মহাভারত

মহাভারত

পয়লা ফেব্রুয়ারি দিবস, কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির বার্ষিক সম্মেলনে লাটসাহেব শ্ৰীযুত শান্তিস্বরূপ ধাওন যা বলেন তার বিগলিতাৰ্থ– আমি তিনখানা খবরের কাগজের রিপোর্টের ওপর নির্ভর করে আমার নিবেদন জানাচ্ছি- এতাবৎ ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা মহাভারতের তথা ভারতীয় সভ্যতার ব্যাখ্যা (ইন্টারপ্রিট) করেছেন তাঁদের পশ্চিমী দৃষ্টিভঙ্গি দৃষ্টিকোণ দৃষ্টিবিন্দু (উয়েসটার্ন আইজ) দিয়ে। এখন আমাদের ভারতীয়দের উচিত, ভারতীয় সভ্যতা (শ্ৰীযুত ধাওন সভ্যতার–সিভলিজেশন-এর সঙ্গে কালচার বলেছিলেন কি না সেটা খবরের কাগজ উল্লেখ করেনি। এটা গুরুত্বব্যঞ্জক। কারণ যে কোন একটা জাতি, দেশ, নেশন অতিশয় সিভিলাইজড না হয়েও কালচার, বৈদগ্ধ্যের উচ্চাসন গ্রহণ করতে পারে। আমি ধরে নিচ্ছি শ্ৰীযুত ধাওন দুটোই বলতে চেয়েছেন। ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যাখ্যা করা।

এ অতি উত্তম প্রস্তাব সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। আমাদের অজানা নয় যে, যবে থেকে ইংরেজ আপন স্বার্থের জন্য ভারতবর্ষে এসেছে সেই থেকেই এ দেশের নিন্দাবাদ করেছে। গোড়ার দিকে মৃদুকণ্ঠে, মোলায়েম মোলায়েম ভাবে। পরে যখন বণিকের মানদণ্ড পুরোপাক্কা রাজদণ্ডে পরিণত হল তখন ভারত বাবদে তার অন্যতম প্রধান কর্তব্য হয়ে দাঁড়াল বিশ্বজনের সামনে সপ্রমাণ করা : ভারতবর্ষ অতিশয় অশিক্ষিত, অসভ্য, অনলচরড দেশ এবং এ দেশকে সভ্য ভদ্র সত্যধর্মে –খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করার জন্য ইংরেজ নিতান্ত পরোপকারার্থে, প্রতি খ্রিস্টজনের যা কর্তব্য, অর্থাৎ বর্বরদের সভ্য করার জন্য এ দেশে এসেছে, এবং এই পাষণ্ড, নেমকহারাম দুশমনের কলকাতা শহরের জলাভূমির আমাশা, নানাবিধ জ্বর রোগে সাতিশয় ক্লেশ ভুঞ্জিয়া সদ্যপ্রভুর পদপ্রান্তে আপন আত্মা নিবেদন করছে, সেক্রিফাইস করছে, এক কথায় মার্টার বা শহিদ হয়েছে। এই যে ইংরেজের দম্ভোলিদম্ভ- এরই ঘৃণ্য ভণ্ডনাম হোয়াইট মেনস বার্ডেন। তদর্থ, গড ধবলাঙ্গদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন, সে যেন শ্যামাঙ্গ, কৃষ্ণাঙ্গ, রক্তাঙ্গ (রেড ইন্ডিয়ান), পীতাঙ্গ পৃথিবীর কুল্লে জাতকে শিক্ষিত সভ্য করার গুরুভার (বার্ডেন) আপন স্কন্ধে তুলে নেয়। এ বার্ডেন বইতে গিয়ে ইংরেজাদি শ্বেতাঙ্গদের কী পরিমাণ মুনাফা হয়েছে সে তত্ত্ব আমরা হাড়ে হাড়ে জানি। থ্রি মেন ইন এ বোট-এর প্রখ্যাত রসাচার্য ভারতপ্রেমী লেখক জরৌম কে জরৌম এই বার্ডেন ভণ্ডামিকে তীব্রতর ভাষায় ব্যঙ্গ করে এই শতকের গোড়ায় একটি প্রবন্ধ লেখেন : হোয়াইট মেনস বার্ডেন– হোয়াই শুড ইট বি সো হেভি? কিংবা ওই ধরনের। তিনি নানা প্রকারের ঠাট্টামশকরা ব্যঙ্গবিদ্রূপ সারার পর বক্রোক্তি করেন, হোয়াইট মেনস বার্ডেন বইতে গিয়ে আমরা যে আত্মত্যাগ, পরার্থে প্রাণ দান করলুম তাতে করে আমাদের কী ফায়দা হয়েছে? এই নেমকহারাম ইন্ডিয়ানরা (বলা বাহুল্য, ইংরেজের আত্মত্যাগ, ভারতীয়ের নেমকহারামি জরৌম আগাপাশতলা উল্টো বুঝলি রামার্থে নিয়েছেন। যদি আমাদের বার্ডেন বওয়ার মূল্য না বুঝে এখন নিজের বার্ডেন নিজেই বইতে চায় (ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন তখন জোরদার জরৌম তার প্রতি অনুরাগী) তবে ফেলে দে না, বাবা, ওই মূর্খদের স্কন্ধে ওদের আপন বার্ডেন। চলে আয় ওদেশ ছেড়ে। বয়ে গেছে আমাদের।

এ তো গেল। ওদিকে আরেক শিরঃপীড়া। ইংরেজের বাক্যরীতিতেই বলি, সে একাই তো বেলাভূমিতে একমাত্র উপলখণ্ড নয়। আরও মেলা চিড়িয়া রয়েছে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় কেবল অতি সামান্য একটা কারণে একটু মুশকিল বাধল। সেটা হচ্ছে এই যে, পৃথিবীর অন্য দেশগুলোকে ভূতে পায়নি।

এস্থলে দেখা ইতোমধ্যে ইউরোপের অন্যান্য জাত ভারতের অনেক অনেক উত্তম উত্তম। গ্রন্থ- অবশ্য অধিকাংশ অনুবাদে পড়ে ফেলেছে। দারাশিকুহকৃত উপনিষদের ফারসি অনুবাদ কিংবা তার আদেশে কৃত অনুবাদ (মুজমা-ই-বহরেন–দ্বিসিন্ধু মিলন) লাতিনে অনূদিত হয়েছে। ইংরেজ পড়ল বিপদে। উপনিষদ হিন্দু ধর্মগ্রন্থ। তার ফারসি অনুবাদ করল এক মুসলমান। তার লাতিন অনুবাদ করল এক খ্রিস্টান পাদ্রি এবং তার উচ্ছ্বসিত প্রশস্তি গাইল সেদিনকার– সর্বোত্তম বললেও অত্যুক্তি করা হয় না– সর্বসংস্কারমুক্ত, ধর্ম-নিরপেক্ষ দার্শনিক শোপেনহাওয়ার।

ইতোমধ্যে, শেক্সপিয়রের সঙ্গে সঙ্গে যার নাম অনেকেই করে থাকেন সেই কবি গ্যোটে শকুন্তলা নাট্যকে প্রশংসা প্রশংসায় স্বর্গে তুলে দিয়েছেন– না, ভুল বললুম,–তিনি বললেন, এই নাট্যেই স্বর্গ এবং পৃথিবী সম্মিলিত হয়েছে।

ইংরেজ জাত ঘড়েলস্য ঘড়েল। সে সুর পালটাল। অবশ্য আমার বক্তব্য এ-নয়, যে নিরপেক্ষ প্রাচ্যবিদ্যামহার্ণব কোনও ইংরেজ কস্মিনকালেই ছিল না। কিন্তু কে পরোয়া করে তাদের?

তাই আজ যখন প্রশ্ন উঠেছে, মহাভারত কাল্পনিক না ঐতিহাসিক তখন ইংরেজ পণ্ডিতেরই বরাত দেওয়া প্রকৃষ্টতম পন্থা। উওশবর্ন হপকিনস তার একাধিক প্রামাণিক গ্রন্থে বলেছেন (যে কারণে, অধমের জানা মতে, ধর্ম বিষয়ে সর্বোৎকৃষ্ট এনসাইক্লোপিডিয়ায় তিনি মহাভারত সম্বন্ধে প্রামাণিক প্রবন্ধ রচনা করার জন্য সম্মানিত আমন্ত্রণ পান), নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে মহাভারত কাব্যে কোনও সত্যকার সংঘর্ষ প্রতিবিম্বিত হয়েছে– ইট (মহাভারত) অনডাউটেডলি রিফলেটস সম্ রিয়েল কনটেসট। পুনরপি তিনি বলেছেন, সত্য ঐতিহাসিক পদ্ধতিতে আমরা যদি পুরাণে উল্লিখিত রাজবংশসমূহের তালিকা (লিস্টস) মহাভারতের সঙ্গে মিলিয়ে দেখি তবে পাই যে মহাভারতের নানা প্রকারের কিংবদন্তির পশ্চাতে সত্য ইতিহাস বিম্বিত হয়েছে। স্বর্গত গিরীন্দ্রশেখর ঠিক এই মতটিই তার প্রামাণিক গ্রন্থে সপ্রমাণ করেছেন; এ-পত্রিকার সম্পাদকীয় স্তম্ভে তার উল্লেখ হয়েছে।

সব থাক, সব যাক্। পাঠক, তোমার কমনসেনস কী বলে? কোনও কিছু ঘটেনি, কোনও কিছু হয়নি, এ যেন হাওয়ার-কোমরে দড়ি বাধা!

ঠিক তেমনি, খোঁড়াখুঁড়ি করে কিছু পাওয়া যায়নি বলে সব ঝট হ্যায়? তবে একটি ছোটিসি চুটকিলা পেশ করি। এক রেড ইন্ডিয়ান বলল তার দেশে খোঁড়াখুঁড়ির ফলে বেরিয়েছে প্রাগৈতিহাসিক যুগের টেলিগ্রাফের তার। অতএব সে-যুগেই তারা টেলিগ্রাফি জানত। উত্তরে এসকিমো বলল, তার দেশে খোঁড়াখুঁড়ি করে কোনও প্রকারের তার পাওয়া যায়নি। অতএব তারা বেতার ওয়্যারলেস ব্যবহার করত।

কিন্তু আমার শিরঃপীড়া ভিন্ন। মহাভারতের মতো কোনও গ্রন্থই বার বার পুনর্বার আমি পড়িনি। অথচ প্রতিবার নব নব সমস্যা দেখা দেয়। সে কথা আর এক দিন হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *