে এমন ভয়-দেখানে কথা বলোনা। আমাদের পক্ষ নিয়ে কথা বলোনা। নিরপেক্ষের মত কথা বলবে, দুৰ্যোধনের অহঙ্কার আহত হলে বিপরীত ফল ফলবে। এ যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য তোমার সর্বশক্তি নিয়োগ কর। এই অকপট মহতী শুভেচ্ছা যখন অবজ্ঞাত ও প্রতিহত হল, যুদ্ধ যখন আনিবাৰ্য্য হয়ে উঠল তখন কিন্তু ভীমসেন মহাকালরূপী কৃষ্ণের বিশ্বন্ত সহযোগী। তার কোমল সরল হৃদয় তখন কুলিশকঠোর, সেখানে শত্রুর জন্য আর একবিন্দু ক্ষমাও অবশিষ্ট নেই।
কৃষ্ণ হস্তিনাপুরে পৌঁছে বিদুরের অতিথি হলেন। বিদুর বললেন–আপনি ফিরে যান, আপনার কথা কৌরবরা শুনবেনা। আপনার অপমান হবে। অস্থানে আপনার প্রচেষ্টা বিফল হতে বাধ্য। কৃষ্ণ বিদুরকে যে উত্তর দিয়েছিলেন, তার মধ্যে শুধু কৃষ্ণচরিত্র নয়, মহাভারতের মূল বক্তব্যের নির্দেশও সেখানে রয়েছে–বিদুর, তুমি ঠিকই বলেছি, ধৃতরাষ্ট্র-পুত্ৰগণ দুরাত্মা সন্দেহ নেই। কিন্তু একথাও মনে রাখবে–
পৰ্য্যস্তাং পৃথিবীং সৰ্বাং সাশ্বাং সরথকুঞ্জরাম।
যো মোচায়েন মৃত্যুপাশাত প্ৰাপ্লুয়াদ ধর্মমুত্তমম্।
–এই পৃথিবীকে মৃত্যুপাশ থেকে যে মুক্ত করতে পারবে সেই লাভ করবে পরম ধর্ম। কৃষ্ণ বলে চললেন–ধর্মপ্ৰচেষ্টা বিফল হলেও ধর্ম নষ্ট হয় না। আমি অকপট ভাবে (অমায়য়া) মীমাংসার চেষ্টা করব। আমি পাণ্ডব কৌরব সকলেরই হিতকামনা করি। পৃথিবীর হিতকামনা করি। ধামিকরা যেন মনে করতে না পারেন, মূঢ় শত্রুরা যেন অপবাদ দিতে না পারে, কৃষ্ণ যুদ্ধ বন্ধ করতে পারত, কিন্তু বন্ধ করার চেষ্টা করেনি।
মানুষ ও পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা মানুষের পরম ধর্মকুরুক্ষেত্রযুদ্ধের উদ্যোগপর্বে কৃষ্ণের মুখে মহাকাব্যকার সর্বকালের সর্বদেশের মানুষকে এই চিরায়ত মানবধর্মের বাণী শুনিয়েছেন। কিন্তু দপিতের উদ্ধত দৰ্প, লোভীর উদগ্র লালসা যদি সকল শান্তিপ্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়, যদি যুদ্ধকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলতে চায়, তবে কি নির্বিরোধী শান্তিবাদী মানুষ অত্যাচারীর লালসাসিক্ত অহঙ্কারের কাছে আত্মসমৰ্পণ করে বৈরাগ্যের পঞ্চ বেছে নেবে ? উদ্যোগপর্বে শান্তি প্ৰচেষ্টার ব্যর্থতার পর মহাভারতের সমগ্ৰ ঘটনাবলীর মধ্যে দিয়ে মহাকবি এর উত্তর দিয়েছেন। আত্মসমর্পণ নয়। লোভীর নিষ্ঠুর লোভ যদি যুদ্ধ চাপিয়ে দেয় যুদ্ধ করতে হবে। কিন্তু ভবিষ্যতের দৃষ্টি স্বচ্ছ ও উন্মুক্ত রেখে বিবেককে কলুষিত না করে যুদ্ধ করতে হবে; নিতান্ত অকপট শান্তি প্ৰচেষ্টা ব্যর্থ হবার পর কৃষ্ণের ভূমিকা আকস্মিকভাবে পরিবতিত হল। যুদ্ধ যখন অনিবাৰ্য্য ভাবে উপস্থিত হয়েছে তখন সৰ্বাত্মক প্ৰস্তুতি ছাড়া উপায় নেই। নিরলস শান্তির দূত দেখা দিলেন নির্মম ধ্বংসের হোতা হিসাবে।
মহাভারতের কৃষ্ণচরিত্র বুঝতে হলে একথাটি মূলতঃ বুঝতে হবে,–কৃষ্ণ মহাভারতের অন্যান্য চরিত্রের মধ্যে ‘একটি চরিত্ৰমাত্ৰ’ নয়! কৃষ্ণ চরিত্রাতীত চরিত্র, অর্থাৎ কৃষ্ণই মহাভারত। মহাভারতের সাহিত্যিক, দার্শনিক ও মানবিক মূল্য যে গভীরতম তাৎপৰ্য্যের মধ্যে একাকার হয়ে মিশে গেছে— কৃষ্ণ মহাভারতের সেই সমগ্র আত্মস্বরূপ। মানুষ ও পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা পরম মানবধর্ম | কিন্তু স্বার্থান্ধ লালসা যদি এই ধৰ্মবোধকে কলুষিত করে, অবমানিত করে, ধ্বংসের পথ থেকে প্রতিনিবৃত্ত না হয় তা হলে মহামানব নেমে আসে মহাকালরূপে। তখন দয়া নেই, ক্ষমা নেই। পৃথিবীর সমস্ত মানুষ মিলেই তখন মানুষের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। মানবসভ্যতার এই মূলনীতি। এই নীতিরই মূৰ্তিমান বিগ্ৰহ শ্ৰীকৃষ্ণ। কৃষ্ণের বহু কৰ্ম আমাদের আপেক্ষিক নীতিবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তার কারণ মূল নীতিকে অন্য কোন নীতি দিয়ে বিচার করা যায় না। তাহলে অনবস্থা দোষ বা infinite regress এসে পড়ে। যেমন ধরুন, ঈশ্বর-বিশ্বাসী ভক্তের ঈশ্বর কিন্তু স্বয়ং নিরশ্বর, কারণ তাঁর উপর অন্য ঈশ্বর মানা হলে তিনি নিজে ঈশ্বর হতে পারেন না। তেমনি মানবের উচ্চতম নৈতিক আদর্শকে অন্য কোনো আদর্শ দিয়ে মাপা যায় না–God of the theists must Himself be an atheist just as the most fundamental moral law must itself be un moral. মানবাত্মার গৌরব পদ দলিত হলে মানবরূপ মহাকালরূপে আবির্ভূত হয়—মহাভারতের এই বাণীরূপই হল শ্ৰীকৃষ্ণ। তাই শান্তির দূত ধ্বংসের হোতারূপে আত্মপ্রকাশ করলেন। এই অর্থেই শ্ৰীকৃষ্ণ চরিত্রাতীত চরিত্র। কৃষ্ণই স্বয়ং মহাভারত।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষ হয়েছে। লক্ষ লক্ষ গলিত বিকৃত শবরাশির মধ্যে গান্ধারী এসে দাঁড়িয়েছেন মাতৃজাতির প্রদীপ্ত বিবেকের প্রতিমূতিরূপে। নিহত পুত্রদের পাপস্থালনের জন্য গান্ধারীর বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। পাণ্ডব বা কৌরব উভয় পক্ষের নিহত যোদ্ধাদের জন্য তিনি আকুল ক্ৰন্দনে মাঝে মাঝে ভেঙ্গে পড়ছেন। আবার উঠে চলছেন, কৃষ্ণকে ডেকে ডেকে তঁর ধ্বংসলীলার পরিণতি দেখাচ্ছেন আর বার বার প্রশ্ন করছেন-হে মাধব, এ কাজ তুমি কেন করলে? তারপর এক সময় শোকদগ্ধ মাতৃহৃদয় ধৈর্ঘ্যের বাঁধ হারিয়ে ফেলল। গান্ধারী উঠে দাঁড়ালেন, চোখের জলে আগুনের শিখা জলে উঠল, কৃষ্ণকে দারুণ অভিশাপ দিলেন গান্ধারী–তোমার যাদব বংশও এমনি ধ্বংস হবে। তুমি থাকবে নিঃসঙ্গ, একাকী। বনে বনে উদভ্ৰান্ত হয়ে ঘুরে বেড়াবে। তারপর একদিন অখ্যাত, অজ্ঞাত, অলক্ষিত তুমি কুৎসিত মৃত্যু বরণ করবে। ভরতবংশের নারীদের মত যাদববংশের পুত্ৰহীন পতিহীন জ্ঞাতিবান্ধবহীন নিঃসহায় নারীকুলও এমনি হাহাকার করবে।
কৃষ্ণ কিন্তু বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না, ধীর গভীর প্রশান্তস্বরে গান্ধারীকে বললেন–গান্ধারি, তুমি আমার কাজটাই এগিয়ে নিয়ে গেলে। এ আমি আগে থেকেই জানি। বৃষ্ণিবংশের ধ্বংস তোমার অভিশাপের আগেই নির্ধারিত হয়েছে। “জানেহমেতদপ্যেবং চীৰ্ণং চারসি ক্ষত্ৰিয়ে।”
গান্ধারী নির্বিকার নির্মম মহাকালের ফাঁদেই পা বাড়ালেন। শোকে ক্ৰোধে প্ৰতিশোধস্পৃহায় উদভ্ৰান্ত মাতৃহৃদয়ের বিবেক কিন্তু কলুষিত হল। মহাকবি একথাই বুঝাতে চাইলেন, ধ্বংসের পাপচক্ৰ সম্পূর্ণ না ঘুরে থামতে জানে না। ধ্বংস ধ্বংসকে ডেকে আনে। কুরুক্ষেপ্রের রক্তলীলায় ধ্বংসের প্ৰথম পর্ব শেষ হয়েছে, দ্বিতীয় পর্ব শেষ হবে বৃষ্ণিবংশের নিধনযজ্ঞে। বৃষ্ণিবংশ নিঃশেষিত হল। নির্জন বনান্তে নিঃসঙ্গাচারী শ্ৰীকৃষ্ণ ব্যাধবাণবিদ্ধ হয়ে প্ৰাণত্যাগ করলেন। কালপুরুষের কাজ শেষ হ’ল। পাণ্ডবরা বলে উঠলেন, ‘কালঃ, কালঃ’। কালপুরুষ তার মাসুল সুদে আসলে আদায় করে নিয়েছে। আর নয়। এবার যাবার পালা। যে রাজ্য নিয়ে পাণ্ডবরা একদিন ও সুখের মুখ দেখেনি, বিবেকের ভারস্বরূপ সেই রাজ্যভার পরীক্ষিতের হস্তে সমর্পণ করে পাণ্ডবেরা মহাপ্ৰস্থানের পথ ধরলেন। স্বর্গে গিয়ে কৌরব পাণ্ডবের মিলন হল। সেখানে শক্ৰতার অবসান ঘটল এই মিলনে। এই শত্রুতার অবসান পৃথিবীতে ঘটলে মানুষের মঙ্গল হত, তবু তা ঘটল না। কেন ঘটল না? পৃথিবীতে মানুষ কি শান্তিতে থাকতে পারবেন?–এই অনুচ্চারিত প্রশ্ন মহাভারতের মহাকবি চিরকালের মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন, প্রশ্নের সমাধানের ইঙ্গিতও তিনি দিয়ে গেছেন।
মহাভারতের ভূমিকাতেই দুটি শ্লোক আছে যাকে টীকাকার নীলকণ্ঠ মহাভারতের তাৎপৰ্য্যগ্ৰাহক শ্লোক বলে উল্লেখ করেছেন। প্ৰথম শ্লোকটিতে দুৰ্যোধনকে বলা হয়েছে “মন্যুময়ো মহাদ্রুমঃ”, দ্বিতীয়টিতে যুধিষ্ঠিরকে বলা হয়েছে “ধর্মময়ো মহাদ্রুমঃ”। ভারতীয় ঐতিহ্যে এ শ্লোকদুটি সুপ্ৰসিদ্ধ। এ ঐতিহ্য শুধু প্রাচীন ভাবনার বিলাস মাত্র নয়। “মন্যু” শব্দের অর্থ এখানে ক্ৰোধ। টীকাকার নীলকণ্ঠ বললেন এখানে ’মন্যু’ শব্দটির দ্বারা দ্বেষ, ঈৰ্য্যা, অসূয়া প্রভৃতি দোষকেও বুঝতে হবে। এই “প্রভৃতির” মধ্যে লোভও আছে।
মহাভারতের যুদ্ধের মূলে রয়েছে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারের প্রশ্ন। এখানে সম্পত্তি হ’ল একটা বিপুল রাজ্য। এই রাজ্যলালসাকে কেন্দ্র করেই হিংসা দ্বেষ ও অহঙ্কার প্রতিপক্ষের হৃদয়ে প্রবল হয়ে উঠেছে। এই রাজ্যাধিকার কি এতই পবিত্র, যার জন্য একটা সমগ্ৰ মহাদেশের মানুষের জীবন ছারখার করে দেয়া চলে? পৃথিবীতে মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার পবিত্র ও মৌলিক মানবিক অধিকার। কোন রাজার রাজ্যের লোভ, কোন ধনীর সম্পত্তির লোভ মানুষকে এই অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারেন। দুৰ্যোধন মানুষের জীবনের মূল্যের চেয়ে তার অহঙ্কৃত রাজ্যলালসাকে অগ্ৰাধিকার দিয়েছেন। তার ফলেই সমগ্র দেশের জীবনে ঘোর দুর্দিন নেমে এসেছে। পাণ্ডবরা রাজ্যের দাবী ত্যাগ করেছিলন। মানবিক মূল্যবোধের ক্ষেত্রে কৌরবদের অপেক্ষা পাণ্ডবরা অধিক সমুন্নত। কিন্তু মহাভারতকার নিরঙ্কুশ শান্তিবাদ বা pacifismকে প্রশ্রয় দিতে রাজী নন। একটা মহাযুদ্ধ বন্ধ করার জন্য আপ্ৰাণ চেষ্টা করার পরও যদি দেখা যায় অত্যাচারীর নিষ্ঠুর লোভের কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমৰ্পণ করে বৈরাগ্য-অবলম্বন করা ছাড়া শান্তির আর পথ নেই, সেখানে আত্মসমর্পণ করা চলেনা। কারণ, তাতে শান্তি আসেনা। দর্পিতের দম্ভ, লোভীর লোভ আরও নিষ্ঠুর ভাবে আত্মপ্ৰকাশের সুযোগ পায় মাত্র। তখন সকল পরিণতির কথা ভেবেও সর্বাত্মক প্ৰতিরোধের জন্য প্ৰস্তুত হতে হবে।
দুৰ্যোধনের চরিত্রে ব্যক্তিগত অনেক গুণ আছে সন্দেহ নেই। কিন্তু তার দর্প ও রাজ্যলোলুপতার কাছে মানুষের জীবনের মূল্য তুচ্ছ। এখানেই মানুষ হিসাবে দুৰ্যোধনের গ্লানিময় নৈতিক পরাজয়। কিন্তু মহাকবির গভীর অন্তদৃষ্টি দুৰ্যোধনের প্রতি অবিচার করেনি। দুৰ্যোধনের দৃঢ় বিশ্বাস রাজ্য তঁরই প্ৰাপ্য। শ্ৰীকৃষ্ণের শান্তি-প্ৰস্তাবের সময় দুৰ্যোধন এ বিশ্বাস অকপটে ব্যক্তি করেছেন-যে পৰ্য্যন্ত আমি বেঁচে থাকব। সে পৰ্য্যন্ত পাণ্ডবরা রাজ্য পাবেন। আমরা যখন বালক ছিলাম। তখন আমাদের অন্ধ পিতা অন্যের কুমন্ত্রণায় আমাদেরই ন্যায়াধিকারভুক্ত রাজ্য অন্যায়ভাবে পাণ্ডবদের দান করেছেন। বিনাযুদ্ধে আমি সূচ্যগ্র মেদিনীও দান করবনা। দুৰ্যোধন যে প্রতিদ্বন্দ্বী পাণ্ডবদের সমুলে ধ্বংস কামনা করেছিলেন, এবং বহু কুটিল উপায়ে সে প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন তাতে কোন ও সন্দেহ নেই। কিন্তু তার ধারণা ছিল এ ক্ষত্ৰিয়ের ধর্ম। রাজসূয় আর অশ্বমেধ যজ্ঞের নামে যদি অন্যের রাজ্য গায়ের জোরে দখল করে নিজের রাজ্য বিস্তার করা রাজধর্মে অন্যায় বলে বিবেচিত না হয়, তবে নিজের রাজ্য নিষ্কণ্টক করার জন্য প্ৰতিদ্বন্দ্বী জ্ঞাতিশক্ৰকে নির্মূল করাই বা অন্যায় হবে কেন?
কুরুক্ষেত্রের ধ্বংসের দিকে একটি মহাদেশকে এগিয়ে দেবার পিছনে রাজ্যলোভের সঙ্গে সঙ্গে দুৰ্যোধনের অহঙ্কারও একটা মস্ত।বড় ভূমিকা গ্ৰহণ করেছিল। আত্মবিস্তারকে তিনি আত্মার অঙ্গীকার বলে মনে করেছেন। এখানে একটা কথা মনে রাখা দরকার। “বিনাযুদ্ধে সূচ্যগ্ৰ মেদিনীও পাণ্ডবদের দেবনা’ এই নির্মম নিশ্চয়েব পিছনে দুৰ্যোধনের আহত অহঙ্কার অনেকখানি কাজ করেছে। ভীমসেন দুৰ্যোধনের অহঙ্কারে আঘাত না করার জন্য কৃষ্ণকে বার বার সতর্ক করেছিলেন-কৃষ্ণ, তুমি মৃত্যু ব্যবহার করবে। কিন্তু কৌরব সভায় শ্ৰীকৃষ্ণের ভক্ত পরিষদ বৃন্দ ঠিক এর বিপরীত কাজটাই করেছেন। বার বার বক্তার পর বক্তা উঠে দুৰ্যোধনকে শুধু ধিক্কারই দেননি, বলেছেন-স্বয়ং ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণের আশ্রয়পুষ্ট পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধে তোমার ধ্বংস অনুবার্য্য। দুর্যোধনের মর্য্যাদায় তাঁরা আঘাত করেছেন। দুৰ্যোধন তার উত্তরে বলেছেন, কৰ্ণ দ্ৰোণ ভীষ্মকে যুদ্ধে পরাজিত করতে পারে পৃথিবীতে এমন কে আছে? তা হলে একবার লড়েই দেখা যাক। বিনাযুদ্ধে সূচ্যগ্ৰ ভূমিও আমি দেবনা। এ আমার শেষ কথা।
ভীমের পদাঘাতে উরুভগ্ন দুৰ্যোধনকে কৃষ্ণ যখন তীব্র তিরস্কার করছেন তখন নিষ্পিষ্টপুচ্ছ সৰ্প যেমন অর্ধেক শরীর নিয়ে ফণা তুলে দাঁড়ায় দুৰ্যোধনও তেমনি হাতের উপর ভর রেখে অর্ধেক শরীর টান করে তুলে ধরলেন। কৃষ্ণের দিকে জলন্ত দুটি চোখের দৃষ্টি স্থির রেখে বললেন–কংসের দাসের জ্ঞাতি তুমি, তোমার লজ্জা নেই, ঘৃণা নেই। কৌরবপক্ষের অন্ততঃ একটি বীরের নাম কর পাণ্ডবরা তোমার কুটিল অপকৌশল ছাড়া যাকে যুদ্ধে জয় করতে পেরেছে। কৃষ্ণ এর উত্তরে দুৰ্যোধনের পাপকাৰ্য্যের একটার পর একটা ফিরিস্তি দিয়ে চললেন। দুৰ্যোধন প্ৰত্যুত্তর দিলেন–আমি পৃথিবী শাসন করেছি, ভোগ করেছি। আমি যা কিছু করেছি তা রাজধর্মে অনুমোদিত। আমি শত্রুর শীর্ষে আরোহণ করেছি। বীরের মত এবার আমি আমার জীবনপ্রান্তে পৌঁছেছি। আমি স্বর্গের গৌরব অর্জন করব। তোমরা কিন্তু এই পৃথিবীর নরককুণ্ডে জীবন্ত শব রূপে বেঁচে থাকবে। দুৰ্যোধনের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে আকাশ থেকে পুষ্পবৃষ্টি হল, সুগন্ধে বাতাস ভরে গেল। সিদ্ধগণের সাধুবাদ ও গন্ধৰ্ব্বগণের গীতিমাধুর্যে দিগন্ত মুখরিত হল। জ্যোতিমালায় আকাশ উদ্ভাসিত হল। বাসুদেব ও পাণ্ডবগণ মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন।
কিন্তু অসাধারণ বীরত্ব সত্ত্বেও দুৰ্যোধনের চরিত্রে এমন একটা ক্রুরতা ছিল যে মহাকবি তাঁকে মহত্ত্বের শিখরে উত্তীর্ণ করতে পারেননি। কৃষ্ণকে শেষ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই যদি দুৰ্যোধন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতেন তবে হয়ত বীরত্বের সঙ্গে খানিকটা মহত্ত্বের দাবীও তিনি করতে পারতেন। কিন্তু তাঁর দুৰ্ভাগ্য তিনি ভগ্ন উরু নিয়ে আরো কিছু সময় বেঁচে রইলেন। এই অল্প সময়ের মধ্যে অশ্বথামাকে দিয়ে নিদ্রিত পাণ্ডব শিবিরে রাত্রির অন্ধকারে এক নিদারুণ নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটালেন। আর এই হত্যাকাণ্ডের খবর শুনে পরম শান্তি ও তৃপ্তিভারে বিন্দুমাত্র অনুতাপ না করে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। দুৰ্যোধন জীবনে কোনদিন বিবেকের দংশন অনুভবও করেননি, কোন কাজের জন্য অনুতাপ করেননি। তার চরিত্রে অন্তদ্বন্দ্বের এমন একটা সৰ্বাত্মক অভাব রয়েছে, আগাগোড়া এমন একটা ক্রুর, নৃশংস ও উদ্ধত সামঞ্জস্য রয়েছে মহাভারতের ট্রাজিডির হিরোর মহিমা তিনি কোনদিন পেতে পারেন না।
ট্রাজিক হিরোর উদাত্ত চারিত্রিক ঐশ্বৰ্য্য রয়েছে কর্ণের। কিন্তু কর্ণেরও একটা বিশিষ্ট সীমা রয়েছে যাকে অতিক্রম করে তার মানবিকতা মহত্তম পৰ্য্যায়ে পৌঁছুতে পারেনি। এই উদার-হৃদয় মহাবীরের জন্মলগ্নের অভিশাপ তাকে মৃত্যু পৰ্য্যন্ত অনুসরণ করেছে। সমাজের উচ্চকোটিতে সদা অবজ্ঞাত এই বীর হৃদয় সামাজিক অন্যায় ও অবিচারে প্রতিক্রিয়া হিসাবে দুৰ্যোধনকৃত সমস্ত পাপাচারের বিশ্বস্ত সহযোগী হতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ একমাত্ৰ দুৰ্যোধনই তাকে প্ৰাপ্য সম্মান দিতে কার্পণ্য করেননি। মাত কুন্তীর কাছে আত্মপরিচয় পাবার পর বিক্ষুব্ধ লাঞ্ছিত হতাশাক্লিষ্ট এই বীরপুরুষ সজ্ঞানে সুনিশ্চিত মৃত্যুর পথে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছেন। সমাজের অবজ্ঞা ও লাঞ্ছনা। এই স্বর্ণহৃদয় বীরপুরুষকে এক নিদারুণ অভিমানের মধ্যে উদাসীন আত্মকেন্দ্ৰিক ও নিঃসঙ্গ করে নির্বাসন দিয়েছে, যার ফলে যুধিষ্ঠিরের মত মানবজীবনের মহত্তম ভাবনার কাছে পৌঁছুবার সুযোগ তার ঘটেনি। সমাজের বিড়ম্বনায় একটা বিরাট সম্ভাবনার অপমৃত্যু এই কৰ্ণচরিত্র। যিনি ঘোষণা করেছিলেন—“দৈবায়ত্তং কুলে জন্ম মদায়ত্তং তু পৌরুষম্’–তিনি যেন শেষ পৰ্য্যন্ত নিবিড় ঔদাসীন্যে দৈবের কাছেই নিজেকে সঁপে দিলেন।
মহাভারতের বিরাট কলেবরে তৎকালীন সমাজের অনেক বিরাট পুরুষের সমাবেশ ঘটেছে। কিন্তু মহাকবির সূক্ষ্ম সামাজিক সংবেদনা। এই বিরাট চরিত্রগুলির দুর্বল রন্ধগুলিকে অবারিত করতে দ্বিধাগ্ৰস্ত হয়নি। ভীষ্ম দ্ৰোণ বিরাট পুরুষ, ভারতীয় ঐতিহে অশেষ শ্ৰদ্ধাভাজন। তবু এদের বিরাটত্ব নীরন্ধ নয়। কবির বাস্তব সমাজদৃষ্টির কাছে এদের দুর্বলতা অনাবিষ্কৃত থাকেনি। এই দুর্বলতার সামাজিক ভিত্তি কোথায় তাও এদের মুখ দিয়েই প্ৰকাশিত হয়েছে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার ঠিক পূর্বক্ষণে যুধিষ্ঠির ভীষ্ম দ্ৰোণ কৃপ ও শিল্যের কাছে একে একে আশীৰ্বাদ প্রার্থনার জন্য উপস্থিত হলেন। ধর্মীরাজের ধর্মবোধের তুলনা নেই। যুদ্ধক্ষেত্রে দুপক্ষের সৈন্যবাহিনী সজ্জিত হয়ে সেনাপতির আদেশের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। যুধিষ্ঠির অস্ত্র ও কবচ পরিত্যাগ করে কুরুসৈন্যের ভিতরে প্রবেশ করলেন। কৌরবপক্ষীয় যোদ্ধগণ উপহাসমুখর হয়ে উঠল—‘পাণ্ডবশ্রেষ্ঠ যুধিষ্ঠির বোধহয় ভয় পেয়েছে, ভীষ্মের কাছে আশ্রয় ভিক্ষা করতে চলেছে। যুধিষ্ঠির ভীষ্মের নিকট উপস্থিত হয়ে এই অপ্রত্যাশিত আগমনের অভিপ্ৰায় ব্যক্ত করলেনআপনি শ্ৰদ্ধেয় গুরুজন। আপনার বিরুদ্ধে আজ আমরা অস্ত্র প্রয়োগ করতে বাধ্য হব। আপনি কৌরবের পক্ষে যুদ্ধ করুন। কিন্তু আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আমাদের অনুমতি দিন, আর আমাদের আশীৰ্বাদ করুন। যুধিষ্ঠিরের এই অত্যাশ্চৰ্য্য আচরণ বীরশ্ৰেষ্ঠ বৃদ্ধ পিতামহের লজ্জাহত বিবেককে আত্মপ্রকাশের পথ করে দিল একটি অকপট স্বীকারোক্তিরূপে। ভীষ্ম বললেন-আমি আজি ক্লীবের মত তোমার কথার উত্তর দিচ্ছি। কৌরবের অর্থে পরিপুষ্ট আমি অর্থদাস। পুরুষ অর্থের দাস, অর্থ পুরুষের দাস নয়। তাই তোমার প্রতিপক্ষীরূপে যুদ্ধ করতে বাধ্য হচ্ছি।
অর্থস্য পুরুষো দাসো দাসস্ত্বর্থো ন কস্যচিত্।
ইতি সত্যং মহারাজ বদ্ধোস্ম্যৰ্থেন কৌরবৈঃ ॥
অতস্ত্বাং ক্লীববিদ্বাক্যং ব্ৰবীমি কুরুনন্দন।
ভূতোস্ম্যৰ্থেন কৌরব্য যুদ্ধাদন্যৎ কিমিচ্ছসি।।
এই অর্থ–দাসত্বের কলুষবন্ধনই বোধ হয় ভীষ্মকে কৌরব সভায় অবমানিতা দ্রৌপদীর ব্যাকুল আবেদন কৌশলে উপেক্ষা করতে বাধ্য করেছিল।
যুধিষ্ঠির তারপর একে একে দ্রোণ কৃপ ও শল্যের নিকট উপস্থিত হয়ে একই কথা বললেন, এবং প্রত্যেকে একই উত্তর দিলেন–
কৌরবের অর্থে প্ৰতিপালিত অর্থদাস আমি আজ ক্লীবের মত তোমার কথার উত্তর দিতে বাধ্য হচ্ছি।
যে সমাজ অর্থের প্রভুত্ব মেনে নেয় সে সমাজে মহাবীরও দুর্বল, মহাপুরুষ ও পৌরুষহীন। এই সাবধানবাণী ঘোষণা করার সময় সতদ্ৰষ্টা কবি কি দিব্য চক্ষে বর্তমান ভারতবর্ষকে দেখতে পেয়েছিলেন? ধৰ্মরূপী বিদুর কিন্তু কৌরবের অন্ন ও অর্থ প্ৰত্যাখ্যান করেছিলেন, স্বাধীন সত্তায় সমৃদ্ধ পর্ণকুটীরের ক্ষুদকণাকেও অমৃত বলে গ্রহণ করেছিলেন। এই দাসীপুত্র কোনদিন অন্যায় ও অধর্মের কাছে মাথা নোয়াননি। বিদ্যুরের বিবেক নিটোল, নিষ্কলুষ নিশ্চিন্দ্ৰ। মহাভারতকার ঘোষণা করলেন—এই দাসীপুত্ৰই সাক্ষাৎ ধর্ম। মহাভারতের নাটকীয় ঘটনাবর্তে বিদুরের উপস্থিতি প্ৰত্যক্ষ নয়, কিন্তু পরোক্ষ। তিনি নির্ভীক স্পষ্টবাদী, কিন্তু মহাকাব্যের প্রধান ঘটনা স্রোতে স্পষ্টত; অংশ গ্ৰহণ করেননি। তার আত্মা যুধিষ্ঠিরের মধ্যে প্রতিফলিত হয়ে মহাকাব্যের শ্রেষ্ঠ নায়করূপে প্ৰকাশিত হয়েছে। তাই মহাভারতের উপাখ্যান বলছে–স্বয়ং ধর্ম দাসীপুত্ৰ বিদুবরূপে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছেন এবং যুধিষ্ঠির হলেন ধর্মের আত্মজ।
প্ৰত্যেকটি চরিত্রে মহাকবি যে গভীর অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় দিয়েছেন, ঘটনার গতির সঙ্গে চরিত্রগুলির সঞ্চার পদ্ধতিকে যে ভাবে তিনি মেলাতে পেরেছেন, একটা সমগ্র মহাদেশের সমগ্র যুগব্যাপী বিপুল ঘটনা-স্রোতের মধ্যে যে ভাবে ভারসাম্য বজায় রেখে তিনি অবাধে ঘোরাফেরা করেছেন তাতে শুধু বিস্ময় বোধ করাই যথেষ্ট নয়, বিনম্র শ্রদ্ধায় অভিভূত অন্তরে এই মহাকবিকে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ মহাকাব্য প্রণেতা বলে প্ৰণাম করতে হয়।
একদিকে ক্ষত্ৰিয় হিসাবে দুৰ্যোধনের অতিসীমিত আপেক্ষিক বিকৃত মূলবোধ, অন্যদিকে যুধিষ্ঠিরের মহত্তম সর্বাত্মক মানবিক মূলবোধ-মহাভারতের ংঘর্ষের মূলভিত্তি এই বিপরীতমুখী মূল্যবোধের বিরোধ। মহাভারতের ভূমিকায় একইে ‘মনুস্ময়ো মহাদ্রুমঃ’ এবং ‘ধর্মময়ো মহাদ্রুমের” বিরোধ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। ভূমিকা থেকে স্বৰ্গারোহণ পর্ব পর্যন্ত এই বিরোধেরই বিস্তার পরিণতি ও উপসংহার। এই ভাবে সমগ্ৰ মহাভারতের একটা একটানা সাধারণ সঙ্গতি আছে, একটা ভাবগত ঐক্য আছে, বক্তব্যের একটা সহজ অক্লিষ্ট সামঞ্জস্য আছে কোন দৃষ্টিশীল সমালোচক যাকে উপেক্ষা করতে পারেন না। লোভের গ্রাস থেকে মানুষকে বাচাতে হবে, বিদ্বেষের বিষবাস্প থেকে মানুষকে রক্ষা করতে হবে, মানুষ ও পৃথিবীকে মৃত্যুর কবল থেকে মুক্ত করতে হবে-এই হল মহত্তম মনুষ্যত্ব। কিন্তু তবু যদি ধ্বংস নেমে আসে, প্রস্তুত হও, মহামানবের মহাকাল-রূপ দেখে ভয় পেওনা। তখন যেন শ্মশান-বৈরাগ্য না আসে। অর্জুন বিশ্বরূপকে দেখেছিলেন লোকক্ষয়কারী কালরূপে। অৰ্জুন কুরুক্ষেত্ৰযুদ্ধে নেমে বললেন, আমি ধ্বংস চাইনা, যুদ্ধ করতে পারব না। এ বৈরাগ্য নয়, বিহ্বলতা। মুহূর্তমাত্র পূর্বে হতাশাহাদয় ধৰ্মরাজকে প্ৰবোধ দিয়ে বীরদৰ্পে অর্জুন যুদ্ধক্ষেত্রে রথ ছুটিয়ে এসেছেন। এখন কি তিনি নূতন করে আবিষ্কার করলেন যে যুদ্ধে ধ্বংস হবে ? ধ্বংস জেনেও যুদ্ধ করতে হবে। অন্যায়ের কাছে মাথা নুইয়ে মানুষ বিবাগী হতে পারে না।
কিন্তু মনে রাখতে হবে এ যুদ্ধে বিজেতা শান্তি পাবেনা। ভয়ঙ্কর বিনাশের মধ্য দিয়ে জয়লাভ করলে তার বেদন যেন বিজেতার বিবেককে আঘাত করে। না হলে মানুষ পশুতে পরিণত হবে। এই বিবেকের মহত্তম ঐশ্বৰ্য্য ছিল যুধিষ্ঠিরের। তাই তিনি ধৰ্মরাজ, অসুখী ধৰ্মরাজ, বিজয় গৌরবে উদ্ধত শক্তিমদমত্ত রাজা নন। তিনি। তিনি বিজয়ের বেদনায় অবনত, মানবিক মহিমায় সমুন্নত ধৰ্মরাজ। এই বিবেক বেঁচে থাকলে বর্তমান ধ্বংসের মধ্যেও ভবিষ্যৎ মনুষ্যত্বের বাঁচার আশা আছে। ভবিষ্যতের মানুষ তখন দ্বিগুণ উৎসাহে সৰ্বাত্মক ধ্বংসকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করবে। কুরুক্ষেত্রের রক্তমেধ পার হয়ে পৃথিবীতে শান্তি আসেনি। তবু এ রক্তমেধ সেদিন বন্ধ করা যায়নি। কুরুক্ষেত্রের নির্মম হানাহানির পর মানবাত্মার মিলন হ’ল পরপারে। সম্পদলোভীর লোভকে সংযত করে, শক্তিমান দীপিতের দৰ্প খর্বিত করে এ পৃথিবীতেই কি বিদ্বেষ-বিষমুক্ত মানুষের মিলন ঘটানো সম্ভব হবে না? মহামানবকে আর কতবার মহাকালের রূপ ধারণ করতে হবে? —মহাভারতের মহাকবি এই অনুচ্চারিত জিজ্ঞাসা সুদূর অতীত থেকে বর্তমানের মানুষের কাছে উপস্থিত করেছেন।