সাঁইত্রিশ
লো হুয়াং লিটনের গ্যারাজে দ্রুতগতি স্পোর্টকার দেখবে ভেবেছে রানা। সেসব গাড়ি হবে ঢাকা সর্বস্ব গাড়ি। থাকবে না তাতে বাড়তি ওজন। কিন্তু গ্যারাজে ঢুকে অবাক হলো। পাশাপাশি রাখা তিনটে দারুণ লোভনীয় গাড়ি।
‘এগুলো টয়োটা কোম্পানির,’ বলল লো হুয়াং, ‘তবে চাইলেও ডিলারের কাছ থেকে কিনতে পারবেন না।’
‘অন্তত কয়েক লাখ ডলার একেকটার দাম,’ রানার কানের কাছে বলল হিনা।
‘গত বছর লে ম্যান্সে নামানো হয় এটা,’ ডানের গাড়িটা দেখাল লো হুয়াং। ‘টুইন-টার্বোচার্জড্ ভি সিক্স, নয় শত আটষট্টি হর্সপাওয়ার। তবে আমাদের ট্র্যাকে রেসের জন্যে হ্রাস করা হয়েছে শক্তি। এখন আছে সাত শ’ হর্সপাওয়ার।’
‘যথেষ্ট।’ কমলা-সাদা গাড়ির পাশে থামল রানা। বুঝে গেছে, ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প ওটা। সামনে থেকে দেখলে মনে হবে খেপা চিতা। চোখা নাকে মিশেছে দু’পাশের কার্বন ফাইবার প্যানেলের ফেণ্ডার। নিচে মোটা পারফর্মেন্স টায়ার। গাড়ির মাঝে অশ্রু বিন্দু আকৃতির ককপিট। সামনের ঈষৎ বাঁকা উইণ্ডশিল্ড দেখার মত। পেছনে বিশাল উইং নিয়ে তিনটে খাড়া ফিন। প্রচণ্ড বেগে যাওয়ার সময় স্থির রাখবে গাড়িটাকে। নির্দ্বিধায় বলল রানা, ‘অটোমোবাইল সম্পর্কে সামান্য জ্ঞান আছে, নইলে ভাবতাম এই জিনিস উড়তে পারে।’
‘ঘণ্টায় শতখানেক মাইল বেগে অ্যাক্সিডেন্ট হলে সত্যিই উড়াল দেবে,’ সতর্ক করল লো হুয়াং লিটন।
‘আমি সতর্ক থাকব,’ কথা দিল রানা।
আধঘণ্টা পর ড্রাইভারের সিটে বসে সিট বেল্ট আটকে নিল ও। পরনে ফ্লেম-রিটাডেন্ট সুট ও ফাইভ-পয়েন্ট হার্নেস। মাথায় বসিয়ে নিয়েছে হেলমেট।
রেসের জন্যে তৈরি।
ককপিট ছোট ও সরু, আরেকটু বড় হলে ভাল লাগত রানার। চারপাশ থেকে ওকে প্রায় ঘিরে রেখেছে বিলেটেড অ্যালিউমিনিয়ম ও প্যাডেড রোল কেইজ। বামে কয়েকটি টগল সুইচ। চাইলে এদিক ওদিক সরানো যায় স্টিয়ারিং হুইল। অ্যাক্সেলারেটরে চাপ দেয়ায় টুইন-টার্বো ভি সিক্স ইঞ্জিন থরথর করে কাঁপিয়ে দিল গাড়িটাকে।
লো হুয়াঙের সহকারী রেডি করছে অটোমেটেড রেস কার। এ সুযোগে নিজের গাড়ির ভেতর দিক দেখল রানা। ফুটওয়েলে পাশাপাশি প্যাডেল। বিশেষ ম্যানুভারের সময় চাপ দিতে পারবে এক পায়েই। তবে দুর্ঘটনাবশত পা রাখতে চায় না ওখানে। হাতের কাছেই প্যাডল শিফটার। সুইচ টিপতেই খোয়া দিয়ে তৈরি ট্র্যাকে গিয়ে পড়ল চারটে শক্তিশালী হেডলাইটের উজ্জ্বল সাদা আলো। পরিষ্কার দেখা গেল রেসের জন্যে কমলা ও সাদা দাগ।
‘ট্র্যাক ভাল করেই চেনে রোবট,’ বলল লো হুয়াং, ‘সুবিধা নিতে চাই না, তাই আপনাকে পাঁচ ল্যাপ দিতে দেব। বুঝে নেবেন কেমন ট্র্যাক। রওনা হন। অভ্যস্ত হয়ে উঠুন গাড়িটার সঙ্গে। গিয়ে আছড়ে পড়বেন না দেয়াল বা নাগাসাকি উপসাগরে। পঞ্চম বাঁক অ্যাক্সিডেন্টের জন্যে কুখ্যাত। ওপরে উঠে বাঁক নিয়েছে রাস্তা। যদি বেড়ার ওপর গিয়ে পড়েন, উল্টে পড়বে গাড়ি। মারাও যেতে পারেন।’
গাড়ির ক্যাবে হাত ভরে দুটো সুইচ টিপল লো হুয়াং। ‘এবার টেলিমেট্রি পাবেন। আর এই সুইচটা ন্যাভিগেশন গাইডেন্স অ্যালার্টের।’
‘গাইডেন্স?’ অবাক হয়েছে রানা।
‘আপনার ফোনের মতই, তবে আরও নিখুঁত,’ বলল বিলিয়নেয়ার। ‘আগেই বলে দেবে সামনের বাঁক কতটা তীক্ষ্ণ। যাতে চমকে যেতে না হয়। আপনার মনে হবে পাশে বসে সাহায্য করছে ন্যাভিগেটর।’
‘নতুন গাড়িতে যথেষ্ট বিরক্ত করে এই জিনিস,’ বলল রানা। ‘তবে ট্র্যাকে হয়তো কাজে আসবে।’
পিছিয়ে গেল লো হুয়াং লিটন। সামনে বেড়ে গাড়ির কার্বন ফাইবার ডোর বন্ধ করল এক মেকানিক, পিছিয়ে গিয়ে দেখাল বুড়ো আঙুল। চারপাশ দেখার জন্যে স্বাভাবিক গতি তুলে প্রথম দুটো চক্কর কাটল রানা। প্রতিবার বাঁকের আগেই সতর্ক করল ন্যাভিগেটর। স্টিয়ারিং হুইল থেকেও এল সঠিক ফিডব্যাক।
তৃতীয় চক্করে গতি তুলল ঘণ্টায় এক শ’ বিশ মাইল। সাগরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় নাগাসাকি উপসাগরে দেখল ভাসমান জাহাজের মিটমিটে আলো। গতি কমিয়ে ঘুরল পঞ্চম বাঁক। বামে ওপরে গেছে রাস্তা। তুমুল বেগে যাওয়ার সময় মনে হবে উড়ে গিয়ে গাড়ি পড়বে সাগরে। চতুর্থ ও পঞ্চম ল্যাপে গতি আরও তুলল রানা। একটু পর ফিরে এসে থামল পিট-এ। সত্যিই এবার তৈরি রেসের জন্যে।
লো হুয়াঙের মেকানিকরা প্রস্তুত রেখেছে হলদে গাড়ি। ওটার তিরিশ ফুট দূরে নিজের গাড়ি রাখল রানা। দুই গাড়ির গায়ে অসংখ্য এনসিআর লোগো। তবে রোবটের গাড়িতে রয়েছে কয়েকটা বাড়তি অ্যান্টেনা।
রাতের পরিবেশ শীতল। তবুও ককপিটে ঘামছে বলে গাড়ির দরজা খুলল রানা। মাথা থেকে নামাল হেলমেট।
ওর পাশে পৌঁছে গেল হিনা। ‘আপনি কি আমার হিরো হওয়ার জন্যে এতবড় ঝুঁকি নিচ্ছেন?’
‘তোমার হিরো?’ মাথা নাড়ল রানা।
‘তা হলে কি টেকনোলজিকে হারাবার জন্যে? প্রমাণ করবেন যে মানুষই সেরা?’
মৃদু হাসল রানা। ‘তা নয়। আসলে চাইছি লো হুয়াংকে অস্বস্তিতে ফেলতে। একটু পর থাকব ট্র্যাকে। চারপাশে চোখ রেখো তুমি।’
ঝুঁকে রানার গালে চুমু দিল হিনা। ‘সৌভাগ্যের জন্যে।
এমনসময় গর্জে উঠল রোবটের গাড়ি। আবার রানার পাশে ফিরল লো হুয়াং লিটন। ‘আপনি তৈরি তো?’
‘হ্যাঁ, তৈরি।’
‘গুড, বেশিক্ষণ রেস হবে না, সাগর থেকে আসছে ঝড়,’ বলল বিলিয়নেয়ার, ‘আমরা চাই না গাড়িদুটো বৃষ্টিতে ভিজুক।’
মাথা দোলাল রানা।
‘ঘুরে আসুন,’ বলল লো হুয়াং, ‘ফিনিশিং লাইন পেরোলে ধরে নেয়া হবে প্রথম গাড়ি জিতেছে।’
আবারও হেলমেট পরে স্ট্র্যাপ টাইট করে নিল রানা। দু’গাড়ি দাঁড়াল নিয়মমত ফর্মেশনে। সরু লেনে যাতে সংঘর্ষ না হয় সেজন্যে তিরিশ ফুট সামনে রানার গাড়ি।
লাল বাতি জ্বলে উঠল ট্র্যাকের পাশের পোলে। তিন সেকেণ্ড পর ওই আলো হয়ে উঠল হলদে। তিন সেকেণ্ড পর বাতি হয়ে গেল সবুজ।
ছিটকে রওনা হলো রানার গাড়ি। দ্রুত বাড়ছে বেগ। আগের ল্যাপগুলোর চেয়ে বেশি গতি তুলছে রানা। ঝড়ের বেগে পেরিয়ে গেল প্রথম বাঁক।
‘ডানদিকে সত্তর ফুট দূরে বাঁক,’ ঘোষণা দিল ন্যাভিগেশন সিস্টেম।
কড়া ব্রেক করতেই রানা টের পেল, ট্র্যাক খামচে ধরেছে চাকার রাবার। সামনে ছিটকে যেতে চাইল রানা, তবে নিজ কাজ ঠিকভাবেই করল রেসিং হার্নেসের স্ট্র্যাপ। স্টিয়ারিং হুইল নিয়ে ধস্তাধস্তি করছে রানা। পিছলে সরে যাচ্ছে সাদা ও কমলা বর্ডার থেকে। নতুন করে গতি তুলে বামে বাঁক নিল ও। হঠাৎ এত বেশি গতি তুলল গাড়িটা, সিটে প্রায় গেঁথে গেল রানা। নানান দেশের ফাইটার বিমান চালাবার সময় এ অনুভূতি হয়েছে ওর।
‘সামনে সরু বাঁক,’ সতর্ক করল ন্যাভিগেটর।
কড়া ব্রেক করতেই ঝট্ করে কমে এল গতি। স্টিয়ারিং হুইল ঘুরিয়ে বামে বাঁক নিল রানা। ট্র্যাকের সবচেয়ে ধীর অংশ এটা। কিছু দূর যাওয়ার পর আরেকটা বাঁক।
‘বামে চল্লিশ ফুট দূরে বাঁক।’
সহজেই চাকা পিছলে যেতে দিয়ে ওই বাঁক পেরিয়ে গেল রানা, নতুন করে তুলল গতি।
‘ডানে ত্রিশ ফুট দূরে বাঁক।’
প্র্যাকটিস ল্যাপের সময় ন্যাভিগেটরকে বিরক্তিকর মনে হয়েছে রানার। মনোযোগ সরে যায় ওটার জন্যে। কিন্তু এখন রিফ্লেক্সের শেষ সীমায় পৌছে বুঝল, ওটা কাজের। ঠিক সময়ে সতর্ক করছে যন্ত্রটা। ফলে ওর চোখ থাকছে সামনের বাঁকে। তৈরি থাকছে মন।
বামে চতুর্থ বাঁক নিয়েই গিয়ার ফেলে তুমুল গতি তুলল রানা। সামনে দীর্ঘ ট্র্যাক গেছে টিলার ওপরে। ঝড়ের বেগে খালি অবযার্ভেশন ব্রিজের তলা দিয়ে বেরিয়ে গেল ও। এরপর সোজা রাস্তা গেছে পঞ্চম বাঁকের দিকে।
‘বামে সত্তর ফুট দূরে ওপরে উঠে বাঁক।’
তীব্র ব্রেক কষে বাঁক নিল রানা। রক্ত উঠে এল মাথায়। গরম লাগছে গাল। আগের ল্যাপের মতই এবারও ওর মনে হলো পিছলে চলেছে বেড়ার দিকে। ওটা ছিঁড়ে বেরোলে মাধ্যাকর্ষণের টানে বহু নিচের উপসাগরে পড়বে গাড়ি। বাঁকের ভেতরের দিকে চোখ রেখে বাঁক নিতে চাইছে ও।
ল্যাপের অবশিষ্ট অংশ ঝামেলা ছাড়াই পেরোল। পেছনে পড়ল স্টার্ট/ফিনিশ লাইন। নয় সেকেণ্ড পেছনে পড়েছে রোবট চালিত গাড়ি।
‘এক ল্যাপ গেল, বাকি চারটে,’ বিড়বিড় করল রানা।
.
পিট এরিয়ার উঁচু ভিউয়িং স্ট্যাণ্ড থেকে ট্র্যাকে দশ মিলিয়ন ডলারের রোবট চালিত গাড়ি দেখছে লো হুয়াং লিটন। রানার গাড়ির পিছু নিয়ে ছুটছে ওটা। দুই গাড়ি দ্বিতীয় ল্যাপ ঘুরে আসতেই গম্ভীর হলো বিলিয়নেয়ার। এখন দশ সেকেণ্ড এগিয়ে আছে মাসুদ রানা।
চিফ ইঞ্জিনিয়ার সাবেলার দিকে তাকাল লো হুয়াং। ‘আপনার গাড়িতে বোধহয় সমস্যা আছে। মাসুদ রানা এখনও আগে কেন?’
‘গাড়িতে সমস্যা নেই,’ জবাবে বলল সাবেলা। ‘পাঁচ ল্যাপ ছুটে গাড়ির চাকা গরম করে নেয়ার সুযোগ পেয়েছে মাসুদ রানা। আমাদের রেসিং কার ছুটছে ঠাণ্ডা টায়ারে ভর করে। বাঁকে ঘোরার সময় কম গ্রিপ পাচ্ছে চাকা, তাই বাধ্য হয়ে কমপিউটার কমিয়ে দিচ্ছে গতি। তবে তৃতীয় ল্যাপের পর সমান সুযোগ পাব আমরা। চতুর্থ ল্যাপে লোকটাকে পাশ কাটিয়ে যাবে আমাদের গাড়ি। আর রেস শেষ হওয়ার সময় এগিয়ে থাকবে অন্তত বিশ সেকেণ্ড। গো হারা হারবে মাসুদ রানা।’
‘আপনার কথা ঠিক হলেই ভাল,’ বলল লো হুয়াং। ‘আমি বিব্রত হতে পছন্দ করি না। যাতে হারতে না হয়, এখনই অফ করে দিন সেফটি প্রোটোকল।’
কৌতূহলী চোখে বসকে দেখলেও নির্দেশ পালন করল চিফ ইঞ্জিনিয়ার। এবার সেফটি অপারেটিং প্যারামিটার পাত্তা না দিয়ে যে-কোনও মূল্যে জিততে চাইবে রোবটিক কার।