চুয়াল্লিশ
দু’ঘণ্টা পর।
নাগাসাকি উপসাগর।
ত্রিশ ফুটি বো-রাইডার বোটে চেপে এগিয়ে চলেছে মাসুদ রানা, সোহেল আহমেদ ও হিনা। শক্তিশালী ইনবোর্ড মোটরের জোরে মাঝারি ঢেউ কাটছে ভি আকৃতি বো। মাত্র ষোলো মাইল দূরে আঁধারে ভরা হাশিমা দ্বীপ।
নুমার হাইটেক গিয়ার সংগ্রহ করার সময় ছিল না, তাই বড় এক কোম্পানির পাওয়ারবোট ‘ধার’ নিয়েছে রানা। ভাড়া দেয় এমন এক কোম্পানি থেকে সংগ্রহ করেছে ডাইভিং গিয়ার। চেষ্টা করবে সব ফেরত দিতে। কিছু নষ্ট হলে, সে ক্ষতির জন্যে নগদ টাকা গুনবে নুমার অ্যাকাউন্ট্যান্ট।
হুইলে আছে হিনা।
বাতাসের বেগ পরখ করছে রানা।
ডাইভিং গিয়ার গুছিয়ে নিচ্ছে সোহেল।
‘উত্তর-পশ্চিমে চলো,’ হিনাকে বলল রানা। ‘কয়েক মাইল যাওয়ার পর আবারও ফিরবে দ্বীপের দিকে।’
হিনা ডানে হুইল ঘোরাতেই কাত হয়ে আবার সোজা হলো বোট।
স্টার্নে এসে দূরে তাকাল সোহেল। ‘কী করা উচিত ভাবছিস, রানা? দ্বীপ কিন্তু ওদিকে। সাঁতরে যেতে হলে খুন হব। বহু দূর।
‘শতখানেক ছবি আর স্যাটেলাইট ইমেজ থেকে মনে হয়েছে, সাঁতরে দ্বীপে ওঠা বুদ্ধির কাজ হবে না।’ ল্যাপটপে হাই রেযোলিউশন এরিয়াল ফোটো দেখাল রানা। ‘দ্বীপ ঘিরে রেখেছে চল্লিশ ফুটি বাঁধ বা দেয়াল। সর্বক্ষণ এসে আছড়ে পড়ছে মস্ত সব ঢেউ। নিচে তলস্রোত। আমরা পাথরে বাড়ি খেয়ে না মরলে, জোরালো স্রোতের টানে চলে যাব সাগরের মাঝে।’
মৃদু মাথা দোলাল সোহেল। ‘দ্বীপে ডক আর পাইলিং আছে। এ ছাড়া, তিন দিকে তিনটে সিঁড়ি। যে-কোনওটা ব্যবহার করতে পারি।’
‘বড় বোটের জন্যে তৈরি করেছে কংক্রিটের ওই ডক,’ বলল রানা। ‘অনেক দূরে দ্বীপের শেষে কংক্রিটের পাইলিং। ওখানে ঢেউ ও স্রোত দুটোই জোরালো। এদিকে সিঁড়ি বেয়ে দ্বীপে ওঠা সহজ হলেও, ধরে নিতে পারিস, ওগুলোর ওপর চোখ রাখবে লো হুয়াং লিটনের লোক।’
‘না সাঁতরালে এত ডাইভিং গিয়ার কেন?’
‘কাজ শেষে যাতে বেরোতে পারি,’ বলল রানা। ‘সম্ভব হলে উবোন হিমুরাকে নিয়ে নতুন ভাটার আগেই বেরিয়ে যাব। সহজেই পৌঁছুতে পারব উপসাগরে।’
‘তুই বলছিস বেরোবার কথা,’ বলল সোহেল, ‘আগে বল, ঢুকবি কী করে?’
‘তোর মনে হয়নি কেন ধার নিলাম এই বিশেষ বোট?’
‘দেখতে সুন্দর। আবার কী!’
‘এটার ড্রামে অনেক কেবল। মোটরের টেনে নেয়ার শক্তি প্রচণ্ড। নতুন স্পোর্টসের নাম শুনেছিস— উইংবোর্ডিং? অ্যাড্রেনালিন জাঙ্কিরা দারুণ পছন্দ করে।’
ভুরু কুঁচকে বন্ধুকে দেখল সোহেল। ‘উইং বোর্ডিং?’
‘প্যারাসেইলিঙের মতই, তবে মাথার ওপরে থাকবে প্যারাশ্যুট, আর পায়ের নিচে ডানা।’
‘তুই ভাবছিস উড়ে গিয়ে নামব ওই দ্বীপে?’
‘ভাসতে ভাসতে,’ বলল রানা, ‘বোট চালিয়ে আমাদের দু’জনকে আকাশে তুলে দেবে হিনা। টেনে নিয়ে যাবে দ্বীপের কাছে। তারপর এক বা দেড় মাইল দূরে থাকতে কেবল ছুটিয়ে ভোকাট্টা ঘুড়ি হব। সাগরের বাতাস বইছে দ্বীপের দিকে। তাতে ভর করে আকাশ থেকে নামব পেঁচার মত।’
মাথা দোলাল সোহেল। ‘তুই সত্যিই প্যাচামুখো। আমি আবার অত্যন্ত সুদর্শন যুবক হলেও মনে হয় না সুন্দরী কেউ থাকবে ওই দ্বীপে। …তবে ওদের রেইডার থাকলে?’
‘আছে বলে মনে হয় না,’ বলল রানা। ‘বহু দিন হলো পরিত্যক্ত হয়েছে দ্বীপ। কেউ যায় না। লো হুয়াঙের লোক চাইলেও ব্যবহার করতে পারবে না রেইডার বা সার্চলাইট। নইলে চোখে পড়বে কারও না কারও। ওরা নিজেরাই আছে চোরের মত। ধরে নে, ওখানে আছে সার্ভেইল্যান্স সিস্টেম। গোপন ক্যামেরা আর মোশন ডিটেক্টর। কিন্তু সেসব থাকবে সাগরের দিকে তাক করা। ভেতরে নজর দেবে না কেউ। আমরা আকাশ থেকে নামব গিয়ে দ্বীপের মাঝখানে।’
‘ওই দেয়াল টপকে মাঝে গিয়ে নামলাম। তারপর?’
দুটো বিদঘুটে লেন্সের গগল্স দেখাল রানা। ‘এগুলোর ইনফ্রারেড সেন্সর আছে। আকাশ থেকে নামার সময় দ্বীপের চারপাশে চোখ বোলাব। হুয়াঙের লোক থাকলে, সেখানে থাকবে বাতি, বিদ্যুৎ আর ইকুইপমেন্ট। আর তার মানেই তাপ। সেসব না দেখলে বুঝব দ্বীপে মানুষ নেই।’
মৃদু মাথা দোলাল সোহেল। ‘নামার সময় তাপের পথ খুঁজব। ওটা হবে হলদে ইঁটের রাস্তার মত।’
‘স্ক্যান করব আমি,’ বলল রানা। ‘তুই হচ্ছিস পাইলট। পৌঁছে দিবি গন্তব্যে। নামবি উঁচু কোনও বাড়ির ছাতে।’
.
পাওয়ারবোটের স্টার্নে কালো নিয়োপ্রেন সুট পরে বারো ফুটি ডানার কাছে দাঁড়িয়ে আছে রানা ও সোহেল। দাঁড়াবার ভাব দেখে কেউ ভাবতে পারে, শত্রুর বিরুদ্ধে লড়বে কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে দুই বন্ধু। সামনে এক পা, অন্য পা একফুট পেছনে বাঁকা করে রাখা। এ ভঙ্গিতে দাঁড়ালে সবচেয়ে বেশি ব্যালান্স পাওয়া যায়।
ওদের কাঁধের স্ট্র্যাপে ঝুলছে ছোট্ট অক্সিজেন বোতল, মুখোশ ও ফিন। সাঁতরে উবোন হিমুরাকে নিয়ে দ্বীপ থেকে বেরোবার সময় কাজে লাগবে ওসব। ওদের দ্বিতীয় কাজ, খুঁজে বের করা কী করছে হুয়াঙের লোক।
পা শক্ত করে গাইড কেবল চেপে ধরল ওরা। একবার উড়ে গেলে ওই কেবল ব্যবহার করে সরবে নানাদিকে। সংক্ষিপ্ত ভিডিয়ো দেখেছে, বুঝে গেছে কীভাবে চালাতে হবে ডানা।
‘কঠিন বলে মনে হচ্ছে না,’ বলল সোহেল, ‘বামে ঝুঁকলে বামে যাবে, আবার ডানে ঝুঁকলে ডানে যাবে।’
‘আরও কঠিন হলে তোর ভাল লাগত?’ জানতে চাইল রানা।
উদাস হয়ে সাগরের দিকে তাকাল সোহেল।
‘আপনাদেরকে কতটা দূরে নেব?’ জানতে চাইল হিনা।
আগেই হিসাব করেছে রানা। ‘দ্বীপের দুই মাইল আগে। সামান্য টেনে নেবে। তারপর খুলে দেব আমরা কেবল।’
‘দুই মাইল?’ মাথা নাড়ল হিনা। ‘তা হলে তো দ্বীপে যেতে গিয়ে আকাশ থেকে পড়েও যেতে পারেন।’
‘অনলাইনে দেখেছি, বারো ফুট এগোলে গ্লাইডার নামে মাত্র একফুট,’ বলল রানা। ‘কেবল আমাদের তুলে দেবে প্রায় পনেরো শ’ ফুট ওপরে। পেরোতে পারব সাড়ে তিন মাইল। কিন্তু সামনে থেকে আসতে পারে বাতাস, তা ছাড়া আমরা অত দক্ষ নই, কাজেই দু’মাইল আগে থেকে রওনা হব।’
মৃদু মাথা দুলিয়ে জিপিএস রিসিভার দেখে নিয়ে রানা ও সোহেলের দিকে তাকাল হিনা। ‘আপনারা রেডি তো?’
নাইট ভিশন ডিযাইনের গগল্স চেক করল সোহেল। ওটা দেখাবে যে-কোনও আলো। রানা শুধু দেখবে কোথায় আছে তাপ। দ্বীপে পৌছে গগলস পরে কোথায় নামবে ঠিক করবে সোহেল।
কপালের গগলস দেখে নিয়ে হিনাকে বুড়ো আঙুল দেখাল সোহেল। শক্ত হাতে ধরেছে গাইড লাইন।
একই কাজ করল রানা। ‘খুলে দাও কেবল!
হুইলে একহাত রেখে ডানের লিভার টানল হিনা।
ক্ল্যাম্প খুলতেই রানা ও সোহেলের পেছনে বেলুনের মত ফুলে উঠল প্যারাসেইল। টানটান হতেই পায়ের নিচে মুরিং থেকে ছুটে গেল কেবল। পরক্ষণে ঝড়ের বেগে ওপরে উঠল ওরা। বোটের পেছনের ড্রাম থেকে বেরোচ্ছে কেবল। *
দু’ডানায় ভর করে সাঁই-সাঁই করে উঠছে ওরা। রানা দেখল, দূরে বৈদ্যুতিক আলোয় ভরা ঝলমলে নাগাসাকি শহর। সব পড়ে আছে অনেক পেছনে।
বারকয়েক সাধারণ কৌশল পরীক্ষা করল ওরা। চট করে সাড়া দিচ্ছে উইংবোর্ড। ওপরের প্যারাসেইলের সঙ্গে কাজ করছে নিখুঁতভাবে। রাতের আঁধারে শীতল হাওয়ায় ভর করে উড়ে চলেছে ওরা।
‘উড়ে যাওয়া কিছুই না,’ বাতাস ছাপিয়ে বলল সোহেল, ‘তবে কেবল খুলে দেয়ার পর এটাকে চালাতে হবে। ডানা পুরনো বাইপ্লেনের মত। প্যারাসেইল বাতাসে ভরা থাকলে যেতে পারব যে-কোনও দিকে। কিন্তু গতি কমলে ধুপ্ করে গিয়ে পড়ব সাগর বা মাটিতে।’
মাথার ওপরে প্যারাসেইল দেখল রানা। ওটা দেখতে বাঁকা চাঁদের মত। ‘পতন শুরু হলে ব্যবহার করবি ইমার্জেন্সি রিলিয। ডানা খসে পড়লে নামব প্যারাশুটিস্টের মত। দ্বীপে নামা যায় এমন কোনও জায়গা দেখলি?’
‘স্যাটেলাইট ইমেজ অনুযায়ী দ্বীপে আছে অন্তত চল্লিশটা বাড়ি,’ বলল সোহেল, ‘ছাত সব সমতল। মনে হয় না সমস্যা হবে নামতে। আরও কাছে গেলে নামার অ্যাংগেল বুঝে ঠিক করব কোথায় পায়ের ধুলো দেব।’
‘তোর নোংরা, ঘেমো, ধাবড়া পায়ের ধুলো লাগার পর আরও বিষাক্ত হয়ে উঠবে ওই দ্বীপ,’ মতামত দিল রানা।
চট্ করে মাথায় কিছু না আসায় উদাস হয়ে দ্বীপ দেখল সোহেল।
হাতের ব্যাণ্ডে আটকে রাখা রেডিয়োতে বলল রানা, ‘দ্বীপের দিকে চলো। চোখ রাখবে জিপিএস-এর ওপর। দু’মাইল দূরে থাকতে ঝাঁকি দেবে কেবলে। এরপর কেবল খুলে দ্বীপের দিকে যাব আমরা। তখন কেবল গুটিয়ে নিয়ে ফিরবে দ্বীপ আর নাগাসাকির মাঝের সাগরে।’
‘ঠিক আছে,’ ইয়ারবাডে জানাল হিনা। ‘গুড লাক!’
বহু নিচে বামে রানা দেখল ঢেউয়ের সাদা ফেনা।
ওদেরকে টেনে নিয়ে চলেছে পাওয়ারবোট।
পিছু নিয়ে কালো দ্বীপের দিকে উড়ে চলেছে রানা ও সোহেল। নিচে ঝিকমিক করছে রুপালি সাগর। গতি বাড়ালেও ক’মিনিট পর বাঁক নিয়ে অন্যদিকে চলল হিনা।
‘কেবলে ঝাঁকি দিয়েছে,’ সোহেলকে বলল রানা। নিচে ঠেলল লাল হ্যাণ্ডেল। মুহূর্তে খুলে গেল কেবলের প্রথম গিঁঠ। হ্যাণ্ডেলে দ্বিতীয় মোচড় দিতেই খট্ শব্দে খসে পড়ল কেবল। সাঁই করে ওপরে উঠল প্যারাসেইল, তবে তাতে কমে গেল এগোবার গতি।
স্লোবোর্ডারদের মত সামনে ঝুঁকল রানা ও সোহেল। আবারও স্বাভাবিক গতি পেল যন্ত্রহীন উড়োজাহাজ। পেছনে পড়ল হিনার বোট। চারপাশে শব্দ বলতে শোঁ-শোঁ হাওয়া। দপ-দপ করছে কানের পর্দা।
‘একপাশ থেকে দমকা হাওয়া,’ বলল সোহেল, ‘সরে যাচ্ছি দক্ষিণে।’
উইংবোর্ডে বামে ওজন চাপাতেই তাল মেলাল প্যারাশুট। যেন পায়ের তলা থেকে খসে পড়বে বোর্ড। তবে দক্ষতার সঙ্গে তৈরি নিচের দু’ডানা। সুন্দরভাবে তাল রাখল ওপরের প্যারাসেইল।
তিরিশ সেকেণ্ড বাতাস বুঝে নিয়ে সরাসরি দ্বীপ লক্ষ্য করে চলল সোহেল। আগে ব্যবহার করেছে উইংসুট বা গ্লাইডার। সেসব ছিল অতি দ্রুত, অথবা ধীর— কিন্তু এই জিনিস দারুণ মজার। ঘণ্টায় চল্লিশ মাইল বেগে উড়ছে ওরা মুক্ত পাখির মত।
‘যেন আকাশে সার্ফ করছি,’ বন্ধুর দিকে চেয়ে হাসল সোহেল।
মৃদু হাসল রানাও।
‘আজ রাতে প্রাণ হাতে নিয়ে দ্বীপ থেকে বেরোতে পারলে, আমার নতুন শখ হবে এটা নিয়ে আকাশে ঘুরে বেড়ানো, বলল সোহেল।
কবজির টাইমার ও আল্টিমিটার দেখল রানা। ‘আট শত ফুট নিচে সাগর, একমিনিট পর পৌছুব দ্বীপের ওপর।’
যত কাছে যাচ্ছে, কালো আর বিশাল হয়ে উঠছে দ্বীপ। উঠে আসছে ওদের দিকে। কী যেন ভয়ানক কিছু আছে ওখানে। বাইরের দেয়ালে আছড়ে পড়ছে সাগরের ঢেউ। সাদা ফেনা দেখল রানা। আবছা আলোয় পরিত্যক্ত সব বাড়ি যেন প্রেতাত্মার দুর্গ।
‘চশমা পরে নে,’ বলল রানা। নিজে চোখে আটকে নিল ইনফ্রারেড লেন্স। একই কাজ করল সোহেল। ব্যবহার করছে নাইট ভিশন গগলস। হঠাৎ ওর মনে হলো দ্বীপ ভরে গেছে সবুজ-ধূসর আলোয়। পরিষ্কার দেখল বাড়ির কোনা। মাঝে সরু সব গলি। এখানে ওখানে উঁচু জঞ্জাল।
উনিশ শ’ চুয়াত্তর সালে বন্ধ হয়েছে খনি ও বসতি। এরপর দ্বীপের ওপর দিয়ে গেছে কিছু প্রচণ্ড টাইফুন ও সাধারণ শত শত ঝড়।
ওপর থেকে দেখে মনে হচ্ছে, নিষ্ঠুর প্রকৃতি ও বহমান কালের অত্যাচারে ধসে পড়ছে পুরনো সব দালান। একটা জানালাতে নেই কবাট। যেখানে সেখানে গজিয়ে উঠেছে ঝোপঝাড়। থমথম করছে চারপাশ। নির্জন ও পরিত্যক্ত।
‘একপাশ থেকে বাতাস থাকলেও ঠিক দিকেই যাচ্ছি,’ বলল সোহেল। ‘প্রথম সারির বাড়ি পার হয়ে নামব দ্বিতীয় সারির কোনও বাড়ির ছাতে। সহজেই যেতে পারব দ্বীপের মাঝখানে।’
‘ছাতের হাল বুঝেছিস?’
‘এখনও না,’ বামে ঝুঁকল সোহেল, ‘সে তুলনায় এখনও অনেক দূরে।
দ্বীপের প্রায় কিছুই দেখেনি রানা। চারপাশের সাগরের চেয়ে শীতল কংক্রিট, ফলে অন্ধকারে দ্বীপটাকে মনে হচ্ছে এবড়োখেবড়ো ধূসর গর্তের মত। এখানে ওখানে ছোট কিছু বিন্দু। ওখানে তাপ আছে। তবে আকার দেখে রানা ধারণা করল, ওগুলো ইঁদুর বা পাখি।
‘হলদে ইঁটের রাস্তা পেলি?’ জানতে চাইল সোহেল।
‘না।’ স্ক্যান করছে রানা। অসংখ্য বাড়ির মাঝে দেখা যাচ্ছে না জমি। ‘সামান্য ডানে সর, পেছনে রাখবি হাওয়া। মাঝের সব গলি দেখতে চাই।’
‘কাছে পৌছে গেছি বলে বেশি সময় পাবি না,’ বলল সোহেল।
ডানে উইংবোর্ডে ওজন চাপাতেই রাজহংসের অলস ভঙ্গিতে বাঁক নিল ওরা। অসংখ্য বাড়ির মাঝের গলি দেখল রানা। কোথাও কোথাও আবছা আলো। ওসব জায়গার কথা মনে রাখল ও। ‘আরও একটু এগোতে পারবি?’
‘সময় পাবি দশ সেকেণ্ড,’ বলল সোহেল। ‘এরপর ঠিক করতে হবে দিক।’ মনে মনে ক্ষণ গুনছে। কোনও নড়াচড়া দেখতে নিচে চেয়ে আছে রানা।
‘সময় শেষ, বলল সোহেল। ‘এবার বামে ওজন দে।’ একইসময়ে বামে ঝুঁকে কন্ট্রোল কেবল টান দিল ওরা। গতি কমিয়ে তীক্ষ্ণ বাঁক নিল দু’পাখার গ্লাইডার। ‘সোজা হ।’
গতি বেড়ে যাওয়ায় পেছনে হারিয়ে গেল সাগর। হঠাৎ যেন ওদের বুকের কাছে উঠে এল জীর্ণ সব দালান। ডানার সামান্য নিচে ছাত।
‘গতি অনেক বেশি,’ সতর্ক করল রানা।
প্যারাশুট টেনে নেয়ায় ওপরে উঠে গতি কমাল গ্লাইডার। তবে সামলে নিতেই আবারও শুরু হলো পতন। সোহেল বুঝল, ওরা নামতে পারবে না বাছাই করা ল্যাণ্ডিং যোনে। হতাশ হয়ে বলল, ‘যাহ্, বাড়িঘর পার হয়ে আছড়ে পড়ব পাহাড়ের কাঁধে। বামে গেলে নামব দ্বীপের খোলা জায়গায়।’
পাথুরে প্রাচীরের মত পাহাড়ি চূড়া ও সবচেয়ে উঁচু বাড়ির মাঝের ফাঁকা অংশ লক্ষ্য করে চলেছে উইংবোর্ড। অবাক হয়ে সোহেল দেখল, এখনও থার্মাল ইমেজিং গগলস পরে তাপ খুঁজছে রানা। এক সেকেণ্ড পর সতর্ক করল সোহেল, ‘ডানা সোজা কর!’
একইসঙ্গে ঝুঁকল দু’বন্ধু। পাহাড়ের উঁচু চূড়া আর বামের বাড়ির মাঝে ঢুকবে গ্লাইডার। জায়গাটা গলির মত, ওদের দু’দিকে থাকবে বড়জোর দশ ফুট। কিন্তু হঠাৎ কেবল-এ হ্যাঁচকা টান দিল রানা, ‘ফিরে চল!’
‘ফিরব! কেন?’
‘বামে বাঁক নে!’ উইংবোর্ডে কাত হলো রানা। কথাটা মেনে নিজেও তাই করল সোহেল। এক শ’ আশি ডিগ্রি বাঁক নেয়ায় কমল গতি। পরক্ষণে নতুন গন্তব্য লক্ষ্য করে চলল গ্লাইডার।
একটা বাড়ির ছাতের পাশে জন্মেছে মাঝারি গাছ। ওটার ওপরদিকে ঘষা খেয়ে বেরিয়ে গেল উইংবোর্ড। নামার মত জায়গার জন্যে সামনে তাকাল সোহেল। সরাসরি দু’ শ’ ফুট দূরে চওড়া এক ছাত। কিন্তু ওই পর্যন্ত যেতে পারবে বলে মনে হলো না ওর।
‘আমার দিকে ডানে ঝুঁকে পড়!’ তাড়া দিল সোহেল।
কাত হয়ে ডানে যাওয়ায় আরও কমল উচ্চতা। আগের বাড়ির পাশের এক দালানের ছাতে ধুপ্ করে নামল ওরা। তাতে থামল না গতি। টেনিস বলের মত ড্রপ খেতে খেতে চলেছে ছাতের শেষপ্রান্ত লক্ষ্য করে। দশতলা থেকে মাটিতে পড়লে স্রেফ খুন হবে ওরা। কিন্তু পাখার ডানদিক বেধে গেল সরু এক ভেণ্ট-এ। ছিটকে ছাতে পড়ে শরীর গড়িয়ে দিল সোহেল। কোথায় যেন পড়ল নাইট ভিশন গগলস। শরীর স্থির হতেই প্রিয় বন্ধু কোথায় দেখতে মুখ তুলে তাকাল ও।
একটু দূরেই উইংবোর্ড। জোর হাওয়ায় আবার উঠতে চাইছে আকাশে। দু’হাতে দড়িদড়া ও সেইল গোছাচ্ছে রানা। মেঝে ছেড়ে দৌড়ে গিয়ে প্যারাসেইলের অন্যদিক চেপে ধরল সোহেল। কাপড়ে পা চাপিয়ে দেয়ায় বেরিয়ে গেল ভেতরের বাতাস। এখন আর ঘুড়ির মত উড়বে না।
হঠাৎ কেন এত বিপজ্জনক কাণ্ড করেছে রানা, বুঝে গেল সোহেল। মাঝের পাহাড়ের পাশ থেকে আকাশে উঠল কপ্টার। বজ্রপাতের শব্দ তুলে মাথার ওপর দিয়ে গেল ওটা। এখনও কোনও বাতি নেই।
‘পাহাড়ের পাশেই কপ্টারের ইঞ্জিনের তাপ দেখে ওদিকে যাইনি,’ জানাল রানা, ‘আরেকটু হলে রোটরে কেটে কিমা হতাম।’
‘দেখেছে কি না কে জানে, যান্ত্রিক ফড়িঙের দিকে তাকাল সোহেল। নাগাসাকির দিকে চলেছে ওটা। ‘আমার ব্যাকআপ ল্যাণ্ডিং যোন ছিল ওদের হেলিপ্যাড। ওখানেই বসে ছিল। আমি পাইলট হলে দু’পাশের সরু জায়গার দিকে খেয়াল দিতাম। ভাবতামই না আকাশ থেকে নামবে কিছু।
‘দেখলে ঘুরে আসত,’ বলল রানা। ‘আয়, গুছিয়ে রাখতে হবে প্যারাশুট।’
প্যারাসেইল ভাঁজ করে গাইড ওআয়্যার দিয়ে পেঁচিয়ে রাখল ওরা। উইংবোর্ড ওপরে তুলল সোহেল, পালের মত কাপড় ওটার নিচে গুঁজল রানা।
বহু দূরে গিয়ে বাতি জ্বেলে শহরের দিকে চলেছে হেলিকপ্টার।
‘মনে হয় না দেখেছে,’ বলল সোহেল, ‘কিন্তু কথা হচ্ছে, সঙ্গে পুলিশ সুপার হিমুরাকে নিয়ে যায়নি তো?’
মাথা নাড়ল রানা। ‘এখানে এনে আবারও অন্য কোথাও নেয়া অর্থহীন। ওরা এসেছিল দলের লোক নামাতে। কারও চোখে পড়বে, সে ভয়ে সময় নষ্ট করেনি পাইলট। ধরে নে, এ দ্বীপেই আছেন হিমুরা। আর সঙ্গে পাবি তোর প্রিয় কমোডো- দোস্ত ওরে চিচিওয়াকে।’
‘শয়তানটা মরুক কমোডো ড্রাগনের গরম পেটে গিয়ে,’ বিড়বিড় করল সোহেল।