ছাপ্পান্ন
‘আমার রোবট শেষ করবে তোদেরকে,’ বেসুরো কণ্ঠে বলল চিফ ইঞ্জিনিয়ার সাবা সাবেলা। তাকে ছাতে গেঁথে ফেলেছে সোহেল। তবে মুখ বন্ধ করার লোক নয় চিনা প্রকৌশলী। ‘শুনছিস না ওরা আসছে? অপেক্ষা কর্, খুন হবি! মাফ পাবি না ওদের কাছ থেকে!’
সাবেলার গলায় ঝুলন্ত আইডেন্টিফায়ারের ফিতা পাশ থেকে ধরল রানা, পরক্ষণে একটানে খুলে নিল জিনিসটা। সহজ সুরে বলল, ‘আমি ভাবছি, তোমাকে আইডেন্টিফায়ার ছাড়া দেখলে কী ভাববে ওরা।
‘ওটা কী?’ জানতে চাইলেন উবোন হিমুরা।
‘ট্র্যান্সমিটার, এটা থাকলে গুলি করে না রোবট,’ বলল রানা। ‘হুয়াঙের ফ্যাক্টরিতে দেখেছি। খুবই কাজের জিনিস।’
সোহেলের তলা থেকে শরীর মুচড়ে উঠে বসতে চাইল সাবেলা। কাজটা তার পক্ষে অসম্ভব। ‘আইডেন্টিফায়ার মাত্র একজনকে বাঁচাবে।’
‘তার চেয়েও বড় কথা, তোমাকে বাঁচাবে না,’ বলল রানা। সোহেলের দিকে তাকাল। ‘ওঠ তো, সোহেল।’
সোহেল দাঁড়াতে ধড়মড় করে উঠে বসল সাবেলা। খামচি দিয়ে কেড়ে নিতে চাইল ডিভাইসটা রানার হাত থেকে।
কিন্তু হাত পিছিয়ে নিয়েছে রানা। তলোয়ারের ডগা দিয়ে বাধ্য করল লোকটাকে বসে থাকতে। ‘বাড়ির উত্তর দিকে সিঁড়ি আছে। যদি প্রাণপণে দৌড়াতে পারো, রোবট আসার আগেই হয়তো পালাতে পারবে। তোমার বদলে আমি হলে দেরি করতাম না। তুমিই বলেছ, ওরা আসছে।’
প্রচণ্ড ঘৃণা নিয়ে রানাকে দেখল চিনা লোকটা। বুঝে গেছে, একটু পর কপালে কী আছে। উঠে দাঁড়িয়ে দৌড় দিল বাড়ির উত্তরদিকের সিঁড়ি লক্ষ্য করে।
‘বাঁচার সুযোগ দিলি, তবে ব্যাটা ধন্যবাদ দেয়ার লোক নয়,’ বলল সোহেল।
‘বাঁচবে না,’ বলল রানা। ‘ছেড়ে দিয়েছি, যাতে ওদিকে মনোযোগ দেয় ছয়পেয়ে মাকড়সা। চল, ছাতের সামনে নেব ডানা আর প্যারাসেইল। গতি পাওয়ার জন্যে প্রথমে প্রায় খাড়া ডাইভ দিতে হবে।’
প্যারাসেইল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠল ওরা। ছাতের দিকে নিচু রেলিঙে ডানা রেখে পেছনে বিছিয়ে দিল প্যারাশুট। হিমুরাকে ডানায় উঠতে সাহায্য করল ওরা। বসে পড়লেন পুলিশ অফিসার, একহাতে শক্ত করে ধরেছেন ডানার নাইলনের স্ট্র্যাপ। নিজেরা যার যার জায়গায় দাঁড়াল রানা ও সোহেল। টান দিয়ে ওপরে তুলল প্যারাশুট। বাতাস পেতেই ফুলে উঠল কাপড়ের বিশাল দানব।
ক’তলা নিচ থেকে এল দুই পশলা গুলির আওয়াজ। করুণ দীর্ঘ এক আর্তনাদ ছাড়ল কেউ। পরক্ষণে এল আরেক পশলা গুলির আওয়াজ। এরপর নামল নীরবতা।
‘সাবা ব্যাটা নিজে পরখ করে দেখল কেমন কাজ করে ওর রোবট,’ বলল সোহেল।
‘চল, যাই,’ তাড়া দিল রানা। ‘সামনে ঝাঁপ দিবি। ভঙ্গি করবি আমরা শোবোর্ডার।’ বন্ধুর গলায় আইডেন্টিফায়ার ঝুলিয়ে দিল ও। ‘তুই পাইলট। হিমুরা বা আমাকে রোৰ্ট গুলি করলেও বেরিয়ে যাবি প্যারাসেইল চালিয়ে।
হাওয়ায় ভরে যেতেই আকাশে উঠেছে প্যারাশুট। ছাতের রেলিং থেকে ডানা সামনে বাড়াল ওরা। ঝপ্ করে নেমে গেল প্যারাসেইল। বাড়ছে পতনের গতি। পেছনে পড়ল পুরনো বাড়ি। রানার মনে হলো, ওরা তিনটে ঈগল, পাহাড়-চূড়া থেকে ঝাঁপ দিয়েছে শিকার ধরতে। তিনজনের ওজনে বাড়ছে এগোবার বেগ। বাতাসে ভেসে উড়ে চলল অযান্ত্রিক উড়োজাহাজ।
পেছনে পড়ল হেলিপ্যাড। সত্তর ফুট ওপর দিয়ে ঝড়ের বেগে বাঁধের দিকে চলেছে ওরা। একটু দূরে দেখল সাগরের ঢেউয়ের সাদা ফেনা।
গুলি এল না ওদের দিকে। হাওয়ার শোঁ-শোঁ আওয়াজ ছাড়া আর কিছু নেই।
সমুদ্র-প্রাচীরের বিশ ফুট ওপর দিয়ে সাগরের আকাশে বেরোল ওরা। মন দিল গতি কমিয়ে উচ্চতা বাড়াতে। কিন্তু গ্লাইডারের মত বাতাস পেল না ডানা ও প্যারাসেইল। একটু একটু করে নেমে যেতে লাগল সাগরের দিকে।
‘যে-কোনও সময়ে সাগরে পড়ব,’ সতর্ক করল রানা।
‘পাইলটের দোষ নেই,’ জানাল সোহেল। ‘কপাল ভাল হলে আমাদের দেখে এগিয়ে আসবে হিনা।’
হাওয়ায় চেপে ছুটে চলেছে ডানা ও প্যারাসেইল। ক্রমেই নেমে চলেছে সাগরের দিকে। একটু পর পায়ের কাছে উঠে এল ঢেউয়ের সাদা ফেনা। প্যারাশুট টেনে ওপরে তুলল ওরা। যতটা পারা যায় এগোতে চায়।
‘সাগরে নামতে তৈরি হোন!’ হিমুরাকে বলল সোহেল।
পরের ঢেউ পেরিয়ে ঝপাস করে নামল প্যারাসেইল সাগরে। ঝটকা খেয়ে পানিতে পড়ল রানা। তলিয়ে গেল ওরা। ঠোঁটে লবণাক্ত পানি। ক’সেকেণ্ড পর ভেসে উঠে দেখল রানা ঢেউয়ে বিছিয়ে আছে প্যারাশুট। ওটার তলা থেকে উঁকি দিচ্ছে সোহেল। দড়িদড়া সরিয়ে বেরিয়ে এল। ওর পাশেই সাঁতার কাটছেন হিমুরা। ক্ষতে লবণ লাগছে বলে ব্যথায় ভীষণ কুঁচকে ফেলেছেন মুখ।
ভাসছে ফাঁপা ডানা। ওটার কিনারা ধরে ভেসে থাকল ওরা।
‘বোট দেখেছিস?’ জানতে চাইল সোহেল।
‘না, তবে ইঞ্জিনের আওয়াজ শুনেছি,’ বলল রানা।
এবার বোটের ইঞ্জিনের গর্জন শুনল সোহেল ও হিমুরা। তীব্র বেগে আসছে ওটা। একটু পর কালো সাগর থেকে আলাদা করা গেল বো-র সাদা ফেনা। ডেকে জ্বলে উঠল মৃদু আলো। গতি কমিয়ে রানাদের পাশে থামল বোট। হুইল থেকে বলল হিনা, ‘বৃষ্টির ভেতর ভিজছে একটা লক্ষ্মী মেয়ে, আর এতক্ষণে সময় হলো আপনাদের আসার?’
বোটে উঠে হিনার মাথায় হাত রাখল রানা। ‘সত্যিই লক্ষ্মী মেয়ে তুমি। আমরা দুঃখিত।’
‘বাদ দেন ওসব, জলদি তোলেন সবাইকে। এখনই গুলি করবে ওরা!’
হিমুরাকে বোটে উঠতে সাহায্য করল রানা। সবার শেষে ডেকে উঠল সোহেল। বোট রওনা হওয়ার আগেই বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠল চারপাশের সাগর। দ্বীপের বাঁধ থেকে আসছে রাইফেলের অসংখ্য গুলি, খলবল করছে পানিতে পড়ে।
ডেকে শুয়ে পড়ল রানা, সোহেল ও হিমুরা। রানা চড়া গলায় বলল, ‘হিনা, বাতি! নাগাসাকির দিকে!’
থ্রটল ঠেলে হুইল ঘুরিয়ে নিল হিনা। আগেই নিভিয়ে দিয়েছে বাতি। লাফ দিয়ে ছুট লাগাল বোট। তবে পেছন থেকে আসছেই রাশি রাশি গুলি।
বাহু ছুঁয়ে গেছে একটা বুলেট, টের পেল রানা। ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল উইণ্ডশিল্ডের কাঁচ। বিস্ফোরিত হলো মেরিন রেডিয়ো। ট্র্যানসম ও বোটের পেছনে বিঁধল অন্তত এক ডযন বুলেট। তারপর রেঞ্জের বাইরে চলে গেল ওরা।
থ্রটল খুলে রেখেছে হিনা।
‘সবাই ঠিক তো?’ জানতে চাইল রানা।
মাথা দোলালেন উবোন হিমুরা। সোহেলের ঊরুর ত্বক চেঁছে গেছে বুলেট। ফাইবারগ্লাসের কুচিতে ভরে গেছে হিনার চুল।
তীর বেগে চলেছে বোট। অনেকটা পেছনে পড়েছে লো হুয়াং লিটনের লোক, রোবট ও দ্বীপ। কিন্তু রানাদের বোটের ইঞ্জিন হাউসিং থেকে বেরোচ্ছে কালো ধোঁয়া। দেড় মাইল যাওয়ার পর কাউলিং থেকে দাউ-দাউ করে বেরোল লালচে শিখা।
‘ইঞ্জিন অফ করো,’ বলল সোহেল। হুইলের পাশ থেকে নিল এক্সটিংগুইশার।
বোটের ইঞ্জিন বন্ধ করল হিনা। ভাসতে ভাসতে চলেছে ওরা। ক্রমেই কমে আসছে গতি।
ইঞ্জিনের কাউলিং খুলে ফায়ার এক্সটিংগুইশার ব্যবহার করে আগুন নেভাল সোহেল। যন্ত্রপাতি দেখে মাথা নাড়ল। ‘আপাতত মেরামত হবে না।’
‘এবার?’ জানতে চাইল হিনা।
মূল ভূখণ্ডের দিকে তাকাল রানা। ফর্সা হয়ে উঠেছে নাগাসাকির পুবাকাশ। একটু পর উঠবে সূর্য। ‘তোমরা দু’জন বোটে থাকবে,’ হিমুরা ও হিনার উদ্দেশে বলল ও। ‘পাশ দিয়ে জাহাজ গেলে উঠে পড়বে। এদিকে সাঁতরে তীরে যাব সোহেল আর আমি।’
‘এখান থেকে পুরো একমাইল দূরে তীর,’ আপত্তির সুরে বলল হিনা।
‘কমপক্ষে,’ বলল রানা।
‘আশা করি জোয়ারের সাহায্য পাব,’ বলল সোহেল।
বোট থেমে যেতেই সাগরে নামল দুই বন্ধু।