মহাবন্যা – মনোজ বসু
গেল-বৈশাখে শ্রীপতি প্রথম এ জায়গায় আসে। নিবারণ তাকে দু-দুখানা জরুরি চিঠি দিয়েছিল, বিশেষ করে আঠাশে তারিখটায় আসবার জন্য। কেন—কি বৃত্তান্ত সেসব খুলে লেখেনি। অনেক ফন্দিফিকিরে দুটো দিনের ছুটি করে শ্রীপতি আঠাশে বিকালের গাড়িতে এসে পৌঁছল। গলার আওয়াজ পেয়ে নিবারণ ওঠে কি পড়ে—ছুটে যায় পাঁচিলের দরজা অবধি; হাত ধরে তাকে নিজের খোপটির ভিতর জামকাঠের তক্তাপোশে এনে বসায়। আর যে কি করবে, খানিকক্ষণ ঠিকই করতে পারে না। ছেলেটাকে ধাক্কা দিয়ে পাঠিয়ে দেয়, যা পান নিয়ে আয়, আর বিড়ি····ছুটে যা। বাচ্চা মেয়েটার বয়স আড়াই বছর; তক্তাপোশের কোণে ঘুমিয়ে ছিল। শ্রীপতির অসুবিধা হচ্ছে বিবেচনা করে তাকে মেজের মাটিতে নামিয়ে রাখল।
শ্রীপতি তাড়া দিয়ে ওঠে, কি হচ্ছে এসব? আমি কি নবাব-বাদশা এলাম তোমার এখানে?
নিবারণ এক ফাঁকে বেরিয়ে লম্বা লাইনটা আগাগোড়া পাক দিয়ে এলো। তারপর লোকের পর লোক—বেশিরভাগই গলিতে দাঁড়িয়ে উঁকি মেরে চলে যাচ্ছে। দু-চারজন বারান্দায় ওঠে। যতীন, কেষ্ট আর চরণ ঘোষ ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। নিবারণ জাঁক করে বলছে, এই····এই। আমার পরিবারকে দেখেছিলে তো? তার সঙ্গে মুখের আদল কি রকম মিলে যাচ্ছে, দেখ। সম্পর্কে তার মাসতুতো ভাই কি না!
কুটুম্বের গৌরবে নিবারণ যেন ফেটে পড়ে। লোকের মতো লোক একটা—সকলের মধ্যে খাতির বেড়ে যায় এই রকম দু-একজন কুটুম্ব থাকলে। বলে, এই রোগা-পটকা মানুষ—কিন্তু সাহেবের সঙ্গে প্যাঁচ কষে আগাগোড়া সকলের পনের টাকা করে ভাতা আদায় করেছে। যে-সে সাহেব নয়, খাঁটি সাদা সাহেব, জাত গোখরো। তার সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো—বোঝ ব্যাপারটা!
শেষকালে অসহ্য হয়ে উঠল। রাগ করে শ্রীপতি বলে, আর একটা লোক নিয়ে এসেছ কি, এক্ষুনি আমি হাঁটা দেব—
নিবারণের ইচ্ছে ছিল, দু-নম্বর লাইনটাতে খবর দিয়ে আসবে। কিন্তু এর পর ভরসায় কুলায় না। ক্ষুন্ন হয়ে চুপচাপ সে দাঁড়িয়ে রইল।
শ্রীপতি বলে, মানুষ ডেকে ডেকে সঙ দেখাবে বলে কি এত খবরাখবর করে নিয়ে এলে?
নিবারণ বলে, সবুর করো ভায়া, সবুর করো। কেন এনেছি দেখ। তোমার গাড়িভাড়ার দশগুণ উশুল হয়ে যাবে।
ঘরের মধ্যে বড্ড গুমট, শ্রীপতি বারান্দায় এসে আড়মোড়া ভাঙে। নিচে লম্বা গলি। ভাতের ফেন, আনাজের খোসা, পোড়া বিড়ি, ছেঁড়া শালপাতার ফাঁকে ফাঁকে পা ফেলে বিস্তর মেয়ে-পুরুষ আনাগোনা করছে। সামনে টালি-ছাওয়া টানা লম্বা ঘর—খোপে খোপে ভাগ করা। সেখানে এদের রান্না হয়। আর এ-দিককার এক একটা খোপে এক এক পরিবারের শোওয়া-বসা সমস্ত চলে।
সন্ধ্যার পর নিবারণ শশব্যস্তে বলল, পিরান চাপাও। টেড়ি কেটে নাও শিগ্গির। সবাই রেডি।
ব্যাপার কি?
কর্তামশায়ের ছেলের বিয়ে হয়েছে। পাকস্পর্শের ভোজ—জবর খাওয়াবে।
শ্রীপতি বলে, আমি তো যাবো না। নেমতন্ন তোমাদের। আমি যাবো কেন?
তোমারও। একগাল হেসে নিবারণ ছাপানো নিমন্ত্রণপত্র দেখায়। বলে, দলিল রয়েছে ভায়া, এমনি নয়। সবান্ধবে যেতে বলেছে, এই দেখ। যাকে খুশি নেবো, কে রুখবে?⋯আর তুমি তো সত্যিকার কুটুম্ব, একেবারে আপনার লোক—
আবার গলা নামিয়ে বলে, শোন তাহলে। ঘি-চাল-তেল মায় রঁসুয়ে বামুন অবধি কলকাতা থেকে এনেছে। সাহেব-সুবো খাবে বলে টিনে ভরতি বিলাতি শুঁটকি মাছ। মহীতোষ রাহার আয়োজন, হেঁ হেঁ—খুঁত ধরবার উপায় নেই।
মহীতোষ রাইসমিলের নাম শোনেননি আপনারা? আর আর ধান-কলে রোদে ধান শুকোয়, স্টিমে সিদ্ধ-ভানাই হয়—এখানে ডায়নামো বসিয়ে বিদ্যুৎ তৈরি হয়ে থাকে, সব কাজকর্ম বিদ্যুতে চলে। অন্ধকার-নিমগ্ন মাঠ-ঘাট গ্রামপুঞ্জের মাঝখানে মহীতোষের বাড়ি ও রাইসমিল বিদ্যুদালোকে ঝলমল করে। সাধারণ একটা গ্রামের মধ্যে এ রকম ব্যবস্থা—রাত্রিবেলা ট্রেনে যেতে যেতে দেখে অবাক হতে হয়। মহীতোষের ছেলে প্রেমতোষ বাঙ্গালোর থেকে ইলেকট্রিক ইঞ্জিনীয়ারিং-এর ডিগ্রি নিয়েও কোন চাকরি-বাকরি করল না, বাপের ব্যবসা দেখছে। এ সমস্ত তার কীর্তি। ব্যবসায়ে সে যুগান্তর আনবে, সবাই বলাবলি করে।
মিলের সাড়ে পাঁচ শো লোক—মজুর-গাড়োয়ান থেকে ম্যানেজার অবধি—যথাসম্ভব সাফ-সাফাই হয়ে নিমন্ত্রণ চলেছে। বুড়ো কৈলাস হাজরা এই আজ সকালেও বমি করতে করতে মাথা ঘুরে পড়েছিলেন—
জ্বরটা কি গেছে হাজরামশায়?
কি করি, বাপু। বুড়ো কর্তা হয়তো গেটে দাঁড়িয়ে। গলায় মাথায় কম্ফর্টার জড়িয়ে যাচ্ছি। যা থাকে কপালে, খেয়ে তো আসি। কাল থেকে আবার আচ্ছা করে কুইনিন গিলব।
ভাল খাওয়া হবে, সে লোভ আছে,—তার উপর মনিব চটে না যান, মনে মনে সেই আতঙ্ক। যত লোক এখানে কাজ করে, সকলের নাম-ধাম-পরিচয় মহীতোষের কণ্ঠস্থ; তার জন্য খাতাপত্র হাতড়াতে হয় না। বুড়োর চোখে ধুলো দেওয়া যায় না, কে এলো আর কে এলো না—সমস্ত মনে মনে গাঁথা হয়ে থাকবে।
বাঁচোয়া, মহীতোষ ফটকে নেই—তাঁর নাকি হাঁপানি বেড়েছে। দাঁড়িয়ে আছে বিল-সরকার বনমালী গুপ্ত। দাঁত খিঁচিয়ে সে বলে উঠল, সরে যা—সরে যা। ইদিকে কেন তোরা?
উর্দি-চাপরাস-পরা দরোয়ান এগিয়ে পথ আটকে দাঁড়াল। নিবারণ ক্রুদ্ধ হয়ে বলে, এমনি আসিনি, মশাই। নেমতন্ন হয়েছে, জানেন?
জানি, খুব জানি। অবহেলার সঙ্গে এদের পিছন করে ক’জন বিশিষ্ট আগন্তুককে বনমালী পথ দেখিয়ে দিল। তারপর বুঝিয়ে বলে, তোদের হল লাল চিঠি—উ-ই যে রাঙা শালুর উপর তিন নম্বর বলে লেখা রয়েছে, ঐ ফটক দিয়ে তোরা ঢুকবি। সাদা খামে সোনালি চিঠি নিয়ে আসছেন যাঁরা, তাঁরাই শুধু এদিকে।
শুধু ফটকই নয়, ভিতরের ব্যবস্থাও আলাদা। প্রশস্ত লন, কাঠ ও বাঁশ দিয়ে মাঝখানে ঘেরা। ওদিকে সোনালি চিঠিওয়ালাদের জন্য টেবিল-চেয়ারের বন্দোবস্ত, এদের এদিকে কুশাসন ও কলাপাতা।
শ্রীপতি বলে, আমি ফিরে চললাম। এ-খাওয়া মুখে রুচবে না। এদের যখন চাকরি করি না—আমার ভয়টা কি?
নিবারণ বোঝাতে লাগে, মাথা গরম কোরো না ভায়া। ঐ রকম উবু হয়ে আমরা কি খেতে পারতাম? এঁটো কাঁটার বিচার নেই, ম্লেচ্ছর মতন গবাগব গিলছে, দেখ। বেশ করেছে, খাসা করেছে। হাতের আঙুল আর পায়ের আঙুল কি সমান হয়? যার যেখানে জায়গা⋯চটলে চলবে কেন?
আবার ভয় ধরিয়ে দেয়, ফিরে গেলে স্রেফ পেটে কিল খেয়ে পড়ে থাকতে হবে, বুঝলে? লাইনের কারও উনানে আগুন জ্বলেনি। ঘরে এক টুকরো বাতাসাও নেই। তার চেয়ে বলি কি—ভাল ভাল জিনিসপত্তোর, চক্ষু বুজে পেট-ভরতি করে নাও। এমনি করে ঠাসবে যেন মুখ নামালে বেরিয়ে আসে। খাতির কিসের? ফিরবার সময় আমরা আকাশমুখো মুখ তুলে চলে যাব।
বিবেচনা করে শ্রীপতিও শেষে সায় দিল, না, খাতির নেই। চালাও প্রাণপণে।
লুচি ছেঁড়াই মুশকিল। দুপুরের দিকে ভেজে রাখা, টানলে রবারের মতো লম্বা হয়। পাঁচু বলছে, দু-মনি ধানের বস্তা নিয়ে ঢালতে পারি কলের মুখে, আর লুচি ছিঁড়বে না? ওর চোদ্দপুরুষ ছিঁড়বে। টানো দু’ হাতে না পেরে ওঠো, হাতে-পায়ে ধরে টানো দিকি—
এদিকে ওদিকে চেয়ে উৎসুককণ্ঠে সে জিজ্ঞাসা করে, পোলাও আনে কই নিবারণদা?
আনবে, আনবে। লুচির পাট হয়ে গেলে তবে তো? মুখ একটা মাত্র⋯তাড়া কিসের?
একজনে তদারক করে বেড়াচ্ছিল; বলল, পাতা হাতে করে উঠো, বাছারা। এঁটো-পাতা রেখে যেও না। বড় রাস্তার নর্দমায় ফেলতে হবে—
বলে কি, এর মধ্যে উঠবার প্রসঙ্গ! পাঁচুর চোখে জল আসবার মতো। পোলাও-র জন্য জায়গা রেখে সে মোটে আধপেটা খেয়েছে। বেড়ার ওদিকে সোনালি চিঠিওয়ালাদের হরদম দেওয়া হচ্ছে—খেতে পারছে না, ফেলে দিচ্ছে, তবু জোর করে পাতে চাপাচ্ছে—তার উগ্র সুমিষ্ট গন্ধে বাতাস ভরে গেছে। শুধু কি গন্ধেই শোধ যাবে? নিবারণের গা ঠেলে পাঁচু বলে, কি বলছে শোন, ও দাদা? শেষটা কি জল দিয়ে পেট ভরাব? নিদেনপক্ষে হাতাখানেক করে দিক না ইদিকে। তুমি একবার ডেকে বলো!⋯
নূতন বউ সুপ্রীতি আছে বৈঠকখানার পাশের ঘরটিতে। আরও অনেকগুলা কমবয়সি মেয়ে সেখানে। লনের এ-ধার ওধার সব দিক দিয়েই বউ দেখা চলে। এমনই সুশ্রী সুন্দর নিটোল চেহারা—তার উপর ফুল দিয়ে তাকে অপরূপ করে সাজিয়েছে, পটে-আঁকা ছবির মতো দেখাচ্ছে। অতিকায় উঁচু একটা চেয়ারের উপর বউয়ের বসবার জায়গা। খানিকটা দূরে টেবিলের উপর নানারকম উপহার স্তূপীকৃত হয়ে উঠছে, রাজরাজ্যেশ্বরীর সিংহাসনের সামনে ভক্তেরা নানারকম অর্ঘ্য দিয়ে যাচ্ছে, এই রকম একটা ভাব। একটা-কিছু এলে মেয়েরা তাড়াতাড়ি খুলে দেখছে, খানিকক্ষণ হাতে হাতে ঘোরে, সকলে তারিফ করে, তার পর নম্বর এঁটে উপহারদাতার নাম সমেত খাতায় জমা করে টেবিলের উপর রাখা হয়। কত কি জিনিস—জড়োয়া গয়না থেকে চিত্র-বিচিত্র ছবির বই। মিলের বাবুরা একসঙ্গেই এসেছে, অথচ উপহারের জিনিস কেউ কাউকে দেখাচ্ছে না—এ ওর উপর টেক্কা দিয়ে কর্তাদের সুনজর আদায় করবে, এই মতলব। সুপ্রীতি ভারি চঞ্চলা মেয়ে, একটাবারও বসছে না, ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রেমতোষ বন্ধুবান্ধব সঙ্গে করে ঢুকছে, পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে, তাদের সঙ্গে হেসে হেসে আলাপ করছে সুপ্রীতি। বউয়ের অহঙ্কারে প্রেমতোষের যেন মাটিতে পা পড়ছে না। এমন সুন্দরী বউ—অহঙ্কারের কথাই বটে!
এরা দেখছে আর দেখছে। আপনিই একটা তুলনার ভাব এসে পড়ে শ্রীপতির মনে। তারও বিয়ে হয়েছে বেশি দিন নয়, এখনো দু’ বছর পোরেনি। বউয়ের নাম চারু। কালো, রোগা—কিন্তু হাসিটা বড় মিষ্টি। ঐ যে সুপ্রীতি হাসছে, ওর চেয়েও তার হাসি ভালো। চারু তাকে চিঠি লেখে, তার মধ্যে ঝুড়ি ঝুড়ি পদ্য। দেখা হলে কালো মেয়েটা কথার তুবড়ি ছুটায়। কিন্তু শ্রীপতি কারো সঙ্গে চারুর পরিচয় করিয়ে দেয় না, বউয়ের রূপহীনতার দরুন মনে মনে লোকে অবজ্ঞা করবে এই আশঙ্কায়। সুপ্রীতির মতো অত ফর্শা রঙ অবশ্য আশা করা যায় না, কিন্তু চারু যদি ফ্যাকাশেও হত একটু! আজ এখানে এসে অবধি এর-তার মুখে প্রেমতোষের শ্বশুরবাড়ি সম্পর্কে অনেক খবর সে শুনেছে। কলকাতা শহরে খানপঞ্চাশ বাড়ির মালিক, মফস্বলেও তাঁদের জমিদারি আছে, রীতিমতো বনেদি ঘর, ওয়ারেন হেস্টিংসের আমল থেকে কোম্পানিবাহাদুরের সঙ্গে দহরম-মহরম, বাড়ির ছেলেমেয়েদের পর্যন্ত এক একখানা মোটরগাড়ি। তবে হবে না কেন এত ফর্শা? চার-পাঁচ পুরুষ ধরে মাটির ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলছে⋯ময়লা লাগে না, তেতলা-চারতলায় আরামে থাকে, ভাল খায়, ভাল পরে—নেহাত বেড়াবার শখ হলে পিচের রাস্তায় বিশাল মোটরের গর্ভে ঢুকে পড়ে। মোটর ছোটে, তাতেই বেড়ানো হয়ে যায় ওদের। জীবনে এক কণিকা ধুলো লাগেনি পায়ে,—এমন ধবধবে রঙ খোলে কি সহজে?
অন্ধকার পথে তারা ফিরে চলেছে। এতক্ষণ উগ্র বিদ্যুতের আলোয় থেকে পথটা দুর্নিরীক্ষ্য বোধ হচ্ছে। ডায়নামো বসিয়ে তৈরি করা বিদ্যুৎ—সে এদের জন্য নয়। আর সকলে তবু হামেশা গতায়াত করে, তাদের চেনা পথ। শ্রীপতি ইটে হোঁচট খেয়ে উ-হু-হু করতে করতে অনেক কষ্টে নিবারণের খোপে গিয়ে উঠল।
তক্তাপোশে মাদুর বিছিয়ে নিবারণ বলে, শুয়ে পড়ো, রাত হয়েছে।
তুমি?
সে হয়ে যাবে। শুয়ে পড়ো দিকি। কত জায়গা রয়েছে।
গলিতে না গাবতলায়? মেজেয় ছেলেমেয়ে শুয়ে পড়েছে, আর ঢেলে রেখেছে যত আনাজ-পত্তোর—
তাচ্ছিল্যের সুরে নিবারণ বলে, ঐ অত বড় একটা বারান্দা আছে কি করতে? আর হয়ই যদি গাবতলা। জায়গাটা কি মন্দ? আর একটা মাদুর হাতে করে সে বাইরের দিকে যায়।
শ্রীপতি বলে, বালিশ লাগবে না?
ওরে বাসরে! মাথার নিচে থেকে বেমালুম সরিয়ে নেবে, তারপর খোল ছিঁড়ে ফেলে দু’আনায় তুলো বেচে দিয়ে আসবে। বড্ড যাচ্ছেতাই জায়গা। ঐ যে আমার ভাই-ব্রাদার সব—কত ভাল ভাল কথা বলে গেল তো তোমার সঙ্গে—সব শালা চোর। বালিশ তো বালিশই সই। বাছ-বিচার করে না।
ক’টা বালিশ বাড়তি আছে তোমার? কই দেখি—
এসব বাজে কথায় নিবারণ কান দেয় না। শ্রীপতি বলে, তোমার ঘরে তুমিই থাকো দাদা। আমি পেরে উঠব না। আমি বেরুলাম।
রুষ্টকণ্ঠে নিবারণ বলে, ঘরের দোষটা হল কি শুনি?
কোথায় ঘর? অন্ধকূপ। কড়িকাঠের ধারে ঘুলঘুলি দিয়ে রেখেছে, বাইরের হাওয়া গায়ে লাগতে দেবে না। গরুর গোয়ালেও লোকে আজকাল দুটো-একটা ফুটো রেখে দেয়।
এত খাতির করে পাতা তক্তাপোশের মাদুরে শ্রীপতিকে কিছুতে শোয়ানো গেল না, সে বারান্দায় গেল। সেখানেও টিকতে পারে না; উঁচু পাঁচিল আর রান্নাঘরের সারি—যেন কয়েদখানা করে রেখেছে। অনেক রাত্রে পাঁচিলের দুয়োর খুলে সে বাইরে এসে দাঁড়ায়। তখন চাঁদ উঠেছে। পৃথিবীতে বাতাস বন্ধ হয়ে গেছে, গাছের পাতাটাও নড়ে না। একটু এগিয়েই মাটির প্রশস্ত উঁচু বাঁধ। বাঁধের ওদিকে কয়েকখানা ক্ষেত—সরু রাস্তা গিয়েছে ক্ষেতের ধার দিয়ে। আর খানিক গিয়ে শ্রীপতি দামোদরের গর্ভে পৌঁছল। বাধাবন্ধহীন ফাঁকা আকাশ—সে নিশ্বাস ফেলে বাঁচল এতক্ষণে।
সীমাহীন বালুরাশি। সামনে অনেক দূরে জ্যোৎস্নালোকে ওপারের তীরভূমি কালো রেখার মতো দেখাচ্ছে। চলেছে তো চলেছে; জলের চিহ্ন দেখা যায় না। শেষকালে একটুখানি পাওয়া গেল, হাত-দেড়েক গভীর, অতি সামান্য চওড়া। শ্রীপতি জলটুকু পার হয়ে গেল।
কারা এখানে? কি করো?
বাঁকড়ো জেলার মুনিষ আমরা বাবু। কাটোয়ায় যাচ্ছি। শুয়ে পড়েছি।
শ্রীপতিও তাদের মধ্যে আরাম করে বালুশয্যায় শুল।
খুব ভোরবেলা। লোকগুলো রওনা হয়ে গেছে, শ্রীপতিই কেবল ঘুমুচ্ছে একা-একা। খোঁজে খোঁজে নিবারণ এসে পড়ল।
হুঁ, জায়গা বেছেছ ভাল!
শ্রীপতি সায় দিয়ে বলে, তোফা, তোফা! চোদ্দপুরুষে কোনদিন এমন নরম বিছানায় শুইনি।
উঠে দাঁড়িয়ে প্রভাতের আলোয় চারিদিকে চেয়ে দেখল। ইনি নাকি আবার বাঁধ ভাঙতেন, ঘর ভাসাতেন? এত নাম এই দামোদরের?
নিবারণ বলে, ভাসাতেন বলছ কেন, এখনো কি পারেন না? মা-কালী রক্ষে করুন, সেদিন এসে আর কাজ নেই—
দূর বিসর্পিত কঠিন বাঁধের দিকে চেয়ে শ্রীপতি হেসে খুন। ঐ বাঁধ ভাঙবে বালির মধ্যে মুখ-ঢাকা ক্লান্ত শ্লথচরণ এই বিশীর্ণ জলধারা? হা-হা-হা! একটা ঘাস ছিঁড়বার মুরোদ নেই, নদা বললে এঁর নাকি আবার অপমান হয়—ইনি হচ্ছেন নদ।
নিবারণ বলে, তেমন ঢল যদি নামে, ঐ বাঁধ এক লহমায় উড়ে যাবে, চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যাবে না। ⋯যাই বলো ভায়া, এরকম জায়গায় পড়ে থাকা তোমার উচিত হয়নি। সর্বনেশে দামোদর! কখন কি করে বসে, আমরা মোটে বিশ্বাস করি নে।
এরই তিন মাস পরে আবার ডাক পড়েছে শ্রীপতির। ১৩৫০ সাল, স্মরণীয় বৎসর, ১১৭৬ সালের চেয়ে ইতিহাসে অনেক বড় জায়গা হবে এর জন্য। এবারের চিঠিটা একটু বিস্তারিত; নিবারণ লিখেছে, বড় গোলমাল—শিগগির এসো।
ব্যাপার হচ্ছে, মহীতোষ রাহা মারা গেছেন; প্রেমতোষ সর্বময় কর্তা। চাল সরবরাহের খুব বড় একটা কন্ট্রাক্ট বাগিয়েছে সে। মিলের লোকেরা বরাবর এক মন করে খোরাকি চাল পেয়ে আসছে। প্রেমতোষ বলে, যখন এই নিয়ম করা হয়েছিল চালের মন তখন চার টাকা। সেই হিসাবে এক মন কেন—আড়াই মনের দাম নগদ দশ টাকা পর্যন্ত ধরে দিতে সে রাজি আছে। কিন্তু চালের একটি কণিকা অপচয় করতে পারবে না।
খুব কান্নাকাটি করেছে এরা। আমরা খাবো কি, হুজুর? বাজারে চাল পাওয়া যায় না, টাকা দিলেও যে মেলে না।
প্রেমতোষের সাফ জবাব। টাকা—টাকা খেয়ে যারা থাকতে পারে, তারাই থাকবে। না পোষায়, সোজা ঐ পথ দেখা যাচ্ছে।
এরই মধ্যে প্রেমতোষ খুব চিনে ফেলেছে এদের। কুত্তার দল—জুতো মারো, ঠ্যাং খোঁড়া করে দাও, যতক্ষণ উচ্ছিষ্টের গন্ধ বেরুচ্ছে কেউ নড়বে না—মুখে যতই ঘেউ-ঘেউ করুক। যাবে কোথায়? দু-বেলা দু-মুঠো ভাত—সে তো দস্তুরমতো বিলাসদ্রব্য হয়ে উঠেছে আজকাল। বাজারে ভেজালহীন খাঁটি চাল একদম পাওয়া যায় না—এক রকম জিনিস উঠেছে, তার নাম চালে-ডালে, টাকায় আঠার ছটাক পর্যন্ত মেলে। চাল ও ডাল আধাআধি দেবার কথা, কিন্তু জোচ্চুরি করে তিনভাগই ডাল মিশিয়ে দেয়। বিপদে পড়ে তখন এরা শ্রীপতিকে খবর দিল। সাদা সাহেবকে যে কাবু করেছে, বাঙালী সাহেবকে কি করতে পারে, দেখা যাক। স্টেশনেই জন-পঁচিশেক প্রতীক্ষা করছিল। যখন শ্রীপতি নিবারণের ঘরে গিয়ে উঠল, যেন তারে তারে খবর হয়ে গেল। ফিসফাস কথাবার্তা⋯নিঃশব্দে সকলে গতায়াত করছে। পাঁচিলের দরজায় খিল এঁটে দেওয়া হয়েছে, জন-দুই সেখানে পাহারায় আছে।
এক ছোকরা বলে, স্ট্রাইক করা হবে নাকি? ওদের যা ব্যবহার, চুপ করে থাকা তো যায় না।
শ্রীপতি চুপি-চুপি জিজ্ঞাসা করে, কে ওটি?
সুরথ ওর নাম। অল্পদিন এসেছে। চালাক ছেলে, ভীষণ তেজি।
সুরথ বলতে লাগল, স্ট্রাইক করবেন কি না, তাই বলুন। কবে থেকে? কাল না পরশু? কাগজপত্র ছাপিয়ে এনে থাকেন তো দিন আমাকে; আমি বিলি করে আসছি। আর কি কি করতে হবে বলে দিন—
শ্রীপতি বলে, তোমরা যাও এখান থেকে। সকলে চলে যাও। শুধু যতীন আর চরণ ঘোষ—এই থাকলে হবে।
সারাদিন বৃষ্টি হয়েছে, এখনও থমথম করছে আকাশ। বেঙ ডাকছে। শ্রীপতি নিবারণের ঘরে ঘুমিয়ে আছে, বাইরে শোবার উপায় তো নেই। অনেক রাত্রে দরজায় দমাদম লাথি—ভেঙে পড়ে আর কি! নিবারণ খিল খুলে দেখে হাফপ্যান্ট পরা মিলের সাব-ম্যানেজার নীলরতন দরোয়ান ড্রাইভার প্রভৃতিতে একটা পল্টন জুটিয়ে এনেছে। শ্রীপতিকে দেখিয়ে বলে, এ বেটা কোত্থেকে এসে জুটল? বল্—বল্—
মত্ত অবস্থা, মুখ দিয়ে ভক্-ভক্ করে গন্ধ বেরুচ্ছে। উত্তরের অপেক্ষা না করে বলতে থাকে, যত জায়গায় লোক ক্ষেপিয়ে বেড়াস্ তুই হারামজাদা। জুটেছিস এসে এখানে?
শ্রীপতি বলে, গায়ে হাত দেবেন না বলছি—
না, গায়ে হাত দেব কেন? শালা আমার গুরুঠাকুর এসেছেন পায়ে হাত দিয়ে পুজো করব!
হাতের রুল দিয়ে মারল শ্রীপতির মাথায় এক বাড়ি। দরদর করে রক্ত পড়ে। নিবারণের জিনিসপত্র সমস্ত তারা ছুঁড়ে বাইরে ফেলল। বলে, সাহেব তাকে ডিশমিশ করেছেন। এক্ষুনি ঘর ছেড়ে বেরো। বেরো—বেরো। নিবারণের ছেলেমেয়ে ঘুম ভেঙে ডুক্রে কেঁদে উঠল।
গলিতে নেমে নিবারণ ছড়ানো জিনিসপত্র কুড়োয়। দেখা গেল, যতীন আর চরণ ঘোষেরও ঐ দশা; তাদেরও চাকরি গেছে। নীলরতন হুমকি দিয়ে বারান্দায় ছুটোছুটি করতে লাগল। আর কে আছিস? কার কার পাখনা গজিয়েছে? সাহেব অবিচার করছেন, কে কে বলে বেড়াচ্ছিস—এগিয়ে আয়, দেখি।
সকলে সকাতরে ঘাড় নাড়ে। না হুজুর, আমরা নই। আমরা অমন কথা বলতে যাবো কেন? কোন গণ্ডগোলে আমরা থাকিনে।
ত্রিশটি পরিবার থাকে এক লাইনে। এই তোলপাড়ের মধ্যে কারওজাগতে বাকি নেই। কেউ একটা কথা বলল না, আতঙ্কে বোধ করি কারও নিশ্বাসও পড়ছে না। বর্ষা-রাত্রির পিছল পথে সামান্য কাপড়-চোপড় ঘটি-বাটি বোঁচকা বেঁধে নিয়ে এরা বিদায় হয়ে গেল। রক্ত গড়িয়ে পড়ে শ্রীপতির কামিজটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, একটাবার মুছে ফেলবে সে হুঁশও তার নেই। পাঁচিলের কাছে দাঁত বের করে হাসছিল সুরথ। এদের দেখে সরে পড়ল।
কোথায় যায় এখন? বৃষ্টিটা থেমে আছে, কিন্তু ভয়ানক পিছল অন্ধকার পথ। সবচেয়ে মুশকিল বাধিয়েছে নিবারণের ছেলেমেয়ে দুটো। অবোধ, মা-হারা—রাত্রিবেলা বিছানায় শুয়ে ভূতের ভয়ে এরা চোখ খোলে না। কোথায় নিয়ে যাবে এদের? ওদিকে নীলরতনের চিৎকার শোনা যাচ্ছে, সকালে কাউকে যদি ত্রিসীমানায় দেখি, গলা কেটে মাটিতে পুঁতে ফেলব। থানা-পুলিস করবে, এমন প্রাণী রাখব না। নীলরতন নিতান্ত বাজে বলে না। এ ব্যাপারের পরেও যদি এরা ঘোরাফেরা করে, কাল সকালে না হোক রাত্রে চুপিসাড়ে ওর ঐ হিংস্র দলবল নিয়ে একটা কিছু করে ফেলা বিচিত্র নয়। নীলরতনের সম্বন্ধে এই ধরনের অনেক কীর্তিকাহিনী মিলের লোকেরা বলাবলি করে থাকে।
স্টেশনের উল্টা দিকে রেললাইনের উপর বসে আবার খানিকটা শলা-পরামর্শ চলল। তিন দিন পরে মাইনের তারিখ, নিবারণের কয়েক আনা মাত্র সম্বল, পুরা একটা টাকাও নেই। যতীন আর চরণেরও প্রায় ঐ দশা—তবে তাদের মস্ত সুবিধা, সবাই তারা দশ-বিশ মাইল হাঁটতে পারবে। শ্রীপতির ফিরতি গাড়িভাড়ার দরুন যা ছিল, সমস্ত নিবারণকে দিয়ে দিল। সকালে আটটা সাতাশের আগে গাড়ি নেই; ততক্ষণ ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকবে এখানে এই রাস্তার উপর; ঐ দুটিকে বেলুড়ে এক পিসির হেপাজতে রেখে আবার নিবারণ ফিরবে। ইতিমধ্যে শ্রীপতিরা রসুলপুরে গিয়ে লোকজন জোটাবে। ঘাড় নিচু করে সইবে না তারা, কি করতে হবে সমস্ত ঠিক হয়ে যাবে কালকের দিনের মধ্যে। গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড এখানে রেল-রাস্তার পাশাপাশি চলেছে। চরণ ঘোষ, যতীন ও শ্রীপতি দ্রুত চলল। রাতের মধ্যে যতদূর পারা যায়, এগুতে হবে—এক এক মিনিটের এখন দাম অনেক।
পুবে ফর্শা দিয়ে এল। এত জল হয়েছে মাঠে! বৃষ্টি তিন-চার দিন অবিরল ধারে হচ্ছে, তা বলে এত জল! বাঁ-হাতি মাঠটায় কিন্তু জল এত বেশি নয়। জায়গায় জায়গায় রাস্তা ছাপিয়ে জলপ্রপাতের মতো জল পড়ছে। চরণ ঘোষ বলে গতিক সুবিধের নয়। সন্দ হচ্ছে। আমার দাদাশ্বশুরের পাকা বাড়ি আছে সামনের গাঁয়ে। যাবে নাকি?
ভোরের আলো পড়েছে রেল-রাস্তার পাশে, যেখানে শিশু ছেলেমেয়ে দুটিকে নিয়ে নিবারণ জেগে বসে আছে। এত জল? কাল দিনমানে তো ছিল না, সন্ধ্যার পর থেকে বৃষ্টিটা বরং বন্ধ হয়েছে। এত জল জমল কি করে?
কি ভয়ানক, জল বাড়ছে যে! দেশ-দেশান্তরের জল ছুটে চলে আসছে। ঘাসের উপর শিশু দুটি ঘুমিয়ে ছিল, তাদের সেই অবস্থায় রেখে নিবারণ নেমে ছুটে গেল লাইনে। ঘরে ঘরে সব খিল দিয়ে ঘুমুচ্ছে। তিনটে পরিবার অসহায়ভাবে পথে উঠেছে, এরই মধ্যে বেমালুম ভুলে গিয়ে তারা দিব্যি নাক ডেকে ঘুমুচ্ছে। পাগলের মতো সে পাঁচিলের দরজায় ধাক্কা দেয়, দেয়ালের ধার দিয়ে চেঁচিয়ে ছুটোছুটি করে। ওরে, বান ডেকেছে। বেরিয়ে এসো। বাঁচতে চাও তো রাস্তায় এসে ওঠো।
বন্যা। দামোদর বাঁধ ভেঙে তাড়া করে আসছে। সকালবেলা স্টেশনে তার এল, আটটা সাতাশের গাড়ি আসবে না। লোকের মুখে চোখে উদ্বেগ⋯তাই তো, গাড়ি কতকাল চলবে না—তাই দেখ। রেলকোয়ার্টার, রাইসমিল ও বাজার রেল রাস্তা-থেকে অনেক নিচে। দেখতে দেখতে স্টেশন লোকারণ্য হয়ে উঠল। মানুষ, গরু-বাছুর, বিছানাপত্র, ট্রাঙ্ক-স্যুটকেস—যে যতদূর বয়ে আনতে পেরেছে।
তোলপাড় লেগে গেছে ওদিকে প্রেমতোষের বাড়িতেও। নিচের ঘরগুলোর জিনিসপত্র দোতলা ও তেতলায় তোলা হচ্ছে। জল বাড়ছে, অতি দ্রুত বাড়ছে। সুপ্রীতির মুখ শুকননা, কথা সরছে না। সবে তো শুরু—আর খানিকটা দেখলে ভয়েই সে হার্টফেল করবে, এমনি অবস্থা। বড় গাড়িটা পেট্রোল ভর্তি হয়ে ফটকে দাঁড়াল।
অর্ধ-অচেতন সুপ্রীতি প্রেমতোষের গায়ে ভর দিয়ে গাড়িতে উঠল। জোরে চালাও গাড়ি—জোরে, খুব জোরে। বন্যাস্রোতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটতে হবে। দুপুরের মধ্যে পৌঁছুতে হবে কলকাতা, মানুষের সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়।
জল বাড়ছে, খরবেগে স্রোত আঘাত করছে রেল-রাস্তার গায়ে। কালভার্টের মুখে ঘোলা জল আবর্তিত হয়ে ঢুকবার চেষ্টা করছে। দুপুর নাগাত দেখা গেল, চারিদিক সমুদ্রের মতো হয়ে উঠেছে, গ্রাম-বাড়ি-ঘর নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে দেখা যায়, গাছের মাথা আর দু-একটা পাকাবাড়ির ছাত।
নিবারণ দেখতে গেল, মিলের কি দশা হয়েছে—যেখানে সে বিশ বচ্ছর কাটাল, যেখানকার লাইনের ঘরে তার শিশু-সন্তান জন্মেছে, ও-বছর স্ত্রী মারা গেছে। সিগন্যাল-পোস্টের ধারে দাঁড়িয়ে তার ঘরের ভিতর-বাহির পরিষ্কার দেখা যায়। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে দেখে। দরজায় শিকল তুলে দিয়ে মানুষজন পালিয়েছে, বাইরের জল ঘুলঘুলির পথে ঘরে ঢুকেছে, সে জল জানলা দিয়ে দরজার ছেঁদা দিয়ে শতধারে ফোয়ারার মতো বারান্দার দিকে পড়ছে। দেখতে চমৎকার। তক্তাপোশটা জলে ভাসছে, এক-একবার জলের টানে দেয়ালের সঙ্গে আঘাত লাগে, জোরে প্রতিহত হয়ে ফিরে যায়। বউকে যেদিন দেশ থেকে এখানে আনে, তারই আগের দিন ঐ তক্তাপোশ কেনা; ওরই উপর শুয়ে রোগে ভুগে ভুগে কঙ্কালসার হয়ে বউ মারা গেল। আজকে ছেলে-মেয়ে নিয়ে সে পথে ভাসছে, তার ঐ সাধ-করে-কেনা তক্তাপোশও ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছে।
পালাও—ওদিকে চলে যাও—রাস্তা ভাঙছে।
মানুষগুলো আরও ঝুঁকল, যেদিক থেকে ঐ রব উঠেছে। সত্যি, ভেঙে ফেলেছে পাকা ইটের গাঁথা কালভার্ট। দুর্বার স্রোত ওপারে যাবার জন্য আকুলি-বিকুলি করছে, ভেঙেচুরে ভাসিয়ে পাক খেয়ে জল বেরুচ্ছে। বড় বড় গাছের ডাল এক নজর দেখা দিয়ে অতলে তলিয়ে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে মাটি ধসে গিয়ে জলধারা বিশাল পথ তৈরি করে নিল। রেল-রাস্তা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, শূন্যে পড়ে আছে কেবল বিরাট সরীসৃপের মতো কাঠে-আঁটা লোহার লাইনগুলো।
বিকাল হয়ে এল। গরুগুলো হাম্বা-হাম্বা করছে, আশ্রয়ার্থীর ভিড় আরও বেড়েছে, খাওয়া-দাওয়া নেই—ছেলেমেয়ে কাঁদছে। ঘরের চাল ভেসে যায় ঐ একটা। চালে বসে মুরগি ডাকছে, পাশে মানুষ। চাল যদি দৈবক্রমে বড় গাছের গায়ে কি পাকাবাড়ির পাশে গিয়ে লাগে, তবে ওরা বাঁচবে; নয় তো তলিয়ে গেল বলে!
প্রেমতোষেরও পথে বিপত্তি ঘটল। এমন যে গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড, সেখানেও জল উঠেছে। চালাও—জোরে চালাও। ভাবছে, এ জায়গাটা নিচু বলেই এ রকম হয়েছে, এগুলে ঐ গ্রামের দিকে ভাল উঁচু রাস্তা পাওয়া যাবে, তখন আর অসুবিধা হবে না। জোরে—আরো আরো জোরে চালাও। আর দু’ঘণ্টায় কলকাতা পৌঁছনো চাই। জল ক্রমেই বেশি⋯ইঞ্জিনে জল ঢুকে স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেল। উপায়? উপায় কি এখন?
ভিতরে সিটের উপর উচ্ছ্বসিত জলতরঙ্গ গিয়ে পড়ল। সুপ্রীতি ভিজা কাপড়ে গাড়ির ছাতে গিয়ে ওঠে। গাড়ি নড়ছে, দুলছে যে! ভাসিয়ে নিয়ে যাবে নাকি? ডালপালা-মেলা বড় অশ্বত্থ গাছ—সেখান থেকে চিৎকার আসে, বাঁচতে চাও তো উঠে এসো। গাড়ি ফেলে গাছে ওঠো—
প্রেমতোষ আর্তকণ্ঠে বলে, গাড়িটা তোমরা ঠেলে দাও ঐ গাছ অবধি। দশ টাকা করে দেব। পায়ে ধরছি তোমাদের—
দশ-দশটা টাকা! টাকার লোভে ঝুপঝুপ করে লাফিয়ে পড়ল জন-আষ্টেক। জলের উপরে যে টান, নিচে তার শতগুণ। ফেলে দেবার জন্য পায়ে কাছি বেঁধে কারা যেন টানছে। অনেক কষ্টে গাছের নিচে মোটর পৌঁছল।
সুপ্রীতি নবনীত-কোমল হাতে জড়িয়ে ধরল গাছের ডাল। চোখে চশমা, নীল সিল্কের শাড়ি সুঠাম সুশুভ্র দেহলতা ঘিরে আছে। সমস্ত জলে-কাদায় মাখামাখি। কি ব্যাকুলতা তার চোখে-মুখে! ডালটা ধরে ঝুল খেয়ে সে উঠবার চেষ্টা করে। বলে, পারছি না তো!
মিহি সুরে এই ধরনের আবদার চিরকাল কত প্রশ্রয় কত প্রশংসা পেয়ে এসেছে! যে সুন্দর, তার অক্ষমতা অতি-মনোহর হয়ে দেখা দেয়। সুপ্রীতি বলে, গাছে চড়তে কি আমি পারি?
হাত তো দু’খানা রয়েছে, পা-ও আছে। আমরা পেরেছি, তুমি কি জন্য পারবে না, ঠাকরুন? শ্রীপতির গলা। গাছের উপর চুপচাপ বসে আছে, আর হিংস্র উল্লাসে প্রলয়-দৃশ্য দেখছে। ঢল নেমেছে, ক্ষীণপ্রাণ সেই দামোদর ছুটে বেরিয়েছে দিগ্দেশ পরিপ্লাবিত করে।
সুপ্রীতির গাল বেয়ে টপ-টপ ঝরছে চোখের জল। আঁকুপাঁকু করে সে উঠবার চেষ্টা করে। আনাড়িপনা দেখে হাসি পায়। তোমার কর্ম নয় গো ঠাকরুন, তোমার ও-হাত লাগে মুখে পাউডার ঘষতে, প্রিয়জনের গলায় মালার মতো পরিয়ে দিতে, ঘি-দুধ মাছ-মাংস যাবতীয় সুখাদ্য ইঞ্চি-মাপা হিসেব করা পদ্ধতিতে মুখে তুলতে। জগতের কোন কাজে লাগে না। বিশ্বসুদ্ধ মানুষ মুগ্ধ বিস্ময়ে অবাক হয়ে থাকে, কত উপমা কত কবিতা উচ্ছ্বসিত হয়—শীতে মোলায়েম ফার আর গরমকালে রেশম-মোড়া অতি চমৎকার সুপ্রীতির হাত দু’খানা!
বন্যা ঘুচিয়ে দিয়েছে মানুষে মানুষে ব্যবধান। নইলে ধরুন, শ্রীপতি সরকারের সঙ্গে মিসেস সুপ্রীতি রাহার ঘনিষ্ঠতা—সাবধানে মাটি বাঁচিয়ে চলে যে সুপ্রীতি, মাটিকে তার বড় ঘৃণা, মাটির কণিকা ফর্শা অঙ্গে লেগে রূপ মলিন করে সেজন্য অনেক দামি সাবান খরচ করতে হয় তাকে—এহেন রূপসী কাদা-মাটি মেখে শ্রীপতিদের সঙ্গে এক গাছের উপর বসবাস করবে, কে ভাবতে পেরেছিল এ কথা? এ বন্যা অবশ্য নেমে যাবে কাল কি পরশু কিংবা পাঁচ-দশ দিন পরে; শ্যামা ধরিত্রী জলগুণ্ঠন সরিয়ে হেসে উঠবে। শ্রীপতিদের খোড়ো ঘর, কাঁচা গোয়াল, গরু-বাছুর উঠানে পালা-দেওয়া খড়ের আঁটি সমস্ত ভেসে গেছে। প্রেমতোষের পাকা গাঁথনির দেয়াল—জলধারা প্রহত হয়ে ফিরছে, এক টুকরা ইট খসাতে পারল না। বন্যার পর সুপ্রীতি গিয়ে উঠবে তার পরম আরামের তেতলার ঘরটিতে। কিন্তু আর যে এক বন্যা আসছে—অভ্রংলিহ প্রাসাদ, টাকার পাহাড়, বিলাস-ব্যসন, ফাঁকির জীবন ভেঙে চুরমার করে দেবে, তাকে রুখবার কি করছ প্রেমতোষ সাহেব? দরকার হলে চারুর মতো গোবর-মাটি দিয়ে ঘর নিকোতে পারবে তো সুপ্রীতি দেবী? সেদিন গাছের ডালে নয়—শান্ত সুস্থ অকৃপণ ধরণীর উপর আমরা এক সঙ্গে দাঁড়াব। ছবিটা আন্দাজ করুন একবার। মিস্টার প্রেমতোষ রাহার পাশে কারা ওসব? তাঁর মিলে সারাদিন চাল তৈরি করে দিয়ে চালের অভাবে যারা উপোস করত তারাই—বীর্যবান, ভরসার আলোয় উজ্জ্বল তাদের মুখ। এই যেমন বালুসর্বস্ব বিশীর্ণ নদীতে ঢল নেমেছে, সেদিনও ঢল নামবে ঐ মাংসলেশহীন ম্যালেরিয়ায় জীর্ণ যতীন কামারের মধ্যে, ঐ সুরথ বিশ্বাস, নীলরতনের মধ্যে—আত্মা যাদের মরে গেছে, উচ্ছিষ্টের আশায় স্পাই হয়ে খবরাখবর দেয়, আপনার লোকের মাথায় লাঠি মারে। আজকের এইসব ভেসে-যাওয়া মেঘম্লান অপরাহ্ণে দুরন্ত প্রলয়-কল্লোলের মধ্যে শ্রীপতি আর এক মহাবন্যার তরঙ্গ-ধ্বনি শুনতে পেল।
১৩৫০ (১৯৪৩)