॥ মহাভারতের জানা-অজানা ॥
মহাভারত নানা পৌরাণিক তথ্যের এক মহাখনি। পড়তে পড়তে অনেক কৌতুহলোদ্দীপক তথ্যই মুহূর্তের জন্যে আনন্দ দিয়ে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যায়। কিছু এই রকম তথ্যকেই প্রয়োজনে হাতের কাছে পাবার এক সামান্য প্রয়াস এই ‘জানা-অজানা’র দর্পণ।
॥ মহাভারতের জানা-অজানা ॥
১। মহাভারত বিশ্বের বৃহত্তম মহাকাব্য। এত দীর্ঘ মহাকাব্য এবং এত বেশি সংখ্যক চরিত্রের সন্নিবেশ বিশ্বের আর কোনও মহাকাব্যে নেই।
২। মহাভারতের স্রষ্টা, পরাশর-সত্যবতীর ছেলে এবং শুকদেবের বাবা, মহর্ষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস। তিনি মূল মহাভারত রচনা করেছিলেন সংস্কৃত বা দেবভাষায়।
৩। মহাভারতের শ্লোক সংখ্যা এক লক্ষ।
৪। মূল সংস্কৃত থেকে ব্যাসদেবের মহাভারতের অবিকৃত বাংলা অনুবাদ প্রথম করেন মহাত্মা কালীপ্রসন্ন সিংহ। এ বিষয়ে তাঁকে সাহায্য করেন পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সহ বহু দেশখ্যাত বিদগ্ধ জ্ঞানীজনেরা।
৫। কাশীরাম দাস পয়ারাদি ছন্দে যে বাংলা মহাভারত লেখেন, তা মূলত ব্যাসদেবের মহাভারতের ওপর নির্ভরশীল হলেও তা কখনই ব্যাসদেবের মহাভারতের আক্ষরিক বঙ্গানুবাদ নয়। তিনি তাঁর নিজের মতো করেই লিখেছেন সে মহাভারত।
৬। প্রাচীনত্বের দিক থেকে বিশ্বের আদি কাব্য মহর্ষি বাল্মীকি রচিত রামায়ণের পরেই মহর্ষি ব্যাসদেব রচিত মহাভারতের স্থান।
৭। প্রাচীনপন্থীদের মতে মহাভারতের রচনাকাল খ্রিস্টের জন্মের তিন হাজার বছর আগে।
প্রবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত বলেছেন, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ২৪৪৯ অব্দে। বঙ্কিমচন্দ্রের মতে, যুদ্ধের সময়কাল খ্রিস্টপূর্ব ১৫৩০ বা ১৪৩০ অব্দ। বালগঙ্গাধর তিলক, যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি প্রমুখের মতে যুদ্ধ হয়েছে খ্রিস্টের জন্মের ১৪০০ বছর আগে।
ইয়োরোপীয় পণ্ডিতরা মনে করেন খ্রিস্টের জন্মের ৪০০ থেকে ৫০০ বছর আগে লেখা হয়েছিল মহাভারত।
রমেশচন্দ্র দত্ত এবং প্র্যাট্-এর মতে খ্রিস্টপূর্ব দ্বাদশ শতাব্দীতে জন্ম। হয়েছিল এই মহাকাব্যের।
ডক্টর সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণের মতে মহাভারত তার বর্তমান আকার পায়। খ্রিস্টের জন্মের ৫০০ বছর আগে।
এই মহাকাব্যের রচনাকাল নিয়ে পণ্ডিতে-পণ্ডিতে মতের লড়াই দীর্ঘ দিন ধরেই চলে আসছে এবং মনে হয় চলতেই থাকবে।
৮। আঠের পর্বে বিভক্ত লক্ষশ্লোকী মহাভারত। পর্বগুলো হল:
১। আদি, ২। সভা, ৩। বন, ৪। বিরাট, ৫। উদ্যোগ, ৬। ভীষ্ম, ৭। দ্রোণ, ৮। কর্ণ, ৯। শল্য, ১০। সৌপ্তিক, ১১। স্ত্রী, ১২। শান্তি, ১৩। অনুশাসন, ১৪। অশ্বমেধ, ১৫। আশ্রমবাসিক, ১৬। মুষল, ১৭। মহাপ্রস্থান আর সর্বশেষ ১৮। স্বর্গারোহণ।
৯। মহাপ্রস্থানের পথে দ্রৌপদী এবং চার পাণ্ডবের পতনের কারণ :
পতনক্রম | নাম | পতনের কারণ |
১। | দ্রৌপদী | অর্জুনের প্রতি বিশেষ পক্ষপাত। |
২। | সহদেব | ‘আমার মতো বুদ্ধিমান আর কে থাকতে পারেন?’ —এই অহংকার। |
৩। | নকুল | ‘আমার মতো সুন্দর আর কেউ নেই।’ —এই অহংকার। |
৪। | অর্জুন | ‘সব শত্রুকে আমি এক দিনেই বধ করব।’ এবং ‘আমার মতো ধনুর্ধর আর কেউ নেই।’ —এই অহংকার। |
৫। | ভীম | মাত্রাতিরিক্ত ভোজন আর অন্যের শক্তি না জেনে সদম্ভ আস্ফালন। |
১০। অজ্ঞাতবাসে থাকাকালীন পাণ্ডবদের ব্যবহৃত ছদ্মনাম :
প্রকৃত নাম | ছদ্মনাম | কাজ |
যুধিষ্ঠির | কঙ্ক | রাজার সাথে পাশা খেলা। |
ভীম | বল্লব | পাচকের কাজ, রান্নাবান্না। |
অর্জুন | বৃহন্নলা | উত্তরাকে নাচ-গান শেখানো। |
নকুল | গ্রন্থিক | অশ্বশালার তত্ত্বাবধান। |
সহদেব | তন্তিপাল | গোশালার তত্ত্বাবধান। |
দ্রৌপদী | সৈরিন্ধ্রী | রানী সুদেষ্ণার পরিচারিকার কাজ— চুল বাঁধা, রানীর গায়ে সুগন্ধী মাখানো, মালা গাঁথা, ইত্যাদি। |
১১। কার শঙ্খ কোন্টা?
শ্রীকৃষ্ণ— পাঞ্চজন্য | অর্জুন— দেবদত্ত | |
যুধিষ্ঠির— অনন্তবিজয় | নকুল— সুঘোষ | |
ভীম— পৌন্ড্র | সহদেব— মণি-পুষ্পক |
১২। এক অক্ষৌহিণী সেনা মানে কত সৈন্য?
এক অক্ষৌহিণী সেনা— | |
পদাতিক— | ১,০৯,৩৫০ জন |
ঘোড়া— | ৬৫,৬১০ টা |
হতি— | ২১,৮৭০ টা |
রথ— | ২১,৮৭০ টা |
মোট— | ২,১৮,৭০০ |
চতুরঙ্গ সেনা। |
১৩। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কার হাতে কে প্রাণ দিলেন? (উল্লেখযোগ্য ইন্দ্র পতন)
হস্তা | হত | হন্তা | হত |
যুধিষ্ঠির | শল্য | ধৃষ্টদ্যুম্ন | দ্রোণ, শাল্ব |
ভীম | দুর্যোধনসহ | ||
গান্ধারীর শত পুত্র | অশ্বত্থামা | ধৃষ্টদ্যুম্ন, দ্রৌপদীর পাঁচ ছেলে, পরীক্ষিত (পুনর্জীবিত) | |
অর্জুন | জয়দ্ৰথ, কর্ণ, | ||
বৃষসেন | দ্রোণ, কৃপ, কর্ণ অশ্বত্থামা, বৃহদ্বল কৃতবর্মা | ||
সহদেব | শকুনি, উলুক | দুঃশাসনের ছেলে বা মতান্তরে— দ্রোণ, কৃপ, কর্ণ, অশ্বত্থামা, শকুনি, | অভিমন্যু |
কর্ণ | ঘটোৎকচ | জয়দ্রথ এবং দুঃশাসন। বা মতান্তরে— | |
দ্রোণ | দ্রুপদ, বিরাট | কর্ণ, দুঃশাসন, কৃপাচার্য, দুর্যোধন, দ্রোণাচার্য, অশ্বত্থামা এবং জয়দ্রথ। |
১৪। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ মোট ১৮ দিন ধরে চলেছিল।
১৫। যুদ্ধ শেষে দু’পক্ষ মিলিয়ে মাত্র ১০ জন বীর বেঁচেছিলেন। এরা হলেন: পাণ্ডব পক্ষে (৭ জন)
যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল, সহদেব, সাত্যকি আর শ্রীকৃষ্ণ।
কৌরব পক্ষে (৩ জন)
অশ্বত্থামা, কৃপাচার্য আর কৃতবর্মা।
১৬। হনুমান মহাভারতের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। ইনি অর্জুনের (কপিধ্বজ) রথের ওপর বসে এমন হুংকার দিয়েছিলেন যে, তাতেই অনেক কুরুসেনার আত্মারাম খাঁচার বাইরে বেরিয়ে যায়।
১৭। যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে বিভীষণ উপস্থিত ছিলেন। প্রথমে যুধিষ্ঠিরকে প্রণাম করতে চাননি। বলেন, ‘কৃষ্ণ ছাড়া আর কারো কাছে আমি মাথা নোয়ব না। কারণ এ মাথা আমি রামের কাছে নত করেছি।’
কৃষ্ণ তখন স্বয়ং সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করলেন যুধিষ্ঠিরকে। বিভীষণ লজ্জা পেলেন। তখন তিনিও যুধিষ্ঠিরকে প্রণাম করলেন।
১৮। এক মতে, রাবণের সাথে অর্জুনের লড়াই হয়েছিল কৈলাসে। অর্জন রাবণকে বেদম প্রহার করে ছেড়ে দেন। রাবণের সৎ দাদা কুবেরের সঙ্গে পাণ্ডবদের খুবই বন্ধুত্ব ছিল।
১৯। দ্রৌপদী-যুধিষ্ঠিরের একান্তে কথা বলার সময় ঘরে ঢুকে পড়ায়, শর্ত মতো ব্রহ্মচর্য পালনে বার বছরের জন্যে বনে যান অর্জুন। ব্রহ্মচর্য কিন্তু পালন করা হয়নি। একের পর এক বিয়ে করে বছরের পর বছর শ্বশুর বাড়িতে কাটিয়েছেন।
২০। অর্জুন মহাপ্রস্থানের আগেও অন্তত দু’বার মারা গেছেন। একবার বকরূপী ধর্মের হাতে। আর একবার ছেলে বভ্রুবাহনের হাতে।
২১। ‘অস্ত্র ধরব না’ বলেও কৃষ্ণ যুদ্ধে দু’বার সুদর্শন চক্র নিয়ে তেড়ে গিয়েছিলেন ভীষ্মকে মারতে। একবার যুদ্ধের তৃতীয় দিনে। একবার নবম দিনে। পণ্ডিত সুখময় ভট্টাচার্য শাস্ত্রী সপ্ততীর্থের মতে, এ ঘটনা সম্ভবত একবারই ঘটেছিল। নবম দিনে। তৃতীয় দিনের উল্লেখ পুনৰ্কৰ্থন হয়ে থাকবে। ভীষ্ম ছিলেন অর্জুন আর দ্রৌপদীর মতোই অসামান্য কৃষ্ণ-ভক্ত। ভীষ্মের তীব্র ইচ্ছে ছিল, তাঁর ইষ্টদেবতার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করাবেন। সম্ভবত প্রতিজ্ঞা ছিল। সত্যব্রত ভক্তের প্রতিজ্ঞা রাখতে ভগবান তাই নিজের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেন।
২২। মহাভারতের যুগেও আধুনিক বিমানের মতোই বিমান ছিল। কৃষ্ণের সঙ্গে ‘সৌভ’ নামের এক বিমান থেকে যুদ্ধ করেন ‘শাল্ব’ নামে এক রাজা। কৃষ্ণ সুদর্শন চক্র দিয়ে বিমানসহ তাঁকে ধ্বংস করেন। রামায়ণে পুষ্পক বিমানের যে বর্ণনা আছে, তার সাথে একালের বিমানের সাদৃশ্য বিস্ময়কর।
২৩। বৈবস্বত মনুর মেয়ে ‘ইলা’ মহাদেবের বরে একমাস পুরুষ আর একমাস নারী হয়ে থাকতে পারতেন।
২৪। শিখণ্ডী প্রথমে নারী হয়ে জন্মান। সেই অবস্থাতেই দ্রুপদ তাঁর বিয়ে দেন রাজা হিরণ্যবর্মার মেয়ের সাথে। বিয়ের পরেই স্ত্রী তাঁর বাবাকে সব ফাঁস করে দিলে দ্রুপদের সাথে হিরণ্যবর্মার যুদ্ধ বাধে। আত্মহত্যা করতে গিয়ে শিখণ্ডী কুবেরের চর স্থূণাকর্ণের কাছ থেকে পৌরুষ ধার নেন। কুবেরের শাপে সেই ধার আর শোধ হয়নি। শিখণ্ডী পুরুষই থেকে গেলেন। গুণাকর্ণ হয়ে গেলেন নারী।
২৫। বিশ্বের প্রথম নলজাতক শিশু সম্ভবত দ্রোণ। যদিও রামায়ণ-মহাভারতে অযোণীসম্ভৃত শিশুর অভাব নেই।
২৬। যুধিষ্ঠির রামায়ণ শুনেছিলেন মার্কণ্ডেয় মুনির কাছে।
২৭। দ্রৌপদীর অবমাননা সহ্য করতে না পেরে কুরুসভায় ভীম যুধিষ্ঠিরের হাত পুড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন।
২৮। গাণ্ডীবের অপমান করায় অর্জুন প্রতিজ্ঞা রাখতে যুধিষ্ঠিরকে কাটতে চেয়েছিলেন।
২৯। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের শেষে ধৃতরাষ্ট্রের একশ দুই সন্তানের মধ্যে মাত্র দু’জন বেঁচেছিলেন। সৌবলীর গর্ভজাত ছেলে ‘যুযুৎসু’, যিনি পাণ্ডবপক্ষে যোগ দিয়েছিলেন, আর গান্ধারীর গর্ভজাত মেয়ে ‘দুঃশলা’, জয়দ্রথের স্ত্রী।
৩০। কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধের সময় যুধিষ্ঠিরের বয়স ছিল ৬৫ বছর, ভীম আর দুর্যোধনের ৬৪, অর্জুন আর কৃষ্ণের ৬৩, নকুল আর সহদেবের ৬২ বছর।
৩১। কে কত বছর বেঁচেছিলেন?*
নাম | আয়ু |
কৃষ্ণ | ১০৭ বছর (১০৬+) |
যুধিষ্ঠির | ১০৯ বছর (১০৮+) |
ভীম | ১০৮ বছর (১০৭+) |
অর্জুন | ১০৭ বছর (১০৬+) |
নকুল | ১০৬ বছর (১০৫+) |
সহদেব | ১০৬ বছর (১০৫+) |
দ্রৌপদী | কম-বেশি ১০০ বছর। |
দুর্যোধন | ৭২ বছর (৭১+) |
অভিমন্যু | ১৬ বছর। |
৩২। বিরাট রাজার বাড়িতে প্রকাশ্য ছদ্মনাম ছাড়াও নিজেরদের যে সাংকেতিক নামে ডাকতেন পাণ্ডবরা:
নাম | সাংকেতিক নাম |
যুধিষ্ঠির | জয় |
ভীম | জয়ন্ত |
অর্জুন | বিজয় |
নকুল | জয়ৎসেন |
সহদেব | জয়দ্বল |
লক্ষ্যণীয় হল যে, সবার নামেই ‘জয়’ শব্দটাকে রাখা হয়েছে।
৩৩। যুদ্ধ যাতে এড়ানো যায় সে উদ্দেশ্যে যুধিষ্ঠির দুর্যোধনের কাছে যে পাঁচটা গ্রাম চেয়েছিলেন— কুশস্থল, বৃকস্থল, মাকন্দি, বারণাবত এবং আর একটি গ্রাম।
মতান্তরে—
পাণিপ্রস্থ (পানিপথ), সোনপ্রস্থ, ইন্দ্রপ্রস্থ, তিলপ্রস্থ এবং ভাগপ্রস্থ।
৩৪। দুর্যোধনের স্ত্রীর নাম মহাভারতে নেই। বেণীসংহার নাটকে ‘ভানুমতী’-কে দুর্যোধনের স্ত্রী বলা হয়েছে। ভানুমতী অত্যন্ত সুন্দরী ছিলেন। তাঁর বাবা কলিঙ্গরাজ চিত্রাঙ্গদ। দুর্যোধন স্বয়ংবর সভা থেকে ভানুমতীকে জোর করে তুলে নিয়ে আসেন। তবে লম্পট দুর্যোধন এক স্ত্রীতেই তৃপ্ত ছিলেন বলে মনে হয় না। সম্ভবত তাঁর আরও অনেক স্ত্রী ছিল।
৩৫। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে বাঙ্গালী রাজারা দুর্যোধনের পক্ষে যুদ্ধ করেছেন।
৩৬। এক বছরের অজ্ঞাতবাসের উদ্দেশ্যে বিরাটনগরে ঢোকার আগে যুধিষ্ঠির রামের মতোই দুর্গার আরাধনা করেছেন। মা দৃগার আশীবাদ মাথায় নিয়েই তিনি বিরাটনগরে প্রবেশ করেছেন।