মহাপ্লাবন – ৫৩

তেপান্ন

একজন বন্দি পালিয়ে গেছে বুঝতেই সোহেলকে মেঝেতে ফেলে পাইপের দিকে দৌড় দিল লো হুয়াঙের লোকদু’জন। ডানদিকের গার্ড হিমুরার কাঁধ ঝাঁকিয়ে ধমকে উঠল, ‘মাসুদ রানা কোথায়?’

‘জানি না,’ বললেন পুলিশ অফিসার। ‘মনে হয় পালিয়ে গেছে।

‘কী করে? কোথায় গেছে সে?

‘শেকল খুলে ফেলেছিল,’ বললেন হিমুরা। ‘আপনারা বোধহয় অনেক বেশি ঢিলা রেখেছিলেন।’

‘তা হলে তোমাকে ফেলে গেল কেন সে?’

মাথা নাড়লেন অফিসার। ‘অকৃতজ্ঞ। চরম অকৃতজ্ঞ! অথচ, কত কিছুই না করেছি তার জন্যে।

প্রতিটা কথা শুনছে রানা। আছে এয়ার শাফটের দশ ফুট নিচে। এরপর কী হবে ভাল করেই জানে। পা রেখেছে একটা ক্ল্যাম্পের ওপর। বামহাতে জড়িয়ে ধরেছে পাইপ। ডানহাতে দেয়াল থেকে খসিয়ে নেয়া পাথর।

‘পালিয়ে যাওয়ার উপায় ছিল না,’ বলল বামের গার্ড।

ধাক্কা দিয়ে উবোন হিমুরাকে মেঝেতে ফেলল তারা। সুড়ঙ্গের আরও গভীরে ফেলল ফ্ল্যাশলাইটের আলো।

ওদিকে কেউ নেই।

এবার শাফটে উঁকি দিল বামদিকের গার্ড।

লোকটার মুখ দেখামাত্র গায়ের জোরে পাথর ছুঁড়ল রানা। সরাসরি গার্ডের চোয়ালে লাগল ওটা। ঝটকা খেয়ে পিছিয়ে গেল মাথা। ওই একইসময়ে তার হাঁটুর নিচে দু’পায়ের জোরালো লাথি বসালেন উবোন হিমুরা।

ধড়াস্ করে কূপের পাশে পড়ল লোকটা।

ওদিকে পাইপ বেয়ে উঠে এসেছে রানা। কাঁধ চেপে ধরে হ্যাঁচকা টান দিল নিচ থেকে। হুড়মুড় করে কূপে পড়ে দেয়ালে নাক-মুখ ছেঁচে গেল গার্ডের, পরক্ষণে রওনা হলো চল্লিশ ফুট নিচের পানি লক্ষ্য করে। পাঁচ সেকেণ্ড পর এল জোরালো ঝপাস্ আওয়াজ।

একই মুহূর্তে পেছন থেকে দ্বিতীয় গার্ডকে ট্যাকল করেছে সোহেল। সামনের দেয়ালে হুড়মুড় করে আছড়ে পড়ল লোকটা। মেঝেতে পড়েছে সোহেলও। উঠে বসেই গার্ডের কিডনিতে বসাল প্রচণ্ড ঘুষি। বিরতি না দিয়ে পরক্ষণে কপাল নামাল লোকটার চোয়ালের ওপর।

এদিকে কূপ থেকে উঠে এসেছে রানা। ধস্তাধস্তি করছে সোহেল আর গার্ড। একপাশ থেকে লোকটার ঘাড়ে লাথি মেরে তাকে অজ্ঞান করল রানা। নরম সুরে বলল, ‘কী রে, তিন টাচে না এর খুন হওয়ার কথা?’

‘বুঝলি না, আমি শম্ভু, বলল সোহেল। ‘তুই যখন আরাম করে সাঁতরে বেড়াচ্ছিস, আমি তখন জীবনের সেরা অভিনয় করেছি।’

গার্ডের পকেটে চাবি পেয়ে সোহেলের হাতের শেকল খুলল রানা। এরপর মুক্ত করল উবোন হিমুরাকে। নিজের শেকল খুলে ব্যস্ত হাতে গার্ডের শার্ট খুলে গোল্লা তৈরি করে গুঁজে দিল তারই মুখে। হাত-পা শেকলে জড়িয়ে মেরে দিল তালা। উঠে দাঁড়াল গার্ডের পিস্তল হাতে।

‘কূপে যে ব্যাটা সাঁতরে বেড়াচ্ছে, তার কী হবে?’ জানতে চাইল সোহেল।

মাথা নাড়লেন হিমুরা। ‘সাঁতার জানে না, তলিয়ে গেছে।’

পিস্তল হাতে ফিরতি পথ ধরল রানা। পাশে সোহেল। পিছনে ধীর পায়ে হিমুরা। বাঁক নেয়ার আগে থামল ওরা। ওদিক থেকে আসছে পায়ের আওয়াজ।

ছায়া থেকে সাবধানে উঁকি দিল রানা ও সোহেল।

এগিয়ে আসছে হুয়াঙের এক লোক। পরনে সাদা ল্যাব কোট। চোখে ভারী কাঁচের চশমা। পিঠ ভরা দীর্ঘ কালো চুল। দু’হাতে পাঁজাকোলা করে রেখেছে লম্বা দুটো কাঠের কেস। প্লাস্টিক পেইন্ট করা দরজার হ্যাণ্ডেল ধরে চোখ থেকে সরিয়ে দিল চুল। টিপল দরজার পাশের বাটন। জ্বলে উঠল সবুজ বাতি। মৃদু আওয়াজে খুলে গেল কবাট। লোকটা ভেতরে ঢুকতেই বন্ধ হলো হুশ্ আওয়াজে।

‘ব্যাটা বেরিয়ে আসার আগেই, চল্, জায়গাটা পার হয়ে যাই,’ বলল সোহেল।

‘না,’ রাজি হলো না রানা, ‘আগে গিফট শপ দেখব।’ বাঁক ঘুরে দরজাটার সামনে থামল ও। টেকনিশিয়ানের মতই চাপ দিল বাটনে। জ্বলে উঠল ‘সবুজ বাতি। হ্যাণ্ডেল মুচড়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল রানা।

ঘরের দূরে পলিশ করা এক তলোয়ার গভীর মনোযোগে দেখছে টেকনিশিয়ান। নিঃশব্দে তার দশ ফুট পিছনে পৌঁছে গেল রানা। খুকখুক করে কেশে উঠে কক করল পিস্তল।

আওয়াজ পেয়ে ঘুরে তাকাল লোকটা। রানাকে দেখেই তলোয়ার টেবিলে নামিয়ে ঝট্ করে দু’হাত তুলল মাথার ওপর।

‘ইংরেজি জানো?’ জানতে চাইল রানা।

মাথা নাড়ল টেকনিশিয়ান।

‘গুড, তো চিনা ভাষায় বলছি, হাঁটু গেড়ে বসো,’ বলল রানা।

বেকায়দাভাবে মেঝেতে বসল লোকটা। দু’হাত মাথার ওপর। চোখে পড়ল চুল। গাল ফুলিয়ে ফুঁ দিয়ে সরাতে চাইল ওগুলোকে।

‘মাঝে মাঝে চুল কাটলেও তো পারো,’ বলল রানা।

মাথা দোলাল টেকনিশিয়ান। কাছের কেস থেকে তলোয়ার নিল রানা। চমৎকার অস্ত্র। ঝিকমিক করছে ল্যাবের ফ্লুরেসেন্ট বাতির আলোয়।

খুলে গেল ঘরের দরজা। ভেতরে ঢুকল সোহেল ও উবোন হিমুরা।

‘পেলি স্যুভেনিয়র?’ জানতে চাইল সোহেল।

তলোয়ার তুলে দেখাল রানা।

ওটা দেখেই চমকে গেলেন পুলিশ অফিসার। মৃদু কাঁপা গলায় বললেন, ‘সাবধান! আপনার হাতে জাপানের জাতীয় সম্পদ! ওটার নাম হঞ্জো মাসামিউনে। তিয়াত্তর বছর আগে লুকিয়ে ফেলা হয়েছিল শিনটো মন্দিরে।’

টেকনিশিয়ানের দিকে তাকাল রানা। ‘লো হুয়াং এসব তলোয়ার দিয়ে কী করবে?’

‘ওটা জাপানের প্রতীক,’ বলল টেকনিশিয়ান।

‘আর অন্যগুলো?’

দ্বিধা করল লোকটা। ‘আমরা পরীক্ষা করে দেখছি।’

‘তা বুঝলাম,’ ল্যাবের নানা ইকুইপমেন্ট দেখছে রানা।

‘কিন্তু কেন? তলোয়ারে কী খুঁজছে লো হুয়াং?’

‘একটা অ্যালয়,’ বলল টেকনিশিয়ান, ‘সোনালি শিখা। খুবই দুর্লভ। এখন পর্যন্ত পাওয়া গেছে সামান্য পরিমাণে। আগ্নেয় ফাটলের ভেতর। আমরা ধারণা করছি, ওটা আছে জাপানে। আর এসব তলোয়ারের একটা তৈরি হয়েছে ওই অ্যালয় দিয়ে। জানতে হবে কীভাবে তৈরি হলো তলোয়ারটা। তার চেয়েও বড় কথা, কোন্ খনি থেকে এল ওই অ্যালয়।’

ভুরু কুঁচকে ফেলল সোহেল। ‘আমরা এখন জানি, চিনের পুব সাগরে কী খুঁজছিল লো হুয়াঙের লোক।’

‘প্রথমে ওখান থেকেই সংগ্রহের চেষ্টা করা হয়,’ বলল টেকনিশিয়ান। ‘কিন্তু তারপর ফুরিয়ে গেল খনি।

‘সাগরের নিচে কীভাবে খনি চালু করেছে?’ জানতে চাইল রানা।

‘আল্ট্রাসনিক ওয়েভ ও হাই-ইনটেনসিটি ভাইব্রেশনের মাধ্যমে। সঙ্গে ব্যবহার করা হয় কার্বন সিলিকন ফ্র্যাকিং লিকুইড। ইউনিক সিস্টেম, গভীর খনিতে ড্রিল না করেও তোলা যায় ‘ওর’।’

‘ওই ‘ওর’-এর সঙ্গে গভীর থেকে উঠছে কোটি কোটি গ্যালন পানি, সেটা জানো?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

‘প্রসেসের সময় পানি বেরোয়ই,’ বলল টেকনিশিয়ান, ‘তবে সেটা বেশি নয়।’

‘বেশি নয়?’ ভুরু কুঁচকে ফেলল রানা। ‘তোমরা তা হলে কিছুই জানো না। তোমাদের তৈরি ফাটল থেকে প্রতি সেকেণ্ডে বেরোচ্ছে কোটি কোটি গ্যালন পানি। আমরা ঠেকাতে না পারলে আগামী একবছরে তলিয়ে যাবে অনেকগুলো নিচু দেশ।’

‘অসম্ভব,’ মাথা নেড়ে বলল লোকটা।

‘হাড়ে হাড়ে সব টের পাবে,’ বলল রানা।

‘চল, বেরিয়ে যাই,’ তাড়া দিল সোহেল। ‘যে-কোনও সময়ে কেউ বুঝবে আমরা শাফটে নেই।’

ঠিকই বলেছে সোহেল। টেকনিশিয়ানের দিকে তাকাল রানা। ‘প্রথম যখন এলাম, সঙ্গে ছিল একটা ইকুইপমেন্ট ব্যাগ। ওটা এখন কোথায়?’

লোকটার চোখ গেল লকারের দিকে। চোখ অনুসরণ করেছে সোহেল। লকার খুলে ওদের ব্যাগ বের করে নিল ও। ভেতরে রয়েছে সুইম ফিন, মাস্ক আর অক্সিজেনের ছোট বোতল। পাশেই ইনফ্রারেড গগলস। ‘সবই আছে। বাদ পড়েনি আমাদের রেডিয়ো ট্র্যান্সিভার।’

‘অস্ত্র?’ জানতে চাইল রানা।

আরও ক’টা লকার ঘেঁটে দেখল সোহেল। ‘না। নেই।’

নিজের পিস্তল ওর হাতে দিল রানা। তলোয়ার উঁচিয়ে বলল, ‘এটাই সই। কাজ শেষে ফেরত দেব সত্যিকারের মালিকের কাছে।’

পিস্তলের চেম্বারে গুলি আছে, দেখল সোহেল। তলোয়ার নাচিয়ে টেকনিশিয়ানকে উঠে দাঁড়াতে ইশারা করল রানা। ‘আমাদের সঙ্গে যাচ্ছ। আরও অনেক কিছু বেরোবে তোমার পেট থেকে।’

তোয়ালে দিয়ে লোকটার মুখ বাঁধলেন উবোন হিমুরা। তার বেল্ট থেকে নিলেন রেডিয়ো। দরজা খুলে সুড়ঙ্গে চোখ বুলিয়ে নিল রানা। কেউ নেই। ‘এবার যাওয়া যাক।’

সুড়ঙ্গ-মুখের দিকে চলেছে ওরা। কিছু দূর যেতেই সামনে পড়ল অ্যাসেম্বলি রুম। ওটা পাশ কাটিয়ে যেতেই হঠাৎ খুলে গেল পেছনের ওই ঘরের দরজা। বেরিয়ে এসেছে দুই চিনা কর্মী। রানা আর সোহেলের মাঝে মুখ বাঁধা টেকনিশিয়ানকে দেখেই সব বুঝে নিল তারা।

ধাক্কা দিয়ে টেকনিশিয়ানকে সরিয়ে তলোয়ার হাতে ঘুরে দাঁড়াল রানা। কিন্তু দু’লাফে দরজার ওদিকে গেল লোকদুটো। পেছনে আটকে দিল কবাট। মাত্র পাঁচ সেকেণ্ড পর ইন্টারকমে এল ঘোষণা: ‘ছুটে গেছে বন্দিরা! প্রধান সুড়ঙ্গে! আবারও বলছি: বন্দিরা এখন প্রধান সুড়ঙ্গে!’

ঠেলা দিয়ে টেকনিশিয়ানকে মেঝেতে ফেলল রানা। তাকে নিলে ধীর হবে গতি। এবার পালাতে হবে লেজ তুলে। ‘চল্‌, চল, হিমুরা আসুন!’

সুড়ঙ্গ-মুখের দিকে ঝেড়ে দৌড় দিল ওরা তিনজন

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *