মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকালমাঝে

মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকালমাঝে

অর্জুনকে বিশ্বরূপ দেখিয়েছিলেন কৃষ্ণ। সে-কথা আমরা গীতায় পড়েছি। শুনেছি, সেই বিশ্বরূপ সহ্য করতে পারেননি অর্জুন। তার কারণ কৃষ্ণ অর্জুনকে যা দেখিয়েছিলেন তা বিশ্বের অন্তররূপ। সেই রূপের সঙ্গে আমাদের পরিচিত বিশ্বের কোনও মিল নেই।

এ-যুগের বিজ্ঞানও আমাদের আর এক বিশ্বরূপ দেখাচ্ছে। মহাজগতের সেই অনির্বচনীয় রূপের সঙ্গে আমাদের চেনা জগতের কোনও সাদৃশ্যই নেই। কৃষ্ণের মতো আধুনিক বিজ্ঞানও আমাদের দেখাচ্ছে জগতের ভিতরকার রূপটা, যার সঙ্গে আমাদের পরিচিত বহির্বিশ্বের মিলই নেই। আর অর্জুন যেমন সহ্য করতে পারেননি কৃষ্ণের সেই বিশ্বরূপ, তেমনি আমাদের কাছেও একেবারেই সহনীয় নয় মহাজগতের বিজ্ঞান-উন্মোচিত অন্তরলোক। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিলেই বুঝবেন, কেন বিশ্বের এই অন্তর্নিহিত রূপ হতে পারে অকল্পনীয়, অসহনীয়।

ধরুন সারাদিন পরিশ্রমের পর খুব ক্লান্ত আপনি। বাড়ি ফিরে এক গেলাস জল খেতে চান। কিন্তু কোথায় জল! যে বস্তুটি গেলাস থেকে আপনার গলা দিয়ে নামবে তা আসলে জলের কোটি কোটি কণা; আরও একটু ভিতরে যান— জলের প্রতিটি কণাতে তখন একটি অক্সিজেন, দুটি হাইড্রোজেন অ্যাটম! অর্থাৎ আপনি যা গিলছেন তেষ্টা মেটাতে তা আসলে কোটি কোটি অক্সিজেন আর হাইড্রোজেন অ্যাটম। জলকে এইভাবে মনে করে সহ্য করতে পারবেন? দম তো বন্ধ হয়ে আসবে এমন জল খেলে!

মহাশূন্যে একটি বাসের মতো বৃহৎ হাবল টেলিস্কোপ ঘন্টায় ১৭ হাজার মাইল গতিতে চলেছে তার কক্ষপথে পৃথিবীর ৪০০ মাইল ওপরে। তবু ২০০ মাইল দূরে একটি পয়সা পড়ে থাকলেও দেখতে পায়। হাবল টেলিস্কোপই আমাদের দেখিয়েছে ১৩.৭ বিলিয়ন বছর আগে কেমন ছিল আমাদের মহাবিশ্ব। তাই হাবল টলিস্কোপকে বলা যেতে পারে একটা টাইম মেশিন যা আমাদের বিশ্বসৃষ্টির আদিতে নিয়ে যেতে সাহায্য করে।

এই COBE স্যাটালাইটই মহাবিশ্বের ‘ডিটেকটিভ’ গল্পের রহস্য সন্ধানে আমাদের সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে। মহাবিশ্বের জন্মলগ্নের খুব কাছে আমাদের পৌঁছে দিয়েছে এই স্যাটালাইট।

ইন্টারন্যাশানাল স্পেস স্টেশন। দুটো ফুটবল খেলার মাঠ একসঙ্গে যত বড়, তত বড় এই স্পেস স্টেশন। ওজন ১ মিলিয়ন পাউন্ড। রাতের আকাশে দেখা যায়—একটি আলোর বিন্দু ধীরে চলছে। এই স্টেশন থেকে অ্যাসট্রোনটরা কাজ করেন। বিশ্বে আরও কোনও গ্রহে প্রাণ আছে কি না সেটা দেখার জন্যে এখানে প্রশিক্ষণও চলছে।

স্পাইরাল গ্যালাক্সির একটি উদাহরণ। ডিশের মতো দেখতে। এর মধ্যে ২০০ বিলিয়নের মতো তারার বাস। তারাগুলির চারপাশে গড়ে ১০টি করে নক্ষত্র হতে পারে। মহাবিশ্বে অন্তত ১২৫ বিলিয়ন গ্যালাক্সির খোঁজ পাওয়া গেছে। তা হলে ভেবে দেখুন মহাবিশ্বে কত গ্রহ আছে। সুতরাং শুধু পৃথিবীতেই প্রাণ আছে একথা ভাবা কতটা উচিত?

অন্য একটি ডিশ-গ্যালাক্সির ছবি যার থেকে একটা ধারণা করা সম্ভব আমাদের গ্যালাক্সি সম্পর্কে। বোঝা যাচ্ছে আমাদের গ্যালাক্সিতে সূর্যটা কোথায় রয়েছে। রয়েছে গ্যালাক্সির কেন্দ্রের বিপুল ব্যস্ততা থেকে অনেক দুরে, নিরাপদ ‘শান্তিনিকেতনে’।

রেড জায়েন্ট অলডেবরন (Aldebaran). পাশে আমাদের সূর্য তুলনায় কত ছোট! আজ থেকে প্রায় ৫ বিলিয়ন বছর পরে আমাদের সূর্যও তার মৃত্যুর আগে হয়ে উঠবে রেড জায়েন্ট এবং গ্রাস করবে পৃথিবীকে তার অগ্নিবলয়ে। তার আগে তো আমাদের অন্য গ্রহে পালাতে হবে।

৫ বিলিয়ন বছর পরে যেভাবে শেষ হবে আমাদের সূর্যের জীবন, এই ছবি থেকে তার ধারণা করা সম্ভব। ছিটকে যাওয়া ধুলো থেকে আবার তৈরি হবে নতুন সৌরজগৎ।

তারাদের মৃত্যুর পরে বহুতারার বিস্ফোরিত ধুলো সঞ্চিত হয়ে তৈরি হল নেবুলা, যেমন এই লেগুন নেবুলা। তার গ্যাস আর ধুলোর মেঘের মধ্যে নতুন তারাদের জন্মের ছবি। আমরা সবাই এই রকম তারার ধুলো দিয়েই তৈরি।

ওরিয়ন—আর একটি সুন্দর নেবুলা যার মধ্যে আমরা দেখতে পাই বহু তারা ও তাদের গ্রহের জন্ম হচ্ছে।

সুন্দর ওরিয়েনের কী সুন্দর আর এক রূপ। এই আলোর দিকে তাকিয়ে মনে আসে রবীন্দ্রনাথের, ‘কোন আলো লাগলো চোখে।’

অ্যানড্রোমেডা—আমাদের কাছের সবচেয়ে বড় গ্যালাক্সি। আমাদের গ্যালাক্সি মিল্কিওয়ের থেকে ২.৫ গুণ বড়। আজ থেকে প্রায় ৩.৫ বিলিয়ন বছর পরে আমাদের গ্যালাক্সির সঙ্গে অ্যানড্রোমেডার ধাক্কা লাগতে পারে। এই ধাক্কার আগেই কিন্তু আমাদের গ্যালাক্সি মিল্কিওয়ে থেকে পালাতে হবে।

মহাশূন্যে দুটি স্পাইর‍্যাল গ্যালাক্সির ধাক্কা। আমাদের গ্যালাক্সির সঙ্গে অ্যানড্রোমেডার ধাক্কা লাগলে ব্যাপারটা কেমন হবে তার আন্দাজ করা যায় এই ছবি থেকে। এর মধ্যে কীভাবে আমরা বাঁচব? বাঁচার পথ অন্য গ্যালাক্সিতে পালানো৷ জগৎ মিথ্যা নয়। এ জন্য স্বাভাবিকভাবেই যতদূর সম্ভব পরিবর্তনশীল। মানিয়ে চলতে হবে আমাদের।

চাঁদের মাটিতে আমার বন্ধু অ্যাসট্রোনট ড. এডনার মিচেল। নিজের চোখে গিয়ে দেখে এসেছেন চাঁদ শুধু অলীক জ্যোৎস্না নয়, আমাদের পৃথিবীর মতোই মাটির তৈরি। আমরা মহাকাশে যত আলোকবিন্দু দেখি তাদের অনেকেই হতে পারে পৃথিবীর মতো ‘রিয়েল এস্টেট’। সূর্য, জুপিটার, ইউরেনাস, নেপচুন ছাড়া সৌরজগতের প্রায় ১২৫টি গ্রহ-উপগ্রহ সবই এইরকম ‘রিয়েল এস্টেট’।

WMAP স্যাটালাইটের সাহায্যে মহাবিশ্বের যে জীবনী তৈরি হয়েছে তা দেখাচ্ছে যে বিশ্বের সব কিছুই আসতে পারে এক কোষের মধ্যে নিহিত একটিই উৎস থেকে।

এক অবিশ্বাস্য বিরল মুহূর্ত। চাঁদের আকাশে পৃথিবীর উদয়! অনেকদিন তো পৃথিবী থেকে চাঁদ দেখা হল। এবার চাঁদ থেকে পৃথিবীর উদয়-অস্ত দেখতে কি ইচ্ছে করছে না?

চাঁদ থেকে তো পৃথিবীর উদয় দেখলেন! এবার দেখুন মঙ্গলগ্রহের আকাশে অস্ত যাচ্ছে আমাদের চিরচেনা সূর্য। ছবিটি তোলা হয়েছে মঙ্গলগ্রহে মানুষের পাঠানো এক যন্ত্রের সাহায্যে। অদূর ভবিষ্যতে মানুষ সেখানে গিয়ে নিজের চোখেই দেখবে এই দৃশ্য। তারই পরিকল্পনা চলছে।

শান্তিনিকেতনের রাঙা মাটি নয়—মঙ্গলগ্রহের রাঙামাটি। মানুষ গিয়ে এই মাটিই দেখবে। সেখানে মানুষের উপযোগী বাসস্থান তৈরির প্ল্যান ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে।

মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন মসৃণ হলেও যদি তাকে খুব সূক্ষ্মভাবে দেখা যায় তবে লক্ষে একটি পরিবর্তন দেখা যেতে পারে। এই ছবিতে সেই সূক্ষ পরিবর্তনগুলি ধরা পড়েছে। এই চিহ্নগুলিই আমাদের নিয়ে যায় মহাবিশ্বের জন্মলগ্নের কাছে। বিশ্বের জন্মলগ্নে কোয়ান্টা ফিল্ডের যে ভুতুড়ে ‘ফ্লাকচুয়েশনস’ ছিল সেগুলিই মহাশূন্যের আকস্মিক এবং প্রবল স্ফীতির ফলে এই রূপ নিয়েছে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এদেরই গ্যালাক্সি এবং গ্যালাক্সিপুঞ্জের বীজ বলে ধরে নিয়েছেন। এই জন্যেই দেওয়া হয়েছিল ২০০৬ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার।

এই ছবির জরুরি বার্তা বলছে মহাবিশ্বে ক্ষুদ্রতম থেকে সৃষ্টি হয় বৃহত্তম। এইভাবে প্রকৃতি সর্বত্র বিরাজমান ভুতুড়ে ফিল্ডের প্রমাণ দিচ্ছে। এটাই আমাদের সাহায্য করে দ্বিধাহীনভাবে বুঝতে যে আদিউৎস জগতের সর্বত্র বিরাজমান। এটাও স্পষ্ট করে বুঝতে সাহায্য করে যে নিত্য অমূর্ত উৎস আর অনিত্য পরিবর্তনশীল মূর্ত সৃষ্টি পরস্পরের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্নভাবে সম্পৃক্ত। তাই দুটিকেই সত্য হতে হবে। যদি শঙ্করাচার্য জানতেন বিজ্ঞানের এই তথ্য তিনি কি বলতে পারতেন?

কিন্তু সৃষ্টিতত্ত্ব জানতে হলে, বিশ্বের অন্তররূপ আমাদের জানতেই হবে। কীভাবে সৃষ্টি হল বিশ্ব? এই মহাসৃষ্টির উৎস কোথায়? সেই উৎস কি একমেবাদ্বিতীয়ম্? না কি, বৈচিত্র্যময় জগতের সৃষ্টির উৎসও বহু? আমরাই বা কেন এবং কী করে এলাম এই জগতে? এসব প্রশ্নের বিজ্ঞানপ্রমাণিত উত্তর যতক্ষণ না পাচ্ছি, ততক্ষণ মহাজগতের সৃষ্টিরহস্যের কোনও সন্ধানসূত্রের সঠিক খোঁজ পাব না আমরা।

যে বিষয়টি বিপুল বিস্ময়ের তা হল, বিজ্ঞানের কোনওরকম সাহায্য ছাড়াই বেদ আর উপনিষদের ঋষিরা সৃষ্টির রহস্যের অন্তরে কী করে অতদূর পর্যন্ত ফেলতে পেরেছিলেন তাঁদের ধ্যানের আলো! তাঁরা বিশ্বের যে অন্তরসত্যের ধ্যানোলব্ধ পরিচয় পেয়েছিলেন তা আজকের বিজ্ঞান কতখানি সমর্থন করছে, তা ভাবলে খুবই আশ্চর্য হতে হয়। বিজ্ঞানের কোনওরকম সাহায্য ছাড়াই কী করে এই বিশ্বের সমস্ত বৈচিত্র্যের একই উৎস ভাবতে পেরেছিল উপনিষদ, কী করেই বা উপলব্ধি করতে পেরেছিল বিশ্বের সর্বত্র, সবকিছুর মধ্যে সেই উৎস বর্তমান! এ-কথা ভাবলে বিপুল বিস্ময়ে জাগে আমাদের প্রাণ।

সৃষ্টিতত্ত্ব এক রূপকথার গল্প শোনাচ্ছে আমাদের। অন্তহীন সেই কাহিনি আমাদের চোখের সামনে খুলে দিচ্ছে বিশ্ববিবর্তনের রূপরেখা। দেখতে পাচ্ছি সেই বিবর্তনের রূপরেখার এক অবিশ্বাস্য নকশা। ভাবা যায় কি সেই অনন্য ব্লুপ্রিন্টের পিছনে নেই কোনও পরিকীর্ণ বুদ্ধিমত্তা? আমরা যতই দেখছি মহাবিশ্বের রূপকল্পনা, ততই আমাদের উপলব্ধির সামনে উন্মোচিত হচ্ছে তার পরিকল্পিত সুসংহত রূপ। পিছনে বুদ্ধিমত্তা না থাকলে কেমন করে এমন সুসংবদ্ধ থাকত বিশ্বের বিবর্তনের নকশা? আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে নিত্য কত বিশৃঙ্খলা। ভিত্তি-স্তরে মহাবিশ্বে পরিব্যাপ্ত সুচারু প্রতিসাম্য, এক অপূর্ব সামঞ্জস্য। দেখতে পাই মহাবিশ্ব চলছে অবিশ্বাস্য সূক্ষ্ম অনিবার্য রীতিনীতির অনুসারে। দেখলে মনে হয় যেন এক বিপুল ক্ষমতা রয়েছে এর পিছনে। জানি আপনাদের মনে প্রশ্ন জেগেছে, কে শাসন করছে এই বিশ্বজগৎ, কী পরিচয় সেই বিমূর্ত ব্যাপ্ত ক্ষমতার? তাকে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় আপাতত বলি, ‘অন্ধকারের রাজা’। এবং সেই অন্ধকারের রাজাকে আপাতত রাখি আমাদের ভাবনার, ব্যাখ্যার বাইরে। সেই অমূর্ত রাজার কাছেই আপনাদের সঙ্গে নিয়ে ফিরে আসব— এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে এখন চলুন আপনাদের নিয়ে যাই মূর্ত বাস্তবে। বোঝার চেষ্টা করা যাক, রিলেটিভিটি এবং কোয়ান্টাম ফিজিক্সের বৈপ্লবিক উন্মোচনের আলোয় কীভাবে বিজ্ঞান দেখছে মহাবিশ্বের মূর্ত বাস্তবকে।

প্রথমেই, নিখিলবিশ্বের কাঠামোর একটা মডেল তৈরি করে নেওয়া যাক। আমাদের সুবিধের জন্যে ধরে নিচ্ছি, এই কাঠামোতে আছে তিনটি স্তর। ক্লাব-স্যান্ডউইচের কথা ভাবছেন না তো? একটা স্তরে চিকেন। একটা স্তরে লেটুস আর টম্যাটো। একটা স্তরে চিজ়। সেরকম ভাবলে ভুল করবেন। বরং ভাবুন রেমব্রান্ট বা রবীন্দ্রনাথের আঁকা কোনও ছবির কথা। এক-একটি ছবিতে কত রকমের রং মিশে আছে কত স্তরে! নীলের মধ্যে লাল। লালের মধ্যে হলুদ। কালোর মধ্যে সাদা। অথচ কিছুতেই তাদের আলাদা করে চেনা যায় না। চেনা যায় না তার কারণ, এইসব রং মিশে তৈরি হচ্ছে অন্য একটি রং! মহাজগতের বিভিন্ন স্তরগুলির মিশ্রণও তেমন— সব একাকার।

এবার বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ওই জটিল স্তরগুলিকে খোলা যাক। দেখা যাক প্রথম স্তরে কী আছে। সেখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি একটি দৃষ্টিগোচর বিশ্ব। যে-বিশ্বে সব বস্তুই মূর্ত। অর্থাৎ যে-বিশ্ব এই মুহূর্তে আমাদের চোখের সামনে রয়েছে। সারাক্ষণ যাকে আমরা দেখছি, যাকে আমরা ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগ করতে পারি। এই বিশ্বের সঙ্গে আমাদের পঞ্চেন্দ্রিয়ের সম্পর্ক— এই বিশ্বকে আমরা ছুঁচ্ছি, শুঁকছি, দেখছি, শুনছি এই বিশ্বের শব্দ, এই বিশ্বের স্বাদ গ্রহণ করছি। এই বিশ্বের অস্তিত্ব যেন আমাদের বাইরে।

এই জন্যেই ডেকার্ট মনে করেছিলেন মন ও বস্তু বুঝি পরস্পরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন। আমরা একদিকে। আর আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ আর একদিকে। শংকরাচার্য যেমন আজ থেকে হাজার বছর আগে এক এবং অদ্বিতীয় ব্রহ্মের সঙ্গে তাঁর বহুপ্রকাশের দ্বন্দ্বটিকে কিছুতেই মনের মধ্যে মেটাতে পারেননি এবং পারেননি বলেই ভুল করে বললেন ‘জগৎ মিথ্যা’, তেমনি শংকরাচার্যের সাতশো বছর পরে ডেকার্টও মেটাতে পারলেন না আমাদের সঙ্গে প্রকাশিত জগতের দ্বন্দ্ব, বললেন জগৎ একদিকে, আমরা একদিকে, চিরায়তভাবে বিচ্ছিন্ন, মাঝখানে এক চিরন্তন বিচ্ছেদরেখা। ডেকার্টের ভাবনায়, মনের মধ্যে বস্তুর কিছু নেই, বস্তুর মধ্যে মনের কিছু নেই। বেশিরভাগ মানুষই এই ভুলটা করে— বিশ্বকে এইভাবেই দেখে। অর্থাৎ দ্রষ্টা আর দৃশ্য সাধারণের চোখে আলাদা। এই হল আমাদের চেনা বিশ্বের প্রথম স্তর।

এবার মহাজগতের দ্বিতীয় স্তরটি খুলে দেখা যাক সেখানে কী আছে। এই দ্বিতীয় স্তরে কিন্তু আমাদের পাঁচটি ইন্দ্রিয়কে ছুটি দিতে হচ্ছে। কারণ আমাদের পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের ক্ষমতা নেই মহাবিশ্বের এই দ্বিতীয় স্তরটিকে তাদের বোধের মধ্যে পাওয়ার। এই স্তর আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়। কারণ এখানে চলছে শক্তির এমন নিরবচ্ছিন্ন খেলা আণুবীক্ষণিক স্তরে এবং অকল্পনীয় দ্রুত গতিতে যাতে আমাদের পাঁচটি ইন্দ্রিয় অভ্যস্ত নয়। তাই তারা এই স্তরে এসে হাত-পা গুটিয়ে অকেজো হয়ে পড়ে। সেইজন্যে এবার প্রয়োজন অন্তর্দৃষ্টির।

আমরা জগতের যে-কোনও বস্তুকে একটি পরিচিত ‘প্যাকেজ’-এ দেখতেই অভ্যস্ত। আমরা বাড়ি-গাড়ি-চেয়ার-টেবিল সবকিছুই চিনি বা চিনতে পারি তাদের পরিচিত চেহারায়। এই পরিচিত চেহারাটাকেই বলছি ‘চেনা প্যাকেজ’। কলকাতার একটি বিজ্ঞাপনে আজকাল একটি স্লোগান খুব জনপ্রিয় হয়েছে— ‘চিনি, তাই কিনি’। যে-বস্তুটিকে কিনতে যাচ্ছি, তাকে চিনতে পারি বলেই তো কিনি। কারণ সেই বস্তুটি আমাদের কাছে একটি পরিচিত ‘প্যাকেজ’। প্রতিটি বস্তুই ঢাকা আছে তার পরিচিত ‘প্যাকেজে’। কিন্তু যদি সেই প্যাকেজটাকে খুলে ফেলা যায়?

এ-প্যাকেজ তো আর হাত দিয়ে খোলা যাবে না। বস্তুর পরিচিত চেহারার প্যাকেজটি খোলার জন্যে বৈদ্যুতীন (electron) অণুবীক্ষণ যন্ত্র আর কণা-ত্বরক যন্ত্র (particle accelerator)-এর সাহায্য নিতে হবে। এই যন্ত্রগুলির সাহায্যে বস্তুর পরিচিত চেহারার প্যাকেজটা খুলে ফেললে বস্তুর মধ্যে কীভাবে সর্বক্ষণ অণু-পরমাণু কাজ করে চলেছে তা আমরা দেখতে পাব।

বস্তু যে অণু-পরমাণু দিয়ে তৈরি তা তো নতুন কথা নয়। প্রশ্ন হল, অণু বা পরমাণু কী দিয়ে তৈরি? অণুর মধ্যে রয়েছে একটি ‘পজ়িটিভলি চার্জড’ নিউক্লিয়াস বা পরমাণুকেন্দ্র। এই পরমাণুকেন্দ্রের মধ্যে বন্দি হয়ে আছে কিছু প্রোটনস। আর আছে কিছু নিউট্রনস। এদের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখছে চারপাশে ঘিরে থাকা কিছু নেগেটিভ তড়িতাণু। প্যাকেজটা যখন খোলাই হয়েছে তখন প্রোটনস বা নিউট্রনসের মধ্যেই বা ঢুকতে বাধা কোথায়? ওদের মধ্যে ঢুকলে দেখতে পাব সেখানে আরও ছোট ছোট কণিকা। এদের নাম ‘কোয়ার্ক’। আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যা-কিছু জিনিস দেখছি— আমাদের চেনা চেয়ার-টেবিল থেকে চিরচেনা ইলিশমাছ— তারা সবাই মূলত তৈরি দু’রকমের মৌল পদার্থ-কণিকায়। এক, কোয়ার্কস, দুই, ইলেকট্রনস। কিন্তু এইভাবে বস্তুকে যখন দেখতে পাই তখন তার আর চেহারার চেনা প্যাকেজটা থাকে না। চেনা বস্তুও অচেনা হয়ে ওঠে। তখন আর বিজ্ঞাপনের ওই স্লোগান— চিনি তাই কিনি— কোনও কাজে লাগে না।

আইনস্টাইনের বহুপরিচিত এক সমীকরণ অনুসারে কোয়ার্কস এবং অন্যান্য মৌল কণাগুলি ‘এনার্জির প্যাকেট’ ছাড়া আর কিছুই না। এবার আসছি বস্তুর মধ্যে একটি অন্তর্নিহিত বিরোধাভাসে। আমাদের চারধারে অনেক বস্তুই ‘সলিড’। কিন্তু সেই পাথরের মতো কঠিন ও ঘন বস্তু যা দিয়ে তৈরি তাদের মধ্যে চলছে নিরন্তর প্রবাহ। ‘সলিড’ বস্তু অথচ তার মধ্যে রয়েছে ‘স্টেট অফ ফ্লাক্স।’ এই হল বস্তুর মধ্যে বিরোধাভাস। এই প্রবাহ হচ্ছে এনার্জির প্রবাহ। এবং এই প্রবাহ কীরকম গতিতে চলছে? আলোর গতিতে! এখানে একটি মূল বার্তা সংক্ষেপে জানিয়ে রাখি। কেউ না, এমনকী পদার্থবিজ্ঞানীরাও জানেন না, এনার্জি কী! শুধু এইটুকু জানি এনার্জি নিজেকে প্রকাশ করে নানাভাবে, আকারে। আর জানি, এত যে ঘটনা ঘটছে নিখিলবিশ্বে, তার মূলে একই এনার্জি। সবকিছু করছে ওই অদৃশ্য শক্তি।

এবার একটি মাথা ঘুরে যাওয়ার মতো প্রশ্ন। আলোর গতিতে প্রবাহিত এনার্জি দিয়ে তৈরি হয়েও কীভাবে আমরা সবাই— আমি আপনি গাছ পাখি পাহাড়— আমাদের আকারে-গঠনে স্থির থাকছি? কীভাবে সবকিছুর মধ্যে এনার্জি রয়েছে যেন সুস্থিত অবস্থায়? কেন আমাদের শরীরের, আমাদের চারপাশের সমস্ত বস্তুর মধ্যে মৌলকণাগুলি ভেঙে পড়ছে না? কীভাবে কে তাদের ধরে রেখেছে? এ হল সত্যিই রূপকথার গল্প। রূপকথার গল্পে আমরা পড়েছি বোতলের মধ্যে বন্দি দৈত্যের কথা। তেমনি এনার্জিও বন্দি হয়ে আছে! যে-বোতলে রূপকথার দৈত্যের মতো এনার্জি বন্দি সেই বোতল আমাদের চেনা বোতল নয়, সেই বোতলের বৈজ্ঞানিক নাম ‘ফিল্ড’ বা ক্ষেত্র। যদি জিজ্ঞেস করেন ‘ক্ষেত্র’ আসলে কী, আমি বলব এই হল সেই ক্ষেত্র যার কোনও আকার নেই, সম্পূর্ণ বিমূর্ত।

যখনই বস্তুর সঙ্গে এই বিমূর্ত ক্ষেত্রের দেখা পেলাম আমরা বাস্তবের দ্বিতীয় স্তর পেরিয়ে পৌঁছোলাম তৃতীয় স্তরে। এই স্তরে পৌঁছে প্রথমেই যে তথ্যটুকু জানা প্রয়োজন তা হল, এইসব বিমূর্ত ক্ষেত্রগুলির আলাদা আলাদা পরিচয় আছে। প্রথমেই আসি আমাদের সবচেয়ে পরিচিত ক্ষেত্রটির প্রসঙ্গে— আমাদের প্রাত্যহিক অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে যে-ক্ষেত্র। এই ক্ষেত্রটির নাম হল, মহাকর্ষক্ষেত্র বা গ্র্যাভিটেশানাল ফিল্ড। আমরা তাকে ছুঁতেও পারি না, দেখতেও পাই না। কিন্তু মহাকর্ষক্ষেত্র যে আছে তার প্রমাণ একটু লাফালেও পেয়ে যাব। সঙ্গে সঙ্গে যে পৃথিবীর মাটিতে আমরা নেমে আসছি, তারই প্রমাণ পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ। আইজ্যাক নিউটনই প্রথম বিজ্ঞানী যিনি মাধ্যাকর্ষণকে শনাক্ত করে চিহ্নিত করেছিলেন। নিউটন কিন্তু শেষ পর্যন্ত ধরতে পারেননি মাধ্যাকর্ষণের সঠিক পরিচয়। হেঁয়ালিটা এই— ফোর্সের মতো নন-মেটিরিয়াল কিছু কেমন করে প্রভাবিত করে দূরের বস্তুকেও মাধ্যমের কোনও সংযোগ ছাড়া? কোনও একটি জিনিসকে কী করে গতি দেওয়া যায় তাকে স্পর্শ না করে? এ-প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে যেতে হবে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম পর্বে। ফ্যারাডে নামের এক ইংরেজ বিজ্ঞানী একটি কয়েল বা কুণ্ডলীর মধ্যে চুম্বক ঘুরিয়ে তৈরি করলেন বিদ্যুৎশক্তি। এই প্রথম এক ঘটনা আমরা দেখলাম যা ঘটতে পারল সরাসরি সংযোগ ছাড়া। ছোট্ট ঘটনা। মনে হয় যেন এমন কিছু নয়। অথচ এই ঘটনার তাৎপর্য আমরা বুঝতে পারি যখন দেখি সারা মহাশূন্য জুড়ে ছড়িয়ে আছে এই ঘটনার পদ্ধতি। ফ্যারাডের দেখানো ঘটনাটির একশো বছর পরে আইনস্টাইনই প্রথম দেখিয়েছিলেন এই ঘটনার তাৎপর্য।

আরও একটু ব্যাখ্যার প্রয়োজন। ফ্যারাডের ওই কুণ্ডলী ও চুম্বকের মধ্যে তো কোনও বস্তুগত সম্পর্ক ছিল না। দুটি পুরোপুরি আলাদা আলাদা বস্তু। কিন্তু ফ্যারাডে দেখালেন চুম্বকক্ষেত্রের মতো এক নন-মেটিরিয়াল সত্তা ও ওই কুণ্ডলীর মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন হতেই ঘটল বিদ্যুৎপ্রবাহ। এই ঘটনা আমাদের মধ্যে একটি নতুন জানলা খুলে দিল। সেই জানলা দিয়ে প্রথম এল ক্ষেত্র বা ‘ফিল্ড’-এর ভাবনা। ক্রমশ বুঝতে পারলাম বিদ্যুৎ এবং চুম্বকের মতো দুটি আলাদা শক্তিও পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত আত্মীয়তার নিহিত সূত্রে। চুম্বকত্ব এবং বিদ্যুৎ, এই দুই আত্মীয়ের মধ্যে সচেতনভাবে প্রথম মিলন ঘটিয়েছিলেন উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল। এবং ওদের সেই মিলিত রূপের নাম রেখেছিলেন ইলেকট্রোম্যাগনেটিজ়ম বা তড়িৎচুম্বকত্ব। ম্যাক্সওয়েল এই বার্তাও আমাদের শোনাতে পেরেছিলেন, আলো হল ইলেকট্রোম্যাগনেটিজ়ম-এর একটি প্রকাশভঙ্গি। আবার খুলে গেল নতুন জানলা। ম্যাক্সওয়েলের এই সমীকরণ উদ্ঘাটিত করল ভাবনার নব সরণি। ম্যাক্সওয়েল যে নতুন সত্যের উন্মোচন ঘটালেন তা হল এই— তরঙ্গরূপে প্রকাশ পায় তড়িৎচুম্বকত্ব। পরীক্ষামূলকভাবে হাইনরিখ হার্টস দেখালেন এই তরঙ্গের অস্তিত্বের প্রমাণ। শুরু হল বেতারতরঙ্গ নির্ভর সম্প্রচারের নতুন যুগ। রবীন্দ্রনাথ তাঁর একটি অনন্য নাম রাখলেন— আকাশবাণী।

নিউটনের মতো ম্যাক্সওয়েলও ভেবেছিলেন, শুধুমাত্র কোনও পদার্থের মাধ্যমেই বিস্তারিত হতে পারে তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ। এবং সেই পদার্থটি হল ইথার। দুশো বছর ধরে চলেছিল এই ধারণা। আইনস্টাইনের যুগান্তকারী প্রতিভা প্রথম প্রমাণ করল, শূন্য মহাকাশ তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের মাধ্যম। আরও একটি ব্যাপারে নতুন বোধের উদ্বোধন ঘটালেন আইনস্টাইন— মহাশূন্য, সময় এবং ক্ষেত্রের পৃথক অস্তিত্ব সম্ভব নয়। ওদের এই একক অস্তিত্বকে বলা যেতে পারে এক মহান সহবাস। ওরা পরস্পরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত বলেই ওরা আছে। খুব সহজভাবে এই জটিল বার্তাটুকু দিয়েছিলেন আইনস্টাইন। দেখালেন, a field is a physical state of space itself’, ক্ষেত্র নেই তো মহাকাশও নেই। সেই প্রথম বৈপ্লবিক বদল দেখা দিল আমাদের বিশ্বচেতনায়। পালটে গেল আমাদের চেনা জগৎ, বদলে গেল পরিচিত বাস্তবের অন্তরমহল।

এতক্ষণ আমরা আলোচনা করছিলাম ‘ম্যানিফেস্ট’ ফিল্ডস বা ‘ব্যক্ত’ ক্ষেত্র সম্পর্কে। কোনও নির্দিষ্ট স্থানেই বোঝা যায় এই ক্ষেত্রগুলির প্রভাব ও তার মান। যেমন পৃথিবীর কাছে বোঝা যায় তার মহাকর্ষক্ষেত্র বা ফিল্ড অফ গ্র্যাভিটি। আমরা হয়তো ভাবতে পারি, যেমন গাড়ির ইঞ্জিন থেকে তাপ বেরোয়, তেমনি হয়তো বস্তু থেকে নির্গত হয় তড়িৎক্ষেত্র। তা নয় কিন্তু। যা ঘটে তা ভারী বিস্ময়ের। ধরুন মহাকাশ থেকে আমরা উপড়ে নিলাম পৃথিবীটাকে। পৃথিবী আর মহাকাশে নেই। তা সত্ত্বেও এক অব্যক্ত ক্ষেত্র, আনম্যানিফেস্ট ফিল্ড, থেকে যাবে শূন্য মহাকাশে। আর সেই অব্যক্ত ক্ষেত্রের মধ্যে থেকে যাবে পৃথিবীর গ্র্যাভিটির বা অভিকর্ষের নকশা বা প্রতিচিত্র!

সমস্ত মহাশূন্য ও মহাকাশ ছেয়ে আছে সব অব্যক্ত ক্ষেত্রগুলি। এদেরই বলে কোয়ান্টাম ফিল্ডস। কোনও একটি অব্যক্ত কোয়ান্টাম ফিল্ডসের প্রভাব এই নিখিল বিশ্বের সর্বত্র সমভাবে অনুভূত হয়। কোয়ান্টাম ফিল্ডস হল সারা মহাজগতের অন্তরসত্য। বিশ্বের এই অন্তর্নিহিত সত্যের ধারণাটি হৃদয়ে গ্রহণ করা একান্ত প্রয়োজন। পরবর্তী পরিচ্ছেদের আলোচনার জন্য। সেই আলোচনার বিষয়, বিজ্ঞান কীভাবে সৃষ্টির একক উত্সের ভাবনাকে সমর্থন করছে।

এখন শুরু করা যাক একটি আপাত স্ববিরোধ প্রসঙ্গে প্রশ্ন তুলে। কোয়ান্টাম ফিল্ড তো অব্যক্ত। যা অব্যক্ত তা জানা গেল কীভাবে?

অধিকাংশ বাঙালির মতো আমারও ছেলেবেলায় ধারণা ছিল না তুষারপাত কেমন। একটু বড় হতে জানলাম, আকাশ থেকে যখন ঝরে পড়ে তুষার তখন সেই তুষারের প্রতিটি টুকরোর মধ্যে চেহারার কোনও মিল থাকে না, প্রতিটি টুকরো হয় এক-এক রকম। বেশ মজা পেয়েছিলাম তুষারের সেই ভ্যারাইটি স্টোর্সের কথা জেনে। আরও অবাক হলাম এবং মজা পেলাম যখন জানলাম এক্কেবারে এই উলটো কথা যে, ইলেকট্রনের মতো মৌলিক কণা সারা মহাবিশ্বে সর্বত্রই একইরকম দেখতে। তাদের আকারের কখনও কোনও উনিশ-বিশ হয় না। কোয়ান্টাম ফিজিক্সের গভীর সব রহস্যের একটি হল— ইলেকট্রনের মতো মৌলিক কণার মাস (ভর বা মোট বস্তুপরিমাপ) ইলেকট্রিক চার্জ এবং স্পিন (ঘূর্ণন) হুবহু এক! বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠিত সত্য এই যে— মৌলিক কণাগুলির প্রতিটি প্রপার্টি সবসময়েই এক— সেই মৌলিককণাগুলি বিগ ব্যাং-এর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তৈরি হয়ে থাকুক, অথবা বহু কোটি বছরের অ্যাস্ট্রোফিজ়িকাল পদ্ধতির সহায়তায় তৈরি হয়ে থাকুক বা হোক জগতের কোনও ল্যাবরেটরিতে।

মৌলকণার এই সাদৃশ্য রহস্য ভেদ করা গিয়েছিল বিশ শতকের শেষভাগে। রহস্যভেদ করে কী জানা গেল? জানা গেল, মৌলকণার সৃষ্টিকর্তা নেপথ্যচারী বা ‘আন্ডারলাইং’ কোয়ান্টাম ফিল্ডস। এরাই অন্ধকারের রাজা। পদার্থবিজ্ঞানের যে নবজাত শাখার অবদানে এই রহস্য সমাধান সম্ভব হল তার নাম কোয়ান্টাম ফিল্ড থিয়োরি। এই থিয়োরির প্রধান প্রবক্তাদের একজন এম আই টি-র নোবেল বিজয়ী ফ্র্যাঙ্ক উইলচেক। তিনি কোয়ান্টাম ফিল্ড থিয়োরির সারাৎসারটি দিয়েছেনই এইভাবে— এই থিয়োরি বলছে মৌলকণা সবথেকে আদি নয়। সবচেয়ে আদি অন্তর্নিহিত ক্ষেত্র। একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা বোঝা সহজ হবে। যেমন সমস্ত ইলেকট্রনই অন্তর্নিহিত ফিল্ডের উদ্দীপনার প্রকাশ— আর কিছু নয়। সেই অন্তর্নিহিত ক্ষেত্রটির নাম ইলেকট্রন ফিল্ড। সমস্ত মহাশূন্য আর মহাকাল জুড়ে পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে এই ইলেকট্রন ফিল্ড। একই সত্য, সমস্ত মৌলকণা প্রসঙ্গেই। আমার চেনা পৃথিবীটাকে অচেনা মনে হয়েছিল যখন জেনেছিলাম, যে-বস্তুগুলিকে আমি ‘সলিড’ ও জড় ভাবতাম সেগুলি আসলে এনার্জির পুঁটলি। এনার্জি-পুঁটলিরই আর এক নাম মৌলকণা। এখন দেখছি আছে আরও বিস্ময়।

একটা মজার কথায় আসি। কোয়ান্টাম ফিল্ডের একটা বাতিক আছে। ক্রেডিট কার্ডে যারা ক্রমাগত ঋণ করতে ভালবাসে কোয়ান্টাম ফিল্ডও তাদের মতো। কোয়ান্টাম ফিল্ড সর্বদা ঋণ করছে। তার ঋণের মহাজন বা ব্যাঙ্ক কে? তার নাম মহাকাশ। কোয়ান্টাম ফিল্ড কী ধার নিচ্ছে মহাকাশের কাছে? ধার নিচ্ছে এনার্জি। এই ধার সে কাজে লাগাচ্ছে কীভাবে? কোয়ান্টাম ফিল্ড ক্রমাগত জোড়ায় জোড়ায় তৈরি করছে ‘অসৎ-কণিকা’ বা ‘ভার্চুয়াল পার্টিকল্স’। এই জোড়ার একটা ম্যাটার, আর একটি অ্যান্টিম্যাটার। ভাবুন অসৎ মৌলকণাগুলি অসংখ্য জলবিন্দুর মতো। যেমন সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়লেই ওপর দিকে ছিটকে যাচ্ছে অসংখ্য জলকণা, তারপর আবার ফিরে আসছে, মিশে যাচ্ছে সমুদ্রের জলরাশির মধ্যে, তেমনি মৌলকণাগুলিও জন্মাচ্ছে, ফিরে যাচ্ছে, মিশে যাচ্ছে। ঢেউ থেকে ছিটকে পড়া জলকণার মতো কোয়ান্টাম-ফিল্ড তৈরি এই জোড়ারা জন্মেই মরছে। নিতান্ত ক্ষণজীবী এরা। কোয়ান্টাম-ফিল্ড এদের তৈরি করার জন্যেই মহাশূন্যের কাছে এনার্জি ধার করেছে। মহাজন বা ব্যাঙ্কের কাছে ধার করলে যেমন শোধ করতে হয়, তেমনি মহাশূন্যের কাছে শক্তি ধার করেও শোধ দিতে হচ্ছে। সে-ধার কণিকারা শোধ করে জীবন দিয়ে। কিন্তু যেই কোনও উৎস থেকে আসে অতিরিক্ত এনার্জি, অমনি একটি স্থায়ী কণিকা যেন উদ্ধার পেয়ে বেরিয়ে আসে অন্ধকার থেকে। তারা মহাবিশ্বে লাভ করে বাস্তব অস্তিত্ব।

এনার্জি বা শক্তি ছাড়া মহাবিশ্বে শুধুই অলীক কণিকা, তাদের নেই কোনও স্থায়ী অস্তিত্ব। নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান তাই মজা করে বলেছিলেন, ‘সময়ের কী অপব্যয়! তৈরি হচ্ছে আর মুছে যাচ্ছে, তৈরি হচ্ছে আর মুছে যাচ্ছে!’ এ তো নেহাতই মজার কথা। একটু গভীরভাবে দেখলে সময়ের অপব্যবহার— এই ধারণাটা কেটে যাবে। এই যে অসৎ কণিকা বা ভার্চুয়াল পার্টিকল্স জন্মাচ্ছে, তারও বেশ প্রয়োজন আছে। এইসব ভার্চুয়াল পার্টিকল্সের এমন কিছু প্রভাব আছে যার আমরা পরিমাপও করতে পারি। এবং তারই ফলে আমরা অনুভব করতে পারি বহু কোয়ান্টাম ফিল্ডের অস্তিত্ব।

কোয়ান্টাম ফিল্ডের চরিত্র সত্যিই এক ধাঁধা। বিজ্ঞানী ওয়ারনার হাইসেনবার্গের আনসার্টেন্টি প্রিন্সিপল বা অনিশ্চয়নীতি অনুসারে কোনও বিশেষ সময়ে কোয়ান্টাম ফিল্ডের কোনও বিশেষ মূল্য থাকতে পারে না, এমনকী শূন্যের মূল্যও নয়। সুতরাং ক্রমাগত বদলে যাচ্ছে যে-কোনও কোয়ান্টাম ফিল্ডের আকার। এটাই হল ভ্যাকুয়াম ফ্লাকচুয়েশনস। To observe the activity of a quantum field you must disturb it. সরাসরিভাবে ধরা সম্ভব না হলেও, ক্যাসিমির এফেক্টে এই ভ্যাকুয়াম ফ্লাকচুয়েশনসের প্রভাব ধরা পড়েছে সুস্পষ্টভাবে।

ক্যাসিমির এফেক্টের ব্যাপারটা এখানে একটু বোঝা প্রয়োজন। ভালই লাগবে শুনতে, কারণ ক্যাসিমির এফেক্ট হল বিজ্ঞানের রূপকথা। ১৯৪৮ সালে ডাচ পদার্থবিজ্ঞানী হেনড্রিক ক্যাসিমির অব্যক্ত তড়িৎচুম্বকীয় ক্ষেত্রের ভ্যাকুয়াম ফ্লাকচুয়েশনসের সমীকরণ দিয়ে দেখালেন সম্পূর্ণ বায়ুশূন্য ভ্যাকুয়ামের মধ্যেও এক ভূতুড়ে শক্তি কাজ করছে। অর্থাৎ এই শক্তি পরিচিত সব শক্তির অনুপস্থিতিতেও কাজ করতে পারে। এই সত্যটুকু ক্যাসিমির শুধু ধরতে পেরেছিলেন থিয়োরির মধ্যে। কিন্তু বহু বছর পরে ১৯৯৬ সালে এই তড়িৎচুম্বকীয় ভূতুড়ে শক্তির সন্দেহাতীত প্রমাণ দিলেন পদার্থবিজ্ঞানী স্টিভেন ল্যামোর। এমন আরও অনেক প্রমাণ পাওয়া গেছে অব্যক্ত কোয়ান্টাম ফিল্ডের অস্তিত্বের। এবং এই ধারণাও এখন প্রমাণিত যে সবরকমের মৌলকণা তাদের অন্তর্নিহিত কোয়ান্টাম ক্ষেত্রেরই উদ্দীপনা।

ভার্চুয়াল পার্টিকল্স ক্রমাগত জন্মাচ্ছে আর মরছে। আর অব্যক্ত ক্ষেত্রগুলির ঝোড়ো ভ্যাকুয়াম ফ্লাকচুয়েশনস মহাশূন্যে তৈরি করছে আণুবীক্ষণিক মাত্রায় কোয়ান্টাম উন্মত্ততা। তাই মহাশূন্য একেবারেই মহাশূন্য নয়। সেখানে চলছে অবিরাম কোয়ান্টাম লীলা। এই হল স্বর্গের বুনন। মহাশূন্য জুড়ে যেন এক অদৃশ্য কল তাঁত বুনছে। কোয়ান্টাম ফিল্ডের বহুস্তরী বুনন ছড়িয়ে সারা মহাশূন্যে। এবং এ এক জাদুবুনন, কারণ বুননবস্ত্রের প্রতিটি অংশের মধ্যে রয়েছে সমস্ত বস্ত্রটির উপাদান। এ-জগতে সত্যি কোনও খালি জায়গা নেই। মহাশূন্যও খালি নয়। সেখানে রয়েছে আমাদের অস্তিত্বের উৎস— যা জেনেও দেখতে পাই না আমরা। শুধুমাত্র হাই-এনার্জি পার্টিকেল ল্যাবরেটরিতেই তাদের মূর্ত প্রকাশ দেখান সম্ভব হয়। কোয়ার্কস আর ইলেকট্রন বস্তুকণার উৎস ‘ম্যাটার ফিল্ড’। সুপরিচিত বলক্ষেত্রগুলিরও অবশ্য নিজেদের কণা আছে, যাদের বলা হয় ‘এলিমেন্টারি ফোর্স পার্টিকল্‌স’। যেমন ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফোর্স ফিল্ডের নিজস্ব পার্টিকল হল ফোটন। এবার আমরা যাব অবশিষ্ট ফোর্স ফিল্ডের আলোচনায়। বিজ্ঞানী হিসেবে আমার আধ্যাত্মিক সন্ধান ক্রমশ নিয়ে যাচ্ছে আমাকে এই প্রশ্নের সামনে— এরা সবাই কি আসছে না একই উৎস থেকে? যে-উৎস একমেবাদ্বিতীয়ম। এক এবং অদ্বিতীয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *