1 of 2

মহাপ্লাবন – ৪৩

তেতাল্লিশ

গভীর মনোযোগে মানচিত্র দেখছে রানা। বুঝতে চাইছে ঠিক কোথায় গেছে লো হুয়াং লিটনের হেলিকপ্টার।

‘ওটা গেছে এদিক দিয়ে,’ মাউস দিয়ে স্ক্রিনে রেখা তৈরি করল সোহেল। ‘ওই বাড়িটা টপকে বন্দর পার হয়ে সাগরে।’

যে রেখা তৈরি করেছে, সেটা গেছে দক্ষিণ-পশ্চিমে।

‘হয়তো চিনের ভূখণ্ডে নিয়ে গেছে অফিসার হিমুরাকে, ‘ বলল হিনা।

‘তা হলে এত ঘুরে যাবে কেন?’ মাথা নাড়ল রানা। ‘কাছের শহর শাংহাই। সেটা আছে পশ্চিমে।’

‘অনেক বেশি দূর,’ বলল সোহেল, ‘ওই হেলিকপ্টার শর্ট রেঞ্জের। শাংহাই কমপক্ষে পাঁচ শ’ মাইল দূরে। চিনের মূল ভূখণ্ডে পৌঁছুতে পারবে না। অন্তত একবারে না।’

‘রিফিউয়েলিং করলে?’ জানতে চাইল রানা।

সোজা হয়ে বসল সোহেল। ‘মাঝ আকাশে রিফিউয়েলিং করবে বলে মনে হয় না। হয়তো নামবে জাহাজে।’

‘হতে পারে,’ বলল রানা। ‘দেখতে হবে শিপ ট্র্যাকার।’

প্রোগ্রামে ক্লিক দিতেই স্ক্রিনে ফুটল নাগাসাকি বন্দর থেকে চারপাশের এক শ’ মাইলের সব জাহাজের আইকন। চাইলে আরও কয়েক শ’ মাইল মানচিত্র দেখতে পাবে ওরা। কিন্তু তাতে সুবিধা হবে বলে মনে হলো না ওদের।

‘চারপাশে শত শত জাহাজ,’ বলল হিনা।

‘আশপাশে হুয়াঙের কোনও ইয়ট আছে?’ জানতে চাইল সোহেল।

অনলাইনে দেখল রানা। ‘তিনটে।’

‘ওসব ইয়ট থেকে খুঁজতে শুরু করতে পারি।’

হুয়াঙের ইয়টের আইডেন্টিফিকেশন নম্বর সার্চ উইণ্ডোতে দিয়ে লোকেশন চাইল রানা। ফুটে উঠল পৃথিবীর মানচিত্র। ‘একটা আছে মোনাকোয়। আরেকটা শাংহাই বন্দরে। তৃতীয়টা আপগ্রেড হচ্ছে ইতালিতে।’

‘ইয়ট বাদ,’ বলল সোহেল।

আগের স্ক্রিনে ফিরল রানা। ব্যস্ত হয়ে টাইপ করল নতুন সার্চ এরিয়া। এবার বাদ দিয়েছে পাঁচ হাজার টনি জাহাজের চেয়ে ছোটগুলোকে। ওদের চাই এমন জাহাজ, যেটায় নামবে কপ্টার। ‘এক শ’ মাইলের ভেতর রয়েছে পঞ্চাশটা জাহাজ। ওখানে নামতে পারে হেলিকপ্টার।’

হতাশ হলো সোহেল। ‘আমরা তো আর পঞ্চাশটা জাহাজ খুঁজতে পারব না।’

‘জাতীয়তা দেখে জাহাজ বাদ দেব,’ নতুন করে টাইপ করছে রানা। ‘আমেরিকান বা ইউরোপিয়ান জাহাজে নামবে না হুয়াঙের কপ্টার। তার মানে, হিসেবে থাকছে চব্বিশটা।’

‘উপকূলের আশপাশে আছে কয়টা?’ জানতে চাইল সোহেল।

কি-বোর্ড টিপে সোহেলের দেখানো রেখা অনুসরণ করল রানা। ক’সেকেণ্ড পর বিস্মিত হয়ে বলল, ‘একটাও না। সবচেয়ে কাছের জাহাজ উত্তরদিকে পনেরো মাইল দূরে। সোজা আসছে নাগাসাকি বন্দরের দিকে।’

‘হয়তো কোর্স পাল্টেছে কপ্টারের পাইলট,’ বলল হিনা। ‘সোহেল বলেছেন, ওরা বাতি নিভিয়ে দিয়েছিল।’

বন্ধুর দিকে তাকাল রানা। ‘অবাক লেগেছে তোর?’

‘না। চোখের আড়ালে সরতে চেয়েছে। একবার বাতি নিভিয়ে দেয়ার পর যে-কোনও দিকে যেতে পারে।’

‘ওরা তো আর ভাবেনি তুই পিছু নিবি, তাই না?’ বলল রানা।

মাথা দোলাল সোহেল। ‘জানার কথা নয়। অথচ, নিভিয়ে দিয়েছিল সব বাতি।’

‘কতটা ওপর দিয়ে যাচ্ছিল?’ জানতে চাইল রানা।

‘যথেষ্ট নিচ দিয়ে,’ বলল সোহেল, ‘ধর, একহাজার ফুট।’

‘আরও ওপরে উঠছিল?’

‘মনে হয় না। উচ্চতা সমান ছিল।’

ম্যাপের দিকে ফিরল রানা।

‘কিছু ভাবছিস?’ জানতে চাইল সোহেল।

মৃদু মাথা দোলাল রানা। এগোল ম্যাপে আগের কোর্স ধরে। ‘আমার ধারণা, ওরা এড়াতে চেয়েছে নাগাসাকির রেইডার। জানা ছিল না পিছু নিয়েছিস তুই। ওরা আসলে চেয়েছে সবার চোখ থেকে সরে যেতে। যাতে ভূখণ্ড থেকে দেখা না যায় কোথায় চলেছে তারা।’

এবার জাহাজ বাদ দিয়ে দ্বীপ খুঁজতে লাগল রানা। জাপানের উপকূলের কাছে দ্বীপের অভাব নেই।

‘গানকানজিমা,’ বলল হিনা।

ওর দিকে তাকাল রানা ও সোহেল।

‘ব্যাটলশিপ আইল্যাণ্ড,’ ব্যাখ্যা দিল হিনা, ‘ওটার আসল নাম হাশিমা। উপকূল থেকে কয়েক মাইল দূরে। ওই দ্বীপে আগে ছিল কয়লার খনি। এক হাজারেরও বেশি মজুর কাজ করত ওখানে। থাকত পরিবারসহ। তাই তাদের জন্যে তৈরি করা হয়েছিল কংক্রিটের বাড়ি আর সি-ওয়াল। ওই দ্বীপ যেন পাহারা দিচ্ছে নাগাসাকি শহরের মুখে। তাই নাম হয়েছে ব্যাটলশিপ আইল্যাণ্ড।

কমপিউটার স্ক্রিনে দ্বীপটা দেখাল হিনা। পেনিনসুলা আছে বলে উপকূল থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরে ওটা। সতেরো মাইল দূরে লিটনের ফ্যাক্টরি।

হাশিমার নাম শুনেছে রানা। পরিত্যক্ত হয়েছে বহু বছর আগেই। ‘ওটা না হয়ে উঠেছিল টুরিস্ট স্পট?’

‘ছিল,’ বলল হিনা। ‘একবছর আগেও হাজার হাজার টুরিস্ট যেত। তারপর জানা গেল, মাটি আর বাড়িগুলোয় আছে প্রচুর পরিমাণে অ্যাসবেস্টস, আর্সেনিক আর নানান ধরনের বিষ। শরীরের জন্যে অত্যন্ত ক্ষতিকর।’

ল্যাপটপ কমপিউটার ঘেঁটে জাপানের রহস্যময় ক’টি দ্বীপ নিয়ে একটি আর্টিকেল খুঁজে বের করেছে রানা। ওখান থেকে পড়ে বলল, ‘এগারো মাস আগে ওই দ্বীপে যাওয়া নিষিদ্ধ করে ফেডারেল গভর্নমেন্ট। একইসময়ে নাগাসাকিতে ফ্যাক্টরি করে হুয়াং। এ-দুটো ব্যাপার কাকতালীয় বলে মনে হচ্ছে না।’

‘আমিও একমত,’ বলল সোহেল।

ওর দেখানো ফ্লাইট পাথ অনুসরণ করল রানা। সরাসরি গেছে হাশিমা দ্বীপের ওপর দিয়ে। ‘আশপাশে আরও কিছু দ্বীপ আছে। টাকাশিমা আর নাকানোশিমা।’

‘টাকাশিমায় জনবসতি আছে,’ বলল হিনা, ‘জাদুঘরও আছে। এ ছাড়া, আছে ছোট হোটেল।’

‘সবার অগোচরে নামতে পারবে না হেলিকপ্টার,’ বলল সোহেল।

‘আর নাকানোশিমা আসলে ছোট দু’তিনটে পাথর ছাড়া কিছুই নয়,’ বলল হিনা। ‘হেলিকপ্টার নামবে না।’

ব্যাটলশিপ আইল্যাণ্ডের স্যাটেলাইট ইমেজ দেখল রানা। ‘ওরা বোধহয় ওখানেই গেছে।’

‘জনশূন্য বলে ওখানে ঘাঁটি গেড়েছে হুয়াং,’ বলল সোহেল, ‘কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ওখানে কেন? নাগাসাকিতেই তো আছে তার বিশাল ফ্যাক্টরি।’

‘গোপন করতে চায় কিছু,’ বলল রানা, ‘জাপানিয সেফটি ইন্সপেশন হবে, সে ঝুঁকি নেয়নি।’

‘আমরা কথা বলতে পারি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে,’ বলল হিনা।

না-সূচক মাথা দোলাল রানা। ‘লাভ হবে না। ওপর মহলে বন্ধু আছে লিটনের। হয়তো তাদেরকে ব্যবহার করেই দখল করেছে ওই দ্বীপ। কর্তৃপক্ষকে কিছু বলতে গেলে খুন হবেন উবোন হিমুরা। তাঁকে বাঁচাতে হলে আমাদেরকে যেতে হবে ওখানে। হাতে সময় নেই।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *