আট
টোকিও শহরের দিকে নামতে শুরু করেছে নুমার জেট বিমান। এয়ার পকেটে পড়ে ঘুম ভেঙে গেল রানার। সিটে উঠে বসে দেখল চারপাশ। দু’পাশের সিটে সোহেল, আসিফ ও তানিয়া। দীর্ঘ এ যাত্রায় একটুও ঘুমিয়ে নেয়নি ওরা। রানার ধারণা: বেশি পণ্ডিতির জন্যে সামনে দুঃখ আছে ওদের তিনজনের কপালে।
নিজে রানা নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারে বিমানে। ইঞ্জিনের হালকা আওয়াজ যেন স্লিপিং পিল। তা ছাড়া, গত আড়াই মাস বৃষ্টি, ঝড় ও তুষারপাতের মাঝে তাঁবুতে ঘুমাবার পর জেট বিমানের স্লিপার সিট মনে হয়েছে রাজার বিছানা।
‘বিমানে পড়ে পড়ে ঘুমিয়ে তুই চ্যাম্পিয়ন বদ্ধ-পাগল, ‘ ঘড়ি দেখল সোহেল। ‘পুরো দশ ঘণ্টা পার করেছিস এক ঘুমে। এটা একটা রেকর্ড।’
‘এটা কিছুই না,’ বলল রানা, ‘এর দ্বিগুণ রেকর্ড আছে আমার।’ এতদিন পর মসৃণ গালে হাত বুলিয়ে নিজেকে কেমন যেন অচেনা লাগল ওর।
কেবিনে ঢুকল সুন্দরী অ্যাটেণ্ড্যান্ট। সবার হাতে দিল ইউক্যালিপটাস পাতার সুবাস ভরা ভেজা, গরম তোয়ালে। ওটা দিয়ে মুখ ও ঘাড় মুছে পুরো সচেতন হয়ে উঠল রানা। জানালা দিয়ে তাকাল নিচে। সাগর থেকে বইছে হাওয়া, তাতে ভর করে উপসাগর পেরোল ওদের বিমান। শহরের ওপরে পৌছে ঘুরে চলল মানুষের তৈরি নকল দ্বীপের হ্যানেডা এয়ারপোর্ট লক্ষ্য করে।
হতাশ করল না রাতের টোকিও, ঝিকমিক করছে কোটি কোটি রঙিন বাতি। ঠিক মাঝে আকাশ ছুঁয়ে ঝলমল করছে লালচে স্তম্ভ— টোকিও টাওয়ার।
মাঝারি হোঁচট খাওয়ার পর রানওয়েতে নেমে ক্রমেই হ্রাস পেল বিমানের গতি। ট্যাক্সিং করে গেট লক্ষ্য করে চলল পাইলট।
একটু পর ফুরফুরে মনে বিমান থেকে নামল রানা।
দীর্ঘ বিমান যাত্রায় ওরা পেরিয়ে এসেছে আন্তর্জাতিক ডেট লাইন, ফলে হারিয়ে গেছে পুরো একটা দিন। জাপানে এখন রাত দশটা।
কাস্টম বুথ থেকে বেরিয়ে ব্যাগেজ চেইনের সামনে থামল ওরা। রানা ও তানিয়ার মনের প্রশ্নটা করল সোহেল, ‘টেকনোলজিওয়ালাদের শত্রু তোর আদিম বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে, আসিফ?’
‘না,’ বলল জিয়োলজিস্ট, ‘করিনি। তবে হোটেলে উঠেই টেলিগ্রাম পাঠাব। তাতে যদি সাড়া না দেন, তখন অন্য উপায় খুঁজতে হবে।’
‘তোমার ভাবতে হবে বলে মনে হয় না,’ টার্মিনালের দিকে তর্জনী তুলল তানিয়া।
টার্মিনালের অটোমেটিক গেটের কাছে সাদা প্যান্ট ও ক্লাসিক গেইশা প্যাটার্নের রঙিন সিল্ক টপ পরে দাঁড়িয়ে আছে এক মেয়ে। কাঁধ থেকে ঝুলছে ব্যাকপ্যাক। হাতের বোর্ডে লেখা: বাঙালি জিয়োলজিস্ট আসিফ রেজা।
‘তোমাকেই খুঁজছে ওই মেয়ে,’ বলল তানিয়া।
‘তাই তো মনে হচ্ছে,’ মাথা দোলাল আসিফ।
‘তো গিয়ে কথা বল্,’ বলল রানা, ‘তোর পিছু নেব আমরা।’
আসিফের ভারী সুটকেস অনায়াসেই বামহাতে তুলল সোহেল। রানার সঙ্গে বিপজ্জনক এক অ্যাসাইনমেন্টে গিয়ে চলন্ত ট্রেনে কাটা পড়েছিল কনুইয়ের ওপর থেকে। পরে বিখ্যাত বাঙালি বিজ্ঞানী কুয়াশা ওকে তৈরি করে দিয়েছে দুর্দান্ত কাজের একটা রোবটিক হাত।
তরুণীর সামনে গিয়ে বাউ করল আসিফ। ‘আমিই আসিফ রেজা। জিয়োলজিস্ট।’
‘আপনিই দেখা করতে এসেছেন মাস্টার ইয়োশিরো শিমের সঙ্গে?’
‘হ্যাঁ। আর এরা আমার কলিগ।’
‘আমার নাম হিনা,’ বলল তরুণী, ‘মাস্টার শিমের ছাত্রী। তিনি লেকের মধ্যে দুর্গে আপনাদের সঙ্গে দেখা করবেন। চমৎকার জায়গা। দয়া করে আমার পিছু নিন।
ঘুরে টার্মিনাল ভবন থেকে বেরিয়ে গেল মেয়েটা। পিছু নিল রানা, সোহেল, আসিফ ও তানিয়া। ফুটপাথ ধরে হেঁটে চলেছে ওরা। টার্মিনালের বাইরে গিজগিজ করছে গাড়ি, শাটল বাস ও ট্যাক্সি। তাড়াহুড়ো করছে সামনের জায়গা দখল করতে। কিন্তু পাঁচজনের দলটির দিকে এগিয়ে এল না কোনও যানবাহন।
হিনার পাশে হাঁটছে আসিফ ও তানিয়া। পেছনে লেজের মত ঝুলে আছে রানা ও সোহেল। দমে গিয়ে রানাকে বলল বিসিআই চিফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর, ‘বুঝলি, ওই ছেমড়ি বোধহয় ভেবেছে হাঁটিয়ে নেবে মাইলের পর মাইল দূরের লেকের তীরে। আমি তা হলে শালা শেষ!’
‘না, মনে হয় ঘোড়ার গাড়ি এনেছে,’ ভরসা দিল রানা।
‘হতে পারে,’ মাথা দোলাল সোহেল। ‘টেকনোলজি যখন পছন্দ করে না…’
‘আমরা অতটা অপছন্দ করি না টেকনোলজি,’ নানান আওয়াজের ওপর দিয়ে কথা শুনেছে তরুণী। ‘আমাদের আপত্তি শুধু ইলেকট্রনিক্স জিনিসপত্রের ব্যাপারে। সাধারণ সব যন্ত্র ঠিকই আছে, তবে সমস্যা করছে মানুষের মনোভাব পাল্টে দেয়া যন্ত্র। যেমন কমপিউটার, ফোন বা অন্যান্য ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতি। ওগুলো প্রতি দিন বারবার বদলে নিচ্ছে প্রোগ্রাম। প্রকাশ করে দিচ্ছে, আপনারা এখন ঠিক কোথায় আছেন, বা কী করছেন। নানানদিক থেকে ব্যক্তিগত জীবনে অশান্তি ডেকে আনছে এসব ইলেকট্রনিক্স জঞ্জাল। তাতে তৈরি হচ্ছে আরও বড় সব সমস্যা।’
‘যেমন?’ জানার আগ্রহ প্রকাশ করল সোহেল।
‘জাপানের কথাই ভাবুন। তরুণ-তরুণীরা ডুবে আছে কমপিউটার, ভিডিয়ো স্ক্রিন বা ভার্চুয়াল রিয়েলিটির ভেতর। তাদের কাছে বহু দূরের বিষয় বাস্তবতা। মানুষ হয়েও মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক রাখছে না কেউ। যাচ্ছে রেস্তোরাঁ, বার, হোটেলে— ডুবে আছে নিজের ভেতর। খাচ্ছে-দাচ্ছে আর ঘুমাচ্ছে। দুনিয়ার হুঁশ নেই। হাজার হাজার মানুষের ভেতরেও একা দ্বীপের মত। চোখ সবসময় কোনও স্ক্রিনে, কানে ইয়ারবাড। এ দেশের মানুষ হয়ে যাচ্ছে রোবটের মত। এখন বিয়ে করতে চায় না যুবক-যুবতীরা। অনেক কমে গেছে বাচ্চা নেয়া। এভাবে চললে আগামী এক বা দুই প্রজন্মের ভেতর জাপানের জনসংখ্যা হবে অর্ধেক। এসবই হচ্ছে পশ্চিমা দুনিয়াতেও। আর এ ক্ষতি করেছে আধুনিক টেকনোলজি।’
মানুষের ভিড়ে ভরা টোকিও দেখে সত্যিই বিশ্বাস হবে না, মাত্র ত্রিশ বছরে অর্ধেক ফাঁকা হয়ে যাবে চারপাশ।
একটা পার্কিং লটে ঢুকে থামল হিনা। ‘আমরা র হওয়ার আগে আমার কাছে দেবেন সেল ফোন, আইস, ক্যামেরা বা কমপিউটার। অন্য আর কোনও ইলেকট্রনিক্স যন্ত্র থাকলে, সেসবও দেবেন।’
ব্যাকপ্যাক নামিয়ে একে একে সবার ইলেকট্রনিক্ যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করতে লাগল হিনা। রানা খেয়াল করল, ব্যাগের ভেতরে রয়েছে কোনও ধাতুর তৈরি ফয়েল।
সবার কাছ থেকে ইলেকট্রনিক্স যন্ত্র নেয়ার পর দেখা গেল তৈরি হয়েছে ছোটখাটো স্তূপ। মনে মনে স্বীকার করল রানা, আজকাল প্রত্যেকে ওরা বয়ে বেড়াচ্ছে এসব। অথচ, কয়েক বছর আগেও এসবের কোনও দরকার ছিল না কারও।
‘এত কিছু, বাস্!’ বিড়বিড় করল সোহেল।
ভারী ব্যাগের মুখ বেঁধে পার্কিং লটের আরেকদিকে এল হিনা। রানা ভেবেছিল, ওদেরকে নেয়ার জন্যে সাদা কোনও ভ্যান গাড়ি এনেছে মেয়েটা, কিন্তু দেখা গেল পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে ষাট দশকের দুটো ক্লাসিক জাপানি গাড়ি।
প্রথমটা সাদা সেডান। দেখতে অনেকটা ওই সময়ের বিএমডাব্লিউ গাড়ির মত। খুব দ্রুত চলার জন্যে তৈরি চাকা। ভেতরে ভিন্টেজ স্পয়লার। চকচক করছে পলিশ করা ক্রোম। দ্বিতীয় গাড়িটা উনিশ শ’ ঊনসত্তর সালের রুপালি রঙের ডাসান ২৪০যেড। নিচু ও লম্বা হুড। নিচু ছাত ও উইণ্ডশিল্ড পেরিয়ে অনেকটা সামনে আয়না। ফেণ্ডার দেখলে যে-কারও মনে হবে, যেন খুব দ্রুত চলছে গাড়িটা। দারুণ যত্নে তৈরি দু’পাশের কিনারা। ভেণ্ট দেখতে মাছের ফুলকার মত। যে- কেউ ভাববে, গাড়িটা আসলে ডাঙায় চলা ক্ষুধার্ত হাঙর।
রানার কাছ থেকে গাড়ি বিষয়ে বহু কিছুই শিখেছে সোহেল। নিজেও হয়ে উঠেছে দক্ষ এক্সপার্ট। প্রশংসা না করে পারল না, ‘দুর্দান্ত গাড়ি তো!’
‘স্যালভেজ ইয়ার্ড থেকে কিনে নিজেই মেরামত করেছি,’ গর্ব ভরে বলল হিনা।
‘তাই?’ চমকপ্রদ তথ্য পেয়ে অবাক হয়েছে সোহেল। বলে ফেলল, ‘তা হলে পরে সুযোগ পেলে আমরা দু’জন মিলে হয়তো মেরামত করব কোনও পুরনো গাড়ি।’
মুখে কিছু না বলে মৃদু মাথা দোলাল হিনা। ‘এই দুই গাড়িতে করে লেকের তীরে যাব।’ সেডানের পাশে গেল সে। ট্রাঙ্ক খুলে ওখানে রাখল রানাদের কাছ থেকে জব্দ করা ইলেকট্রনিক্স যন্ত্র ভরা ব্যাগ। রানা খেয়াল করল, ট্রাঙ্কের ভেতরেও আরেক স্তরের ধাতুর লাইনিং।
‘আমি তোমার সঙ্গে যেতে পারি,’ হিনাকে বলল সোহেল।
ধুপ্ করে ট্রাঙ্ক বন্ধ করে হিনা বলল, ‘না, আমার সঙ্গে যাবেন বাঙালি জিয়োলজিস্ট আসিফ রেজা।’
এ কথায় মস্ত এক দীর্ঘশ্বাস ফেলল প্রেমিকপুরুষ সোহেল।
‘আর বাঙালি জিয়োলজিস্ট আসিফ রেজার সঙ্গে অবশ্যই যাবে তার স্ত্রী,’ জানিয়ে দিল তানিয়া।
‘তাতে কোনও আপত্তি নেই,’ বলল হিনা। ‘অন্য দু’জন দ্বিতীয় গাড়িটাতে করে পিছু নেবেন। বেশি পেছনে পড়ে যাবেন না। আমরা দ্রুত গতি তুলে যাব। হয়তো এরই ভেতর নজর রাখছে কেউ।’
রানা ও সোহেলের দিকে চাবি ছুঁড়ে দিল তরুণী।
খপ্ করে চাবি ক্যাচ ধরল সোহেল। রানাকে বিজয়ীর হাসি দিয়ে বলল, ‘আমিই গাড়ি চালাচ্ছি।’
ক্লাসিক স্পোর্টস কারের দিকে চলেছে। রানা গিয়ে খুলল ডানদিকের দরজা। একইসময়ে গাড়ির বামের দরজা খুলে নিজের ভুলটা বুঝে মুখ গম্ভীর করে ফেলল সোহেল। কঠোর চোখে তাকাল রানার দিকে। কিন্তু ততক্ষণে স্টিয়ারিং হুইলের পেছনে সমাসীন হয়েছে রানা।
‘যাশালা!’ বিড়বিড় করল সোহেল। আমেরিকায় ক’দিন গাড়ি চালিয়ে মনে ছিল না, জাপানি গাড়ির স্টিয়ারিং থাকে ডানদিকে।
‘জাপানে রাইট হ্যাণ্ড ড্রাইভ গাড়ি চলে, দোস্ত,’ আগুনে ঘি ঢালল রানা। ‘পরেরবার মনে রাখবি। তা হলে দেখবি তোর বান্ধবীর সঙ্গে বসে গাড়ি মেরামত সহজ হবে।’
‘জেট ল্যাগে মাথা কাজ করছে না, আর সেই সুযোগে আমাকে ঠকিয়ে দিয়েছিস,’ আপত্তির সুরে বলল সোহেল।
‘এজন্যেই বলেছিলাম প্লেনে একটু ঘুমিয়ে নে,’ জিভ দিয়ে চুকচুক করে আওয়াজ তুলল রানা। ‘ওই ঘুম তোকে প্রায় তুলে আনত আদিম মানুষের কাছাকাছি। এবার চাবিটা দে দেখি!’
‘শালা, বাটপার!’ চাবি দিয়ে গোমড়া মুখে প্যাসেঞ্জার সিটে উঠে পড়ল সোহেল।
ইঞ্জিন চালু হতেই একফস্ট পাইপ থেকে বেরোল নিখুঁত আওয়াজ। ডাটসান ২৪০যেড-এর দুই দরজা বন্ধ হতে না হতেই রওনা হয়ে গেল সাদা সেডান। দ্রুত গতি তুলছে হিনা। গিয়ারশ্যাফট ধরে ব্যাক গিয়ার ফেলে পিছিয়ে গেল রানা, তারপর গাড়ি ঘুরিয়ে তীরবেগে চলল সেডানের পেছনে। একমিনিট পেরোবার আগেই দুই গাড়ি উড়ে চলল রাত্রিকালীন টোকিওর সড়কে।
কিছুক্ষণ পর গতি কমাতে হলো জ্যামের কারণে। তবে শহর পেছনে পড়ার পর আবারও তুমুল গতি তুলল হিনা। পেছনে আঠার মত লেগে রইল রানা ওর ডাটসান ২৪০যেড নিয়ে। ঘণ্টায় এক শ’ মাইল বেগে চলেছে দক্ষিণ-পশ্চিমের হাইওয়ে ধরে।
‘সত্যিই কেউ চোখ রেখেছে ভাবছিস?’ জানতে চাইল সোহেল।
‘কাউকে দেখিনি,’ বলল রানা। ‘তবে বেশিরভাগ মানুষ চাইছে আরও আধুনিক হোক জাপান, আর এরা চাইছে তার উল্টোটা।’ হাত বাড়িয়ে ম্যানুয়াল অ্যানালগ বাটন টিপে এম/এফ রেডিয়ো চালু করল রানা। ঠিক জায়গায় নিল নিডল। ‘মনে আছে, ছোটবেলায় এই জিনিস দেখে লোভ হতো? কিন্তু বড়রা ধরতে দিতেন না। সে সময়ের আধুনিক টেকনোলজি।’
মৃদু হাসল সোহেল। ‘মনে আছে। অ্যানালগ রেডিয়ো। এই গাড়িটাও অন্য যুগের টেকনোলজি। কার্বুরেটর আছে। ম্যানুয়ালি ক্যামশাট্ দিয়ে বন্ধ বা খুলতে হবে ভাল্ভ্। কমপিউটার ডায়াগনস্টিক আর ইঞ্জিন কন্ট্রোল ইউনিট তখনও আঁকা হয়নি ড্রয়িং বোর্ডে। সত্যিকারের মেশিন। যে চালাবে, চলবে তার ইশারায়। নিজে থেকে ভাববে না।’
লেন বদলে অ্যাক্সেলারেটরে চাপ দিল রানা। সাঁই করে পেছনে পড়ল নতুন অডি আর লেক্সাস গাড়ি। ‘এই জিনিসের মজাই আলাদা। মনে হয় কিছু করছি।’
একঘণ্টা হাইওয়ে ধরে যাওয়ার পর ওরা ঢুকল অন্ধকার, টিলাময় এলাকায়। চলল অপেক্ষাকৃত সরু সেকেণ্ডারি রোড ধরে। পেরিয়ে গেল আরও একঘণ্টা। পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথে হিনার পেছনে চলেছে রানা। আরও অনেকক্ষণ পর পৌঁছল উঁচু এক মালভূমিতে। এরপর পথ হলো সোজা। দূরে দেখা গেল চাঁদের আলোয় ঝিকমিক করছে হ্রদ।
কাছে গিয়ে গতি কমিয়ে মাটির কাঁচা রাস্তায় নামল হিনা। এগিয়ে চলল।
‘আশপাশে বাড়ি নেই,’ মন্তব্য করল সোহেল। ‘দুর্গ তো দূরের কথা!’
চুপ করে থাকল রানা। মেয়েটার পিছু নিয়ে পৌছে গেল লেকের তীরে। ওরা দেখল এক শ’ ফুট দূরে পানির ভেতর ছোট একটা দ্বীপ। সরু সেতু গেছে ওদিকে। খুব সাবধানে সেতুর ওপর গাড়ি তুলল হিনা। রানা ও সোহেল বুঝল, ওই সেতু প্রস্থে বড়জোর মেয়েটার গাড়ির সমান। হেডলাইট গিয়ে পড়ল দ্বীপে। সামনে রয়েছে পুরু পাথরের দেয়াল। মাঝে ড্র- ব্রিজ। ধীরে ধীরে নামছে ওটা।
‘দ্বীপই দুর্গ বা কেল্লা,’ বলল সোহেল।
প্রাচীন দেয়ালে জায়গায় জায়গায় পাথরের ব্যাটলমেন্ট। ভেতরের দিকে বিশাল প্যাগোডা আকৃতির দুর্গ।
‘যখন তখন দেখব ড্রাগন,’ ঠাট্টার সুরে বলল সোহেল। রানার মনোযোগ কাঠের সেতুর ওপর। ওটা এতই সরু ও নড়বড়ে, একটু এদিক-ওদিক হলে গাড়ি নিয়ে লেকে পড়বে ওরা। ‘সেডান যখন গেছে, আমরাও পারব।
নেমে এসেছে ড্র-ব্রিজ। ওটার ওপর উঠল হিনার গাড়ি। ঢুকে পড়ল দুর্গের ভেতর।
‘এবার আমাদের পালা,’ শ্বাস আটকে বলল সোহেল। সাবধানে এগোল রানা। ধুপ্ আওয়াজে কাঠের তক্তায় উঠল গাড়ি। ঠিকভাবে চলেছে বুঝতে মাথা বের করে সামনের চাকার ওপর চোখ রাখল রানা। সেতুর এক ইঞ্চি ভেতরে রয়ে গেছে চাকার বাইরের দিক।
‘এদিকে অনেক জায়গা,’ জানাল সোহেল।
‘কতটা?’
‘অন্তত তিন ইঞ্চি।’ রানাকে দেখে নিল সোহেল।
‘শুনে সন্তুষ্ট হইলাম, বৎস।’ বামে দুই ইঞ্চি সরল রানা। শামুকের গতি তুলে চলেছে ড্র-ব্রিজের দিকে। নিচে কড়মড় আওয়াজে গুঙিয়ে উঠছে তক্তা। ড্র-ব্রিজ প্রস্থে আরও কয়েক ইঞ্চি চওড়া। সেতুর চেয়ে মজবুত। নিচে লোহার পাত। ড্র- ব্রিজ পেরিয়ে দুর্গের গ্যারাজে ঢুকল রানা। আগে ওখানে রাখা হতো ঘোড়া।
গ্যারাজের চারদিকে ডযনখানেক গাড়ি। সব পঞ্চাশ, ষাট বা সত্তর সালে তৈরি। একটা মিনি কুপার গাড়ির পাশে থামল রানা। কিছুটা দূরে আইকনিক ইউনিয়ন জ্যাক। ছাতে ভোরের লালচে সূর্য আঁকা।
‘ভাল সংগ্রহ,’ মন্তব্য করল সোহেল।
ইঞ্জিন বন্ধ করে গাড়ি থেকে নামল ওরা। এসে রানার হাত থেকে চাবি নিল ধূসর আলখেল্লা পরা এক তরুণ। একই পোশাকের এক তরুণী নিল হিনার গাড়ির চাবি। রানা দেখল, দুই তরুণ-তরুণীর কোমরের খাপে ড্যাগার। চারদেয়ালে ঝুলছে প্রাচীন সব অস্ত্র। তলোয়ার, বর্শা, কুঠার, বর্ম, ঢাল ইত্যাদি। গ্যারাজ ভরা পুরনো আমলের গাড়ির সঙ্গে যেন খাপ খাচ্ছে না অস্ত্রগুলো। তবে খোঁজ নিলে হয়তো জানা যাবে, গাড়ি বা অস্ত্র প্রতিটি অ্যান্টিক— দুর্মূল্য।
কোথা থেকে যেন বাজপড়া এক কণ্ঠ বলে উঠল, ‘স্বাগতম আমার দুর্গে!
চোখ তুলে তাকাল রানা। গ্যারাজের ওপরের বারান্দা থেকে এসেছে কণ্ঠস্বর। লোকটার পরনে কালো আলখেল্লা। কাঁধে কাঠের বোর্ড। কোমরে ঝুলছে লাল-সাদা দীর্ঘ খাপ। ভেতরে বোধহয় কারুকাজ করা সামুরাই তলোয়ার। লম্বা চুল খোঁপা করেছেন ভদ্রলোক। গালে বাঁদরের মত হালকা দাড়ি। গোঁফ নেই। ‘আমিই ইয়োশিরো শিমেযু,’ বললেন তিনি। ‘দুঃখিত, দুর্গে ঢোকার আগে সার্চ করা হবে আপনাদেরকে। তবে আমরা খুশি, এসেছেন অতিথি হতে। আতিথেয়তায় ত্রুটি করব না আমরা।’
রানাদেরকে ঘিরে ফেলেছে শিমের ক’জন স্যাঙাৎ। ওদিকে ধুম্ আওয়াজে আটকে গেল ড্র-ব্রিজ। ব্র্যাকেটে লোহার দণ্ড বসিয়ে দিল দু’জন তরুণ।
‘ফোন বা ই-মেইল নেই…’ বিড়বিড় করল সোহেল।
বেরোবারও উপায় নেই,’ নিচু গলায় ওকে বলল রানা। ‘তরুণ-তরুণীদেরকে জিম্মি করেছে, সাধে বলে না অন্যরা।’