ছেচল্লিশ
ঢালু সুড়ঙ্গ ধরে পাহাড়ের আরও গভীরে ঢুকছে রানা ও সোহেল। সুড়ঙ্গের মেঝেতে কেউ তৈরি করেছে নিচু বাঁধ, কিন্তু ওটা টপকে বৃষ্টির পানির ধারা কিছুদূর গিয়ে পড়ছে খাড়া এক শাফটের মধ্যে। পাশের দেয়ালেই এলিভেটর, তবে মনে হলো না কেউ ব্যবহার করে।
‘কয়েক বছরে ব্যবহার হয়নি,’ মন্তব্য করল সোহেল।
জবাব না দিয়ে ইনফ্রারেড স্কোপ দিয়ে খাড়া শাফট দেখল রানা। ‘ওদিকে তাপ নেই। নিচে নেই ওরা। আরও এগোতে হবে।’
সুড়ঙ্গের আরও ভেতরে যাওয়ার পর প্রথমবারের মত ওরা দেখল আধুনিক সভ্যতার চিহ্ন। ছাতে পুরনো কেবলের বদলে নতুন তার। জ্বলছে কম ওয়াটের এলইডি বাল্ব।
সামনে দু’ভাগ হয়েছে সুড়ঙ্গ। ইনফ্রারেড গগলস ব্যবহার করে মেঝে দেখল রানা। পায়ের ছাপে রয়ে গেছে মৃদু তাপ। বেশিরভাগ লোক গেছে বামে।
ওদিকেই চলল রানা।
ওর বাহু স্পর্শ করল সোহেল। ‘ভুল করছিস না তো?’
‘হলদে ইঁটের রাস্তা,’ নিচু গলায় বলল রানা। ‘আছি ব্যস্ত পথে।’
ওর কথাই ঠিক। আঁকাবাঁকা সুড়ঙ্গের মাঝ দিয়ে এক শ গজ যেতেই দেখল প্লাস্টিকের কোট দেয়া দু’কবাটের ট্রিপল- সিল ডোর। আগেরজনের রেখে যাওয়া তাপ জ্বলজ্বল করছে হ্যাণ্ডেলে।
গগলস খুলে বলল রানা, ‘আধুনিক করেছে পুরনো খনি।’
মাথা দোলাল সোহেল। ‘মনে হচ্ছে না আমাদেরকে দেখলে খুব খুশি হবে এরা।’
দরজার হ্যাণ্ডেল পরখ করল রানা। নিচু গলায় বলল, ‘লক করা নেই। চল, ভেতরে ঢুকে দেখি।’
পাহাড়ে হুয়াঙের দু’গার্ডের কাছ থেকে পাওয়া পিস্তলের সেফটি অফ করল দুই বন্ধু। বামহাতে খুব ধীরে হ্যাণ্ডেল ঘোরাল রানা। ক্লিক আওয়াজে খুলে গেল ল্যাচ। দরজা খুলতেই ভেতর থেকে এল সামান্য বাতাস। ঘরে রয়েছে পযিটিভ প্রেশার।
রানা দরজা আরেকটু খুলতেই ঘরে পিস্তল তাক করল সোহেল। কয়েক সেকেণ্ড পর বুঝল, কেউ নেই। ‘ভেতরে ঢুকে দেখি কী আছে।’
সোহেলের পিছু নিল রানা। কাভার করছে বন্ধুকে। আরেক হাতে প্রায় নিঃশব্দে বন্ধ করল পেছনে দরজা। ঘরে নানান ইকুইপমেন্ট। বেশিরভাগই বল্টু মেরে আটকে দেয়া হয়েছে মেঝেতে। কয়েকটা তাকে বেশকিছু অঙ্গ। সবই রোবটের। জাইরো, সার্ভো, হাত ও পা।
‘শালাদের মাথা কই?’ বিড়বিড় করল সোহেল। ‘রোবট নিয়ে খেপে উঠেছে লো হুয়াং! শালার নিজেরই মাথার ঠিক নেই। রোবট আর ওই জিনিস পাবে কই!’
‘নিজের মাথা ঠাণ্ডা রাখ,’ পরামর্শ দিল রানা।
তাকের অঙ্গগুলো দেখছে সোহেল।
ঘরের আরও ভেতরে ঢুকল রানা। পেয়ে গেল হাই-টেক থ্রি-ডি প্রিন্টিং মেশিন। একটু আগে ব্যবহার হয়েছে বলে এখনও গরম।
কন্ট্রোল প্যানেলের ছোট্ট স্ক্রিনে ট্যাপ করল রানা। ফুটে উঠল কয়েকটা অক্ষর আর ফাঁকা জায়গা। চাইছে পাসওঅর্ড। সময় নষ্ট না করে অন্যদিকে মন দিল রানা।
থ্রি-ডি প্রিন্টারের পাশের টেবিল পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি ঢালু। চাদর দিয়ে ওখানে ঢেকে রাখা হয়েছে একটা দেহ। রানা চাদর টেনে সরাবার সময় ভাবল, ক্ষতবিক্ষত হয়ে পড়ে আছে উবোন হিমুরার লাশ। কিন্তু তা নয়। টেবিলে শুইয়ে রাখা হয়েছে মানুষের আকৃতির অর্ধেক তৈরি একটা রোবট। চেহারা নেই, শরীরের প্যানেল নেই, আছে শুধু কাঠামো, একগাদা তার ও শক্তিশালী ব্যাটারি। রোবটের বুকে আছে একটা ব্লাডার আর তরল ভরা রিযার্ভয়ার।
দুটো রোবটিক হাত এনে সোহেল জিজ্ঞেস করল, ‘কাজের আরও দুটো হাত পেলে নিশ্চয়ই খুশি হবি?’
জবাব দিল না রানা।
মাথা নাড়ল সোহেল। ‘ডক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনকে তো দেখছি না!’
টেবিলের অর্ধ তৈরি রোবটের ওপর চাদর টেনে ঘরের পেছনে চলল রানা। ওদিকের দেয়ালে রয়েছে ঘোলা একটা বড় কাঁচ। ইনফ্রারেড স্কোপ চোখে পরে ওদিকটা দেখতে চাইল ও। পেল শুধু নিজের হৃৎপিণ্ডের তাপের প্রতিফলন।
গগলস খুলে মুখের দু’পাশে হাত রেখে কাঁচে চোখ ঠেকাল রানা। তাতেও দেখা গেল না কিছু। শুনল কীসের যেন আওয়াজ। মৃদু কাঁপছে কাঁচ। ওর মনে হলো, পাশের ঘরে, নিচু গলায় কথা বলছে কয়েকজন। সোহেলকে হাতের ইশারায় ডাকল। ‘শুনতে পেয়েছিস?’
কাঁচে কান পাতল সোহেল। ‘আলাপ করছে?’
‘বারবার একই কথা,’ বলল রানা, ‘প্রার্থনা করা বা মন্ত্র পড়ার মত।’
‘উবোন হিমুরার বদলে আমি হলে সাহায্যের জন্যে প্রার্থনাই করতাম,’ বলল সোহেল।
দরজা খুঁজতে শুরু করে রানা দেখল, একটা প্যানেলে আছে স্প্রিং লোডেড ম্যাগনেটিক ল্যাচ। একবার ওটাতে চাপ দিতেই খুলে গেল দরজা। বাড়ল গলার আওয়াজ। ওদিকের প্রায়ান্ধকার ঘরে ঢুকল রানা। এখানেও মেডিকেল টেবিলে অর্ধেক তৈরি রোবট। তবে ঘরের পেছনে আছে হাই- ডেফিনেশন স্ক্রিনের সামনে দুই লোক। স্ক্রিন দেখছে আর বলছে বারবার একই কথা।
পিস্তল হাতে এগোল সতর্ক রানা। তবে ওকে পাত্তা দিল না লোকদুটো। একপাশ থেকে দেখে রানার মনে হলো, ঘোরের ভেতর আছে তারা।
দেয়ালে বাতির সুইচ পেয়ে লোকদু’জনের দিকে পিস্তল তাক করল রানা। থমকে গেল বাতি জ্বালতে গিয়েও। মনে পড়েছে, লো হুয়াঙের নাগাসাকির ফ্যাক্টরিতে ইংরেজিতে এ কথা নিজেই বলেছিল ও।
স্ক্রিনের লোকটা বলল, ‘জাপান কখনও চিনের বন্ধু হবে না।’
‘জাপান কখনও চিনের বন্ধু হবে না,’ আবৃত্তি করল দুই লোক।
বাতি জ্বেলে দিল রানা। নড়ল না লোকদু’জন। আগের মতই বলছে একই কথা। তাদের সামনে গিয়ে থামল রানা। লোকদু’জন দেখতে একইরকম। মাথায় ক্রু-কাট চুল। চোখের মণি কুচকুচে কালো। গালে তিন দিনের খোঁচা-খোঁচা দাড়ি।
রানার মনে হলো, আয়নার দিকে চেয়ে আছে ও।
দুটো আয়না!
নিজের রোবটিক সংস্করণ দেখছে ও!
.
প্রায় ধসে পড়া বাড়ির দশতলায় উঠে থামল ওরে চিচিওয়া। চারপাশে আবর্জনা ও জঞ্জাল। ভেঙে র্যাম্পের মত ছাত নেমেছে মেঝেতে। মাঝের ফাঁকা অংশে দেখা যাচ্ছে আকাশের মেঘের ধূসর রঙ। ওই ঢালু স্ল্যাব বেয়ে ছাতে উঠল ওরে। ভিজছে বৃষ্টিতে। সতর্ক চোখে দেখল চারপাশ।
মিলিটারি বা পুলিশের প্যারাশুট বা ইকুইপমেন্ট নেই ছাতে। ধরে নেয়ার কারণ নেই দ্বীপে গোপনে এসেছে কেউ। কিন্তু আবছা আলোয় কালচে ছাতে কয়েক সেকেণ্ড পর দেখল চওড়া, সাদাটে কিছু।
ওটা বারো ফুটি ডানার মত। হয়তো পড়েছে বিমান থেকেই, তবে অক্ষত। ডানার নিচে গুঁজে রাখা হয়েছে প্যারাসেইল।
‘মাসুদ রানা,’ বিড়বিড় করল চিচিওয়া। ঘুরেই দৌড়ে স্ল্যাবের কাছে পৌঁছল সে। পিছলে স্ল্যাব বেয়ে নেমে এল নিচের মেঝেতে। দৌড় দিল নিচতলায় নামতে। শুনতে পেল লো হুয়াঙের অগ্রসরমাণ হেলিকপ্টারের গর্জন। ছোটার গতি আরও বাড়ল ওরের। খালাতো ভাইকে সতর্ক করতে হবে, নইলে সর্বনাশ ডেকে আনবে মাসুদ রানা!