মহাপ্লাবন – ৫৪

চুয়ান্ন

রেডিয়ো রুম থেকে বিমর্ষ মনে বেরোতে যাচ্ছে সাবা সাবেলা, এমনসময় ইন্টারকমে শুনল ঘোষণা। সঙ্গে সঙ্গে দেরি না করে যোগাযোগ করল সে, ‘ওরা কোথায়?’

‘প্রধান সুড়ঙ্গে। অ্যাসেম্বলি রুমের বাইরে। হাতে অস্ত্র, স্যর! ধরে নিয়ে যাচ্ছে এক টেকনিশিয়ানকে!’

সাবেলার পাশে দাঁড়িয়ে আছে চিচিওয়া। কড়া সুরে বলল, ‘অ্যালার্ম বাজিয়ে দিন।’

‘এটা কি মিলিটারি বেস পেয়েছেন?’ বিরক্ত হয়ে বলল সাবেলা। ‘আমাদের কোনও অ্যালার্ম নেই।’

চোখে আগুন নিয়ে তাকে দেখল প্রেতাত্মা। আরও কিছু বলতে গিয়েও চুপ মেরে গেল চিফ ইঞ্জিনিয়ার। ইন্টারকমের প্যানেলে টিপল অন্য বাটন। যোগাযোগ করছে কন্ট্রোল রুমে। ‘অ্যাই, আমি সাবা সাবেলা! পালিয়ে গেছে বন্দিরা। ধরে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের এক টেকনিশিয়ানকে। লোক জড় করে ধরো ওদেরকে!’

ওদিক থেকে সাড়া নেই। তবে কয়েক সেকেণ্ড পর বলল একজন, ‘দ্বীপের বাইরের দিকে আমাদের লোক পাহারা দিচ্ছে।’

‘ডেকে আনো।’

‘তাতে লাভ হবে না। লোকগুলো প্রধান সুড়ঙ্গে থাকলে এতক্ষণে কমপ্লেক্স থেকে বেরিয়ে গেছে।’

‘আগেই হুয়াংকে বলেছি, এরা শেষ করবে আমাদেরকে,’ আফসোস করল ওরে চিচিওয়া।

‘আপনি খামোকা ঘাবড়ে যাচ্ছেন,’ বলল সাবেলা। ‘খনি থেকে বেরোলেও দ্বীপ থেকে বেরোবার উপায় নেই। হেলিকপ্টার চলে গেছে। কোনও বোটও নেই। কী করবে তারা? সাঁতরে যাবে?’

রক্তচক্ষু করে তাকে দেখল ওরে। ‘ঠিক তাই করবে ওরা। নুমার লোক। পরনে ছিল ওয়েট সুট। সাধে তো আর সঙ্গে করে ফিন আর মুখোশ আনেনি।’

‘সাঁতরে যাওয়া অসম্ভব,’ তর্ক জুড়ল সাবেলা। ‘ থেকে মূল ভূখণ্ড পুরো তিন মাইল দূরে। সাগরে নামলে জোর স্রোত নিয়ে ফেলবে বিশ মাইল দূরে। লাশ পাব পরে।’

‘পুলিশ অফিসারের কথা জানি না, তবে অন্য দু’জন নুমার লোক, তার ওপর ওরা বাঙালি। ওই দেশে একটু পর পর বিশাল সব নদী। মায়ের পেট থেকে পড়েই সাঁতার শেখে ওরা। যদি ভাবেন জাপানের মূল ভূখণ্ডে গিয়ে উঠতে পারবে না, তো আপনি আছেন বোকার স্বর্গে। একঘণ্টার বেশি লাগবে না তীরে উঠতে। তা ছাড়া, হয়তো সাগরে রেখে এসেছে বোট। ওখানে লোক আছে তাদের।’

বিপদ কত বড়, ভাবতে গিয়ে সত্যিই ঘামতে লাগল সাবা সাবেলা। হুয়াঙের কথা মেনে দ্বীপে বোট রাখা হয়নি। কিন্তু একবার মাসুদ রানা, সোহেল আহমেদ আর উবোন হিমুরা দ্বীপ থেকে সাগরে নামলে কে ঠেকাবে তাদেরকে? আবারও ইন্টারকমের বাটন টিপল সে। ‘কন্ট্রোল রুম, তোমাদের সঙ্গে ক’জন আছে?’

‘দলে সিকিউরিটির দশজন, এ ছাড়া আছেন আপনি আর টেকনিশিয়ানরা।’

এত কম লোকে কিছুই হবে না।

‘চালু করো ওঅর-বট,’ জানাল সাবেলা, ‘ওগুলোকে রাখবে সার্চ অ্যাণ্ড ডেস্ট্রয় মোডে।’

‘কিন্তু বাইরে আমাদের লোক আছে,’ আপত্তির সুরে বলল ইনচার্জ।

‘হাতে সময় নেই যে নতুন করে ওঅর-বট রিপ্রোগ্রামিং করব,’ বলল চিফ ইঞ্জিনিয়ার, ‘বাইরে যারা আছে, বলো দেয়ালের কাছে যেন থাকে। পাহারা দিক সিঁড়ি। আটকে দেবে সাগরে যাওয়ার পথ। এদিকে ওঅর-বট ছড়িয়ে দিয়ে পলাতকদেরকে ধাওয়া দেব আমরা। তাড়া খেয়ে আমাদের

চর হাতে ধরা পড়বে তারা। সাগরে কাউকে দেখলে দেরি না করে গুলি করবে। এবার ধরতে হবে না কাউকে।’

‘জী, স্যর।’

শিরার মাঝে অ্যাড্রেনালিন টগবগ করছে সাবেলার।

নতুন চোখে তাকে দেখছে চিচিওয়া। আগে ভাবেনি, এ লোকের মেরুদণ্ড আছে।

‘জানতাম না যে আপনার ভেতর এই জিনিস আছে।’

‘কী জিনিস?’

‘এত সাহস! বুঝিনি এত ঠাণ্ডা মাথায় খুন করতে বলতে পারবেন।’

‘হয় ওরা মরবে, নইলে আমরা,’ বলল সাবেলা। ‘এর এদিক-ওদিক হওয়ার উপায় নেই। পলাতকরা জাপানের মূল ভূখণ্ডে পৌঁছুলে এ দ্বীপ হবে আমাদের জন্যে বন্দিশালা।’

.

সুড়ঙ্গ থেকে ছুটে বেরিয়ে এল রানা, সোহেল ও হিমুরা। রাতের আকাশ ভেঙে ঝরছে বৃষ্টি। পরিবেশ বেশ শীতল। পাহাড়ের গায়ে থোকা থোকা ধূসর কুয়াশার ফুল।

নিশ্চয়ই এবার খুন করতে পিছু নেবে হুয়াঙের লোক। সুড়ঙ্গ-মুখ থেকে এক শ’ গজ দূরের প্রথম বাড়িটাতে ঢুকল ওরা। অন্ধকারে বসল মেঝেতে। টেকনিশিয়ানের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া রেডিয়ো চালু করতেই শুনল বিপক্ষ দলের কথাবার্তা।

রানার দিকে তাকালেন হিমুরা। ‘সব বুঝতে পারছি না। চিনা ভাষা।’

‘বলছে, যাতে তাদের লোক সাগরের তীরে বাঁধের কাছে থাকে,’ বলল রানা। ‘এদিক থেকে তাড়া করবে ওঅর-বট বোধহয় সশস্ত্র রোবট।’

প্রায় ধসে পড়া বাড়ি থেকে সুড়ঙ্গের দিকে চেয়ে রইল ওরা। সবার আগে প্রথমে দেখল রানা, সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে এল লন মোয়ার আকৃতির এক মেশিন। ছয়টা পা ওটার। প্রকাণ্ড মাকড়সার মত। মাথায় এলইডি বাতি। ওটা যেন ভয়ঙ্কর দানবের চোখ। এ বাড়িটার দিকে ঘুরল ওঅর-বট।

‘আড়ালে থাকুন,’ হিমুরাকে বলল রানা।

কংক্রিটের দেয়ালের ওদিকে সরে বসল ওরা। সাবধানে পিলারের পাশ থেকে উঁকি দিল রানা। রীতিমত মার্চ করতে করতে উল্টো দিকে রওনা হয়েছে কুৎসিত মেশিনটা।

‘যাচ্ছে কোথায়?’ জানতে চাইলেন হিমুরা।

‘ডকের দিকে,’ বলল রানা। ‘যাতে ওদিক দিয়ে সাগরে নেমে যেতে না পারি।’

‘ওটা কি যান্ত্ৰিক মাকড়সা?’ জানতে চাইল সোহেল।

‘লো হুয়াং লিটন বলেছিল ওই জিনিস ওঅর-বট,’ বলল রানা। ‘ফ্যাক্টরির ভেতরে দেখিয়ে দিয়েছে কীভাবে লড়াই করে।’ সোহেলের হাতের পিস্তল আর নিজের তলোয়ার দেখাল ও। ‘এসব দিয়ে সুবিধে হবে না।’

সুড়ঙ্গ থেকে বেরোল আরও দুটো মাকড়সা-মেশিন। আলাদা দুটো পথে গেল ওগুলো। ‘ছড়িয়ে পড়ছে,’ বলল রানা। ‘কতগুলো আছে জানি না, তবে একটা না একটা এদিকে আসবে।’

‘তা হলে সাগরতীরে যাওয়া কঠিন হবে,’ বলল সোহেল, ‘দ্বীপ থেকে নেমে যাওয়ার মত পথ মানেই হয় সিঁড়ি, নইলে ডক।’

‘ধরে নিন ওদিকটা পাহারা দিচ্ছে,’ বললেন হিমুরা।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল সোহেল। ‘শেষ উপায় বোধহয় ওই উঁচু দেয়াল থেকে সাগরে ঝাঁপ দেয়া।’

‘পঞ্চাশ ফুট ওপর থেকে পড়ব বিক্ষুব্ধ সাগরে,’ মাথা নাড়ল রানা। ‘কিন্তু ওখানে আছে বড় বড় পাথরখণ্ড আর কংক্রিটের পাইলিং। ভুল ঢেউয়ে ঝাঁপ দিলে সঙ্গে সঙ্গে মরব। তা ছাড়া, বেঁচে গেলেও বড় ঢেউ আছড়ে ফেলবে পেছনের দেয়ালের ওপর।’

‘বেশ ক’বছর আগে এখানে ট্রায়াথলন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলাম,’ বললেন হিমুরা। ‘সাগরে ওখানে আছে চোরাস্রোত। এই হাত নিয়ে সাঁতরাতে পারব না। আমাকে বরং রেখে যান। মেশিনগুলোকে নেব ভুল দিকে। সেই সুযোগে দ্বীপ থেকে বেরিয়ে যাবেন আপনারা।’

মাথা নাড়ল রানা। ‘আপনাকে ফেলে যাওয়ার জন্যে এখানে আসিনি। তা ছাড়া, সাঁতার কাটতে না পারলে উড়ে যাব।’

.

মাসুদ রানা, সোহেল আহমেদ ও উবোন হিমুরা খনি থেকে বেরিয়ে গেছে নিশ্চিত হয়ে নিরাপদ রেকর্ডিং রুম থেকে বেরোল চিফ ইঞ্জিনিয়ার সাবা সাবেলা। চলেছে কন্ট্রোল রুম লক্ষ্য করে। পাশেই ওরে চিচিওয়া। পাশের দেয়ালে তলোয়ার দিয়ে বিশ্রী আওয়াজ করে, হাড় জ্বালিয়ে মেজাজ বিগড়ে দিচ্ছে লোকটা। কপাল ভাল, ওই তলোয়ার হঞ্জো মাসামিউনে নয়। মিউরামাসার তলোয়ারের ডগা থেকে বারবার ছিটকে উঠছে কমলা ফুলকি।

‘বিশ্রী আওয়াজটা বন্ধ করবেন?’

কথা পাত্তা দিল না চিচিওয়া। কন্ট্রোল রুমে যাওয়ার পুরো পথ তলোয়ার ঘষল দেয়ালে। যেন শান দিচ্ছে ফলা।

সাবা সাবেলা ও ওরে চিচিওয়া ঘরে ঢুকতেই চমকে ওদের দিকে তাকাল গার্ডদের নিয়ন্ত্রক।

‘বুঝলে ওরা কোথায়?’ জিজ্ঞেস করল সাবেলা।

‘এখনও না।’

কাছের কন্সোলের সামনে থামল সাবেলা। নানান এলাকায় ষোলোটা ওঅর-বটের ক্যামেরা থেকে আসছে ষোলোটা স্ক্রিনে ভিডিয়ো। ওই ষোলো ওঅর-বটের পেছনে চলেছে আরও ষোলোটা। একটা বাড়ির ছাতে বসানো ক্যামেরার মাধ্যমে দেখা গেল, খনি থেকে বেরিয়ে গোটা দ্বীপে ছড়িয়ে পড়ছে বত্রিশটা ওঅর-বট।

সাবেলার পাশে থেমে ওই দৃশ্য দেখল ওরে। ‘আপনি তো দ্বীপের পশ্চিম দিক খালি করে রেখেছেন।’

কথা ঠিক।

সহজ সুরে বলল সাবেলা, ‘ওদিকের খাড়া পাহাড় বেয়ে সাগরে নামতে পারবে না কেউ। তা ছাড়া, মূল ভূখণ্ডে যেতে চাইলে যাবে পুবে। নইলে চোরাস্রোত টেনে নেবে মাঝ সাগরে।’

‘আপনি এখনও বুঝতে পারছেন না, ওরা কত ভয়ঙ্কর লোক,’ বলল ওরে।

‘জানি ওরা ট্রেইণ্ড ডাইভার, তবে এত বোকা নয় যে জেনেবুঝে আত্মহত্যা করবে,’ বলল সাবেলা। ‘ওরা যদি সাগরে নামতেও পারে, ওপর থেকে গুলি খেয়ে মরবে। যেতে হলে তারা যাবে পুব দিকে।’

তর্কে গেল না ওরে চিচিওয়া।

নতুন নির্দেশ দিল চিফ ইঞ্জিনিয়ার, ‘সাগর-তীরে পাঠাও কয়েকটা ওঅর-বট। তীর পাহারা দেবে। লোকগুলোকে দেখামাত্র যেন গুলি করে।’

দ্বিধায় পড়ল কন্ট্রোলার। ‘যত ছড়িয়ে দেয়া হবে জাল, ফাঁক তৈরি করে বেরোবার সম্ভাবনা তত বাড়বে।’

‘প্রতিটি ওঅর-বটের আছে ওয়াইড-ফিল্ড ইনফ্রারেড সেন্সর,’ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল সাবেলা। ‘সাধারণ এক শত সৈনিক যে এলাকা কাভার করবে, সেটা করবে দশটা ওঅর- বট।’

‘কিন্তু লোকগুলো কোনও বাড়িতে লুকিয়ে থাকলে?’

‘তা হলে সরাসরি আমাদের পাতা ফাঁদে পড়বে তারা। আগামী কয়েক ঘণ্টার মধ্যে শেষ হয়ে যাবে নাগাসাকির অপারেশন। খুন হবে প্রধানমন্ত্রী আর কেবিনেট মন্ত্রী। সবাই দেখবে হত্যার পেছনে মাসুদ রানা, সোহেল আহমেদ আর উবোন হিমুরা। পুলিশ থেকে শুরু করে সেনাবাহিনীর হাজার হাজার লোক পাগল হয়ে উঠবে তাদেরকে গ্রেফতার করতে। কোথাও পালাতে পারবে না তারা।’

.

পরবর্তী বাড়ির কোণে পৌছে উঁকি দিল রানা। সরু সব গলির চৌমাথায় পাহারা দিচ্ছে ওঅর-বট। অন্যগুলো চলেছে আরও দূরের টার্গেটে।

বাড়ির আরেক কোনা থেকে রানার কাছে ফিরল সোহেল। ‘বাড়ির ওদিকে আরেকটা।’

‘এদিকে আসছে?’

মাথা নাড়ল সোহেল। ‘চৌমাথা পাহারা দিচ্ছে।’

‘এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে, নিয়েছে,’ বললেন হিমুরা। ‘পালিয়ে যাওয়ার পথ রাখছে না। এরপর শুরু করবে সার্চ। ফাঁদে পড়ে গেছি আমরা।’

হুয়াঙের কথা মনে পড়ল রানার। একসময় পুলিশের কাজ করবে এসব মেশিন। ‘চারপাশের কয়েক ব্লক কাভার করছে,‘ বলল ও। ‘ওঅর-বট এড়াতে পারলেও সাগর-তীরে থাকবে হুয়াঙের সশস্ত্র লোক।’

দ্বীপের কোথায় আছে ওরা, মনের চোখে দেখল রানা। ক’মুহূর্ত পর বলল, ‘সিঁড়ি খুঁজে ওপরে উঠতে হবে।’

‘তারপর?’ জানতে চাইল সোহেল।

‘আমার ভুল না হলে, এ বাড়ির ছাত থেকে সরু একটা বিম গেছে পাশের বাড়ির ছাতে। সেতু নয়, তবে সতর্ক থাকলে পেরোতে পারব ওটা।’

‘তাতে এড়াতে পারব এসব ওঅর-বট,’ বলল সোহেল, ‘কিন্তু তারপর?’

‘এরপর খাটাতে হবে নতুন কৌশল,’ বলল রানা।

গম্ভীর হয়ে গেল সোহেল। ‘যা ভাবছি, তুই সেটা ভেবে থাকলে, ভাল হতো তুই না ভাবলেই।’

‘এ ছাড়া উপায় নেই,’ বলল রানা।

‘আপনারা গোয়েন্দা বইয়ের লেখকদের মত সূত্র গোপন করছেন,’ বললেন হিমুরা, ‘আসলে কী করতে চান?’

‘ওঅর-বটগুলোকে লোভ দেখিয়ে সরাতে হবে,’ বলল রানা। ‘যে ক’টাকে পারা যায়।

‘আর তারপর?’

‘এ বাড়ির ছাতে উঠবেন আপনারা। এদিকে আমি চারপাশে জড় করব ওঅর-বট। পরে ছাতের বিমে উঠে যাব পাশের বাড়ির ছাতে। চাইলেও পিছু নিতে পারবে না।’

‘এসব মেশিন পিছু নিলে?’ জানতে চাইলেন হিমুরা।

‘মনে হয় না পারবে,’ বলল রানা, ‘হুয়াঙের গাড়ির রোবট শুধু চিনত পরিচিত পথ। যখন মাঝের মাঠ পেরোলাম, তখনও ওটা গেছে ট্র্যাক ধরে। ওঅর-বটকে ওই ধরনের প্রোগ্রামিং দিলে, প্রায় ভাঙা বিমে উঠে পিছু নেবে না।’

মৃদু মাথা দোলালেন পুলিশ অফিসার। ‘তার মানে, ওরা যখন আবারও নেমে পিছু নেবে, ততক্ষণে আমরা পেরিয়ে গেছি বেশ কয়েকটা বাড়ি?’

‘মন্দ নয় প্ল্যান,’ বলল সোহেল। ‘তো এবার আকর্ষণ করতে হবে ওগুলোর মনোযোগ।’

‘তোরা সিঁড়ি বেয়ে উঠবি, আমি জানিয়ে দেব আমরা এখন এখানে,’ বলল রানা।

‘ঝুঁকিটা বরং আমিই নিই, বলল সোহেল। ‘তুই ছাতে ওঠ।

মাথা নাড়ল রানা। ‘না। তুই থাকবি অফিসার হিমুরার পাশে। পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবি তাঁকে।’

রানা গম্ভীর দেখে তর্ক করল না সোহেল।

উবোন হিমুরা ও সোহেল সিঁড়ি খুঁজে উঠতে শুরু করার পর সতর্ক পায়ে বাড়ির সামনের দিকে এল রানা। দু’দিকের কোণে ছয়টা করে পা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দুই ওঅর-বট। বামেরটা কাছে। প্রতিটা বটের আছে শক্তিশালী ক্যামেরা। ভালভাবেই দেখবে। বাড়ি থেকে এক পা বেড়ে থমকে গেল রানা। যে-কেউ ভাববে, ওঅরবট দেখে ভীষণ ভয় পেয়েছে। ওর দিকে ঘুরে গেল দুই মাকড়সা-রোবট।

বুকে লাল লেয়ারের বিন্দু তাক হতেই ঝাঁপ দিয়ে বাড়িতে ঢুকল রানা। খ্যাট-খ্যাট আওয়াজে গর্জে উঠেছে আগ্নেয়াস্ত্র। মেঝেতে পড়ে আছে রানা। মাথার ওপর দিয়ে গেল অন্তত দশটা গুলি।

দ্রুত ক্রল করে বাড়ির সিঁড়ি লক্ষ্য করে চলল রানা। বুঝে গেছে পিছু নেবে মেশিনগুলো। পেছনে আবারও গর্জে উঠেছে __। ওপরের দেয়ালে লাগল গুলি।

দেখে ফেলেছিস?’ বিড়বিড় করল রানা, ‘তো এবার ধর্ তো দেখি!’

টাইটেনিয়ামের পা ফেলে কংক্রিটের মেঝেতে খট-খট শব্দে আসছে ওগুলো। উঠেই দুই লাফে সিঁড়ির সামনে পৌঁছুল রানা। ঝড়ের বেগে উঠে এল দোতলায়। ততক্ষণে বাড়িতে ঢুকেছে ওঅর-বট। মাথা এদিক ওদিক ঘুরিয়ে স্ক্যান করছে একতলা।

ধুপ-ধাপ শব্দে আরও চারতলা উঠে গতি কমাল রানা। দু’দিকের খালি ঘরে জানালার কোনও চৌকাঠ নেই। সামনের ঘরের হাঁ করা চৌকো গর্ত দিয়ে নিচে দেখল রানা। নানাদিক থেকে এই বাড়ির দিকে আসছে ওঅর-বট

ওর প্ল্যানে কাজ হলেও বেড়েছে বিপদের মাত্রা। যা ভেবেছে, তার চেয়ে ওঅর-বটের গতি অনেক বেশি। উঠে আসছে খট-খট শব্দ তুলে। মাত্র দুইতলা নিচেই প্রথমটা।

পরের কয়েকতলা রকেট বেগে উঠল রানা। আশপাশে দরজা নেই যে আটকে দেবে। বাধা দেয়ারও উপায় নেই। ঠেকাতে পারবে না মেশিনের গতি। তা ছাড়া, নিজেই সিমুলেশনের সময় ফ্যাক্টরিতে দেখেছে, সব দরজা ভেঙে ঢুকেছিল ওই জিনিস।

অষ্টমতলায় উঠে সোহেল আর হিমুরার তৈরি আওয়াজ শুনল রানা। কী যেন ভাঙতে চাইছে তারা। ‘কী করিস্, সোহেল?’ জানতে চাইল ও।

‘তোর প্রথম ভুল শুধরে নিতে চাইছি,’ বলল সোহেল। ‘ছাতে ওঠার দরজায় বিশাল তালা। দরজা ভাঙার চেষ্টা করছি।’

‘একটা ভুল কিছুই না,’ আত্মসমর্থন করল রানা। পরক্ষণে জানাল, ‘আরও ভুল হয়েছে। অন্যগুলোর জন্যে থামছে না প্রথম ওঅর-বট। উঠে আসছে সাক্ষাৎ ইবলিশের মত।’

‘গতি কমিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা কর,’ বলল সোহেল।

‘কাজটা অত সহজ না,’ বলল রানা। ‘খারাপই লাগছে, সে আমলে তলোয়ারের বদলে রকেট লঞ্চার তৈরি করেননি মাসামিউনে!’

‘অন্য উপায় বা পথ খুঁজব?’ ওপর থেকে জানতে চাইল সোহেল।

প্রায় অন্ধকারে চারপাশে চোখ বোলাল রানা। ওর মনে হলো কাজে লাগতে পারে একটা জিনিস। পাল্টা চেঁচাল ও, ‘না, নিজেদের কাজ চালিয়ে যা!’

‘তুই কী করবি?’

‘জরুরি কাজে নিয়োজিত।’

‘ঢাকার মিউসিপ্যালিটি কর্পোরেশনের ময়লার গাড়ির মত হাল তোর?’

জবাব দিল না রানা।

দরজা ভাঙতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে সোহেল ও হিমুরা।

সিঁড়ির ল্যাণ্ডিঙে প্রায় ভাঙা রেলিঙে সাঁই করে হঞ্জো মাসামিউনে চালাল রানা। কয়েকবার তলোয়ার চালাবার পর কাটা পড়ল নিচের জং ধরা কয়েকটা লোহার রড। ঝুলছে সিমেন্টের বড়সড়ো পিণ্ড। ওটাকে সিঁড়ির মুখে রাখল রানা। কাজ শেষে উঠে এল ওপরতলায়। এদিক ওদিক তাকাল। একটু দূরে দেয়ালের বড় এক অংশ ধসে পড়ে তৈরি করেছে স্তূপ। মেঝে থেকে মাঝারি কংক্রিটের খণ্ড তুলতে চাইল ও। কিন্তু অনেক বেশি ওজন। এবার নিচু হয়ে দু’পায়ে ওটাকে ঠেলে নিল সিঁড়ির দিকে। মেঝেতে বিশ্রী আওয়াজ তুলছে কংক্রিট। কয়েক মুহূর্ত পর ওটা রাখল ভাঙা রেলিঙের পাশে। হাঁপিয়ে গেছে। অপেক্ষা করছে ধৈর্যের সঙ্গে।

মাত্র দোতলা নিচেই ওঅর-বট। স্ক্যান করছে, তারপর উঠে আসছে একতলা করে। হিট সিগনেচার পেলেই শুরু হবে গুলি।

আরেকতলা ওঠ, দুষ্ট মাকড়সা, বিড়বিড় করল রানা। ক’মুহূর্ত পর সিঁড়ির বাঁক ঘুরে দশ ফুট নিচে পৌঁছে গেল ওঅর-বট। এজন্যেই অপেক্ষা করছিল রানা, দু’হাতের সমস্ত শক্তি ব্যয় করে দু’ শ’ পাউণ্ডের কংক্রিটের পিণ্ড ফেলল সরাসরি ওঅর-বটের ওপর। যন্ত্রটা চাপা পড়ল কংক্রিটের চাকার নিচে। খটাং আওয়াজ শুনে মনে হলো ভেঙে গেছে কয়েকটা পা। রুটির মত চ্যাপ্টা হয়েছে যন্ত্রটা।

ছয় পা ছয় দিকে ছড়িয়ে আছে। মুহূর্তের জন্যে রানার মনে হলো বারোটা বেজে গেছে ওটার। কিন্তু তিন সেকেণ্ড পর নড়ল মেশিন, অবিশ্বাস্য শক্তি ব্যয় করে ঝেড়ে ফেলল পিঠ থেকে কংক্রিটের পিণ্ড। আবার উঠে দাঁড়াল ছয় পায়ে ভর করে।

‘চেপ্টে গেলেও এত সহজ প্রাণী না তেলাপোকা,’ বিড়বিড় করল রানা।

ওপরে মাথা তাক করল ওঅর-বট। রানাকে দেখেই তাক করল টার্গেটিং লেযার। পরক্ষণে পাঠাল গুলি।

ডাইভ দিয়ে দূরে গিয়ে পড়েছে রানা। গুলি খেয়ে মরতে হলো না ওকে। নিচ থেকে এল বিকট বিস্ফোরণের আওয়াজ। থরথর করে কেঁপে উঠল গোটা সিঁড়ি।

এগিয়ে রেলিঙের পাশ থেকে উঁকি দিল রানা। গুলি ছুঁড়তেই ফেটে গেছে ওঅর-বটের অস্ত্রের ব্যারেল। ওপর থেকে পড়া ভারী কংক্রিটের স্ল্যাবের চাপে বাঁকা হয়ে গিয়েছিল ওটা। ফলাফল ওই বিস্ফোরণ।

মেশিনটা পুরো ধ্বংস হয়নি, তবে গুলি করতে পারবে না। দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল রানা। ওপরতলায় পৌঁছে দেখল দরজা খুলেছে সোহেল ও হিমুরা। বৃষ্টির মাঝে ছাতে উঠে পেছনে দরজাটা আটকে দিল রানা। ছাতের কিনারায় পৌঁছে পাশের বাড়ির দিকে চেয়ে আছে সোহেল ও হিমুরা। চেহারা দেখে মনে হলো খুব নাখোশ।

‘বুঝলি, রানা, ইন্তেকাল করেছে ওই বিম,’ শুকনো গলায় বলল সোহেল।

‘থাকার তো কথা, বলল রানা।

আঙুল তাক করে দেখাল সোহেল। ছাতের এদিকে বিমের ভাঙা অংশ রয়েছে মাত্র ছয় ইঞ্চি। ইতিহাসবেত্তার ভঙ্গিতে বলল ও, ‘আজ থেকে বহুকাল আগে এখানেই ছিল সেই বিম, সময়টা ছিল বাদশা আকবরের আমল।’

মাথা নেড়ে বিড়বিড় করল রানা, ‘পুরনো ছবি কখনও বিশ্বাস করতে নেই! ‘

ছাতের কিনারা থেকে নিচে তাকাল ও। নানাদিক থেকে এ বাড়ির দিকে আসছে অন্তত এক ডযন ওঅর-বট! অন্যগুলো বোধহয় ঢুকে পড়েছে বাড়ির ভেতর।

‘তোর প্ল্যানের আর সব ঠিক,’ ঢোক গিলল সোহেল, ‘আসছে লড়াকু মেশিন।’

‘এবার?’ রানার দিকে ফিরলেন হিমুরা।

পাশের বাড়ি দেখল রানা। মাঝের ব্যবধান মাত্র ছয় ফুট। আধতলা নিচে ওদিকের বাড়ির ছাত। তলোয়ার তাক করে পাশের বাড়ি দেখাল ও। ‘একমাত্র উপায় লাফিয়ে পেরিয়ে যাওয়া।’

পরস্পরকে দেখল ওরা তিনজন, তারপর পিছিয়ে গেল কয়েক ফুট। দৌড়ে গিয়ে পেরোতে হবে মাঝের দূরত্ব। বহু নিচে কংক্রিটের চাতাল বুকে নিয়ে হাঁ করে আছে কালো অন্ধকার।

.

‘বিকল হয়েছে নয় নম্বর ওঅর-বট,’ জানাল কন্ট্রোলার।

ফাঁকা স্ক্রিনের দিকে তাকাল সাবেলা। ‘কী হয়েছে?’

‘বুঝলেন না?’ খেঁকিয়ে উঠল চিচিওয়া। ‘বিস্ফোরিত হয়েছে ওটার রাইফেলের ব্যারেল। কংক্রিটের চাকা পড়ে বাঁকা হয়েছিল। মানুষ হলে আপনার পোকা ভুলেও গুলি ছুঁড়ত না। আবার আপনারা বলেন এসব রোবট নিখুঁত!’

‘অন্যগুলো খতম করবে ওদেরকে,’ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল সাবেলা। ‘ওই ছাত থেকে কোথাও যাওয়ার উপায় নেই।’

অন্যান্য ভিডিয়ো ফিডের দিকে তাকাল সে। ক্ষতিকর ওঅর-বট পাশ কাটিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠছে অন্যগুলো। একটু পর পৌঁছুবে গন্তব্যে। মাত্র বিশ সেকেণ্ড পর দরজা বিধ্বস্ত করে ছাতে উঠে গেল ওগুলো।

আধমিনিট পর বলল কন্ট্রোলার, ‘আশপাশে কোনও টার্গেট নেই।’

‘অন্যতলায় নেই তো?’ বলল সাবেলা, ‘হয়তো গোপনে নেমে গেছে?’

ডেটা স্ক্রিন দেখল কন্ট্রোলার। ‘ওই বাড়ির প্রতি তলায় আছে আমাদের ওঅর-বট। কোথাও থার্মাল সিগনেচার নেই। নড়ছে না কিছু। ওদেরকে হারিয়ে ফেলেছি আমরা।’

ধাক্কা দিয়ে তাকে সরিয়ে নিজে ডেটা দেখতে লাগল চিফ ইঞ্জিনিয়ার সাবেলা। বিড়বিড় করে বলল, ‘এটা হতে পারে না। নিশ্চয়ই ওই বাড়ির ভেতরেই কোথাও আছে!’

তার ঘাড়ের ওপর দিয়ে ডেটা দেখছে ওরে চিচিওয়া। মুখে ভয়ানক দুর্গন্ধ। দম আটকে ফেলল সাবেলা। ভাবছে, ওঅর- বট লাগে নাকি, এই লোক ফুঁ মেরেই তো যে কাউকে খুন করতে পারবে!

‘দ্বীপের ম্যাপ দেখান আমাকে,’ বলল নৃশংস খুনি।

‘ম্যাপ দিয়ে কী করবেন?’

‘সময় নষ্ট করবেন না। এখন তর্কের সময় নয়।’

রেগে গেলেও নির্দেশ পালন করল সাবেলা। স্ক্রিনে ফুটে উঠল দ্বীপের প্রতিটি বাড়ির ছবি। সাগরের দিক বাদ পড়ল না। ‘লাল বিন্দু দেখাচ্ছে ওঅর-বটের অবস্থান। আর একটু আগেও ওই বাড়িটাতে ছিল লোকগুলো। ওখানেই জড় হয়েছে বেশিরভাগ ওঅর-বট।’

কয়েক মুহূর্ত দেখার পর সব বুঝে গেল ওরে চিচিওয়া। ‘এমন কোনও উপায় আছে, আমি বেরিয়ে গেলে আমাকে খুন করবে না ওসব মেশিন?’

‘আইডেন্টিফায়ার দিতে পারব,’ বলল সাবেলা। পাশের এক কন্সোলে ফিতা থেকে ঝুলছে কয়েকটা ডিভাইস। ‘ওই জিনিস থাকলে মেশিন মনে করবে আপনি তাদের বন্ধু। ভুলেও গুলি করবে না।’

শুনে খুশি হলো ওরে। তলোয়ার তাক করল সাবেলার দিকে। চাপা স্বরে বলল, ‘তো দিন একটা। নিজেও পরবেন আরেকটা।’

‘আমি?’ চমকে গেল সাবেলা, ‘আমি ওখানে গিয়ে কী করব?’

‘জরুরি কাজ,’ বলল প্রেতাত্মা। ‘ওদেরকে ধরব। সঙ্গে আপনিও থাকবেন।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *