সাত
জাপানের টোকিও শহরের নোংরা অংশের সরু এক গলি ধরে হেঁটে চলেছে লো হুয়াং লিটন। তাকে ঘিরে রেখেছে তিনজন সশস্ত্র বডিগার্ড। বিলাসবহুল জীবনে অভ্যস্ত হলেও হংকং-এর দরিদ্র এলাকায় জীবন শুরু বিলিয়নেয়ারের, তাই একবারও নাক কুঁচকে গেল না আবর্জনার দুর্গন্ধে।
ঢুকে পড়ল ডানের পার্লারে। ভাল করেই জানে, ভেতরের ঘরে অপেক্ষা করছে বিশেষ এক লোক।
বাইরের ঘরে বিলিয়নেয়ার এবং তার তিন বডিগার্ডকে দক্ষ হাতে সার্চ করল চারজন জাপানি লোক। সরিয়ে নেয়া হলো ফোন ও জুতো। বডিগার্ডদের বলা হলো বাইরের ঘরেই রয়ে যেতে।
পেছনের ঘরে গিয়ে ঢুকল লো হুয়াং লিটন।
ঘরের মাঝে পা মুড়িয়ে বসে আছে চিতাবাঘের মত চিকন দেহের এক লোক, সারাশরীরে রঙিন উল্কি। সাধারণ মানুষ তাকে চেনে ‘ওরে’ নামে। অর্থাৎ: ভূত বা প্রেতাত্মা। যতজনকে খুন করেছে বলে ধারণা করা হয়, তার অর্ধেক সত্যি হলেও সে সংখ্যা আতঙ্কজনক। রাতে বাচ্চারা ঘুমাতে না চাইলে ভয় দেখায় জাপানি মায়েরা: ‘ওরে আসছে! ওরে ভয়ঙ্কর! ওরে এলে রক্ষা নেই! চট্ করে ঘুমিয়ে পড়ো, সোনা!’
লালচে আলোয় তাকে দেখল লো হুয়াং লিটন। গতবার যখন দেখেছে, তার চেয়েও চিকন হয়েছে প্রেতাত্মা।
‘আবারও এখানে আসবে, ভাবিনি,’ বলল ওরে।
‘তোমার জন্যে কাজ নিয়ে এসেছি।’
‘এবার কাকে কিডন্যাপ করতে হবে?’
‘না,’ মাথা নাড়ল লিটন। ‘এবারের কাজে রক্ত ঝরবে।’
খুব স্বাভাবিক থাকল ভূতের চেহারা। শান্ত স্বরে বলল, ‘অবাক করলে। ব্যবসায়ীরা কেনা-বিক্রির কাজ করে। তাদেরকে কখনও ঝরাতে হয় না কারও রক্ত।’
কথা ঠিক, ভাবল লো হুয়াং লিটন। তবে আপাতত যে কাজে নেমেছে, সেটা শেষ করতে হলে ঝরাতে হবে অনেকের রক্ত। যেমন ঝরবে মানুষের প্রাণ, তেমনি হুড়মুড় করে আসবে কোটি কোটি ডলার।
‘এক লোক, তাকে কিনে নিতে পারব না, প্রথম সুযোগেই সমস্যা করবে,’ বলল লিটন, ‘তাকে আর তার লোকদের সরিয়ে দেবে পৃথিবী থেকে। আমার হয়ে কাজটা করলে তুমি নিজেও হয়ে উঠবে বড়লোক।’
‘টাকার অভাব নেই আমার,’ বলল ওরে।
‘তো মানা করে দিতে, আসতাম না,’ রাগ দেখাল লো হুয়াং।
‘সে উপায় ছিল না। ভুলে যাইনি, তুমি আমার খালাতো ভাই।’
মাথা দোলাল হুয়াং। কথা ঠিক। বাকচাতুরীর সাহায্য নিল সে, ‘এবারে আমরা হব হয়তো আপন ভাইয়ের মতই। আমার কাজ শেষ হলে, কেউ আর স্পর্শ করতে পারবে না তোমাকে। টাকাও যেমন পাবে, তেমনি লুকিয়ে থাকতে হবে না পুলিশের ভয়ে।’
‘তাই নাকি?’ বাঁকা হাসল ওরে।
‘মিথ্যা বলছি না।’
কঙ্কালের মত শীর্ণ দু’হাত হাঁটুর ওপর রাখল ওরে। কী যেন ভাবছে। কিছুক্ষণ পর বলল, ‘তোমাকে বিশ্বাস করি। তবে কাজ নিলে ফি নেব আগের মতই। নগদ টাকায়।’
‘আপত্তি নেই,’ বলল লো হুয়াং লিটন। ‘পাবে সব নতুন নোট। বাঁচতে দেবে না শত্রুদের কাউকে। কোথাও রাখবে না কোনও প্রমাণ।’
‘ওটাই আমার বৈশিষ্ট্য। নামটা বলো।’
‘নামগুলো,’ শুধরে দিল লো হুয়াং।
‘তা হলে তো আরও ভাল। টাকার অঙ্ক বাড়বে।’
ওরের হাতে সংক্ষিপ্ত লিস্ট দিল হুয়াং। ওখানে লেখা আছে পাঁচজনের নাম।
‘কারা এরা?’
‘প্রথমজন ইয়োশিরো শিমেযু,’ বলল হুয়াং, ‘অন্যরা আসছে তার সঙ্গে দেখা করতে। চাই না কেউ বেঁচে থাকুক।’
‘কারণটা কী?’
‘এ ধরনের প্রশ্নের জবাব দেব না,’ জোর গলায় বলল লো হুয়াং লিটন। যদিও ওরে ওকে খুন করবে সে ভয়ে ধুকপুক করছে বুক।
‘তা হলে কাজটা নেব না,’ জানিয়ে দিল ওরে।
‘জানতেই হবে?’ মরিয়া হয়ে বলল লো হুয়াং।
‘হ্যাঁ। কেন তাদেরকে খুন করতে হবে?’
‘ইয়োশিরো শিমেষু নষ্ট করছে আমার ব্যবসা,’ বলল লো হুয়াং। কোনও ব্যাখ্যা দিল না। ‘অন্য চারজন বাংলাদেশি। ওরাও ক্ষতিকর আমার ব্যবসার জন্যে।’
‘কারা এরা?’
‘ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বী।’
‘কীভাবে মরুক চাও?’
‘সবাইকে পুড়িয়ে মারাই ভাল। প্রমাণ থাকবে না।’
মাথা দুলিয়ে তালিকা মেঝেতে রাখল ওরে। ‘প্রমাণ নষ্ট হলেও আগুন ব্যবহারে বাড়বে তোমার খরচ। পাঁচজনের জন্যে আলাদা ফি। আগুন তৈরিতে দেবে বাড়তি টাকা। অ্যাডভান্স ছাড়া কাজে হাত দেব না।’
‘আগেই দেব অর্ধেক,’ বলল লো হুয়াং।
চুপ থাকল প্রেতাত্মা।
নার্ভাস বোধ করছে বিলিয়নেয়ার। আজকাল বেশি সময় কাটাচ্ছে সে সুস্থ মানসিকতার পৃথিবীতে, নিজেকে ধমক দিল। এখন শক্ত হতে হবে তাকে।
‘বেশ, তা-ই হোক,’ বলল ওরে।
শিস বাজাল লো হুয়াং। তার তিন বডিগার্ডের পিছু নিয়ে এল পিশাচের মত শয়তান খুনির চার স্যাঙাৎ। লিটনের প্রধান বডিগার্ড নিচু এক টেবিলে রাখল ব্রিফকেস। খোলা হলো ডালা। ভেতরে কানায় কানায় ভরা বড় নোটের ইউরোর বাণ্ডিল
‘সবাই মরলে পাবে বাকিটা,’ বলল লো হুয়াং লিটন। ‘কাজ কবে শেষ হলে খুশি হও?’ জানতে চাইল ওরে। ‘চার বাঙালি আজই পৌঁছুবে টোকিওতে। শিমেযুর সঙ্গে তাদের দেখা হলেই, একসঙ্গে পুড়িয়ে মেরে ফেলাই ভাল।’