পাঁচ
যুক্তরাষ্ট্র।
কুচকুচে কালো আকাশ বুকে নিয়ে সেপ্টেম্বরের বৃষ্টিস্নাত সকাল। হু-হু করে বইছে ঝোড়ো হাওয়া। মাঝে মাঝে কড়াৎ আওয়াজে পড়ছে একটা-দুটো বাজ।
রাজধানী ওয়াশিংটনের কংগ্রেশনাল বিল্ডিঙের নতুন ব্রিফিং এরিয়ার আনুষ্ঠানিক নাম: স্যামুয়েল বি. গুডউইন মিডিয়া রুম। কিন্তু ওখানে যারা কাজ করে, ওটাকে বলে: থিয়েটার। এর একটা কারণ, কয়েক স্তরে রয়েছে সারি সারি আরামদায়ক চেয়ার। থিয়েটার বলার অন্য কারণ, নিয়মিত এখানে চলে অসংখ্য রাজনৈতিক নাটক।
এ মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে ভীষণ গম্ভীর চেহারায় যে যাঁর সিটে বসে আছেন ক’জন সিনেটর ও কংগ্রেসম্যান।
কী আশ্চর্য বেয়াক্কেলে লোক মাসুদ রানা, এখনও আসার নাম নেই তার!
ক্ষমতাশালী মানুষগুলোর চোখে-মুখে বিরক্তি। একটু পর পর দেখছেন ঘড়ি। ঠিক দশটায় সবাইকে হাজির থাকতে অনুরোধ করে নিজেই আসেনি লোকটা। এখন বাজে এগারোটা। ভেতো বাঙালি কোনও দিনও মানুষ হবে না!
নিচু গলায় নিজেদের ভেতর আলাপ করছেন সিনেটর ও কংগ্রেসম্যানরা। দু’একটা আপত্তিকর মন্তব্য শুনে গা জ্বলে যাচ্ছে বিসিআই বা বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের চিফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর সোহেল আহমেদের। বসে আছে চতুর্থ সারির সিটে। ক’দিন আগে এ দেশে এসেছে ছুটি কাটাতে।
আমেরিকার উদ্দেশে গ্রিনল্যাণ্ড ত্যাগের আগে রানা ফোনে বলেছিল, ‘ভাল হয় তুই মিটিঙে এলে। হয়তো পাবি জরুরি অ্যাসাইনমেন্ট।’
‘তা হলে আর অফিসে বসে মাছি মারতে হবে না,’ খুশি হয়ে বলেছে সোহেল। ‘তুই আর সোহানা দেশে নেই, সেই দুঃখ ভুলতে দিনরাত আমাকে বকে চলেছে বুড়োটা। প্রথম সুযোগে ছুটি নিয়ে ভেগে এসেছি এখানে।’ প্রসঙ্গ পাল্টে রানার কাছে জানতে চেয়েছে, ‘কী ধরনের অ্যাসাইনমেন্ট রে, দোস্ত?’
জবাবে রানা বলেছে, ‘এখনও জানি না। তবে বিষয়টা হবে খুব জটিল এবং বিপজ্জনক।’
ঘরের চারপাশে চোখ বোলাল সোহেল। বিষয় যে জটিল, তাতে ভুল নেই। মঞ্চে ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অভ সায়েন্সের প্রখ্যাত চার বিজ্ঞানী। পাঁচজনের শার্টের বুকে নাসার ব্যাজ। তিনজনের সামনের বোর্ডে লেখা পদবী দেখে সোহেল বুঝেছে, তাঁরা হোয়াইট হাউসের অ্যাডভাইযরি স্টাফ। এ ছাড়া, দু’জন এসেছেন এনওএএ থেকে। পৃথিবীর আবহাওয়া, বায়ুমণ্ডলীয় পরিস্থিতি এবং সামগ্রিক পরিবেশ পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব ওই এজেন্সির। সোহেলের পাশের সিটেই রয়েছে নুমা বা দ্য ন্যাশনাল আণ্ডারওঅটার অ্যাণ্ড মেরিন এজেন্সির কয়েকজন। তাদের মধ্যে দু’জনকে খুব ভাল করেই চেনে সোহেল।
ওরা স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই বাঙালি এবং ওর বন্ধু। আসিফ রেজা ও তানিয়া রেজার কাজ নুমায় পৃথিবীর সাগর মনিটর করা। তাল গাছের মত উঁচু আসিফ দক্ষ জিয়োলজিস্ট। গভীর সাগরে গুরুতর সমস্যা দেখা দিলে ডাক পড়ে তার। তবে এ মুহূর্তে তাকে প্রায় বিধ্বস্ত বলে মনে হচ্ছে সোহেলের। শান্ত দানবের চোখের চারপাশে কালো দাগ। বোধহয় ঘুমাতে পারেনি গত কয়েক রাত।
স্বামীর পাশে তানিয়া, দক্ষ মেরিন বায়োলজিস্ট। স্বামী গভীর রাতে জেগে কাজ করলে পাশে থাকে উৎসাহ দেয়ার জন্যে।
তানিয়ার ওদিকের সিটে কমোডর জোসেফ কার্ক। নিজ যোগ্যতায় হয়েছেন নুমার চিফ অ্যাডমিরাল হ্যামিলটনের ডানহাত। তবে কয়েকটা ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক অ্যাসাইনমেন্টে বেপরোয়া সাহস, বুদ্ধি ও যোগ্যতা দেখিয়ে তাঁর শ্রদ্ধা অর্জন করে নিয়েছে রানা। এমনি-এমনি ওকে করা হয়নি নুমার অনারারি ডিরেক্টর।
দুশ্চিন্তা নিয়ে আরেকবার ঘড়ি দেখলেন কার্ক।
নিচু গলায় বলল তানিয়া, ‘রানা তো দেরি করার মানুষ নয়। জরুরি কোনও কাজে আটকে গেল?’
‘জরুরি কিছুই হবে,’ বলল আসিফ। ‘গত ছয় মাসে গোটা দুনিয়ার সাগরের পানি উঠেছে পুরো আট পয়েন্ট তিন ইঞ্চি।
আসিফের কথাটা শুনতে পেয়েছেন কার্ক। কয়েক সেকেণ্ড পর বললেন, ‘সাগরের উচ্চতা আট পয়েন্ট তিন ইঞ্চি বেড়েছে মানে, যোগ হয়েছে একুশ কোয়াড্রিলিয়ন গ্যালন। তার মানে, গ্রেট লেকের সব পানির তিন গুণ। এত জল বেড়েছে মাত্র ছয় মাসে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, কেউ খেয়াল করেনি বাড়ছে সাগরের পানি।’
‘এভাবে বাড়লে আগামী বছর কয়েক ফুট নিচে তলিয়ে যাবে বাংলাদেশ, ফ্লোরিডা ছাড়াও বহু দেশ ও দ্বীপ,’ বলল আসিফ রেজা।
‘অথচ পৃথিবীর তাপ বাড়েনি,’ বলল তানিয়া। চুপ হয়ে গেল ও।
পডিয়ামে দাঁড়ালেন এক সিনিয়র সিনেটর। বোধহয়, আলাপ করেছেন অন্যদের সঙ্গে, এখন জানিয়ে দেবেন বাতিল করা হচ্ছে মিটিং। বক্তব্য শুরু করতে বোয়াল মাছের মত মস্ত এক হাঁ মেললেন ভদ্রলোক, কিন্তু তখনই দড়াম করে খুলে গেল প্রধান দরজা। দৃঢ় পায়ে ঘরে ঢুকল কালো চুলের এক যুবক। এলোমেলো দাড়ি তার কাকের বাসা। তার দিকে চেয়ে আছেন সিনেটর। কিছু বলার আগেই মুখ খুলল মাসুদ রানা, ‘সাগরের উচ্চতা গ্লোবাল ওঅর্মিঙের জন্যে বাড়ছে না।’
ওর কথায় মঞ্চে ও প্রথম সারির সিটের সবার ভেতর শুরু হলো গুঞ্জন।
‘সরি!’ বললেন পডিয়ামের সিনেটর। ‘হাতেম তাঈয়ের মত দাড়ির জন্যে আপনাকে চিনতে পারিনি, মিস্টার রানা।’
‘সময় ছিল না ভদ্রস্থ হওয়ার,’ বলল রানা। ‘গত আড়াই মাস ছিলাম দক্ষিণ ও উত্তর মেরুর গ্লেসিয়ারে। ঢাকা শহরের গুলিস্তানকেও জ্যামের দিক থেকে হারিয়ে দিয়েছে আপনাদের আই-৯৫ হাইওয়ে। এদিকে মোবাইল ফোনের ব্যাটারির চার্জ শেষ। আসতে দেরি হয়েছে বলে দুঃখিত।’
‘তারমানে বলছেন, সাগরের পানি গ্লোবাল ওঅর্মিঙের জন্যে বাড়ছে না?’ জানতে চাইলেন দ্য ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যাণ্ড অ্যাটমসফেয়ারিক বোর্ডের চেয়ারম্যান। ‘তা হলে? কীজন্যে…’
‘সব প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই। তবে এটা জানি, আগের মতই আছে গ্লেসিয়ার,’ পরিষ্কার জানিয়ে দিল রানা।
‘কিন্তু আমাদের তৈরি অতিরিক্ত তাপের জন্যে এমনটা হচ্ছে না?’ জানতে চাইলেন ফ্লোরিডার সিনেটর।
‘এ ক্ষেত্রে তা হচ্ছে না,’ বলল রানা। ‘তা হলে সাগর উঠে আসছে কেন?’
‘তা এখনও জানতে পারিনি আমরা।’
‘আপনি তো জরুরি ডেটা সংগ্রহ করেছেন?’ জানতে চাইলেন দ্য ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যাণ্ড অ্যাটমসফেয়ারিক বোর্ডের চেয়ারম্যান।
‘তা করেছি,’ বলল রানা।
‘তা হলে দয়া করে সেসব ডেটা পাঠিয়ে দেবেন আমাদের সবার অফিসে,’ বললেন দলনেতা সিনেটর।
‘বেশ, পাঠিয়ে দেয়া হবে,’ বলল ক্লান্ত রানা।
‘আজ দেরি হয়ে গেছে, শেষ করা যাক মিটিং,’ বললেন সিনেটর। ‘সব ডেটা দেখার পর আবারও দু’সপ্তাহ পর মিটিঙে বসব আমরা। যদি এর মধ্যে জানা না যায়, কী জন্যে উঠে আসছে সাগর, বাধ্য হয়েই জানাতে হবে সাধারণ মানুষকে। এর ফলাফল হবে ভয়ঙ্কর। আতঙ্কিত হয়ে উঠবে সবাই।’
মাথা দোলাচ্ছেন প্রায় সবাই।
রানা খুশি, দীর্ঘ সময় এখন বকবক শুনতে হবে না। সিট ছেড়ে দরজার দিকে চলেছেন অনেকে।
রানার কাছে এসে দাঁড়াল সোহেল, আসিফ ও তানিয়া। মোটা এক সিনেটরের সঙ্গে কথা বলছেন জোসেফ কার্ক। ‘তোর আনা ডেটা থেকে বেরোবে, কেন বাড়ছে সা উচ্চতা?’ জানতে চাইল সোহেল।
মাথা নাড়ল রানা। ‘ব্যাপারটা রহস্যজনক। সেজন্যেই খুব জরুরি এর জবাব খুঁজে বের করা।’
ওদের দিকে এগিয়ে এলেন জোসেফ কার্ক।
‘চলুন, যাওয়া যাক নুমা হেডকোয়ার্টারে,’ বলল রানা।
মাথা দোলালেন কার্ক।
দরজার দিকে চলল ওরা। আলাপে ঠিক হলো, বিকেল পাঁচটায় বসবে রানা, সোহেল, আসিফ ও তানিয়া। সন্দেহজনক ডেটা পেলে তা জানিয়ে দেবে অ্যাডমিরাল জর্জ হ্যামিলটন বা জোসেফ কার্ককে।